মধ্য এবং লোহিত সাগরের মধ্যেকার যোজকটি হাইকসোদের নিয়ন্ত্রণে ছিল আর মিসরের সাথে উত্তরে সিনাই মরুভূমির সংযোগ ছিল। সেক্ষেত্রে সুমেরিয়দের সিনাই মরুভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে আরও দক্ষিণে গিয়ে জাহাজে চড়ে লোহিতসাগর পার হয়ে আমাদের কাছে আসতে হবে। এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের সেনাবাহিনীকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে, এছাড়া পানির কষ্ট আর লোহিতসাগরে জাহাজ চলাচলের অপ্রতুলতার কথা ছেড়ে দিলেও এই পথে যাত্রা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
ইতিপূর্বে যে প্রস্তাবটি আমি ফারাওকে দিয়েছিলাম, এখন এটনকে তার কিছুটা ধারণা দিলাম, সেটা হল মিসর আর ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজের মাঝে একটি মৈত্রি চুক্তি। বংশপরম্পরায় ক্রিটের শাসকের উপাধি ছিল সর্বাধিরাজ মিনোজ। তিনি ছিলেন আমাদের ফারাওয়ের সমকক্ষ। অবশ্য তাকে আমাদের ফারাওয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলাটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। তবে এটুকু অন্তত বললে যথেষ্ট হবে যে, তার নৌবহরে দশহাজারেরও বেশি রণতরী এবং এমন উন্নত ধরনের বাণিজ্যপোত ছিল যে, আর কোনো জাহাজ তাদেরকে সাগরে ধরতে কিংবা পরাজিত করতে পারতো না।
ক্রিটবাসীরা যা চায় তা আমাদের কাছে আছে: শস্য, সোনা এবং সুন্দরী বিয়ের কনে। আর আমাদের যা প্রয়োজন ক্রিটে তা আছে: অত্যন্ত দুর্ধর্ষ রণতরী বহর। যার সাহায্যে নীলনদের বদ্বীপের মোহনায় হাইকসোদের বন্দরগুলো অবরোধ করা যায়। আর সৈন্য বোঝাই সুমেরিয় জাহাজগুলোকে পাহারা দিয়ে মধ্য সাগরের দক্ষিণ উপকূলে পাঠিয়ে হাইকসোদের উপর একটি ভয়ঙ্কর সাঁড়াশি আক্রমণ করে, এই দুই শক্তির মাঝে ওদের সেনাবাহিনীকে চেপে ধরে পিষে ফেলা যায়।
এটন করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললো, চমৎকার পরিকল্পনা! প্রায় নির্ভুল একটি পরিকল্পনা। তবে প্রিয় তায়তা, একটা ছোট বিষয় তোমার নজর এড়িয়ে গেছে। সে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো আর একটু আগে বাও খেলায় আমি যে তাকে হারিয়ে দিয়েছিলাম তার একটা শোধ নিতে পেরেছে ভেবে বেশ আত্মতৃপ্তির ভাব দেখাতে লাগলো। আমি কখনও প্রতিহিংসা পরায়ণ ছিলাম না, তবে এই ঘটনার সুবাদে একটু নির্দোষ আনন্দ নেবার সুযোগও হারালাম না। একটু হতবাক হবার ভঙ্গি : করে বললাম।
আহা, দয়া করে বলনা কী সেটা! আমিতো খুব সাবধানে সবদিক ভেবে এই পরিকল্পনা করেছি। এতে ভুলটা কোথায় বল?
এটন জিহ্বায় চুকচুক শব্দ করে তার হাতির মতো বিশাল এক উরুতে চাপড় মেরে বললো, তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো বন্ধু। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ ইতিমধ্যেই হাইকসো রাজা বিওনের সাথে একটা গোপন মৈত্রিচুক্তি করে ফেলেছে। একথা বলে এটন মনে করেছে সে আমার পরিকল্পনায় একটা বিরাট খুঁত বের করে ফেলেছে।
উত্তরে আমি বললাম, হ্যাঁ ঠিকই বলেছো! আমার মনে হয় পাঁচমাস আগে তামিয়াতে ক্রিটরা বিওনের সাথে বাণিজ্য করার জন্য যে দুর্গ স্থাপন করেছে তুমি তার কথা বলছে। এটাতো নীল বদ্বীপের একেবারে পূর্বদিকের মোহনায় অবস্থিত, তাই না?
এবার এটনের হতাশ হবার পালা। তুমি কখন এটা জানলে? কীভাবে জানলে?
আমি দুই হাত দুদিকে মেলে বললাম, এটন! তুমি নিশ্চয়ই এটা আশা করতে পারো না যে আমার গোপন খবরের সমস্ত সূত্রগুলো আমি প্রকাশ করে দেব?
এবার এটন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, সমর চুক্তি না হলেও সর্বাধিরাজ মিনোজ আর বিওনের মধ্যে ইতিমধ্যেই একটা গোপন সমঝোতা হয়েছে। সবাই জানে তুমি খুব বুদ্ধিমান তায়তা। তবে এখানে তুমি তেমন কিছু করতে পারবে না।
আমি রহস্যময়ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর যদি বিওন প্রতারণা করার পরিকল্পনা করে থাকে?
সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, প্রতারণা মানে? বুঝতে পারলাম না তায়তা। এখানে কী ধরনের প্রতারণা হবে?
তোমার কোনো ধারণা আছে এটন, ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ কী পরিমাণ রূপা হাইকসো এলাকার মাঝে তাদের এই নতুন দুর্গে জমা করেছে?
নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। যদি সর্বাধিরাজ মিনোজ বিওনের কাছ থেকে আগামী মৌসুমের বেশিরভাগ শস্য কিনতে চান তাহলে তাকে প্রচুর পরিমাণে রূপা হাতে রাখতে হবে। তারপর এটন একটু সাবধানে হিসেব করে বললো, সম্ভবত দশ কিংবা বিশ লাখও হবে।
তোমার কল্পনাশক্তি খুবই ভালো বলতে হয়, প্রিয় বন্ধু। তবে সর্বাধিরাজ মিনোজ যে সমস্যাগুলোর সম্মুখিন হতে যাচ্ছেন, তুমি তার সামান্য অংশ বলেছ। ঝড়ের মৌসুমে তিনি খোলা সাগরে এত সম্পদ বোঝাই জাহাজ পাঠাবার ঝুঁকি নেবেন না। কাজেই বছরের পাঁচমাস তিনি মধ্য সাগরের দক্ষিণ উপকূলে রূপার পিণ্ডগুলো পাঠাতে পারছেন না। আর শীতকালে তার দ্বীপ থেকে পাঁচশো লিগেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে।
এটন দ্রুত বলে উঠলো, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ! আমি তোমার যুক্তিটা বুঝতে পেরেছি। তার মানে সেই সময়ে সর্বাধিরাজ মিনোজ বিশাল সমুদ্রে আফ্রিকার উপকূলের দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করতে পারবেন না!
আমি একমত হয়ে বললাম, পুরো শীতকালে অর্ধেক পৃথিবীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তিনি মিসরীয় উপকুলে একটি নিরাপদ নৌঘাঁটি স্থাপন করতে পারেন তবে তার নৌবহর শীতকালের ঝড়ের ধাক্কাটা সামলাতে পারবে। তারপর সারা বছর ধরে স্থলভূমির নিরাপদ আচ্ছাদনে তার জাহাজগুলো মেসোপটেমিয়া থেকে মরিতানিয়া পর্যন্ত বাণিজ্য করে যেতে পারবে। একটু থেমে আমি তাকে সর্বাধিরাজ মিনোজ কী পরিকল্পনা করতে যাচ্ছেন তার বিশালত্ব পুরোপুরি বুঝার সুযোগ দিলাম। তারপর বললাম, এই ধরনের কার্যক্রমের একশোভাগের এক অংশও বিশ লাখ রূপার বাটে পোষাবে না। কমপক্ষে পাঁচশো লাখ রূপা তাকে তামিয়াতের নতুন দুর্গে জমা রাখতে হবে যদি তাকে শীতকালে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে হয়। তোমার কী মনে হয় এই বিপুল পরিমাণ রূপার জন্য যে কোনো লোক কি প্রতারণা করতে পারে না? বিশেষত সেই লোক যদি হয় বিওনের মতো বিশ্বাসঘাতক, লুণ্ঠনকারী এবং অসৎ একজন মানুষ?