পর্দা সরানো খোলা দরজা দিয়ে সবুজ পোশাক পরা একদল নারীযোদ্ধা ঢুকলো। ওরা মাথায় ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির উজ্জ্বল পালক উঁচু করে লাগানো টুপি পরে রয়েছে। হাতের উঁচু ঢালগুলো লবণ মাখানো কুমিরের চামড়ার তৈরি। ওরা চারপাশ থেকে গোল হয়ে ঘিরে ধরে কিছু একটা লুকিয়ে নিয়ে আসছিল। রঙ্গমঞ্চের ঠিক মাঝখানে এসে ওরা থামলো। তারপর পূর্বনির্ধারিত ইঙ্গিতে সরে দাঁড়াতেই আমার দুই রাজকুমারীকে মাঝখানে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা গেল।
তেহুতি আর বেকাথা হাত ধরাধরি করে হতবাক হয়ে মুখ উঁচু করে তাদের সামনে গ্যালারিতে বসা উপাসক আর পুরোহিতদের বিকট চিৎকার শুনছে। ওদের মাথায় সাদা গোলাপের মুকুট পরানো রয়েছে।
তবে মাথায় মুকুট ছাড়া পরনে আর কিছু নেই। দুজনেই পুরোপুরি নগ্ন। ওদেরকে দেখে খুব কমবয়সি, নাজুক প্রায় শিশুর মতো মনে হচ্ছিল। তেহুতি আর বেকাথাতে একা দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে নারী-দেহরক্ষী দলটি ঘুরে রঙ্গমঞ্চ থেকে বের হয়ে গেল।
সমবেত উপাসকদের একযোগে প্রচণ্ড চিৎকার করে মন্ত্র পড়ার শব্দে মেয়েদুটো অভিভুত হয়ে আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। সর্বাধিরাজ মিনোজ আবার উঠে দাঁড়াতেই চিৎকার থামিয়ে সবাই চুপ হলো। ধীরে ধীরে তিনি ঘুরতেই তার সোনালি মুখোশটি মন্দিরের পেছনের দেয়ালমুখি হল। দেয়ালের গায়ে দূরবর্তী ক্রোনাস পর্বতের ছবি আঁকা ছিল। এবার তিনি গলা চড়িয়ে তার দেবতাকে আবাহন করতে শুরু করলেন। তার শিরস্ত্রাণের মধ্য থেকে প্রতিধ্বনিতৃ হয়ে বের হয়ে আসা চিৎকার আর ষাঁড়ের মত গর্জনের একটি বর্ণও আমি বুঝতে পারলাম না।
তবে এবার কথাগুলোর অর্থ ঠিকই বুঝা গেল, যখন তিনি তার রত্নখচিত কোমরবন্ধ থেকে ব্রোঞ্জের বিশাল তলোয়ারটি বের করলেন। তলোয়ারটি আমার সমান লম্বা। তিনি ঘুরে নিচে বলির মেঝেতে দাঁড়ানো নগ্ন মেয়েদুটির দিকে তাকালেন।
যদিও মাথাটকা ধাতব মুখোশ আর পেছনে পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে কথাগুলো কিছুটা দুর্বোধ্য আর অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল, তারপরও এই প্রথমবার আমি তার উচ্চারিত কথাগুলোর অর্থ সঠিক ধরতে পারলাম।
হে প্রিয় ক্রোনাস! সকল দেবতার প্রথম দেবতা- ক্রোনাস! আমি আপনার পুত্র; আপনার ঔরসজাত; আপনার দেহ এবং রক্তের অংশ। হাজার বছর ধরে আমি আপনার উপাসনা করে আসছি। হাজার বছর ধরে আপনাকে ভালোবেসে আপনাকে মান্য করে এসেছি। এখন আবার দাঁড়িয়ে আপনার প্রতি আমার আনুগত্য এবং শপথ ঘোষণা করছি। আমি আপনার জন্য বলি এনেছি যা আপনার পবিত্র আত্মা ব্যকুলভাবে কামনা করছে। আপনার পানের জন্য কুমারী রাজকন্যার রক্ত আর খাওয়ার জন্য কুমারী রাজকন্যার মাংস এনেছি। আসুন আপনার পার্থিব রূপে এসে আপনার জন্য যে অর্ঘ্য এনেছি তা গ্রহণ করুন। মেরে ফেলুন! খেয়ে ফেলুন!
তারপর তিনি তলোয়ারটি তুলে তেহুতি আর বেকাথার সামনের বন্ধ দরজার উপর জোরে একটি খোঁচা মারলেন।
দরজাটির দুই দিকের পাল্লা খুলে গেল তবে ভেতরে অন্ধকার দেখা গেল। আমি তাকালাম তবে দরজার ওপাশে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর ভেতরে কিছু একটা নড়াচড়া করে উঠলো, যা এতো বিশাল আর ভয়ঙ্কর যে আমার কল্পনার বাইরে।
ভীত সন্ত্রস্ত বেকাথা হু হু করে কেঁদে উঠে তার বড় বোনের গা ঘেঁসে এলো। আতঙ্কে তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। তেহুতি এক হাত দিয়ে তার বোনকে ধরলো। বেকাথাও দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনেই তোরণের দিক থেকে পিছিয়ে এলো।
পুরো মঞ্চ জুড়ে নিবিড় এবং স্পষ্ট বোধগম্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো; আর বাইরের জগতেও। আগ্নেয়গিরির মেঘের মত গুড়গুড় গর্জনও হঠাৎ থেমে গেল। নিচে পৃথিবী স্থির হয়ে রয়েছে। মনে হল বিশাল দেবতা ক্রোনাসও তার নিজের মন্দিরে যে নাটক ঘটতে যাচ্ছে তাতে সম্মোহিত হয়ে পড়েছেন।
নাকের ক্রদ্ধ ফেস-ফেঁসানি আর বালু ছড়ানো পথে ভারী খুরের ধপ ধপ শব্দে নীরবতা ভঙ্গ হল। একটি বন্য উরুস ষাঁড় তীব্র গতিতে খোলা দরজা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে ঢুকলো। সমবেত কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণের প্রচণ্ড কোলাহল হঠাৎ কানে যেতেই সে আচমকা মাঝ পথে থেমে পড়লো। তারপর সামনের পায়ের খুর দিয়ে বালু আঁচড়ে ধুলির মেঘ উড়াতে শুরু করলো।
এযাবত যত উরুস ষাড় আমি দেখেছি সেগুলোর গায়ে কালো আর গাঢ় বাদামি ডোরা কাটা ছিল। তবে এই ষাঁড়টির গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। চোখদুটো পালিশ করা রুবির মতো উজ্জ্বল। প্রচণ্ড ক্রোধে মাথাটি এদিকওদিক নাড়তেই মনে হল ষাঁড়টির দেহ আরও ফুলে আরও বড় হয়ে উঠছে। ক্রোধটি কোথায় ঝাড়বে সেই লক্ষ্য খুঁজছে।
বিশাল শিংগুলো হাতির দাঁতের মতো সাদা। কালো চকচকে ডগাগুলো বর্শার আগার মতো তীক্ষ্ণ। একজন মানুষ হাত মেলে ধরলে তার দ্বিগুণ হবে শিংদুটোর বিস্তার। . প্রাণীটি সামনে দাঁড়ানো নগ্ন মেয়েদুটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে একবার তাকালো, তারপর মাথা নিচু করলো। রাগে এর দুই কাঁধের মাঝখানের বিশাল কুজটি ফুলে উঠেছে। তারপর এটি খুর দিয়ে মাটি আঁচড়াতে লাগলো।
জন্তুটির গায়ের রঙ ও আকৃতি আর সেই সাথে এর দেহ থেকে যে অশুভ আভা নিঃসৃত হচ্ছে তা থেকে হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম যে, এটি কোনো বনজঙ্গল কিংবা পর্বতের প্রাণী নয়। এটি এমন একটি কিছু যাকে এর দানবীয় প্রভুর তরফ থেকে বলি গ্রহণ করার জন্য আগ্নেয়গিরির গভীর অগ্নিকুণ্ড থেকে পাঠানো হয়েছে।