ম্যাগাস! ওর মেজাজের পরিবর্তন টের পেয়ে গেল মেরেন। কী হয়েছে? তাইতার কাঁধ আঁকড়ে ধরল সে। তলোয়ারের বাটের উপর অন্য হাত। কষ্টের ভেতর কথা বলতে না পেরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিল তাইতা, শূন্যে তাকিয়ে রইল।
শেষবার চোখ রাখার পর মাঝের সময়টুকুতে স্বাভাবিক আকারের চেয়ে কয়েক গুন স্ফীত হয়ে উঠেছে লস্ত্রিসের তারা। এক কালের উজ্জ্বল, অবিরাম আভা এখন মিটমিটে হয়ে গেছে, ওটার বিচ্ছুরণ যেন পরাস্ত সেনাদলের তাঁবুর মতো বেহাল অবস্থায় তিরতির করে কাঁপছে। দেহ বিকৃত হয়ে গেছে, প্রান্তগুলো ফাঁপা, মাঝখানে দুমড়ে গেছে।
এমনকি মেরেনও পরিবর্তনটা ধরতে পারল। আপনার তারা! একটা কিছু হয়েছে ওটার। এর মানে কী? তাইতার কাছে ওটার গুরুত্ব জানে ও।
বলতে পারব না, ফিসফিস করে বলল তাইতা। আমাকে এখানে রেখে যাও, মেরেন। নিজের গালিচায় ফিরে যাও। আমার এখন মনোযোগ নষ্ট হওয়া চলবে না। ভোরে আমাকে নিতে এসো।
সূর্য ওঠার পর তারাটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত লক্ষ রাখল তাইতা। ওকে টাওয়ার থেকে নিয়ে যেতে এল মেরেন। লস্ত্রিসের তারাটার মরণ যাত্রার কথা জানে ও।
রাতের দীর্ঘ জাগরণের ফলে ক্লান্ত হলেও ঘুমাতে পারেনি ও। মৃত্যুপথযাত্রী নক্ষত্রের ইমেজ ওর মনটা ভরে রেখেছে, অন্ধকার, আকারহীন দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খেয়েছে ওকে। এটা ছিল অশুভের সবশেষ ও সবচেয়ে মারাত্মক প্রকাশ। প্রথমে মানুষ আর পশু ঘাতক প্লেগের আক্রমণ, এবার তারাদের ধ্বংসকারী ভয়ানক এই বৈরিতা। পরের রাতে টাওয়ারে ফিরল না তাইতা, তার বদলে সান্ত্বনার আশায় একাই মরুভূমিতে গেল। গুরুকে অনুসরণ না করার নির্দেশ থাকলেও দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নিল মেরেন। অবশ্য তাইতা ওর উপস্থিতি টের পেয়ে জাদুর মায়ায় নিজেকে আড়াল করে ফাঁকি দিল। গুরুর নিরাপত্তার কথা ভেবে ক্ষিপ্ত, শঙ্কিত মেরেন সারা রাত খোঁজ করে বেড়াল। ভোরে অনুসন্ধানী দল গঠন করতে গালালায় ফিরে প্রাচীন মন্দিরের সিঁড়িতে তাইতাকে নিংসঙ্গ বসে থাকতে দেখতে পেল ও।
আমাকে হতাশ করলে, মেরেন। দায়িত্ব অবহেলা করে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো তোমাকে মানায় না, ওকে ভর্ৎসনা করল সে। এখন কি আমাকে উপোস রাখতে চাও তুমি? তোমার নতুন কাজের মেয়েটাকে তলব করো, আশা করো সুন্দর চেহারা তার রান্নার বারটা বাজায়নি।
সেদিন দিনের বেলায় ঘুমাল না ও, টেরেসের কিনারায় ছায়ায় বসে রইল। সন্ধ্যার খাবার শেষ হলে আরও একবার মিনারে উঠে গেল। সূর্যটা দিগন্তের মাত্র এক আঙুল নিচে, কিন্তু যখন তারাগুলো ওর চোখে ধরা দিতে শুরু করবে, অন্ধকারের একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে রাজি নয় ও। চোরের মতো দ্রুত ও নিঃশব্দে রাত নামল। তীক্ষ্ণ চোখে পুবে তাকাল তাইতা। রাতের আকাশের অন্ধকার হয়ে আসা খিলানে একে একে দেখা দিতে শুরু করেছে তারাগুলো। ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সহসা ওর মাথার উপর উদয় হলো দিল লস্ত্রিসের তারা। গ্ৰহপুঞ্জের সারিতে নিজের অবস্থান স্থির রেখেছে দেখে বিস্মিত হলো ও। গালালার মিনারের মাথার উপর লণ্ঠনের কম্পিত শিখার মতো ঝুলে আছে এখন।
এখন আর তারা নেই ওটা। শেষবার ওটায় চোখ রাখার পর অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একটা ভীষণ মেঘে বিস্ফোরিত হয়েছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। গাঢ়, অশুভ বাষ্প বের হয়ে আসছে চারপাশ থেকে। মাথার উপর গোটা আকাশকে আলোকিত করে তোলা বিশাল আগুনে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
অপেক্ষা করল তাইতা, দীর্ঘ অন্ধকার মুহূর্ত জুড়ে লক্ষ করতে লাগল। ওর মাথার উপরের অবস্থান থেকে নড়ল না তারাটা। সূর্যোদয়ের সময়ও একই জায়গায় রইল ওটা। রাতের পর বিরাট আলোকবর্তিকার মতো আকাশের বুকে স্থির হয়ে রইল তারাটা, নির্ঘাৎ স্বর্গের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওটার অলৌকিক আলো। ওটাকে ঘিরে রাখা ধ্বংসের মেঘ একবার বাড়ছে আবার কমছে। কেন্দ্রে ঝলসে উঠছে আগুন। তারপর মরে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই ফের আরেক জায়গায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে।
ভোরে প্রাচীন মন্দিরে হাজির হলো শহরবাসীরা। হাইপোস্টাইল হলের বিশাল বিশাল কলামের ছায়ায় ম্যাগাসের কথা শুনতে অপেক্ষা করতে লাগল। তাইতা টাওয়ার থেকে নেমে এলে ঘিরে ধরল ওকে। ওদের শহরের উপর কুলন্ত বিশাল আগ্নেয় বিস্ফোরণের ব্যাখ্যার আবেদন জানাল। হে মহান ম্যাগাস, এটা কি আরেকটা প্লেগের আগাম লক্ষণ? দয়া করে এই ভীষণ কুলক্ষণের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন। কিন্তু ওদের স্বস্তি দেওয়ার মতো কিছুই বলতে পারল না ও। ওর গবেষণা লস্ত্রিসের তারার এমনি অস্বাভাবিক আচরণের জন্যে তৈরি করেনি ওকে।
নতুন চাঁদ আবার ভরে উঠল, বিস্ফোরিত নক্ষত্রের ভীতিকর ইমেজ কোমল করে তুলল ওটার আলো। কিন্তু আবার ওটা ক্ষয়ে যাবার পর ফের আকাশে আধিপত্য বিস্তার করল লস্ত্রিসের তারা। এত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে যে অন্য তারাগুলোকে ওটার পাশে তুচ্ছ ঠেকল। যেন ওটার আলোতে আকৃষ্ট হয়েই দক্ষিণ থেকে ধেয়ে এল পঙ্গপালের ঝাক, নেমে এল গালালার বুকে। দুদিন থাকল ওগুলো, সেচের জমি তছনছ করে দিল, ধুরা ভুট্টার একটা কণা বা জলপাই গাছের ডালে একটা পাতাও অবশিষ্ট রইল না। ওদের ঝাঁকের ভারে ডালিম গাছের ডাল নুয়ে পড়ল, ভেঙে পড়ল তারপর। তৃতীয় দিন সকালে এক বিশাল সীমাহীন মেঘের আকারে আকাশে ভাসল, উড়ে গেল পশ্চিমে নীলের দিকে: নীল নদের বান না ডাকায় ইতিমধ্যে মরণোন্মুখ দেশের উপর আরও গজব নামাবে বলে।