ক্রিটান সৈন্যরা শৃঙ্খলা ভেঙে ছত্রভঙ্গ হয়ে তাদের সেনানায়কদের পিছু পিছু ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু যখন দেখলো আমরা কিছু না বলে চলে যাচ্ছি, তখন ওরা থেমে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে একনাগাড়ে উঁচু করে তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। তবে কোনটাই আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারলো না।
অশ্বারোহী সেনানায়করা অবশ্য হাল ছেড়ে দিল না, ওরা ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের নৌবহরকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। যখন আকেমির জাহাজ বরাবর এলো তখন ওরা তলোয়ার কোষমুক্ত করলো। তারপর ঘোড়ার পাদানির উপর দাঁড়িয়ে অজস্র গালিগালাজ করতে করতে আকেমির লোকজনের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে শুরু করলো।
আকেমির প্রতি আমার কঠোর নির্দেশ ছিল মিনোয়ানদের লক্ষ্য করে তীর না ছোঁড়ার। তিনতলা জাহাজের উপরের ডেক থেকে ওরা আকেমির তীরন্দাজদের সহজ লক্ষ্য ছিল, কিন্তু ওরা তাদেরকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলো। এতে মিনোয়ানরা আরও ক্রদ্ধ হল। ওরা নদীর তীর দিয়ে আরও দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে প্রথমে আকেমি তারপর দিলবারের জাহাজ পার হয়ে আমার জাহাজের কাছাকাছি এলো।
আমার নির্দেশ মোতাবেক আমার লোকজন লুকোবার কোনো চেষ্টাই করলো না। আমাদের জাহাজের সাথে তাল মিলিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে ঘোড়া ছুটতে ছুটাতে সেই চার সেনানায়ক মাত্র একশো পা দূরত্ব থেকে আমাদের পরনে আসল হাইকসো সামরিক উর্দি আর সাজসরঞ্জাম পরিষ্কার দেখতে পেল।
আমাদের অনুসরণ করে ইতোমধ্যে ওরা প্রায় তিনলিগ দূরত্ব চলে এসেছে। ঘোড়াগুলোও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এরপর তীর থেকে জোর বাতাস বইতেই আমাদের জাহাজগুলো ওদের কাছ থেকে দ্রুত সরে পড়লো। নদীর তীর এবার জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। কালো কাদায় ঘোড়াগুলোর পা দেবে যেতেই ওরা ঘোড়ার রাশ টেনে থামাতে বাধ্য হল। আর আমরা বেশ দ্রুত ওদের কাছ থেকে ভেসে চললাম ভোলা সাগরের দিকে।
পুরো ঘটনাটা যেভাবে ঘটলো, তা দেখে আমি বেশ খুশি হলাম। মিনোয়ান সেনানায়করা দেখেছে, যা আমি ওদের দেখাতে চেয়েছিলাম–অর্থাৎ হাইকসো জলদস্যুরা তিন জাহাজ ভর্তি সর্বাধিরাজ মিনোজের পাঁচ লাখ রূপার বাঁট নিয়ে দক্ষিণ দিকের নদী হয়ে রাজা বিওনের রাজধানী মেমফিসের দিকে ভেসে চলেছে।
২. পরবর্তী ভূমিকা
এখন আমাদের পরবর্তী ভূমিকা পালন করার সময় হয়েছে। তামিয়াত দুর্গ থেকে ক্রিটানদের যেসব সামরিক উর্দি আর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছি, সেগুলো ডেকে এনে রাখার নির্দেশ দিলাম। তারপর হাসি তামাশার মধ্য দিয়ে আমাদের লোকেরা হাইকসো উর্দি খুলে মিনোয়ান সামরিক উর্দি পরলো। ওদের চকচকে শিরস্ত্রাণ আর কারুকাজ করা তলোয়ার থেকে শুরু করে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা পাতলা নরম চামড়ার বুট জুতা পরলো।
আকেমি আর দিলবার উভয়ের উপর আমার কড়া নির্দেশ ছিল, ওদের লোকেরা যেন হাইকসো উর্দি আর সাজসরঞ্জামের একটা টুকরাও নদীতে ছুঁড়ে
ফেলে। স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগুলোর কোনো একটি টুকরাও যদি তামিয়াত দুর্গের মিনোয়ান সেনাদের হাতে পড়ে তাহলে আমার সব কৌশল ফাঁস হয়ে যাবে।
ক্রিটানরা সহজেই বুঝতে পারবে কীভাবে তাদের বোকা বানানো হয়েছে। কাজেই খুলে ফেলা সমস্ত হাইকসো সামরিক উর্দি আর অন্যান্য সাজসরঞ্জাম বোঁচকা বেঁধে নিচের ডেকে লুকিয়ে রাখা হল।
পেছন থেকে অনুকুল বাতাস পেয়ে আমাদের পালগুলো ফুলে উঠেছে, সারিবদ্ধ দাঁড় চালিয়ে বেশ দ্রুত আমরা দক্ষিণদিকে ভেসে চললাম। মিনোয়ানদের এই জাহাজ তিনটি ছিল সমুদ্রের বুকে সবচেয়ে দ্রুতগামী জাহাজ। এতো মানুষ আর রূপার বিশাল ওজন সত্ত্বেও জাহাজগুলো বেশ দ্রুত চলছিল।
বদ্বীপ আর অসংখ্য শাখানদী পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত আমাদের জাহাজ তিনটি মূল নদীতে চলে এলো। তিনটি জাহাজ একটি অন্যটির সাথে পাল্লা দিয়ে ভেসে চললো। এক জাহাজের নাবিকেরা অন্য জাহাজের নাবিকদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারতে লাগলো আর রসিকতা করতে লাগলো।
নোঙর করা মাছধরা নৌকা আর মালামাল বোঝাই ছোট ছোট নৌকার পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে চললাম। নৌকাগুলো পাশ কাটিয়ে যাবার সময় আমি উপরের ডেক থেকে নিচে নৌকাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। মাঝিমাল্লাদের মধ্যে হতবাক চেহারার কয়েকটা মিসরীয় মুখ চোখে পড়লেও বেশিরভাগই ছিল হাইকসো।
এই দুই জাতির পার্থক্য আমি সহজেই ধরতে পারি। আমার মিসরীয় ভাইদের সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, উঁচু কপাল, বড় বড় চোখ আর নিখুঁত চেহারা। অর্থাৎ একবার তাকালেই বুঝা যায় এরা উচ্চ জাতি।
আর হাইকসোদের মধ্যে এই ধরনের চেহারা খুব কম দেখা যায়। অবশ্য আমি শুধু শুধু পক্ষপাতিত্ব করে ওদের বিরুদ্ধাচরণ করছি না। তবে ওদেরকে ঘৃণা করার আমার অনেক কারণ আছে। ওরা সবাই চোর-ডাকাত। নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচার করাতেই ওদের আনন্দ। ওদের নিকৃষ্টমানের আর অশ্লীল ভাষা শুনলে যেকোনো সভ্য মানুষের কানে শ্রুতিকটু মনে হবে। ওরা সবচেয়ে বিশ্রী দেবতা শেঠের পূজা করে। আমাদের দেশ দখল করে ওরা আমাদের দেশের মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়েছে।
তবে আমার মধ্যে কোনো গোঁড়ামি নেই। যাদের তা আছে তেমন লোকদের আমি ঘৃণা করি। আসলে আমি অনেক চেষ্টা করেও হাইকসো জাতির মধ্যে প্রশংসনীয় কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই নি। দেবতারা জানেন এটা আমার দোষ নয় যে, আমি তেমন কিছু ওদের মাঝে খুঁজে পাইনি।