জারাস দৌড়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, তাই করবো?
আমি মৃদু হেসে কাণ্ডারীর দিকে ঘাড় কাত করে বললাম, হ্যাঁ, তাই করতে বল। আমরা আবার সাগরের দিকে ঘুরে চললাম। অন্য জাহাজ দুটোও আমাদের অনুসরণ করলো। এখন আমরা সৈকত থেকে বেশ দূরে সরে চলতে লাগলাম। তারপর কিছুদূর সামনে গিয়ে তামিয়াত দুর্গের পাহারা চৌকির নজর এড়ালাম। আবার গতিপথ বদলালাম। এরপর সোজা বদ্বীপের গোলকধাঁধার মতো জলাভূমির দিকে এগোলাম।
মানচিত্র থেকে আমি জেনেছিলাম কোথায় নোঙর বাধার মতো নিরাপদ স্থান পাওয়া যেতে পারে। পালগুলো নামিয়ে ডেকে বিছিয়ে রাখা হল, তারপর প্যাপিরাস আর নলখাগড়ার ঘন বনের মধ্য দিয়ে পথ করে আমার পছন্দমতো একটা উপদের দিকে চললাম। এখানে পৌঁছে আমরা গাছপালার ঘন জঙ্গলে পুরোপুরি ঢাকা পড়লাম। অগভীর পানিতে নোঙর ফেলা হল, জাহাজের তলা সাগরের নিচে কাদার একটু উপরে রইল। থুতনি পর্যন্ত শরীর পানিতে ডুবিয়ে আমরা এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে আসা যাওয়া করতে লাগলাম।
সূর্যাস্তের পর চাঁদ উঠতেই সবাই অবশিষ্ট টুনা মাছ দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। জারাস নিঃশব্দে তিন জাহাজ থেকে আট জন লোক বেছে নিল। ওদেরকে জানাল পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার সাথে সাথে আমাদের সাথে শত্রুপক্ষের অবস্থান পরীক্ষা করার অভিযানে যেতে হবে।
ভোর হবার ঘন্টা খানেক আগে আমরা সবাই দুটো এক বৈঠার ডিঙিতে চড়লাম। এদুটো জাহাজের পেছনে বেঁধে আনা হয়েছিল। চওড়া উপহ্রদের মধ্য দিয়ে বৈঠা বেয়ে অন্তরীপের যে জায়গায় দুৰ্গটা দেখেছিলাম তার একটু কাছে পৌঁছলাম।
অন্ধকারে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া জলাভূমির পাখির ডাক আর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্ধকার হালকা হতেই আবছা আলোয় জলচর জংলি হাঁস, রাজহাঁস, লম্বা ঠ্যাং আর গলার বক, সুন্দর পালক আর লেজ বিশিষ্ট বিভিন্ন ধরনের অন্তত পঞ্চাশটারও বেশি সারসজাতীয় পাখি দেখা গেল। আমরা উপহ্রদের মধ্য দিয়ে ডিঙ্গি বেয়ে এগোতেই হাঁসগুলো ঝাঁক বেঁধে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে পানির উপর থেকে শূন্যে উড়াল দিল। দিগন্তের উপর সূর্য উঠতেই দেখা গেল চারপাশের জায়গাটি পুরোপুরি জংলি আর মনুষ্যবসতির অনুপযোগী একটি স্থান।
শক্ত মাটিতে পৌঁছার পর ডিঙি দুটো টেনে নিয়ে নলখাগড়ার ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর ঘন ঝোঁপের মধ্য দিয়ে সাবধানে এগিয়ে চললাম।
তারপর হঠাৎ একটা গভীর খালের কাছে এসে পৌঁছলাম। প্যাপিরাসের মধ্য দিয়ে খালটা দক্ষিণ দিকে সোজা সাগরের দিকে চলে গেছে। প্রায় একশো কদম চওড়া খালটা বেশ গভীর, হেঁটে পার হওয়া সম্ভব নয়। খালের অপর তীরে পাহারা চৌকির সমতল ছাদ দেখা যাচ্ছে। ছাদের পাচিলের উপরে কমপক্ষে তিনজন পাহারাদারের শিরস্ত্রাণপরা মাথা দেখা যাচ্ছে।
এরপর হঠাৎ সাগরের দিক থেকে একটা জলযান আসার পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল। আমি সবাইকে সাবধান করলাম। জাহাজ চলার কাঁচকোচ, মাঝিমাল্লাদের বৈঠা বাওয়ার শব্দ বেড়ে চলেছে। তারপর হঠাৎ খালের বাঁকে একটা সমুদ্রগামি বিশাল জাহাজ দেখা গেল।
এত বড় আর এ-ধরনের জাহাজ আমি কখনও দেখিনি। তবে আমার গুপ্তচরদের পাঠানো বর্ণনা থেকে আমি নিশ্চিত হলাম এটা ক্রিটদের তিন সারিতে দাঁড় বাওয়া একটা রণতরী। এতে যেমন মাল বহন করা যায়, তেমনি যুদ্ধজাহাজ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। একটার পর একটা তিনতলা ডেকে তিন সারি দাঁড় রয়েছে।
জাহাজের সামনের লম্বা সরু ডগাটি ব্রোঞ্জের পাত দিয়ে মোড়ানো, যাতে শত্রুপক্ষের জাহাজকে গুঁতো দেওয়া যায়। দুটি মাস্তুলে বেশ বড় জায়গা জুড়ে পাল খাটানো যায়। তবে পালগুলো এখন গোটানো রয়েছে, যেহেতু সংকীর্ণ খালের মধ্য দিয়ে দাঁড় বেয়ে আসতে হচ্ছে। জাহাজটি বেশ সুন্দর, দড়িদড়া পরিষ্কার আর উঁচু বরগা। এই জাহাজটি দেখে সহজেই বুঝা যায় ক্রিটের নৌবাহিনী কেন পৃথিবীর মধ্যে সেরা। মাল বোঝাই হওয়ার কারণে এখন একটু নিচু হলেও অন্য কোন জাহাজই এর মোকাবেলা করতে পারবে না। ভাবলাম জাহাজের খোলে কি মাল বোঝাই করা হয়েছে কে জানে।
নলখাগড়ার ঝোঁপের যে জায়গায় আমরা লুকিয়েছিলাম, জাহাজটি তার সমান্তরাল হতেই আমি নাবিকদের চেহারা দেখতে পেলাম। সামনের দিকে তিনজন নৌ-কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছে আর পাশেই চারজন মাঝি লম্বা দাঁড় সামলাচ্ছে। তিন নৌযোদ্ধার মুখের বেশিরভাগ বর্ম দিয়ে ঢাকা থাকলেও বুঝা যাচ্ছে লোকগুলো গড়পরতা মিসরীয়দের চেয়ে বেশ লম্বা আর বলিষ্ঠ। ওরা যে বাণিজ্যপোতের নাবিক নয় বরং যোদ্ধা, তা সহজেই বুঝা যায়।
জাহাজটি আমাদের পাশ কাটাবার সময় লক্ষ করে বুঝতে পারলাম, সবচেয়ে উপরের সারিতে যারা লম্বা দাঁড় বাইছে তারা মোটেই ভারবাহী পশুর মতো মাঝিমাল্লা নয়, ওরা অবশ্যই যোদ্ধা। অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই দাঁড় ছেড়ে দিয়ে পায়ের কাছে রাখা অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
তবে নিচের সারিগুলোতে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাসেরা দাঁড় বাইছিল। ওদের শরীরের গন্ধ থেকে আমি বুঝতে পারলাম ওরা সেই হতভাগ্যের দল যারা সারা জীবন এই দাঁড় বাওয়ার বেঞ্চেই জীবন কাটিয়েছে। যেখানে ওরা বসে রয়েছে, সেখানে বসেই দাঁড় টানে, খায়, ঘুমায়, মল ত্যাগ করে আর শেষপর্যন্ত সেখানেই মারা যায়।