সরু কামরাটায় ঢুকে কাঁচ মোড়া ডিসপ্লে কেসের সামনে দাঁড়ালো রোয়েন, কেসটা মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা। ছোটখাট আর্টিফ্যাক্ট, যন্ত্রপাতি আর হাতিয়ার, কবচ, মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্রে ঠাসা ভেতরটা এগুলো মধ্যে আছে নিউ কিংডম-এর বিশতম রাজবংশের জিনিসপত্র, এক হাজার একশো খ্রিস্টপূর্ব আমলের। আর ওল্ড কিংডম-এর জিনিসগুলো প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরানো। এ-সব সংগ্রহের ক্যাটালগ নিখুঁত নয়, অনেক জিনিসের কোনো পরিচয়ই উল্লেখ করা হয় নি।
শেষের দিকে, নিচের শেলফে, সাজানো রয়েছে অলঙ্কার, আঙটি আর সীল। প্রতিটি সীলের পাশে মোমের উপর ওই সীলের একটা করে ছাপ। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে এ আর্টিফ্যাক্টগুলোর একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে রোয়েন। ডিসপ্লের মাঝখানে নীল ল্যাপিস ল্যাজিউলাই দিয়ে তৈরি একটা খুদে সীল। প্রাচীনকালে ল্যাপিস মূল্যবান ও দুর্লভ ছিল, যেহেতু মিশরীয় সাম্রাজ্যে জিনিসটা পাওয়া যেত না। ওই সীল থেকে মোমের উপর যে ছাপ দেওয়া হয়েছে তাতে ডানা ভাঙা একটা শ্যেন বা বাজপাখি দেখা যাচ্ছে। বাজ পাখির নিচে লেখাটা পরিষ্কার পড়তে পারলো রোয়েন : টাইটা, মহারানীর লেখক।
রোয়েন জানে, এ সেই একই লোক, কারণ স্ক্রোলে নিজেই সই হিসেবে ডানাভাঙা শ্যেন পাখি ব্যবহার করেছে সে। রোয়েন ভাবছে এ ক্ষুদে আর্টিপ্যাক্ট কোত্থেকে এখানে এলো। সম্ভবত কোনো গ্রামবাসী বৃদ্ধ লেখক তথা ক্রীতদাসের হারানো সমাধি থেকে চুরি করেছে। তবে কে সে, কবে বা ঠিক কোত্থেকে পেল, আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই।
তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ, টাইটা? এ কি মাথা খাঁটিয়ে তৈরি করা একটা বিরাট ধাঁধা? তুমি কি তোমার সমাধি থেকে আমার উদ্দেশে হাসছ? আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ঠাণ্ডা কাঁচে কপাল ঠেকে গেল। তোমার সমাধি যেখানেই থাকুক, তুমি যেখানেই থাকো, আমার বন্ধু হবে? নাকি আমার প্রতিপক্ষ হওয়াই তোমার ইচ্ছে? দাঁড়িয়ে কামিজ থেকে ধুলো ঝাড়ল রোয়েন। ঠিক আছে, দেখা যাবে। তোমার সঙ্গে খেলব আমি, দেখবো কে কাকে হারাতে পারে।
*
গাঢ় রঙের চকচকে সিল্ক স্যুট পরে ডেস্কে বসে আছেন আতালান আবু সিন। তবে রোয়েন জানে আলখেল্লা পরেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন মন্ত্রী মহোদয়, স্বস্তি পান গালিচার উপর কুশনে হেলান দিয়ে বসতে। ওর চোখের কৌতুক লক্ষ করে হাসলেন তিনি; বললেন, আজ দুপুরে কয়েকজন আমেরিকানের সঙ্গে মিটিং ছিল।
রোয়েন তাকে পছন্দ করে। ওর সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করেন তিনি, মিউজিয়ামের চাকরিটাও তাঁর ব্যক্তিগত অনুমোদন ছাড়া পেত না ও। তাঁর পজিশনে অন্য যে কোনো লোক মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে রোয়েন আবেদন প্রত্যাখ্যান করত, বিশেষ করে স্ত্রীর আপত্তির মুখে।
ওর কুশলাদি জানতে চাইলেন তিনি হাতের ব্যান্ডেজটা দেখিয়ে রোয়েন বলল, দশ দিন পর স্টিচ খোলা হবে।
পরিবেশ একটু আড়ষ্ট হয়ে আছে, তাই ভূমিকা না করে সরাসরি নিজের কথা বলে গেল রোয়েন। ডুরেঈদকে হারিয়ে আমি এখন বুঝতে পারছি না জীবনটা নিয়ে কী করব। তাই ভাবছি দূরে কোথাও একা থাকব কিছুদিন। আমাকে ছয় মাসের ছুটি দিতে হবে। ভাবছি ইংল্যান্ডে মায়ের কাছে চলে যাব।
মন্ত্রির উদ্বেগ অকৃত্রিম মনে হলো। রোয়েনকে তিনি অনুরোধ করলেন, তবে প্লিজ, আমাদেরকে ছেড়ে বেশিদিন থাকবেন না। আপনাদের গবেষণা অমূল্য অবদান রেখেছে। ডুরেঈদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে হলে আপনার সাহায্য ছাড়া চলবে না। মুখে যাই বলুন, রোয়েনের কথায় তিনি যে স্বস্তি পাচ্ছেন সেটা পুরোপুরি চাপা থাকলো না। তিনি আশা করেছিলেন আজই তাঁর সামনে ডিরেক্টরশিপের জন্য আবেদনপত্র জমা দেবে রোয়েন। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই ভাগ্নে নাহুত গাদ্দাবির সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাঁর। রোয়েন আবেদনপত্র জমা দিলে সান্ত্বনাসূচক কিছু বাণী শুনিয়ে অবশ্যই সেটা বাতিল করা হতো। দু জনেই ওরা জানে ডিরেক্টরের পদটা নাহুত গাদ্দাবিই পেতে যাচ্ছেন।
বিদায় নেওয়ার সময় রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন আতালান, ডেস্কে ঘুরে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এলেন। এলিভেটরে চড়ে নিচে নামার সময় নিজেকে রোয়েনের বন্ধনহীন ও স্বাধীন লাগলো।
রেনোয়া নিয়ে গেট থেকে বেরুতেই কায়রো ট্রাফিক গ্রাস করলো ওকে। অলস পিঁপড়ের মতো এগুচ্ছে গাড়ি, আরোহী উপচে পড়া একটা বাস ওর সামনে, অবিরত নীল ধোয়া ছাড়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রেনোয়া। শহরের ট্রাফিক সমস্যার যেনো কোনো সমাধান নেই। রিয়ার-ভিউ মিররে চোখ রেখে পেছন দিকে তাকালো রোয়েন। ওর ব্যাক বাম্পার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, ওটার পেছনে যানবাহনের ভিড় নিরেট ও সম্পূর্ণ অচল। শুধু মোটর সাইকেল আরোহীরা চলাচলের স্বাধীনতা ভোগ করছে। সেরকম একজনকে আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসতে দেখলো রোয়েন। লাল তোবড়ানো একটা টু হানড্রেড সিসি হোন্ডা, গায়ে এতো ধুলো জমেছে যে রঙটা কোনো রকমে চেনা গেল। ব্যাকসীটে একজন আরোহী বসে আছে, ড্রাইভারের মতো তারও মুখের নিচের অংশ মাথায় জড়ানো কাপড় নামিয়ে আড়াল করা, ধোঁয়া আর ধুলো থেকে রক্ষা পাবার জন্য।
রঙ সাইড দিয়ে ছুটে আসছে মোটরসাইকেল, আসছে ট্যাক্সি আর ফুটপাথ ঘেঁষে পার্ক করা কারগুলোর সরু ফাঁক গলে, ফাঁকটার দু পাশে অতিরিক্ত এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। মোটর সাইকেল আরোহীর উদ্দেশ্যে অশ্লীল একটা ইঙ্গিত করলো ট্যাক্সি ড্রাইভার, তারপর চিৎকার করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, তার এ পাগলামি আর বোকামির জন্য আল্লাহ তাকে অবশ্যই নরকে পাঠাবে।