প্রাচীন এ মিশরীয়র সঙ্গে কত দিক থেকেই না বিচিত্র আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করে রোয়েন। সন্দেহ নেই, টাইটার সরাসরি বংশধরও যেহেতু কপটিক খ্রিস্টান, কাজেই ওর রক্তধারা প্রাচীন সেই ফারাও আর পিরামিড যুগ থেকে প্রবাহিত। আরবরা তো মিশর জয় করেছে সম্প্রতি, চোদ্দশো বছরও হয় নি।
গ্রামের শেষ মাথায় নিজ পরিবারে ফিরে গেছেন বৃদ্ধা আলেয়া, রাত দশটার দিকে নিজেই দু কাপ কফি বানালো রোয়েন। কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় টুকটাক আলাপ হলো।
রোয়েনের কাছে, তার স্বামীর সাথে সম্পর্কটা বন্ধুর মতো, তাই এমন কোনো আলোচ্য বিষয় নেই, যা নিষিদ্ধ। ইংল্যান্ড থেকে আর্কিওলজিতে ডক্টরেট নিয়ে মিশরে ফেরার পর পরীক্ষা দিয়ে ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যান্টিকুইটিজ-এ চাকরি পেয়েছে রোয়েন। ডুরেঈদ ওই বিভাগেরই পরিচালক।
ডুরেঈদ যখন মহৎ প্রাণের উপত্যকার কবর খনন করেন, রোয়েন তখন তার সহকারী হিসেবে ছিল। ওটা ছিল রানী লসট্রিস-এর সমাধি, খ্রিস্টের জন্মের সতেরো শ আশি বছর আগেকার।
সমাধির সমস্ত জিনিস প্রাচীনকালেই চুরি হয়ে গেছে, এটা দেখে হতাশ হন ডুরেঈদ। রোয়েনও খুব কাতর হয়ে পড়ে। থাকার মধ্যে আছে শুধু দেয়াল ও সিলিং ঢাকা দেয়ালচিত্র।
স্তম্ভের পেছনের দেয়ালে রোয়েনই তখন কাজ করছিল, যেখানে এককালে দাঁড়িয়ে ছিল ভাস্কর্যশিল্প–অলংকৃত ও শিলালিপিসমৃদ্ধ পাথুরে শবাধার; দেয়ালচিত্রের ছবি তুলছে ও। এ সময় একদিকের দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়লো, বেরিয়ে পড়লো দশটা কুলঙ্গি বা দেয়ালে তৈরি ছোট খোপ। দেখা গেল দশটা কুলঙ্গিতে দশটা তেল চকচকে স্বচ্ছ পাত্র রয়েছে। প্রতিটি পাত্রে পাওয়া গেল একটা করে প্যাপিরাস। ক্ষয় ক্ষতি কিছু হলেও, প্রায় চার হাজার বছর পর আশ্চর্য অটুট অবস্থায় আজো টিকে আছে।
কি আশ্চর্য ও বিস্ময়কর কাহিনীই না বলা হয়েছে ওগুলোয়। শক্তিশালী ও সুদক্ষ শত্ৰু-বাহিনী আক্রমণ করলো একটা জাতিকে এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত হলো ঘোড়া এবং ঘোড়ায় টানা রথ। এর আগে মিশরীয়রা ঘোড়া দেখে নি। হিকসস বাহিনীর দ্বারা পরাজিত ও বিধ্বস্ত নীলনদের আশীর্বাদপুষ্ট মানুষ পালাতে বাধ্য হলো। নেতৃত্ব দিল ওদের রাণী, রাণী লসট্রিস; বিশাল নদী অনুসরণ করে দক্ষিণ দিকে চলে এলো মিশরের অধিবাসীরা, চলে এলো প্রায় নদীর উৎসমুখে, ইথিওপিয় ভূখন্ডে, নির্দয় পাহাড়ি এলাকার গভীরে। এখানে, প্রবেশ নিষিদ্ধ পাহাড়শ্রেণির ভেতর, রাণী লসট্রিস ও তাঁর স্বামী মামোসের মমি করা দেহ সমাধির ভেতর সংরক্ষণ করলেন। ফারাও মামোস, যুদ্ধে হিকসস বাহিনীর হাতে নিহত হন।
বহু বছর পর রাণী লসট্রিস তাঁর প্রজাদের নিয়ে উত্তর অভিযানে বেরোন, আবার ফিরে আসেন মিশরে। এবার ওঁদের কাছে নিজস্ব ঘোড়া আর রথ আছে, দুর্গম আর নিষ্ঠুর আফ্রিকার প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে দক্ষ হয়েছে যোদ্ধারা, সুদীর্ঘ নদীর তীর ধরে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মতো ছুটে এসে হানাদার হিকসস বা রাখাল-রাজা বাহিনীকে প্রতিআক্রমণ করে বসলো মিশরীয় বাহিনী। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হার হলো হিকসসের, তার কবল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো আপার ও লোয়ার ঈজিপ্ট।
এ গল্প রোয়েনের অস্তিত্বের অণু-পরমাণুতে শিহরণ জাগায়। প্যাপিরাসে বৃদ্ধ ক্রীতদাসের আঁকা চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিফের অর্থ ধীরে ধীরে একটু একটু করে উদ্ধার করে ওরা, আর প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হতে থাকে ও।
কায়রোর মিউজিয়ামে, সারাদিন রুটিন কাজ করার পর এ ভিলায় রোজ রাতে স্ক্রোল নিয়ে বসে ওরা। দেখতে দেখতে কয়েক বছর কেটে গেছে, তবে নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের ফলও পেয়েছে, দশটা ফ্রোলের পাঠোদ্ধার করা গেছে, বাকি আছে শুধু সপ্তম স্ক্রোল। এটি আসলে হেঁয়ালিতে ভরা, লেখক গূঢ় রহস্যময় সাঙ্কেতিক ভাষায় এমন সব ঘটনার কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে গেছে যে এতো কাল পর কার সাধ্য অর্থ বের করে। নিজেদের কর্মজীবনে হাজার হাজার টেক্সট স্টাডি করেছে ওরা, কিন্তু সপ্তম স্ক্রোলে টাইটা এমন সব সিম্বল বা প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করেছে যা আগে কখনো ওদের চোখে পড়ে নি। এখন ওরা দু জনেই জানে যে টাইটা চেয়েছিল তার প্রিয় রাণী ছাড়া আর কেউ যেনো এর অর্থ করতে না পারে। মনোহারিনী রাণীকে দেওয়া এগুলো ছিল তার শেষ উপহার, যে উপহার রাণী সঙ্গে করে কবরে নিয়ে যাবেন।
দু জনের এক করা মেধা, কল্পনাশক্তি আর শ্রম কয়েক বছর ধরে কাজে লাগিয়ে অবশেষে একটা উপসংহারে পৌঁছতে যাচ্ছে ওরা। অনুবাদে এখনো অনেক ফাঁক রয়ে যাচ্ছে, কিছু অংশের পাঠ সঠিক হলো কিনা সন্দেহ আছে, তবে পাণ্ডুলিপির মূল কাঠামোটা এমন ভঙ্গিতে সাজিয়েছে ওরা যে তা থেকে বক্তব্যের সারমর্মটুকু বের করে নেওয়া সম্ভব।
এ মুহূর্তে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মাথা নাড়ছেন ডুরেঈদ, যেমন আগেও বহুবার করেছেন তিনি। সত্যি আমি ভয় পাচ্ছি, বললেন। এটা বিশাল
একটা গুরু দায়িত্ব। বছরের পর বছর রাত জেগে যে জ্ঞান আমরা অর্জন করলাম, এটা নিয়ে কী করা হবে। এ যদি মন্দ কোনো লোকের হাতে পড়ে… কথা শেষ না করে চুমুক দিলেন আবার, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন কী আমরা যদি ভালো কোনো লোককেও দেখাই, প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো এ গল্প সে কী সত্যি বলে বিশ্বাস করবে?