পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার পর জারাস মন্তব্য করলো, ওরা সবদিক বিবেচনা করেই পরিকল্পনা করেছে।
আমি একমত পোষণ করে বললাম, এর জন্যই ক্রিটানরা বিখ্যাত… সবদিক বিবেচনা করা। তারপরও আমি জায়গাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম, ক্রিটানদের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোনো দুর্বল দিক বের করা যায় কি না। অনেক খুঁজে একমাত্র পন্টুন সেতুটাই আমার মনে হল একমাত্র পথ যা আমি সামলাতে পারবো।
এরপর মনোযোগ ফেরালাম জেটির দিকে, সেখানে তখনও জাহাজ তিনটি নোঙর করা রয়েছে। ক্রিটানরা যে পদ্ধতিতে প্রথম জাহাজটি থেকে মাল নামাচ্ছিল, তা বিবেচনা করে বুঝতে পারলাম পদ্ধতিটা খুব একটা কার্যকর নয়। আমি হলে জাহাজের খোলের মুখে তেপায়া টেবিল আর কপিকল লাগিয়ে সিন্দুকগুলো ডেক বরাবর বারকোশের উপর রাখতাম। তারপর সেখান থেকে ঠেলাগাড়িতে সিন্দুকগুলো জেটির মধ্য দিয়ে দুর্গের ফটক পর্যন্ত নিয়ে যেতাম।– অথচ ক্রিটান ক্রীতদাসগুলো একটা একটা করে কাঠের সিন্দুক জাহাজের নিচের খোল থেকে বের করে মই বেয়ে উপরে ডেকে নিচ্ছিল। এভাবে কাজ শেষ করতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে।
এবার আমি একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলাম। কাজটা যে এমন বিশাল আকার ধারণ করবে তা আমি আগে বুঝে উঠতে পারিনি। লাখ লাখ রূপার বাট নাড়াচাড়া করার কথা বলা সহজ, তবে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের আসল ওজন আর পরিমাণ এখন চোখে দেখার পর এগুলো এখান থেকে জব্দ করে সমুদ্র, পর্বত আর মরুভূমির উপর দিয়ে শত শত লিগ দূরত্ব পার করে নিয়ে যাওয়ার কাজটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। তার উপর পেছন পেছন থাকবে একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ সেনাবাহিনী।
এবার সত্যিই দুশ্চিন্তায় পড়লাম, মনে হচ্ছে কাজটা অসম্ভব। একবার ভাবলাম কোনোমতে সিন্দুকগুলো কজা করতে পারলে সাগরে ডুবিয়ে দেব। সর্বাধিরাজ মিনোজ কিংবা রাজা বিওন-কেউ আর তার নাগাল পাবে না। তারপর ক্রিস্টানদের প্রতিশোধ থেকে পালিয়ে আমার লোকজনদের নিয়ে আমি থিবসে ফিরে যেতে পারি। হয়তো সর্বাধিরাজ মিনোজকে বুঝিয়ে বলতে পারবো যে, রাজা বিওনই হচ্ছে মূল অপরাধী। তবে এতে আমার সন্দেহ হচ্ছে।
সমস্যাটির তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান মনে এলো না। প্রায় ঘন্টাখানেক আমি আর জারাস ঘাসের উপর শুয়ে সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মাথায় একটা সমাধানের সূত্র ভেসে এলো। এত সহজ আর সুন্দর একটা সমাধান কীভাবে আমার মাথায় এলো ভেবে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
ভাবলাম সবকিছু জারাসকে খুলে বলি। তারপর আবার একটু চিন্তা করে থামলাম।
সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মধ্য গগন পার হয়ে পশ্চিমে প্রায় অর্ধেক পথে ঢলে পড়েছে। এবার তিনটি যুদ্ধ জাহাজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলাম। অনুভব করলাম জারাস নিবিষ্টমনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হল সে বুঝতে পেরেছে, আমার মনে নিশ্চয়ই কোনো একটা পরিকল্পনা এসেছে। যাইহোক এখনও সবকিছু তাকে বলার সময় আসেনি।
শেষপর্যন্ত বললাম, যথেষ্ট হয়েছে। এবার চল যাই।
কোন দিকে, তায়তা?
আমাদের নৌকায় ফিরে যেতে হবে। রাতের আগেই অনেক কাজ সারতে হবে।
.
উপহ্রদের যে জায়গায় আমাদের ছোট নৌকা তিনটা ছেড়ে এসেছিলাম, সাঁতার কেটে সেখানে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। বাকি লোকজন আমাদের দুজনকে ফিরতে দেখে খুব খুশি হল। ওরা হয়তো ভেবেছিল আমরা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম আর ওরা আমাদের মেরে ফেলেছে। যাইহোক এখন ওরা আমার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে রইল।
সবার আগে যে কাজটা নিয়ে আমি ভাবছিলাম, তা হল ভারি বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত আমার সৈন্যদেরকে কীভাবে এই গভীর খাল পার করিয়ে দুর্গের কাছে নিয়ে যাবো। অথচ এদের বেশিরভাগই সাঁতার জানে না।
এটা করতে গিয়ে প্রথমে সবচেয়ে ছোট আর হালকা নৌকাটা বেছে নিলাম। তারপর আমার লোকদের বললাম অন্যদুটোর তলা ফুটো করে উপহ্রদের সবচেয়ে গভীর অংশে ডুবিয়ে দিতে। একবার অবশ্য আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে ভাবলাম ধুয়া চোখে পড়লে ক্রিটানদের সন্দেহ হলে বিষয়টা তদন্ত করার জন্য ওরা খোঁজ নিতে কাউকে পাঠাতে পারে।
তারপর ছোট নৌকাটা অগভীর পানির উপর দিয়ে টেনে দুর্গের কাছাকাছি উপহ্রদের পূর্বতীরে পৌঁছলাম। তারপর ডাঙার উপর দিয়ে নৌকাটা টেনে খালের কাছে নিয়ে যাবার কাজে সমস্ত লোক নিযুক্ত করলাম। অন্য নৌকা দুটো থেকে যে দড়িগুলো খুলে নিয়েছিলাম সেগুলো দিয়ে বেঁধে নৌকাটা টানার ব্যবস্থা করা হল।
এক একটা রশি একশোজন করে টানার কারণ নৌকার তলি একটা পিছলের মতো হল আর নৌকার কাঠামোর ওজনের ভারে প্যাপিরাসের ঘাস চ্যাপ্টা করে তার উপর দিয়ে সহজেই চলতে লাগলো। যাইহোক নদীর মূল প্রণালীতে পৌঁছতে আমাদেরকে প্রায় অর্ধেক লিগ ডাঙা পার হতে হল। এই কাজ শেষ করতে করতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল আর আকাশের অনেক উপরে কুঁজো চাঁদ দেখা গেল।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই কিছু ঠাণ্ডা খাবার খেলাম আর সৈন্যদেরকে বর্ম আর উর্দি পরার সময় দিলাম। তারপর যতদুর সম্ভব নিঃশব্দে দাঁড় বেয়ে একেক বার পঞ্চাশজন লোক নৌকায় নিয়ে খাল পার হলাম।