কয়েকঘন্টা পর উড়ন্ত আর সাঁতার কেটে চলা এই বিপুল প্রাণীর সংখ্যা কমতে কমতে একসময় আর দেখা গেল না।
.
রাত ঘনাতেই তারার আলোয় পথ দেখে চলতে লাগলাম। পরদিন ভোরে সূর্য উঠার পর দেখলাম আকাশ আর সাগরে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। সবকিছু নীরব নির্জন, থমথমে হয়ে রয়েছে।
কেবল দাঁড় বাওয়ার শব্দ, জাহাজের গায়ে পানির ছলকে ওঠার শব্দ আর দাঁড় বাওয়ার তালে তালে ঢাক পেটাবার ধুম ধুম শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। লোকজন কেউ কথা বলছে না কিংবা হাসছে না।
এমনকি আমার কাঁধের উপরের হলুদ ক্যানারি পাখিটিও নিশ্চুপ হয়ে একসময় দুপুরের দিকে টুপ করে ডেকে পড়ে গেল। আমি তুলে দেখলাম পাখিটা মরে গেছে। মরা পাখিটি সাগরের পানিতে পাখির দেবী আর্টেমিসের হাতে তুলে দিলাম। তারপর মাস্তুলের ডগায় আমার অবস্থানে উঠে পড়লাম।
দিগন্তের চারদিক তাকিয়ে হতাশ হয়ে দেখলাম সব শূন্য, কিছুই নেই। এক ঘন্টা বসে থাকলাম, তারপর আরও এক ঘন্টা বসে আশা নিয়ে দেখতে থাকলাম।
কড়া রোদে চোখ ব্যথা করছিল। আর কিছুক্ষণ পর চোখে ভূতুড়ে জাহাজ আর কাল্পনিক দ্বীপ দেখতে শুরু করলাম। চোখ বুজে চোখকে বিশ্রাম দিলাম।
যখন আবার চোখ মেলে তাকালাম, তখন অবাক হয়ে দেখলাম আমার মতিভ্রম আরও বেড়ে গেছে। আমাদের জাহাজের সামনে দিগন্তরেখা পর্বতমালার মতো আকাশের দিকে উঠছে। প্রতি মুহূর্তে এই সামুদ্রিক আল্পস পর্বতমালা উঁচু হয়ে আরও ভীতিকর হচ্ছে। চূড়ায় সদ্য পড়া তুষারের মতো সাদা ফেনা দেখা যাচ্ছে।
তারপর নিচে থেকে লোকজনের কথাবার্তা শোনা গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জারাস, হুই আর অন্যান্য কর্মকর্তারা দ্রুত জাহাজের সামনের গলুইয়ের দিকে ছুটছে। ওরা সেখানে সমবেত হয়ে সামনের দিকে আঙুল নির্দেশ করে নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করছে। উপরের ডেকের দাঁড়িরা দাঁড় বাওয়া থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে রয়েছে। জাহাজরে গতি ধীর হয়ে প্রায় থেমে এসেছে।
আমি দ্রুত মাস্তুল বেয়ে ডেকে নেমে সামনের দিকে ছুটে চললাম। লোকজনদেরকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলাম যার যার অবস্থান নিয়ে জাহাজের দিক সঠিক পথে রাখতে।
সামনের দিক থেকে জারাস আর অন্যান্য কর্মকর্তারা আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকাল।
জারাস ছুটে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, এসব কী হচ্ছে? পৃথিবী কী উল্টে পড়ছে? তারপর কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে আতঙ্কিত স্বরে বললো, সাগরতো ফুলে উঠে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে।
আমি কণ্ঠস্বর যতদূর সম্ভব শান্ত রেখে বললাম, এটা একটা ঢেউ।
সে প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে বললো, এটা খুব বড়। এতো দ্রুত আসছে যে এটাকে শুধু ঢেউ বলা যাবে না।
আমি নিশ্চিত হয়ে বললাম, এটা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। একই রকম জলোচ্ছ্বাস যা প্রাচীন কালের আটলান্টিস সাম্রাজ্যকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
সকল দেবতার দিব্যি। এর হাত থেকে বাঁচার কি কোনো উপায় নেই?
জারাসের মতো মানুষ এতো সহজে লড়াই ছাড়া হার মানার কথা নয়। তাকে ধমকে বলে উঠলাম, সমস্ত লোকজনকে সাবধান হতে বল। আর অতিরিক্ত দাঁড় হাতের কাছে রাখতে বল। ঐ জলোচ্ছ্বাস যখন আঘাত হানবে তখন বেশ ক্ষতি হবে। দাঁড়গুলো ভেঙে যাবে। আমাদেরকে গতিপথ ঠিক রেখে জাহাজ চালিয়ে যেতে হবে। এক পাশ থেকে আঘাত হানলে একটা কাঠের গুঁড়ির মতো উল্টে ফেলবে। কাজেই সমস্ত খোল কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে মজবুতভাবে সুরক্ষিত করো। পানিতে ভেসে থাকার জন্য দাঁড়ি বেঞ্চে কিছু একটা ব্যবস্থা নাও যাতে দাঁড়িরা ভেসে না যায়।
আমার নির্দেশ মোতাবেক জারাস হুইকে নিয়ে কাজে লেগে পড়েলা। আমি আর তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করলাম না। ওদেরকে ওদের মতো কাজ করতে দিয়ে জাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের এদিকে আসা লক্ষ্য করতে লাগলাম।
যতই এটা কাছে আসছে ততই উঁচু হয়ে মনে হচ্ছে আরও দ্রুত গতিতে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ধাক্কাটি সামলাবার প্রস্তুতি নেবার মতো যথেষ্ট সময়ও হাতে নেই।
প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজের সামনের গলুই এতো দ্রুত উপরের দিকে উঠলো যে, তাল সামলাতে না পেরে আমি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলাম। আমার পেট ফুসফুঁসে চাপ দিতেই আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপরও আমরা উপরের দিকে উঠতেই থাকলাম। জাহাজের পেছনের গলুই নিচু হতেই ডেক বাঁকা হয়ে প্রায় খাড়া হয়ে গেল। আমি দুই হাতে জাহাজের কিনারা ধরে রাখলাম। ডেকের উপরের যেসব আলগা জিনিসপত্র ছিল সেগুলো গড়িয়ে নিচের দিকে চলে গেল।
এমন লণ্ডভণ্ড বিশৃঙ্খল অবস্থা সত্ত্বেও জারাস আর হুই শক্ত হাতে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ সামলাতে চেষ্টা করছিল। ওরা লোকজনদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিল।
বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে মাঝিমাল্লারা দাঁড় বাইতে বাইতে চিৎকার করে দেবতা আর তাদের মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছিল।
যতই আমরা উঁচু হলাম জাহাজ ততই খাড়া হতে হতে ডেক প্রায় খাড়া হয়ে গেল আর দাঁড়গুলো আকাশের দিকে মুখ করে থাকলো।
এক মুহূর্তের জন্য আমি বিশাল ঢেউয়ের চূড়ার উপর দিয়ে সামনে তাকালাম। দেখলাম আমরা এতো উঁচুতে উঠেছি যে আমি দূর দিগন্তে ক্রিটদ্বীপের দক্ষিণ তীর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর এর উপরে দ্বীপের অন্য পাশে ক্রোনাস পর্বতের চূড়ার ফাটল দিয়ে ধুয়ার স্তম্ভ সগর্জনে উপরের দিকে উঠছে। হলুদ গন্ধকের মেঘ পাক খেতে খেতে উঠে উত্তর দিকের পুরো আকাশ ঢেকে ফেলেছে। তারপর ঢেউয়ের সাদা চূড়া আমাদের জাহাজের উপর আছড়ে পড়ে সবুজ পানিতে আমাদেরকে ভাসিয়ে দিল।