সবাই বেরিয়ে গেল স্টাডি থেকে। বশিত ল্যাম্পের প্যারাফিন ঢালল ইবনে আল-সিমার শার্ট আর ট্রাউজারে। কাজটা শেষ করে শেলফগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো সে, বাকি তেল দিয়ে বই আর পাণ্ডুলিপিগুলো ভেজাল। ল্যাম্প ফেলে দিয়ে আলখেল্লার ভেতর থেকে দিয়াশলাই বের করে জ্বালল। প্রথমে বুককেসে আগুন দিল সে। দপ করে জ্বলে উঠলো প্যারাফিন, স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা পাণ্ডুলিপিতে আগুন ধরে গেল। ডুরেঈদের কাছে ফিরে এলো সে। দিয়াশলাইয়ের আরেকটা কাঠি জ্বেলে তাঁর প্যারাফিন আর রক্তে ভেজা কাপড়ে ফেললো।
ডুরেঈদের বুকের উপর নীল কয়েকটা শিখা নাচতে শুরু করলো। কাপড় পুড়ে যাচ্ছে, আগুন ধরছে মাংসে, সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ওগুলোর রঙ। এক সময় কমলা দেখালো, মাথা থেকে স্কুল বা ভুসা ভর্তি ধোঁয়া উঠছে।
ছুটে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ল বশিত। চলে গেল ওরা।
*
অসহ্য ব্যথা জাগিয়ে দিল ডুরেঈদকে। গভীর অতল জীবনের প্রান্তসীমা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য এরকম তীব্রতারই প্রয়োজন ছিল। গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর্যায়ে প্রথমেই তিনি নিজের মাংস পোড়ার গন্ধ পেলেন, তারপরই নিদারুণ যন্ত্রণা পুরো শক্তিতে আঘাত করলো তাকে। একটা ঝাঁকি খেয়ে কাঁপুনি শুরু হওয়ার পর তা আর থামছে না। চোখ মেলে নিজের দিকে তাকালেন তিনি।
কালো ছাই হয়ে যাচ্ছে কাপড়, কুঁকড়ে উঠছে। আর ব্যথা যে এতো তীব্র হতে পারে, তার কোনো ধারণা ছিল না। অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন, কামরার ভেতর তার চারপাশে আগুন জ্বলছে। ধোয়া আর উত্তাপের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার উপর দিয়ে, এ-সবের ভেতর দিয়ে দোড়গোড়ার আকৃতিটা কোনো রকমে দেখা গেল। যন্ত্রণার অবসান চাইছেন তিনি, মৃত্যু কামনা করছেন।
তারপর রোয়েনের কথা মনে পড়লো দগ্ধ, কালো ঠোঁট খুলে প্রিয়তমার নামটা উচ্চারণ করতে চাইছেন, কোনো আওয়াজ বের হলো না। শুধু রোয়েনের চিন্তা নড়াচড়ার শক্তি এনে দিল তাঁকে। কারণ, রোয়েনকে তিনি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। একটা গড়ান দিলেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে আগুনের আঁচ ঝলসে দিল পিঠ। গুঙিয়ে উঠে আবার গড়ালেন, দরজার দিকে একটু এগুলেন।
নড়তে প্রবল ইচ্ছাশক্তি লাগছে, প্রতিটি নড়াচড়া নতুন করে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা বয়ে আনছে। তবে গড়ান দিয়ে আবার যখন চিৎ হলেন, তাজা ও ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়ায় একটু আরাম বোধ হলো। বাড়তি শক্তিটুকু ধাপগুলোর উপর দিয়ে ঠাণ্ডা পাকা চাতালে নেমে আসতে সাহায্য করলো তাকে।
কাপড় আর শরীরে এখনো আগুন জ্বলছে। নিস্তেজ বাড়ি মেরে শিখাগুলো নেভাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাত দুটো, জ্বলন্ত, কালো থাবা হয়ে আছে। তারপর পোনা ছাড়া পুকুরটার কথা মনে পড়লো। শরীরটাকে ঠাণ্ডা পানিতে ফেলে দেওয়ার চিন্তা আরেকটু শক্তি এনে দিল মনে। ক্রল করে সেদিকে এগুলেন, শিরদাঁড়া ভাঙা সাপের মতো।
মাংস থেকে উকটগন্ধী ধোয়া উঠছে, গলায় বেঁধে যাওয়ায় কাশি শুরু হলো, তবু মরিয়া হয়ে একটু একটু করে এগুচ্ছেন। পাথুরে মেঝের খাঁজে ফোস্কা ওঠা ত্বকের কিছুটা রয়ে গেল, শেষ একটা গড়ান দিয়ে পুকুরে পড়লেন তিনি। হিসস করে শব্দ হলো, বাষ্প উঠলো খানিকটা, ম্লান মেঘ মুহূর্তের জন্য অন্ধ করে দিল তাকে। জ্বলন্ত মাংসে ঠাণ্ডা পানির আলিঙ্গন অসহনীয় ব্যথায় জন্ম দিল, প্রায় অচেতন হয়ে পড়লেন ডুরেঈদ।
আবার যখন সচেতন হলেন, ভেজা মাথা তুলে দেখলেন শেষ প্রান্তের ধাপ বেয়ে চাতালে উঠে আসছে একটা ছায়ামূর্তি। কে চিনতে পারলেন না, তবে আসছে বাগানের দিক থেকে। তারপর জ্বলন্ত ভিলার আলো পড়লো ছায়ামূর্তির গায়ে, এবার রোয়েনকে চিনতে পারলেন তিনি। ভেজা চুল লেপ্টে আছে মুখে, ছেঁড়া ও কাদামাখা কাপড় থেকে লেকের পানি ঝরছে। ডান হাতের উপর দিকে ব্যান্ডেজ, এখনো সামান্য রক্ত চুয়াচ্ছে।
রোয়েন তাঁকে দেখতে পায় নি। চাতালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত স্টাডিরূপের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ডুরেঈদ কি ওই আগুনের ভেতর? প্রশ্নটা মনে জাগতেই সামনে বাড়লো রোয়েন, কিন্তু আগুনের আঁচ নিরেট পাঁচিলের মতো, ঠেকিয়ে দিল ওকে। সেই মুহূর্তে খসে পড়লো ছাদ, গর্জে উঠে আকাশের দিকে লাফ দিল শিখাগুলো। চারদিকে টুকরো টুকরো আগুন ছড়িয়ে পড়লো। পিছিয়ে এলো রোয়েন, হাত তুলে মুখ ঢাকল।
মুখ খুলে রোয়েনকে ডাকছেন ডুরেঈদ। কিন্তু ধোঁয়ায় পোড়া গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ঘুরে ছুটল রোয়েন, ধাপ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ডুরেঈদ বুঝতে পারলেন, লোকজনকে ডাকতে যাচ্ছে রোয়েন। ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শেষ একবার চেষ্টা করলেন তিনি। কাকের মতো কর্কশ কা-কা আওয়াজ বের হলো গলা থেকে।
বন করে ঘুরে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন। চিৎকারটা শুরু হলো কয়েক সেকেন্ড পর। ডুরেঈদের ঘাড়ের উপর ওটা কোনো মানুষের মাথা নয়। খুলির চুল অদৃশ্য হয়েছে, পুড়ে ছাই হবার পর বেশিরভাগই খসে পড়েছে; সিদ্ধ মাংসের ফালি ঝুলছে গাল আর চিবুক থেকে। গোটা মুখ কালো, ভেতরে কাঁচা মাংস দেখা যাচ্ছে। পিছু হটছে রোয়েন। ডুরেঈদ যেনো কুৎসিত একটা প্রাণী।
রোয়েন, আওয়াজটা এতো কর্কশ, কোনো রকমে চেনা গেল। আবেদনের ভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন তিনি। থামল রোয়েন, আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে ছুটে এসে বাড়ানো হাতটা ধরল।