কীভাবে ফারাওর কাছে ফিরে গিয়ে তাইতার অপহরণের কথা বলব? বিলাপ করছে তিনাত। অন্তত লাশ তো খুঁজে বের করতে হবে।
তোমাকে বলেছি তো, কর্নেল তিনাত। দুজনকেই জিনরা আকাশে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছি আমি, ওকে নিরস্ত করার প্রয়াস পেল মেরেন।
কিন্তু তিনাত একগুঁয়ে আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারপরেও অনুসন্ধান চালাতে হবে আমাদের। বনের প্রতিটি ইঞ্চি চিরুণী তল্লাশি চালাব আমরা, জোর করল সে। আরও একবার লোকেরা প্রসারিত রেখায় ছড়িয়ে পড়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল।
সবার সামনে রয়েছে মেরেন ও তিনাত, ওদের মাত্র হাত খানেক দূরে হাঁটছে মেরেন। ভয়ঙ্করভাবে চোখ কুঁচকে আছে ওর, আপনমনে বিড়বিড় করছে। আরে তিনাত, বোকামি করো না। চলো নৌকায় ফিরে যাই, ম্যাগাস ওর জাদু নিয়ে থাকুন।
এই সময় এক সৈনিক ফেনের রক্তমাখা টিউনিকের খোঁজ পেতেই চিৎকার শুনতে পেল ওরা। ওর দিকে ছুটে গেল মেরেন, তিনাতের সাথে তর্ক জুড়ে দিতে শুনল ওকে, তল্লাশি বাদ দিতে রাজি করানোর চেষ্টা করছে ওকে। রক্তাক্ত পোশাকের প্রমাণ পাওয়ায় অবশেষে ক্ষান্ত দিল তিনাত। উইন্ডস্মোক আর ওয়ার্লউইন্ডকে নিয়ে জিরাফের লাশের কাছে ফিরে গেল ওরা, ছাল খসিয়ে মাংস কেটে নৌকায় নিয়ে যাবে। উঠে দাঁড়াল তাইতা ও ফেন, অস্ত্রশস্ত্র তুলে তারপর উত্তর দিকে কোণাকুনি আবার নীলের তীরে আসার জন্যে এগোল।
তোমার সাথে একা হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে আমার, স্বপ্নিল ভাব নিয়ে বলল ফেন। আমরা কি আবার বিশ্রাম নিতে ওই গাছের ছায়ায় থামব?
মনে হচ্ছে তোমার ভেতর একটা সুপ্ত ড্রাগনকে জাগিয়ে দিয়েছি।
*
তাইতার অদৃশ্য হওয়ার মারাত্মক খবর শোনার পর গোটা দলটাই রীতিমতো এক শোকাবহ অবস্থায় পতিত হলো। পরদিন ওরা ঘোড়া বোঝাই করে আবার নদীর ভাটির দিকে রওয়ানা হওয়ার সময় শববাহী মিছিলের মতো লাগছিল ওদের। ওরা কেবল ম্যাগাসকেই হারায়নি, বরং ফেনও বিদায় নিয়েছে। ওর সৌন্দর্য ও কমনীয়তা দলের সবার কাছে সৌভাগ্যের কবচের মতো ছিল। সিদুদুর মতো অল্প বয়সী তরুণীরা বিশেষ করে যাদের ও অস্ত্রে গোলা ভরার কাজ থেকে মুক্তি দিয়েছিল তারা ওকে রীতিমতো পূজা করতে শুরু করেছিল।
জানি সত্যি না তারপরেও ওকে ছাড়া নিজেকে বিষাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে, মেরেনকে ফিসফিস করে বলল সিদুদু। কেন তাই এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলতে গেলেন?
নিজের আর ফেনের জন্যে নতুন জীবন গড়ে তুলতে হবে তাকে। তিনি যখন বয়স্ক আর রূপালি দাড়িধারী ছিলেন তাদের খুব অল্পজনই তাঁর জাদুকরী পরিবর্তনের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। ওরা তার নব জন্মের ভেতর কালো ডাকিনী বিদ্যার বৈরী ব্যাপারস্যাপার দেখতে পাবে। ফেন ভয় ও ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হবে।
তারমানে ওরা এমন কোথাও যাবে যেখানে আমরা ওদের অনুসরণ করতে পারব না।
আমারও সেই রকমই ভয়, তাই তোমাকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না, ওর কাঁধে হাত রেখে বলল মেরেন। এখন থেকে আমাদের দুজনকে নিজের পথ বেছে নিতে হবে। পরস্পরের মাঝে আমাদের অবশ্যই শক্তি আর লক্ষ্য খুঁজে পেতে হবে।
কিন্তু ওদের ভাগ্যে কী হবে? ওরা কোথায় যাবে? জোর করল সিদুদু।
তাইতা এমন এক জ্ঞানের সন্ধান করছেন আমরা যা বুঝব না। ওর সারাটা জীবনই একটা অনুসন্ধান। এখন তার জীবন অন্তহীন হয়ে গেছে বলে অনুসন্ধানও তাই। কী বলেছে সেটা মনে মনে উল্টেপাল্টে দেখল ও। তারপর আবার খেই ধরল, ওর পক্ষে এটা অন্তদৃষ্টির এক বিরল ঝলক। সেটা বিশাল আশীর্বাদ বা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ওদের কি আর কোনওদিনই দেখতে পাব না আমরা? দয়া করে বলো, ব্যাপারটা অমন হবে না।
ওরা চলে যাবার আগে আবার ওদের দেখা পাব। এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যেতে পারে। আমাদের সাথে অমন নিষ্ঠুর আচরণ কখনওই করবে না। তবে একদিন চিরকালের মতো চলে যাবে ওরা।
কথা বলায় সময় পাশ দিয়ে পিছলে চলে যাওয়া তীরের দিকে নজর রাখছিল মেরেন, তাই চিহ্ন রেখে যাবার কথা বলেছিল, সেটা দেখার চেষ্টা করছে। অবশেষে তীর থেকে আলোর উজ্জ্বল একটা প্রতিফলন দেখতে পেল, পলিশ করা ধাতুর উপর রোদের প্রতিফলন। চোখের উপর হাত রেখে দেখার চেষ্টা করল সে। ওই যে, তীরে দিকে নৌকা ঘোরাল ও। মাঝিরা ওদের বৈঠা থামাল। ডেক আর শুকনো জমিনের মাঝের দূরত্বটুকু এক লাফে পার হয়ে গেল মেরেন, দৌড়ে গেল ডগার উপর খাড়া হয়ে থাকা তলোয়ারটার দিকে। বের করে নিল ওটা, মাথার উপর ঘোরাল। তাইতার তলোয়ার! তিনাতের উদ্দেশে বলল ও। পেছনের গালিতে ছিল সে। এটা একটা লক্ষণ!
ওর কাছে একটা শোর পার্টি পাঠাল তিনাত। দুই দিকে আধ লীগ এলাকা জুড়ে তল্লাশি চালাল ওরা। কিন্তু মানুষের উপস্থিতির আর কোনও চিহ্ন পেল না।
বুড়ো শেয়ালের মতোই চতুর তাইতা, ভাবল মেরেন। এমন নিখুঁতভাবে কায়দা করছে এমনকি আমি পর্যন্ত ধরা খেয়ে যাচ্ছি। আপনমনে হাসল সে। তবে অন্য লোকদের সাথে কথা বলার সময় চেহারা গম্ভীর করে রাখল। তল্লাশী চালিয়ে আর ফায়দা নেই। এইসব ব্যাপার আমাদের বোধের বাইরে। ম্যাগাস তাইতাই যদি হেরে গিয়ে থাকেন, তো আমরা কোন ছার? আমরাও পরাস্ত হওয়ার আগেই বরং নৌকায় ফিরে যাই। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীতি নিয়ে দ্রুততার সাথে পরমার্শটা গ্রহণ করল ওরা, ঝটপট আবার গালিতে আশ্রয় নিল। ওরা নিরাপদে আবার রওয়ানা দেওয়ার পরপরই যাত্রা অব্যাহত রাখার হুকুম দিল মেরেন। মাঝিরা বেঞ্চে নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করল। তারপর লীগ খানেক দূরত্ব নীরবে এগিয়ে চলল।