শিকারের দিকে তাকিয়ে এটি দাঁত বের করে ক্রুদ্ধ গর্জন করলো। উপরের ঠোঁট পেছনের দিকে কুঁচকাতেই লম্বা তীক্ষ্ণদাঁত বের হয়ে পড়লো। এই দাঁত তৃণভোজীর নয় এটি মাংসাশী প্রাণীর দাঁত।
সর্বাধিরাজ মিনোজ এই প্রাণীটিকে প্ররোচিত করে বলতে লাগলেন, আমি আপনার পানের জন্য কুমারীর রাজরক্ত এনেছি। আপনার খাওয়ার জন্য কুমারী রাজকন্যার মাংস এনেছি। মেরে ফেলুন! খেয়ে ফেলুন!
আমাকে অসাড় করতে যাচ্ছিল যে আতঙ্কবোধ, তা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। তারপর মিনোয়ানদের সমবেত কণ্ঠের মন্ত্রপাঠের কানে তালা লাগানো শোরগোলের উপর দিয়ে গলা তুলে চিৎকার করে বললাম, জারাস, হুই! আমাদেরকে নিচে গিয়ে ওদেরকে বাঁচাতে হবে। পর্দা ব্যবহার করে নামতে চেষ্টা কর। তবে যেভাবেই হোক নেমে পড়।
ওরা দুজন প্রায় ধাক্কা দিয়ে দ্রুত আমাকে পাশ কাটাল। একজনের পর একজন ব্যালকনির রেলিং টপকালো, তারপর ঝুলন্ত পর্দাটি ধরে নিচে নামলো। নিচে মঞ্চে নামার সময় আঘাত এড়াতে ওরা পর্দা ধরে সরসর করে পিছলে নামলো। তবে দেখলাম তেহুতিকে বাঁচাতে ওরা অনেক দেরি করে ফেলেছে।
চকচকে সাদা বঁড়টি এখন তেহুতির দিকে এর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রিভূত করেছে। এবার প্রচণ্ড গর্জন করে সোজা তার দিকে তেড়ে গেল।
বেকাথা চিৎকার করে উঠলো। এই শব্দে নিশ্চিত দানবটির মেজাজ বিগড়ে গিয়ে চোখ আরও লাল হল। জারাস আর হুই তখন মাত্র মেঝেতে পা রেখেছে। আক্রমণের মাঝখানে হস্তক্ষেপ করার আগে মঞ্চের অর্ধেক জায়গা পার হতে হবে।
আমি ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে একটা তীর ছুঁড়লাম। তীরটা ঠিক বঁড়টির বিশাল কাঁধে আঘাত করলো যেখানে আমি লক্ষস্থির করেছিলাম। তবে কাঁধের হাড়ে লেগে তীরটা ছিটকে সরে গিয়ে দর্শকসারিতে বসা একজন মিনোয়ান অভিজাতের বুকে আঘাত করলো। লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
তীরের আঘাত বঁড়টির গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারেনি। আর তীর ছুঁড়ার সাহস হল না, কেননা বেকাথা তখন তার বোনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সে সোজা ষাঁড়ের হামলার পথেই ছুটতে শুরু করেছে।
ষাঁড়টি তার দিকে ঘুরে দানবীয় মাথাটা নিচু করলো। লম্বা চকচকে একটা শিং দিয়ে বেকাথাকে গুতো মারতেই এটি তার বাহুর উপরে বিঁধলো। শিংয়ের তোয় বেকাথা ষাঁড়টির পিঠের উপর দিয়ে শূন্যে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়লো। আমি দেখলাম তার বাহুর হাড় ভেঙে গিয়ে রক্ত ঝরছে। মনে হল মাটিতে নরম বালুর উপর পড়ায় সে বেশি আঘাত পায় নি। ষাঁড়টি আবার ঘুরে তাকে অনুসরণ করলো।
তেহুতি আমাদের সবার চেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল। সে একছুটে ষাঁড়টির আক্রমণের পথে গিয়ে জোরে চিৎকার করে দুই হাত তুলে ষাঁড়টির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো।
ষাঁড়টির দপদপ করে উঠা নাসারন্ধ্রের ছিদ্র থেকে বের হওয়া নিঃশ্বাসের গরম আর দুর্গন্ধময় বাষ্প গুহার স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল। তেতি এই বাস্পের নিচ দিয়ে ছুটতে ছুটতে মাথার গোলাপের মুকুটটি খুলে নিয়ে জন্তুটির মুখে ছুঁড়ে মেরে জম্ভটিকে পাশ কাটাল।
হতচকিত হয়ে বিশাল ষাঁড়টি একটু থামলো, এই ফাঁকে তেহুতি আবার এক চরকি মেরে ঘুরতেই জারাসকে দেখতে পেল। সে তখন মাত্র পর্দা বেয়ে রঙ্গমঞ্চের মেঝের কাছাকাছি নেমেছে।
সে চিৎকার করে উঠলো, জারাস! বঁড়টি এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো, তারপর বেকাথাকে ছেড়ে ঘুরে তেহুতির দিকে তাড়া করতে ছুটলো। তেহুতি একটি হরিণীর মতো দ্রুতগামি হলেও ষাঁড়টি তার চেয়েও দ্রুতগামি ছিল। এটি প্রায় তার উপর এসে পড়তেই সে চোখের পলকে এক লাফ দিয়ে দিক বদল করলো। এতে বঁড়টি ঘুরে আবার তার পিছু নেওয়ার আগে সে একগজের মতো জায়গা পেল।
আমি দেখলাম এবার সে আমি যেখানে ব্যালকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক তার নিচ দিয়ে যাবে। আমি কোমরবন্ধে গোঁজা তলোয়ারটি বের করে উঁচু করে ধরে নিচে মঞ্চের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। তলোয়ারটি সরাসরি নিচের দিকে পড়তেই এর ডগাটি বালুতে গেঁথে গেল। হাতলটি তেহুতির সামনে খাড়া হয়ে দাঁড়ালো।
চিৎকার করে তেহুতিকে বললাম, তলোয়ারটি তুলে নাও!
আরেকবার তেহুতি একজন ক্রীড়াবিদের দ্রুতো আর শক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাল। ছুটন্ত অবস্থায় পাশ কাটাবার সময় সে তলোয়ারটি ঝট করে মাটি থেকে ডান হাতে তুলে নিল।
ষাঁড়টি আবার প্রায় তার উপর এসে পড়েছে। এটি মাথা ঘুরাতেই বামদিকের শিং বাতাসে হিশশ শব্দ করে তেহুতির কাঁধ ঘেসে গেল। তেহুতি মাথা নিচু করে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। বঁড়টি আবার তাকে পাশ কাটিয়ে গেল। তারপর ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার জন্য বঁড়টি ঝটকা মেরে মাথা উচুঁ করতেই তেহুতি এক হাত দিয়ে বঁড়টির কাছের শিংটি ধরে ফেললো।
তেহুতি এক হাত দিয়ে ধরে থাকা অবস্থায় বঁড়টি শিং উপরের দিকে তুলতেই সে বাধা দিল না। বরং সে ষাঁড়টির সাথে একই দিকে লাফ মারলো। ষাঁড়ের কুজওয়ালা পিঠের উপর দিয়ে শূন্যে ভেসে সে অন্যপাশে মাটিতে নামলো। মাটিতে নামার সময় সে তলোয়ারের ডগাটি ষাঁড়টির কাঁধের হাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় নিশানা করলো।
নরম এই স্থানটিতে কোনো হাড় নেই। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তেহুতি তলোয়ারটি পুরোপুরি ষাঁড়ের দুই কাঁধের মাঝখান দিয়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর তলোয়ারটি ভেতরে সেঁধানো অবস্থায় হাতলটি ছেড়ে দিল।