গোটা মিশর ভীত, হতাশায় মুষড়ে পড়ল দেশের লোকজন।
*
এরপর আরেকজন অতিথি এলেন গালালায়। রাতের বেলায় হাজির হলেন নতিনি, কিন্তু লস্ত্রিসের তারাটা তেলের কুপির শেষ শিখার মতো এমন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল যে অনেক দূরে থাকলেও তাইতাকে কাফেলা দেখাতে পারছিল মেরেন।
বহুদূরের দেশ থেকে আসছে ওই মালবাহী পশুগুলো, মন্তব্য করল মেরেন। উট মিশরের প্রাণী নয়, এখনও ওর উত্তেজনা জাগিয়ে তোলার মতো বিরল জিনিস। ক্যারাভান রুট ধরে আসেনি ওরা, এসেছে সোজা মরুভূমির উপর দিয়ে। গোটা ব্যাপারটাই অদ্ভুত। ওদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে আমাদের।
ইতস্তত না করে সোজা মন্দিরের উদ্দেশে এগিয়ে এলো বিদেশী পর্যটকের দল। যেন কেউ পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। উট চালকরা ওদের পশু বাঁধল। তারপর শিবির খাটানোর স্বাভাবিক শোরগোল শুরু হলো।
ওদের কাছে যাও, নির্দেশ দিল তাইতা।দেখ কী জানতে পারো।
সূর্য বেশ উপরে উঠে আসার আগে ফিরল না মেরেন। মোট বিশজন পুরুষ রয়েছে ওখানে, সবাই চাকর বাকর। বলছে আমাদের কাছে আসতে নাকি বিশ মাস ধরে চলার উপর আছে ওরা।
ওদের নেতা কে? তার সম্পর্কে কী জানতে পেরেছ?
তার দেখা পাইনি। বিশ্রাম নিতে চলে গেছেন তিনি। শিবিরের মাঝখানের তাবুটাই তাঁর। সেরা উল দিয়ে বানানো। দলের সবাই অনেক শ্রদ্ধা আর সম্মানের সাথে তার কথা বলে।
কী নাম তার?
জানি না। ওকে স্রেফ হিতামা বলছে ওরা, ওদের ভাষায় এর মানে মহান জ্ঞানী।
এখানে কী চান?
আপনাকে, ম্যাগাস। আপনার কাছেই এসেছেন। ক্যারাভান সর্দার নাম ধরে আপনার খোঁজ করছিল।
সামান্য বিস্মিত হয়েছে মাত্র তাইতা। আমাদের কাছে কী খাবার আছে? এই হিতামা নামের লোকটাকে ঠিক মতো আপ্যায়ন করতে হবে।
পঙ্গপাল আর খরার পর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। আমার কাছে কিছু ঝলসানো মাছ আর লোনা পিঠা বানানোর মতো যথেষ্ট ভূট্টা আছে।
গতকাল যোগাড় করা ব্যাঙের ছাতাগুলোর কী হলো?
পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে এখন। গ্রামে হয়তো একটা কিছু মিলতে পারে।
না, বন্ধুদের আর ঝামেলায় ফেলো না। এমনিতেই ওদের জীবন বেশ কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের যা আছে তাতেই কাজ সারব। শেষমেষ অতিথির ঔদার্যের কল্যাণে রক্ষা পেল ওরা। ওদের সাথে সন্ধ্যার খাবারে অংশ নিতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন হাতিমা, কিন্তু চমৎকার একটা উটসহ ফেরত পাঠালেন তিনি মেরেনকে। পরিষ্কার বোঝা গেল এখানকার জনগণ দুর্ভিক্ষে কেমন কষ্ট পাচ্ছে তার স্পষ্ট ধারণা রাখেন তিনি। পশুটা জবাই করে সিনার মাংসের রোস্ট বানালো মেরেন। ওটার বাকি অংশ হিতামার ভৃত্য ও শহরের বেশিরভাগ লোকজনের খাবার হিসাবে যথেষ্ট হবে।
মন্দিরের ছাদে অতিথির জন্যে অপেক্ষায় রইল তাইতা। লোকটা কে হতে পারে জানতে কৌতূহল হচ্ছে। পদবী থেকে বোঝা যাচ্ছে ম্যাগাইদের একজন। কিংবা হয়তো অন্য কোনও প্রাজ্ঞ গোত্রের প্রধান পুরোহিত। ওর মন বলছে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু প্রকাশ পাবে ওর কাছে।
ইনি কি তবে ভবিষ্যদ্বাণীর সেই বার্তাবাহক, যার জন্যে এতদিন অপেক্ষায় আছি? ভাবল ও। তারপর মেহমানকে নিয়ে প্রশস্ত পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে মেরেনের উঠে আসার শব্দ পেয়ে নড়ে চড়ে বসল ও।
তোমাদের গুরুর দিকে লক্ষ রেখ। সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে, বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাহকদের বলল মেরেন। অবশেষে ছাদে পৌঁছাল ওরা। তাইতার তক্তপোষের কাছেই পর্দা ঢাকা হাওদা নামাতে সাহায্য করল ওদের। তারপর ওদের দুজনের মাঝখানে টেবিলে ডালিমের গন্ধঅলা শরবতের একটা রূপালি বাটি আর দুটো খাওয়ার বাটি রাখল। নিজের গুরুর দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকাল। আর কী করতে পারি, ম্যাগাস?
এবার তুমি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারো, মেরেন। খাবার জন্যে তৈরি হলে খবর দেব তোমাকে। একটা বাটিতে শরবত ঢেলে পর্দার মুখের কাছে ধরল তাইতা, শক্ত করে বাঁধা রয়েছে ওটার মুখ। শুভেচ্ছা, স্বাগতম। আমার দীন কুটিরে সম্মান বয়ে এনেছেন আপনি, অদৃশ্য অতিথির উদ্দেশে বিড়বিড় করে বলল ও। কোনও জবাব মিলল না। পালকির উপর অন্তর্চক্ষুর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল ও। রূপালি পর্দার ওধারে জীবন্ত কোনও প্রাণীর আভা ধরতে না পেরে রীতিমতো অবাক মানল। প্রতিটি জায়গা সাবধানে পরখ করার পরেও প্রাণের কোনও চিহ্ন পেল না। ফাঁকা, বন্ধ্যা ঠেকল।কেউ নেই? চট করে উঠে পালকির দিকে এগিয়ে গেল ও। কথা বলুন! দাবি জানাল। এটা কী ধরনের শয়তানি?
একটানে পর্দাটা সরিয়ে দিল ও, বিস্ময়ে পিছিয়ে এল এক কদম। গদিমোড়া বিছানায় আসন পেতে বসে আছেন এক লোক, ওরই দিকে তাকিয়ে আছেন। পরনে স্রেফ রেশমি একটা নেংটি। কঙ্কালসার শরীর, টাক মাথাটা খুলির মতো; গায়ের ত্বক সাপের ছেড়ে দেওয়া খোলসের মতোই শুষ্ক, কোঁকড়ানো। প্রাচীন ফসিলের মতো জরাজীর্ণ তার অবয়ব, কিন্তু চেহারা অভিব্যক্তি প্রশান্ত, সুন্দরও।
আপনার কোনও আভা নেই! ঠোঁটের ফাঁক গলে কথাগুলো বেরিয়ে আসা ঠেকানোর আগেই সজোরে বলে উঠল ও।
মৃদু মাথা দোলালেন হিতামা। আপনারও তাইতা, তাইতা। সরস্বতীর মন্দির থেকে ফিরে আসা কেউই চোখে পড়ার মতো আভা বিলোয় না। আমরা আমাদের মনুষ্যত্বের একটা অংশ আলোকবাহী কশ্যপের কাছে রেখে এসেছি। এই ঘাটতি আমাদের পরস্পরকে চিনতে সক্ষম করে তোলে।