সিঁড়ে বেয়ে হাপির ঠিকানায় পৌঁছতে হলে অনেকগুলো ধাপ নামতে হবে। কঠিন পরিশ্রম আর অনেক চেষ্টার পর দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছলাম আমরা। তারপর আর এগুলাম না, কারণ এখানেই রাজকুমার একটা দৈববাণী পেল। স্বপ্নের ভেতর তার বাবা, মৃত দেবতা ফারাও, দেখা দিলেন তাকে এবং জানালেন, দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ জায়গাতেই আমি অনন্তকাল বিশ্রাম নিব।
চোখ থেকে চশমা খুলে রোয়েনের দিকে তাকালেন ডুরেঈদ। দ্বিতীয় ধাপ, বললেন তিনি।
অন্তত এ একবার স্পষ্ট একটা বর্ণনা দিয়েছে টাইটা। সে তার স্বভাবসুলভ হেঁয়ালি এখানে ব্যবহার করে নি।
এসো, স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফগুলো দেখি, বলল রোয়েন, গ্লসি শিটগুলো নিজের দিকে টেনে নিল। টেবিল ঘুরে ওর পেছনে এসে দাঁড়ালেন ডুরেঈদ। একটা গিরিখাদে ওরা বাধা পেল। খাদের ভেতর স্বাভাবিক বাধা কী হতে পারে? খানিক পরপর নদীর তলায় ঢাল থাকতে পারে, স্রোত ওখানে প্রবল হবে। কিংবা একটা জলপ্রপাত থাকতে পারে। ওটা যদি দ্বিতীয় জলপ্রপাত হয়, তাহলে এ জায়গায় ছিল ওরা- স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফের এক জায়গায় আঙুল ঠেকালো রোয়েন। ওখানে বিশাল দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়েছে সরু একটা নদী।
হঠাৎ মনোযোগ ছুটে গেল রোয়েনের, মাথা তুললাম। শুনছ? গলার স্বর বদলে গেছে, তীক্ষ্ণ ও সতর্ক শোনাল।
কী? ডুরেঈদও মুখ তুললেন।
কুকুর, বলল রোয়েন।
ওই ব্যাটা দোআঁশলাটা, বললেন ডুরেঈদ, ঘেউ ঘেউ করে রাতটাকে ভৌতিক করে তোলে। ওটাকে আর না তাড়ালেই নয়।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার ঘরে বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল ওরা। পেছন দিকে পাম গাছের তলায় শেডের ভেতর জেনারেটরের নরম শব্দ থেমে গেছে। মরু রাতের স্বাভাবিক অংশ হয়ে ওঠায় শুধু থেমে গেলে ওটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে ওরা।
চাতালের দরজা দিয়ে তারার অস্পষ্ট আলো ঢুকছে ভেতরে। উঠে গিয়ে দরজার পাশের একটা শেলফ থেকে তেল ভরা ল্যাম্পটা নামালেন ডুরেঈদ, জ্বলার পর চেহারায় কৃত্রিম বা সকৌতুক হতাশা ফুটিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালেন। যাই, দেখে আসে…
ডুরেঈদ, বাধা দিল রোয়েন, কুকুরটা!
কয়েক সেকেন্ড কান পেতে শোনার পর একটু উদ্বিগ্ন দেখালো ডুরেঈদকে। কুকুরটা একদম চুপ মেরে গেছে। ও কিছু না, বলে দরজার দিকে এগুলেন তিনি।
তেমন কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিল রোয়েন, ডুরেঈদ, সাবধান কিন্তু!
গুরুত্ব না দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন ডুরেঈদ, বেরিয়ে এলেন চাতালে।
বাইরে একটা ছায়া নড়তে দেখলো রোয়েন, ভাবল বাতাসে মাচার উপর কোনো লতা বা ডাল দোল খাচ্ছে। তারপর ওর খেয়াল হলো, রাতটা একদম স্থির, এতোটুকু বাতাস বইছে না। এ সময় লোকটাকে দেখতে পেল, ফ্ল্যাগস্টোনের উপর দিয়ে দ্রুত ও নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। মাছ ভর্তি পুকুরটা পাকা চাতালের মাঝখানে, ওটাকে ঘুরে এগুচ্ছেন ডুরেঈদ; লোকটা তার পেছন দিকে চলে আসছে।
ডুরেঈদ! রোয়েনের চিৎকার শুনে দ্রুত আধ পাক ঘুরলেন ডুরেঈদ, উঁচু করলেন ল্যাম্পটা।
কে তুমি? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। এখানে কী চাও?
আগন্তুক নিঃশব্দে তাঁর কাছে চলে আসছে। গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা আলখেল্লা ফুলে উঠছে পায়ের চারপাশে, এক প্রস্থ কাপড়ে মাথাটা ঢাকা। ল্যাম্পের আলোয় ডুরেঈদ দেখলেন মাথার সাদা কাপড়ের একটা প্রান্ত মুখের উপর নামিয়ে এনে লোকটা তার চেহারা ঢেকে রেখেছে।
লোকটা রোয়েনের দিকে পেছন ফিরে রয়েছে, তার হাতের ছুরিটা তাই দেখতে পায় নি ও। তবে ডুরেঈদের পেট লক্ষ্য করে ছোরা মারার ভঙ্গিটা চিনতে পারল। ব্যথায় কাতরে উঠলেন ডুরেঈদ, কুঁজো হয়ে গেলেন। আততায়ী ছুরিটা বের করে নিয়ে আবার ঢোকালো, তবে এবার ল্যাম্প ফেলে দিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললেন ডুরেঈদ।
খসে পড়া ল্যাম্পের শিখা দপদপ আওয়াজ করছে। আলো ও ছায়ার ভেতর ধস্তাধস্তি করছে দু জন। রোয়েন দেখতে পেল ডুরেঈদের সাদা শার্টের সামনের দিকটায় গাঢ় একটা দাগ ছড়িয়ে পড়ছে।
দৌড় দাও! চিৎকার করছেন ডুরেঈদ। যাও, রোয়েন, যাও! লোকজনকে ডাকো! ওকে আমি ধরে রাখতে পারছি না! রোয়েন জানে ডুরেঈদ নেহাতই শান্তশিষ্ট একজন ভদ্র মানুষ, জীবনের বেশিরভাগ সময় ঘরে বসে বইপত্র নিয়ে কাটিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে লোকটার সঙ্গে তিনি পারছেন না।
যাও, রোয়েন, যাও! প্লিজ, নিজেকে বাঁচাও! গলার আওয়াজই বলে দিল রোয়েনকে, ডুরেঈদ দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তবে এখনো তিনি আততায়ীর ছুরি ধরা হাতটা ছাড়েন নি।
আতঙ্কে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল রোয়েন, হঠাৎ সংবিৎ ফিরে ছুটলো দরজার দিকে। চাতালে বেরিয়ে এলো বিড়ালের মতো ক্ষিপ্র বেগে। আততায়ীকে ডুরেঈদ আটকে রেখেছেন, লোকটা যাতে রোয়েনের পথ আগলাতে না পারে।
নিচু পাঁচিল টপকে ঝোঁপের মাঝখানে নামলো রোয়েন, প্রায় সেঁধিয়ে গেল দ্বিতীয় লোকটার আলিঙ্গনের ভেতর। তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে মোচড় খেলো, ছিটকে সরে গিয়ে ছুটলো আবার লোকটার লম্বা করা হাতের আঙুল আঁচড় কাটলো ওর মুখে। নিজেকে প্রায় ছাড়িয়ে নিয়েছে রোয়েন, এ সময় আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আটকে গেল গলার কাছে ওর সুতি ব্লাউজে।
একবার লোকটার হাতে ছুরি দেখতে পেল রোয়েন, তারার আলো লেগে ঝিক করে উঠলো রূপালি একটা লম্বা আকৃতি। ওটা দেখামাত্র মৃত্যু ভয় নতুন শক্তি যোগাল ওকে। ফড় ফড় করে ছিঁড়ে গেল কামিজ, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটছে রোয়েন-তবে তারপরও একটু দেরি হয়ে গেছে ওর ছুরির ফলাটাকে পুরোপুরি এড়াতে পারলো না। বাহুর উপর দিকটা চিরে গেছে, বুঝতে পেরে বাঁচার আকুলতা আরো তীব্র হয়ে উঠলো, সমস্ত শক্তি এক করে লোকটাকে লাথি মারল রোয়েন। লাগলো শরীরের নিচের দিকে নরম কোথাও, তবে ঝাঁকি খেলো ওর গোড়ালি আর হাঁটু। লোকটা গুঁড়িয়ে উঠে হাঁটু গাড়ল মাটিতে।