তারপর সে পিঠ বাঁকা করে আহত বঁড়টির পেছনে হালকা পায়ে এক লাফে নেমে দুই হাত উঁচু করে পেছন দিকে সরে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে দানবীয় জন্তুটির টলে পড়া লক্ষ্য করতে লাগলো। বঁড়টি সামনের দুই পা দুইদিকে ছড়িয়ে মাথা নিচু করে নাক মাটিতে ঠেকাল। মুখ হা করে প্রচণ্ড গর্জন করলো। এর গলা দিয়ে উজ্জ্বল রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হল।
তারপর টলতে টলতে পেছন দিকে হেলতেই পেছনের পাদুটো ভেঙে যেতেই পশুটি প্রচণ্ড শব্দে মঞ্চের মেঝেতে পড়ে গেল। শব্দটি শুনে মনে হল যেন কুঠার দিয়ে একটি সিডার গাছ কেটে মাটিতে ফেলা হয়েছে। একপাশে গড়িয়ে পড়ে এটি কিছুক্ষণ পর পর পেছনের পা দুটো ছুঁড়তে লাগলো। তারপর নিশ্চল হয়ে গেল।
পুরো গুহায় নীরবতা নেমে এলো। আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম।
এরপর উপসাগরের ওপারে আগ্নেয়গিরিতে বিশাল দেবতা ক্রোনাস প্রচণ্ড রোষে ফেটে পড়লেন। দেবতা তার বলি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তার আত্মস্বরূপ প্রাণীটিকে তার নিজ মন্দিরের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে।
আমি মন্দিরের রঙ্গমঞ্চ থেকে মুখ তুলে বাইরে কুমুসস উপসাগরে একটি আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেলাম।
চরমতম ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ক্রোনাস তার নিজের দুর্গ ধ্বংস করেছেন। মনে হল এটি বেশ ধীরে ধীরে ঘটছে। সম্পূর্ণ পর্বতটি বড় বড় কয়েক হাজার টুকরায় বিস্ফোরিত হল। এক একটি খণ্ড ক্রিট কিংবা তার চেয়েও বড়। সমুদ্রপৃষ্ঠের কয়েক হাজার ফুট নিচে আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রস্থল থেকে প্রচণ্ড শক্তির বলে এগুলো অনেক উঁচুতে সজোরে নিক্ষিপ্ত হল। পাথরগুলো কেন্দ্রস্থলের গভীর চুল্লিতে উত্তপ্ত হয়ে একসময় গলে যায় এবং এমন উজ্জ্বল সাদা আলো নিয়ে জ্বলতে থাকে, যা সূর্যকে ম্লান করে দিয়ে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। তারপর পাথরগুলো সাগরে পড়তেই সাগরের পানি টগবগ করে ফুটতে থাকে।
ফুটন্ত পানি থেকে বাষ্প বিস্ফোরিত হয়ে পাক খেয়ে খেয়ে সাদা মেঘ হয়ে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে আকাশের দিকে উঠে যায়। এখন কিছুই আর নেই; সাগর, পৃথিবী আর আকাশ। শুধু ঘন বাস্পের দেয়াল রয়েছে।
মনে হল সমস্ত কিছু নিঃশব্দে ঘটেছে আর সারা পৃথিবী আর এর মাঝের সমস্ত জীবন্ত প্রাণী শ্বাস বন্ধ করে রেখেছে।
তারপর এই প্রলয় কাণ্ডের আওয়াজ শোনা গেল। উপসাগরের পানির উপর দিয়ে শব্দটি আসতে যা সময়টুকু লেগেছিল। অনেকটা পাথর পতনের মতো শব্দটি একটি কঠিন বস্তুর মতো ক্রিট দ্বীপের উপর আছড়ে পড়লো।
যদিও আমরা গুহার দেয়াল দিয়ে আংশিক ঢাকা ছিলাম, তারপরও প্রচণ্ড শব্দের ধাক্কায় আমরা মাটিতে পড়ে গেলাম। শব্দের চোটে কানে তালা লেগে যেতেই আমরা মাটিতে শুয়ে কানে হাত চাপা দিয়ে ফোঁপাতে লাগলাম।
প্রচণ্ড শব্দ আর কম্পনের কারণে গুহার ছাদ থেকে বড় বড় পাথরের চাঙর খসে পড়লো। পাথর চাপা পড়ে আমার চারদিকে মানুষ আর্তচিৎকার করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছিল। ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের ডেকের মত গুহার মেঝে দুলতে শুরু করলো।
সবার আগে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তবে জ্বলন্ত পর্বতের আলোয় আমার চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল আর মেঘের গুড়গুড় গর্জনের মতো শব্দে কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। কোনোমতে হাঁটু গেড়ে বসে গুহার চতুর্দিকে তাকালাম। তবে আমিই একমাত্র লোক নড়াচড়া করছিলাম না।
জারাস ষাঁড়ের মৃতদেহের কাছে পড়ে থাকা তেহুতির দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। সে তেহুতিকে তার কোলে তুলে নিল। আমি দেখলাম তেহুতিও বিমুঢ় আর হতভম্ব হয়ে রয়েছে।
হুই বেকাথার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হল সে তাকে ছুঁতে ভয় পাচ্ছিল। সে এমন একজন যোদ্ধা যে বহু যুদ্ধক্ষেত্রে ডিঙিয়ে এসেছে, অথচ তার ভালোবাসার নারীর রক্ত দেখে আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। একটি শিশু যেমন তার প্রিয় পিতামাতার কাছে সান্ত্বনা খুঁজে, সেরকমভাবে বেকাথাও ভাঙা হাতটি অন্য হাতে ধরে হুইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
এবার ওদের দিক থেকে ফিরে আমি সর্বাধিরাজ মিনোজের দিকে তাকালাম। তিনি গুহার খোলা মুখের কাছে দাঁড়িয়ে বাস্পের মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, যা সেই জায়গাটিকে নিশ্চিহ্ন করেছে যেখানে একসময় ক্রোনাস পর্বত অবস্থিত ছিল।
মিনোজ দুই হাতে তার মায়ের রোগা পলকা দেহটিকে ধরে দুই হাত মাথার উপরে উঁচু করে ধরে রেখেছে। তার মাথা চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে আর চোখগুলো কোটর থেকে বের হয়ে রয়েছে। গুহার ছাদ থেকে খসে পড়া পাথরের আঘাতে তিনি মারা গেছেন।
মিনোজ গর্জন করে উঠলো, কেন তুমি এটা আমার সাথে করলে? হে মহাপরাক্রমশালী ক্রোনাস, আমিতো তোমার সন্তান। আমার মা তোমার প্রেয়সী এবং স্ত্রী ছিলেন। তুমি কি আমার দেওয়া অর্ঘ্য গ্রহণ করে তাকে বাঁচাতে পারতে না?
আমি বুঝলাম সে এই পৃথিবীতে আরও অনিষ্টকর কাজ করার আগেই তাকে আমার মেরে ফেলতে হবে। এরপর সে আমাদের সকলকে-আমার রাজকুমারী, আমার বন্ধু আর আমার সহকর্মীসহ আমাকেও ধ্বংস করবে।
ধনুক তুলে একটা তীর ছুঁড়ে মারলাম। এটা তার পেছনের সোনারবর্মের ঠিক মাঝখানে আঘাত করলো। তার দেহ স্থির হয়ে গেল আর তীরের আঘাতে তার পিঠে যে গর্ত হয়েছিল সেখান থেকে কালো রক্ত ঝরতে লাগলো। রক্তের দুর্গন্ধে সমস্ত মন্দির ভরে গেল, যেন দশদিন রোদে ফেলে রাখার পর পচন ধরা লাশের দুর্গন্ধ।