তারপর একটি হাত আমার কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলো আর সেই সাথে কানের কাছে প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পেলাম। আমি জানি এটা জারাসের গলা কিন্তু তারপরও চোখ খুললাম না। আমি অপেক্ষা করছিলাম দেবতা আমাদেরকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু জারাস অনবরত আমাকে ধরে ঝাঁকিয়েই চলেছে, আমি সাবধানে চোখ খুললাম কিন্তু সেই সাথে প্রার্থনাও করে চললাম। তখনই বুঝলাম জারাস কিছু বলতে চাচ্ছে আর তখন একপাশে সাগরের দিকে তাকালাম।
সাগর জীবন্ত হয়ে উঠেছে তীরের ফলার মতো বিশাল চকচকে কতগুলো দেহ নিয়ে। তারপর একমুহূর্ত পর বুঝতে পারলাম এগুলো জীবন্ত প্রাণী আর এক একটা প্রাণী একটা ঘোড়ার সমান আকৃতির। দানবাকৃতির এই মাছগুলো এতঘন হয়ে এক সাথে ছিল যে, নিচেরগুলো উপরেরগুলোকে ঠেলে উপরের দিকে ভেসে উঠতে চেষ্টা করায় বিশাল ঢেউ সৃষ্টি করে পানি ছিটিয়ে চলছিল।
জারাস চেঁচিয়েই চলেছে, টুনা! এগুলো টুনা মাছ।
উচ্চ মিসর একটি স্থলবেষ্টিত দেশ হওয়ায় খোলা সাগরে যাওয়ার আমার তেমন সুযোগ হয়নি। আর এত বিশাল পরিমাণে টুনা মাছও দেখিনি। তবে এগুলো সম্পর্কে অনেক লেখা পড়েছি, তাই আমার বুঝা উচিত ছিল কী হচ্ছে। সাথে সাথে চোখ খুলে আমিও জারাসের মতো চিৎকার করে উঠলাম। অবশ্যই এগুলো টুনা মাছ! হারপুন নিয়ে লোকজনকে তৈরি হতে বল!
জাহাজে উঠার সময়েই আমি হারপুন লক্ষ্য করেছিলাম। এগুলো দাঁড়িদের বসার বেঞ্চের নিচে রাখা ছিল। আমার ধারণা ছিল জলদস্যুদের হামলা ঠেকাতে এগুলো ব্যবহৃত হয়। একজন মানুষের দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের সমান লম্বা বল্লম। ডগা ধারালো সংকর ধাতুর। ডগার পেছনে একটা চোখের মতো ছিদ্র দিয়ে নারিকেলের ছোবড়ার আঁশের দড়ি ঢোকানো ছিল। আর দড়ির অপর প্রান্তে একটা বাঁকা কাঠের ফাত্না বাঁধা ছিল।
আমার নির্দেশের সাথে সাথে সবচেয়ে আগে জারাস কাজে লেগে পড়লো। তারপর অন্যরা তাকে অনুসরণ করলো।
সে লম্বা অস্ত্রটা বেঞ্চের তলা থেকে তুলে নিয়ে দড়ির গিঁট খুলে রশি ছাড়তে ছাড়তে জাহাজের এক পাশে ছুটে চললো। লম্বা হারপুনটা কাঁধে রেখে রশিবাধা মাথাটা নিচে ঝাঁক বেঁধে চলা টুনার চকচকে রূপালি স্রোতের দিকে তাক করলো। বিশাল গোল গোল চোখ নিয়ে মাছগুলো মনে হচ্ছে আতঙ্কিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি লক্ষ্য করলাম, সে লক্ষ্য স্থির করে হারপুনের মাথা নিচু করে সোজা পানিতে ছুঁড়ে মারলো। ভারী হারপুনের ডগাটা বিশাল মাছের শরীরে সজোরে বিধতেই মাছটি একটা ঝটকা মারতেই হারপুনটা একটু কেঁপে পানিতে তলিয়ে গেল।
জারাস এক লাফে ডেকে নেমে লম্বা রশিটা ধরে ফেললো। আরও তিনজন নাবিক এগিয়ে এলো ওর সাহায্যে, তারপর সবাই মিলে রশিটা সামলে টানতে টানতে মাছটা টেনে তুললো।
চারজন লোক জারাসকে অনুসরণ করে বেঞ্চের নিচ থেকে হারপুন তুলে নিয়ে জাহাজের একপাশে ছুটে গেল। একটু পর জাহাজের দুইপাশেই লোকজন ছুটাছুটি করে হারপুন গেঁথে বিশাল মাছগুলো জাহাজের ডেকে টেনে উঠাতে লাগলো। লোকজনের উত্তেজিত চিৎকার, চেঁচামেচি, নির্দেশ আর হট্টগোলের শব্দে জাহাজের পুরো পরিবেশে কর্মচাঞ্চল্য জেগে উঠলো।
একটার পর একটা মাছ ডেকে উঠিয়ে হাতুড়ির আঘাতে মেরে ফেলা হল। হারপুনে গেঁথে শেষ মাছটা তুলে কেটে ফেলার পর বাদবাকি মাছের দল হঠাৎ যেরকম উদয় হয়েছিল সেরকম হঠাৎ আবার গভীর পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেই রাতে আমরা আবার সৈকতে নামলাম, তারপর বেলাভূমিতে আগুন জ্বেলে মাছ রান্না করে খেলাম। এটি ছিল সাগরের সবচেয়ে সুস্বাদু মাছ। স্বাদ বাড়াবার জন্য ওরা একটু লবন মেখে নিল। সবাই পেটপুরে খেল তারপর চামড়ার মশক থেকে মদ খেল।
আমি জানতাম শক্তি সঞ্চয়ের পরদিন সকালে ওরা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবে। মাংস খেলে একজন যোদ্ধার মনে যে দানবটি থাকে তা জেগে উঠে।
সেই রাতে আমি গাইলাম তানুস এবং নীল তরবারির গাথা। এটা ছিল সাগরের রণসঙ্গীত। আর এই গান ওদের মনে চরম উদ্দীপনা জাগিয়ে তুললো। সবাই আমার সাথে গলা মিলিয়ে গানটা গাইতে লাগলো, এমনকি যার গলা একেবারে বেসুরো সেও বাদ গেল না। তারপর আমি লক্ষ্য করলাম ওদের চোখে লড়াই করার মানসিকতা তীব্র হয়ে উঠেছে। এখন ওরা যেকোনো শত্রুর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।
.
পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমরা জাহাজগুলো পানিতে ভাসালাম। হালকা আলোয় পানির নিচে ডুবো পাহাড়ের চূড়া সামলে নিরাপদ পথ বেছে নিয়ে চলতে লাগলাম।
নীলনদের বদ্বীপের মুখের কাছাকাছি আসতেই আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হলাম। শেষবিকেলে একটা মোহনা পার হলাম, এর পূর্বপাশে নিচু জঙ্গল আর পশ্চিমে খোলা মাটির তীর। একটু ভেতরে সাগরের দিকে মুখ করা জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটিতে একটি কাদামাটির ইটের তৈরি চুনকামকরা দুর্গ দেখা গেল। দুর্গের চূড়াটা প্রায় ভেঙে পড়েছে আর সাগরের দিকের অধিকাংশ দেয়ালেরও ভগ্ন দশা। তবে আমি বুঝতে পারলাম এটা হচ্ছে তামিয়াত প্রণালীর নৌচলাচলের সংকেত কেন্দ্র। সম্ভবত অনেক আগে মৃত কোনো মিসরী নাবিক এটা তৈরি করেছিল।
আমি একছুটে আমাদের জাহাজের একমাত্র মাস্তুলের কাছে গিয়ে খুঁটি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। উপরে পালের খুঁটি পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে সামনে তাকালাম। এখান থেকে সামনে তীরভূমি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে তীরভূমির আরও ভেতরে গাছের মাথার উপর দিয়ে একটি আয়তাকার স্থাপনা পরিষ্কার দেখা গেল। এটাও সাদা চুনকাম করা। এবার আমি নিঃসন্দেহ হলাম মিনোয়ানদের যে বাণিজ্য-দুর্গ আর কোষাগার আমরা খুঁজছি এগুলো তার সূরক্ষিত পর্যবেক্ষণ চৌকি। আমি মাস্তুলের খুঁটি বেয়ে সর সর করে নিচে নেমে চিৎকার করে কাণ্ডারীকে বললাম, জলদি হাল ধর! জাহাজ সামনের ডানদিকে তিন পয়েন্ট ঘোরাও!