আমি ওদেরকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, ভালো কাজ করেছ। তারপর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, তোমার লোকদের বল, বন্দীদের সবার পরনের উর্দি আর বর্ম খুলে নিতে। সে নির্দেশ জারি করতে করতেই আমি ডেক থেকে সিঁড়ি দিয়ে সবচেয়ে উপরের দাঁড় বাওয়া ডেকে নামতে শুরু করলাম। বেঞ্চে কেউ নেই আর লম্বা দাঁড়গুলো এমনি পড়ে রয়েছে। তবে এই দাঁড়গুলো বাওয়ার জন্য আমার কাছে পঞ্চাশজন মানুষ আছে। এখানে সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে ক্রীতদাসদের ডেকে নামলাম। সাথে সাথে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ নাকে এল। দুর্গন্ধটা এমন শক্তিশালী যে প্রায় দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপরও নামতে লাগলাম।
নিচু ছাদে আটকানো ব্রাকেটে তেলের প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। এই আলোয় দেখতে পেলাম সারিবদ্ধ প্রায় অর্ধনগ্ন ক্রীতদাসেরা বেঞ্চে বসে ওদের সামনের লম্বা দাঁড়ে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। যারা জেগেছিল, তারা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। ওদের নড়চড়ার সাথে সাথে শিকলের ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ভাবলাম একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে বলি, যদি ওরা ভালোভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় বেয়ে চলে, তবে থিবসে পৌঁছে ওদেরকে মুক্তি দেব। কিন্তু এই চিন্তাটা বাদ দিলাম, কেননা ওরা এখন আর পুরোপুরি মানুষের পর্যায়ে নেই। জঘন্য বন্দী জীবন আর নির্মম ব্যবহারের ফলে ওরা প্রায় পশুর পর্যায়ে নেমে এসেছে। আমার ভালো কথা ওদের কাছে কোনো অর্থই বয়ে আনবে না। চাবুক ছাড়া আর কিছুই ওরা এখন বুঝে না।
নিচু ছাদ থেকে মাথা বাঁচাতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ক্রীতদাসের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে শেষমাথায় একটা দরজার কাছে গেলাম। নিশ্চিত এটাই মাল রাখার খোল। দরজায় একটা ভারি পিতলের তালা ঝুলছিল। জারাস আমার পিছু পিছু আসছিল। আমি একপাশে সরে তাকে জায়গা করে দিতেই সে তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়ে তালাটা খুলে এক লাথি মেরে দরজাটা খুললো।
ব্রাকেট থেকে একটা তেলের প্রদীপ নিয়ে আমি মালখানায় ঢুকলাম। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত রূপার বাক্সগুলো সাজানো রয়েছে। অবশ্য মাঝখানে একটা বড় ফাঁক দেখা যাচ্ছে। মনে মনে একটা হিসাব কষে বুঝলাম ক্রিটানরা প্রায় একশোটা বাক্স এখান থেকে দুর্গে নিয়ে গেছে।
একবার ভাবলাম, এই বিশাল ধনভাণ্ডারের এই সামান্য অংশটুকু ফেলে রেখে তিনটি জাহাজে আর যা আছে তা নিয়ে চলে যাই। তারপর ভাবনাটা সরিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, দেবতা মৃদু হেসেছেন তায়তা, এখন এর পুরোপুরি সুযোগ নাও, কখন আবার দেবতা ভ্রুকুটি করে কে জানে। তারপর জারাসের দিকে ফিরে বললাম, এসো আমার সাথে। তোমার কাছে যতলোক আছে, সেখান থেকে যতজন পার নিয়ে এসো।
এবার কোথায় যাব?
আমি সারিবদ্ধ করে রাখা রূপার বাক্সগুলোর মাঝখানের ফাঁকটা দেখিয়ে বললাম, দুর্গে গিয়ে আমরা খুঁজে বের করবো বাদবাকি রূপার পেটিগুলো ক্রিটানরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। ওখানে যত রূপা আছে তা দিয়ে একটা পুরো সেনাবাহিনীকে সজ্জিত করে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো যায়। যে করেই হোক বিওনের হাতে যেন এটা না পড়ে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
এরপর আমরা দ্রুত ডেকে ফিরে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে জেটিতে নামলাম, জারাসও তার দশজন লোক নিয়ে আমাকে অনুসরণ করলো। সাথে সে বন্দী ক্রিটান নাবিকদেরও নিয়ে এলো। ওদের পরনের সমস্ত পোশাক খুলে প্রায় নগ্ন করেছে। দুর্গের ফটকের ভেতরে আমরা দিলবার আর তার ত্রিশজন লোকের দেখা পেলাম। তীরে যেসব শত্রুদেরকে ওরা বন্দী করেছিল তাদেরকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।
আমি দিলবারকে নির্দেশ দিলাম তার অধীনস্থ বন্দীদেরও পোশাক খুলে নিতে। ক্রিটান সৈন্যদের পোশাক আর বর্ম যতবেশি পাওয়া যায় তা আমাদের প্রয়োজন হবে। মিনোয়ান সেনা কর্মকর্তারা রূপা, সোনা আর মূল্যবান পাথরের নেকলেশ, আংটি, বাজুবন্ধ, বালা পরেছিল।
আমি দিলবারকে নির্দেশ দিলাম ওগুলোও খুলে নিতে। সেখান থেকে দুটো অসাধারণ ধরনের অলংকার তুলে নিয়ে আমি আমার চামড়ার থলেতে ভরে নিলাম। বেশিরভাগ মেয়েদের মতো আমার দুই ছোট রাজকুমারিও সুন্দর আর চকচকে ছোটখাট গহনা পছন্দ করে।
তারপর নজর ফেরালাম শিকলে বাঁধা বন্দীর সারির দিকে। ওরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক নজর দেখেই বুঝলাম এখানে বিভিন্ন জাতের মানুষ রয়েছে, যার মাঝে লিবিয়, হুরিয়, সুমেরিয় আছে। তবে বেশিরভাগই মিসরী। সম্ভবত হাইকসোরা এদের বন্দী করেছিল, তারপর এই দুর্গ নির্মাণ করার কাজে সাহায্য করার জন্য ওরা এদেরকে ক্রিস্টানদের হাতে তুলে দিয়েছিল। এদের মধ্যে একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। লোকটির বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে এখনও হতাশায় ভেঙে পড়েনি।
দিলবারকে বললাম, এই লোকটাকে পাশের কামরায় নিয়ে যাও। সে লোকটাকে জাপটে ধরে টানতে টানতে পাশের ছোট কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আমি তাকে বললাম আমাদের দুজনকে একা রেখে কামরা ছেড়ে চলে যেতে। তারপর কিছুক্ষণ নিরবে ক্রীতদাসটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো আচরণ করলেও তার চোখে একটু অবাধ্য ভাব আছে যা সে লুকাতে চেষ্টা করছিল।
ভালো! আমি ভাবলাম, তার মানে সে এখনও মানুষ আছে।
তারপর আমি আমাদের নিজেদের সুমিষ্টভাষায় নরম সুরে তাকে বললাম, তুমি একজন মিসরী। কথাটা শুনেই সে চমকে উঠল, বুঝলাম সে আমার কথা বুঝেছে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, কোন পল্টন? কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে সে শুধু কাঁধ ঝাঁকালো। এমন ভান করলো যেন আমার কথা বুঝতে পারেনি, তারপর নিচে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।