জাহাজটি আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় নৌকর্মকর্তাদের চেঁচিয়ে নির্দেশ দিতে শোনা যাচ্ছিল। উপরের সারির দাঁড়গুলো একটা রূপালি চিলের ডানার মতো এক সাথে পানি থেকে উঠছিল আর নামছিল। আর নিচেরগুলো ঝপঝপ করে পানিতে পড়ছিল আর পেছনে টানছিল। খালের শেষমাথার বাঁক পার হয়ে জাহাজটি একটু দূরে চকচকে চুনকাম করা দুর্গের দিকে ভেসে চললো।
তারপর একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো, যার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ঠিক প্রথমটির মতোই আরেকটি জাহাজ সাগর থেকে মোহনার মধ্য দিয়ে খালে ঢুকলো, তারপর আমাদের পাশ কাটিয়ে একই পথে সামনে চলে গেল। এই জাহাজটিও মাল বোঝাইয়ের কারণে নিচু ছিল।
তারপর আবার হতবাক আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে লক্ষ্য করলাম ঠিক একই রকম তৃতীয় আরেকটি জাহাজ খাল বেয়ে এসে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। এটিও আগের দুই জাহাজকে অনুসরণ করে দুর্গের পথে চলে গেল।
এবার আমি বিষয়টা বুঝতে পারলাম। তিনমাস আগে আমার চর আমাকে খবর দিয়েছিল যে, ধনরত্ন বোঝাই তিনটি জাহাজ ক্রিটের প্রধান সমুদ্র বন্দর আগাফের থেকে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এই খবরটা আমার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে কয়েক মাস লেগে যায়। ইতিমধ্যে কোনো কারণে এই নৌবহরের সমুদ্র যাত্রা বিলম্বিত হয়ে যায়, সম্ভবত প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এটা হয়েছে। তবে দেরি হওয়ার খবরটা গুপ্তচরেরা আমাকে জানাতে পারেনি।
আমার ধারণা ছিল, জাহাজগুলো তামিয়াত দুর্গে মাল খালাস করে আবার ফিরতি যাত্রায় আগাফের বন্দরের দিকে রওয়ানা দেবার অনেক পরে আমি তামিয়াতে পৌঁছাবো।
কিন্তু এই জাহাজগুলো যখন তামিয়াতে পৌঁছাবে তখন আমিও সেখানে পৌঁছব এরকম আশা আমি করিনি, সম্ভবত কোন দেবতার অনুগ্রহে এটা সম্ভব হয়েছে। ছোটকাল থেকে আমি জেনে এসেছি যে আমি দেবতার প্রিয়পাত্র। বিশেষত প্রধান দেবতা হোরাসের, যার কাছে আমি সবসময় প্রার্থনা করি। তা নাহলে জন্মের পর থেকেই আমার মধ্যে এত বুদ্ধি আর গুণের সমন্বয় কী করে হল? কী কারণে আমি এতবার ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি, যেখানে অন্য কোনো সাধারণ মানুষ হলে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেত? কী করে আমি এত তরুণ আর সুন্দর থাকতে পারলাম আর এত তীক্ষ্ণধী থাকলাম। অথচ আমার আশেপাশের সবারই বয়সের সাথে সাথে চামড়া কুঁচকে গেল, চুল সাদা আর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল? নিশ্চয়ই আমার মাঝে এমন কিছু আছে যা, অন্যান্য সাধারণ মানুষ থেকে আমাকে আলাদা করেছে।
এটাও নিশ্চয়ই হোরাস দেবতার অনুগ্রহের আরেকটি দৃষ্টান্ত। আমি মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম প্রথম সুযোগেই তার কাছে একটি বড় ধরনের উৎসর্গ নিবেদন করবো। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে জারাসের কাছে গিয়ে তার জামার হাত ধরে টান দিয়ে বললাম,
খাল পার হয়ে আমাকে ক্রিস্টানদের দুর্গের কাছে যেতে হবে।
আমাদের এই মিসরের দুটো বিষয় আমার কাছে বেশ হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হয়, যার কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাই না। প্রথমটি হল ঘোড়াকে আমরা মাল বহন করার জন্য আর যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র, রথ টানার কাজে ব্যবহার করলেও প্রায় কোনো মিসরিই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয় না। আর দ্বিতীয় ধাঁধাটি হল বিশাল একটি নদীর তীরে বাস করলেও কেউ সাঁতার কাটতে জানে না। কাউকে এ-বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কেবল কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলবে, এ ধরনের আচরণ দেবতাদের পছন্দ নয়।
তবে আমি আগেই বলেছি অন্যদের চেয়ে আমি আলাদা। অবশ্য একথা বলবো না যে, সবদিক দিয়েই আমি শ্রেষ্ঠ। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি একজন চৌকস ঘোড়সওয়ার আর সেই সাথে একজন শক্তিশালী এবং অক্লান্ত সাঁতারু।
আমি জানতাম জারাসের এদুটো গুণের কোনোটাই নেই, তবে রথের রশি যখন তার হাতে থাকে, তখন তাকে হারাবার মতো কেউ নেই। তাই তাকে আমি নির্দেশ দিলাম কর্ক গাছের ছাল দিয়ে বয়া বানিয়ে নিতে যার সাহায্যে সে পানিতে ভেসে থাকতে পারবে। তারপর আমরা দুজনে কোমর পর্যন্ত পোশাক খুলে খালের পানিতে নেমে পড়লাম। জারাস ওর তলোয়ারটা কর্কের বয়ার সাথে বেঁধে নিয়েছিল, আমি আমারটা পিঠে বেঁধে নিলাম। একটা ভোঁদড়ের মতো দ্রুত সাঁতার কেটে আমি খালের অপর তীরে পৌঁছে গেলাম, এদিকে জারাস তখনও দম নিতে নিতে কেবল অর্ধেক পথ পার হয়েছে।
সে খালের এপারে পৌঁছার পর আমি তাকে তীরে উঠতে সাহায্য করলাম। তারপর সে একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আমরা নলখাগড়ার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চুপিসারে ক্রিটান দুর্গের দিকে রওয়ানা দিলাম। তারপর একটা সুবিধামতো জায়গায় পৌঁছে দালানটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম ওরা কেন এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিল। চুনাপাথর পাহাড়ের একটা লম্বা আর সরু চূড়ার উপর শক্ত ভিত্তির উপর দুৰ্গটা খাড়া করা হয়েছে।
মূল খালটা ভাগ হয়ে দুর্গের চারপাশ ঘিরে একটা দুর্গপরিখা তৈরি করেছে। দুর্গের চতুর্দিকে নদীর প্রবাহটি যে পোতাশ্রয় সৃষ্টি করেছে সেখানে বিভিন্ন ধরনের বেশ কয়েকটি জলযান নোঙর করা রয়েছে। বেশিরভাগই বজরা, যা দিয়ে সম্ভবত ক্রিটানরা নির্মাণ সামগ্রী বয়ে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একটিও সমুদ্র চলাচলের উপযোগী জাহাজ নয়। কেবল সেই তিনটি চমৎকার তিনতলা দাঁড় বাওয়া জাহাজ রয়েছে, যেগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে এসেছে।