এবারে তোমার পালা! চিৎকার করে ডুরেঈদের উদ্দেশ্যে বলল রোয়েন। বয়সের কারণে ডুরেঈদের শরীরে এখন আর সেই চঞ্চলতা নেই। ধীরে, বালিয়াড়ির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলেন তিনি। এক হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন স্ত্রীকে। চুমো খাওয়ার ইচ্ছেটা দমন করলেন অতি কষ্টে। বাড়ির বাইরে, এমন কী প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশ করার আরবীয় রীতি নয় এটি।
অবিন্যস্ত পোশাক ঠিক-ঠাক করে চুল বেঁধে নিল রোয়েন। নলখাগড়ার ঝোঁপ ঘেঁষে, সেচের খালগুলোর উপর স্থাপিত নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে হেঁটে চললো ওরা। ক্ষেতের কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে থাকা কৃষকের দল হাত উঁচিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। দারুণ সম্মান করে তারা অধ্যাপক ডুরেঈদকে।
আস্সালামু আলাইকুম, ডক্টর!
জ্ঞানী লোকদের সম্মান দিতে জানে এরা। বিগত বছরগুলোয় ডুরেঈদ এবং তাঁর পরিবারের সদয় আচরণের জন্য একটু বেশিই ভালোবাসে তাঁকে। গ্রামের বেশিরভাগ অধিবাসীই মুসলমান, কিন্তু তিনি খ্রিস্টান–এটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশে।
ভিলায় পৌঁছতে, বৃদ্ধা পরিচারিকা আলেয়া, বকুনি লাগালো ডুরেঈদ আর রোয়েনকে। সবসময় দেরি করো তোমরা! কেননা বাপু, একটু নিয়ম করে চললে ক্ষতি কী শুনি? এখানে আমাদের একটা সম্মান আছে!
বুড়ি মা, ঠিকই বলেছো, বিনয়ের সাথে বললেন ডুরেঈদ, তোমাকে ছাড়া যে আমাদের কী করে চলতো! অনুচ্চ স্বরে গজগজ করতে করতে রোয়েনকে অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিল বুড়ি।
চাতালে বসে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষ করলো ওরা জলপাই, আঙুর, রুটি আর ছাগ দুধের তৈরি পনির দিয়ে। আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে। মরুর নিস্তব্ধ আকাশে মিটমিট করছে তারার দল।
রোয়েন, প্রিয়তমা, টেবিলের ওপাশে বসা স্ত্রীর হাত ছুঁলেন ডুরেঈদ। চলো, কাজ শুরু করি। উঠে দাঁড়িয়ে, চাতালের উপরে নিজের স্টাডির উদ্দেশ্যে হেঁটে চললেন তিনি।
স্টাডিতে প্রবেশ করে, লম্বা স্টীল সেফের সামনে এসে দাঁড়ালো রোয়েন আল সিমা, হাতল ঘুরিয়ে কমবিনেশন লক খুলছে। গাদা গাদা প্রাচীন বই-পুস্তক আর রাশি রাশি গুটানো স্ক্রোল বা প্যাপিরাস রয়েছে স্টাডিতে, আরো রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি ও আর্টিফ্যাক্ট। এ সবই তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় ও সংগ্রহ। এতো কিছুর মাঝখানে স্টিলের সেফটা এ ঘরে মানায় নি।
ভারী স্টীলের দরজাটা খুলে যেতে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলে রোয়েন। প্রাচীন এসব পুরানিদর্শন দিনের মধ্যে যতোবারই দেখুক, সশ্রদ্ধ ভয় ও বিস্ময় মেশানো একটা অনুভূতি অবশ করে দেয় ওকে।
সপ্তম স্ক্রোল, ফিসফিস করে বলল রোয়েন, ওটা ছোঁয়ার মুহূর্তে শক্ত হয়ে উঠলো পেশী। গুটানো প্যাপিরাসে লেখা সপ্তম লিপি প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো, লিখে রেখে গেছে সময়কে জয় করে ইতিহাস ঠাই করে নেওয়া বিশাল এক প্রতিভা। সে বেঁচে ছিল কয়েক সহস্র বছর আগে, ধুলোয় মিশে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব, কিন্তু তার সম্পর্কে সব কথা জানার পর রোয়েন তাকে নিজের স্বামীর মতোই শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। তার কথা চিরন্তন ও অবিনাশী, সেসব যেনো কবর থেকে স্পষ্ট উঠে আসে রোয়েনের কানে, ভেসে আসে স্বর্গীয় উদ্যান থেকে। খ্রিস্টপূর্ব আধ্যাত্মিক ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাস করতো সে, সেই মহান ত্রয়ী–ওসিরিস, আইসিস আর হোরাস-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিল। রোয়েন তার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পায়। সেও সাম্প্রতিক একটা ট্রিনিটি অর্থাৎ ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী, সেও পরম ঈশ্বর, ঈশ্বরপুত্র এবং পরমআত্মার প্রতি নিবেদিত প্রাণ।
স্ক্রোলটা লম্বা একটা টেবিল নিয়ে এলো রোয়েন, ওখানে আগেই কাজ শুরু করেছেন ডুরেঈদ। টেবিলের উপর তার সামনে ওটা রাখতে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, মুহূর্তের জন্য তার চেহারায় শ্রদ্ধা মেশানো বিস্ময় ও সমীহ ফুটে উঠতে দেখলো রোয়েন। ও জানে, দু জনেরই এ একই অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ডুরেঈদ চান স্ক্রোলটা সারাক্ষণ টেবিলেই থাকুক, এমন কী যখন ওটার কোনো প্রয়োজন নেই, তখনও। ক্রোলের ছবি আর মাইক্রোফিল্ম আছে, কাজ করতে কোনো অসুবিধে হয় না। তবু লেখাগুলো পরীক্ষা করার সময় প্রাচীন লেখকের অদৃশ্য উপস্থিতি যেনো তাঁর খুব দরকার।
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন ডুরেঈদ। আমার চেয়ে তোমার চোখ ভালো, রোয়েন, বললেন তিনি। দেখো দেখি, এ ক্যারেক্টারটা থেকে কী বুঝলে?
কয়েক মুহূর্ত মাথা ঘামানোর পর, ডুরেঈদের হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিল রোয়েন, ওটার ভেতর দিয়ে তাকালো আবার।
দেখে মনে হচ্ছে, আমাদেরকে ধোকায় ফেলার জন্য টাইটা নিজের তৈরি আরেকটা গুপ্তলিপি ব্যবহার করেছে এখানে, বলল ও। বলার সুরে প্রাচীন লেখকের প্রতি আদর ও ভালোবাসা ফুটল, তবে তারই সঙ্গে কৃত্রিম একটু ক্ষোভও প্রকাশ পেল; সব মিলিয়ে ভাবটা যেনো বন্ধুটি এখনো বেঁচে আছে এবং সকৌতুক চালাকি করছে ওদের সঙ্গে।
তাহলে, মাথা খাঁটিয়ে ধাঁধার জবাব বের করতে হয়, দুরেঈদের কণ্ঠে উৎসাহ। প্রাচীন এ খেলাটা তাঁর খুব পছন্দ না হলে সারাজীবন লেগে থাকতে পারতেন না।
কাজে মগ্ন হয়ে পড়ে ডুরেঈদ এবং রোয়েন। ঠাণ্ডা রাতের প্রহর কাটে নিঃশব্দে। এ সময়টাই কাজ করতে পারে ওরা। কখনো ওরা ইংরেজিতে কথা বলে, কখনো আরবিতে; দুটো ভাষাতেই সমান দক্ষ। ফ্রেঞ্চ ওদের তৃতীয় ভাষা, তবে খুব কমই ব্যবহার করার দরকার পড়ে। দুজনেই ওরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করেছে, মাতৃভূমি এ মিশর থেকে অনেক দূরে। মাতৃভূমি এ মিশর, এটা ক্রীতদাস টাইটার প্রিয় একটা প্রকাশভঙ্গি, স্ক্রোলে বহুবার ব্যবহার করেছে সে, উচ্চারণ করতে রোয়েনেরও খুব ভালো লাগে।