ভারী ওজন নড়াচড়ার কারণে ভাসমান পন্টুন স্থিতিশীলতা হারাতে শুরু করলো। ওজনদার বর্মপরা লোকগুলো ভারসাম্য হারিয়ে মাতালের মতো একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়তে লাগলো, তারপর পন্টুন থেকে ছিটকে পানিতে পড়তে শুরু লাগলো।
আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করলাম একটা পন্টুন পানিতে ডুবে যেতেই প্রায় বিশজন মানুষ একধার দিয়ে খালের পানিতে ছিটকে পড়ে গেল। কয়েকমিনিটের মধ্যে বেশিরভাগ ক্রিটান সৈন্য কালো পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে ইঁদুরের মতো পানির নিচে তলিয়ে গেল।
বিষয়টা আরও বেদনাদায়ক মনে হল, কেননা এরাতো আসলে আমাদের শত্রুও ছিল না। আমি ইচ্ছা করে কারসাজি করে এদেরকে আমাদের মিত্র বানিয়েছিলাম। আমার দেশ মিসর আর ফারাওয়ের জন্য একাজটা করছি জেনেও মনে কোন সান্ত্বনা পেলাম না। আমার কৃতকর্মের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখার পর আমি মর্মাহত হলাম।
যাইহোক অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আমার মনের অপরাধবোধ আর বিবেকদংশন একপাশে সরিয়ে দিলাম। জানি যা ঘটেছে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর কথা মন থেকে দূর করবার চেষ্টা করে নিজেদের মানুষের কথা ভাবতে শুরু করলাম। আর কী কী ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব শুরু করলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে যেখানে রশিগুলো কেটেছিলাম সেদিকে এগোলাম। অকারণে চিৎকার করে আমার লোকদের উপর রাগ ঝাড়তে শুরু করলাম। ওদেরকে বললাম দাঁড় নিয়ে বেঞ্চে বসতে, কাউকে কাউকে ঠেলা দিলাম, লাথি দিলাম আর ইতস্তত করার কারণে দুএকজনকে চড়চাপড়ও দিলাম। ওরা সবাই হতবাক হল আমার কাজকারবার দেখে।
অবশেষে আমি নৌকার হাল নিজের হাতে তুলে নিলাম। দাঁড়িরা একসাথে দাঁড় বেয়ে চললো। এরপর দুর্গের মূল ফটকের নিচে পাথরের জেটির দিকে নৌকার মুখ ঘুরালাম। সেখানেই রূপার বাটভরা জাহাজগুলো নোঙ্গর করা ছিল।
.
আমাদের ছোট্ট নৌকাটির গলুই পাথরের জেটির সিঁড়ির গায়ে ঠেকতেই আমি এক লাফে নেমে পড়লাম। খোলা তরবারি হাতে জারাস সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। উত্তেজনায় সে হাঁপাচ্ছিল আর দাঁত বের করে বোকার মত হাসছিল।
রক্তমাখা তরবারি ডগা দুর্গের খোলা ফটকের দিকে নির্দেশ করে সে বললো, রত্নভাণ্ডার ভরা তিনটা জাহাজ আর দুর্গটাও আমরা দখলে নিয়েছি! পন্টুন সেতুর কাছে আপনি যে গোলমাল সৃষ্টি করেছিলেন তাতে বেশ চমৎকারভাবে ওদের মনোযোগ সেদিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। দুর্গের রক্ষীরা যখন আপনাদের লড়াই দেখছিল, তখন আমরা আচমকা আক্রমণ করে ওদেরকে কাবু করে ফেলি। আমাদের আসা ওরা মোটেই টের পায়নি। মনে হয়না কেউ পালাতে পেরেছে আর পালাতে চেষ্টা করলেও বেশি দূর যেতে পারবে না। তারপর একটু থেমে দম নিয়ে আবার বললো, সেতুর কাজটি আপনি কীভাবে সামলালেন তায়তা? আমি বেশ খুশি হলাম শুনে যে, লড়াইয়ের উত্তেজনার মধ্যে আর বিজয়ের পরও হাইকসো ভাষায় কথা বলার কথা তার মনে আছে।
আমি তাকে সংক্ষেপে জানালাম, সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে আর অর্ধেকের বেশি শত্রুসেনা নদীতে ডুবে গেছে। তারপর পেছন দাঁড়িয়ে থাকা আকেমির দিকে তাকিয়ে বললাম, এই নৌকাটি আর দাঁড় বাওয়ার জন্য বারোজন লোক সাথে নাও। তারপর একটু দূরে একসারিতে নোঙর করা ছোট ছোট কয়েকটা নৌকা দেখিয়ে বললাম, মশাল আর আগুনের পাত্র নিয়ে ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেল। নইলে ক্রিটানরা ওগুলো দখল করে ওদের সৈন্যদের খাল পার করিয়ে আবার আজ রাতে আমাদের উপর আক্রমণ চালাতে পারে।
আকেমি উত্তর দিল, এখুনি আপনার নির্দেশ পালন করা হবে, প্রভু।
আমি বললাম, সবচেয়ে বড় নৌকাটা রেখে দিও। সারির একেবারে শেষ মাথায় ঐ চতুষ্কোণ পাল-বিশিষ্ট ছোট জাহাজটা পুড়িও না। ওটা এখানে নিয়ে এস, আমরা যখন চলে যাবো তখন এটা জেটিতে বেঁধে রেখে যাবো।
আকেমি আর জারাস, উভয়েই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। শুধু জারাস সাহস করে আমার এই নির্দেশ সম্পর্কে জানতে চেয়ে বললো, ক্রিটানদের জন্য এটা এখানে রেখে যাবো? কেন এটা করবো আমরা?
এটা এজন্য রেখে যাবো, যাতে ক্রিস্টানদের সেনা কর্মকর্তারা ক্রিট দ্বীপে ফিরে গিয়ে তাদের রাজাকে হাইকসো মিত্রদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানাতে পারে। ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ এই পাঁচলাখ রূপার বাট হারিয়ে নিশ্চয়ই মনে খুব কষ্ট পাবেন। তারপর আবার যখন এই ঘটনার সংবাদ পাবেন, তখন তিনি রাজা বিওনের রক্ত পান করতে চাইবেন।
তারপর আমি জেটিতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আকেমি আর তার লোকজনের নদীর মোহনার দিকে যাওয়া লক্ষ্য করলাম। সে চারজন লোককে বড় চারকোণা পালওয়ালা জাহাজে তুলে দিল। ওরা একটা তিনকোণা পাল তুলে জাহাজটা জেটির নিচে যে জায়গায় আমি আনতে বলেছিলাম, সেখানে এনে রাখলো।
তারপর দেখলাম আকেমি আমাদের ছোট্ট নৌকাটির সামনের গলুইর কাছে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার লোকেরা দাঁড় বেয়ে তাকে সারিবদ্ধ ছোট ছোট নৌকাগুলোর কাছে নিয়ে গেল। যেতে যেতে সে একটা একটা জ্বলন্ত মশাল প্রত্যেক নৌকার উপর ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। সবগুলো ভালোভাবে জ্বলতে শুরু করার পর আমি সন্তুষ্ট হলাম। তারপর ফিরে জারাস যেখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ফিরে গেলাম।
তাকে বললাম, বাকি লোকজনদের নিয়ে আমার সাথে এসো। তারপর সবচেয়ে কাছে ধনভাণ্ডারভরা ক্রিস্টানদের তিনতলা বড় জাহাজটার দিকে ছুটতে ছুটতে বললাম, এই জাহাজটা দখল করো জারাস। আমি তোমার সাথেই যাব।