শক্ৰমিত্র কেউই যাতে আমাদের দেখতে কিংবা আমাদের কথা শুনতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য বারান্দার দুই মাথায় প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে। এরা বিশ্বস্ত কর্মকতার সরাসরি অধীনস্থ ছিল, তবে এরা ফারাও আর আমার দৃষ্টির আড়ালে অবস্থান নিয়েছিল। মার্বেল পাথরে ছাওয়া পায়ে চলা পথ দিয়ে আমরা পায়চারি করছিলাম। এখন যেহেতু আমরা দুজন একা, তাই তার কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে চলা আমার জন্য সম্ভব ছিল। কেননা তার জন্ম মুহূর্ত থেকেই আমি তার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম।
প্রকৃতপক্ষে আমার হাতেই তার জন্ম হয়। যখন রানি লসট্রিস এক টানে তাকে গর্ভ থেকে বের করে আনেন তখন আমিই প্রথম এই নবজাত শিশুর দেহটি হাতে ধরেছিলাম। আর প্রথম যে কাজটি এই রাজকুমার করেছিলেন, তা হল আমার গায়ে প্রস্রাব করা। এই কথা মনে পড়তেই আমি মৃদু হাসলাম।
সেদিন থেকেই আমিই ছিলাম তার শিক্ষক এবং গুরু। আমিই তাকে শিখিয়েছিলাম কীভাবে শৌচকর্ম করতে হয়, তারপর লেখাপড়া, তীর ঘোড়া আর যুদ্ধরথ চালনা শিখিয়েছিলাম। আমার কাছ থেকেই তিনি শিখেছেন কীভাবে একটি জাতিকে শাসন করতে হয়। অবশেষে এখন তিনি একজন চমৎকার যুবক, সাহসী ও বলবান যোদ্ধা আর এই মিসরের একজন পরিশীলিত শাসক হয়েছেন। তবে আমরা এখনও খুব ভালো বন্ধু। অন্তত এতটুকু আমি বলতে পারি, ফারাও আমাকে একজন পিতার মতো ভালোবাসেন, যে পিতাকে তিনি কখনও দেখেননি। আর আমিও তাকে সেই পুত্রের মতো ভালোবাসি যে পুত্র আমার কখনও ছিল না।
শত্রুসৈন্যকে বোকা বানাবার জন্য আমি যে কৌশল উদ্ভাবন করেছি, তার বিবরণ শুনতে শুনতে তিনি পায়চারি করা থামিয়ে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমার বলা শেষ হলে তিনি তার ইস্পাত কঠিন হাত দিয়ে আমার দুই কাঁধ চেপে ধরলেন। তলোয়ার ঘুরিয়ে, তীর ছুঁড়ে আর একটি চার ঘোড়ার রথের লাগাম সামলিয়ে তার হাতদুটো কঠিন আর ব্রোঞ্জের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, তায়তা, তুমি একটি বুড়ো পাজির পা ঝাড়া! সবসময় আমাকে অবাক করে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ এ-রকম সাংঘাতিক পরিকল্পনা করতে পারে না। আমার মনে আছে যখন তুমি আমাকে হাইকসো ভাষা শেখার জন্য জোরজবরদস্তি করেছিলে তখন আমার খুব রাগ হয়েছিল; আর এখনতো এটা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। এ-ধরনের অভিযানে আমাদের শত্রুদের একজন হিসেবে চলতে না পারলে তো আমি কখনও এই অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারতাম না।
এরপর আমার কয়েকঘন্টা লাগলো তাকে বুঝাতে যে ইতিহাসের এরকম চরম একটি মুহূর্তে একজন নেতার মিসর ছেড়ে যাওয়াটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে আর তামিয়াতে মিনোজের দুর্গ দখল কিংবা সেখানকার সম্পদের চেয়ে তার দেশে থাকাটা অনেক জরুরী। আমি হোরাসকে ধন্যবাদ দিলাম এজন্য যে, তার বয়স কম হওয়ায় তার মত বদলাতে অসুবিধা হয় না, আবার অন্যদিকে ভালোমন্দ বুঝার মতো বয়সও তার হয়েছে। অনেক আগে থেকে আমি শিখেছি কীভাবে তাকে বুঝতে না দিয়ে তার মত আমার দিকে ফেরাতে হয়। পরিশেষে প্রত্যেকবারই আমি আমার মতো করতে পারি।
যাইহোক আমার প্রস্তাব মতো ফারাও জারাসকেই এই অভিযানে নেতৃত্ব দিতে নির্দেশ দিলেন। ফারাওয়ের মতো জারাসের বয়সও মাত্র পঁচিশ বছর হলেও–সে ইতিমধ্যেই তার সামরিক পদবী অনুযায়ী যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। আমি ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার তার সাথে কাজ করেছি এবং জানতে পেরেছি যে তার সুনাম যথার্থ। সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে শ্রদ্ধা করে।
যাইহোক বিদায় নেবার আগে ফারাও ত্যামোস আমার হাতে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহরটা তুলে দিলেন। এর মানে হচ্ছে এটি বহনকারীর হাতে ফারাও তার পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দিচ্ছেন। এই সীলমোহর যার হাতে থাকবে সে কেবল ফারাওকে জবাবদিহি করবে। রাজকীয় দায়িত্ব পালনকালে কোনো মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হলেও সীলমোহরধারীকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে কিংবা তার কাজে বাধা দিতে পারবে না।
প্রথানুযায়ী ফারাও কেবলমাত্র যথাযথ পবিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজদরবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে কারও হাতে এই সীলমোহর তুলে দেন। তবে আমি বুঝতে পারলাম এ-ধরনের একটি সংবেদনশীল বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ গোপনীয়তার মধ্যে এটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাইহোক আমার প্রতি তার এই আস্থা দেখানোর কারণে আমি অত্যন্ত বাধিত হলাম।
হাঁটুগেড়ে বসে তার সামনে মাটিতে কপাল ঠেকালাম। তবে ফারাও নিচু হয়ে আমাকে ধরে দাঁড় করালেন।
তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আমাকে কখনও বিফল করনি, তায়তা। জানি এবারও করবে না।
.
আমি জারাসকে খুঁজে বের করে তাকে এই মিশনের গুরুত্ব বুঝিয়ে বললাম। আর এও বললাম ফারাওয়ের কাছে নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা তুলে ধরার এটি একটি সুযোগ। এই মিশনের সফলতা তাকে উন্নতির সোপানে দৃঢ় পদক্ষেপ রাখা আর রাজার সুনজরে থাকার পথ খুলে দেবে। আমার কথা শুনে সে অভিভূত হল।
অভিযানের জন্য আমরা দুজন মিলে দুইশোজনের একটি তালিকা ঠিক করলাম। প্রথম দিকে জারাস প্রতিবাদ করেছিল যে, এত কম লোক দিয়ে ক্রিট সেনা ছাউনির প্রায় দুই হাজার সেনার মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। তখন আমি তাকে মিশনের বিশেষ অংশটি বুঝিয়ে বললাম, যা এটন আর ফারাওকেও বলিনি। তারপর সে আমার পরিকল্পনা পুরোপুরি বুঝতে পেরে তা গ্রহণ করলো।