ওদের একসাথে থাকার দশকগুলোয়, সেই ক্ষমতাদখলকারীদের বিরুদ্ধে মহান লড়াইয়ের সময় থেকে, নেফার সেতির উচ্চ ও নিম্ন মিশরের দ্বৈত সিংহাসনে আরোহণের কাল থেকেই বরাবর তাইতার পাশে ছিল মেরেন। তাইতার দত্তক ছেলে ও, ওর ছেটে ফেলা পৌরুষ থেকে কোনওদিনই ওর পক্ষে জন্ম নেওয়া সম্ভব হতো না। না, মেরেন ওর কাছে সন্তানের চেয়েও বেশি, বুড়ো মানুষটার প্রতি ওর ভালোবাসা রক্তের বাঁধনও অতিক্রম করে গেছে। এখন ওর নিজস্ব দুর্দশা সবকিছু আচ্ছন্ন করে রাখলেও ওকে বিচলিত হতে দেখে আলোড়িত হলো তাইতা।
আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশে, আমাদের ভালোবাসার মানুষজনের কপালে, আমাদের প্রিয় রাজার ভাগ্যে, কেন এমন হচ্ছে? আবেদন ঝরে পড়ল মেরেনের কণ্ঠে।
মাথা নাড়ল তাইতা, অনেকক্ষণ নীরব রইল। তারপর সামনে ঝুঁকে মেরেনের বাহু স্পর্শ করল।দেবতারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন, বলল ও।
কেন? লেগে রইল মেরেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন শঙ্কায় বলতে গেলে ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেছে এই মহাবীর যোদ্ধা ও সামনের কাতারের সঙ্গীটি। কী অন্যায় হয়েছে?
আমরা মিশরে ফেরার পর থেকে মনে মনে এই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজে ফিরছি। উৎসর্গ করেছি, লক্ষণের আশায় আকাশের আনাচে-কানাচে খোঁজ করেছি। কিন্তু ওদের ঐশী ক্ষোভের কারণ এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। যেন ঘৃণায় ভরা সত্তায় ঢাকা পড়ে গেছে।
ফারাও ও মিশরের স্বার্থে, আমাদের স্বার্থে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতেই হবে, ম্যাগাস। আকুতি জানাল মেরেন। কিন্তু আর কোথায় খোঁজ করা বাকি আছে?
অচিরেই জবাব পেয়ে যাব, মেরেন। দৈবজ্ঞ আগেই এর ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। অপ্রত্যাশিত কোনও বার্তাবাহক নিয়ে আসবে খবরটা-হয়তো মানুষ বা দাবো, কোনও পশু বা দেবতা। সম্ভবত আকাশের বুকে তারার হরফে লেখা কোনও লক্ষণ হিসাবে দেখা দেবে। তবে এই গালালাতেই আমার কাছে আসবে উত্তরটা।
কখন, ম্যাগাস? এরই মধ্যে কি যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়নি?
সম্ভবত আজ রাতেই।
*
ক্ষিপ্রতার সাথে উঠে দাঁড়াল তাইতা। অনেক বয়স হলেও তরুণের মতোই মনড়াচড়া করতে পারে। ওর ক্ষিপ্রতা ও সজীবতা সব সময়ই মেরনকে বিস্মিত করে আসছে। এমনকি এতগুলো বছর ওর সাথে কাটানোর পরেও। টেরেসের কোণ থেকে ছড়িটা তুলে নিল তাইতা, হালকাভাবে ওটার উপর ভর দিয়ে সিঁড়ির নিচে গিয়ে উঁচু মিনারের দিকে তাকাল। গ্রামবাসীরা ওর জন্যেই বানিয়েছে ওটা। গালালা গ্রামের সবাই শ্রম দিয়েছে। বুড়ো ম্যাগাসের প্রতি ওদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার লক্ষযোগ্য প্রমাণ। শহরকে পুষ্টিতে ভরে তোলা ঝর্নার মুখ খুলে দিয়েছিল ও, নিজস্ব জাদুর অদৃশ্য কিন্তু জোরাল শক্তিতে ওদের রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে।
মিনারের বাইরের দিকে এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া সিঁড়িটার দিকে তাকাল তাইতা; ধাপগুলো সরু, দুপাশ খোলা, রক্ষা করার জন্যে রেইলিং নেই। আইবেক্সের মতো উঠে গেল ও, পায়ের দিকে তাকাচ্ছে না। পাথরে মৃদু আওয়াজ তুলছে ওর ছড়ির ডগা। চূড়ার প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে রেশমী প্রার্থনার গালিচায় পুব দিকে ফিরে বসল ও। ওর পাশে রূপার একটা ফ্লাস্ক রাখল মেরেন। তারপর তাইতার প্রয়োজনে চট করে সাড়া দেওয়ার মতো কাছাকাছি দূরত্বে ওর পেছনে বসল, তবে এত কাছে নয় যে ম্যাগাসের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হবে।
ফ্লাস্কের শিংয়ের ছিপি খুলে তীব্র তেতো এক চুমুক তরল খেল তাইতা। ধীরে ধীরে গিলল, পেট থেকে শরীরের প্রতিটি পেশিতে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়া টের পাচ্ছে। স্ফটিকের মতো ঔজ্জ্বল্যে ভরিয়ে দিচ্ছে ওর মনটাকে। মৃদু শ্বাস নিল ও। তরলের কোমল প্রভাবে আত্মার অন্তর্চক্ষু খোলার সুযোগ করে দিল।
দুরাত আগে বুড়ো চাঁদটাকে গিলে নিয়েছে রাতের দানব। এখন আকাশটা তারার দখলে। অবস্থান অনুযায়ী তারাগুলো ফুটে ওঠার সময় খেয়াল রাখল তাইতা। সবচেয়ে উজ্জ্বল ও শক্তিশালী তারাটা রয়েছে সবার আগে। অচিরেই হাজার হাজার তারা উঠে গোটা আকাশ ভরে ফেলল, রূপালি আভায় ভাসিয়ে দিল মরুভূমি। জীবনভর তারা পর্যবেক্ষণ করেছে তাইতা। ভেবেছিল তারা সম্পর্কে যা কিছু জানার, বোঝার তার সবই ওর জানা বা বোঝা হয়ে গেছে; কিন্তু এখন ওর অন্তর্চক্ষু দিয়ে নতুন উপলব্ধি এবং বস্তুর চিরন্তর পরিকল্পনায় মানুষ ও দেবতাদের কর্মকাণ্ডে ওদের অবস্থান সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি গড়ে তুলছে ও। একটা বিশেষ উজ্জ্বল নক্ষত্রকে সাগ্রহে আলাদা করে নিল ও। জানে, ওর বসার জায়গা থেকে ওটাই সবচেয়ে কাছে। তারাটাকে দেখামাত্র উল্লসিত হয়ে উঠল ওর সমস্ত ইন্দ্রিয়: সেদিন সন্ধ্যায় তারাটা যেন সরাসরি মাথার উপর ঝুলে আছে বলে মনে হলো।
এই তারাটা রানি লস্ত্রিসকে মমি করার ঠিক নব্বই দিন পর, যেরাতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেরাতে আবির্ভূত হয়। ওটার আবির্ভাব ছিল অলৌকিক ঘটনা। মারা যাবার আগে লস্ত্রিস আবার ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করেছিল ওর কাছে, ওর দৃঢ় বিশ্বাস জাগল ওই তারাটিই রানির প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। ওকে কখনওই ছেড়ে যায়নি সে। এতগুলো বছর ওর নক্ষত্র ছিল ওর ধ্রুবতারা। ওটার দিকে তাকালেই রানির মৃত্যুর পর ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলা নিঃসঙ্গতা দূর হয়ে যায়।
এখন অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাকাতেই লখ্রিসের তারার চারপাশে ওর আভা লক্ষ করল ও। অন্যান্য মহাজাগতিক কাঠামোর তুলনায় বেশ ছোট হলেও স্বর্গীয় আর কোনও বস্তুই ওটার ঔজ্জ্বল্যের সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। লস্ত্রিসের জন্যে নিজের ভালোবাসা অবিরাম, হ্রাসহীনভাবে বয়ে যাওয়া অনুভব করল তাইতা, ওর আত্মাকে উষ্ণ করে তুলেছে। সহসা সতর্কতায় ওর গোটা দেহ আড়ষ্ট হয়ে গেল, শিরা উপশিরা হয়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে ধেয়ে গেল একটা শীতল অনুভূতি।