আমাদের দলটি তৈরি হওয়ার পর যে কয়েকটা ডিঙি প্রবল জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়েছিল সেগুলো পানিতে ভাসালাম। এতো লোকের ভারে ডিঙিগুলো বিপজ্জনকভাবে দুলে উঠলো।
ঢেউয়ের ধাক্কায় পানি ছলকে নৌকার গলুইয়ের দুই পাশ দিয়ে উঠতেই আমি নিরবে ইনানার প্রতি প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। দেবীকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, আমি কেবল তার নির্দেশ অনুসরণ করছি এবং তিনি নিশ্চয়ই তা শুনেছেন। পোতাশ্রয় রক্ষা বাঁধের কাছে পৌঁছার আগে কেবল তিনজন লোক নৌকা থেকে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে একজন কোনোমতে সাঁতার কেটে জাহাজে ফিরে যেতে পেরেছিল।
পাথরের গায়ে জোরে ধাক্কা লাগতেই ডিঙিগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তবে আমরা হাত ধরাধরি করে নিজেদের সামলে পোতাশ্রয় রক্ষা বাঁধে উঠলাম। আর কোনো ক্ষতি ছাড়াই শক্ত মাটিতে পা রাখলাম।
তারপর জারাস সমস্ত লোকজনকে দুই সারীতে বিভক্ত করার পর আমি ওদেরকে পানিতে ডুবে যাওয়া নগরীর ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললাম। জঞ্জালের নিচে অর্ধেক দেহ মাটিচাপা পড়া ফুলে উঠা কয়েকটি লাশ ছাড়া শহর সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য। এরপর আমরা পর্বতের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। এই স্থানটিও প্লাবিত হয়েছিল। আমি প্রথম সরবরাহ চৌকির দিকে যাওয়ার পথটি খুঁজতে শুরু করলাম। সমস্ত চিহ্ন ধুয়েমুছে গেছে। হয়তো কখনও তা খুঁজে পেতাম না যদি শিকারীর শিঙা ফুকার শব্দ না শুনতাম। সরবরাহ দলের তিনজন সদস্য উঁচু জায়গা থেকে আমাদেরকে দেখতে পেয়ে নিচে নেমে এলো।
ওরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, আমাদেরকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ভেবেছিল যে আমরা ওদের উদ্ধার করতে এসেছি। তবে বেশ হতাশ হল যখন বুঝতে পারলো আসলে তা নয় বিষয়টি। আমি সকলকে সরবরাহ চৌকির দিকে দৌড়ে উঠতে বললাম। পাগল ক্রোনাস দেবতার মেজাজের সাথে তাল রেখে পায়ের নিচে মাটি থরথর করে কেঁপে উঠছিল।
প্রথম চৌকিতে পৌঁছে ছয়জন লোক আর বিশটি ঘোড়া পেলাম। এরা কোনোভাবে তাণ্ডব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পেরেছিল। নিচে মাটি কাঁপার কারণে ঘোড়াগুলো আতঙ্কে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। গন্ধক পোড়া গন্ধ শুঁকে ঘোড়াগুলোর নাসারন্ধ্র ফুলে উঠছিল। অনেক চেষ্টার পর ঘোড়াগুলোকে শান্ত করলাম।
কিছুক্ষণ থেমে অস্ত্রশস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে নিলাম। নিশ্চিন্ত হলাম দেখে যে আমার বাঁকা ধনুকটি মোমলাগান চামড়ার বাক্সে তখনও শুকনো রয়েছে। তবে ধনুকের অতিরিক্ত ছিলাগুলোর অবস্থা দেখে মনঃপুত হল না। কাজেই চৌকির অধিনায়কের কাছ থেকে তার আপত্তি সত্ত্বেও বেশ কিছু ধনুকের ছিলা নিলাম। তারপর ওদেরকে নির্দেশ দিলাম, কোনো কারণে আমরা যদি ফিরে আসতে বাধ্য হই তখন আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য ওরা যেন এখানেই অবস্থান করে।
তারপর আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে জারাস আর হুইকে ঘোড়ায় চড়তে নির্দেশ দিয়ে পথ দেখিয়ে আমাদের ছোট দলটিকে ইডা পর্বতের উপরের পথের দিকে এগিয়ে চললাম।
চূড়ায় পৌঁছাবার একটু আগে সামনের পথ থেকে ছুটে আসা একদল বন্য পশুর খুরের প্রচণ্ড বজ্রধ্বনির মতো শব্দ আর গর্জন শুনতে পেলাম। সাথে সাথে আমার দলের লোকদেরকে নিয়ে পথের পাশে ঘন গাছের মাঝে লুকালাম। একটু পরই একদল দানবাকৃতির পশু আমাদের পাশ কাটিয়ে নিচের দিকে গেল।
অবশ্য সাথে সাথে পশুগুলোকে চিনতে পারলাম। এগুলো ছিল একপাল বন্য উরুস ষাঁড়। রক্তের মতো জ্বলজ্বলে লাল চোখ নিয়ে এগুলো আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল। পিঠে কুজ। পিঠের চামড়া কালো আর গাঢ় বাদামি রংয়ের লম্বা দাগ। হা করা মুখ থেকে জিহ্বা বের হয়ে রয়েছে আর সেখান থেকে ফেনিল লালা ঝরছিল। পশুগুলো আতঙ্কিত হয়ে পর্বতের চূড়ার পাশের পথ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল।
ঠিক এসময়ে আরেকবার ভূকম্পনে আমাদের নিচে পর্বত আবার কেঁপে উঠলো। তাকিয়ে দেখলাম যেপথে বন্য ষাঁড়গুলো ছুটছিল সেদিকে পর্বতের চূড়ার কিনারায় একটি গভীর ফাটল দেখা দিয়েছে। পর্বতের ঢালটি এতো খাড়া ছিল আর পশুর পালটি এতো দ্রুত ছুটছিল যে তাল সামলাতে না পেরে পশুগুলো নিচের দিকে পতন সামলাতে পারলো না। সম্পূর্ণ পশুর পালটি চূড়ার উপর থেকে নিচে পড়ে গেল। পেছনেরগুলো সামনেরগুলোকে ঠেলতেই সমস্ত পশু শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কয়েকশো ফুট নিচে পাথরের উপর বিশাল দেহগুলো আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর সব নীরব হয়ে গেল, তারপর আবার নীরবতা ভঙ্গ হল আগ্নেয়গিরির প্রচণ্ড গর্জনে।
আমরা আবার সবাই পথে নেমে শেষ খাড়া ঢাল বেয়ে চূড়ায় উঠলাম। এখানে একটু থামলাম। পেছন ফিরে বিধ্বস্ত ক্রিমাদ বন্দর থেকে একটু দূরে নোঙর করা আমাদের জাহাজের ক্ষুদ্র আকৃতিটি দেখলাম। তারপর আবার ঘোড়ার পিঠে ঘুরে বসে সামনের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকালাম, যা ছিল এককালে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের রাজধানী, কুমুসস।
বিশাল বন্দরটি আর নেই। বাতিঘরেরও চিহ্ন নেই। সম্ভবত বন্দরের অববাহিকায় ডুবে গেছে। বন্দরের দেয়ালগুলো ভিত্তিসহ পানিতে ভেসে গেছে। কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সাগরের পানি পাথরের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে, যেখানে একসময় এক বিশাল নগরী দাঁড়িয়েছিল।
সর্বাধিরাজ মিনোজ তার নৌবহরের যে দশ হাজার জাহাজের জন্য দম্ভ করতেন, সেগুলো সব জোয়ার রেখার উপর দিয়ে আছড়ে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। পুরো উপসাগরের বুকে ভেসে থাকা একটি জাহাজেরও চিহ্ন নেই। বিধ্বস্ত জাহাজের ভাসমান জঞ্জালে পানি সয়লাব হয়ে রয়েছে। যে প্রাসাদে সর্বাধিরাজ মিনোজ আমার রাজকুমারীদের বিয়ে করেছিলেন সেটিও আর নেই। এছাড়া নৌসদর দপ্তর থেকে শুরু করে সৈকত জুড়ে যে সুরম্য অট্টালিকাগুলো ছিল সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়েছে।