শত্রু সেনার প্রথম সারিটি আমাদের উপর আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো। মশালের আলোয় পুরো দৃশ্যটি পরিষ্কার দেখা গেল। তখনও পন্টুন সেতুর কয়েকটা রশি কাটা বাকি ছিল। পঞ্চাশ পা দূরত্ব থাকতেই শুনলাম আক্রমণের নেতৃত্বে থাকা ওদের একজন সেনাকর্মকর্তা চিৎকার করে কিছু একটা নির্দেশ দিল। ভাষাটা পরিষ্কার না বুঝলেও তার অর্থটা সাথে সাথেই পরিষ্কার হল।
ছুটন্ত অবস্থাতেই ক্রিটান সৈন্যরা পেছনে দিকে হেলে এক যোগে বল্লম ছুঁড়লো। বল্লমগুলো আমার লোকজনের মাঝে এসে পড়লো, ওরা তখনও কুঠার দিয়ে লম্বানৌকাগুলো বেঁধে রাখা দড়ির বাঁধন কাটছিল। আমি দেখলাম একটা বল্লম আমার একজন লোকের পিঠ দিয়ে ঢুকে ডগাটা সামনের দিকে প্রায় একগজ বুক থেকে বের হল। সে নৌকাটির একপাশ দিয়ে নদীতে পড়ে গেল আর কালো পানিতে দেহটা তলিয়ে গেল। তবে তার সাথে কাজ করে যাওয়া অন্যান্য সেনারা একবারও কাজ ছেড়ে তার দিকে ফিরে তাকাল না। ওরা একমনে পন্টুন বেঁধে রাখা রশির উপর কুঠার চালিয়ে গেল।
রশিটা ছিঁড়তেই বেশ জোরে কট করে একটা শব্দ শুনলাম, তারপর কাঠের সাথে কাঠ ঘসাঘসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো। আরও রশি ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হতেই লম্বা নৌকাগুলো আলাদা হতে শুরু করলো।
তারপর একসময় সেতুটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তবে বিচ্ছিন্ন অংশ দুটি আমাদের নৌকার দুইপাশে লেগে থাকলো। আমি চিৎকার করে আমার লোকদের নৌকায় উঠে আসতে বললাম। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত ছিলাম না, আমার দুর্ভাবনা ছিল কেবল আমার দুঃসাহসী লোকদের নিরাপত্তা নিয়ে।
বর্মপরা ক্রিটানরা কোন ধরনের বাধা ছাড়াই ঝড়ের মতো পন্টুনের উপর দিয়ে ছুটে এল। যুদ্ধংদেহী আর গগন বিদারি চিৎকার করতে করতে ওরা বল্লম ছুঁড়তে লাগলো। আমার লোকেরা নৌকার পাটাতনের আড়ালে বসে পড়লো। সড়কিগুলো নৌকার কাঠের গায়ে এসে বিঁধলো।
সেতুর দুই অংশের মাঝখানে বেঁধে রাখা আমাদের নৌকার দড়িগুলো কাটার জন্য চিৎকার করে আমি নির্দেশ দিলাম। তবে হৈচৈ আর প্রচণ্ড কোলাহলের মাঝে কেউ আমার নির্দেশ শুনতে পেল না। আমার একজন লোকের হাত থেকে একটা কুঠার কেড়ে নিয়ে আমি নৌকার সামনের দিকে ছুটে গেলাম।
একজন ক্রিস্টান সৈন্যও আমার দিকে ছুটে এল। আমরা দুজনে একইসাথে নৌকার সামনের দিকে পৌঁছলাম। ছুটতে ছুটতে সে তার হাতের বল্লমটা আমার দিকে ছুঁড়লো, তারপর কোমরের খাপ থেকে তলোয়ারটা বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা মুখোমুখি হতেই সে তলোয়ারটা খাপ থেকে বের করে হাতে নিল।
দেখলাম শিরস্ত্রাণের নিচে সে দাঁত বের করে হাসছে। হয়তো ভাবছিল আমার আর রক্ষা নেই, এবার নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করবে। তারপর তলোয়ারটা একবার পিছিয়ে আগাটা সোজা আমার বুক বরাবর চালাল। তবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঠিক সময়মতো শরীরে একটা মোচড় দিলাম। ফলে তলোয়ারের ডগাটা আমার বগলের নিচ দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে আমি এক হাতে তার তলোয়ার ধরা হাতটির কনুই চেপে ধরলাম।
তারপর তাকে শক্ত করে সামনে খাড়া করে ধরে রাখলাম। সে ছাড়া পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু নড়াচড়ার কারণে তার পায়ের নিচে পন্টুনের অংশটা দুলে উঠতেই সে ভারসাম্য হারাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি তার তলোয়ার ধরা হাতটা ছেড়ে দিলাম। এর জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, সাথে সাথে পেছনের দিকে ঢলে পড়তেই দুই হাত সামনে বাড়িয়ে তাল সামলাতে চেষ্টা করলো।
সাথে সাথে আমি তার তলোয়ার ধরা ডান হাতের কব্জির উপর কুড়ালের এক কোপ মারলাম, শরীরের শুধু এই অংশটাই ধাতব বর্ম দিয়ে ঢাকা ছিল না। নৌকার দুলুনির কারণে আমিও ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলাম না, তাই কোপটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। তলোয়ার ধরা হাতটা সম্পূর্ণ কাটা না পড়লেও কব্জির হাড় কেঁটে গিয়ে আঙুলগুলো আলগা হয়ে পড়লো। হাতের আঙুলগুলো খুলে যেতেই তলোয়ারটা তার হাত থেকে নিচে কাঠের তক্তার উপর পড়তেই ঠনঠন ধাতব শব্দ হল। টলমল পায়ে সে তার পেছনের সঙ্গির গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। জড়াজড়ি অবস্থায় দুজনেই পন্টুন সেতু টপকে ঝপাং করে নিচে পানিতে পড়ে গেল। পরনের ভারী বর্মের ওজনের কারণে সাথে সাথেই দুজনেই পানির নিচে তলিয়ে গেল।
কুড়ালটা তখনও আমার হাতে ধরা ছিল, আর যে দুটো মুরিং রশি দিয়ে আমাদের নৌকাটা পন্টুন সেতুর সাথে বাঁধা ছিল, সেগুলো ঠিক আমার সামনে শক্ত হয়ে টান টান হয়েছিল। রশির গিটের উপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। আমি কুড়ালটা মাথার উপর তুলে সর্বশক্তি দিয়ে সবচেয়ে মোটা রশিটার উপর লক্ষ স্থির করে এক কোপ দিলাম। ধনুকের ছিলার মতো রশিটা কেটে দুই টুকরা হয়ে গেল। তারপর আবার কুড়ালটা তুলে অন্য রশিটার উপর কোপ মারতেই এটিও কেটে গেল। রশিগুলো আলাদা হতেই ওজন আর টান ছুটে যেতেই নৌকার মাথাটা একবার উপরের দিকে উঠেই আবার নামলো। আর আমরা বাঁধন মুক্ত হয়ে স্রোতের অনুকূলে ভেসে চললাম।
এর ফলে ভাঙা সেতুর উপরে নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সেতুর প্রত্যেকটি অংশ তখনও নদীর তীরে বাঁধা ছিল। তবে নদীর মাঝে অন্য দুই অংশ সংযুক্ত ছিল না আর স্রোত দুই মাথাকে আরও দূরে সরিয়ে দিল। লক্ষ্য করলাম একসাথে দল বেঁধে থাকা বেশ কয়েকজন ক্রিটান সৈন্য টলমল অবস্থায় ভাঙা সেতুর উপর দাঁড়িয়ে তাল সামলাতে চেষ্টা করছে।