থিবস থেকে এত দূর আসতে অনেক কষ্ট হলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি। সন্ধ্যায় আমাদের শিবিরের সবার মাঝে বেশ উত্তেজনা, উদ্দীপনা জেগে উঠলো।
জারাস তার সবচেয়ে চৌকশ দুইজন লোকের উপর অন্যান্য জাহাজের নেতৃত্বের ভার দিয়েছিল। প্রথমজনের নাম দিলবার। দীর্ঘদেহী সুন্দর চেহারার এই লোকটির পেশিবহুল, শক্তিশালী দুটি হাত ছিল। প্রথম সাক্ষাতেই সে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল আর আমিও তাকে পছন্দ করেছিলাম। তার কালো চোখদুটো তীব্ৰভেদী হলেও ডানদিকের গালে আড়াআড়িভাবে তলোয়ারের একটা দগদগে ক্ষত ছিল। এতে অবশ্য তার সুন্দর চেহারায় বিরূপ প্রভাব রাখেনি। সে কোনো আদেশ দিলে লোকজন সাথে সাথে তা পালন করতো।
তৃতীয় জাহাজের অধিনায়ক ছিল গাট্টাগোট্টা চেহারার বৃষকন্ধ এক লোক। এর নাম আকেমি। হাসিখুশি এই লোকটি উচ্চকণ্ঠে কথা বলতো। তার পছন্দের হাতিয়ার ছিল লম্বা হাতলওয়ালা একটা কুঠার। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর আকেমি আমার কাছে এলো।
আমাকে অভিবাদন করে সে বললো, প্রভু তায়তা। লোকজন আমাকে বলেছে আজ রাতে আপনি কি গান গেয়ে আমাদেরকে সম্মানিত করবেন? প্রথম প্রথম লোকজন আমাকে এই সম্বোধন করায় আমি মৃদু প্রতিবাদ করেছিলাম, কেননা আমি এর যোগ্য নই। কিন্তু কেউ তা মানেনি আর আমিও আর এরপর থেকে বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি।
আমার কণ্ঠস্বর ছিল অসাধারণ আর আমার হাতের আঙুলে বীণাও প্রায় স্বর্গীয় সুর নিয়ে বাজতো। আমি খুব কমই এ-ধরনের অনুরোধ ফিরিয়ে দিতাম।
সেই রাতে তামিয়াত যুদ্ধের আগে আমি তাদের জন্য বেছে নিলাম রানি লসট্রিসের শোকসঙ্গীত। এটা ছিল আমার বিখ্যাত একটি রচনা। আমার চারপাশে সবাই আগুন ঘিরে বসলো। আমি পুরো ১৫০টি চরণই গেয়ে শোনালাম। ওদের মধ্যে যারা ভালো গান গাইতো ওরা আমার সাথে কোরাসে গলা মেলাল আর অন্যরা গুণগুণ করলো। গানের শেষে সবার চোখ সজল হল। আমার চোখের জল অবশ্য আমার গান গাওয়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটায় নি।
.
পরদিন ভোরে প্রথম আলো ফোঁটার সাথে সাথেই আমাদের শিবিরে কর্মচাঞ্চল্য জেগে উঠলো। এখন আমাদের লোকজন বেদুঈন পোশাক আর মাথার আবায়া খুলে হাইকসো উর্দি, বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্রভরা গাটরি খুললো। বর্মটি মূলত চামড়ার তৈরি তবে শিরস্ত্রাণটি ছিল ব্রোঞ্জের আর নাকের উপরিভাগ ধাতুর টুকরা দিয়ে ঢাকা। প্রত্যেকে একটা করে শক্তিশালী বাঁকা ধনুক আর তূণ ভর্তি চকমকি পাথরের মাথাওয়ালা তীর নিয়ে সজ্জিত হল। তীরগুলোর গোড়ায় হাইকসো রীতিতে বিভিন্ন রঙের পালক লাগানো ছিল। তলোয়ারগুলো পিঠের খাপে ভরা ছিল, হাতল ছিল উপরের দিকে যাতে সহজে হাত দিয়ে টেনে বের করা যায়। তলোয়ারের পাতগুলো মিসরীয় তলোয়ারের মতো সোজা ছিল না, এগুলো প্রাচ্যের রীতিতে বাঁকা ছিল।
বর্ম আর অস্ত্রগুলো খুব ভারী ছিল আর প্রচণ্ড রোদে খুব গরম হয়ে যাওয়ায় এগুলো পরে দাঁড় বাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। কাজেই আমাদের। লোকেরা পরনের কাপড় খুলে শুধু লেঙটি পরলো আর যুদ্ধের পোশাক-আশাক সবকিছু পায়ের কাছে ডেকে বিছিয়ে রাখলো।
এদের বেশিরভাগেরই গায়ের রঙ ফর্সা আর চুল সোনালি। আমি ওদের সকলকে বলালাম চুলার ছাই নিয়ে মুখে আর দাড়িতে মেখে নিয়ে কালো করতে যাতে ওদের দেখে হাইকসো সৈন্য মনে হয়।
তিনটি জাহাজ সৈকত থেকে উপসাগরের পানিতে ভাসলো। আমি জারাসের সাথে সবার আগের জাহাজে থাকলাম। কাণ্ডারীর পাশেই দাঁড়ালাম, সে লম্বা হাতটা ধরেছিল। উশু বন্দরে যে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জাহাজগুলো কিনেছিলাম, তার কাছ থেকে একটা প্যাপিরাস মানচিত্রও সাথে নিয়েছিলাম। এতে জেবেল আর ওয়াদি আল নিলামের মাঝে মধ্য সাগরের দক্ষিণাংশের বিশদ বিবরণ তুলে ধরা ছিল। লোকটি দাবী করেছিল সে তার প্রত্যক্ষ
অভিজ্ঞতা থেকে নিজ হাতে মানচিত্রটি তৈরি করেছে। মানচিত্রটা ডেকে বিছিয়ে চারকোণায় চারটি নুড়ি পাথর দিয়ে চাপ দিলাম। আর সাথে সাথে সৈকতের কিছু বৈশিষ্ট দেখে মানচিত্রের সাথে মেলাতে পারলাম। দেখে মনে হল মানচিত্রটা নিভরযোগ্য।
সকালে দুইবার আমরা দিগন্ত রেখার কাছে অন্যান্য জলযানের পাল দেখতে পেলাম। তবে আমরা সরে গিয়ে ওগুলোকে চলে যাওয়ার সুযোগ দিলাম। তারপর সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর তখন জাহাজের সামনের গলুই থেকে দাঁড়ি চিৎকার করে সকলকে সাবধান করে সামনের দিকে দেখাল। আমি চোখে হাত দিয়ে রোদ ঢেকে সে যেদিকে দেখিয়েছিল সেদিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম দিগন্তজুড়ে সাগরের পানি সাদা হয়ে ভারী ঝড়ো বাতাসের মতো আমাদের উপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু এখনতো ঝড়ের ঋতু নয়।
আমি জারাসকে বললাম, পাল নামিয়ে ফেলতে বল! দাঁড়গুলো তুলে ভেতরে রেখে নোঙর তৈরি করে রাখতে বল।
প্রচণ্ড বেগে পানি আমাদের দিকে ছুটে আসছিল। বাতাসের ধাক্কা সামলাবার জন্য আমরা তৈরি হলাম। সাদা পানি প্রচণ্ড গর্জন করে এদিকে ছুটে আসছে। আমি শক্ত হাতে নৌকার একপাশ ধরে থাকলাম। সাগরের ঢেউ পাটাতনের উপর আছড়ে পড়লো। লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি আর জাহাজের দুইধারে ঢেউ ভেঙে পড়ার হট্টগোলে কানে তালা লেগে গেল। কিন্তু কোন হাওয়া নেই দেখে অবাক হলাম। সাথে সাথে আমার মনে হল হাওয়া ছাড়া ঝড় মানে নিশ্চয়ই অতিপ্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার। এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য আমি চোখ বুজে মহান দেবতা হোরাসের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।