প্রভুর জন্য আমি যেসব কাজ করেছিলাম, তার মধ্যে প্রথমটি ছিল স্পোকওয়ালা চাকা দিয়ে তৈরি উন্নত প্রযুক্তির রথের গাড়ি। হাইকসোদের নিরেট কাঠের চাকা থেকে এগুলো অনেক হালকা আর দ্রুতগামি ছিল। এই রথ টেনে নেবার জন্য ঘোড়া খুঁজে আনলাম। তারপর যখন আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত হলাম, তখন নতুন ফারাও নবযুবা ত্যামোসের নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনী জলপ্রপাতের মধ্য দিয়ে উত্তরে মিসর অভিযানে বের হল।
হানাদার হাইকসো নেতা নিজেকে রাজা স্যালিটিস নামে পরিচয় দিত, তবে সে মোটেই রাজা ছিল না। বড়জোর সে ছিল একজন দস্যুসর্দার এবং একজন অপরাধী। তবে তার সেনাবাহিনী সংখ্যায় মিসরীয়দের দ্বিগুণ ছিল। এরা ছিল অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং দুর্ধর্ষ প্রকৃতির।
আমরা হঠাৎ থিবস আক্রমণ করে ওদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করলাম। ওদের রথগুলো চুর্ণবিচুর্ণ করে প্রচুর সৈন্য হত্যা করলাম। আর বাদবাকিদেরকে উত্তরদিকে তাড়িয়ে দিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রে দশহাজার মৃতদেহ আর দুই হাজার ভাঙা রথ ফেলে ওরা পিছু হটে গেল।
তবে আমাদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হল। আর সেজন্যই তাদেরকে অনুসরণ করে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারলাম না। তখন থেকেই হাইকমোরা নীলনদের বদ্বীপে লুকিয়ে থাকতে শুরু করলো।
সেই লুটেরা রাজা স্যালিটিস এখন মৃত। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন মিসরীয় যোদ্ধার তরবারির আঘাতে সে মারা যায়নি, যা তার জন্য সঠিক বিচার হত। চারপাশে একগাদা অতিকুৎসিৎ স্ত্রী আর বীভৎস অগুণতি সন্তান নিয়ে বার্ধক্যের কারণে সে মারা গিয়েছিল। এর মধ্যে তার সবচেয়ে বড় ছেলে বিওনও ছিল। এই বিওন এখন নিজেকে রাজা বিওন নামে উচ্চ এবং নিম্ন মিসর সাম্রাজ্যের ফারাও ঘোষণা করেছে। আসলে সে একজন হত্যাকারী ছাড়া আর কিছুই নয়, সে তার বাবার চেয়েও নিকৃষ্ট। আমার গুপ্তচরেরা নিয়মিত আমাকে জানাতে যে, থিবসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া হাইকসো সেনাবাহিনীকে সে আবার পুনর্গঠন করছে।
এই খবরগুলো বেশ অস্বস্তিকর ছিল, কেননা একই যুদ্ধে আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে উঠার রসদ সংগ্রহ করতে আমাদের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। চতুর্দিকে স্থলবেষ্টিত আমাদের দক্ষিণ রাজ্যটি বিশাল মধ্যসাগর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল আর সভ্যজগতের বিভিন্ন দেশ এবং নগর রাষ্ট্রের সাথেও বাণিজ্য হচ্ছিল না। যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ চামড়া, কাঠ, তামা, খাদ, টিন এবং শক্তির অন্যান্য উৎস এই দেশগুলোতে প্রচুর ছিল, অথচ আমাদের এগুলোর অভাব ছিল। এছাড়া আমাদের মানবসম্পদেরও কমতি ছিল। আমাদের এখন মিত্র প্রয়োজন।
অন্যদিকে আমাদের শত্রুপক্ষ হাইকসোদের নীল নদের মোহনায় চমৎকার বন্দর ছিল। এছাড়া আমার গুপ্তচরেরা আমাকে আরও জানিয়েছে যে, হাইকসোরাও অন্য যোদ্ধা দেশের সাথে মিত্ৰতা করার চেষ্টা করছে।
এসব বিষয় নিয়ে আলাপ করতেই এটন আর আমি এই নির্জন জায়গায় মিলিত হয়েছিলাম। আমাদের প্রিয় মিসরের অস্তিত্ব এখন তরবারির ডগায় ঝুলছে। এটন আর আমি এনিয়ে অনেকবার দীর্ঘ আলাপ করেছি, তবে এই শেষবার আলাপআলোচনা করে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ফারাওর সামনে তুলে ধরবো।
তবে রাজকুমারিদের উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। ওরা লক্ষ্য করেছিল এটন বাও খেলার খুঁটি তুলে নিচ্ছে আর এটাকেই ওরা একটা ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়েছিল যে, এবার আমাকে পুরোপুরি ওদের দখলে নিতে পারবে। আমি ওদের দুজনের প্রতি আত্মনিবেদিত হলেও ওদের চাহিদা ছিল খুব বেশি। উপহৃদের পানি চতুর্দিকে ছিটিয়ে ওরা দ্রুত আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলো। বেকাথা ছোট হলেও সে ছিল খুব দ্রুত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য সে যে কোনো কিছু করতে পারত। তেহুতিকে পেছনে ফেলে সে ভেজা আর ঠাণ্ডা শরীর নিয়ে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
তারপর আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালে ওর লাল চুলো মাথাটা খুঁজে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি তাতা। আমাদেরকে একটা গল্প শোনাও, তাতা।
এদিকে তেহুতিও ছুটে এলো, তবে সে জায়গা পেল আমার পায়ের কাছে। ভেজা শরীরে মাটিতে বসে সে আমার পা তার বুকে চেপে ধরলো, তারপর আমার হাঁটুর উপর থুতনি রেখে উপরের দিকে মুখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ, তাতা। আমাদের মায়ের কথা বল। বল, মা কীরকম সুন্দরী আর বুদ্ধিমতি ছিল।
আমি প্রতিবাদের সুরে বললাম, আগে আমাকে এটন চাচার সাথে কথা বলতে হবে।
বেকাথা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। তবে বেশি সময় নিও না। এটা খুবই বিরক্তিকর।
ঠিক আছে, কথা দিলাম, বেশি সময় নেব না। তারপর এটনের দিকে ফিরে হাইকসো ভাষায় কথা বলতে শুরু করলাম। আমরা দুজনেই আমাদের শত্রুর ভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারতাম।
আমি সবসময় আমার শত্রুকে জানার চেষ্টা করতাম। শব্দ আর ভাষার ব্যাপারে আমার বেশ পটুত্ব ছিল। থিবসে ফেরার পর লেখাপড়ার জন্য আমি অনেক বছর সময় পেয়েছিলাম। এটন নুবিয়ার শরণার্থীদলের সাথে যোগ দেয় নি। অভিযানের প্রতি তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। সে মিসরেই রয়ে যায় আর হাইকসোদের অত্যাচার সহ্য করে। তবে ভাষাসহ হাইকসোদের কাছ থেকে শেখার যা কিছু ছিল সব শিখে নেয়। রাজকুমারিরা এই ভাষার এক বর্ণও বুঝতে পারে না।