কাউকে দেখাবার দরকার কি? রোয়েনের কথায় সামান্য হলেও ক্ষোভ বা ঝাঁঝ প্রকাশ পেল। যা করার আমরা করলেই তো পারি। মাঝে মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ডুরেঈদের বয়েস হয়েছে, কাজেই তিনি সতর্ক ও সাবধান। আর রোয়েনের আচরণে তারুণ্যের অস্থিরতা প্রকাশ পায়।
তুমি বুঝবে না, রোয়েন, বললেন তিনি। যখনই তিনি এ কথা বলেন, অস্বস্তি বোধ করে রোয়েন। আরব পুরোপুরি পুরুষদের জগৎ, মর্যাদার সমান ভাগ মেয়েদেরকে তারা এখনো দিতে শেখে নি। অথচ আরেক জগতের সঙ্গে পরিচয় আছে রোয়েনের, যেখানে মেয়েরা সমান মর্যাদা দাবি করে এবং পায়ও দান। হিসেবে নয়, অধিকার হিসেবে। দুই জগতের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছে রোয়েন, পশ্চিমা জগৎ আর আরব জগৎ।
রোয়েনের মা ইংরেজ মহিলা, কায়রোর ব্রিটিশ দূতাবাসে কাজ করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ওর বাবা মিশরীয়, কর্নেল নাসেরের সরাসরি অধীনে একজন তরুণ অফিসার ছিলেন। পরস্পরকে ভালোবাসেন ওঁরা, তারপর বিয়ে করেন। যদিও ওদের দাম্পত্য জীবনটা সুখের হয় নি।
ওর মা চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে ইংল্যান্ডের ইয়র্কে, নিজের জন্মস্থানে। চেয়েছিলেন জন্মসূত্রে তাঁর সন্তানের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব থাকা চাই। মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর মায়ের জেদে ইংল্যান্ডে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে হয় রোয়েনকে। তবে প্রতিটি দীর্ঘ ছুটি কায়রোয় বাবা ও চাচার সঙ্গে কাটিয়েছে ও। ওর বাবার বিস্ময়কর পদোন্নতি হয়, শেষ দিকে তিনি মোবারক মন্ত্রীসভার সদস্য হতে পেরেছিলেন। বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসত রোয়েন, বোধহয় সেজন্যই বাবা ও আরব সমাজের প্রভাব বেশি পড়ে ওর উপর। বাল্য ও কৈশোর কাল বেশির ভাগটাই মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে কাটালেও মা বা পশ্চিমা সমাজের প্রভাব ওর উপর খুব কম।
কপটিক সমাজের ঐহিত্য হলো গুরুজনরা মেয়ের পাত্র ঠিক করবেন। মৃত্যুর আগে রোয়েনের বাবা তার জন্য পাত্র ঠিক করে দিয়েছিলেন। মনের গভীরে আপত্তি থাকলেও মৃত্যুপথযাত্রী বাবার শেষ ইচ্ছে রক্ষা করেছিল সে।
তবে ডুরেঈদের সঙ্গে ওর দাম্পত্য-জীবন সুখের হয় নি এ কথা বলা যাবে না। শুধু যদি ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা ওর না থাকতো, রোয়েন জানে, অত্যন্ত সুখের হতো ওর জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ডেভিড বলে এক তরুণের প্রেমে পড়েছিল সে।
ভালোই চলছিল রোয়েনের জীবন। হঠাৎ একদিন নিজের বাপ-মায়ের কথা মেনে তাদেরই নির্বাচিত এক সুন্দরীর সঙ্গে বিয়ে বসে ডেভিড। ভেঙে যায় ওদের সম্পর্ক।
ডুরেঈদকে রোয়েন সম্মান করে, পছন্দও করে। শুধু কখনো কখনো গভীর রাতে ওর মনে হয়, সমর্থ কোনো তরুণ হয়তো আরো অনেক বেশি শারীরিক সুখ দিতে পারতো ওকে।
ডুরেঈদ আবার কথা বলছেন। মন্ত্রীর সঙ্গে আবার আমি কথা বলেছি, কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত নাহুত তাকে বুঝিয়েছে যে, আমি একটু পাগলাটে। বিষণ্ণ হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। নাহুত গাদ্দাবি তাঁর ডেপুটি, অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী তরুণ, মন্ত্রীসভায় ও প্রশাসনে তার আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা অনেক। মিনিস্টার আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, ফাণ্ড পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই আমাকে দেখতে হবে বাইরে থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় কিনা। সম্ভাব্য স্পনসর হিসেবে তালিকায় চারটি নাম রেখেছি। প্রথমেই বলা যেতে পারে গেটি মিউজিয়ামের কথা, কিন্তু বিশাল ও নিষ্পণ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে কখনোই আমার ভালো লাগে নি। একা একজন লোকের সাহায্য পেলে খুশি হই। সিদ্ধান্তে আসাটা তাহলে সহজ হয়। এসব কিছুই নতুন নয়:রোয়েনের কাছে, তবু এ দিয়েই শুনছে ও।
তারপর ধরো, হের ফন শিলার। তার টাকা আছে, এ বিষয়ে আগ্রহও আছে, কিন্তু তাঁকে আমি এতো ভালোভাবে চিনি না যে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি।
আর আমেরিকান ভদ্রলোক? তিনি তো বিখ্যাত একজন কালেক্টর।
পিটার ওয়ালশের সঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। নিজের ভাগ বাড়াবার দিকে এতো বেশি ঝোঁক তার, তাঁকে আমার রাক্ষস বলে মনে হয়। সত্যি ভয় পাই।
তাহলে বাকি থাকলো কে? তালিকার প্রথম নামটা?
ডুরেঈদ জবাব দিলেন না, কারণ উত্তরটা দু জনেরই জানা। ওঅর্ক টেবিলের দিকে তাকালেন তিনি, জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কত সাধারণ আর নগণ্য। পুরানো একটা প্যাপিরাস স্ক্রোল, কয়েকটা ফটোগ্রাফ আর নোট বুক, একটা কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। বিশ্বাস করা কঠিন মন্দ লোকের হাতে পড়লে এ সামান্য কয়টা জিনিস কী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
তারপর হেসে উঠলেন। আমি বোধহয় একটু বেশি ভয় পাচ্ছি। হয়তো রাত জেগে কাজ করার প্রতিক্রিয়া। চলো, কাজে ফিরে যাই আবার? আগে পাজি বুড়ো টাইটার পুরো বক্তব্য অনুবাদ করি, তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যাবে, কী বলো?
সামনের স্তূপ থেকে উপরের ফটোটা হাতে নিলেন। স্ক্রোলের মাঝখানের অংশ দেখানো হয়েছে এতে। ভাগ্যই খারাপ, তা না হলে ঠিক এ জায়গার প্যাপিরাস ভেঙে খসে পড়বে কেন। চোখে চশমা পরলেন। পড়ছেন রোয়েনকে শোনাবার জন্য।