তেহুতির নিতম্ব চওড়া হলেও কোমর ছিল একটি সুরার জগের গলার মতো সরু। বুকদুটো গোলাকার আর নিটোল। মাথাজুড়ে সোনালি কোঁকড়া চুল ছিল তার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। মায়ের মতো তার চোখদুটোও ছিল সবুজ। তার সৌন্দর্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না আর যখনই সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতো আমার বুক ধক করে উঠতো। তার স্বভাব ছিল কোমল, সহজে রাগতো না তবে একবার রেগে উঠলে সে অকুতোভয় আর কঠিন হয়ে উঠতো।
আমি তাকে প্রায় সেরকমই ভালোবাসি যেমনটি তার মাকে এখনও ভালোবাসি।
এটন মুক্তকণ্ঠে আমার প্রশংসা করে বললো, তুমি ভালোভাবেই ওদের মানুষ করছো তায়তা। ওরাই হচ্ছে সেই সম্পদ যা আমাদের মিসরকে বর্বরদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
এই বিষয়টিসহ আরও অনেক বিষয়ে এটন আর আমি সম্পূর্ণ একমত ছিলাম। আর এটিই আসল কারণ যেজন্য আমরা দুজন এই সূদুর নির্জন স্থানে এসেছি। যদিও স্বয়ং ফারাওসহ রাজপ্রাসাদের সবাই জানে আমরা এখানে বাও খেলার প্রতিযোগিতা করছি।
তার এই মন্তব্যের তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিয়ে আমি চোখ নামালাম বাও ছকের দিকে। আমি যখন মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন এটন ওর শেষ চালটা দিয়েছিল। মিসরের এই ভীষণ সুন্দর খেলায় সে ছিল অত্যন্ত কুশলি একজন খেলোয়াড়, কিংবা সমগ্র সভ্য জগতেরও একজন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় বলা চলে। শুধু আমি ছাড়া। আমি সাধারণত চারটি খেলার মধ্যে তিনটিতেই তাকে হারিয়ে দিতাম।
এখন একবার নজর দিয়েই বুঝতে পারলাম সেই তিনটি জিতের একটি এবার হতে যাচ্ছে। তার শেষ চালটা বেশ দুর্বল ছিল, খুঁটির বিন্যাস
এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। কোনো কোনো সময় যখন সে ভাবতে শুরু করে যে, এই দানে তার জয় নিশ্চিত হবে তখন প্রায়ই সে এই ভুলটি করে ফেলতো। বাতাসে তার অসাবধানতা টের পাওয়া যেত আর তখন সে সাতটি খুঁটির নিয়ম মেনে চলতো না। এরপর সে দক্ষিণ দিকের নৌকা থেকে পূর্ণ আক্রমণে মনোযোগ দিতে গিয়ে পুর্ব কিংবা পশ্চিম দিকের দখল নিতে আমাকে সুযোগ করে দিত। এবার পূর্বদিক ভোলা ছিল। আমি আর দ্বিতীয় সুযোগের জন্য অপেক্ষা না করে গোখরা সাপের মতো একটা ছোবল মারলাম।
আমার আচমকা এই চালটা যখন সে বুঝতে পারলো তখন হতবাক হয়ে পেছন দিকে হেলে পড়তেই টুলের পেছন দিকে প্রায় উল্টে পড়লো। আমার এই চাতুরিটি বুঝতে পেরে রাগে তার মুখ কালো হয়ে গেল। কথা বলতে গিয়ে তার গলা ভেঙে গেল, আমার তোমাকে ঘৃণা করা উচিত তায়তা। আগে না করলেও এখন অবশ্যই করা উচিত।
আমি যদুর সম্ভব আবেগ দমন করে বললাম, শোন তুমি আমার পুরোনো বন্ধু। আসলে আজ আমার ভাগ্য ভালো ছিল। যাইহোক এটাতো শুধু একটা খেলা।
সে রাগে গাল ফুলিয়ে বললো, এ যাবত যত ফাঁকাবুলি তোমার কাছ থেকে শুনেছি, তার মধ্যে এটা হচ্ছে সবচেয়ে মোটাদাগের। এটা শুধু খেলা নয়। এটা হচ্ছে বেঁচে থাকার একটা কারণ। এবার সে আসলেই রেগে গেছে। মনে হল।
আমি টেবিলের নিচে থেকে তামার মদের জগটা বের করে তার কাপটা ভরে দিলাম। এটা সর্বোৎকৃষ্ট মদ, পুরো মিসরের মধ্যে সেরা। আমি নিজে ফারাওর প্রাসাদের নিচের মদ্য-ভান্ডার থেকে সরাসরি নিয়ে এসেছিলাম। এটন আবার গাল ফুলিয়ে রাগটা আমার উপর ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে যাবে, কিন্তু তার আগের মোটা মোটা আঙুল দিয়ে কাপের হাতলটা ধরতেই সে কাপটা ঠোঁটের কাছে তুললো। দুই ঢোক গিলতেই সুখের আমেজে তার চোখ মুদে এল। তারপর কাপটা নামিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
তারপর বাও খেলার খুঁটিগুলো চামড়ার থলেতে ভরতে ভরতে বললো, হয়তো তোমার কথাই ঠিক তায়তা। বেঁচে থাকার আরও ভালো কারণ নিশ্চয়ই আছে। উত্তরদিক থেকে কী খবর পেলে? তোমার গোয়েন্দা বুদ্ধির চমক আরেকবার আমাকে দেখাও দেখি।
এবার আমাদের এই সাক্ষাতকারের আসল উদ্দেশ্যে আমরা পৌঁছেছি। উত্তরদিকটা সবসময়ই বিপজ্জনক ছিল।
একশো বছর আগে বিশ্বাসঘাতকতা আর বিদ্রোহের কারণে শক্তিশালী মিসর বিভক্ত হয়ে পড়ে। লাল দাবীদার নকল ফারাও, ইচ্ছে করেই আমি তার নাম নিচ্ছি না–অনন্তকাল সে অভিশপ্ত হোক। এই বিশ্বাসঘাতক লোকটি আসল ফারাওয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসিউতের উত্তরে পুরো অংশ দখল করে নেয়। তারপর থেকে আমাদের এই মিসরে একশো বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে।
পরবর্তীতে এই লাল দাবীদারের উত্তরাধিকারী সিনাইয়ের ওপারের তৃণভূমি থেকে আসা বন্য এবং যোদ্ধা এক উপজাতির আক্রমণের শিকার হল। ঘোড়া আর রথের সাহায্যে এই বর্বররা পুরো মিসর জয় করে নিল। এমন অস্ত্রের কথা আমরা আগে কখনও শুনিনি। লাল দাবীদারকে পরাজিত করার পর এরা মধ্য সাগর থেকে শুরু করে আসিউত পর্যন্ত মিসরের সম্পূর্ণ উত্তরাংশ দখল করে নিল। তারপর এই হাইকসোরা দক্ষিণে আমাদের উপর হামলা চালাল।
আমরা অর্থাৎ আসল মিসরীয়রা তাদের হামলা প্রতিহত করতে পারলাম। আমরা নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হলাম। তারপর আরও দক্ষিণে নীলনদের জলপ্রপাতের ওপারে এলিফ্যান্টিনি দ্বীপ আর পৃথিবীর শেষ সীমানার জঙ্গলে পালিয়ে গেলাম। যখন আমরা ক্রমশ নির্জীব আর অবসন্ন হয়ে পড়ছিলাম তখন আমাদের প্রভু, রানি লসট্রিস নতুন করে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করছিলেন।
এই নবজন্মলাভে আমার ভূমিকাও খুব একটা তুচ্ছ ছিল না। নিজের ব্যাপারে আমি সাধারণত বেশি বলি না, তবে অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, আমার পরামর্শ আর পথনির্দেশ ছাড়া আমার প্রভু এবং তার পুত্র যুবরাজ মেমনন, যিনি এখন ফারাও ত্যামোস হয়েছেন, কোনদিন তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারতেন না।