তীরের আঘাতে মিনোজের দেহ গুহার দেয়ালের খোলা জায়গা দিয়ে নিচে পড়ে গেল। সে নিচে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মায়ের মৃতদেহটিও, কালো কাপড়ের পুতুলের মতো সে যেখানে পড়েছিল তার পাশে পড়লো।
আমি এক লাফে ব্যালকনির দেয়াল টপকে পর্দা বেয়ে মঞ্চের মেঝেতে নামলাম। তারপর যেখানে বেকাথা শুয়েছিল সেখানে ছুটে গেলাম। তলোয়ারের খাপসহ কোমরবন্ধ খুলে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হুইকে বললাম, তাকে শক্ত করে ধর। তার খুব যন্ত্রণা হবে।
তার বাহুর ভাঙা হাড়টি সোজা করতেই সে ফুঁপিয়ে উঠলো। হাড়টা সোজা রাখার জন্য তলোয়ারের খাপের সাথে হাতটা বেঁধে দিলাম। তারপর মদের বোতলটি আমার কোমরের থলে থেকে নিয়ে হুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, সে যতটুকু খেতে পারে ততটুকু তাকে খাওয়াও। এতে ভালো কাজ হবে।
যন্ত্রণার মধ্যেও মৃদু হেসে বেকাথা ফিসফিস করে বললো, হুই আমার মনের মানুষ। এখন সে যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো। তার ঘরই আমার ঘর। আর যে মদ আমি পান করছি তা তার সাথে ভাগাভাগি করে নেব। আমি তার জন্য গর্ববোধ করলাম।
মন্দিরের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখলাম হেরেম থেকে আসা রাজকীয় নারী দেহরক্ষীর দলটি পালিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম ওদের সাথে মিলোয়ন অভিজাতরাও পালিয়েছে। তবে তোরানকে দেখলাম লক্সিয়াসের কাঁধে হাত রেখে জারাস আর তেতির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধু, তুমি কি আমাদের সাথে আসবে?
তোরান একটু ভেবে উত্তর দিল, মিনোয়ান সাম্রাজ্য আজ এখানে ধ্বংস হয়েছে। আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। পাঁচশো বছর আগে এই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। তার চেহারা মলিন হল। তারপর এক মুহূর্ত পর বললো, আমি আমার স্বদেশ হারিয়েছি। তবে মিসর হাইকসোদের বিরুদ্ধে তাদের সবচেয়ে মিত্র হারিয়েছে। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস বললো, তবে যাইহোক লক্সিয়াস আর আমি আপনার সাথে থিবসে গিয়ে সেটাকেই আমাদের নতুন দেশ বানাবো।
আমি ঘুরে জারাস আর তেহুতির দিকে তাকিয়ে বললাম, জারাস, তেহুতি, আমি তোমাদের দুজনকে জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছি। তবে অবাক হলাম না যখন তেহুতি দুজনের হয়ে উত্তর দিল।
সে কেবল বললো, তায়তা, আমি তোমাকে আর মিসরকে ভালোবাসি, তবে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি জারাসকে। যদি তোমার সাথে থিবসে ফিরে যাই, তবে আমার ভাই আবার আমাকে অন্য কোনো বর্বর দেশের পাগল রাজার সাথে বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। আমি যথাসাধ্য ফারাও আর আমার দেশের জন্য সেবা করার চেষ্টা করেছি। তবে এখন আমি মুক্ত হয়ে আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই। তারপর জারাসের এক হাত ধরে আবার বললো, আমরা হুই আর বেকাথার সাথে চলে যাবো। তারপর আইয়োনিয়ান সাগরের ওপারে উত্তরের দেশে নতুন ঘর বাঁধবো।
আমি বললাম, আমিও তোমাদের সাথে গেলে খুশি হতাম। তবে আমার দায়িত্ব রয়েছে থিবসে ফারাওয়ের সাথে। আমি তাকে জানাবো তুমি আর বেকাথা মরে গেছ, তাহলে তিনি আর কখনও তোমাদের খোঁজে কাউকে পাঠাবেন না।
সে বললো, ধন্যবাদ তায়তা। তারপর একটু ইতস্তত করে আবার বললো, হয়তো একদিন দেবতা প্রসন্ন হলে তুমি আবার আমাদেরকে খুঁজতে আসবে।
আমি একমত হয়ে বললাম, হয়তো আসবো।
সে কথা দিল, আমি আমার প্রথম ছেলে হলে তোমার নামে তার নামকরণ করবো। আমি ঘুরে চোখের পানি লুকালাম। তারপর শূন্য পাথরের বসার ধাপের উপর চড়ে গুহার দেয়ালের খোলা জায়গাটির কাছে এলাম। এখান দিয়েই আমার তীর মিনোজের দেহে আঘাত করেছিল।
খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে তিনশো ফুট নিচে তাকিয়ে দেখলাম পাথরের উপর রক্তের মাঝে মিনোজের দেহটি হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। তার বুকের রূপার বর্মের উপর দিয়ে আমার তীরের ডগা বের হয়ে রয়েছে। মাথায় তখনও সেই শিরস্ত্রাণটি পরা রয়েছে। শিরস্ত্রাণের চোখের অন্ধকার গর্তের ভেতর দিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না।
মৃদু কণ্ঠে প্রশ্নটি করলাম, তুমি কী? তুমি কী একজন মানুষ, দানব, শয়তান না দেবতা ছিলে? তারপর মাথা নেড়ে আবার বললাম, প্রার্থনা করছি এই প্রশ্নের উত্তর যেন কোনোদিন জানতে না পারি।
মিনোজের মা, পাসিফের মৃতদেহ আমার পায়ের কাছে পড়েছিল। আমি দেহটি তুলে নিচে ফেলে দিলাম। তারপর আবার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটি দেহ একটি আরেকটির উপর বিশ্রিভাবে পড়ে রয়েছে।
তারপর ঘুরে আবার রঙ্গমঞ্চের দিকে গেলাম, যেখানে আমার মেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাই মন্দির থেকে বের হয়ে গোলক ধাঁধার মধ্য দিয়ে হেঁটে জঙ্গলের মাথায় আমাদের ঘোড়াগুলোর কাছে পৌঁছলাম। তারপর ঘোড়ায় চড়ে শেষবারের মতো একটি পরিবারের মতো একসাথে চললাম। ইডা পর্বতের ঢালে পৌঁছে ঘোড়ার লাগাম টেনে থামিয়ে কুনুসস উপসাগরের দিকে ফিরে তাকালাম।
ক্রোনাস পর্বত আর নেই। সমুদ্রের অতল গভীরে তলিয়ে গেছে। কেবল টগবগ করে ফুটতে থাকা সাগরের ঘোলা পানি এর সমাধির চিহ্ন হয়ে রয়েছে।
তারপর সামনে তাকিয়ে দেখলাম, যেখানে একদা ক্রিমাদ বন্দরটি ছিল, সেখানে আমাদের ছয়টি জাহাজের নৌবহর অক্ষত দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে জাহাজগুলো তীর থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে সমুদ্রে নোঙর করা ছিল। ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।