পাম বীথির ভেতর দিয়ে ছুটছে রোয়েন। প্রথম দিকে খেয়াল থাকলো না কোনো দিকে যাচ্ছে বা কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ছুটছে যতক্ষণ শক্তিতে কুলায় দূরে সরে যাবার চেষ্টায়। তারপর ধীরে ধীরে আতঙ্কটা নিয়ন্ত্রণে আনল। ঝট করে পেছন দিকে তাকালো, কেউ ওর পিছু নেয় নি। লেকের কিনারায় পৌঁছে ছোটার গতি কমাল, বুঝতে পারছে তা না হলে হাঁপিয়ে যাবে। অনুভব করলো কাঁধের নিচে বাহু থেকে গরম রক্ত গড়াচ্ছে, হাত বেয়ে নেমে এসে আঙুলের ডগা থেকে ঝড়ে পড়ছে টপ টপ করে।
থামলো রোয়েন, বসে হেলান দিল একটা পাম গাছে। এক ফালি কামিজ ছিঁড়ে বাহুর ক্ষতটা বাঁধল, অক্ষত হাতটা এতো বেশি কাঁপছে যে কাজটা শেষ করতে অনেক সময় লাগলো। বাম হাত দাঁত দিয়ে ধরে গিট বাঁধল ব্যান্ডেজে, এখন আর আগের মতো রক্ত বের হচ্ছে না। কোনো দিকে যাবে বুঝতে পারছে না রোয়েন। এদিক ওদিক তাকাতে একটা জানালো দেখতে পেল, ভেতরে ল্যাম্প জ্বলছে। কাছাকাছি সেচ খালটার পাশে ওটা আলেয়ার ঘর, চিনতে পারলো ও। উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকেই এগুলো।
একশো কদমও এগোয় নি, শুনতে পেল পাম বীথির ভেতর কে যেনো কাকে আরবিতে বলছে, ইউসুফ, মেয়েলোকটা তোমার এদিকে আসে নি তো?
সঙ্গে সঙ্গে রোয়েনের সামনের অন্ধকারে একটা টর্চ জ্বলে উঠলো, শোনা গেল আরেক লোকের গলা, না, এদিকে আসে নি।
ভাগ্যক্রমে সামনের লোকটার হাতে গিয়ে পড়ে নি রোয়েন। ঝপ করে বসে পড়লো, মরিয়া হয়ে চারদিকে তাকিয়ে পালাবার পথ খুঁজছে। ওর পেছনের পাম বীথির ভেতর থেকে আরেকটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে, ওর ফেলে আসা পথ ধরে। নিশ্চয়ই এ লোকটাকেই লাথি মেরেছিল, তবে এরই মধ্যে আঘাতটা সামলে নিয়েছে।
দু দিকে বাধা, কাজেই লেকের দিকে ফিরে এলো রোয়েন। রাস্তাটাও ওদিকেই। এতো রাতে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, তবে ঈশ্বর চাইলে ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়েও যেতে পারে কাউকে। ছুটতে গিয়ে আছাড় খেলো রোয়েন, হাঁটুর চামড়া উঠে গেল, লাফ দিয়ে সোজা হয়ে আবার ছুটলো।
দ্বিতীয়বার আছাড় খাবার পর হাতে ঠেকল কমলালেবু সাইজের একটা পাথর। আবার ছোটার সময় মুঠোয় থাকলো ওটা, অস্ত্র হিসেবে খানিকটা অভয় দিচ্ছে ওকে।
বাহুর ক্ষমতা ব্যথা করছে। ডুরেঈদের কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে। তার আঘাত যে গুরুতর, ও জানে। বাঁচবে তো? যেভাবে হোক ডুরেঈদের কাছে সাহায্য নিয়ে ফিরতে হবে ওকে। ওর পেছনে পাম বীথির ভেতর টর্চ নিয়ে খোঁজাখুঁজি করছে লোক দু জন। ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসছে তারা। খানিক পর পর পরস্পরের সাড়া নিচ্ছে।
একটা নালা থেকে অবশেষে রাস্তার উপর উঠে এলো রোয়েন। বোধ হয় স্বস্তি পাওয়াতেই পা দুটো কাঁপতে শুরু করলো, মনে হলো এ পা নিয়ে আর হাঁটতে পারবে না। তবু চেষ্টা করলো রোয়েন। গ্রামের দিকে ঘুরলো ও। হাঁটা শুরু করছে, তবে প্রথম বাঁকে এখনো পৌঁছায় নি। এ সময় গাছপালার আড়াল থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসতে দেখলো একজোড়া হেডলাইটকে। রাস্তার মাঝখান ধরে গাড়িটার দিকে ছুটল রোয়েন। বাঁচান! আরবিতে চিৎকার করছে। সাহায্য করুন, প্লিজ!
বাঁক ঘুরলো গাড়িটা। হেডলাইটের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার আগে রোয়েন দেখলো গাঢ় রঙের ছোট একটা ফিয়াট ওটা। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে থামানোর জন্য হাত নাড়ছে ও, হেডলাইটের আলোয় রাস্তাটাকে মনে হচ্ছে
থিয়েটারের স্টেজ। সামনে থামলো ফিয়াট, ছুটে পাশে চলে এলো রোয়েন, দরজার হাতল ধরে টান দিল।
প্লিজ, বাঁচান! ওরা…
দরজা খুলে গেল, লাফ দিয়ে নিচে নেমে রোয়েনের আড়ষ্ট ডান হাতটা খপ করে ধরে ফেললো ড্রাইভার। হ্যাঁচকা টানে ব্যাক ডোরের দরজা খুলল সে। ইউসুফ! বশিত! পাম বীথির দিকে মুখ ঘুরিয়ে ডাক দিল। মেয়েটাকে পেয়েছি! ইউসুফ আর বশিত সাড়া দিচ্ছে, শুনতে পেল রোয়েন। দেখলো টর্চের আলো ঘুরে গিয়ে এদিকেই সরে আসছে দ্রুত।
ওর ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ওকে নত করার চেষ্টা করছে ড্রাইভার,গাড়ির ব্যাক সীটে ঢোকাতে চায়। হঠাৎ খেয়াল হলো রোয়েনের, বাম হাতের মুঠোয় পাথরটা এখনো আছে। একটু ঘুরলো ও, শক্ত করলো পেশী, মুঠোয় ধরা পাথরটা সজোরে ঠুকে দিল লোকটার মাথার পাশে। শেষ মুহূর্তে খুলি বাঁচাবার চেষ্টা করলো। সে ফলে পাথরটা গুঁড়িয়ে দিল তার কপালের হাড়। বিনা প্রতিবাদে রাস্তার উপর ঢলে পড়লো লোকটা, তারপর আর নড়ল না।
পাথরটা ফেলে দিয়ে আবার ছুটছে রোয়েন। হঠাৎ খেয়াল হলো, হেডলাইটের তৈরি আলোর পথ ধরে ছুটছে সে, তার প্রতিটি নড়াচড়া আলোকিত। পাম বীথি থেকে বেরিয়ে এসে ওর পিছু নিয়েছে অপর দু লোক, চিৎকার করে কী যেনো বলছে তারা। পেছন দিকে তাকাতে রোয়েন দেখলো, দ্রুত কাছে চলে আসছে খুনীরা। বুঝতে পারল, বাঁচার একমাত্র উপায় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া। ঘুরে রাস্তার কিনারায় চলে এলো, ঢাল বেয়ে তর তর করে নামছে। নামার গতি নিয়ন্ত্রণে থাকলো না, লেকের কোমর সমান পানিতে চলে এলো রোয়েন। আতঙ্ক ও অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারে নি রাস্তার পাকে লেকের কাছে চলে এসেছে। এখন আর ঢাল বেরিয়ে রাস্তায় ওঠার সময় নেই। তবে মনে পড়লো, সামনে প্যাপিরাস আর নল খাগড়া আছে, লুকানোর জায়গা পাওয়া যেতে পারে।