একশো পঞ্চাশ জনের বড় দলটি নিয়ে জারাসকে নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহারা চৌকির নজর এড়িয়ে যতদূর সম্ভব দুর্গের মূল ফটকের কাছাকাছি পাঠালাম। আমার কাছ থেকে সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত ওরা সেখানেই লুকিয়ে থাকবে।
দুজন আলাদা হওয়ার আগে জারাসকে আমার পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বললাম। পঞ্চাশজন লোকসহ আমি নৌকা নিয়ে উজানের দিকে যাব। আমার উদ্দেশ্য হল পন্টুনসেতুটা ধ্বংস করা। এটাই শক্রর মূল শিবিরের সাথে যে দ্বীপে কোষাগারটি রয়েছে সেখানে যাওয়ার একমাত্র পথ। আলাদা হওয়ার আগে জারাসকে আলিঙ্গন করে আবার কয়েকবার আমার নির্দেশগুলো তাকে বুঝিয়ে বললাম, যাতে কোনো ধরনের ভুলবুঝাবুঝি না হয়।
তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর আমি নৌকায় বসে মাল্লাদের দাঁড় বাওয়ার নির্দেশ দিলাম। খরস্রোতা হলেও আমার মাল্লারা প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে চললো। বেশ দ্রুত আমরা উজানের দিকে এগিয়ে চললাম। একটুপরই চাঁদের আলোয় চকচকে সাদা চুনাপাথরের দুর্গের চূড়াটা নজরে পড়লো। দুর্গ চোখে পড়ার সাথে সাথেই আমার লোকেরা দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁড় বাইতে লাগলো।
এবার শেষ বাকটার কাছে পৌঁছলাম, এরপর সামনেই দুর্গ। তিনতলা জাহাজ তিনটি এর আগে যেরকম দেখে গিয়েছিলাম সেরকম এখনও পাথরের জেটিতে নোঙর করা রয়েছে। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম দুটো জাহাজ এখনও পানিতে একটু দেবে রয়েছে। তার মানে এখনও এগুলোর খোলে রূপার বাটভরা রয়েছে। তৃতীয় জাহাজটা একটু উঁচু মনে হল। এর বেশিরভাগ মাল হয়তো খালাস করা হয়েছে। তারপরও আমার আন্দাজ মতো এটিরও অর্ধেকের বেশি মাল এখনও জাহাজে রয়ে গেছে।
আশেপাশে কোন ক্রিটান পাহারাদার দেখা গেল না। বিশাল জাহাজগুলোতেও কোনো আলো নেই। যাইহোক জেটির এক মাথায় একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে রাখা হয়েছে। আর দুর্গের ফটকের দুই পাশে দুটো ব্রাকেটের মধ্যে মশাল জ্বলতে দেখা গেল।
মাথা থেকে ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণটা খুলে কোলের উপর রাখলাম। তারপর গলায় পেঁচানো উজ্জ্বল হলুদ কাপড়ের টুকরাটা দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকলাম। এটা অত্যন্ত দামি অসাধারণ একটি কাপড়, যাকে রেশমি কাপড় বলা হয়। অত্যন্ত দুর্লভ এই কাপড়টি রূপার চেয়েও দামী। পৃথিবীর অন্য এক কোণ থেকে এটা আসে। সেখানে মানুষ নয়, গুটিপোকা এই কাপড় বুনে। এর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা রয়েছে। এটি অশুভ শক্তিকে দূর করে, এছাড়া প্লেগ আর হলুদ ফুলের মতো রোগকে দূরে রাখে। যাইহোক এখন এটা দিয়ে আমি আমার মুখ ঢাকলাম।
আমার চেহারায় এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, শত্রু মিত্র যে কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে। আসলে সৌন্দর্যের জন্য মূল্য দিতে হয়। ফারাওয়ের পর সম্ভবত আমার মুখই সারা বিশ্বে সুপরিচিত। অবশ্য বিশ্ব বলতে আমি মিসরকে বুঝাচ্ছি। এবার শিরস্ত্রাণটি আবার মাথায় পরতেই অন্যান্য সৈন্যদের মাঝে আমি মিশে গেলাম।
স্বভাবতই আমরা ধরে নিয়েছিলাম ক্রিস্টান সেনাকর্মকর্তারা এত লোকজনের ভীড়ে এই দুর্গে নিশ্চয়ই রাত কাটাবে না। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই ওরা বেশিরভাগ সেনাসহ সেতু পার হয়ে খালের অন্য তীরে তাদের আরামদায়ক শিবিরে রাত কাটাতে চলে গেল।
তারপরও জেটি থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে আমরা নিঃশব্দে নোঙর বাঁধা জাহাজগুলো আর দুর্গের দেয়াল পার হলাম। এগুলো পেছনে ছেড়ে আসার পর সামনে দূরে সারিবধা লম্বা নৌকাগুলো দেখা গেল, এগুলো পাশাপাশি বেঁধে পন্টুন সেতুটা তৈরি করা হয়েছে।
আমরা দাঁড় বেয়ে উজানের দিকে এগিয়ে পন্টুন সেতুর প্রায় দুইশো গজের মধ্যে পৌঁছলাম। তারপর স্রোতের দিকে নৌকা ঘুরিয়ে সরু লম্বা পন্টুন সেতুর দিকে তীর তাক করলাম। দাঁড়িদের বললাম দাঁড় ছেড়ে দিয়ে কোনো নড়াচড়া না করে স্রোতের হাতে নৌকা ছেড়ে দিতে। স্রোত আমাদেরকে সেতুর কেন্দ্রে নিয়ে যাবে।
শেষ মুহূর্তে আমি হাল ঘুরিয়ে দিয়ে সেতুর গায়ে নৌকা ঠেকালাম।
আমার লোকেরা প্রস্তুত ছিল। তিনজন তিনজন করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ওরা নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সেতুর দিকে ছুটলো। বাদবাকিরা কুঠার আর তলোয়ার নিয়ে পন্টুন সেতুর দিকের জাহাজের পাশে দাঁড়াল। আর কোন নির্দেশের অপেক্ষা না করে ওরা একটার সাথে আরেকটা বেঁধে রাখা লম্বা নৌকাগুলোর রশির বাঁধন কাটতে শুরু করলো।
কুঠারের আঘাতের শব্দ নিশ্চয়ই খালের অন্য তীরে শত্রু শিবিরে পৌঁছে গিয়েছিল, কেননা প্রায় সাথে সাথেই শুনলাম সৈন্যদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আহবান জানাতে ক্রিটানরা ঢাক পিটানো শুরু হয়েছে। শত্রু শিবিরে হৈ চৈ, হট্টগোল শুরু হল, সার্জেন্টরা চিৎকার করে নির্দেশ দিতে লাগলো, ঢালের সাথে তলোয়ারের ঝনঝনানি, বর্মের ঠোকাঠুকি, খটখট আর ঢাকের শব্দ এখানেও পৌঁছে গিয়েছে। তারপর মশাল জ্বালতেই চারদিক আলোয় ভরে গেল, পলিশকরা ধাতব ঢাল আর বুকের বর্মের উপর আলো প্রতিফলিত হল।
ঘুমচোখে পদাতিক সেনার দীর্ঘ একটি সারি খুঁটির বেড়ার মাঝখানে যে পথটি ছিল তার মুখ থেকে বের হয়ে পন্টুন সেতুর গোড়ায় এসে দাঁড়াল। প্রথম চারজন ক্রিটান সেনা একযোগে সরু সেতুটির উপর লাফিয়ে পড়তেই তাদের পায়ের স্যান্ডেলের চাপে সেতুটি দুলে উঠলো।