আমাদের বিশ কিউবিট কিংবা তার চেয়েও বেশি নিচে মস্ত ফাঁক হয়ে থাকা একটি বিশাল গুহামুখের মতো খোলা জায়গা দেখা যাচ্ছে। এর সামনের দেয়ালে দুই পাশে স্তম্ভ বসানো একটি প্রবেশ পথ দিয়ে দিনের আলো ঢুকে জায়গাটি আলোকিত হয়েছে। প্রবেশ পথটির মধ্য দিয়ে আমরা বিধ্বস্ত ক্রোনাস নগরী আর দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়া দেখতে পেলাম।
আমাদের ঠিক নিচে একটি প্রশস্ত অর্ধ-বৃত্তাকার মল্লভূমি দেখা যাচ্ছে। এর মেঝে সুক্ষ সাদা বালু দিয়ে ঢাকা, এর উপরে একটি সোনা আর রূপার একটি বেদি রয়েছে। বেদিতে একটি বন্য ষাঁড়ের সোনালি মূর্তি দাঁড় করানো রয়েছে। ষাঁড়ের মূর্তিটি ফুল আর সুগন্ধি ধুপের পাত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে।
মল্লভূমি আর বেদির চারপাশ ঘিরে কয়েক স্তরে গ্যালারির মতো ধাপে ধাপে পাথরের আসন পাতা রয়েছে।
নিচের দুই ধাপের আসনে সারিবদ্ধভাবে বসে রয়েছে কালো পোশাক আর উঁচু টুপিপরা মিনোয়ান অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। তাদের মুখে চক-খড়ি চূর্ণ মেখে সাদা করা হয়েছে আর চোখের চারদিকে প্রথাগতভাবে কালো সুরমা মাখা। ওরা সবাই কোনো নড়াচড়া না করে একদৃষ্টিতে নিচে রঙ্গালয়ের শূন্য মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেবল এক সুরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় গাওয়া শোকসঙ্গীত উচ্চারণ করার সময় তাদের মুখ নড়ছিল।
মাত্র কয়েকজনকে দেখে আমি অবাক হলাম। তেহুতি আর বেকাথার সাথে মিনোজের বিয়ের সময় বন্দরের রাজপ্রাসাদে ওরা কয়েকহাজার ছিল। আর আজ এখানে পঞ্চাশ জনেরও কম দেখা যাচ্ছে। অগ্নৎপাত আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মিনোয়ান সমাজের ফুলের ভয়াবহ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে।
স্তব গেয়ে চলা লোকগুলোর পেছনের সারির আসনগুলো শূন্য পড়ে রয়েছে। গ্যালারির কেন্দ্রস্থলে একটি উঁচু সোনার সিংহাসন রয়েছে। এটিও শূন্য।
সিংহাসনের ঠিক পেছনে ভূগর্ভস্থ মন্দিরে ঢোকার সুরঙ্গ পথের মুখ দেখা যাচ্ছে। গুহার মতো মুখটি দিয়ে কুনুসস উপসাগরের ওপারে দূরে ক্রোনাস পর্বতের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। জমজ আগ্নেয়গিরি ধুয়ার কুণ্ডলি উদ্গিরণ করে আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে সূর্যকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে।
আমরা যে ব্যালকনিতে হামাগুড়ি দিয়ে বসেছিলাম সেটি নিচের মল্লভূমির মেঝে থেকে এতো উঁচুতে ছিল যে, আমাদের দিকে মুখ করে বসা দর্শকরা আমাদের দেখতে পাচ্ছিল না। এছাড়া গুহার ছাদ থেকে বালুময় মেঝের একটু উপর পর্যন্ত ঝুলানো একটি গাঢ় রঙের পর্দার আড়ালে আমরা আংশিক ঢাকা পড়েছিলাম। তারপরও আমি, জারাস আর হুইকে সাবধান করে বললাম একটু পিছিয়ে ছায়ার মাঝে গিয়ে ওদের অস্ত্রগুলো কিছু একটা দিয়ে ঢেকে রাখতে যাতে এর উপর দিনের আলো প্রতিফলিত হয়ে মন্দিরে আমাদের উপস্থিতি ফাঁস না হয়ে যায়।
আমার কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই এই রঙ্গমঞ্চের দুইদিকে দিয়ে রক্ত লাল আলখাল্লাপরা দুইসারি পুরোহিত ভেতরে ঢুকলো। ওরা সোনালি সিংহাসনের চারদিকে অবস্থান নিয়ে অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে গলা মিলিয়ে শোক সঙ্গীতে সামিল হল।
তারপর হঠাৎ সমস্ত শব্দ থেমে গেল। চতুর্দিকে গভীর নীরবতা নেমে এল। সমবেত উপাসকবৃন্দ এবার গোঙনির মতো শব্দ করে একটানা কিছু উচ্চারণ করে যেতে লাগলো আর সবাই একসাথে সকলে হাঁটু গেড়ে বসে মার্বেল পাথরের মেঝেতে মাথা ঠেকালো।
সর্বাধিরাজ মিনোজ এবার আসবেন মনে করে আমি সারাক্ষণ শূন্য সিংহাসনটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, ভেবেছিলাম মানুষকে ঠকানোর জন্য আরেকটি নাটকীয় কৌশল ব্যবহৃত হবে। তারপরও আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এক মুহূর্ত সিংহাসনটি খালি ছিল আর তার পরের মুহূর্তেই দেখলাম মিনোয়ান নৃপতি সেখানে বসে রয়েছেন। আর দুর্বল কংকালসার দেহ নিয়ে তার মাও তার পাশে বসে রয়েছেন।
তার মা একজন বিধবার কালো বেশ পরে রয়েছেন। তবে মিনোজ অত্যন্ত উজ্জ্বল রাজভূষণ পরে রয়েছেন। মনে হচ্ছে তার উপস্থিতি দিয়ে গুহামুখে সমস্ত প্রজাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে। তার বর্ম আর দামি ধাতুর তৈরি বীভৎস ষাঁড়ের মুখোশ থেকে উজ্জ্বল আলোর চিকন ছটা ছায়ায় ছিটকে পড়ছে।
লুকোনো জায়গা থেকে বাদকদল রণসঙ্গীত বাজাতে শুরু করতেই পুরো গুহামুখ তুমুল কোলাহলপূর্ণ শব্দে ভরে গেল। আর সেই সাথে সমবেত উপাসকবৃন্দ আবেগে আত্মহারা হয়ে ব্যক্তি পূজার আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।
সর্বাধিরাজ মিনোজ এবার তার বর্ম পরা ডান হাতের মুঠো উঁচু করতেই আবার সম্পূর্ণ নীরবতা নেমে এলো। এমনকি ব্যলকনিতে বসা আমরা তিনজনও সেই সাথে নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।
মিনোজ আবার আরেকটি ইঙ্গিত করতেই আবার সবাই সমস্বরে অন্যধরনের একটি আদিম পাশবিক ক্রদ্ধ শব্দ করতে শুরু করলো। তারপর গুহার ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পর্দাগুলো দুইদিকে সরিয়ে দেওয়া হল। রঙ্গস্থলের দুই পাশের পাথরের দেয়ালে দুটি বন্ধ দরজা দেখা গেল। সমবেত উপাসকরা আরও জোরে স্তব করতে লাগলো। এমনকি লাল পোশাকপরা পুরোহিতরাও তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করে স্তব করতে লাগলো। শব্দটি এখন আর প্রার্থনা কিংবা পূজার স্তব রইল না। এটি এখন একটি প্রচণ্ড যৌন কামনা এবং ধর্ষকাম বিষয়ক আনন্দের কামোত্তেজনা জাগানো গর্জনে পরিণত হয়েছে।