আমি তাকে নিজের পছন্দ মত লোক বেছে নেবার সুযোগ দিয়েছিলাম। শুধু একটা বিষয়ে জোর দিয়েছিলাম, আর তা হল যাদেরকে সে পছন্দ করবে তাদের প্রত্যেককে হাইকসো ভাষা জানতে হবে। হাইকমোরা যখন দক্ষিণ মিসর আক্রমণ করেছিল তখন জারাস খুব ছোট ছিল, তাই সে অন্যান্যদের সাথে নির্বাসনে নুবিয়ায় যায়নি। প্রকৃতপক্ষে তার যখন ষোল বছর বয়স তখন তাকে জোর করে হাইকসো সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল। ফলে সে এত চমৎকার হাইকসো ভাষায় কথা বলতে শিখেছিল যেন সে তাদেরই একজন। যাইহোক সে একজন প্রকৃত মিসরী ছিল। আর তাই ফারাও ত্যামোস যখন আমাদের সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে জলপ্রপাতের মধ্য দিয়ে এসে থিবসের যুদ্ধে হাইকসোদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেন, তখন সেই প্রথম তার আসল
জাতির কাছে ফিরে আসে।
জারাস যে লোকগুলোকে বেছে নিয়েছিল, তারা বেশিরভাগই তার অধীনস্থ প্রশিক্ষিত এবং কুশলী যোদ্ধা ছিল। তারা যেমন নাবিক ছিল তেমনি যোদ্ধাও ছিল। আর যখন ওরা যুদ্ধের রথ টানতো না তখন নদীর বুকে নৌযোদ্ধা হিসেবে সময় কাটাত। জারাসের তাদেরকে আর কিছুই শেখাবার বাকি ছিল না।
আমি তাকে বললাম লোকগুলোকে পনেরো বিশজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে নিতে, যাতে থিবস শহর থেকে বের হবার সময় কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না হয়।
নগরের মূল ফটকে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহর দেখাতেই প্রহরীদলের অধিনায়ক আমাকে কোনো প্রশ্ন করলো না। পরপর তিন রাত ধরে জারাসের বাহিনীর লোকগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শহর থেকে বের হয়ে পূর্বদিকের জঙ্গলের দিকে চললো। ওরা প্রাচীন আকিতা নগরীর ধ্বংসাবশেষ এলাকায় এসে আমার সাথে মিলিত হল। আমি ওদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলাম।
আমি সেখানে কয়েকগাড়ি বোঝাই আসল হাইকসো শিরস্ত্রাণ, বর্ম, যুদ্ধের পোশাক আর অস্ত্র এনে রেখেছিলাম। থিবসের যুদ্ধে শত্রুর কাছ থেকে আমরা যেসব যুদ্ধ উপকরণ দখল করেছিলাম, এগুলো তার সামান্য কিছু অংশ ছিল।
আকিতা থেকে পুবে লোহিত সাগরের উত্তরদিকের শেষ মাথায় সুয়েজ উপসাগরের সৈকতের দিকে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। উর্দি আর অস্ত্রের উপর সবাই বেদুইন আলখাল্লা পরে নিল।
জারাস আর আমি ঘোড়ায় চড়ে মূল দলের আগেই রওয়ানা দিয়েছিলাম। আমরা দুজন উপসাগরের সৈকতে আল নাদাস নামে একটি ছোট্ট জেলে পল্লীতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, দলের বাকিরা সেখানে এসে আমাদের সাথে যোগ দিল।
জারাস তার পূর্বপরিচিত বিশ্বস্ত একজন পথপ্রদর্শক নিযুক্ত করেছিল। লোকটির নাম আল-নামজু। একচোখবিশিষ্ট দীর্ঘদেহী লোকটি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতো। সে আল নাদাসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমাদেরকে পুবদিকের সৈকতে নিয়ে যাবার জন্য আল-নামজু গ্রামের সমস্ত মাছ ধরা নৌকা ভাড়া করেছিল। এই জায়গায় উপসাগর বিশ লিগেরও কম চওড়া, আমরা ওপারে সিনাই এলাকার নিচু পাহাড়গুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।
রাতে তারার আলোয় পথ দেখে ওপারে গেলাম। উপসাগরের পূর্বসৈকতে আরেকটা ছোট জেলে পল্লীর কাছে পৌঁছলাম। জুবা নামে এই গ্রামটিতে আল নামজুর ছেলেরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভারী মালপত্রগুলো বহন করার জন্য ওরা একশো গাধা ভাড়া করেছিল। উত্তরদিকে মধ্যসাগরে পৌঁছাতে আমাদেরকে আরও দুইশো লিগ পথ হেঁটে যেতে হবে। তবে আমাদের লোকেরা যে কোনো পরিস্থিতিতে চলার মতো প্রশিক্ষিত ছিল, কাজেই আমরা দ্রুত চলতে শুরু করলাম।
হাইকসো সেনাচৌকি এড়াতে আল নামজু আমাদেরকে নিয়ে আফ্রিকা আর এশিয়ার সংযোগকারী সিনাই যোজকের পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করলো। শেষপর্যন্ত আমরা মধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরের ফোনিশিয় বন্দর উশুর কাছে পৌঁছলাম। এই স্থানটি সুমেরিয় সীমান্ত আর হাইকসো হানাদারদের অধিকৃত উত্তর মিসরের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থানে ছিল।
বন্দরের বাইরে জারাস আর তার লোকজনদের রেখে আমি দুটি গাধার পিঠে শস্য আর গমের চামড়ার থলেতে সোনার বাট লুকিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। সাহায্য করার জন্য সাথে চারজন লোক বেছে নিলাম। বন্দরের বণিকদের সাথে তিনদিন দরকষাকষির পর তিনটি মাঝারি মাপের একতলা পাল তোলা জাহাজের ব্যবস্থা করলাম। জাহাজ ফোনিশিয় মেলকার্ট মন্দিরের নিচে সমুদ্র সৈকতে আনার ব্যবস্থা করা হল। প্রচুর অর্থ ব্যয় হল, থিবস থেকে শস্যের থলেতে লুকিয়ে আনা আর কয়েকটা মাত্র সোনার বাট অবশিষ্ট রইল।
স্থলভাগের দিক থেকে আসা হালকা বাতাস আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিল। বড়পালগুলো খাঁটিয়ে মাল্লাদের মাঝে মাঝে বিশ্রাম দেওয়া হল। আবার উশু পার হলাম, তবে এবার বিপরীত দিকে। আমি নৌকাগুলো দিগন্তসীমার নিচে আর বন্দরের নজরের বাইরে রাখার চেষ্টা করলাম।
এক একটা নৌকায় সত্তর জনেরও বেশি মানুষ বসলেও আমরা বেশ দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চললাম। পরদিন বিকেলে আমি হিসাব করে দেখলাম তামিয়াতের ক্রিট দুর্গ সামনে একলিগেরও কম দূরত্বে রয়েছে।
আমি অবশ্য জারাসের সাথে সামনের নৌকাতেই ছিলাম। এবার তাকে জানালাম যেহেতু উশু অনেক পেছনে ফেলে এসেছি, কাজেই এখন আমরা সবাই কাছাকাছি হয়ে সৈকতের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই থাকতে পারি। কেননা স্থলভূমি দেখে আমার পক্ষে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে নৌকা চালানো সুবিধা ছিল। শেষবেলায় সূর্য সামনের সাগরের পানি ছুঁতেই আমি কান্ডারীকে একটা নির্জন বালুকাবেলা দেখালাম। নৌকার তলভাগ মাটি ছুঁতেই লোকজন লাফিয়ে নেমে বালুর উপর দিয়ে নৌকাটি টেনে নিয়ে গেল।