কাফেলা চালকদের কল্যাণে ওদের প্রত্যাবর্তনের খবর মিশরের বাকি অংশে দ্রুত রাষ্ট্র হয়ে গেল। অচিরেই ফারাও নেফার সেতি আর রানি মিনতাকার বার্তাবাহকরা হাজির হলো থেবসের দরবারে। পাঠানো সংবাদে তেমন খুশির কিছু নেই: প্রথমবারের মতো রাজ্যে আবির্ভূত প্লেগের সংবাদ কানে এলো তাইতার। যত তাড়াতাড়ি পারো, চলে এসো, প্রাজ্ঞ, নির্দেশ দিয়েছেন ফারাও। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন।
আইসিসের নতুন চাঁদ উঠলেই আসব আমি, জবাব দিল তাইতা। ইচ্ছে করে অবাধ্যতা দেখাচ্ছে না ও, জানে ফারাওকে পরামর্শ দেওয়ার মতো আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি এখনও নেওয়া হয়নি ওর। বুঝতে পারছে, এই প্লেগ আসলে শ্রদ্ধেয় মাতা সুমনার আশঙ্কিত মহা অমঙ্গলের প্রকাশ, যার জন্যে ওকে সতর্ক করে দিয়েছিল সে। অন্তর্চক্ষুর অধিকারী হলেও এখনই মিথ্যার শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে না ও। অবশ্যই লক্ষণ বিচার করতে হবে ওকে, যাচাই করতে হবে, তারপর নিজের আধ্যাত্মিক সম্পদ একত্রিত করতে হবে। সহজাত প্রবৃত্তির জোরে ও জানে গালালায় ওর জান্যে নির্দেশনা আসবে, সেজন্যে অপেক্ষাও করতে হবে।
কিন্তু অনেক রকম বাধা আর বিচ্যুতি দেখা গেল। অচিরেই আগন্তুকদের আগমন ঘটতে শুরু করল, তীর্থযাত্রী ও ভিখিরির দল ভিখ মাঙতে শুরু করল, পঙ্গু আর অসুস্থরা এলো রোগমুক্তির আশায়। রাজণ্যদের দূতরা সাথে করে বিপুল উপহার নিয়ে এলেন, ভবিষ্যদ্বাণী ও ঐশী নির্দেশনা চাইলেন তাঁরা। আগ্রহের সাথে ওদের আভা বিচার করল তাইতা। আশা করল ওদের ভেতর ওর কাক্ষিত জন আছে। বারবার হতাশ হতে হলো, উপহারসহই ফেরত পাঠাল ওদের।
আমাদের কি কিছু খাজনা রেখে দেওয়া উচিত ছিল না, ম্যাগাস? আবেদন জানাল মেরেন। আপনি পবিত্র পুরুষে পরিণত হলেও তো খাবারের দরকার হবে, তাছাড়া আপনার টিউনিকও তো ন্যকড়ায় পরিণত হয়েছে। আমারও একটা নতুন ধনুক দরকার হয়ে পড়েছে।
মাঝে মাঝে হয়তো কোনও অতিথি ক্ষীণ আশা জাগিয়ে তুলছে, যখন আভার জটিলতা চিনতে পারছে ও। ওরা প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের সন্ধানী, ম্যাজাইদের ভ্রাতৃসংঘের মাঝে ওর খ্যাতি জেনে হাজির হচ্ছে। কিন্তু ওরা ওর কাছে নিতে আসছে, কারওই ওর ক্ষমতার সাথে তাল মেলানোর ক্ষমতা বা বিনিময়ে কিছু দেওয়ার নেই। তারপরেও ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও, প্রতিটি কথা যাচাই করছে। তাৎপর্যপূর্ণ তেমন কিছুই নেই, তবু অনেক সময় কোনও বিক্ষিপ্ত মন্তব্য বা ভুল মতামত সঠিক পথে নিয়ে আসছে ওর মনকে। ওদের ভুলের ভেতর দিয়ে বিপরীত ও সঠিক উপসংহারে পৌঁছে যাচ্ছে ও। কশ্যপ ও সুমনার সতর্কবাণী সর্বক্ষণ মাথায়। রয়েছে ওর, আসন্ন সংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্যে ওর সর্বশক্তি, প্রজ্ঞা আর বুদ্ধির দরকার হবে।
*
মিশর থেকে এসে লোহিত সাগর তীরবর্তী পাহাড়ী বুনো সাগাফাগামী কাফেলা নিয়মিত মিশর মাতার খবর বয়ে আনছে। এমনি আরেকটা কাফেলা পৌঁছানোর পর কাফেলার সর্দারের সাথে আলাপ করতে মেরেনকে পাঠাল তাইতা। বিখ্যাত ম্যাগাস তাইতার আস্থাভাজন জানা থাকায় ওর সাথে সম্মানের সাথে ব্যবহার করল সবাই। সেদিন সন্ধ্যায় শহর থেকে ফিরে ও জানাল, কাফেলার বণিক ওবেদ তিন্দালি মহাদেবতা হোরাসের কাছে প্রার্থনার সময় তার নাম মনে রাখার আবেদন জানিয়েছে। সুদূর ইথিওপিয়া থেকে সবচেয়ে ভালো মানের কফির দরাজ উপহার পাঠিয়েছে আপনার কাছে, কিন্তু আপনাকে এখন নিজেকে স্থির করার জন্যে সাবধান করে দিচ্ছি, ম্যাগাস, কেননা ডেল্টা থেকে আপনার জন্যে স্বস্তিকর কোনও খবর বয়ে আনেনি সে।
চোখের আড়ালে খেলে যাওয়া শঙ্কা লুকোতে মুখ নিচু করল বুড়ো মানুষটা। এরই মধ্যে যেসব খবর পেয়েছে তার চেয়ে খারাপ সংবাদ আর কী হতে পারে? আবার মুখ তুলে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে কথা বলল ও। আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। না মেরেন। কিছুই লুকিয়ো না। নীল নদের বান শুরু হয়ে গেছে?
এখনও হয়নি, মৃদু কণ্ঠে, বিষণ্ণ সুরে জবাব দিল মেরেন। এই নিয়ে বিনা বন্যায় সাত বছর কেটে যাচ্ছে।
তাইতার কঠিন অভিব্যক্তি বদলে গেল। বন্যা আর দক্ষিণ থেকে বয়ে আসা উর্বর পলিমাটি ছাড়া মিশর দুর্ভিক্ষ, পঙ্গপাল ও মরণের ফাঁদে পড়বে।
ম্যাগাস, খবরটা আমার দুঃখ যারপরনাই বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু আরও খারাপ খবর বাকি আছে এখনও, বিড়বিড় করে বলল মেরেন। নীল নদের যেটুকু পানি অবশিষ্ট ছিল সেটা রক্ত হয়ে গেছে।
ওর দিকে চেয়ে রইল তাইতা। রক্ত! পুনরাবৃত্তি করল ও। বুঝলাম না!
ম্যাগাস, এমনকি নদীর শুকিয়ে যাওয়া পুকুরগুলো পর্যন্ত গাঢ় লাল হয়ে গেছে, পচা লাশের মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, বলল মেরেন। মানুষ বা পশু কেউই ওই পানি মুখে তুলতে পারছে না। ঘোড়া, গরু আর ছাগলগুলো তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছে। নদীর কিনারে সার বেধে পড়ে আছে ওদের মরদেহ।
প্লেগ ও ভোগান্তি! সময়ের আদিতেও এমন কিছু কখনও কেউ কল্পনা করেনি, ফিসফিস করে বলল তাইতা।
কিন্তু এটা কেবল একটামাত্র প্লেগ নয়, ম্যাগাস, গোঁয়ারের মতো বলে চলল মেরেন। নীলের রক্তাক্ত পুকুর থেকে কুকুরের মতো বিশাল আর ক্ষিপ্র কাঁটাঅলা ব্যাঙ উঠে এসেছে। ওদের বিষাক্ত শরীর ঢেকে রাখা ফুসকুড়ি থেকে দুর্গন্ধময় বিষ চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে। মড়া পশুগুলো খেয়ে নিচ্ছে ওরা। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। লোকে বলছে, মহান হোরেস যেন ক্ষমা করেন, দানবগুলো বাচ্চা আর বয়স্ক দুর্বল লোক, আর যাদের নিজেদের বাঁচানোর ক্ষমতা নেই, তাদেরও আক্রমণ করছে। আর্তনাদ ছেড়ে মোচড় খাওয়ার সময়ই গিলে নিচ্ছে ওদের। থেমে লম্বা শ্বাস নিল মেরেন। কী ঘটছে এই দুনিয়ায়? আমাদের উপর একি ভয়ানক অভিশাপ নেমে এলো, মহান ম্যাগাস?