গলুইতে মূল বৈঠা হাঁকাচ্ছে হিলতো। হঠাৎ মাথা উঁচু করে গান ধরল সে। কর্কশ কিন্তু শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। যুদ্ধের ডামাডোল ছাপিয়ে লোকদের নির্দেশ দেয় ওরই কণ্ঠস্বর। নীরব নদীর ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল তার গানের সুর:
ভয়াল দেবী হাগ-এন-সা-কে প্রণাম, অনন্ত কাল অবধি যার আয়ু।
প্রথম পাইলনের রক্ষকতাকে জানাই প্রণাম।
পৃথিবীর একেবারে গভীরে তোমার বাস;
প্রতিদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে মরণ ঘটে তোমার।
ভোরে আবার জীবিত হয়ে ওঠো। রোজ তোমার নতুন করে পাওয়া
তারুণ্য নিয়ে উদিত হও লোনাসের ফলের মতো।
তাইতা শব্দের ক্ষমতা রাখেন;
তাকে প্রথম পাইলন অতিক্রম করতে দাও!
এটা মৃতের গীতিকা-এর একটা অধ্যায়, এক রাজার নামে বিলাপ। সাথে সাথে গোটা দল সুর তুলে নিল, বাকি অংশ গাইল:
তাকে সেখানেই যেতে দাও যেখানে আমরা যেতে পারব না।
অন্ধকার জগতের রহস্য জানার সুযোগ দাও তাঁকে।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হোরাসের প্রাজ্ঞ সাপে পরিণত হয়েছে তিনি।
পরের পঙক্তি গাইল হিলতো:
জগতের ধ্বংসকারী সেথকে প্রণাম;
আত্মার সর্বশক্তিমানকে জানাই প্রণাম, ভয়াল ভীতি জাগিয়ে তোলা ঐশ্বরিক আত্মা।
তাইতার আত্মাকে দ্বিতীয় পাইলন অতিক্রম করতে দাও।
শক্তির শব্দের অধিকারী তিনি।
তাইতাকে অসিরিসের শাপলা সিংহাসনে পৌঁছাতে দাও;
যার পেছনে আইসস আর হাথর দাঁড়িয়ে থাকেন।
কয়েকজন মহিলাসহ অন্যরা সুরেলা কণ্ঠে তাল মেলাল:
ওকে যেতে দাও যেখানে আমরা যেতে পারব না।
অন্ধকার জগতের রহস্য জানার সুযোগ দাও তাকে।
ওকে যেতে দাও!
ওকে যেতে দাও!
সামনের নৌকার স্টার্নে স্টিয়ারিং বেঠা ধরে দাঁড়ানো মেরেন গাইতে লাগল ওদের সাথে। ওর পাশে সিদুদুর কণ্ঠ কাঁপছে, সর্বোচ্চ লয়ে পৗঁছালে ওর আবেগের ভারে ভেঙে পড়ার অবস্থা হলো।
পেশিবহুল হাতে হালকা স্পর্শ টের পেল মেরেন। ওই হাতেই স্টিয়ারিং বেঠা ধরে রেখেছে ও। বিস্ময়ে চমকে উঠে চারপাশে তাকাল। কেউ নেই, কিন্তু স্পর্শ ছিল পরিষ্কার। তাইতার অধীনে থাকতে নবীশ হিসাবে ভালো করেই সরাসরি উৎসের দিকে না তাকানো শিখেছিল। তো দৃষ্টি একপাশে সরিয়ে দৃষ্টিসীমার সীমানায় একটা আবছা অবয়ব দেখতে পেল। ভালো করে নজর দিতেই মিলিয়ে গেল সেটা।
ম্যাগাস, আপনি এখানে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ও, ঠোঁটজোড়া নড়ল না।
ওর প্রশ্নের জবাব দানকারী কণ্ঠস্বরও সমান অস্পষ্ট। তোমার পাশেই আছি আমি, সিদুদুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফেন।
পরিকল্পনা মোতাবেক মেরেন যেখানে তলোয়ার উদ্ধার করেছে সেখানে নৌকা ভেড়ানোর পর নৌকায় উঠেছে ওরা। চেহারায় স্বস্তি ও খুশির ছাপ ফুটতে দিল না মেরেন; যাতে অন্যরা দেখে ফেলতে না পারে। দৃষ্টি সরিয়ে দৃষ্টিসীমার উল্টোদিকে আরেকটা আবছায়া অবয়ব দেখতে পেল ও, সিদুদুর খুব কাছে আবির্ভূত হয়েছে।
তোমার বাম পাশে আছে ফেন, সিদুদুকে সতর্ক করে দিল ও। উঁহু, দেখতে পাবে না। তোমাকে স্পর্শ করতে বলো ওকে। নিজের গালের উপর ফেনের অদৃশ্য আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চেহারা।
তীরে যারীবা খাটাতে যখন শেষ বিকেলে তীরে ভিড়ল ওদের বহর, জমায়েতের উদ্দেশে বক্তব্য রাখল মেরেন। সামনের গালির ফোর ডেকে একটা মন্দির বানাব আমরা, আমাদের সাথে থাকার সময় যেখানে ওরা থাকতে পছন্দ করত। এটা হবে একটা আশ্রয়, এখানে তাইতা আর ফেনের বিদেহী আত্মা অন্য জগতের পথে প্রথম পাইলন পাড়ি দেওয়ার আগে অস্তিত্বের এই বলয়ে নব্বই দিন বন্দি থাকার সময়টায় বিশ্রাম নিতে পারবেন।
ছোট জায়গাটা আগাছার মাদুরে ঘিরে ওখানে মেঝেতে মাদুর আর নিখোঁজ জুটির জিনিসপত্র রেখে দিল ওরা। রোজ সন্ধ্যায় ওটার ওপাশে খাবার, বিয়র ও পানির প্রসাদ রেখে আসে সিদুদু। সকাল নাগাদ সেগুলো খাওয়া হয়ে যায়। ম্যাগাসের বিদেহী আত্মা এখনও ওদের উপর নজর রাখছে জেনে দলটা অনেক উৎসাহিত হয়ে উঠেছে, ফলে নৌবহরের মেজাজ মর্জিও অনেক হালকা এখন। আবারও হাসল লোকেরা, কিন্তু ফোরডেকের মন্দির থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখল ওরা।
আবার উত্তরে বাতাসের আবাস কেবুইতে পৌঁছুল ওরা, নদীটা এখানে, যার উপর দিয়ে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে ওরা, তার সাথে পুবের পাহাড়সারি থেকে নেমে সত্যিকার নীলে পরিণত হতে অন্যান্য শক্তিমান ধারার সাথে মিশেছে। শেষবার দেখার পর খুব একটা বদলায়নি কেবুই, কেবল এর চারপাশের ক্ষেতি জমিগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে; শহরের মাটির প্রাচীরের গা ঘেঁষে চরে বেড়াচ্ছে ঘোড়া ও গরুর পাল। সহসা এমনি বিরাট আকারের একটা নৌবহরের আবির্ভাব সেনাছাউনী ও শহরবাসীকে আশঙ্কিত, ভীত করে তুলল। মেরেন সামনের জাহাজের গলুইতে এসে বন্ধুসুলভ উদ্দেশ্যের কথা বলার পরেই কেবল গভর্নর নারা চিনতে পারলেন ওকে।
কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস যে! চিৎকার করে তীরন্দাজদের উদ্দেশে বললেন তিনি। ওদের দিকে তীর ছুঁড়ো না।
মেরেন তীরে পা রাখামাত্র ওকে আলিঙ্গন করলেন নারা। অনেক আগেই তোমাদের ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম আমরা, তাই ফারাও নেফার সেতির নামে সম্ভাব্য উষ্ণতম স্বাগত জানাই তোমাদের। তিনাতের সাথে এর আগে দেখা হয়নি নারার। কর্নেল লোত্তির নেতৃত্বাধীন অভিযাত্রী দল নারা গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগেই কেবুই অতিক্রম করে গিয়েছিল। তবে অভিযানের কথা তিনি জানতেন, তাকে জীবিত কমান্ডার হিসাবে দেওয়া মেরেনের বক্তব্য মেনে নিলেন তিনি। তবে ওরা নদীর তীরে আলোচনা করার সময় বারবার ভেড়ানো নৌকাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলেন নারা, যেন কারও আসার অপেক্ষা করছেন। শেষে নিজেকে আর সামলে রাখতে পররলে না। ক্ষমা করবে, কর্নেল, কিন্তু জানতে চাইছি সেই অসাধারণ মানুষটি, মহান ম্যাগাস গালালার তাইতার কী হয়েছে।