আপনিও না, জবাব দিল সুমনা। কোনও মোহন্তই বিলোয় না। এটাই আমাদের পরস্পরের কাছে পরিচয় দেওয়ার নিশ্চিত উপায়।
তুমি আমার চেয়ে অনেক প্রাজ্ঞ।
প্রজ্ঞার জন্যে আপনার আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতা আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে যাওয়ায় আপনি কুশলীদের চূড়ান্ত অবস্থানের ঠিক আগের জায়গায় পৌঁছে গেছেন। এখন আপনি যেখানে আছেন, আর মাত্র একটি পর্যায় আছে এরপর। সেটা হচ্ছে দয়াময় অমরত্ব।
রোজই নিজেকে আরও শক্তিশালী বোধ করছি। আগের চেয়ে পষ্টভাবে আহ্বান শুনতে পাচ্ছি। একে উপেক্ষা করা যাবে না। তোমাদের ছেড়ে যেতেই হচ্ছে আমাকে।
হ্যাঁ, আমাদের সাথে আপনার অবস্থানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সায় দিল সুমনা। আমাদের আর কখনও দেখা হবে না, তাইতা। দুঃসাহসই যেন আপনার সাথী হয়। অন্তর্চক্ষু আপনাকে পথ দেখাক।
*
পুকুর ধারের তাঁবুতে আস্ত্রাতা ও উ লুর সাথে ছিল মেরেন। দৃঢ় পদক্ষেপে নতাইতাকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে চট করে কাপড়ের দিকে হাত বাড়াল ওরা। পোশাক পরে নিল। তানসিদ রয়েছে ওর পাশে। এই প্রথম যেন তাইতার পরিবর্তনের মাত্রাটুকু ধরতে পারল ওরা। এখন আর বয়সের ভারে নুয়ে নেই ও, দীর্ঘ, ঋজু ভঙ্গি, শক্তিশালী। ওর মাথার চুল আর দাড়িতে এখনও রূপালি আভা থাকলেও আগের চেয়ে ঢের ঘন, ঝলমলে মনে হচ্ছে। ওর চোখজোড়া এখন আর ম্লান, আবছা নয়, বরং পরিষ্কার, স্থির। এমনকি ন্যূনতম কল্পনাপ্রবণ মেরেনও এইসব পরিবর্তন ধরতে পারছে। ছুটে গিয়ে তাইতার সামনে নত হলো ও। নিঃশব্দে ওর পা জড়িয়ে ধরল। ওকে তুলে আলিঙ্গন করল তাইতা। তারপর সামনে ধরে সতর্কভাবে যাচাই করল। মেরেনের আভা যেন গাঢ় কমলা রঙের, মরুর বুকে ভোরের মতো। সৎ যোদ্ধার আভা, বীর ও সত্যিকারের যোদ্ধা। তোমার অস্ত্রশস্ত্র নাও, সৎ মেরেন, কারণ এবার আমাদের বিদায় নিতে হচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে মাটির সাথে যেন সেঁটে রইল মেরেন। কিন্তু পরক্ষণে আস্ত্রাতার দিকে চোখ ফেরাল।
ওর আভা যাচাই করল তাইতা। তেলের লণ্ঠনের স্থির শিখার মতো, পরিষ্কার, নির্মল। কিন্তু সহসা শিখাটাকে কেঁপে উঠতে দেখল ও। তারপর বিদায়ের বেদনা কাটিয়ে উঠতেই ফের স্থির হয়ে গেল। ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মন্দিরের আবাসিক এলাকায় চলে গেল মেরেন, খানিক পরে ফিরে এল আবার। কোমরে সোর্ডবেল্ট বেঁধে নিয়েছে, বাম কাঁধে ঝুলছে তীর ধনুক। তাইতার বাঘের ছালের জোব্বা গোল করে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে।
মেয়েদের এক এক করে চুমু খেল তাইতা। তিন অপ্সরার নৃত্যরত আভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ও। উ লু রূপালি মেঘের আড়ালে আবৃত হয়ে গেছে, তাতে কাঁপা
সোনালি রঙের ছোপ, অনেক জটিল, আস্ত্রাতার আভার চেয়ে গভীর। কুশলীদের পথে আরও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে সে।
তানসিদের আভা মদের বাটিতে ভেসে বেড়ানো মূল্যবান তেলের পর্দার মতো মুক্তো যেন, বারবার রঙ আর ভাব বদলাচ্ছে, আলোর নক্ষত্র ছুঁড়ে দিচ্ছে। ওর আত্মা মহান, মনটা খুবই ভালো। নিজেকে কখনও সুমনার বাঁশ–সূঁচের খোঁচার নিচে যেতে দেবে কিনা ভাবল তাইতা। ওকে চুমু খেল। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বলতর ঝলকে কেঁপে উঠল ওর আভা। অল্প কদিনের পরিচয়ে আত্মার অনেক কিছুই বিনিময় করেছে ওরা। মেয়েটা ওকে ভালোবেসে ফেলেছে।
তোমার নিয়তি পূরণ হোক, ওদের ঠোঁট বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় ফিসফিস করে বলল তাইতা।
আমি মন থেকে জানি আপনি আপনার নিয়তি পূরণ করবেন, ম্যাগাস, কোমল কণ্ঠে জবাব দিল সে। আপনার কথা কোনওদিন ভুলব না আমি। সহজাতভাবে ওর গলা জড়িয়ে ধরল। আহা, ম্যাগাস, আমি যদি…কী যে ইচ্ছে করছে…
জানি কী ইচ্ছে করছে। ভালোই হতো সেটা, আস্তে করে বলল তাইতা। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার সম্ভব নয়।
মেরেনের দিকে ফিরল ও। তুমি তৈরি?
আমি তৈরি, ম্যাগাস, বলল মেরেন। আপনি পথ দেখান, আমি আসছি।
*
উল্টোপথে এগোল ওরা। চূড়ার কাছে যেখানে চিরন্তন হাওয়া বিলাপ করে ফিরছে অসেখানে পাহাড়ে উঠে তারপর বিশাল পাহাড়ি পথের গোড়াতে হাজির হলো, সেপথ ধরে এগোল পশ্চিমে। সমস্ত বাঁক ও মোড়, প্রতিটি চড়াই, পাস ও বিপজ্জনক ফোর্ড মনে আছে মেরেনের, ফলে সঠিক পথের খোঁজ করতে গিয়ে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করল না ওরা, দ্রুত আগে বাড়ল। আবার একবাতানার হাওয়াখেলানো প্রান্তরে পৌঁছুল ওরা, বুনো ঘোড়ার বড় বড় পাল দাবড়ে বেড়ায় এখানে।
প্রথম আগ্রাসী হিকস্স বাহিনীর সাথে মিশরে আবির্ভাব ঘটার পর থেকেই অসাধারণ পশুগুলোর সাথে খাতির জমে গিয়েছিল তাইতার। শত্রুপক্ষের কাছ থেকে ওগুলোকে বন্দি করে ও, ফারাও মামোসের জন্যে ওর নকশা করা রথে জুততে প্রথম দলটাকে পোশ মানায়। এই সেবার বিনিময়ে ওকে দশ সহস্র রথের প্রভু উপাধি দিয়েছিলেন ফারাও। ঘোড়ার প্রতি তাইতার ভালোবাসা অনেক দিনের পুরোনো।
ঘেসো প্রান্তর হয়ে যাবার পথে উঁচু কঠিন পাহাড়ী পথ বেয়ে নেমে আসার পর ঘোড়ার পালের মাঝে থাকবার জন্যে বিরতি দিল ওরা। ঘোড়ার পাল অনুসরণ করে একটা মলিন, বৈশিষ্ট্যহীন ল্যান্ডস্কেপের মুখোমুখি হলো। গোপন একটা উপত্যকা, পরিষ্কার মিষ্টি পানি বুকে নিয়ে প্রাকৃতিক ঝর্নার একটা ধারা বয়ে চলেছে ওটার পাশ দিয়ে। উন্মুক্ত প্রান্তরকে ক্ষয়ে দেওয়া চিরন্তন হাওয়া অবশ্য ছায়া ঢাকা জায়গাগুলোতে পৌঁছেনি, ঘাস এখানে সবুজ, রসালো। অনেক ঘোড়া দেখা যাচ্ছে এখানে। ওদের উপভোগ করতে ঝর্নার ধারে শিবির খাটাল তাইতা। ঘাসো মাটি দিয়ে একটা কুঁড়ে বানাল মেরেন। শুকনো গোবর জ্বালানি হিসাবে কাজে লাগাল ওরা। পুকুরে মাছ আর জলো ইঁদুরের ছড়াছড়ি। ফাঁদ পেতে ওগুলো ধরল মেরেন, ওদিকে ভেজা জমিনে খাবার উপযোগি শ্যাওলা আর শেকড়ের সন্ধান করল তাইতা। ওদের কুঁড়ের চারপাশে, ঘোড়াগুলো যাতে মাড়িয়ে না দেয়, এমন কাছাকাছি দূরত্বে সরস্বতীর মন্দির থেকে আনা কিছু বীজ ছড়িয়ে দিল ও। বেশ ভালো ফসল ফলাল। বিশ্রামে সুস্থ হয়ে উঠল ওরা, পরের কঠিন যাত্রার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করছে।