ডেস্কের উপর বসে দু হাতে মুখ ঢাকল রোয়েন। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ। রীতিমতো ধ্বংসপ্রাপ্ত কক্ষের মধ্যে কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
*
সোমবার সকালের মধ্যে নিজের জীবনে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলো রোয়েন। ফ্ল্যাটে এসে ওর জবানবন্দি নিয়ে গেছে পুলিশ। আবর্জনা ফেলে দিয়ে ঘরগুলো একাই যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়েছে। সাদা রানীর বিচ্ছিন্ন মাথাটা খুঁজে পাবার পর আঠা দিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিয়েছে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সবুজ রেনোয়ায় যখন চড়ল, ডান হাতের ক্ষতটায় প্রায় কোনো ব্যথাই নেই। মনটা খুশি, তা বলা যাবে না। তবে হতাশা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, নিশ্চিতভাবে জানে এখন কী করতে হবে ওকে।
মিউজিয়ামে পৌঁছে প্রথমেই দুরেঈদের অফিসে ঢুকলো রোয়েন। ওর আগেই ওখানে পৌঁছে গেছেন নাহুত গাদ্দাবি, দেখে বিব্রত ও অস্বস্তি বোধ করলো। দু জন সিকিউরিটি গার্ডকে কাজে লাগিয়েছেন নাহুত। তারা ডুরেঈদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব বের করে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ চেপে রেখে রোয়েন শান্ত সুরে বলল, তোমার উচিত ছিল এ কাজটা আমাকে করতে দেওয়া।
অমায়িক হেসে নাহুত বললেন, দুঃখিত, রোয়েন। ভাবলাম আমার সাহায্য পেলে তুমি খুশি হবে। মোটা টার্কিশ চুরুট কুঁকছেন। এ চুরুটের ধোঁয়া আর ঝাঁঝাল গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না রোয়েন।
ডুরেঈদের ডেস্কের পেছনে এসে দাঁড়ালো ও। একটা দেরাজ খুললো। ডুরেঈদের ডে বুকটা এখানে ছিল। এখন দেখছি নেই। তুমি দেখেছ?
না, ওই দেরাজে কিছুই পাওয়া যায় নি। গার্ড দু জনের দিকে তাকালেন নাহুত, যেনো সাক্ষী দিতে বলছেন। ঘাড় ও নাক চুলকে মাথা নাড়লো তারা। রোয়েন জানে, ডে বুকে গুরুত্বপূর্ণ খুব বেশি কিছু ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত তথ্য রেকর্ড ও জমা করার দায়িত্ব রোয়েনের উপর দিয়ে নিশ্চিত ছিলেন ডুরেঈদ। আর রোয়েন সেগুলো যত্নের সঙ্গে ওর পি.সি-তে তুলে রাখত।
ধন্যবাদ, নাহুত, বলল রোয়েন। বাকি যা করার আমি করছি। তোমাকে আর আটকে রাখতে চাই না।
কোনো সাহায্য দরকার হলে বলবে, রোয়েন, প্লিজ। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে সম্মান দেখিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন নাহুত গাদ্দাবি।
ডুরেঈদের অফিস খালি করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বেশিরভাগ আগেই বাক্সে ভরা হয়েছিল, গার্ডদের বলতে তারা সেগুলো রোয়েনের অফিসের ভেতর দেয়াল ঘেঁষে রেখে এলো। লাঞ্চ আওয়ারে নিজের কাজ নিয়ে বসলো রোয়েন, শেষ করার পরও দেখা গেল মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে হাতে এক ঘণ্টা সময় আছে।
ডুরেঈদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা করতে হয়, দীর্ঘ একটা সময় মিউজিয়াম ছেড়ে দূরে থাকতে হবে রোয়েনকে। শ্রদ্ধেয় ফারাও আর পুরা নিদর্শনগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করলো বিশাল বিল্ডিঙের পাবলিক সেকশনে চলে এলো রোয়েন।
সোমবার, কাজেই মিউজিয়ামের এগজিবিশন হলগুলো টুরিস্টে গিজগিজ করছে। তিনতলার কয়েকটা কামরায় রয়েছে তুতেনখামেন ট্রেজার, প্রচণ্ড ভিড়ে ওখানে দু মিনিটের বেশি টিকতে পাল না রোয়েন। অনেক ঠেলাঠেলি করে কোনো রকমে একবার ডিসপ্লে কেবিনেটের সামনে পৌঁছতে পারল, কেবিনেটের ভেতর শিশু ফারাও-এর সোনালি ডেথ-মাস্ক রয়েছে।
ওখান থেকে বেরিয়ে প্রাচীন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলো রোয়েন। তিন হাজার বছর পরও দ্বিতীয় রামেসিসের সরু মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই, দেখে মনে হবে প্রশান্তচিত্তে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তার ত্বকে হালকা চকচকে একটা ভাব আছে, মার্বেলে যেমন দেখা যায়। তাঁর চুল সোনালি, তবে হেনা বা মেহেদি দিয়ে রাঙানো। একই জিনিস দিয়ে রঙ করা হাত লম্বা, সরু এবং সুগঠিত। তবে পরনে শুধু লিনেন-এর তৈরি একটা ফালি। কবর চোররা তাঁর মমির প্যাঁচও খুলে ফেলেছিল, লিনেন ব্যান্ডেজের তলা থেকে মন্ত্রপূত কবচ আর গুবরে পোকা আকৃতির মণি পাবার লোভে, কাজেই তার শরীর প্রায় নগ্নই বলা যায়। আঠারোশো একাশি সালে এলো বাহারির পাহাড় প্রাচীরের একটা গুহায় অন্যান্য রাজার মমির সঙ্গে যখন পাওয়া গেল তাঁকে, শুধু প্যাপিরাস পার্চমেন্টের একটু টুকরো সাঁটা ছিল বুকে, ওই টুকরোটা থেকেই তাঁর বংশধারা সম্পর্কে সব কথা জানা যায়।
বংশধারা উল্লেখ করার মধ্যে এক ধরনের গৌরব তো আছেই, আরো আছে। নীতিবোধ। প্রাচীন যে-কোন মমির সঙ্গে তথ্য ও বার্তা থাকে, সেগুলো কতটুকু সত্য বা অতিরঞ্জিত নয়, সেটাই হলো প্রশ্ন। এ প্রশ্ন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছে ওরা ডুরেঈদ-রোয়েন–লেখক টাইটা সত্যি কথা লিখে গেছে কি? তার বর্ণনামতো সত্যিই কি বহুদূর নির্দয় আফ্রিকান পাহাড়ের গভীরে সমস্ত গুপ্তধন সহ আরেকজন মহান ফারাও নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছেন? চিন্তাটা উত্তেজিত ও রোমাঞ্চিত করে। রোয়েনকে, গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।
তোমাকে কথা দিয়েছি, ডুরেঈদ, ফিসফিস করে আরবিতে বলল রোয়েন, তোমার আমার সুখস্মৃতির উদ্দেশ্যে কাজটা আমি করব।
হাত পনেরো মিনিট সময় থাকতে মিউজিয়ামের মূল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রোয়েন। এক পাশের একটা হলে ঢুকবে ও, টুরিস্ট বা গাইডরা ওদিকে খুব কমই যায়। গেলেও শুধু আমেনহোটেপ-এর মূর্তি দেখতে।