আমার কথাগুলো শোনার পর পুরো বিষয়টা উপলব্ধি করে এটন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল। তারপর আবার ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে তোমার কাছে প্রমাণ আছে যে, সর্বাধিরাজ মিনোজের সাথে করা প্রাথমিক মৈত্রি চুক্তি উপেক্ষা করে বিওন তামিয়াত দুর্গ আক্রমণ করবে আর সর্বাধিরাজ মিনোজের সমস্ত সম্পদ লুট করে নেবে? এই কথাই কি তুমি আমাকে বলতে চাচ্ছ তায়তা?
আমি এটা বলিনি যে, বিওন একাজ করবে তার কোনো প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমি শুধু তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি। আমি কোনো উক্তি করিনি। এবার তার হতভম্ব চেহারা দেখে আমি মুখ টিপে হাসলাম। একটু বেশি নির্দয় হয়ে গেছে, তবে দুষ্টুমিটা করা থেকে নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমাদের এতদিনের পরিচয়ে এই প্রথম দেখলাম আমার কথার পিঠে সে কিছুই বলতে পারছে না। এবার সত্যি তার জন্য আমার করুণা হল।
দেখ এটন, আমরা দুজনেই জানি বিওন একজন জংলি আনাড়ি-গেঁয়ো ভূত। সে রথ চালাতে পারে, তলোয়ার ঘোরাতে পারে, তীর ছুঁড়তে পারে আর একটা নগরে লুটতরাজ করতে পারে। তবে আমার মনে হয়, গদাইলস্করি চাল আর যন্ত্রণাদায়ক ধীরগতি ছাড়া সে গোপন কোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারবে না।
এটন বললো, তাহলে কে সর্বাধিরাজ মিনোজের কোষাগার আক্রমণ করবে? তার কথার তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিয়ে আমি টুলে আরাম করে বসে মৃদু হাসলাম। এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, নিশ্চয়ই তুমি নও তায়তা! সর্বাধিরাজ মিনোজের পাঁচলাখ রূপা লুট করার পরিকল্পনা করে কীভাবে তুমি ক্রিটের কাছে সহায়তা আর মৈত্রী আশা করবে?
আমি তাকে বললাম, অন্ধকারে কে হাইকসো আর কে মিসরী তা বুঝা বেশ কঠিন। বিশেষত মিসরীয়রা যদি হাইকসো যোদ্ধার পোশাক পরে, হাইকসো অস্ত্র হাতে নিয়ে হাইকসো ভাষায় কথা বলে। সে মাথা নাড়লো, মুখে কোনো কথা জোগাল না। তারপরও আমি আবার বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একমত হবে যে, এ-ধরনের একটা বিশ্বাসঘাতক আক্রমণের পর আমাদের বিরুদ্ধে ক্রিট আর হাইকসোদের মাঝে কোনো ধরনের সমঝোতা হবার আদৌ আর কোনো আশা থাকবে?
এবার এটন মৃদু হেসে বললো, তুমি সত্যিই খুব চতুর, তায়তা। ভাবছি তোমাকে কখনও বিশ্বাস করতে পারবো না। তারপর সে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তামিয়াতে ক্রিটের গ্যারিসন কত বড় হবে?
এ-মুহূর্তে সৈনিক আর তীরন্দাজ মিলিয়ে হাজার দুয়েক হবে। তবে এদের বেশিরভাগই ভাড়াটে সৈনিক।
এবার সে আগ্রহ দেখিয়ে বললো, আচ্ছা! তারপর একটু থেমে বললো, তোমার কত লোক লাগবে কিংবা এভাবেও বলতে পারি, বিওনের কত লোক লাগবে এই কাপুরুষচিত পরিকল্পনা কাজে লাগাতে?
আমি বাধা দিয়ে বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। সবকিছু আমি এটনকে বলতে পারি না আর সেও তা বুঝতে পেরে আর চাপাচাপি করলো না। তবে ঘুরিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করলো।
তামিয়াত দুর্গে তুমি কাউকে জীবিত রাখবে না? সবাইকে মেরে ফেলবে?
তার এই প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ওদের বেশিরভাগকেই পালিয়ে যাবার সুযোগ দেব। আমি চাই যেন বেশিরভাগ লোক ক্রিটে ফিরে গিয়ে সর্বাধিরাজ মিনোজকে বিওনের বিশ্বাসঘাতকতার কথাটা জানিয়ে তাকে সাবধান করে।
এটন বললো, আর ক্রিটের সম্পদ? ঐ পাঁচ লাখ রূপার কী হবে?
ফারাওয়ের সিন্দুক প্রায় খালিই বলা চলে। সম্পদ ছাড়া আমরা মিসরকে রক্ষা করতে পারবো না।
তারপর সে জিজ্ঞেস করলো, এই অভিযান কে চালাবে? তুমিই কি নেতৃত্ব দেবে তায়তা?
আমি চেহারায় দুঃখ নিয়ে বললাম, তুমি জানো আমি যোদ্ধা নই, এটন। আমি একজন চিকিৎসক, কবি এবং একজন শান্তিপ্রিয় দার্শনিক। যাইহোক যদি ফারাও নির্দেশ দেন তবে অধিনায়কের একজন উপদেষ্টা হিসেবে অভিযানে অংশ গ্রহণ নেবো।
তাহলে কে নেতৃত্ব দেবে? ক্রাটাস?
ক্রাটাসকে আমি পছন্দ করি, সে একজন ভালো সৈনিক। তবে লোকটা বুড়ো, মাথামোটা আর কোনো ধরনের যুক্তি কিংবা মতামতের ধার ধারে না।
এবার এটন চুক চুক করে বললো, হে শান্তিপ্রিয় কবি! তুমি জেনারেল ক্রাটাসের একেবারে সঠিক বর্ণনা দিয়েছ। সে না হলে ফারাও কাকে নিযুক্ত করবেন?
সম্ভবত জারাসকে নিযুক্ত করবেন।
ও আচ্ছা! রাজকীয় রক্ষিবাহিনীর নীল কুমির ডিভিশনের সেই বিখ্যাত ক্যাপ্টেন জারাস? তোমার পছন্দের লোক, তাই না তায়তা?
আমি তার কথায় টিটকারির সুর উপেক্ষা করে বললাম, আমার কোনো বিশেষ পছন্দের লোক নেই। তবে এই কাজের জন্য জারাস সবচেয়ে উপযুক্ত।
.
ফারাওকে আমার এই পরিকল্পনা জানালাম, কীভাবে ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের কাছে রাজা বিওনকে অবিশ্বাসি করে তোলা হবে আর দুজনের মাঝে এমন সন্দেহের বীজ ঢুকানো হবে, যার ফলে ওরা পরস্পরকে অবিশ্বাস করবে। অথচ এই দুজনই পৃথিবীতে আমাদের চরম শত্রু। আমার এই চমৎকার আর অত্যন্ত সহজ পরিকল্পনা শুনে ফারাও ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন।
আমি একান্তে তার সাক্ষাত প্রার্থনা করতেই তিনি সাথে সাথে রাজি হয়েছিলেন। আমরা দুজনে তার সিংহদরবারের চারপাশ ঘিরে থাকা দুপাশে পামগাছশোভিত চওড়া বারান্দায় হাঁটছিলাম। দক্ষিণ মিসরের নীল নদের সবচেয়ে চওড়া তীরে এর অবস্থান। অবশ্য আসিউতের পরই নদী আরও চওড়া হয়ে যখন হাইকসোদের অধিকৃত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় তখন এর স্রোত প্রবাহ ধীর হয়ে আসে। তারপর বদ্বীপের মধ্য দিয়ে নদী মধ্যসাগরে উপনীত হয়।