নাটকীয়ভাবে জঙ্গল শেষ হয়ে গেল, একটা খোলা প্রান্তরে পৌঁছাল ওরা, প্রায় লীগখানেক দূরে জঙ্গলের উল্টোদিকের প্রাচীরের কাছে শেষ হয়েছে এটা। ফাঁকা জায়গার সীমান্তে একটা বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে। মাখনের মতো হলুদ পাথরের চাঁই থেকে বানানো ওটার মিনার, বুরুজ আর টেরেসগুলো। একটা পাথরের দেয়াল পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। বাইরের দিক ঢেকে রাখা মূর্তি আর প্যানেলগুলো নগ্ন পুরুষ ও ইন্দ্রিয়কাতর নারীদের মহাযজ্ঞ তুলে ধরেছে।
মূর্তিগুলোর খেলা দেখলে ঘোড়াও ভয় পাবে, সতর্ক কণ্ঠে বলল মেরেন, যদিও ওর চোখজোড়া ঝিলিক মারছে।
আমার ধারণা ভাস্কর্যের জন্যে দারুণ মডেল হবে তুমি, বলল তাইতা। হলদে পাথরের গায়ে মানবদেহের সম্ভব সব রকম ভঙ্গিমা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে দেয়ালের কোনও কিছুই নিশ্চয় নতুন নয় তোমার কাছে?
বরং উল্টো, অনেক কিছু শেখার আছে আমার, স্বীকার গেল মেরেন। এর অর্ধেকও কোনওদিন স্বপ্নে আর কল্পনায় আসেনি।
জ্ঞান আর বংশধারার মন্দির, ওদের মনে করিয়ে দিল গঙ্গা। এখানে প্রজননের কর্মকাণ্ডকে একাধারে পবিত্র ও সুন্দর মনে করা হয়।
মেরেনেরও অনেক দিন ধরে তাই ধারণা, শুষ্ক কণ্ঠে মন্তব্য করল তাইতা।
এখন ওদের পায়ের নিচের পথ মসৃণ, পথ ধরে মন্দিরের বাইরের প্রাচীরের তোরণের কাছে চলে এল ওরা। বিশাল কাঠের কবাট খোলা ছিল।
ভেতরে যাও! ওদের তাগিদ দিল গঙ্গা। অপ্সরারা অপেক্ষা করছে।
অপ্সরা? জানতে চাইল মেরেন।
মন্দিরের সেবাদাসী, ব্যাখ্যা করল গঙ্গা।
তোরণ পার হলো ওরা। তারপর এমনকি তাইতা পর্যন্ত বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে উঠল। এক অনন্য সাধারণ উদ্যানে নিজেদের আবিষ্কার করেছে ওরা। মসৃণ সবুজ আঙিনায় ফুলে ভরা গুল্ম ঝোঁপ আর ফল গাছের ছড়াছড়ি; এরই মধ্যে বেশির ভাগ গাছপালাই ফুলে-ফলে ভরে উঠেছে: রসাল ফলগুলো তৃপ্তিকরভাবে, পেকে উঠছে। এমনকি অভিজ্ঞ বৃক্ষ বিশেষজ্ঞ ও উদ্যানবিদ তাইতা পর্যন্ত কিছু কিছু বিচিত্র প্রজাতির গাছ চিনতে পারল না। ফুলের কেয়ারিগুলোয় চোখ ধাঁধানো নানা রঙের সমাহার। তোরণের কাছে লনে বসে ছিল তিন জন তরুণী। পর্যটকদের দেখেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা, হালকা পায়ে ছুটে এল মিলিত হতে। উত্তেজনায় নাচছে, লাফাচ্ছে। তাইতা ও মেরেনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। প্রথম অপ্সরা ছিপছিপে, সোনালি চুল মাথায়, অসাধারণ সুন্দরী। মাখনের মতো মসৃণ ত্বকের কল্যাণে ওকেও বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে। শুভেচ্ছা, ভালোভাবেই দেখা হলো। আমি আস্ত্রাতা, বলল সে।
দ্বিতীয় অপ্সরার মাথায় ঘন চুল, চোখজোড়া তীর্যক। মৌচাকের মোমের মতো পলিশ করা স্বচ্ছ ত্বক। নিপূণ কারিগরের হাতে খোদাই করা হাতির দাঁতের মতো। নারী সত্তার পূর্ণ বিকাশে অনন্য সাধারণ লাগছে তাকে। আমি উ লু, বলল সে। মেরেনের পেশল বাহু সমীহের সাথে লক্ষ করতে লাগল। তুমি অনেক সুন্দর।
আমার নাম তানসিদ, বলল লম্বা মূর্তির মতো তৃতীয় অপ্সরা। চোখজোড়া বিস্ময়কর টারকোয়েজ সবুজ, দাঁতগুলো শাদা, নিখুঁত। তাইতাকে চুমু খেল সে, বাগানের কোনও ফুলের সৌরভের মতোই সুবাসিত মনে হলো ওর নিঃশ্বাস। তোমাকে স্বাগতম, ওকে বলল তানসিদ। তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। আমাদের জন্যে আনন্দ বয়ে এনেছ তোমরা।
উ লুকে এক হাতে জাড়িয়ে ধরে তোরণের দিকে চোখ ফেরাল মেরেন। গঙ্গা কোথায় গেল? জানতে চাইল ও।
গঙ্গা বলে কেউ কখনও ছিল না, ওকে বলল তাইতা। বুনো আত্মা সে। কাজ শেষ হওয়ায় ভিন্ন জগতে ফিরে গেছে। কথাটা মেনে নিল মেরেন। ম্যাগাসের সাথে অনেক লম্বা সময় কাটানোর পর এখন আর অদ্ভুত ও জাদুকরী কোনও ঘটনায়ও অবাক হয় না।
অপ্সরারা মন্দিরের ভেতরে নিয়ে এল ওদের। বাগানের উজ্জ্বল রোদের পর উঁচু দেয়ালগুলো শীতল ও ম্লান ঠেকল। সরস্বতীর সোনার মূর্তির সামনে রাখা ধূপদানীর ধূপের সুবাসে সুবাসিত হয়ে আছে চারপাশের হাওয়া। ওগুলোর সামনে পূজা দিচ্ছে ঢিলেঢালা জাফরানি জোব্বা পরা পুরোহিত আর পুরোহিতীনিরা, অন্যদিকে আরও অনেক অপ্সরা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে ছায়ার ভেতর। কেউ কেউ আগন্তুকদের জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে এগিয়ে এল। মেরেনের বাহু আর বুকে হাত বোলাল ওরা, বিলি কেটে দিল তাইতার রূপালি দাড়িতে।
সবশেষে উ লু, তানসিদ আর আস্ত্রাতা হাত ধরে একটা দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে মন্দিরের আবাসিক মহলে নিয়ে এল ওদের। খাবার ঘরে গামলা ভরা সজির স্টু আর কাপে করে মিষ্টি লাল মদ খেতে দিল। দীর্ঘদিন সামান্য খাবারের উপর টিকে ছিল ওরা, এমনকি তাইতাও গ্রোগ্রাসে খেল। খাওয়া শেষ হওয়ার পর তাইতাকে ওর জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরে নিয়ে গেল তানুসিদ। পোশাক খুলতে সাহায্য করল ওকে, তারপর উষ্ণ পানি ভরা একটা তামার বেসিনে দাঁড় করিয়ে ক্লান্ত শরীর স্পঞ্জ করে দিল। যেন সন্তানের পরিচর্যা করছে কোনও মা, এতটাই কোমল ও স্বাভাবিক ওর ভঙ্গি। মেয়েটা ওর নপুংসক বানানোর বিভৎস ক্ষতে স্পঞ্জ বোলানোর সময়ও এতটুকু বিব্রত বোধ করল না তাইতা। গা মুছে দিয়ে ওকে। তক্তপাষের কাছে নিয়ে এল মেয়েটা, ওর পাশে বসে মৃদু কণ্ঠে গান গাইতে লাগল, যতক্ষণ না স্বপ্নহীন ঘুমে তলিয়ে গেল ও।
মেরেনকে অন্য একটা কামরায় নিয়ে এল উ লু আর আস্ত্রাতা। তানসিদের মতোই ওকে গোসন করাল ওরা, তারপর তক্তপোষে শুইয়ে দিল। ওদের কাছে রাখার চেষ্টা করল মেরেন, কিন্তু পরিশ্রান্ত ছিল ও, ইচ্ছাটুকুও আন্তরিক ছিল না। খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল ওরা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমে ঢলে পড়ল ও।