ওহ্, গড! ওহ্, গড! ফোঁপাচ্ছে রোয়েন। টেনে ডুরেঈদকে পুকুর থেকে তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাঁর হাতের চামড়া চলে এলো ওর মুঠোর ভেতর, সার্জিকাল রাবার গ্লাভের মতো। চামড়া ছাড়ানো নগ্ন ও রক্তাক্ত তালু বীভৎস দেখাচ্ছে।
পুকুরের কিনারায় হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে স্থির হলো রোয়েন, ডুরেঈদকে দুহাতের ভেতর তুলে নিতে চাইছে। ও জানে, ডুরেঈদের ভারী শরীরটা তুলতে পারবে না। সে চেষ্টা করলে আরো বেশি ব্যথাও পাবেন ডুরেঈদ। এখন শুধু জড়িয়ে ধরে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ও। সন্দেহ নেই মারা যাচ্ছেন উনি, এভাবে পুড়ে যাবার পর কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না।
লোকজন এখুনি ছুটে আসবে, আরবিতে ফিসফিস করছে রোয়েন। নিশ্চয়ই কেউ আগুন দেখেছে।
রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর মোচড় খাচ্ছেন ডুরেঈদ। মরণঘাতি জখমের ব্যথায় আর কথা বলার চেষ্টায়। স্ক্রোল? কোনো রকমে শুনতে পেল রোয়েন। জ্বলন্ত ভিলার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো ও।
নেই, বলল রোয়েন। সব শেষ। হয় পুড়ে গেছে, নয়তো চুরি হয়ে গেছে।
হাল… ছেড়ো… না, বললেন ডুরেঈদ, শব্দের চেয়ে ফপ ফপ আওয়াজের সঙ্গে বাতাসই বেশি বের হচ্ছে গলা থেকে। এতো পরিশ্রম… এতো সাধনা…
সব শেষ, আবার বলল রোয়েন। ওগুলো ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না…
না! অস্পষ্ট আওয়াজ, তবে প্রতিবাদের সুরটা তীব্র। আমার জন্য… আমার শেষ ইচ্ছে…।
এ-সব বোলো না, ডুরেঈদ! মিনতি করলো রোয়েন। তুমি ভালো… সুস্থ হয়ে উঠবে।
কথা দাও, বললেন ডুরেঈদ। কথা দাও আমাকে!
কোনো স্পনসর নেই। আমি একা। একা আমার পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়।
নিকোলাস! বললেন ডুরেঈদ। ঝুঁকে তার আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ওর কানে অগ্নিদগ্ধ ঠোঁট ঠেকল। হারপার নিকোলাস! আবার বললেন তিনি।
কঠিন মানুষ… বুদ্ধিমান মানুষ..সাহসী… এতোক্ষণে তাঁর কথা ধরতে পারলো রোয়েন। হ্যাঁ, অবশ্যই, সম্ভাব্য স্পনসরদের তালিকায় হারপার নিকোলাসের নামটা সবার আগে আছে। রোয়েন জানে, ডুরেঈদ এ হারপার নিকোলাসকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। এ ভদ্রলোক যে তাঁর প্রথম পছন্দ, তা তিনি অনেকবার রোয়েনকে জানিয়েছেন।
কিন্তু কী বলব তাকে আমি? তিনি তো আমাকে চেনেনও না। কী করে তাঁকে বিশ্বাস করাবো? আসল স্ক্রোলই তো নেই!
ওর উপর আস্থা রাখবে। ফিসফিস করলেন ডুরেঈদ। ভালো মানুষ। আস্থা রাখবে… আবার ব্যাকুল আবেদন প্রকাশ পেল তাঁর কথায়, আমাকে কথা দাও!
হঠাৎ মনে পড়লো রোয়েনের। কায়রোয়, ওদের ফ্ল্যাটে, একটা নোটবুক আছে; আরো আছে টাইটা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ভর্তি হার্ড ড্রাইভ, ওর পি.সি.-তে।, সব শেষ হয়ে যায় নি। ঠিক আছে, রাজি হলো ও। কথা দিচ্ছি, ডুরেঈদ।
শরীরের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতে মানবিক কোনো অনুভূতি প্রকাশ পাবার কথা নয়, তা সত্ত্বেও ফিসফিস করার সময় ডুরেঈদের গলায় ক্ষীণ সন্তুষ্টির আভাস থাকলো। মাই ফ্লাওয়ার… মাথাটা সামনের দিকে নত হলো, রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
গ্রামের কৃষকরা রোয়েনকে ওই অবস্থাতেই দেখতে পেল, পুকুরের কিনারায় ডুরেঈদকে জড়িয়ে ধরে আছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। ইতোমধ্যে ভিলার আগুন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, আগুনের আভার চেয়ে ভোরের আলো এখন আরো বেশি উজ্জ্বল।
*
মিউজিয়াম আর অ্যান্টিকুইটিজ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সব স্টাফই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য মরুদ্যানে হাজির হলেন। এমন কি আতালান আবু সিন, সাংস্কৃতিক ও পর্যটন মন্ত্রীও কায়রো থেকে কালো এয়ার কন্ডিশনড মার্সিডিজ নিয়ে চলে এলেন। মন্ত্রী হওয়ার সূত্রে তিনিই ইবনে ডুরেঈদের বস্।
মুসলমান, তাই গির্জার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। নাহুত গাদ্দাবি তার মামার পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর মা মন্ত্রীর ছোট বোন। ডুরেঈদ প্রায়ই হাসিমুখে বলতেন, আর্কিওলজিতে ভাগ্নের সমস্ত যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার অভাব এ আত্মীয়তার সম্পর্ক পুষিয়ে দিয়েছে। প্রশাসক হিসেবেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তবে সেসব প্রকাশের উচ্চারণ করতে সাহস পায় না কেউ।
গির্জার ভেতর ধূপের ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রোয়েনের। কালো পোশাক পরা পুরোহিত বাইবেল পাঠ করছেন। ডান বাহুর ক্ষত শুকাতে শুরু করায় টান পড়ছে স্টিচে, নতুন করে শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। অলংকৃত, গিলটি করা বেদির সামনে লম্বা কালো কফিন যতবার দেখছে রোয়েন, ততবার চুলবিহীন খুলি ছাড়ানো ডুরেঈদের মাথাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। টলে উঠছে ও, তাল সামলাবার জন্য সীটের হাতল আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে।
অবশেষে গির্জার অনুষ্ঠান শেষ হলো। তবে রোয়েনের কাজ এখনো শেষ হয় নি। সেই একমাত্র নিকটাত্মীয়, কাজেই শব মিছিলের সামনে থাকতে হলো ওকে। তমাল বীথির ভেতর দিয়ে এগুলো মিছিল, শেষ মাথায় পারিবারিক গোরস্থানে ডুরেঈদের আত্মীয়-স্বজনরা অপেক্ষা করছে।
কায়রোয় ফিরে যাবার আগে আতালান আবু সিন রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে এলেন। দু একটা সান্ত্বনার কথাও শোনালেন তিনি। আইন-শৃঙ্খলার কী সাংঘাতিক অবনতি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি। এ জঘন্য . অপরাধের জন্য দায়ী ক্রিমিনালদের অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। প্লিজ, যে কয় দিন ইচ্ছে ছুটি নিন আপনি।