এবার তাকে হুকুমের সুরে বললাম, তাকাও আমার দিকে! একথা বলে শিরস্ত্রাণ খুলে মুখের নিচের অংশ ঢাকতে যে হলুদ কাপড়টা পেঁচিয়ে রেখেছিলাম, সেটা খুলে ফেললাম। তারপর আবার বললাম, তাকাও আমার দিকে!
লোকটি মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কে?
সে অবাক বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললো, আপনি তায়তা। ছোটবেলায় আমি আপনাকে লুক্সরের হাথোর মন্দিরে দেখেছিলাম। বাবা বলেছিলেন জীবিত মিসরীয়দের মধ্যে আপনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তারপর সে আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো। আমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাবার এই ধরন দেখে আমি অভিভূত হলাম। তারপরও কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্থির রেখে বললাম,
হ্যাঁ সৈনিক, আমি তায়তা। তুমি কে?
আমি ছাব্বিশতম রথবাহিনীর রহিম। পাঁচবছর আগে হাইকসো কুকুরগুলো আমাকে বন্দী করে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আমাদের প্রিয় মিসরে ফিরে যেতে চাও? উত্তরে সে মৃদু হাসতেই দেখা গেল তার একটা দাঁত নেই আর মারের চোটে মুখে কালশিটে দাগ পড়েছে। প্রচুর মার খেলেও সে একজন মিসরীয় যোদ্ধা, দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল, যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ আমি আপনার লোক!
গতকাল ক্রিটানরা জাহাজ থেকে যে সিন্দুকগুলো তোমাদেরকে দিয়ে নামিয়ে এনেছে সেগুলো কোথায় রেখেছে?
সিঁড়ির নিচে ইস্পাতের ভারি দরজাওয়ালা একটা গোপন কুঠরিতে রেখেছে। তবে দরজায় তালা দেওয়া আছে।
চাবি কার কাছে?
কাঁধে সবুজ পট্টি দেওয়া মোটা লোকটার কাছে। সে ক্রীতদাসদের তত্ত্বাবধায়ক।
লোকটাকে আমি অন্যান্য বন্দীদের সাথে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখেছি। তার কাছে কি তোমাদের শিকলের তালার চাবি আছে, রহিম? এগুলো তোমাদের দরকার পড়বে, কারণ এখন থেকে তুমি আবার মুক্ত মানুষ। কথাটা মনে করে সে দাঁত বের করে হাসলো।
সমস্ত চাবি সে তার কোমরে একটা শিকলে ঝুলিয়ে রাখে। তার পোশাকের নিচে চাবির গোছাটা লুকিয়ে রাখে।
রহিমের কাছ থেকে জানতে পারলাম আশিজনেরও বেশি মিসরীয় তিরন্দাজ আর রথীসেনা ওরা বন্দী করেছে। ওদের পায়ের শিকল খুলে দিতেই ওরা খুশিমনে রূপার বাক্সগুলো দুর্গ থেকে জারাসের জাহাজের খোলে বয়ে নিয়ে চললো।
রূপার বাক্সগুলো যখন স্থানান্তর করা হচ্ছিল তখন রহিম আমাকে দুর্গের অস্ত্রভাণ্ডারে নিয়ে গেল। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে থরে থরে সাজানো সামরিক উর্দি, বর্ম আর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখে আমার আনন্দ হল।
সবকিছু জাহাজে নিয়ে গিয়ে মূল ডেকে রাখার নির্দেশ দিলাম যাতে প্রয়োজনে সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়।
সবশেষে বন্দী ক্রিটানদের তাদের নিজেদের ক্রীতদাস ব্যারাকে তালা বন্ধ করে রেখে আমরা অপেক্ষামান তিনটি তিনতলা জাহাজে চড়লাম।
.
সমস্ত লোকজনকে আমি তিনটি জাহাজে সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছিলাম, যাতে সবগুলো বৈঠা চালানো যায়। আমার নিদের্শে নিচের ডেকে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসদেরকে শক্ত রুটি, শুকনো মাছ আর বিয়ার খেতে দেওয়া হল। এগুলো আমরা দুর্গের ভাঁড়ার ঘরে পেয়েছিলাম। ময়লা কড়াপরা হাত দিয়ে ওদের গোগ্রাসে খাওয়ার দৃশ্যটা খুবই করুণ ছিল। খাবার আর ভালো ব্যবহার ওদেরকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। আমি জানি ওরা খুশিমনে আমার কাজে লাগবে।
পুবআকাশে ভোরের আলো দেখা দিতেই আমাদের যাত্রার সময় হল। সবচেয়ে আগের জাহাজের হালে জারাসের পাশে আমি আমার জায়গা করে নিলাম। মাথায় হাইকসো শিরস্ত্রাণ পরলাম আর সিল্কের হলুদ স্কার্ফটা দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকলাম।
জারাস নোঙর তুলে ফেলার নির্দেশ দিতেই প্রত্যেক দাঁড় বাওয়া ডেকে ঢাক পেটানো শুরু হল। ঢাক পেটানোর তালে তালে লম্বা দাঁড়গুলো পানিতে একবার ডুবিয়ে আবার তুললো, এভাবেই দাঁড় বাওয়া শুরু হল। একটু পরই আমরা নদীর মূল ধারায় এলাম। বাকি দুটো জাহাজও আমাদের অনুসরণ করলো। আমরা সোজা দক্ষিণদিকে হাইকসো রাজধানীর দিকে ভেসে চললাম, এরপরই সামনে দুশো লিগ নদীপথ শত্রুর অধীনে রয়েছে।
এদিকে আগুনে জ্বলতে থাকা নৌকাগুলো থেকে বয়ে আসা ঘন ধুয়া নদীর উপর দিয়ে দুরে ক্রিটান সেনাশিবির ঢেকে ফেলছিল। তবে উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা বাতাসে ধুয়ার পর্দাটা সরে যেতেই আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম যেসব ক্রিস্টান সৈন্য পন্টুন সেতুর ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচেছিল, ওরা সবাই নদীর তীরে যুদ্ধসাজে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ওদের সেনাপতিরা সৈন্য নিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থান নিয়েছিল। তীরন্দাজরা উদ্যত তীর-ধনুক নিয়ে নদীর তীরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা উত্তর দিকে খোলা সাগরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেই ওরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। প্রত্যেক তীরন্দাজের ধনুকের ছিলা টান টান হয়ে আছে আর ধনুকে তীর জোতা রয়েছে। ওরা কেবল তীর ছুঁড়ার জন্য অপেক্ষা করছে।
ওদের উচ্চপদস্থ চারজন সেনানায়কের শিরস্ত্রাণে লম্বা পুচ্ছ আর বুকে কাঁধে অনেক পদক চকচক করছে। তীরন্দাজদের সারির পেছনে ঘোড়ার পিঠে বসে ওরা আক্রমণের নির্দেশ দেবার জন্য অপেক্ষা করছে।
তবে ওরা হতবাক হয়ে গেল, যখন দেখলো আমরা দক্ষিণ দিকের খালের দিকে মোড় ঘুরে ওদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। প্রথমে ওদের তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তারপর যখন দিলবারের অধীনে দ্বিতীয় তিনতলা জাহাজটিও মোড় ঘুরে আমাদের জাহাজকে অনুসরণ করতে শুরু করলো, তখন ওরা আক্রমণে এলো। এরপর বহরের শেষ জাহাজটি আকেমির অধীনে খালের মোড় ঘুরতেই ক্রিটান সেনানায়কদের নিদেশের রাগি চিৎকার শোনা গেল। তীর ঘেঁষে ঘোড়া ছুটিয়ে ওরা আমাদের পিছু নিল। দৃশ্যটা দেখে আমার হাসি পেল।