লেকের গভীরে চলে এলো রোয়েন, পায়ের নিচে মাটি পাচ্ছে না। সাঁতরাচ্ছে ও। গলায় ওড়নাটা নেই, কোথায় খসে পড়েছে বলতে পারবে না। কামিজ আর সালোয়ার খুব বেশি ঢোলা হওয়ার সাঁতার কাটতে অসুবিধে হচ্ছে। পানির উপর থাকা নিরাপদ নয় মনে করে কিছুক্ষণ ডুব সাঁতার দিল। সন্দেহ নেই, ইতোমধ্যে রাস্তার কিনারায় পৌঁছে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে লোকগুলো।
মাথার উপর নল খাগড়া ঝোঁপ পেয়ে থামলো রোয়েন। আরো খানিকটা ভেতরে সরে এলো। পানির উপর শুধু নাকটা তুলে রেখেছে, মুখটা রাস্তার উল্টো দিকে ফেরানো। রোয়েন জানে ওর কালো চুলে টর্চের আলো প্রতিফলিত হবে না।
কান দুটো পানির নিচে থাকলেও রাস্তার উপর থেকে লোকগুলোর জোরালো গলা শুনতে পাচ্ছে রোয়েন। কিনারায় দাঁড়িয়ে নল খাগড়ার উপর টর্চের আলো ফেলছে, খুঁজছে ওকে। একবার টর্চের আলো ওর মাথার চারপাশে ঘোরাফেরা করলো, ডুব দেওয়ার জন্য বড় করে শ্বাস নিল রোয়েন। তবে না, আলোটা সরে গেল।
মাথা একটু তুললাম রোয়েন, কান দুটো পানির উপর উঠে এলো। লোকগুলো আরবিতে কথা বলছে। যে লোকটার নাম বশিত তার গলা চিনতে পারল। মনে হলো সে ওদের লীডার, কাকে কী করতে হবে বলে দিচ্ছে। ইউসুফ, যাও, বেশ্যাটাকে তুলে আনেনা।
ঢাল বেয়ে নেমে আসার আওয়াজ পেল রোয়েন। ছপ ছপ শব্দ তুলে পানিতে নামলো ইউসুফ। আরো সামনে, রাস্তা থেকে বলল বশিত। ওদিকে, নল খাগড়ার ভেতর, আমি যেখানে টর্চের আলো ফেলছি।
পানি ওদিকে অনেক গভীর। কেউ আমরা সাঁতার জানি না। তুমি না।
ওই তো, তোমার ঠিক সামনে। নল খাগড়ার ভেতর। আমি ওর মাথা দেখতে পাচ্ছি। বশিত উৎসাহ দিল তাকে। ধরা পড়ে গেছে, বুঝতে পেরে যতটা সম্ভব পানির নিচে মাথা নামালো রোয়েন।
চারদিকে প্রচুর পানি ছিটিয়ে ওর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ইউসুফ। অকস্মাৎ আল্লাহ রে, আল্লাহ বলে চিৎকার দিল সে, ঘুরে উঁচু পাড়ের দিকে পালাচ্ছে। কিছু না, নল খাগড়ার ভেতর থেকে এক ঝাঁক হাঁস ভয় পেয়ে সশব্দে ডানা মেলেছে আকাশে। রাস্তা থেকে বশিত হুমকি-ধামকি দিলেও কাজ হলো না, ইতোমধ্যে ঢালের উপর উঠে পড়েছে ইউসুফ, সে আর পানিতে নামতে রাজি নয়। ঢাল বেয়ে রাস্তায় উঠেছে সে, বলল, আসল গুরুত্ব স্কোলের, মেয়েটার তেমন গুরুত্ব নেই। স্ক্রোল ছাড়া টাকা পাওয়া যাবে না। মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।
রাস্তার কিনারা থেকে গাড়ি কাছে ফিরে গেল লোকগুলো। উঠে বসলো সবাই, গ্রামের দিকে চলে গেল গাড়ি। তারপরও ভয়ে পানি থেকে উঠছে না রোয়েন, ভাবছে অন্ধকার রাস্তায় ওরা কাউকে পাহারায় রেখে গেছে কিনা। খানিক পর ঠাণ্ডায় কাঁপুনি ধরে গেল, পানি থেকে না উঠলে মারা যেতে পারে। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না, শরীরে শক্তি আছে বলেও মনে হলো না। মরি মরব, দিনের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত পানি ছেড়ে আমি উঠব না।
এবাবে আরো বেশ কিছুক্ষণ কাটল। আগুনের আভায় আকাশটাকে রাঙা হয়ে উঠতে দেখলো রোয়েন। পাম গাছগুলোর ভেতর কমলা রঙের শিখাও মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কী ঘটছে বুঝতে পেরে নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গেল রোয়েন। কীভাবে শক্তি ফিরে পেল বলতে পারবে না, লেকের পাড়ে উঠে এসে কাদায়
দাঁড়িয়ে থাকলো। ঠক ঠক করে কাঁপছে, ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে, পানি গড়াচ্ছে চোখ দুটো থেকে।
ভিলায় আগুন দিয়েছে ওরা! বিড়বিড় করলো রোয়েন। ডুরেঈদ! ওহ্ গড, প্লিজ! নো, নো!
ঢাল বেয়ে উঠলো রোয়েন, জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে ছুটছে।
*
শেষ বাঁকটা ঘোরার আগেই হেডলাইট আর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল বশিত, ভিলার চালু ড্রাইভওয়ে ধরে গড়িয়ে এসে চাতালের নিচে থামলো ফিয়াট। পাথুরে ধাপ বেয়ে তিনজনই তারা চাতালে উঠে এলো। বশিত যেখানে ফেলে গেছে সেখানেই পুকুরের পাশে পড়ে রয়েছেন ডুরেঈদ। সেদিকে একবারও না তাকিয়ে পাশ কাটালো তারা, সরাসরি স্টাডিরূপে ঢুকলো। নাইলনের সস্তা টোট ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো বশিত। এরই মধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি কাজ সারো।
দোষটা ইউসুফের, ফিয়াটের ড্রাইভার কথা বলছে, সে-ই তো মেয়েটাকে পালাতে দিল।
রাস্তায় তুমিও একটা সুযোগ পেয়েছিলে, খেঁকিয়ে উঠলো ইউসুফ। কিছু করতে পারো নি।
থামো! দু জনকেই ধমক দিল বশিত। টাকা পেতে চাইলে কোনো ভুল করা চলবে না। টর্চের আলোয় টেবিলে পড়ে থাকা স্ক্রোলটা দেখালো সে। এটাই সেটা। নিশ্চতভাবেই জানে, চিনতে পারার জন্য ক্রোলের ফটোগ্রাফ দেখানো হয়েছে তাকে। প্রতিটি জিনিস চেয়েছে ওরা–প্রতিটি ম্যাপ আর ফটো। কাগজপত্র, বই, কিছুই রেখে যাওয়া চলবে না। দ্রুত হাতে টেবিলের সমস্ত জিনিস টোট ব্যাগে ভরে ফেলা হলো। বশিত বলল, এবার ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে হয়। নিয়ে এসো তাকে।
চাতালে বেরিয়ে এলো দু জন, ডুরেঈদের গোড়ালি ধরে টেনে নিয়ে এলো স্টাডিতে। আনার সময় তাঁর মাথা পাথুরে ধাপের উপর আর দোড়গোড়ায় ঘন বাড়ি খেলো, তার রক্ত মেঝেতে লাল ও ভেজা দাগ ফেলে দিল, টর্চের আলোয় চকচক করছে। . .
ল্যাম্পটা আনো! নির্দেশ দিল বশিত। ডুরেঈদের ফেলে দেওয়া ল্যাম্পটা কুড়িয়ে আনল একজন। অনেক আগেই নিভে গেছে সেটা। কানের কাছে তুলে নাড়লো বশিত। তেলে ভর্তি হয়ে আছে, বলল সে, প্যাঁচ ঘুরিয়ে ছিপি খুলল। যাও, ব্যাগটা গাড়িতে রেখে এসো।