জীবন রক্ষার জন্য যে রশি সবার কোমরে বেঁধে রাখা হয়েছিল, প্রচণ্ড চাপে তার একটা ছিঁড়ে যেতেই চারজন নাবিক সাগরে ভেসে গেল। তারপর আর ওদের দেখা গেল না। বাকিরা কোনোমতে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। আমার কোমরে জড়ানো মোটা শনের রশিটা শক্ত করে কোমরে চেপে বসে আমাকে কেটে প্রায় দুইভাগ করে ফেলছিল। ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। বুঝতে পারলাম আমরা ডুবে যাচ্ছি।
তারপর হঠাৎ জলোচ্ছাসের ঢেউয়ের পেছনের ঢাল দিয়ে জাহাজের সামনের গলুই ভেসে উঠলো। আমি আবার পরিষ্কার বাতাস বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। মনে হল যেন আমরা অনন্তকালের পর মুক্ত হয়েছি। শুধু কোমরে বেঁধে রাখা রশির কারণে আমরা জাহাজ থেকে ছিটকে পড়া থেকে বেঁচে গেলাম।
তারপর আবার আমাদের জাহাজ সাগরের বুকে ধপাস করে পড়লো। প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে কাঠের তক্তা, বাল্কহেড আর কাঠামোর অন্যান্য অংশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। দাঁড়গুলো শুকনো কাঠির মতো ছিঁড়ে গেল।
আমি ভেবেছিলাম আমরা আবার গভীর পানিতে ডুবে যাব। তবে আমাদের ছোট্ট জাহাজটি এবার কাঁপতে কাঁপতে মুক্ত হল। আবার আমরা ভেসে উঠলাম, পুরো ডেক পানিতে ভেসে গেছে। ডেকের উপর মানুষ আর যন্ত্রপাতি একে অপরের উপর স্থূপীকৃত হয়ে রয়েছে।
জারাস আর হুই চিৎকার করে লোকজনদের যার যার অবস্থানে যেতে নির্দেশ দিল। কয়েকজন নাবিক গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, কয়েকজনের হাতপা ভেঙে গিয়েছিল আর অন্যান্যদের পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এদেরকে একপাশে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। অতিরিক্ত ভালো দাঁড়গুলো নিচে দাঁড়ি বেঞ্চে ক্ষতিগ্রস্ত দাঁড়ের জায়গায় বাঁধা হল। দাড়ীরা ভাঙা দাঁড়ের গোড়ার অংশগুলো ছুঁড়ে ফেলে নূতন দাঁড় নিয়ে বাওয়া শুরু করলো।
তারপর আমরা পাগলের মত পানি সেচতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে জাহাজের উচ্চতা বেড়ে জাহাজ আবার পানির উপর হালকা হল। ঢাকিরা আবার ঢাক পেটাতে শুরু করলো। দাঁড়ীরা আবার তাদের আসনে বসে দাঁড় টানতে শুরু করলো। আমরা আবার ক্রিটের দিকে চললাম। এই নিচু অবস্থান থেকে এখন ক্রিটের তটরেখা আবার দিগন্তের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে এখন ক্রোনাস পর্বত থেকে নিঃসৃত আগ্নেয়গিরির ধূঁয়া আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।
দুপুরের একটু পর বাতাস জোরে বইতে শুরু করলো। নাবিকেরা মাস্তুল খাঁটিয়ে সমস্ত পাল খাটাল। এবার চলার গতি দ্বিগুণ হল। জলোচ্ছাসের পর পানিতে ভাঙা গাছের ডালপালা, আর সামনের দ্বীপ থেকে বিধ্বস্ত জাহাজ এবং দালানকোঠার ভাসমান ভাঙা টুকরা ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা এর মধ্য দিয়েই সাবধানে পথ করে নিয়ে এগিয়ে চললাম।
দুইঘন্টা পর আবার ক্রিট দ্বীপ নজরে এলো। এর উপরে আকাশ পর্যন্ত উঁচু আগ্নেয়গিরির ধুয়ার স্তম্ভের তুলনায় এটাকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আর গুরুত্বহীন মনে হচ্ছিল। এখন উন্মাদ ক্রোনাস দেবতার গুড় গুড় গম্ভীর গর্জন আমাদের উপরও এসে পড়ছে। এতো দূর থেকেও গর্জন ঠিকই শোনা যাচ্ছিল। আর দেবতার তাণ্ডবের তালে তালে সাগরের পানিও নাচছিল।
দাঁড়ীরা ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে দাঁড় টানছিল। অন্যান্য নাবিকরা ডেকে গা ঘেঁসাঘেসি করে বসে আহত আর মৃতপ্রায়দের সেবা করতে লাগলো। আতঙ্কে সবার মুখ সাদা হয়ে গেছে। তারপরও আমি ক্রিটের দিকে ওদেরকে যেতে বাধ্য করছিলাম। যখন মনে হল ওরা বিদ্রোহ করে বসতে পারে, তখন জারাস আর হুই চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে রইল।
ডাঙার কাছাকাছি হতেই জলোচ্ছাসের তাণ্ডবলীলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ক্রিমাদ বন্দরের কাছে পৌঁছে চিনতেই পারছিলাম না। কেবল পেছনে ইডা পাহাড়ের চূড়া দেখে বুঝা গেল এটা ক্রিমাদ বন্দর।
প্রচণ্ড ঢেউ এসে সমস্ত দালানকোঠা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এমনকি পোতাশয় রক্ষা করা বাঁধের ভারী পাথরখণ্ডগুলোও বাচ্চাদের খেলার ব্লকের মতো সাগরে ভেঙে পড়েছে।
পর্বতের পাদদেশ জুড়ে যেসব বন আর কৃষি ভূমি ছিল, সেগুলো সব রিক্ত হয়ে গেছে। বড় বড় গাছ, দালানের ধ্বংসাবশেষ আর বিশাল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ একসাথে মিশে জঞ্জালের মতো স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে।
সবচেয়ে খারাপ লাগলো, যখন দেখলাম আস্তাবলটা নেই। সহিস আর ঘোড়াগুলো নিশ্চয়ই ঢেউয়ের তোড়ে সাগরে ভেসে গেছে। রাজকুমারীরা দ্বীপের অন্যপাশে রয়েছে। ঘোড়া ছাড়া এই জট পাকানো জঙ্গলের ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ওদের কাছে পৌঁছাতে অনেকদিন লেগে যাবে।
বড় জোর এটুকু আশা করা যায়, দ্বীপের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত যে কয়েকটি রসদ সরবরাহ চৌকি করেছিলাম সেগুলো হয়তো অনেক উঁচুতে অবস্থানের কারণে জলোচ্ছাসের ছোবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। হয়তো কয়েকটা ঘোড়াও বেঁচে থাকতে পারে।
ক্রিমাদ বন্দরের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটু দূরে গভীর সমুদ্রে আমরা জাহাজের নোঙর ফেললাম। তারপর জারাস আর হুইকে ডেকে বললাম, পর্বতের উপরে প্রতিটি রসদ সরবরাহ ঘাটির আস্তাবলে দশ থেকে বিশটা ঘোড়া থাকার কথা। যদি এখনও বেঁচে থাকে। তোমরা ত্রিশজন ভালো লোক। বেছে নিয়ে আমার সাথে তীরে চল। ওরা কেবল অস্ত্র নেবে কোনো বর্ম নয়। এতো ভার ঘোড়া নিতে পারবে না।