ঝর্নার কাছে ওদের উপস্থিতিতে ঘোড়াগুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অচিরেই তাইতাকে কয়েক কদম কাছে আসার সুযোগ করে দিল ওরা, কিন্তু তারপরই মাথা ঝাঁকিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। সদ্য পাওয়া অন্তর্চক্ষুর ক্ষমতায় প্রতিটি ঘোড়ার আভা নিরীখ করল ও।
নিচু জাতের প্রাণীদের ঘিরে রাখা আভা মানুষের আভার মতো তীব্র না হলেও সুস্থ ও শক্তিশালী এবং পেশল ও হৃদয়বান ঘোড়াগুলোকে আলাদা করতে পারল ও। ওদের মেজাজ আর অবস্থাও যাচাই করল। কোনগুলো মাথা গরম, বা বেপরোয়া আর কোনগুলো কোমল ও বশ মানানোর উপযোগী সেটা স্থির করা গেল। বাগানের গাছগুলোর বড় হতে কয়েক সপ্তাহ সময় নিল। এই সময় পাঁচটা পশুর সাথে পরীক্ষামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলল ও। সবকটাই উন্নত বুদ্ধিমত্তা, শক্তি ও আন্তরিক মানসিকতার। ওগুলোর তিনটে মাদী ঘোড়া, বাচ্চাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে পায়ের কাছে। বাকি দুটো বাচ্চা, এখনও স্ট্যালিয়নগুলোর সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে বটে কিন্তু লাথি হাঁকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে ওদের আগে বাড়া ঠেকাচ্ছে। একটা বিশেষ বাচ্চা ঘোড়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করছে তাইতা।
ছোট্ট পালটাও ওর মতো আকৃষ্ট হতে শুরু করেছে। ওদের কবল থেকে বাগান বাঁচাতে মেরেনের দেওয়া বেড়ার কাছে ঘুমাচ্ছে ওরা। ব্যাপারটা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে মেরেনকে। মেয়ে মানুষদের চেনা আছে আমার, ওই কুটিল মাদীগুলো বিশ্বাস করতে পারছি না। সাহস সঞ্চয় করছে ওরা। একদিন সকালে উঠে দেখব আমাদের বাগানের আর কিছুই বাকি নেই। বেশির ভাগ সময়ই বেড়াটাকে আরও মজবুত করা আর আগ্রাসীভাবে পাহারা দেওয়ার পেছনে ব্যয় করছে ও।
তাইতাকে ফসলের অংশ কাঁচা সীমের খানিকটা একটা ব্যাগে ভরে সেগুলো পটের কাছে আনার বদলে ছোট্ট পালটা যেখানে বসে আগ্রহের সাথে জরিপ করছিল সেখানে নিয়ে যেতে দেখে রীতিমতো ভীত হয়ে উঠল মেরেন। নিজের জন্যে পছন্দ করা বাচ্চা ঘোড়াটা ধোঁয়াটে ধূসর ছোপঅলা ক্রিম রঙা। তাইতাকে আগের চেয়ে ঢের কাছে যাবার সুযোগ দিল ওটা, দুই কান খাড়া করে ওর আদুরে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। অবশেষে তার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে গেল ও। মাথা নেড়ে দৌড়ে পালাল ওটা। থেমে পিছু ডাকল ওঃ তোমার জন্যে একটা উপহার ছিল, প্রিয়তমা। মিষ্টি মেয়ের জন্যে মিষ্টি। ওর কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটা। মুঠো ভর্তি সীম বাড়িয়ে ধরল তাইতা। ঘাড়ের উপর দিয়ে ওর দিকে তাকাল ঘোড়াটা। চোখ পাকাল, চোখের পাতার গোলাপি কিনারা বেরিয়ে পড়ল। সীমের গন্ধ শুঁকতে নাক ফোলাল তারপর।
হ্যাঁ, সুন্দরী জানোয়ার, স্রেফ গন্ধ শুকো। কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবে আমাকে?
নাক দিয়ে একটা শব্দ করল ঘোড়াটা, সিদ্ধান্তহীনতায় মাথা দোলাল।
আচ্ছা, ঠিকাছে। নিতে না চাইলে মেরেন খুশি হয়েই নিজের পটে রাখবে এগুলো। বেড়ার দিকে ঘুরে দাঁড়াল ও। কিন্তু এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। গভীর মনোযোগের সাথে পরস্পরকে মাপল ওরা। ওর দিকে এক পা বাড়াল ঘোড়াটা। আবার থমকে দাঁড়াল। মুখের কাছে হাত এনে একটা সীম দাঁতের ফাঁকে রেখে মুখ খোলা রেখে চিবুল তাইতা। কি যে মজা বলে বোঝাতে পারব না, ওকে বলল ও। অবশেষে হার মানল ওটা। কাছে এসে নিপূণভাবে বাটির মতো করে ধরা হাত থেকে সীম তুলে নিল। মখমলের মতো নাকটা, নিঃশ্বাসে লেগে আছে নতুন ঘাসের গন্ধ। তোমাকে কী নামে ডাকব? ওকে জিজ্ঞেস করল তাইতা। তোমার সৌন্দর্যের সাথে মানানসই হতে হবে। আহ! তোমার উপযুক্ত নাম পেয়েছি। তোমার নাম হবে উইন্ডস্মোক।
পরের সপ্তাহগুলোয় জমিতে নিড়ানি দিল তাইতা ও মেরেন। তারপর পাকা সীম তুলে জলো ইঁদুরের চামড়ায় বানানো বস্তায় তুলে রাখল। রোদ-হাওয়ায় লতা শুকিয়ে বান্ডিল বানাল। বেড়ার উপর দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াগুলো, তাইতার দেওয়া সীমের লতা চিবুচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় শেষবারের মতো উইন্ডস্মোককে একমুঠো সীম দিয়ে ওটার ঘাড়ে হাত তুলে কেশরে বিলি কাটল তাইতা, মৃদু স্বরে কথা বলল ওটার সাথে। তারপর কোনওরকম তাড়াহুড়ো ছাড়াই টিউনিকের স্কার্ট তুলে হাড়জিরজিরে পায়ে ওটার পিঠে চেপে বসল। মহাবিস্ময়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল ঘোড়াটা, কাঁধের উপর দিয়ে দেখছে তাইতাকে, চোখজোড়া চিকচিক করছে। পায়ের আঙুলে ওটাকে গুঁতো দিল তাইতা, পশুটা এগোতে শুরু করল, ওদিকে মহা আনন্দে চিৎকার ছেড়ে হাত তালি দিল মোরেন।
ওরা পুকুর পারের শিবির ত্যাগ করার সময় উইন্ডস্মোকের পিঠে রইল তাইতা, মেরেন চালাচ্ছে অন্য একটা পুরোনো মেয়ার। ওদের মালসামান পিছনে মাস ঘোড়াগুলোর পিঠে বোঝাই করা।
এভাবে বিদায় নেওয়ার সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারল ওরা। কিন্তু গালালায় পৌঁছালো যখন, ততদিনে সাত বছর পার হয়ে গেছে। ওদের ফেরার খবর রাষ্ট্র হওয়ামাত্র আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল গোটা শহরে। নগরবাসীরা অনেক আগেই ধরে নিয়েছিল ওরা মরে গেছে। সবাই যার যার পরিবার নিয়ে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে হাজির হলো। ওদের সম্মান দেখাতে ছোটখাট উপহার রয়েছে সবার কাছে। ওদের দূরে থাকার সময় অধিকাংশ বাচ্চাই বেড়ে উঠেছে। অনেকের বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে। বাচ্চাদের আদর করল তাইতা, আশীর্বাদ করল।