এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মাঝে জমজ আগ্নেয়গিরি প্রচণ্ড গর্জনের সাথে অগ্নিশিখা আর ধূঁয়া উদ্গিরণ করে আকাশ ঢেকে ফেললো।
আমি অবিশ্বাসের চোখে সামনের ধ্বংসলীলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিনোয়ান সাম্রাজ্যের চিহ্ন নেই। এর নিজের উন্মাদ দেবতা সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।
কিন্তু আমার মেয়েরা কোথায়? আমার বুকের ভেতরে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হল। কেন তুমি আমাকে এখানে পাঠালে ইনানা? এটা কি শুধু আমার সাথে মজা করার জন্য আর আমাকে কষ্ট দেবার জন্য করেছ?
তারপর হঠাৎ চোখে পড়লো, যেখানে আমার ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক তার নিচে পাহাড়ের পাদদেশে মিসরীয় দুতাবাস ভবনটির দিকে। কিছুদিনের জন্য হলেও এটা আমার বাড়ি ছিল। ভবনটি সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে। এতো উঁচুতে জোয়ারের ঢেউ পৌঁছাতে পারেনি। দ্বীপের উত্তর ঢালে একমাত্র এই ভবনটি টিকে রয়েছে।
জারাস আর হুইকে চেঁচিয়ে ডাকলাম, আমার পেছন পেছন এসো। ঘোড়ার পাঁজরে পা দিয়ে তো দিতেই ঘোড়া সামনের দিকে চলতে শুরু করলো। পর্বতের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নামা শুরু করতেই আরেকবার ক্রোনাস পর্বতের জমজ চূড়া থেকে প্রচণ্ড কম্পন শুরু হল। আমার ঘোড়াটি আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। আমি তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। তবে রেকাবের দুইপাশে ঝুলে থাকা লোক দুইজন ভারসাম্য হারিয়ে বিপজ্জনকভাবে পড়ে যাচ্ছিল। আমি ঘোড়াটিকে শান্ত করা পর্যন্ত ওরা অতিকষ্টে নিজেরদেরকে ধরে রাখলো। তারপর আবার আমরা নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।
দূতাবাস প্রাঙ্গণ দেখে মনে হল জনশূন্য। দ্রুত মূল ফটকের সামনে পৌঁছেই লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলাম।
জারাস আর হুই, তোমরা দুজনে পেছনের আস্তাবলে গিয়ে খুঁজে দেখো কোনো ঘোড়া পাও কি না। মেয়েদেরকে খুঁজে পেলে ক্রিমাদ ফিরে যেতে আরও ঘোড়া প্রয়োজন হবে। কোনোমতেই হতাশার কাছে হার মানবো না। আমার রাজকুমারীরা জীবিত না থাকলে ইনানা কখনও আমাকে এখানে ডেকে আনতেন না।
দূতাবাসের দরজা হাট করে খোলা রয়েছে। আমি এক ছুটে ভেতরে ঢুকে জীবিত কেউ আছে কি না জানতে হাঁকডাক শুরু করলাম। তবে কেবল প্রতিধ্বনি আমাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। সমস্ত কামরা শূন্য তবে বেশির ভাগই লুট করা হয়েছে। জিনিসপত্র চারপাশে ছড়ানো ছিটানো। চাকরবাকর আর নগরী থেকে আসা আশ্রিতরা যা পেয়েছে লুট করে নিয়ে পালিয়েছে।
ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কোন দিকে ঘুরবো। হতাশাবোধ আমাকে প্রায় গ্রাস করার উপক্রম হয়েছে। মন শক্ত করে দেবীর কাছে জোরে জোরে প্রার্থনা করতে লাগলাম, ইনানা! ওরা কোথায়? এখন তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। মিনতি করছি আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চল।
সাথে সাথে আমার ডাকে সাড়া পাওয়া গেল। ভবনের উপরতলা থেকে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত্ব হল। প্রভু তায়তা তুমি? সিঁড়িতে কারও পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর সে চিৎকার করে বলে উঠলো, আমি মনে করেছিলাম লুটপাট করতে আরও লুটেরা দস্যুদল এসেছে। আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা মূর্তিটি সিঁড়ির শেষ ধাপগুলো ছুটে পার হয়ে আমার দুইহাতের মাঝে আঁপিয়ে পড়লো। আমি দুই হাতে তার মুখ ধরে উপরে তুললাম। তারপর এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, লক্সিয়াস, তুমি এখানে কী করছো বাছা! আমি তোমাকে অন্য কেউ মনে করেছিলাম।
আমার প্রভু তোরান আমাকে এখানে পাঠিয়ে বলেছেন আপনার জন্য অপেক্ষা করতে। আমরা জানতাম আপনি অবশ্যই আসবেন। আপনাকে পথ দেখিয়ে ক্রোনাস পর্বতে দেবতার প্রধান মন্দিরে নিয়ে যেতে বলেছেন। সে একনাগাড়ে এতোদ্রুত কথাগুলো বলে গেল যে, সে কী বলছিল তা আমি ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলাম। তারপর বললাম, শান্ত হও বাছা! আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারিছ না। লম্বা একটা শ্বাস নাও। তারপর ধীরে ধীরে খুলে বলল কী ঘটেছে।
সর্বাধিরাজ মিনোজের নির্দেশে পুরোহিতরা তেহুতি আর বেকাথাকে প্রধান মন্দিরে নিয়ে গেছে। সেখানে ওরা ক্রোনাস দেবতাকে শান্ত করার জন্য তাদেরকে বলি দেবে, যাতে দেবতা খুশি হয়ে অগ্নিবর্ষণ করে আর গন্ধক ছুঁড়ে মিনোয়ান সাম্রাজ্য ধ্বংস না করেন। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে দ্রুত বলে চললো, ঐ পুরোহিতরা ইতোমধ্যে সর্বাধিরাজ মিনোজের চল্লিশজন কুমারীবধূকে বলি দিয়েছে। তবে ক্রোনাস তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার দুর্বার ক্রোধ প্রশমিত করা যাচ্ছে না। তিনি চরম বলি দাবী করছেন: মিসরীয় ফারাও রাজপরিবারের রাজকুমারীদের বলি চাচ্ছেন।
তোরান কোথায়?
এই ভয়ঙ্কর কাজটি করা থেকে সর্বাধিরাজ মিনোজকে বিরত করতে আর আপনি আসা পর্যন্ত অন্তত বলি বিলম্বিত করার জন্য তিনি প্রধান মন্দিরে গেছেন। তিনি বলেছেন একমাত্র আপনিই তেহুতি আর বেকাথাকে বাঁচাতে পারেন। যেভাবেই হোক তিনি জানতেন আপনি অবশ্যই আসবেন। একজন আলখাল্লাপরা নারী স্বপ্নে তাকে সাবধান করেছিলেন
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি মন্দিরে যাওয়ার পথ চেনো?
সে বললো, হ্যাঁ, চিনি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তোরান আমাকে বলেছেন কীভাবে গোপন দরজাটা খুঁজে বের করে গোলকধাঁধার পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।