আমি সোমবারে মিউজিয়ামে আসছি, জবাব দিল রোয়েন।
পকেট ডায়েরি বের করে পাতা ওল্টালেন মন্ত্রী, বললেন, তাহলে বিকেল চারটার সময় দেখা করবেন আমার সঙ্গে। বিদায় নিয়ে মার্সিডিজের দিকে এগুলেন তিনি।
এরপর হ্যান্ডশেক করতে এলেন নাহুত গাদ্দাবি। ফ্যাকাসে চামড়ায় অসংখ্য তিল আর চোখের নিচে কফি রঙের দাগ থাকলেও নাহুত যথেষ্ট লম্বা। মাথায় ঢেউ খেলানো চুল, দাঁতগুলো খুব সাদা। দামি স্যুট আর সেন্ট ব্যবহার করেন তিনি। তার বাড়ানো হাতটা দেখতে না পাবার ভান করলো রোয়েন। গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন নাহুত। ভালো মানুষরা তাড়াতাড়ি চলে যায়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। ডুরেঈদকে আমি শ্রদ্ধা করতাম।
মাথা ঝাঁকালো রোয়েন, মুখে কিছু বলল না, জানে ডাহা মিথ্যে কথা কলছেন নাহুত। ডুরেঈদ আর তাঁর ডেপুটির মধ্যে কোনোকালে সদ্ভাব ছিল না। টাইটার স্ক্রোল নিয়ে কতবার কাজ করতে চেয়েছেন নাহুত, কিন্তু দুরেঈদ অনুমতি দেন নি। বিশেষ করে লক্ষ্য রাখতেন, নাহুত যাতে সপ্তম স্ক্রোল ছুঁতে না পারেন।
এ নিয়ে দু জনের মধ্যে কথা কাটাকাটিও হয়েছে কয়েকবার। তুমি বোধহয় ডিরেক্টর পদটার জন্য অ্যাপ্লাই করবে, তাই না, রোয়েন? ওই পদ পাবার যোগ্যতা তোমার আছে।
ধন্যবাদ, নাহুত, ইউ আর ভেরি কাউন্ড। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কিছু ভাবি নি আমি। তবে তুমিও বোধহয় অ্যাপ্লাই করছ, তাই না?
অবশ্যই, নিচু গলায় হেসে উঠে মাথা ঝাঁকালেন নাহুত। কে জানে, তুমি হয়তো আমার নাকের সামনে থেকে পদটা কেড়ে নেবে। তার হাসিতে সংশয় বা উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। আরব সমাজে রোয়েন একটা মেয়ে, তার উপর খ্রিস্টান, আর নাহুত মন্ত্রী মহোদয়ের ভাগ্নে। তিনি জানেন পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণই তাঁর অনুকূলে। বন্ধুরাও পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, আমরাও তাই করব, কী বলো? তুমি আর আমি, আমরা তো পরস্পরের বন্ধুই, তাই না?
হ্যাঁ, ভবিষ্যতে অনেক বন্ধু দরকার হবে আমার, বিড়বিড় করলো রোয়েন।
ডিপার্টমেন্টের কে তোমার বন্ধু নয়? সবাই তোমাকে পছন্দ করে, রোয়েন। নাহুতের অন্তত এ কথাটা সত্যি। তোমাকে আমি লিফট দিতে পারি? আমি জানি মামা আপত্তি করবেন না।
আজই আমি কায়রোয় ফিরছি না, নাহুত, তবু ধন্যবাদ। ডুরেঈদের ব্যক্তিগত কিছু বিষয় দেখাশোনা করতে হবে আমাকে। কথাটা সত্যি নয়। আজ সন্ধ্যের দিকে কায়রোয় ওদের ফ্ল্যাটে ফিরবে রোয়েন। তবে কারণটা নিজেও ভালো জানে না, নাহুতকে ওর প্ল্যান সম্পর্কে জানতে দিতে চাইছে না।
তাহলে সোমবার বিকেলে মিউজিয়ামে আবার দেখা হচ্ছে।
আত্মীয়-স্বজন, পারিবারিক বন্ধু আর গ্রামের কৃষকদের সময় দিতে হলো, সবাই তারা রোয়েনের সঙ্গে দেখা করে শোক প্রকাশ করলো। নিঃসঙ্গ আর অবশ লাগছে নিজেকে, এতো লোকের এতো শোক আর সান্ত্বনা অর্থহীন মনে হলো রোয়েনের। সন্ধ্যের খানিক আগে ডুরেঈদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, মনটা অশান্ত হয়ে আছে। ডান হাতটা সিঙে ঝুলছে, গাড়ি চালাতে তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।
কায়রোর কাছাকাছি এসে ট্রাফিক জামে পড়লো রোয়েন। গির্জা-অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। ডুরেঈদের রেনোয়া আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে রেখে এলিভেটরে চড়ে উঠে এলো টপ ফ্লোরে।
ফ্ল্যাটে ঢুকে দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়ালো রোয়েন। সিটিংরূপ তছনছ করা হয়েছে–এমন কি কাপের্ট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, দেয়াল থেকে নামানো হয়েছে সব কয়টা পেইন্টিং। যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ভাঙাচোরা ফার্নিচার আর ছড়ানো ছিটানো অর্নামেন্টের ভেতর দিয়ে হাঁটছে রোয়েন। প্যাসেজ ধরে এগোবার সময় বেডরুমের ভেতর তাকালো। বেডরুমটাও বাদ দেওয়া হয় নি। ওর আর ডুরেঈদের কাপড়-চোপড় মেঝেতে পড়ে আছে, কাবার্ডের দরজাগুলো খোলা। একটা কাবার্ডের দরজা কজাসহ খুলে ফেলা হয়েছে। বিছানাটা ওল্টানো, চাদর আর বালিশ মেঝেতে পড়ে আছে।
একই অবস্থা বাথরুমের। কসমেটিকস আর পারফিউমের বোতল সব কয়টা ভাঙা। তবে ভেতরে ঢুকলো না রোয়েন, জানে ঢুকলে কী দেখতে পাবে। প্যাসেজ ধরে বড় কামরাটার দিকে এগিয়ে গেল। ওটাই ওরা স্টাডি আর ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করে।
এখানেও সব ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়েছে, তবে প্রথমেই রোয়েনের চোখ পড়লো অ্যান্টিক দাবা সেটটার উপর। ডুরেঈদের দেওয়া উপহার, ওর খুব শখের জিনিস। জেট আর আইভরি দিয়ে তৈরি বোর্ডটা ভেঙে দু টুকরো করা হয়েছে, খুঁটিগুলো অকারণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে কামবার চারদিকে। ঝুঁকে সাদা কুইনটা তুলে নিল রোয়েন। মোচড় দিয়ে রানীর ঘাড় ভাঙা হয়েছে।
অক্ষত হাতে রানীকে নিয়ে রোয়েন যেনো ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। জানালোর নিচে ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। সম্ভবত হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে চুরমার করা হয়েছে ওর পি.সি.। স্ক্রীন ফেটে চৌচির, মেইনফ্রেম চিড়ে-চ্যাপ্টা। দেখেই বোঝা যায়, হার্ড ড্রাইভে কোনো তথ্য নেই। এ কমপিউটার মেরামত করা সম্ভব নয়।
দেরাজগুলো খোলা, ভেতরের সব জিনিস মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তবে ফ্লপি ডিস্কগুলো কোথাও পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না কোনো নোটবুক বা ফটোগ্রাফ। সপ্তম স্ক্রোলের সঙ্গে ওর সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিন বছরের কঠিন পরিশ্রম আর সাধনা সব শেষ। এখন প্রমাণ করাই অসম্ভব যে ওগুলোর অস্তিত্ব ছিল।