এই জাহাজগুলো তামিয়াত দুর্গের মূল ফটকের ঠিক নিচে একটা পাথরের জেটিতে নোঙর করা রয়েছে। ফটকটি ভোলা আর নবাগতদের স্বাগত জানাতে কয়েকজন উর্দিপরা সৈন্য সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পালকদিয়ে সাজানো শিরস্ত্রাণ আর সোনার সাজসজ্জা দেখে আমি বুঝতে পারলাম সেখানে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাও রয়েছে।
আমি আর জারাস সাঁতার কেটে খাল পার হয়ে এখানে পৌঁছার আগেই প্রথম জাহাজের নাবিকেরা জাহাজের খোল থেকে মাল নামানোর কাজ শুরু করে দিয়েছিল। শিকলে বাঁধা একদল অর্ধনগ্ন ক্রীতদাস জাহাজ থেকে মাল নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। অর্ধেক বর্মপরা আর কোমরবন্ধে গোঁজা ছোট তরবারি নিয়ে কয়েকজন তত্ত্বাবধায়ক এদের কাজ দেখাশুনা করছিল। এদের সবার হাতে কাঁচা চামড়ার বিনুনি করা চাবুক রয়েছে।
লম্বা একটা তক্তার উপর দিয়ে ক্রীতদাসেরা একইরকম ভারি কাঠের সিন্দুকগুলো নিয়ে তীরে যাচ্ছিল। খুব বড় না হলেও সিন্দুকগুলো বেশ ভারি, তাই এর ওজনের ভারে ক্রীতদাসেরা টলমল করে হাঁটছিল। পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছিল বেশ ধীরগতিতে আর বিরক্ত তত্ত্বাবধায়করা কর্মরত ক্রীতদাসদেরকে চিৎকার করে তিরস্কার করছিল।
তারপর আমরা লক্ষ্য করলাম একজন ক্রীতদাস কাঠের তক্তা থেকে তীরে নামার সময় পা ফসকে নিচে পড়ে গেল আর মাথার উপর থেকে ভারি কাঠের সিন্দুকটা নিচে পাথরের স্ল্যাবের উপর পড়তেই এর ডালা ভেঙে খুলে গেল আর ভেতরের রূপার বাটগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো। মাটিতে স্তূপ হয়ে পড়া চকচকে উজ্জ্বল রূপার বাটগুলোর উপর রোদ পড়ে ঝিকমিক করে উঠলো। দৃশ্যটি দেখে আমার বুক ধক করে উঠলো। এক হাতের চেয়ে ছোট দৈর্ঘ্যের রূপার চারকোণা প্রায় কুড়িটা বাট কাঠের সিন্দুকটিতে ঠেসে ভরা ছিল। যে জাহাজে এই সিন্দুকগুলো মধ্য সাগর দিয়ে বয়ে আনা হয়েছে, সেরকম একটি বিশাল জাহাজ তৈরি করার খরচ এক সিন্দুক ভরা এই রূপার বাট দিয়ে মেটানো যাবে। আমার সমস্ত আশা পূর্ণ হয়েছে। এটিই সেই বিশাল ধনভাণ্ডার যা আমি প্রত্যাশা করেছিলাম।
তিনজন তত্ত্বাবধায়ক একযোগে মাটিতে পড়ে যাওয়া ক্রীতদাসের ঘর্মাক্ত শরীরের উপর চাবুক মারতে শুরু করলো। লোকটা চিৎকার করে ছটফট করছিল আর দুইহাত দিয়ে মুখ ঢাকতে চেষ্টা করছিল। একটা চাবুকের আঘাতে তার মুখে পড়তেই লোকটির ডান চোখটি কোটর থেকে ছিটকে বের হয়ে স্নায়ুতন্ত্রির সাথে গালের উপর ঝুলতে লাগলো। ছটফট করতে করতে শেষপর্যন্ত ক্রীতদাসটি জ্ঞান হারালো, আর নিজেকে বাঁচাবার শক্তি অবশিষ্ট রইল না। একজন সৈন্য তার এক পা ধরে টানতে টানতে জেটির কিনারায় নিয়ে এক টানে নদীতে ফেলে দিল। ঝপ করে কাদাভরা পানিতে পড়ে দেহটা নিচে তলিয়ে গেল।
এই ঘটনার পর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অর্ধনগ্ন অন্যান্য ক্রীতদাসরা মুখ বুজে কাজ করে যেতে লাগলো, যেন কিছুই হয়নি।
জারাসের কাঁধে টোকা দিয়ে আমি তার মনোযোগ আকর্ষণ করলাম। তারপর দুজনে আবার নলখাগড়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে ফিরে গেলাম। এবার ঘুরে দুর্গের অন্যধারে নদীর অপর তীরের কাছে পৌঁছলাম। একঘন্টা ধরে সাবধানে চতুর্দিক লক্ষ্য করার পর একটা জায়গা খুঁজে পেলাম, যেখান থেকে দুর্গ আর আশপাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি বুঝা যায়। দুর্গ সম্পর্কে আমার গুপ্তচরেরা যেসব তথ্য দিয়েছিল এবার তা সরেজমিনে যাচাই করতে পারলাম।
দুর্গ ঘিরে থাকা দেয়ালগুলো দুর্ভেদ্য মনে হলেও এলাকাটা খুব বেশি বড় নয়। যেটুকু জায়গা রয়েছে তাতে কেবল কোষাগার আর একটা ব্যারাকের স্থান সংকুলান হবে। সাগর থেকে খাল দিয়ে এসে ছোট আকারের আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার মতো কিছু সংখ্যক সৈন্য সেখানে থাকতে পারবে।
তবে ক্রিটানরা নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছিল, বড় ধরনের শত্রুর আক্রমণ হলে অন্তত কয়েকহাজার সেনা হাতে রাখতে হবে। আর এই সমস্যার সমাধানের জন্য ওরা নদীর উপর দিয়ে পন্টুন সেতু তৈরি করেছিল, যাতে নদীর মাঝখানে দ্বীপে অবস্থিত দুর্গ রক্ষার জন্য নদীর যেকোনো তীর থেকে সেনারা দ্রুত নদী পার হয়ে দুর্গের দিকে ছুটে যেতে পারে।
আমি মাটিতে যেখানে শুয়েছিলাম, সেখান থেকে পূর্বদিকের একেবারে শেষ মাথায় নদীর তীরে ক্রিটানরা তাদের সৈন্যদের মূল শিবির স্থাপন করেছিল। শিবিরের চারপাশ ঘিরে দুই মানুষ সমান উচ্চতার কাঠের খুঁটি দিয়ে প্রতিরক্ষা বেড়া তৈরি করেছে। কাঠের খুঁটিগুলোর মাথা কেটে চোখা করা হয়েছে। আন্দাজ করলাম এখানে দুই থেকে তিনহাজার সৈন্য থাকতে পারে।
শিবির এলাকার চারকোণে উঁচু পাহারা মাচা স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষ্য করলাম খুঁটি দিয়ে ঘেরা জায়গাটির মাঝে দালানের ছাদ নদীতীরের শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া কালো মাটি দিয়ে ঘন করে লেপা হয়েছে। দেয়ালের উপর দিয়ে শত্রুসেনারা অগ্নিবাণ ছুঁড়লে এটি তা প্রতিরোধ করবে।
ফটক থেকে নদী তীরের যে জায়গায় পন্টুন সেতুটি রয়েছে সে জায়গা পর্যন্ত ক্রিটানরা শুকনো কালো মাটি দিয়ে ইটের রাস্তা তৈরি করেছে। এটাও শত্রুর তীরের আক্রমণ থেকে ক্রিস্টানদের রক্ষা করবে।
ওরা একটার পর একটা লম্বা নৌকা পাশাপাশি বেঁধে নদীর দুই খালের উপর পন্টুন সেতুটি তৈরি করেছে। সেতুর উপর তক্তা ফেলে একটা পথ করা হয়েছে। যাতে প্রয়োজন মতো অনেক সৈন্য শিবির থেকে ছুটে যেতে পারে।