বেকাথা রেগে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, তোমাদের এই বিশ্রী ভাষায় কথা বলা শুনলে আমার ঘেন্না করে। তেহুতিও মাথা নেড়ে তার সাথে সুর মিলিয়ে বললো, যদি তুমি আমাদের ভালোবাস তাহলে মিসরি ভাষায় কথা বল তায়তা।
আমি বেকাথাকে জড়িয়ে ধরে তেহুতির মাথায় হাত রেখে আদর করলাম। তবে তারপরও এটনের সাথে সেই ভাষায় কথা বলে চললাম, যা মেয়েরা ভীষণ অপছন্দ করে। বাচ্চাদের কথায় কান না দিয়ে যা বলার বলে যাও বন্ধু।
এটন হাসি চেপে বললো, তাহলে সেই কথাই রইল তায়তা। আমাদের মিত্র প্রয়োজন আর সেই মিত্রদের সাথে বাণিজ্য করতে হবে। তবে সেই সাথে এসব বিষয় হাইকসোদের কাছে গোপন রাখতে হবে।
আমি মাথা নেড়ে গম্ভীরস্বরে বললাম, সবসময়ের মতো তুমি সঠিক জায়গায় পৌঁছেছ আর সত্যিকার সমস্যাটির কথাও উল্লেখ করেছ। মিত্র এবং বাণিজ্য। খুব চমৎকার বলেছ। তাহলে বল বাণিজ্য করার মতো কী আছে আমাদের কাছে, এটন?
জলপ্রপাতের ওধারে নুবিয়ায় নির্বাসিত জীবন কাটাবার সময় আমরা খনি থেকে যে সোনা পেয়েছি সেগুলো আছে। যদিও এটন কখনও মিসর ছেড়ে যায়নি, কিন্তু তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন সে সেই দলবদ্ধ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে আমার হাসি পেলেও আমি গাম্ভীর্য বজায় রাখলাম। তারপর সে বললো, যদিও এই হলুদ ধাতুটি রূপার মতো তেমন মূল্যবান নয় তবুও মানুষ এর জন্য লালায়িত। ফারাও যে পরিমাণ সোনা তার কোষাগারে জমা করেছেন তা দিয়ে আমরা সহজেই বন্ধু আর মিত্র কিনতে পারবো।
আমি একমত হয়ে মাথা নাড়লাম। যদিও আমি জানতাম এটন কিংবা ওর মতো অন্য যারা আমার মতো রাজার এত কাছাকাছি নয়, তারা ফারাওয়ের সম্পদ সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে। বিষয়টার আরও ব্যাপ্তি দেবার জন্য আমি তাকে মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, তবে প্রত্যেকবছর প্লাবনের সময় আমাদের মা নীলনদ থেকে যে কালো দোঁআশলা মাটি আমরা দুই তীরে পাই সেকথা ভুলে যেও না। মানুষকে খেয়েপড়ে বাঁচতে হবে এটন। ক্রিট, সুমেরিয় আর হেলেনিয় নগর রাষ্ট্রগুলোর চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুব কম। ওদের জনগণের মুখে খাবার তুলে দেবার মতো শস্য জোগাতে ওদের খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়। আর আমাদের প্রচুর শস্য রয়েছে।
আরে তাইতো তায়তা। বাণিজ্য করার মতো আমাদের কাছে শস্য আর ঘোড়া আছে। আমাদের ঘোড়া পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এছাড়া এর চেয়েও আরও দুর্লভ এবং মূল্যবান কিছু বস্তু আমাদের কাছে আছে। এই কথা বলে এটন একটু থামলো, তারপর আমার কোলে বসা যে শিশুটিকে আমি আদর করছিলাম আর আমার হাঁটুর কাছে বসা সুন্দর শিশুটির দিকে সে তাকাল।
এই বিষয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মাঝের এলাকার ক্রিট আর সুমেরিয়রা ছিল আমাদের সবচেয়ে কাছের এবং অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিবেশি। এই দুই জাতের মানুষেরাই সাধারণত শ্যামবর্ণ হত আর ওদের মাথার চুলও ছিল কালো। ওদের শাসক গোষ্ঠির কাছে এজিয়ান গোত্র আর মিসরের রাজপরিবারের সুন্দর চুল আর ফর্সা ত্বকের মেয়েদের ভীষণ কদর রয়েছে। তবে ফ্যাকাসে চেহারার কাঠখোট্টা হেলেনিয় মেয়েদের সাথে আমাদের নীল নদের অববাহিকার উজ্জ্বল রত্নের মতো লাবণ্যময়ী মেয়েদের কোনো তুলনাই করা যায় না।
আমার এই দুই রাজকুমারির বাবা তানুসের ছিল আগুনে রঙের কোঁকড়ানো চুল আর মা রানি লসট্রিস ছিলেন উজ্জ্বল স্বর্ণকেশি। তাদের বংশধর, এই দুই রাজকন্যার সৌন্দর্যের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন দেশের দূতেরা ইতিমধ্যেই অতিকষ্টে বিশাল মরুভূমি এবং গভীর সমুদ্র পেরিয়ে থিবসের রাজপ্রাসাদে এসে ফারাও ত্যামোসের কাছে তাদের প্রভুদের আগ্রহ প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, তারা ত্যামোস রাজপরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে স্থাপন করতে আগ্রহী। সুমেরিয় রাজা নিমরদ এবং ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ তাদের দূত পাঠিয়েছিলেন।
আমার পরামর্শ মোতাবেক ফারাও এই দুই রাজ্যের দূতকে সাদরে বরণ করেছিলেন। রূপা আর সিডার কাঠের যেসব চমৎকার উপহারসামগ্রী ওরা এনেছিল তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। তারপর মনোযোগ দিয়ে তার একজন কিংবা উভয় বোনের সাথে বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনলেন। তবে ফারাও জানালেন দুই বোনই এখনও অনেক ঘোট, সুতরাং বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা এখনই বলা যাবে না। বরং ওরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আবার এ-বিষয়ে আলাপ করা যেতে পারে। তবে এটা বেশ কিছুদিন আগের কথা আর এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
সে-সময় ফারাও আমার সাথে সুমেরিয় কিংবা ক্রিটের সাথে মিসরের সম্ভাব্য মৈত্রী বন্ধন নিয়ে আলাপ করেছিলেন আর আমি তাকে সুকৌশলে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে, সুমেরিয়দের চেয়ে ক্রিটের সাথে মৈত্রি করাটাই বরং ভালো হবে।
প্রথমত সুমেরিয়রা সমুদ্রগামি জাতি নয়। অশ্বারোহী সেনা এবং রথসহ ওদের শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী থাকলেও তাদের তেমন কোনো নৌবাহিনী ছিল না। আমি ফারাওকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমাদের সাগরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। হাইকসো শত্রুরা উত্তর দিকে নীল নদের যাওয়ার পথটি নিয়ন্ত্রণ করছে আর আমরা মূলত একটি ভূ-বেষ্টিত দেশ।
সুমেরিয়দেরও সমুদ্রপথের যাত্রা সীমিত ছিল আর তাদের নৌবহরও ছিল অন্যান্য দেশ, যেমন ক্রিট এবং পশ্চিমের মরিতানিয়দের তুলনায় বেশ ছোট। সুমেরিয়রা জাহাজবোঝাই মালামাল নিয়ে সমুদ্রপথে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে সবসময় অনিচ্ছুক ছিল। ওরা জলদস্যু এবং সমুদ্রঝড়ের তাণ্ডবে আতঙ্কিত ছিল। তাছাড়া দুইদেশের মাঝে স্থলপথও বিপদসঙ্কুল ছিল।