এই জাতির মানুষগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে আমার মনে একটা ভাবনা জাগলো যে, ভবিষ্যতে কোনো এক সময় ওদের প্রতি আমার বিরাগ ভাবটি আরও সঠিক আর দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করাটাই সঠিক হবে। কিছু একটা করে ওদেরকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে রাজা বিওনও বুঝতে পারবে কাজটা সঠিক হয়েছে।
সেই দিনটি হবে সকল মিসরীয়দের জন্য একটি খুশির দিন। কথাটা ভাবতেই আমার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। চিন্তাটায় আরেকটু শান দিয়ে ভাবলাম আর দেরি করে লাভ কি? পুরো পরিকল্পনার ছকটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার মনে ভেসে উঠলো।
নিচের ডেকে ক্যাপ্টেনের কেবিনে একটা লেখার টেবিল আর কিছু পাকানো প্যাপিরাস কাগজ দেখেছিলাম। ক্রিটানরা শিক্ষিত জাতি। ওরা কীলককার হস্তলিপি পদ্ধতি ব্যবহার করে যা সুমেরিয়দের সাথে মিলে না। এই সঙ্কেতগুলো আমি পড়তে আর চিনতে পারলেও সেসময়ে মিনোয়ানদের ভাষার সাথে পরিচিত ছিলাম না।
জানা কথা হাইকসোরা পুরোপুরি অশিক্ষিত। তবে আমার গুপ্তচরেরা আমাকে জানিয়েছিল ওরা কয়েকজন মিসরীয় লেখককে বন্দী করে ক্রীতদাস বানিয়ে, তাদেরকে দিয়ে আমাদের লিপি পড়ে, লিখে আর অনুবাদ করিয়েছে।
আমি আরও জেনেছি ওরা এই লিপিকারদের কাছ থেকেই শিখেছে, কীভাবে পাখির সাহায্যে অনেক দূরে বার্তা পাঠানো যায়। বানরের মতো হাইকলোরাও নকল করতে পটু। কোনো উদ্ভাবনী চিন্তা দিয়ে ওরা কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। অন্য লোকের মহৎ ভাবনাকে ওরা নিজেদের বলে চালিয়ে দেয়।
জারাসের সাথে কথা শেষ করে আমি দ্রুত মূল ডেকের নিচে কেবিনে গেলাম। লেখার সরঞ্জামগুলো আমি যেখানে দেখে গিয়েছিলাম সেখানেই রয়েছে। সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাসকেটের মধ্যে এগুলো রাখা ছিল। কাসকেটের উপরে আইবিস পাখির মাথাওয়ালা লেখার দেবতা থথের একটা ছোট চিত্র আঁকা রয়েছে।
আমি ডেকে আসন গেড়ে বসে লেখার বাক্সটা খুললাম। খুশি হয়ে দেখলাম, ভেতরে বিভিন্ন আকারের প্যাপিরাস কাগজ ছাড়াও বেশ কয়েকটি তুলি আর কালির ব্লক রয়েছে। এছাড়া ঘোড়ার কেশর বুনে তৈরি করা চারটে ছোট ছোট গুটলিও বাক্সটায় রয়েছে। খাওয়ার জন্য আমরা যে-ধরনের সাধারণ কবুতর পালন করি তার পায়ে এই গুটলিগুলো বাঁধা যায়। এই কবুতরগুলোর আশ্চর্য ধরনের একটি অভ্যাস আছে, যে-জায়গায় ওরা ডিম ফুটে বের হয় সেখানে ওরা ফিরে যেতে পারে। আর পায়ে ছোট্ট বার্তাবহনকারী গুটলি বেঁধে দিলে তাও বহন করে নিয়ে যায়।
আমি দ্রুত হাতে কবুতরের পায়ের বার্তাবহনকারী গুটলিতে বাধার মত ছোট একটা প্যাপিরাসের টুকরা নিলাম। তারপর একটা সরু তুলি আর লেখার কালি গুড়া করে নিলাম।
লেখার বিষয়টিবস্তু আমার মনেই ছিল, তাই নতুন করে ভাবনা চিন্তা করার দরকার পড়েনি। খুব ছোট ছোট অক্ষরে পরিষ্কার লেখার হাত ছিল আমার।
শুরু করলাম যথারীতি সম্ভাষণ দিয়ে, উচ্চ ও নিচের মিসরের ফারাও হে, মহাপরাক্রমশালী বিওন। যদিও সে এই ধরনের কিছু নয়, তবুও এই ধরনের পদমর্যাদার প্রতীক সে পছন্দ করে। আমি, ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ আপনাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছি। আমাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আমি মহামান্যের জন্য রূপাভর্তি তিনটি বিশাল জাহাজ পাঠাচ্ছি। এপিফি মাসের দ্বিতীয় দিনে নীল নদের বদ্বীপে তামিয়াতে আমার ঘাঁটি থেকে জাহাজগুলো রওয়ানা দেবে। আশা করি একই মাসের পঞ্চম দিনে মেমফিসে আপনার রাজধানীতে এগুলো পৌঁছে যাবে। এই ঘটনার খবর আপনার নজরে আসার আগে যাতে কোনো দুষ্ট লোকের হাতে না পড়ে সেজন্য শেষ মুহূর্তে খবরটি বিলম্বিত করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস যে সম্মান প্রদর্শন করে এই উপহারসামগ্রীগুলো আপনার বরাবর পাঠানো হয়েছে, তা আপনি যথাযথ আগ্রহের মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করবেন।
কালি শুকাবার সাথে সাথে কাগজটা পাকিয়ে কবুতরের পায়ে বাঁধার গুটলিতে রেখে এরাবিক আঠা দিয়ে সিল করলাম। তারপর কেবিন থেকে বের হয়ে নিচের ডেকে নেমে মালামাল রাখার খোলের দরজায় কাছে গেলাম।
জারাস লাথি মেরে দরজার তালা ভেঙে ফেলার পর আর মেরামত করা হয়নি। হাতে ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। পেছন ফিরে দরজাটা বন্ধ করলাম। যে সিন্দুকটা খুলে ভেতরের মালামাল দেখছিলাম, সেটার ডালা তখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। আমার ড্যাগার দিয়ে চাড় দিয়ে ডালাটা খুললাম। তারপর সিন্দুকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতর থেকে একটা রূপার বাঁট বের করলাম। ভারি বঁটটা আমার কোমরবন্ধের সাথে বাঁধা ছোট থলের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলাম। তারপর উপরে ডেকে গিয়ে জারাসের পাশে আমার জায়গায় পৌঁছলাম। চুপিচুপি তার সাথে কথা বললাম যাতে কেউ না শুনতে পারে।
এক ঘন্টার মধ্যেই আমরা কুনটুস নদীবন্দরে পৌঁছে যাবো। সেখানে বিওনের শুল্ক ফাঁড়ির লোকেরা চলাচলকারী সমস্ত জাহাজ থেকে শুল্ক আদায় করে…
জারাস আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বললো, এসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না প্রভু তায়তা। আমাদের ওরা দেরি করাতে পারবে না। আমরা মশা তাড়াবার মতো ওদেরকে তাড়িয়ে দেব…
না, জারাস। তুমি তোমার বৈঠা আর পাল গুটিয়ে রাখবে। আর শুল্কদপ্তরের নৌকা কাছে আসতে স্বাগত জানাবে। ওরা কাছে এলে যথাযথ সম্মান দেখাবে। শুল্ক কর্তাকে বায়না দিয়ে রাখতে হবে। কেননা তার সহযোগিতা প্রয়োজন পড়বে। তারপর জারাসকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে আমি জাহাজের অন্যপাশে সরে গেলাম। আসলে আমি নিজেও নিশ্চিত নই কুনটুসে পৌঁছার পর কী হতে পারে।