Site icon BnBoi.Com

দ্য টাইগার’স প্রে – উইলবার স্মিথ

দ্য টাইগার’স প্রে - উইলবার স্মিথ

দ্য টাইগার’স প্রে

 ১. ডাওজার নামের জাহাজ

দ্য টাইগার’স প্রে – উইলবার স্মিথ / টম হারপার
অনুবাদ: অসীম পিয়াস

উৎসর্গ : বইটি উৎসর্গ করছি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী নিসো-কে, দিন রাত্রির প্রতিটি ক্ষণ যে আমার পৃথিবী আলোকিত করে রেখেছে।

ভাষায় যতোটা প্রকাশ করা সম্ভব, তার চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায়।

.

.

ডাওজার নামের জাহাজটায় বিশাল বিশাল অনেকগুলো পাল। সেই সাথে মালপত্রে বোঝাই। উষ্ণ মৌসুমি বায়ু চাবুকের মতো বাড়ি দিয়ে সমুদ্রের নীল বুকে সফেদ রেখা একে দিয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই, ঝকঝকে। ফলে সূর্য কিরণ পড়ে দাগগুলো ঝিকমিক করে উঠছে। বাতাসে জাহাজের পালগুলো ফুলে আছে, মাস্তুলের সাথের বাঁধনগুলো এতো টানটান হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে এখুনি ছিঁড়ে যাবে। ভারী জাহাজটা ভারত মহাসাগরের ঢেউয়ের তালে একবার উপরে উঠছে আর নামছে। আসলে জাহাজটা প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে।

ডাওজারের মাস্টার জোশিয়াহ ইঞ্চবার্ড জাহাজের পিছনে দাঁড়িয়ে পিছু ধাওয়াকারী জাহাজটার দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের আলো ফোঁটার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে ওটাকে। লম্বা, সরু জাহাজটা একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতোই ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওটার কালো গায়ে লাল রঙ করা কামানের চারকোণা খোপ চিহ্নিত করা। ধীরে ধীরে কমছে জাহাজ দুটোর

ইঞ্চবার্ড মাথার উপরের পালগুলোর দিকে তাকালো। বাতাস একধারে বয়েই চলেছে, পালগুলোও তাই এখনো টানটান হয়ে আছে। এভাবে যদি চলতেই থাকে তাহলে ছিঁড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগবে না, কিন্তু আবার এই ঝুঁকিটা না নিলেও সর্বনাশ হওয়াটা নিশ্চিত।

“মি. ইভান্স,” ফাস্ট মেট-এর দিকে হাক ছাড়লো জোশিয়াহ। “সবাইকে দ্রুত স্টেসেইল (জাহাজের আগা থেকে মাথা পর্যন্ত যে পাল খাটানো হয়) টাঙ্গাতে বলো।”

মিস্টার ইভান্সের বাড়ি ওয়েলশ। বয়শ তিরিশের শেষ দিকে। সে উপরের পালগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। “এই বাতাসের ভিতর স্যার? আর বেশি হলে মাস্তুল ভেঙে যাবে।”

“ঠিক বলেছো মি. ইভান্স, কিন্তু তোমার কাজ আমার কথার উপর কথা বলা না, তোমার কাজ আমার কথা শোনা। গতি আর আধা নট বাড়াতে পারলেও বেঁচে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকবে।”

ইঞ্চবার্ড প্রায় বিশ বছর যাবত এই সাগরে জাহাজ চালাচ্ছে। প্রতি পদে পদে মামা চাচার জোরওয়ালা লোকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজের যোগ্যতায় আজ ও এই অবস্থানে এসেছে। ভারত আর স্পাইস দ্বীপের জঘন্য সব বন্দরের এমন সব অভিযান থেকে ও বেঁচে ফিরে এসেছে যেসব অভিযানে অর্ধেক ক্রু তাদের বিছানাতেই সমাহিত হয়ে আছে। আর এখন, এই মুহূর্তে ও নিজের জাহাজকে বিপদে ফেলতে পারবে না।

“করছেন কি?”

কথাটা বললো একজন মহিলা। স্বরটা শান্ত কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ। পিছন থেকে এসেছে কথাটা। কয়েকজন ক্রু দড়ি বেয়ে মাস্তুলে ওঠা থামিয়ে থমকে গেলো। সাগরের অথৈ জলের মাঝে তিন সপ্তাহ কাটানোর পর একজন মহিলার মুখ দর্শন সত্যিকার অর্থেই বড় মনোরম।

ইঞ্চবার্ড দ্রুত ঠোঁটের আগায় চলে আসা গালিটা আটকালো। “সেনোরা দুয়ার্তে। এসব আপনার ভাবার বিষয় না। আপনি বরং নিচের ডেকে থাকলেই ভালো করবেন।”

দুয়ার্তে উপরের দিকে তাকালো। বাতাসে ওর লম্বা কালো চুল উড়ছে। তার মাঝখানে ওর জলপাই রঙের সুন্দর মুখটা দেখা যাচ্ছে। ও এতোটাই হ্যাংলা যে দেখে মনে হচ্ছে আর একটু জোরে বাতাস দিলেই উড়ে গিয়ে সমুদ্রে পড়বে। কিন্তু নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ইঞ্চবার্ড জানে যে মেয়েটা মোটেও ততোটা দুর্বল নয়।

“অবশ্যই এটা আমার ভাববার বিষয়,” দুয়ার্তে বললো। “জাহাজের কিছু হলে আমরা সবাই-ই মারা পড়বো।”

লোকগুলো তখনও ঝুলতে ঝুলতে ওকে দেখেই চলেছে। ফার্স্ট মেট ইভান্স তা দেখে চেঁচিয়ে উঠলো, “কাজে মন দে সবাই। নইলে হাতের রশি দিয়ে পিটাবো কিন্তু।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার উঠতে শুরু করলো সবাই। ইঞ্চবার্ড টের পেলো, এই মহিলার উপস্থিতি ওর খবরদারি ফলানোতে সমস্যা করছে।

“নিচে যান,” আদেশ দিলো ও। “জলদস্যুরা একটা মেয়েকে ধরতে পারলে কি করবে সেটা কি আমাকে বলে দিতে হবে?”

“সর্বনাশ,” মাস্তুলের মাথায় দাঁড়ানো লোকটা চেঁচিয়ে বললো। “ওরা পতাকা তুলে দিয়েছে। তারপর এতো জোরে যীশুর নাম ধরে ডাক দিলো যে নিচের সবাই শুনতে পেলো।

অবশ্য লোকটা না বললেও চলতো। সবাই দেখতে পেয়েছে ততোক্ষণে ওদের শত্রু জাহাজের মূল মাস্তুল থেকে একটা কালো পতাকা উড়ছে, তার নিচেই উড়ছে আর একটা লাল পতাকা।

এর মানে হচ্ছে, কাউকেই জ্যান্ত ছাড়া হবে না!

*

পতপত করে উড়তে থাকা পতাকা দুটো দেখতে পেয়ে ফাইটিং কক-এর ক্যাপ্টেন জ্যাক লেগ্রাঞ্জের মুখে ক্ষুধার্ত একটা হাসি ফুটে উঠলো। মাদাগাস্কারের উপকূলে প্রথমবার চোখে পড়ার পর থেকেই, গত তিন দিন ধরে ওরা সামনের মার্চেন্টম্যানটা (ব্যবসার উদ্দেশ্যে মালবাহী জাহাজ) ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে। জাহাজটা বন্দর ছাড়তে দেরি করে ফেলেছে, এ কারণে ভারত মহাসাগরের জলদস্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে যে পাহারাদার জাহাজের দলটা আছে সেটার সাথে আসতে পারেনি। রাতে প্রচুর বাতাস হয়েছে, সে কারণে লেগ্রাঞ্জ জাহাজের সবগুলো পালই তুলে দিয়েছে, আশা করছে ওর জাহাজটা সামনের পেটমোটা জাহাজটাকে সহজেই ধরে ফেলতে পারবে। জুয়াটা কাজে লেগেছে বলা যায়, ওরা আর এক কি দেড় লীগ পিছিয়ে আছে মাত্র। আর কিছু পরেই ধরে ফেলবে।

লেগ্রাঞ্জ নিজের জাহাজের দিকে তাকালো এবার। জাহাজটা শুরুতে ব্রিস্টল থেকে দাস আনা নেওয়ার কাজ করতো। পূর্ব আফ্রিকা থেকে আমেরিকার উপনিবেশ আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ সব জায়গাতেই চলাচল ছিলো ওটার। লেগ্রাঞ্জ ছিলো এটার ফাস্ট মেট। কিন্তু একদিন চুরি করতে গিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে ধরা পড়ে যায়। ক্যাপ্টেন ওকে পিটিয়ে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়। পরদিন রাতে, ক্ষতের ব্যান্ডেজের রক্ত শুকানোর আগেই ও ওর পক্ষের নাবিকদের নিয়ে জাহাজ আক্রমণ করে, আর জাহাজ দখল করে ক্যাপ্টেনকে মাস্তুল-এর কাঠে ঝুলিয়ে দেয়। ওরা জাহাজটাকে একটা জনশূন্য খাড়িতে নিয়ে যায়, তারপর জাহাজটার নাবিকদের থাকার জায়গাটা পুরো ভেঙ্গে ফেলে খোলের দুপাশে এক ডজন বন্দুকের খোপ তৈরি করে নেয়। নিজেদের বিনোদনের জন্যে সুন্দর কয়েকটাকে রেখে স্বাস্থ্যবান দাসগুলোকে বেঁচে দেয় ওরা। দুর্বল আর রোগাগুলোকে হাত পা বেঁধে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। জাহাজের যেসব ক্রু ওদের দলে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় ওদেরও একই পরিণতি হয়। জাহাজটা আগে শুধু নামেই যোদ্ধা ছিলো, এখন কাজেও হয়েছে। এখন ওটা এমন এক শিকারি যেটা সাগরের বুকের বড় বড় জাহাজগুলো বাদে আর সবকিছুকেই শিকার করতে পারে।

“বো চেজারটা (জাহাজের সামনে বসানো কামান) থেকে গোলা ছোড়ো,” আদেশ দিলো ও। “পাছায় বাড়ি খেয়ে ওটা আর কদ্দূর যেতে পারে দেখা যাক।”

“আর একটা পালও যদি ভোলা হয়, তাহলে ওদের বড় মাস্তুলটা ভেঙ্গে পড়বে,” পাশ থেকে মেট বললো।

লেগ্রাঞ্জ হাসলো। “একদম ঠিক!”

ওর লোকেরা বো চেজারটায় গোলা ভরতে লাগলো। জাহাজের সামনে পিছনে দুই দিকেই আছে কামান। জাহাজের পাটাতন কিছুটা বাড়িয়ে ওগুলো বসানোর জায়গা করা হয়েছে। বত্রিশ পাউন্ডের গোলা ছুঁড়তে পারে কামানগুলো। গোলন্দাজ লোকটা নিচ থেকে একটা ব্রেজিয়ারে (লোহার পাত্র) কয়লা এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। ওরা জাহাজ আর জাহাজের মালপত্র দুটোই চায় কিন্তু যদি শেষ পর্যন্ত হাত ফসকে যায়, তাহলে লেগ্রাঞ্জ দরকার হলে জাহাজটা পুড়িয়ে দেবে তবুও পালাতে দেবে না।

“ওটার কি হবে ক্যাপ্টেন?” মেট জিজ্ঞেস করলো।

জাহাজের পিছন দিকে বহুদূরে দিগন্তের কাছে আরো একটা জাহাজকে : ঢেউয়ের তালে দুলতে দেখা যাচ্ছে। লেগ্রাঞ্জ নিজের পাই গ্লাসটা সেদিকে তাক করলো। জাহাজটা ছোট, এক মাস্তুলের। রোদে পোড়া খোল। বাতাসের তোড়ে প্রায় উড়ে আসছে, মনে হচ্ছে হুমড়ি খেয়ে উল্টে পড়তে পড়তেও পড়ছে না। ওটার লোকজন সব জাহাজের ডেক-এ জড়ো হয়ে ওদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। একজনের হাতে একটা টেলিস্কোপ দেখা গেলো, ফাইটিং কক-এর দিকে তাক করাপতাকা দেখে সম্ভবত ব্যাটা এতোক্ষণে নিজের পায়জামা ভিজিয়ে ফেলেছে, আর মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছে যে জলদস্যুরা ওদেরকে রেখে আরো দামী একটা জাহাজের পিছু নিয়েছে।

লেগ্রাঞ্জ মুখ টিপে হেসে হাতের টেলিস্কোপটা নামিয়ে রাখলো। “আগে এদের সাথে বোঝাঁপড়াটা করে নেই। তারপর ওটার দিকে নজর দেওয়া যাবে। আপাতত ওটা আমাদের কোনো ঝামেলা করতে পারবে না।”

*

টম কোর্টনী নিজের টেলিস্কোপ নামালো। লাল আর কালো পতাকাওয়ালা জলদস্যুর জাহাজটা দিগন্ত রেখার কাছে ছোট হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায়।

“মার্চেন্টম্যানটা আরো একটা পাল খাটাচ্ছে,” মন্তব্য করলো ও। “এবার সম্ভবত ওরা ওদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে।”

জলদস্যুর জাহাজ থেকে আলো ঝলসে উঠলো। এক সেকেন্ড পরেই ওরা কামানের গোলার পানির উপর আছড়ে পড়ার মৃদু শব্দ শুনতে পেলো।

“এখনো সীমার বাইরে,” টমের পাশের লোকটা বললো। কামানের গোলার আঘাতে মার্চেন্টম্যানটার পিছনের কয়েক ক্যাবল দূরের পানি ছিটকে উঠেছে শুধু। লোকটা টমের চাইতে লম্বা, গা ভর্তি মাংস, নড়লেই কিলবিল করে। তার কালো মুখ ভরা অনেকগুলো কাটা দাগ, উঁচু নিচু হয়ে আছে। আফ্রিকার যে উপজাতিতে ওর জন্য সেটার শাস্ত্রীয় আচারের চিহ্ন ওগুলো। সেই ছোট থেকে লোকটা টমের সাথে আছে-এর আগে ছিলো টমের বাবা হাল-এর সাথে। অথচ ওর কালো শরীরটায় এখনো একটা ভাজ-ও পড়েনি কিংবা একটা চুলেও সামান্য পাক ধরেনি। যদিও মাথা সবসময়েই কামিয়ে রাখে।

“বেশিক্ষণের জন্যে না, আবোলি। এই মোটা শরীর নিয়ে জাহাজটা আর বড়জোর কয়েক নট পর্যন্ত নিরাপদে থাকবে।”

“ওরা আত্মসমর্পণ করলেই বুদ্ধির কাজ করবে। যারা বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তাদেরকে জলদস্যুরা কি করে সেটা তো জানাই আছে।”

টম ওর পিছনদিকে তাকালো। সামনের দিকে টাঙ্গানো শামিয়ানার নিচে দুজন মহিলা বসে আছে। দুজনেই ওদের কথা কান পেতে শুনছে, আর সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করছে না।

“তার মানে আমাদের আসলে মার্চেন্টম্যানটাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই,” অনিশ্চিত স্বরে বললো টম।

আবোলি জানে টমের মাথার ভিতর কি চিন্তা চলছে। “ওদের চল্লিশটা কামান আছে, আর আমাদের বারোটা,” সতর্ক করলো ও। “আর ওদের লোকও কমপক্ষে আমাদের দ্বিগুণ।”

“ওদের সাথে লাগতে যাওয়া চরম বোকামি হবে।”

মহিলাদের দুজনের একজন উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। তার নীল চোখ ঝকঝক করছে। মহিলাকে ঠিক প্রচলিত অর্থে সুন্দরি বলা যাবে : মুখের কাটা বেশি বড়, চোয়াল শক্ত, আর রোদে থাকতে থাকতে মসৃণ চামড়া তামাটে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দেখে ভীষণ রকম প্রাণবন্ত মনে হয়, জীবনে ভরপুর। আশপাশের সবাইও সেই শক্তিতে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। চেহারাটাও দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। ফলে প্রথম দেখাতেই টম ওর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো বলা যায়।

“উজবুকের মতো কথা বোলো না টম কোর্টনী,” ঘোষণা দিলো সে। “তুমি আসলেই ঐ বেচারাদেরকে এই জলদস্যুদের হাতে মরতে ছেড়ে দেবে?” টমের হাত থেকে পাই গ্লাসটা ছিনিয়ে নিতে নিতে বললো ও। তারপর নিজের চোখে দিয়ে বললো, “যদূর জানি ঐ জাহাজে একজন মহিলাও আছে। দস্যুরা জাহাজটা দখল করে ফেললে তার কি অবস্থা হবে জানো না?”

যে লোকটা হাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে টম তার সাথে চোখাচোখি করলো। “তোমার কি মনে হয় ডোরি?”

ডোরিয়ান কোর্টনী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ওরা দুজন ভাই। যদিও খুব কম মানুষই সেটা ধরতে পারে। আরবের মরুভূমিতে থাকতে থাকতে ডোরিয়ানের গায়ের রঙ গাড় বাদামী হয়ে গিয়েছে। মাথায় একটা সবুজ পট্টি বাঁধা। ওর লাল চুলের পুরোটাই তাতে ঢাকা পড়েছে প্রায়। ঢিলেঢালা নাবিকদের পায়জামা পরনে ওর। কোমরে একটা বাকানো ছুরি ঝোলানো।

“আমিও ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারছি না।” হালকা চালেই বললো ডোরি। কিন্তু সবাই জানে ওর কথার পিছনে আসলে কতোটা তিক্ততা লুকিয়ে আছে। মাত্র এগারো বছর বয়সে ওকে দস্যুরা ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। প্রায় দশ বছর খোঁজার পর টম আবার ওকে খুঁজে পায়। সবাই ভেবেছিলো মারা গিয়েছে ও। ডোরিয়ানকে কিনেছিলো মাস্কটের এক হিতৈষী রাজকুমার। ও তার বাড়ির একজন প্রহরী হিসেবে কাজ শুরু করে। পূর্ব আফ্রিকার মরুভূমিতে আবার যখন ওদের দেখা হয় তখন টম ওকে চিনতেই পারেনি। বলা যায়, মাত্র এক চুলের জন্যে ওরা একজন আর একজনকে খুন করে ফেলেনি সেবার।

“ব্যাপারটা মোটেও সহজ হবে না ক্লিবি,” আবোলি সতর্ক করলো। টমকে ও ক্লিবি নামে ডাকে; ওর মাতৃভাষায় এর মানে হচ্ছে বাজপাখি। দাস ব্যবসায়ীদেরকে আবোলি ভয়াবহ মাত্রায় ঘৃণা করে। ও আফ্রিকার লোজি উপজাতিদের একজন। ওর দুজন স্ত্রী-জিতি আর ফাল্লা। তাদের গর্ভে ওর ছয়টা বাচ্চা জন্ম নেয়। একবার ব্যবসার কাজে আবোলি অনেক দূরে গিয়েছিলো। সেই ফাঁকে আরব দাস ব্যবসায়ীরা গ্রামে আক্রমণ করে ওখানকার লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তার মাঝে জিতি, ফাল্লা আর আবোলির বড় দুই ছেলে-ও ছিলো। বাকি বাচ্চাদেরকে মেরে রেখে যায়। আবোলির ছোট ছোট চারটা ছেলেমেয়েকে গাছের গুঁড়ির সাথে আছাড় মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কারণ ওরা এতো ছোট ছিলো যে ওদেরকে পূর্ব তীরের দাস বাণিজ্যের এলাকায় জোর করে নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ হতো না।

টম আর আবোলি পুরো আফ্রিকা জুড়ে দস্যুগুলোকে খুঁজে খুঁজে মেরেছে। ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছেও হাল ছাড়েনি। এর মধ্যেই জিতি, ফাল্লা আর ওদের জীবিত দুই ছেলেকে মুক্ত করে ওরা। আর দাস ব্যবসায়ীদের উপর চরম প্রতিশোধ নেয়। ছেলে দুটো, মানে যামা আর তুলা এখন প্রায় তরুণ। আবোলি ইদানীং ওদের মুখেও ঐ শাস্ত্রীয় চিহ্ন দেওয়ার কথা ভাবছে। টম জানে ওরাও চিহ্নটা অর্জন করার জন্যে অধীর হয়ে আছে।

“জাহাজটা তো পুরো বোঝাই হয়ে আছে, ডোরিয়ান বললো। মনে হলো যেনো এইমাত্র ব্যাপারটা টের পেয়েছে ও। “মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে একেবারে মোক্ষম জিনিস।”

আবোলি এর মধ্যেই ওর পিস্তল প্রস্তুত করা শুরু করেছে। “তোমার বাবা কি বলতেন জানো নিশ্চয়ই।”

“সবারই উপকার করো, কিন্তু করা শেষে নিজের ফী-টা নিতে ভুলো না।” টম হেসে বললো। “সে যা-ই হোক, কিন্তু মেয়েমানুষ সাথে থাকলে কোনো ঝামেলায় জড়ানো আমার ঠিক পছন্দ না।”

সারাহ ডেকের নিচে গায়েব হয়ে গেলো। একটু পরেই ফিরে এলো একটা সোনালি হাতলওয়ালা তরবারি হাতে করে। হাতলের মাথায় একটা নীলকান্ত মণি ঝিকমিক করছে।

“তুমি কি যাবে টম কোর্টনী? নাকি আমাকেই করতে হবে কাজটা?” জানতে চাইলো ও।

সাগর জুড়ে আরো একটা গোলার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো। এবার অবশ্য মার্চেন্টম্যানটা থেকে কয়েক টুকরো কাঠ উড়ে যেতে দেখা গেলো।

‘হায় খোদা, মিসেস কোর্টনী, আমারতো মনে হয় এমনকি দস্যুরাও তোমার কথা অমান্য করার চাইতে বরং মুঘল সাম্রাজ্যের গুপ্তধনে ভরা ঐ জাহাজটাকে ছেড়ে দেওয়াই বেশি পছন্দ করবে। তুমি কি বলল, ইয়াসমিনি?” শেষের কথাটা ও বললো সারাহের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরি আরব মেয়েটাকে। ও হচ্ছে ডোরিয়ানের স্ত্রী, পরনে একদম ছিমছাম একটা পোশাক, মাথায় একটা সাদা ওড়না।

“একজন ভালো স্ত্রী সর্বাবস্থায় তার স্বামীকে মান্য করে,” বিনয়ী কণ্ঠে বললো ও। “আমি আমার ওষুধের বাক্সটা গুছিয়ে নিচ্ছি। সন্দেহ নেই আপনাদের কাজ শেষ হওয়ার আগেই আমার কাজ শুরু হয়ে যাবে।”

টম নীল তরবারিটা কোমরে গুঁজে নিলো। ওটার নাম নেপচুন। একসময় তরবারিটা ছিলো ওর বাবার, তার আগে ওর দাদার। তবে এটার প্রথম মালিক ছিলো ওর পরদাদা চার্লস কোর্টনি। স্পেনের র‍্যাঞ্চেরিয়া জয়ের পর স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক তাকে এটা উপহার দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে তরবারিটা পাওয়ার কারণে টম এখন টেম্পল অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য হলি গ্রেইল-এর একজন নাইট নটোনিয়ার। ওর উত্তরসূরিদের মতোই ও এটা দিয়ে অসংখ্য লোককে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। তবে সেসব মৃত্যু ওদের পাওনা ছিলো। তরবারিটা একেবারে খাঁটি টোলেডো ইস্পাতের তৈরি, আর হাতলের নীলাটার জন্যে ফলার ওজনটাও চমৎকারভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।

টম খাপ থেকে তরবারিটা বের করলো, সূর্যের আলো ওটায় প্রতিফলিত হতে ওর চেহারাও আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।

“কামানগুলো রেডি করে ফেলো আবোলি। দুটো করে তিতির পাখি মারো ওদের দিকে।” তিতির পাখি হলো ছোট ছোট সীসার বল ভরা গোলা। মেঘের মতো ওগুলো ভেসে যায়, আর সামনে যেটা-ই পড়ে সেটা ধ্বংস করে ছাড়ে। “মি. উইলসন, বাতাসের দিকে আরো তিন পয়েন্ট ঘুরিয়ে দিন জাহাজের মুখ।”

*

দস্যুদের বো চেজার আবারও গর্জে উঠলো। একটা গোলা অনেক দূরে গিয়ে পড়লো, আর একটা পিছনদিকের একটা তক্তা ভেঙ্গে বেরিয়ে গেলো, টুকরো কাঠের গুঁড়োয় ভরে গেলো আশপাশ। ইঞ্চবার্ডের গালেও একটা টুকরো এসে লাগলো, উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো সেখান দিয়ে।

দস্যুরা ওদের জাহাজের দিকে পরিবর্তন করে এমনভাবে বাকিয়ে নিলো যাতে ডাজারের সবগুলো মাস্তুল এক সারিতে চলে আসে। ঠিক নাইনপিন খেলার মতো।

“অতো দূর থেকে লাগানো সহজ হবে না,” শান্ত কণ্ঠে বললো মেট।

ওদের ধারণা ভুল প্রমাণ করতে ঠিক সাথে সাথেই উপর থেকে মড়াত করে একটা শব্দ ভেসে এলো। সবার চোখ ঘুরে গেলো উপর দিকে-দেখতে পেলো একগাদা কাঠ আর ক্যানভাসের কাপড় ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। সবাই লাফিয়ে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করলোর কয়েকজন নড়তে দেরি করে ফেললো। হাল ধরে ছিলো যে লোকটা তার ঠিক চাদি বরাবর পড়লো মাস্তুল, মুহূর্তে ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে গেলো মাথাটা। বাতাসের উল্টো দিকে ঘুরে গেলো জাহাজ। আর পালটা মৃত লোকটার উপর কাফনের কাপড়ের মতো করে ঢেকে গেলো।

“কেটে দাও ওটা,” চেঁচিয়ে বললো ইঞ্চবার্ড। “হুইলটাকে মুক্ত রাখতে হবে।” লোকজন কুড়াল হাতে ছুটে গিয়ে মাস্তুলের গোড়াটা কাটা শুরু করলো।

আর একটা গোলা ছোঁড়ার শব্দে ওর কথা চাপা পড়ে গেলো। ওর মুখের মাত্র এক ফুট দূর দিয়ে উড়ে গেলো কামানের গোলাটা। ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পাটাতনের উপর পড়ে গেলো ইঞ্চবার্ড। জাহাজটা এখন একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। জাহাজের খোলটা কেঁপে উঠলো আবার। আরও একটা মাস্তুল ফাটার আওয়াজ পাওয়া গেলো। জুরা পাল-টাকে সরিয়ে ফেলেছে ততোক্ষণে। সদ্য মৃত লোকটার রক্তে লাল হয়ে আছে ওটা। নিচেই দেখা গুলো হুইলটাও টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে, মাস্তুলটা ঠিক ওটার উপরেই পড়েছিলো। আবার একটা বসাতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। আর ওদের হাতে মোটেও অতোটা সময় নেই।

এদিকে দস্যুদের জাহাজটা ক্রমেই কাছিয়ে আসছে, আর কিছুক্ষণের মাঝেই পাশাপাশি চলে আসবে। ইঞ্চবার্ড ওটার ডেক-এর লোকজনগুলোকেও দেখতে পাচ্ছে এখন। কয়েকজন তাদের হাতের তরবারি নেড়ে উল্লাস করছে, বাকিদের হাতেও ভয়ালদর্শন লম্বা তরবারি।

ইঞ্চবার্ড দাঁতে দাঁত পিষলো। “জাহাজে কাউকে উঠতে দেবে না।”

*

ফাইটিং ককের হালী ওটাকে ডাওজারের পাশাপাশি নিয়ে এলো। তারপর মাস্তুলের উপরের লোকেরা পাল গুটিয়ে নিলো, আর বাকি দস্যুরা জাহাজের কিনারের কাঠের উপর উঠে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। ওদের লাফঝাপের চোটে জাহাজ দুটো একটা আর একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে দুলতে লাগলো। এখন ওদের মাঝে ব্যবধান মাত্র কয়েক ফুট পানি।

লেগ্রাঞ্জ লাফ দিয়ে রেইলের উপর উঠে দাঁড়ালো। পানির মতোই সহজে হয়ে গেলো কাজটা, সন্তুষ্টচিত্তে ভাবলো ও। মার্চেন্টম্যানের ডেক-এ তাকিয়ে দেখে ওখানে কেউ নেই। কু-রা নিশ্চয়ই ডেক-এর নিচে, পাগলের মতো নিজেদের মূল্যবান সম্পদ লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। খামাখা কষ্ট করছে : কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা কান্নাকাটি করতে করতে জীবন ভিক্ষা দেওয়ার জন্যে অনুনয় করতে থাকবে, আর কোথায় কি রেখেছে সেসবও সুড়সুড় করে বলে দেবে।

ও কথা বলার জন্যে মুখের সামনে চোঙ্গাটা তুললো। “পতাকা নামিয়ে নাও আর অতিথিদের বরণ করার জন্যে প্রস্তুত হও।”

ওর লোকেরা উল্লাস করে উঠলো। লেগ্রাঞ্জ জাহাজের কামানগুলোর দিকে তাকালো। ওগুলোর একটাতেও কোনো গোলন্দাজ নেই। কক-এর কামানের বহরে এগুলো সংযুক্ত হবে এখন। অথবা ও ডাওজারকেই কিছুটা সংস্কার করে নিজের জাহাজের বহরে যোগ করে নিতে পারবে। দুটো জাহাজ পেলে পুরো সমুদ্রটাই ওর হয়ে যাবে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই নেকড়ের মতো ধূর্ত একটা হাসি ফুটলো ওর মুখে।

চোখের কোণে রঙিন কিছু একটা ধরা পড়লো ওর : একটা কমলা আভা, যেন একটা কামানের গোড়ার কাছে কোনো ধাতুর উপর সূর্যের আলো পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। ও গলা বাড়িয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করলো। ওটা সূর্যের আলো না। ওটা আসলে কামানের সলতেতে লাগানো আগুন, ধীরে ধীরে সেটা গোলার দিকে এগিয়ে চলেছে। দ্রুত বাকি কামানগুলোকে পরীক্ষা করতেই ওর রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। প্রতিটা কামানেই গোলা ভরা, আর সলতেতে আগুন লাগিয়ে ঠিক ওদের দিকেই তাক করে রাখা হয়েছে।

“মাথা নামাও সবাই,” চিৎকার করে উঠলো ও। গোলন্দাজবিহীন কামানগুলো থেকে একেবারে পয়েন্ট ব্লাংক থেকে কয়েকটা গোলা ছুটে গেলো। গোলার সাথে পেরেক ভরে দেওয়া হয়েছে। গোলাটা সোজা জাহাজের একটা পাশকে পুরো চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলো। একদম সামনে যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিলো তারা একেবারে কিমা কিমা হয়ে গেলো বলা যায়, রক্তের হোলি খেলা হলো যেন ওখানে। তাদের পিছনে যারা ছিলো তারাও প্লিন্টারের আঘাতে মারাত্মক আহত হলো। কয়েকটা মুহূর্ত নিঃসীম নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলো, কিন্তু তারপরেই ডাওজারের লোকেরা হারে রে রে করতে করতে মাস্কেট আর পিস্তল হাতে দৌড়ে আসতেই আবার আকাশ বাতাস চিৎকার আর গুলির আওয়াজে ভরে উঠলো। ওরা লাফিয়ে কক-এর ডেক-এ উঠে এসে যারা তখনও বেঁচে ছিলো তাদেরকে গুলি করে মারতে লাগলো। কম আহতেরা পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবার গুলি খেয়ে শুয়ে গেলো। জাহাজ দুটো দূরে সরে যেতে শুরু করতেই ডাওজারের লোকজন উল্লাস করে উঠলো।

লেগ্রাঞ্জের শিকার হাত ফসকে যাচ্ছে। কিন্তু ফাইটিং কক-এ প্রায় দুইশ লোক আছে; আর ডাওজারে সর্বোচ্চ হলে একশোর কাছাকাছি লোক হবে। ফলে এতো ক্ষয় ক্ষতির পরেও দস্যুরা এখনো সংখ্যায় বেশি। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যে ওদের দরকার শুধু সাহস।

প্রচণ্ড আক্রোশে চিৎকার করে উঠে লেগ্রাঞ্জ একটা দুলতে থাকা রশি পাকড়ে নিজের কোমরে বেঁধে নিলো, তারপর মুক্ত হাতটায় একটা পিস্তল তুলে নিয়ে আবার রেইলের উপর উঠে দাঁড়ালো।

“কাউকে জ্যান্ত ছাড়বো না,” গর্জে উঠলো ও। তারপর দড়িতে ঝুলে ধোঁয়ার ভিতর দিয়েই ডাওজারের ডেক-এ গিয়ে নামলো। একজন নাবিক ওকে দেখতে পেলো, কিন্তু হাতের মাস্কেটের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় সে একটা তরবারি তুলে নিতে গেলো। লেগ্রাঞ্জ একেবারে মুখে গুলি করে শুইয়ে দিলো তাকে। তারপর পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে কোমর থেকে আর একটা তুলে নিলো। আর একটা নাবিক ওর সামনে পড়ে গেলো, লেগ্রাঞ্জ ওকেও গুলি করলো, তারপর নিজের তরবারি বের করলো।

একটু পরেই ডাওজারের ডেক জুড়ে লোহার ঝনঝনানি আর খালি পায়ের ধুপধাপ শব্দ শোনা যেতে লাগলো, কারণ লেগ্রাঞ্জের সাঙাতেরাও ওকে অনুসরণ করে এটায় এসে নামতে শুরু করেছে। প্রায় প্রত্যেকের গায়েই মৃত সঙ্গীদের রক্ত আর মাংস মেখে আছে, প্রথমেই ওরা হাত দিয়ে নাড়িয়ে ধোয়াটা পরিষ্কার করে নিলো। ডাওজারের লোকজন মুহূর্তের মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়লো। এতো কিছুর পরেও দস্যুরা ওদের চাইতে সংখ্যায় এখনো অনেক বেশি। আর এই মুহূর্তে দস্যুরা সবাই একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্যে মারাত্মক ক্ষেপে আছে। একে একে ডাওজারের প্রায় সবগুলো ক্রু-কে হত্যা করা হলো। শুধু কয়েকজনকে জাহাজের লেজের কাছের হাত পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো।

লড়াই শেষ হয়েছে বোঝমাত্র কয়েকজন দস্যু ছুটে গেলো লুট শুরু করতে। বাকিরা ডাওজারের যে কয়জন জীবিত আছে তাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের তরবারি দিয়ে মাঝে মাঝে খোঁচা দিতে লাগলো, কিন্তু মেরে ফেলার কোনো চেষ্টা করলো না। কারণ ওরা জানে যে ওদের ক্যাপ্টেন এতে তাড়াতাড়ি সব শেষ করতে চাইবে না। ওদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে এরা যা করেছে সেটার প্রতিশোধ নিতে হবে ধীরে ধীরে।

লেগ্রাঞ্জ ধীর পায়ে লাশগুলোর ফাঁক দিয়ে, রক্তে ভেজা ডেক ধরে এগিয়ে এলো। “তোদের মধ্যে ক্যাপ্টেন কে?” জানতে চাইলো ও।

ইঞ্চবার্ড লেংচে লেংচে সামনে এগিয়ে এলো। হাতের একটা কাটা থেকে রক্ত ঝরে ওর জামা লাল হয়ে আছে। “জোসিয়াহ ইঞ্চবার্ড, আমিই মাস্টার।”

লেগ্রাঞ্জ ওর ঘাড় ধরে সামনে টেনে এনে ধাক্কা দিয়ে ডেক-এ ফেলে দিলো। “আত্মসমর্পণ করলি না কেননা?” হিসহিসিয়ে উঠলো ও। “আমাদের সাথে লড়াই করিস, কতো বড় সাহস তোর!”

লেগ্রাঞ্জ কোমর থেকে একটা ছুরি বের করে ইঞ্চবার্ডের গালে চেপে ধরলো। আমি তোর জ্যান্ত চামড়া ছাড়িয়ে নেবো, তারপর তোর সামনে তোর নাড়িভুড়ি কেটে হাঙ্গরকে খেতে দেবো।”

পাশের লোকগুলো সব হেসে উঠলো। ইঞ্চবার্ড কাঁপতে কাঁপতে অনুনয় করতে লাগলো।

“আমরা মাদ্রাজ থেকে মশলা আর সুতি কাপড় নিয়ে এসেছি, সব জাহাজের খোলে আছে। আর বাইরে আছে মরিচ। সব নিয়ে নিন।”

লেগ্রাঞ্জ ওর দিকে মুখ এগিয়ে নিলো। “তাতো নেবোই। আমি তোর জাহাজের প্রতিটা তক্তা, প্রতিটা পেরেক খুলে ফেলবো। তারপর প্রতিটা লুকানো পয়সা পর্যন্ত খুঁজে বের করবো। কিন্তু সেজন্যে আমি তোকে কিছু করবো না, তুই শাস্তি পাবি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্যে, আমার লোকেদের যা করেছিস সেটার জন্যে।”

নিচে নামার সিঁড়ির মুখে একটা ধ্বস্তাধস্তির আওয়াজ হলো। লেগ্রাঞ্জ ঘুরে সেদিকে তাকাতেই দেখে ওর দুজন লোক এক বন্দিকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে। আসছে। বন্দিটা একজন মহিলা, সেটা চোখে পড়তেই সবাই শিষ দিয়ে উঠলো। মহিলার শরীরের উর্ধাংশের কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, হাত দিয়ে নিজের গলা আর বুক ঢেকে রেখেছে সে। লোক দুটো মহিলাটাকে ধাক্কা দিয়ে লেগ্রাঞ্জের সামনে ফেলে দিলো।

“ক্যাপ্টেনের কেবিনে পেয়েছি একে। এগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলো।” একজন দস্যু নিজের মুঠি খুলতেই একগাদা সোনার মুদ্রা গড়িয়ে পড়লো। বাকিরা তা দেকেহ আবারও শিষ দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করলো।

লেগ্রাঞ্জ মেয়েটার থুতনির নিচে হাত দিয়ে জোর করে ওর মুখটা নিজের দিকে ফেরালো। মেয়েটা কালো নিষ্কল্প চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে, চোখের মণিতে অপরিসীম ঘৃণা, অনুগ্রহ ভিক্ষার কোনো চিহ্ন সেখানে নেই।

“ব্রেজিয়ারটা নিয়ে এসো,” আদেশ দিলো লেগ্রাঞ্জ। তারপর চুল ধরে টেনে মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে আচমকা প্রচণ্ড জোরে দিলো একটা ধাক্কা। মেয়েটা পিছন দিকে সরে গিয়ে একটা রশিতে বেঁধে উল্টে পড়ে গেলো। পড়ে গিয়ে নড়ার আগেই চারজন দস্যু এগিয়ে গেলো ওর দিকে, তারপর ওর চার হাত পা চারদিকে টেনে ডেক-এর সাথে চেপে ধরে রাখলো।

লেগ্রাঞ্জ এগিয়ে গেলো ওর দিকে। তারপর হাতের ছুরি দিয়ে মেয়েটার স্কার্টের খানিকটা কেটে দিতেই ওর লোকেরা মেয়েটার দুই পা দুদিকে টেনে ধরলো। মেয়েটা মোচড়া মুচড়ি করতে লাগলো কিন্তু লোকগুলো শক্ত হাতে ওকে ধরে রাখলো। লেগ্রাঞ্জ স্কার্টের আরো খানিকটা উপরে তুললো, মেয়েটার মসৃণ উরু বের হয়ে গেলো তাতে। লোকজন অশ্লীল শব্দ করতে লাগলো।

লেগ্রাঞ্জ ইঞ্চবার্ডের দিকে তাকালো। “এ কি তোর বৌ? নাকি বেশ্যা?”

“একজন যাত্রী,” দাঁতে দাঁত চেপে বললো ইঞ্চবার্ড। ওনাকে ছেড়ে দিন হুজুর।”

“সেটা নির্ভর করবে ও আমাকে কেমন মজা দেয় তার উপর।”

দুজন লোক একটা লোহার তেপায়ার উপর একটা ব্রেজিয়ার নিয়ে এলো। ভিতরে কয়লা সামান্য আভায় জ্বলছে। লেগ্রাঞ্জ ওগুলোকে নিজের তরবারি দিয়ে নাড়তে লাগলো। একটু পরেই তরবারির ডগাটা গনগনে লাল হয়ে গেলো। তারপর ধোঁয়া ওঠা তরবারিটা তুলে এনে মেয়েটার উপর ধরে রাখলো। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালো আবার। এখন আর সেখানে কোনো প্রতিরোধ নেই, আছে নিখাদ আতংক।

লেগ্রাঞ্জের ঠোঁটে একটা চিকন হাসি দেখা গেলো। ও তরবারিটা ঠিক মেয়েটার উরুর সংযোগস্থলের কাছাকাছি নামিয়ে আনলো। শরীরের মাত্র কয়েক ইঞ্চি উপরে হবে। মেয়েটা এক ফোঁটা নাড়াচাড়া করছে না। তরবারির ছোঁয়া লাগার ভয়ে মোচড়ামুচড়ি দূরে থাক যেনো নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছে। তরবারিটা থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে।

লেগ্রাঞ্জ তরবারিটা আরো খানিকটা নামানো শুরু করতেই মেয়েটা আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ছিলো ধোঁকাবাজি। এখন তরবারিটা মাত্র এক চুল উপরে বলা যায়। লেগ্রাঞ্জ হেসে উঠলো। ওর অত্যাচারে দাসী মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকে অনেক দিন ও এরকম মজা করার সুযোগ পায় না।

“সব নিয়ে নিন,” অনুনয় করলো মেয়েটা। “জাহাজ, স্বর্ণ, যা ইচ্ছা নিয়ে নিন।”

“নেবো,” লেগ্রাঞ্জ কথা দিলো। “কিন্তু তার আগে একটু মজা না করলে হয়!” তরবারির মাথাটা ততোক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। ও আবার সেটাকে ব্রেজিয়ারে ঠেসে দিলো। এবার আগের চাইতেও গরম হলে তারপর বের করে মেয়েটার চোখের সামনে ধরে রাখলো। মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। “দেখতে পাচ্ছিস এটা? এটায় তুই মরবি না। কিন্তু আমি তোকে এমন শিক্ষা দেবো যা তুই কোনোদিন কল্পনাও করিসনি।”

“নরকের কীট, তুই নরকেই যা,” হিসিয়ে উঠলো মেয়েটা।

ওর কথা লেগ্রাঞ্জকে বরং আরো বেশি উসকে দিলো। ওর এরকম তেজী মেয়েই পছন্দ-যখন শেষ পর্যন্ত ও হাল ছেড়ে দেবে তখনকার তৃপ্তির সাথে আর কিছুর তুলনা হয় না। ও নিজের ঠোঁট চাটতেই রক্তের স্বাদ পেলো। নিচের তলা থেকে চিৎকার আর হাতাহাতির আওয়াজ শোনা গেলো, কিন্তু লেগ্রাঞ্জ তখন এই খেলায় এতো বেশি মজে ছিলো যে অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসত ছিলো না। ভাবলো ওর লোকেরা হয়তো লুটের মাল নিয়ে ঝগড়া করছে। ওদেরকে পরে সামলানো যাবে।

ও নিজের খালি হাতটা দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে নরম সুরে বললো, “তোকে আমি একটু একটু করে পোড়াবো, বুঝলি মাগী? পুরো শরীরে হ্যাঁকা দেবো। তারপর তোকে ভোগ করে আমার লোকেদের মাঝে ছেড়ে দেবো। ওরা তোকে নিয়ে তখন যা ইচ্ছে করবে।”

*

“দাঁড় ওঠাও,” শান্ত স্বরে আদেশ দিলো টম। সেন্টারাসের ডিঙ্গি নৌকাটা দস্যুদের জাহাজের কালো শরীরের নিচে আসতেই আটটা দাঁড়ের সবগুলো উঠে গেলো নৌকার ভিতরে। টম আস্তে নৌকার হাল ঘুরিয়ে দিলো। ও একবারের জন্যেও উপরে তাকালো না। সমস্ত মনোযোগ নিপে নৌকাটা জাহাজের সমান্তরালে নিয়ে আসা। নৌকার সামনে বসে আবোলি আর ডোরিয়ান ফাইটিং কক-এর ডেক-এর দিকে নিজেদের মাস্কেট তাক করে রেখেছে। কিনার থেকে দেখা গেলো একটা কামান বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাক করে আছে। যদি দস্যুদের জাহাজে একজন দস্যুও থেকে থাকে, তাহলে সে এটা দিয়ে নৌকার সবাইকে ভর্তা বানিয়ে ফেলতে পারবে।

টম ঘাড় ঘুরিয়ে সেন্টারাস-এর দিকে তাকালো। এখান থেকে আধা মাইলটাক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দস্যুরা ওটাকে খেয়াল করেনি করলেও এখন লুটতরাজ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত যে ওটার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সারাহ আর ইয়াসমিনির সাথে মাত্র দুজন লোককে রেখে এসেছে ও। ওরা যদি এখানে ব্যর্থ হয়, তাহলে মেয়ে দুটোর কপালে শনি আছে। ও জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিলো।

ডিঙ্গি নৌকাটার গলুই দস্যুদের জাহাজের গায়ে ঘষা খেলো। হালকা খসখস শব্দ হলো শুধু। আবোলি জাহাজে ওঠার সিঁড়িটা আঁকড়ে ধরে উপরের দিকে ইশারা করলো। টম মাথা নেড়ে জানালো যে কেউ নেই। পানির কাছাকাছি জাহজের খোলে একসারি খুপরি দেখা গেল। কামানের খোপ হিসেবে খুব নিচু ওগুলো। টম বুঝলো ওগুলো সম্ভবত বাতাস চলাচলের জন্যে বানানো হয়েছে। জাহজটা যখন দাস আনা নেওয়া করতো তখন কাজে লাগতো।

টম বেল্ট থেকে নিজের ছুরিটা খুলে নিয়ে হাতের কাছের খুপরিটার জোড়া লাগানো জায়গাটায় ঢুকিয়ে চাড় দিলো। যখন দাসেরা এখানে থাকতো তখন এটাকে ভিতর থেকে হুড়কো টেনে বন্ধ করে দেয়া হতো। কিন্তু দস্যুদের এসব ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওর ছুরির ফলা ভিতরের হুড়কোয় স্পর্শ করলো। ও ছুরিটা উপর দিকে চাড় দিলো।

হুড়কো খুলে পড়ে গেলো। খুপরিটা খুলে ভিতরের আলো আধারিতে উঁকি দিলো টম। কেউ ওর দিকে তেড়ে এলো না। আবোলি নৌকাটা স্থির করে ধরে রাখলো, আর ও দেহটা বাকিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। বাকিরাও অস্ত্র হাতে ওর পিছু নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। আবোলির অবশ্য ওর দশাসই শরীরটা নিয়ে ঐ ছোট ফুটো দিয়ে ঢুকতে কষ্ট হলো।

খোলটা একেবারে জিনিসপত্রে ঠাসা আর বদ্ধ। টম প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে আগালো, কিন্তু তবুও মাথা উপরের কাঠে ঠুকে গেলো। দস্যুদের লুট করা মালামালের ভিতর দিয়ে আগাতে লাগলো ও। আলো বলতে উপরের কাঠের ফাঁক গলে যেটুকু আসছে সেটুকুই। সেন্টারাসের বাকি লোকজন আর আবালি আর ডোরিও আছে পিছনেই। বাকিদের মধ্যে আছে আলফ উইলসন, টমের বাবার সাথেও জাহাজ চালিয়েছে সে; আবোলির দুই ছেলে, যামা আর তুলা। অন্ধকারে ওদের চোখ জ্বলজ্বল করছে, জাহাজটার দাস ব্যবসা সংক্রান্ত অতীত বুঝতে পেরে ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে। ওরা প্রত্যেকেই জানে যে অন্য কোনো পরিস্থিতিতে এখানে আসলে হয়তো ওরা কাঠের ভিতর থেকে মুখব্যাদান করে থাকা এই লোহার কড়াগুলোর সাথে বাধা থাকতো, তারপর সমুদ্রের ওপারে আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ানে পশুর মতো বিক্রি হয়ে যেতো; তবে সেটাও নির্ভর করছে যদি শেষ পর্যন্ত ওরা এই খুপরির ভিতর বেঁচে থাকতে পারে, তবেই। ওদের মনে হতে লাগলো এই তক্তাগুলো থেকে যেনো বাতাসে সেই অভাগা লোকগুলোর দুর্দশা আর কষ্টের কান্না আর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে।

টম মই বেয়ে উঠে সাবধানে মাথা তুললো উপরে। ও যেখানে মাথা তুলেছে সেটা জাহাজের কোয়ার্টারডেক, একেবারে পিছনের মাস্তুলের কাছেই। সামনে গনগনে সূর্যের নিচে শুধু মানুষের লাশ ইতস্তত পড়ে আছে। জ্যান্ত সবাই ডাওজারে গিয়েছে, সেটা লুট করতে। টম পিছনের সবাইকে হাতের ইশারা করলো উপরে উঠে আসতে। ও লম্বা একটা কামানের দিকে ইঙ্গিত করলো। ওটার নল সোজা ডাওজারের খোলের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে।

ও দ্রুত আদেশ দিলো, “ওটা টেনে আনো ভিতরে।”

যামা আর তুলা ঝটপট কামানটা যে দড়ি দিয়ে জাহাজের সাথে বাঁধা সেটা টেনে ধরলো। আলফ উইলসন আর অন্য লোকটাও যোগ দিলো ওদের সাথে। সবাই একসাথে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো ওটা। ঘড় ঘড় করতে করতে কামানটা নিজের জায়গায় ফিরে আসতেই খোপটা দিয়ে আলো প্রবেশ করতে লাগলো। সেদিকে দিয়ে নিজের মাথা বের করে দিলো টম। দুটো জাহাজই একসাথে চলছে এখন। কিছুক্ষণ পরপর দুটোর খোল বাড়ি খাচ্ছে পরম্পর। আর দুটোর ফাঁকে এক চিলতে পানি ঝিকমিক করছে।

ও নিজের বেল্ট খুলে ফেললো। “আমাকে ধরো, আবোলি।”

আবোলি ওর পা ধরে রাখলো, আর ও কামানের খোপটা দিয়ে শরীর বাকিয়ে মুচড়িয়ে ডাওজারের গা স্পর্শ করলো। কিন্তু ডাওজারের গায়ে কোনো কামানের খোপ নেই। তবে টম জাহাজের লেজের দিকের জানালাগুলো হাতে পেলো, ঠিক ক্যাপ্টেনের কেবিনের জানালা ছিল ওটা। জানালার কাঁচের ওপাশে কয়েকটা অবয়ব নাড়াচাড়া করতে দেখা গেলো, বোঝা যাচ্ছে যে ভিতরে কোনো দামী জিনিস লুকানো আছে কিনা সেটা খুঁজতে পুরো কেবিনটায় তাণ্ডব চালাচ্ছে। টম সাথে সাথে জমে গেল জায়গায়, কিন্তু ওরা নিজেদের কাজে এতো বেশি মগ্ন হয়ে ছিলো যে, দুই জাহাজের মাঝখানের এই গাঢ় অন্ধকারে ওর উপস্থিতি টের পেলো না।

“ধরো দেখি এটা,” একজন ডাক দিলো। “খুব বেশি ভারি!”

ভাঙা জানালা দিয়ে স্পষ্ট লোকটার গলা শোনা যাচ্ছিলো। টম দেখলো আর একজন লোক এসে তার সাথে হাত লাগালো। দুজন মিলে একটা শক্ত বক্স ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো।

কেবিনে আর কেউ নেই। টম আরো খানিকটা মুচড়ে এগিয়ে গেলো, ভাগ্যিস আবোলি শক্ত হাতে ওকে ধরে রেখেছিলো। জানালার ভাঙা কাঁচের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো ও, সাবধান থাকছে যাতে কবজি না কাটে। তারপর জানালার হুড়কো খুলে জানালাটা খুলে ফেললো।

“ছেড়ে দাও,” ফিসফিসিয়ে বললো টম। আবোলি ছেড়ে দিতেই ও জানালার গোবরাট ধরে নিজেকে ভিতরে টেনে তুললো। ওর পতনের ধাক্কায় কয়েকটা কুশন ছড়িয়ে পড়লো নিচে। ওগুলো ছিঁড়ে তুলা বের করে ফেলা হয়েছে। ভিতরে যদি দামি কিছু থেকে থাকে তাহলে তা আর নেই।

আবোলি টমের নীল তরবারিটা জানালা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। টম ওটা নিজের কোমরে বেঁধে নিয়ে পিস্তলটা পরীক্ষা করে নিলো। বাকিরাও তততক্ষণে চলে এলো এই জাহাজে। সবাই ভিতরে ঢোকার পর দেখা গেলো নাড়াচাড়ার আর জায়গা নেই।

কেবিনের উপরের ডেক থেকে একটা হাসির হল্লা ভেসে এলো। কি হচ্ছে ভেবে পেলো না টম।

আচমকা খুলে গেলো দরজা। এক দস্যুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো সামনে। সে এতোক্ষণ রান্নাঘরটা লুট করছিলো সম্ভবত, কারণ তার এক হাতে দেখা গেলো এক গাদা রূপার চামচ আর এক হাতে একটা মোমদানি।

“কি করছো তোমরা? এসব আমার।” কিন্তু এরপরেই ওর খেয়াল হলো যে এরা ওর দলের কেউ না। “তোরা আবার কোন শালা?”

কিন্তু কেউ যে তরবারি চালাবে সেই জায়গা ঘরের ভিতরে ছিলো না। আবোলি হাতের ছুরিটাই চালালো শেষ পর্যন্ত। দস্যুর গলা এফোঁড় ওফোড় হয়ে গেলো। গলা চেপে ধরে মেঝেতে পড়ে গেলো সে। গলগল করে হাতের ফাঁক দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। হাতের চামচ আর মোমদানি ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।

“আমার পিছনে আসো সবাই!” টম মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে। পুরো জায়গাটা কুরুক্ষেত্র হয়ে আছে : লোকজন কাপড়চোপড়ের গাটরি নিয়ে টানাটানি করছে, আলমারি ভেঙ্গে ভিতরের জিনিস ছড়িয়ে ফেলেছে, দামি দামি সব মশলা পুরো মেঝেতে সয়লাব হয়ে আছে। কয়েকজনকে দেখা গেলো রাম-এর একটা পিপা ভেঙ্গে সেটা থেকে খাওয়া। শুরু করেছে।

কারো হাতেই অস্ত্র নেই। বেশিরভাগই ওদেরকে ঘরটা থেকে বের হতে দেখেনি, বা দেখলেও বোঝেনি যে ওরা আসলে কারা।

সেন্টারাসের দলটা দেরি না করে আক্রমণ করে বসলো। ডোরি আর আবোলি অভিজ্ঞ যোদ্ধা। অসংখ্য যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছে। যামা আর তুলা ওদের বাবার লড়াইয়ের কাহিনি শুনে শুনে বড় হয়েছে। ওরাও আজ জীবনে প্রথম লড়াইয়ের স্বাদ নিলো। আলফ উইলসন আর বাকিরা এর আগে এভোবার কোর্টনীদের সাথে নানান অভিযানে গিয়েছে যে ওরা একেবারে নিখুঁতভাবে জানে যে কি করতে হবে।

দস্যুরা বলা যায় টেরও পেলো না যে ওদের সাথে কি হচ্ছে। বেশিরভাগই কিছু বুঝে ওঠার আগেই অক্কা পেলো। কয়েকজন হাতের কাছে যা পেলো তা দিয়েই আত্মরক্ষার চেষ্টা করলো-নেভিগেশনের বই, থালা বাটি, কাপড়ের গাটরি-কিন্তু তাদেরকেও অনায়াসে পেড়ে ফেলা হলো। চোখের কোনা দিয়ে টম দেখতে পেলো যে ডোরিয়ান মাপা পদক্ষেপে সামনে আগাচ্ছে। ওর সামনের দস্যুর হাতে ছুরি। ডোরিয়ান তরবারি দিয়ে ঝটকা মেরে ছুরিটা ফেলে দিলো, সাথে সাথেই সেটা ঘুরিয়ে দস্যুর হৃৎপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিলো। তারপর কবজির মোচড়ে তরবারিটা বের করে হাতল দিয়ে পিছনে আক্রমণোদ্যত একজনের মুখে আঘাত করলো। লোকটা মুখ চেপে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা, ডোরিয়ান সামনে এগিয়ে তাকেও এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো।

কিন্তু গুটিকয়েক দস্যু ঠিকই সিডি পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। “সবাই ডেক-এ যাও জলদি,” আদেশ দিলো টম। এতোক্ষণে উপরের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই নিচে কি হচ্ছে সেটা টের পেয়ে গিয়েছে, ওদের কেউ যদি উপরে ওঠার রাস্তাটা বন্ধ করে দেয় তাহলে টম আর ওর দল নিচেই আটকা পড়ে যাবে।

টম গুলির বেগে সিঁড়ির দিকে ছুটলো। সিঁড়িটা রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে, তবুও ও তিনটা করে ধাপ একবারে পার হতে লাগলো। সিঁড়ির মাথায় একজন লোককে দেখা গেলো; টম একটা পিস্তল বের করে বাম হাত দিয়ে গুলি করলো তাকে। এতো কাছে থেকে গুলি না লাগার প্রশ্নই আসে না। লোকটা ওর উপর মুখ থুবড়ে পড়লো। টম একদিকে সরে গিয়ে সংঘর্ষ এড়ালো, তারপর এক লাফে বাকি সিঁড়িটা টপকে উপরের ডেক-এ এসে উঠলো।

যুদ্ধের উত্তেজনায় ওর সবগুলো স্নায়ু টানটান হয়ে আছে। এক নজরেই সব চোখে পড়লো ওর পিছন দিকে বন্দীদেরকে জড়ো করে রাখা হয়েছে অস্ত্রধারী দস্যুরা ঘিরে রেখেছে তাদেরকে; জাহাজের ক্যাপ্টেন হাঁটু মুড়ে বসে আছে, সারা শরীর রক্তাক্ত; একটা মহিলাকে মেঝেতে চেপে রাখা হয়েছে, বিবস্ত্র, এক দাড়িওয়ালা দস্যু তার উরুর ফাঁকে একটা তরবারি ধরে আছে।

টম ওর দ্বিতীয় পিস্তলটা বের করে গুলি করলো। কিন্তু একটু বেশি তাড়াহুড়া করায় গুলি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পিছনের আর একটা লোকের গায়ে লাগলো। দস্যুদের ক্যাপ্টেন লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো। অন্ধ আক্রোশে সে হাতের তরবারিটা দিয়ে শোয়ানো মেয়েমানুষটাকে বিদ্ধ করতে গেলো।

আর একটা গুলির শব্দ পাওয়া গেলো। ডোরিয়ান টমের পাশে উঠে এসেছে। ওর হাতের দুটো পিস্তল থেকেই ধোঁয়া উড়ছে; দস্যুদের ক্যাপ্টেন তরবারি ফেলে কবজি চেপে টলতে টলতে পিছনে সরে গেলো। রক্ত পড়ছে সেখান থেকে।

টম ভাইয়ের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসলো। “গুড় শট, ডোরি।”

“আমিতো ব্যাটার হৃদপিণ্ডের দিকে তাক করেছিলাম,” ডরিয়ান গুলিহীন পিস্তলটা কোমরে গুজতে গুজতে বললো। তারপর আবার তরবারিটা তুলে নিলো ডান হাতে। এক দস্যু বর্শা হাতে ওর দিকে এগিয়ে এলো। ডোরিয়ান একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়ালো, ফলে লোকটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। ডোরিয়ান সেই সুযোগে নিজের তরবারি গেঁথে দিলো। একেবারে বুকের মাঝ বরাবর ঢুকলো তরবারিটা, ফলে শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানে প্রায় এক বিঘত পরিমাণ লম্বা একটা ক্ষত সৃষ্টি হলো।

আবোলি ততোক্ষণে আবার নিচে নেমে গিয়েছে। টমও ওর পিছু পিছু নিচে নেমে গেলো। আবারও জাহাজের পিছনে আর একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠে ডাওজারের লোকজন এবার ওদের বন্দীকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওদের কাছে অস্ত্র ছিলো না কিন্তু দস্যুরা ছিলো একদম অপ্রস্তুত। কয়েকজন লুটতরাজে চলে গিয়েছিলো; আর বাকিরা ছিলো লেগ্রাঞ্জের সাথে মহিলাটার কান্ড কীর্তি দেখায় ব্যস্ত। কয়েকজন নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে রেখেছিলো, ফলে এখন ওরা দুই দিক থেকেই আক্রমণের শিকার হলো। নাবিকেরা দস্যুদের অস্ত্র জোর করে কেড়ে নিলো, নাহয় এমনভাবে চেপে রাখলো যাতে ওরা ওগুলো আর ব্যবহার করতে না পারে। টম এর ভিতর দিয়েই এগিয়ে দস্যুদের সর্দারকে খুঁজতে লাগলো।

ওর পা কিছু একটায় আটকে গেলো। চোখ নামিয়ে সেদিকে তাকালো ও। একটু আগে দেখা মহিলাটা, শরীর বাকিয়ে একটা বল-এর মতো হয়ে আছে, ছেঁড়া জামা দিয়েই আব্রু রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাছেই একটা গনগনে ব্রেজিয়ার জ্বলছে। আশেপাশের হট্টগোলে সবাই ভুলে গিয়েছে সেটার কথা।

এই যুদ্ধের উত্তেজনার মাঝেও, টম সতর্ক হয়ে গেলো। আগুন হচ্ছে সকল নাবিকের নিকৃষ্টতম ভীতি–যা কিনা একটা জাহাজকে মুহূর্তেই কালো ছাইতে রূপান্তরিত করতে পারে।

আবোলিও দেখেছে সেটা। ও একটা পা দিয়ে ব্রেজিয়ারটা তুলে নিয়ে পাশের দস্যুদের জাহাজে ছুঁড়ে দিলো। গরম কয়লা ছড়িয়ে পড়লো ডেক জুড়ে। একটা গিয়ে পড়লো এক গাদা রশির উপর, কিন্তু ডাওজারের এই হট্টগোলের মাঝে কেউ সেটা খেয়াল করলো না।

টম মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কেউ কাছে আসতে চাইলেই ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিলো দূরে, আর ফাঁকে ফাঁকে শত্ৰুদলের ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে লাগলো। সেন্টারাসের লোকজন, ডাওজারের ক্রু আর দস্যুদল ততোক্ষণে মরণপণ লড়াইতে লেগে গিয়েছে। নিচের ডেক থেকে ইঁদুরের মতো আরো অনেকগুলো দস্যু দৌড়ে এলো। এসেই এমন এক আক্রোশে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো যা সচরাচর টমের চোখে পড়েনি আগে। এর কারণ অবশ্য জানা, ওদের আর হারাবার কিছু নেই।

তারপর আচমকাই, ঠিক বাতাসের গতি পরিবর্তনের মতো দস্যুরা রণে ভঙ্গ দিয়ে দিলো। টমের সামনের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলো। এটাই সুযোগ ওর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করার। ও সামনে এগিয়ে পলায়নরত কয়েকজনকে পেড়ে ফেললো। প্রথমে ও বুঝতে পারলো না ওরা এভাবে পালাচ্ছে কেননা। একটু পরেই গন্ধটা পেলো টম। চারপাশের বাতাসে ভেসে বেড়ানো গান পাউডারের ঝাঝালো গন্ধটা না। এটা হচ্ছে কাঠ আর আলকাতরা পোড়ার শক্তিশালী দম আটকানো গন্ধ।

উদ্দত শত্রু আর জ্বলন্ত জাহাজের মাঝে দস্যুরা শেষমেশ জাহাজটাকেই বাঁচাবে বলে ঠিক করেছে, আর সেজন্যেই সেদিকে দৌড়ে যাচ্ছে যদি জাহাজটা কোনোমতে বাঁচাতে পারে। একজনকে দেখা গেলো ডাওজারের কিনারা দিয়ে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। টম তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। লোকটা দুই জাহাজের মাঝখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে খোলে বাড়ি খেয়ে পানিতে আছড়ে পড়লো। টম আশেপাশে তাকালো। কালো ধোঁয়া ফাইটিং কককে পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছে; জাহাজের কিনারা ছাড়িয়ে আগুন থাকার জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এখন।

“এটাকে ঐ জাহাজ থেকে দূরে সরাতে হবে,” চিৎকার করে বললো টম। আগুন যদি কোনোভাবে ডাওজারে লেগে যায় তাহলে ওরা সবাই পুড়ে মরবে। যামা ওর বিশাল কুঠারটা দিয়ে ঝুলতে থাকা সব রশি কেটে দিতে লাগলো। ডাওজারের দুজন ক্রু-ও দুটো তরবারি তুলে নিয়ে ওর সাথে যোগ দিলো।

আগুনের শিখা লকলক করে উপরে উঠতেই লাগলো। কিন্তু তখনো জাহাজ দুটো জোড়া লেগেই আছে। উপরে তাকিয়ে টম দেখলো ডাওজারের মাস্তুলের একটা আড়কাঠ দস্যুদের জাহাজটার রশিতে বেঁধে গিয়েছে। ফলে দুটো জাহাজই খুব শক্তভাবে আটকে আছে।

“কুড়ালটা দাও আমাকে।” বলে ও যামার হাত থেকে সেটা নিয়ে মাস্তুলের সাথে বাধা জালটা বেয়ে উঠতে লাগলো উপরে। ডোরিয়ানও উঠলো পিছু পিছু।

জালের ফাঁকগুলোয় পা বাঁধিয়ে টম মাস্তুলের মাথার কাছে উঠে এলো। নিজের জাহাজের ক্যাপ্টেন হওয়ায় এর আগে কখনোই ওকে এতো উপরে উঠতে হয়নি, কিন্তু তবুও দেখা গেলো কাজটায় ভালোই দক্ষ ও।

মাথায় পৌঁছেই আড়কাঠ আর রশিগুলোর স্তূপে কোপ দিতে লাগলো টম। ওর ঠিক নিচেই দেখা গেলো আগুন জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে আগুনের শিখা ওর জুতোর তলা চাটছে। ধোয়ায় চোখে পানি চলে এলো। ডোরিয়ানও পৌঁছে একই কাজ করতে লাগলো। ও আড়কাঠের উপর চড়ে বসে যে পাশটায় রশিগুলো আটকে আছে সে পাশটা কোপাতে লাগলো।

কিন্তু এরপরেও দেখা গেলো জাহাজ দুটো কেউ কারো বন্ধন ছাড়ছেই না।

“ছুটছে না কেন?”

ডোরিয়ান একটা পেরেকের দিকে দেখালো। ওটার সাথে রশিগুলো আটকে আছে। ও টমের হাত থেকে কুড়ালটা নিয়ে ওটার দিকে এগিয়ে গেলো।

কিন্তু কিছু একটা এসে আড়কাঠটায় আঘাত করলো। টমও টের পেলো কনটা, তারপরেই মাস্তুলের গায়ে হওয়া ছিদ্রটা দেখতে পেলো। ঠিক ডোরিয়ানের পায়ের কাছে। ধোয়ার ভিতর দিয়েই টম দেখতে পেলো দস্যুদলের সর্দার হাতের মাস্কেটটা নামাচ্ছে। সে-ই করেছে গুলিটা।

ও আমাদের দুজনকেই একসাথে মারতে চাচ্ছে, মনে মনে ভাবলো টম। এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে ও আড়কাঠের শেষ মাথায় এগিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে ফাইটিং কক-এর পাল ধরে ঝুলে পড়লো। তারপর একটা পাক খেয়ে কিছু একটা ধরে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই পেলো না। এতো জোরে নিচে পড়তে লাগলো যে ঘষায় ওর হাত পা ছিলে গেলো, তারপর প্রচণ্ড জোরে শক্ত ডেক-এ আছড়ে পড়লো। ধোঁয়া আর হট্টগোলের মাঝে কেউ ওকে খেয়াল করলো না। সবাই পানি ভরা বালতি হাতে ছোটাছুটি করছে, চেষ্টা করছে আগুনের তেজ কিছুটা কমাতে। বাকিরা চেষ্টা করছে সাথের নৌকাটা নামাতে। ওটা নোঙ্গরে আটকে বেখাপ্লাভাবে ঝুলছে।

লেগ্রাঞ্জ মাস্কেটটায় গুলি ভরছে আবার। টম নিজেকে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলো। দুজনেই ছিটোকে পড়লো মাটিতে। মাস্কেটটা লেগ্রাঞ্জের শরীরের নিচে পড়লো। লেগ্রাঞ্জ শরীরকে ঝাড়া দিয়ে টমকে ফেলে দিতে চাইলো কিন্তু টমের শরীরে ওজনের জন্যে পারলো না। টম নিজের মোজার ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে আনলো।

লেগ্রাঞ্জ কিছু করার না পেয়ে অন্ধের মতো ডেক-এর উপর একটা অস্ত্রের জন্যে হাতড়াতে লাগলো। একটা কামানের নিচে একটা কাঠের মুগুর পড়ে ছিলো, সেটায় হাত লাগলো ওর। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ও সেটা দিয়ে টমের মাথায় বাড়ি দিলো। সময়মতো টমের চোখে পড়লো ব্যাপারটা। ও মাথা সরিয়ে ফেললো, ফলে বাড়িটা লাগলো ওর কাঁধে। কিন্তু টমের বন্ধনুক্ত হতে লেগ্রাঞ্জের ওটুকুই যথেষ্ট ছিলো। ও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে থাকা মাস্কেটটা তুলে নিয়ে টমের দিকে তাক করে ধরেই ট্রিগার টিপে দিলো।

চকমকি পাথরটায় ইস্পাতের ঘষায় ফুলকি ছুটলো। টম চমকে উঠে পিছু হটার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাস্কেটটায় মিসফায়ার হলো। ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে লেগ্রাঞ্জ অস্ত্রটা উল্টো করে ব্যারেল চেপে ধরে টমের দিকে এগিয়ে গেলো।

বাতাসে ধোয়া কেটে গিয়েছে ততক্ষণে। লেগ্রাঞ্জের পিছনে তাকিয়ে টম দেখলো যে জাহাজ দুটো সরে যাচ্ছে দূরে। ডোরিয়ান ডাওজারকে মুক্ত করে ফেলেছে। ওকে এখনি সাঁতরে ওটায় গিয়ে উঠতে হবে-কিন্তু সামনেই দাঁড়িয়ে আছে লেগ্রাঞ্জ, গদার মতো করে ধরে আছে নিজের মাস্কেটটা। টম পিছিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে দস্যুর ভয়ানক বাড়িগুলো এড়িয়ে যেতে লাগলো। ততোক্ষণে পূর্ণোদ্যমে জ্বলতে শুরু করেছে আগুন; আর সবাই আগুন নেভানোয় ক্ষান্ত দিয়ে নিজের জান বাঁচানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু লেগ্রাঞ্জ। তবুও টমকে আক্রমণ করতেই থাকলো, এতো দ্রুত ও হাতের অস্ত্রটা ঘোরাতে লাগলো যে টম যে কিছু একটা হাতে তুলে নেবে সে সুযোগই পাচ্ছিলো না।

টম আর এক ধাপ পিছিয়ে গেলো আর একটু পরেই জাহাজের কিনার। বহু কষ্টে মাস্কেটের আরো একটা আঘাত এড়িয়ে ও রেইলের উপর শরীরটা টেনে তুললো।

সরু ধারটার উপর ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে ও নিচের পানির দিকে তাকালো একবার। জাহাজটা বাতাসের ধাক্কায় আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ও যদি লাফ দেয় তাহলে বাতাস ওকে জাহাজের নিচে ঠেলে দেবে। সেক্ষেত্রে জাহাজের খোলে লেগে থাকা শামুকে কেটে মোরব্বা হতে সময় লাগবে না। তবে যদি এর আগেই হাঙ্গর ওকে ধরে ফেলে তাহলে ভিন্ন কথা।

লেগ্রাঞ্জও ব্যাপারটা জানে। ও তাই আক্রমণে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করলো। ও জানে না যে টম কে, কোথা থেকে এসেছে বা কিভাবে জাহাজে উঠেছে, শুধু জানে যে টম ওর হাত থেকে ওর শিকার কেড়ে নিয়েছে। আর টমের জন্যেই ওর জাহাজটাও এখন হারাতে হচ্ছে। আবারও একটা ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে ও টমের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য টমকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবে।

টম আঘাতটাকে এড়িয়ে পিছন দিকে ঝাঁপ দিলো। অবাক চোখে লেগ্রাঞ্জ দেখলো, টম নিচের পানিতে আছড়ে না পড়ে শূন্যে ভাসছে। তারপর জাহাজের পাশ থেকে এমনভাবে উড়ে গেলো যেনো ওর পাখা গজিয়েছে।

লেগ্রাঞ্জ খেয়াল করেনি যে জাহাজের মাস্তুলের আড়কাঠের সাথে পাল খাটানোর যে দড়িটা বাধা সেটা টম আগেই ধরে ফেলেছিলো। টম ঝুলতে ঝুলিতে যতোদূর সম্ভব দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলো, আসার সময় গতি আরো বেশি বেড়ে গেলো কারণ জাহাজ ঘুরে গিয়ে ওর ভরবেগ আরো বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। ও পা দুটো ভাজ করে বুকের কাছে তুলে আনলো, তারপর লেগ্রাঞ্জের কাছে আসতেই সপাটে পা চালালো। বুটশুদ্ধ পা জোড়া লেগ্রাঞ্জের কপালে আঘাত হানলো। এতো জোরে লেগ্রাঞ্জের শরীরটা বেঁকে গেলো যে টম স্পষ্ট ওর মেরুদণ্ড ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো। লেগ্রাঞ্জ পা ভাঁজ হয়ে পিছনে উল্টে পড়ে গেলো। সাথে সাথে আগুন এসে গ্রাস করালো ওকে। এক মুহূর্তের জন্যে টম লেগ্রাঞ্জের ভয়ার্ত মুখটা দেখতে পেলো। ওর দাড়ি, চুল আর কাপড়ে আগুন ধরে গিয়েছে ততোক্ষণে, চেহারায় ফোস্কা পড়ে কাঁপছে।

টম দড়িটাতে ঝুলে উল্টো পাশের পানির উপর পৌঁছে গেলো। তারপর বিপরীত দিকে ফিরতে শুরু করতেই ছেড়ে দিলো দড়িটা। ঝুপ করে পড়লো গিয়ে পানিতে। হাঙ্গরেরা ওর রক্তের গন্ধ পাওয়ার আগেই শক্ত হাতে সাঁতার কেটে সহজেই ডাওজারের কাছে পৌঁছে গেলো ও। ডোরিয়ান মইয়ের শেষ ধাপে অপেক্ষা করছিলো ওকে ধরে টেনে তোলার জন্যে।

“সারাহ আর ইয়াসমিনি কোথায়?” হাফাতে হাফাতে বললো টম। তখনো শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি। ও পাগলের মতো ডাওাজারের চারপাশের পানিতে খুঁজতে লাগলো, তারপর ফাইটিং কক-এর জ্বলন্ত শরীরের ফাঁক দিয়ে ওদের দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

টম এরপর নিজের মনোযোগ ফেরালো দস্যুদের জাহাজের প্রতি। অগ্নিকুণ্ড ওটার প্রতিটা মাস্তুল আর কিনার ধরে জ্বলছে, পালগুলোতেও একই অবস্থা। কয়েকজনের গায়েও লেগে গিয়েছে আগুন। লোকজন থাকতে না পেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যেসব দস্যু ডাওজারে আটকা পড়েছে তারা যে খুব আরামে আছে তা কিন্তু না। জাহাজের ক্রুরা সবাই ভয়ানক হিংস্র হয়ে আছে। কাউকেই ছাড়া হচ্ছে না। ঠিক দস্যুরা যেরকম বলেছিলো।

“একটা নৌকা নামিয়ে দেওয়া উচিত, সমুদ্রে হাবুডুবুর দস্যুদের দেখিয়ে বললো ডোরিয়ান। হাঙরের ডানা দেখা যেতেই চিৎকার শুরু হয়ে গেলো সবার মাঝে।

“এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে লাভ কি বলো, কেপ টাউনে গিয়ে সেই ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে,” টম মনে করিয়ে দিলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ধাক্কায় ওদের ফুসফুসের সব বাতাস বেরিয়ে গেলো, হল্কা এসে লাগলো সবার গায়ে। একটা বিশাল ঢেউ এসে জাহাজকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। যারা দাঁড়িয়ে ছিলো সবাই-ই ডেক-এ ছিটকে পড়লো। জ্বলন্ত ছাই আর ধ্বংসাবশেষ ঝরতে লাগলো উপর থেকে। সামনে তাকিয়ে দেখা গেলো ফাইটিং কক বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে। শুধু কিছু পোড়া কাঠ ভাসতে দেখা যাচ্ছে পানিতে।

টম কষ্টে সৃষ্টে উঠে দাঁড়ালো। এখন আর কাউকে উদ্ধারের চিন্তা করে লাভ নেই। পানিতে থাকা প্রত্যেকটা লোকই নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে বিস্ফোরণের ধাক্কায় তলিয়ে গিয়েছে।

“ওটার পাউডার ম্যাগাজিনে লেগেছিলো মনে হয়।” জাহাজের পাশ থেকে এক পোড়খাওয়া চেহারার লোক বলে উঠলো। গায়ের কোট হারিয়ে ফেলেছে। সে; আর তার বাহু আর গালের একটা কাটা থেকে রক্ত ঝরছে। এরপরেও তার চেহারায় কর্তৃত্বের ছাপটা স্পষ্ট দেখতে পেলো টম।

“আপনিই কি ডাওজারের মাস্টার?”

“জোসিয়াহ ইঞ্চবার্ড।” লোকটা ফাইটিং ককের ধ্বংসাবশেষের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, টুকরো গুলো বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। “জাহাজটা আর ওটার ডাকাতগুলো দুটোর জন্যেই পরিণতিটা ভালোই হয়েছে বলবো।”

টম লড়াই সম্পর্কে লোকটার মন্তব্য শোনার অপেক্ষায় চুপ করে থাকলো, আশা করলো, ওরা যে সাহায্য করেছে সে জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কিন্তু ইঞ্চবার্ড আর কিছুই বললো না।

“ভাগ্য ভালো যে দস্যুরা যখন আক্রমণ করেছিলো তখন আমরা কাছেই ছিলাম,” টম মনে করিয়ে দিলো। “আমরা আপনার জাহাজটাকে বাঁচিয়েছি।”

ইঞ্চবার্ড ওর কথার অর্থ সাথে সাথেই ধরতে পারলো। “দুঃখিত, আপনারা এজন্যে কিছু পাবেন না। কড়া ভাষায় জানিয়ে দিলো ইঞ্চবার্ড।

“আপনার জাহাজটা দস্যুরা দখল করে নিয়েছিলো। আপনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন,” জানালো ডোরিয়ান।

“আমি আত্মসমর্পণ করিনি।”

“কিন্তু সব দেখে কিন্তু সেটাই মনে হয়েছে।”

“আপনাদের যদি সেরকম মনে হয় তাহলে লন্ডনের নৌ আদালতে অভিযোগ করতে পারেন।”

টম আর কিছু বললো না। পনের বছর আগে একজন ফেরারি হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে এসেছিলো ও। ওর বড় ভাই বিলিকে হত্যার অভিযোগ আছে ওর বিরুদ্ধে। বিলি ছিলো একজন আপাদমস্তক শয়তান লোক। প্রচণ্ড রগচটা। টেমস নদীর ঘাটে, এক মধ্যরাতে ও টমকে আক্রমণ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। অন্ধকারে চিনতে না পেরে টম নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে খুন করে বসে। কিন্তু একথা বলে আদালতে পার পাওয়া যাবে না। ও যদি আবার ফিরে যায়, তাহলে নিশ্চিত ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হবে।

ইঞ্চবার্ডের সেটা জানার কথা না। তবে ও টমের দুর্বলতাটা ধরতে পারলো। “আপনি যদি মামলা করতে চান তো কোনো সমস্যা নেই। আমি সানন্দে আমার জাহাজে করেই আপনাকে লন্ডনে নিয়ে যাবো।”

“আমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনার জাহাজটা রক্ষা করেছি।” ডেক-এর লোকদের মাঝে উত্তেজিত কোলাহল শোনা গেলো। সেন্টারাস পাশাপাশি চলে এসেছে। আবোলি, সারাহ আর ইয়াসমিনিকে ধরে ডাওজারে চড়তে সাহায্য করলো। আমি আমার লোকজন, এমনকি আমার পরিবারের জীবনের ঝুঁকিও নিয়েছি,” টম আবার বললো।

ইঞ্চবার্ডের কণ্ঠ নরম হলো কিছুটা। “আমার হাত-পা বাঁধা, স্যার। ব্যাপারটা একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। আমি যদি আমার মালিকদের না জানিয়ে কিছু করি তাহলে আর কোনোদিন সমুদ্রের মুখ দেখা হবে না। আপনারা যা করেছেন, সেটার জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে যা চান তা-ই দিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সেজন্যে আপনাকে আগে কর্তৃপক্ষকে বলতে হবে।”

টম মাথা ঝাঁকালো। মাস্টার এই জাহাজের দায়িত্বে আছে, কিন্তু এতে যা আছে সেসবের মালিক অন্য কেউ। “তাহলে আমি বরং তার সাথেই কথা বলি।”

সারাহ আর ইয়াসমিনি মই বেয়ে উপরে উঠে এলো। সারাহ নিজের পিছনে হাত বেঁধে ডেক জুড়ে ধ্বংসস্তূপ দেখতে লাগলো।

“পরুষ মানুষ মিয়ে আর পারা যায় না,” ইয়াসমিনিকে বললো ও। “কখনো কিছু এলোমেলো ছাড়া গুছিয়ে রাখতে জানে না।” তারপর ইঞ্চবার্ডের দিকে ফিরে বললো। “আমার স্বামী আপনার জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি করে থাকলে দুঃখিত।”

ইঞ্চবাৰ্ড অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো। “আমরাও ঠিক সেটা নিয়েই আলাপ করছিলাম।”

“আপনার স্বামী আমাদের সবাইকে রক্ষা করেছেন, আর একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। লেগ্রাঞ্জের হাত থেকে যে মহিলাটাকে টম বাঁচিয়েছিলো সে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। কণ্ঠ নিচু আর কেমন ফ্যাসফেসে হয়ে আছে। এমন এক টানে কথা কথা বলছে যেটা টম ধরতে পারলো না। ছেঁড়া কাপড়টা পাল্টে সে নতুন একটা পোশাক পরেছে। একটা নীল রঙ্গা সূতি কাপড়, ঠিক তার বুকের উপর এসে শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছে গোটা সমুদ্রই বুঝি মেয়েটার গায়ে এসে জুটেছে। চুল একটা ফিতেয় বাঁধা, তবে কয়েকটা ঠিকই ছুটে এসে ওর খোলা গলায় খেলা করছে। বয়স মোটেও বিশের বেশি না, কিন্তু চেহারা দেখে বোঝা যায় সেই তুলনায় সাহস আর শক্তিতে অনেক বেশি পরিপক্ক মেয়েটা। ডেক এর প্রতিটা লোক তাকিয়ে আছে তার দিকে। এক ঘণ্টা আগেও এরা সবাই মেয়েটার সবচে গোপনীয় অঙ্গটাও দেখেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে কারো মনে মোটেও কামভাব জাগছে না।

“ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ড, আশা করি আপনি ভদ্রতা ভুলে যাননি,” মহিলা বললো। “এই লোকগুলো আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে আর আমি এমনকি এদের নামটা পর্যন্ত জানি না।”

টম সামান্য মাথা ঝাঁকালো। “আমার নাম টম,” বললো ও। “আমার ভাই, ডোরিয়ান; ওর স্ত্রী, ইয়াসমিন; আর আমার স্ত্রী, সারাহ। আপনাদের সাহায্য করতে পেরে আমরা খুব খুশি।”

“আমি অ্যানা দুয়ার্তে। ঐ দস্যুগুলো আমাদের সব লুট করে নিতে চেয়েছিলো।” অ্যানার শরীরে মৃদু কাঁপুনি বয়ে গেলো। “আমি জানি ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ড কেননা তার জাহাজ রক্ষা করার জন্যে বিনিময়ে কিছু দিতে পারছেন না। কিন্তু দয়া করে আমাদেরকে অকৃতজ্ঞ ভাববেন না। দস্যুরা আমাদের মালপত্রের যেটুকু রেখে গিয়েছে তার থেকে যতো ইচ্ছে নিয়ে নিন।”

টম আশা করলো ইঞ্চবার্ড প্রতিবাদ করবে। কিন্তু ক্যাপ্টেন একটা কথা-ও বললো না।

“আপনি আমাদের দিকটা ভাবছেন বলে খুশি হলাম ম্যাম, কিন্তু আমার মনে হয় এভাবে আমাদেরকে ইচ্ছে মতো সব দিয়ে দিলে কর্তৃপক্ষ বেজার হতে পারে। বিশেষ করে উনিও যদি ইঞ্চবার্ডের মতো হন, তাহলেতো কথাই নেই।”

অ্যানা নিজের মাথা নাড়লো।

“এগুলো আমার মালপত্র।”

“আপনার?”

“আমিই কর্তৃপক্ষ।”

“আপনি?” টম ওর আশ্চর্য ভাবটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলো না।

সারাহ কনুই দিয়ে ওকে গুতো দিলো। “টম কোর্টনী। তুমি একটা আস্ত গবেট। তুমি পুরো আফ্রিকা জুড়ে মহিলা সেনানায়ক, মহিলা ডাকাত, মহিলা মানুষখেকোদের দেখেছো আর জিনিসপত্র বিক্রি করেছো আর এখন কিনা মহিলা ব্যবসায়ী দেখেই তব্দা খেয়ে গেলে?”

অ্যানা আর সারাহ দৃষ্টি বিনিময় করলো-ওদের চোখাচোখির কিছুই বুঝলো না টম। তবে নিজেকে আসলেই বেকুব আর বুদ্ধ মনে হতে লাগলো ওর। এদিকে সারাহের মুখে ওর নাম শুনে ইঞ্চবার্ডের মুখভঙ্গির আশ্চর্য পরিবর্তন ওর চোখে পড়লো না।

সারাহ ওর হাতের ভিতর নিজের বাহু ঢুকিয়ে একদিকে টেনে নিয়ে গেলো। “চলোতো, মিষ্টি করে বললো ও। “মিস দুয়ার্তের উপর যথেষ্ট ধকল গিয়েছে, এখন এভাবে ওনাকে হা করে গিলতে হবে না। চলো কয়টা কাপড়ের গাটরি পছন্দ করি, যা দিয়ে আমাদের বন্দুকের গুলি আর পাউডারের দাম উঠে যাবে। তারপর এদেরকে শান্তিমতো নিজেদের পথে চলে যেতে দেই।”

*

সেদিন পুরোটা, এরপর আরো গোটা একটা দিন লেগে গেলো ওদের আলাদা হতে। সারাহ আর ইয়াসমিনি আহতদের সেবা করলো। টম, ডোরিয়ান আর আবোলি ইঞ্চবার্ডের লোকদেরকে জাহাজ মেরামতে সাহায্য করলো। ওরা মিলে আবার একটা মাস্তুল খাড়া করে দিলো। জাহাজের প্রায় অর্ধেক ক্রু মারা পড়েছে, ফলে সেন্টারাসের লোকেরা রশি পাকিয়ে আর মাস্তুলে চটা মেরে আবার খাড়া না করে দিলে আবার জাহাজটার পক্ষে একা চলা সম্ভব হতো না।

“আবহাওয়া ঠিক থাকলে এটা দিয়েই কেপ টাউনে পৌঁছে যাবো,” ইঞ্চবার্ড বললো। “ওখান থেকে নতুন লোক ভাড়া করে লন্ডনের দিকে যাত্রা করবো।”

কাজটা খুব একটা সহজ না। কিন্তু টম টের পেলো যে ইঞ্চবার্ড চাচ্ছে ওরা জাহাজ থেকে চলে যাক। ব্যপারটা ওর কাছে ভালোই লাগলো। ওরাও তাই দেরি না করে বিদায় নিয়ে ফিরে চললো।

বাতাস পরিষ্কার। রাত নামতেই সারাহ আর টম জাহাজের পিছনের গলইতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত অবলোকন করলো। সূর্যটা পশ্চিম আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত দেশগুলোর ওপাশে টুপ করে ডুবে গেলো।

“তুমি ঐ দুয়ার্তে মেয়েটার কথা ভাবছো, তাই না?” সারাহ বললো।

“আরে না, না,” টম বলতে গেলো কিন্তু ওকে থামিয়ে দিলো সারাহ।

“আমাদের যদি একটা ছেলে থাকতো তাহলে ঠিক ওর মতোই একটা বৌ চাইতাম আমি।”

টম সারাহকে আরো কাছে টেনে নিলো। বিয়ের পর থেকেই ওরা বাচ্চা নেওয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছে। কয়েক বছর আগে সারাহ গর্ভবতীও হয়েছিলো, তখন ওরা লুঙ্গা নদীতে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছিলো; টম ভেবেছিলো ওদের জীবন এবার পূর্ণতা পাবে। কিন্তু সারাহের গর্ভপাত হয়ে যায়, আর তার পর থেকেই ওদের শত চেষ্টার পরেও আর সারাহের গর্ভ সঞ্চার সম্ভব হয়নি।

“তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে তুমি ইংল্যান্ডে থেকে গেলেই ভালো করতে?” সারাহ জানতে চাইলো। “ডেভনের (একটা শহর) কোনো সুন্দরি মেয়েকে বিয়ে করে হাই উইল্ড-এ (টমদের বাড়ির নাম) বাড়ি বানিয়ে থাকলেই ভালো হতো। ডজনখানেক বাচ্চাকাচ্চা হতো।”

টম সারাহের গালে আলতো একটা চাপড় দিলো। “কখনোই না। আর হাই উইল্ড এর মালিক হচ্ছে ব্ল্যাক বিলি।” টমদের বংশের নিয়ম অনুযায়ী সব সম্পত্তির মালিক হয় বড় ছেলে। বিলি ডেভনের সবচেয়ে বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। তবুও সম্পত্তির লোভে বিলি ওদের বাবাকে সময়ের আগেই কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু সেই সম্পত্তি ভোগ করার জন্যে বেঁচে থাকতে পারে নি সে।

“সম্পত্তির মালিক এখন হবে বিলির ছেলে ফ্রান্সিস।” টম বলে থামলো একটু। মায়ের কোলে শোয়া একটা লালমুখো ছেলের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। “এতদিনে তাগড়া জোয়ান হয়ে যাওয়ার কথা ওর। হাই উইল্ডের জমিদার-ও হয়ে গিয়েছে।”

সারাহ বাতাসের তোড়ে উড়তে থাকা কাপড় সোজা করলো আবার। “সময় আমাদের সবার সাথেই বড় নির্দয় আচরণ করে, টম কোর্টনী।”

টম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো, সূর্যের শেষ কিরণটা সেখানে সমুদ্রকে লেহন করছে। ঢেউ এসে সেন্টারাসের খোলে বাড়ি খেয়ে গর্জন করছে, জাহাজটা এখন যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমে, আফ্রিকার সর্ব দক্ষিণে কেপ টাউনে। হাই উইল্ড থেকে পালিয়ে আসার পর এই শহরটাকেই টম বাড়ি হিসেবে পরিচয় দেয় এখন। কেপ টাউনে ওরা জাহাজটার টুকটাক মেরামত করবে, কিনে আনা মালপত্র বিক্রি করবে, নতুন মালামাল কিনবে, তারপর কয়েক মাস পর আবার হয়তো নতুন কোনো অভিযানে বের হবে।

টম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জীবনে কোনো কিছু নিয়ে ওর দুঃখ নেই, কিন্তু বড় হওয়ার পথে ওকে কতোটা কষ্ট করতে হয়েছে সেসব ও ভুলে যায়নি। সেই বিশাল পুরনো বাড়িটা, সেই গির্জাটা যেটার প্রাঙ্গণে অসংখ্য কোর্টনী কবরে শুয়ে আছে। ওর দাদার সেবা করা চাকরেরা, যাদের সন্তানেরা অনাগত কোর্টনীদের সন্তানদের সেবা করবে, সবই ছিলো একটা বিশাল কিছুর অংশ হিসেবে থাকার অনুভূতি। এখন ও যেখানেই থাকুক না কেননা, ওর শিকড় ওখানেই প্রোথিত, অনেক গভীরে। ও নিজেকে ওখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, কিন্তু এখনো নতুন কোনো জমিনের সন্ধান পায়নি যেখানে নতুন করে শিকড় গাড়তে পারে।

টম সারাহকে দুই হাতে ধরে কপালে চুমু খেলো।

“আমি ভাবছি ফ্রান্সিস এখন কেমন হয়েছে,” কৌতূহলী কণ্ঠে বললো ও।

*

বিশাল বাড়িটা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। বাতাস এসে ওটার কিনারে বা গম্বুজে ধাক্কা খেয়ে বিচিত্র শব্দ করছে আর ধুপধাপ করে ঢিলে হয়ে যাওয়া খিড়কিগুলোকে আটকে দিচ্ছে। শুধুমাত্র সবার উপরের তলার শেষ ঘরটা বাদে বাকি সবগুলো জানালা অন্ধকার হয়ে আছে।

ওটা হচ্ছে মাস্টার বেডরুম। একটা মাত্র মোমবাতি মোমদানির উপরে টিমটিম করে জ্বলছে সেখানে। সেই আলোয় ঘরের চারপাশে বিচিত্র সব ছায়া পড়েছে, যেনো ওগুলো সব দৈত্য দানো৷ চিমনি বেয়ে বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ফায়ারপ্লেসের নিভে যাওয়া কয়লাগুলো তাতে কেঁপে কেঁপে উঠে ঝাঁঝরির উপর নাড়াচাড়া করছে। কয়লা শেষ হয়ে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টা আগেই নিভে গিয়েছে আগুন, কিন্তু তবুও ওটার পাশে দুটো অবয়ব বসে পড়ে নকশা তুলছে, আর একজন কমবয়সী। ছেলে এই মৃদু আলোতেও বই পড়ার ভান করে যাচ্ছে। বিগত পনেরো মিনিট যাবত একটা পৃষ্ঠায়ই আটকে আছে সে।

মহিলাটা হঠাৎ মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন। তার ছেলে দৌড়ে এলো কাছে।

“কি হলো আম্মু?”

মহিলা নিজের আঙুল মুখে পুরে খানিকটা রক্ত চুষে নিলেন। “এই আলোয় চোখে দেখা যায় না, ফ্রান্সিস।”

মহিলা হচ্ছে এলিস লেইটন-আগে নাম ছিলো এলিস গ্রেনভিল, এরপর এলিস কোর্টনী। ছেলের দিকে তাকালেন উনি, ছেলের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছোঁয়া দেখে আপ্লুত হয়ে গিয়েছেন। ছেলের বয়স পুরো আঠারো হয়নি, কিন্তু এখনই তাগড়া জোয়ান হয়ে গিয়েছে বলা যায়। তবে ছেলেটার মন বড় নরম। মহিলার চিন্তার কারণ সেটাই। বাইরের শয়তানিতে ভরা দুনিয়াতে ছেলেটা কিভাবে কি করবে কে জানে। খাড়া খাড়া কালো চুল, সেই সাথে বাদামী গায়ের রঙ আর মায়াবী কালো চোখে ছেলেটাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগে। চোখের পাতার ঠিক উপরে কপালেও এক গোছা কালো চুল আছে ওর। মহিলা খেয়াল করে দেখেছেন যে গায়ের মেয়েরা ওর দিকে কিভাবে তাকায়। কোনো একসময়, ঠিক একই দৃষ্টিতে উনিও ওর বাবার দিকে তাকাতেন।

জানালার কপাট দড়াম করে বাড়ি খেলো আবার। যেনো শয়তান নিজে এসে দরজায় করাঘাত করছে। ফ্রান্সিস হাতের বইটা বন্ধ করে একটা লোহার শলা দিয়ে ফায়ারপ্লেসের ভিতর খোঁচাখুঁচি করতে লাগলো। কিন্তু ছাই বাদে আর কিছু বের হলো না।

“বাবা কোথায় গিয়েছে জানো?”

ওর বাবা-মানে আসলে সৎ বাবা। তবে এনাকেই ও বাবা হিসেবে জানে। গত এক সপ্তাহ যাবত বলা যায় লাইব্রেরিতেই নিজেকে বন্দী করে রেখেছেন উনি। কি সব কাগজপত্র নিয়ে পড়ে আছেন, যেসব ওদেরকে দেখতে দিচ্ছেন না। একবার ফ্রান্সিস দেখে করতে গিয়েছিলো, স্যার ওয়াল্টার ওকে বকাঝকা করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

এলিস হাতের কাপড়টা নামিয়ে রাখলেন। ওনার কালো চুলে বয়সের আগেই পাক ধরেছে, চোখে কোটরের ভিতরে প্রায়, ধূসর চামড়া গালের কাছটায় কুঁচকে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের এখনো ওর মায়ের সুন্দর আর হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা মনে আছে। সেই ছোটবেলায় মা যখন কোনো পার্টি বা নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফিরতো, তখন ফিরেই আগে ওর ঘরে এসে ওর কপালে চুমু দিয়ে শুভরাত্রি জানাতে। তার চামড়া থেকে তখন আভা বের হতো, চোখ জোড়া ঝলমল করতো। মা যখন ওর দিকে ঝুঁকে আসতো তখন ও মায়ের গায়ের সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেতো, তার নরম তুলতুলে হাত ওর গালে স্পর্শ করতো। মায়ের গলার হীরার হারটা মোমের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠতে। সেই হীরাগুলোই সবার আগে হাতছাড়া হয়েছে।

খালি বাড়িটায় আবার একটা প্রচণ্ড শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে গেলো। মেঝে শুষ্টু কেঁপে উঠলো তাতে। ফায়ারপ্লেসের কয়লা, সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়লো। ফ্রান্সিস লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো।

“বজ্রপাত নাকি?” অনিশ্চিত স্বরে বললেন এলিস।

ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো। “জানালাও না। নিচ থেকে এসেছে শব্দটা।”

বলে ও লম্বা বারান্দাটা ধরে হেঁটে গিয়ে বিশাল সিঁড়িটা ধরে নেমে এলো। মোমবাতি থেকে মোম গড়িয়ে পড়ে ওর হাতে ছ্যাকা দিতে লাগলো। কিন্তু হাই উইন্ডে আর কোনো রূপার মোমবাতিদান অবশিষ্ট নেই। ফ্রান্সিস সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বাতাসে গন্ধ শুকলো। শিকারের অভিজ্ঞতা থেকে ও গান পাউডারের ঘ্রাণ ভালোই চেনে। স্থানীয় সেনাবাহিনির মহড়ার সময়েও দেখেছে। কিন্তু এ বাড়িতে কখনো এই জিনিসের ঘ্রাণ পায়নি।

বুকের ভিতর একটা শঙ্কা দলা পাকিয়ে উঠলো ওর, হৃৎপিণ্ড বাড়ি খেতে লাগলো বুকের খাঁচার সাথে। ও দৌড়ে লাইব্রেরির দরজার কাছে পৌঁছালো। “বাবা?” ডাক দিলো ও। “বাবা ঠিক আছেন আপনি?”

উত্তরে শুধু জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা পতনের শব্দ বাদে আর কিছুই পাওয়া গেলো না। ও দরজাটা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটা আটকানো। হাঁটু মুড়ে বসে ও চাবির ফুটো দিয়ে ভিতরে তাকালো। কিন্তু ফুটোয় চাবি ভরা থাকায় ওপাশের কিছুই দেখা গেলো না।

“বাবা?” আরো একবার চেষ্টা করলো ও। এবার আগের চাইতে জোরে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ওর বাবা প্রায় কোনো বিরতি ছাড়াই মদ খেয়ে যাচ্ছে। হয়তো উনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন।

মোমবাতিটা নামিয়ে রেখে ও পকেটা হাত ঢুকিয়ে একটা ছুরি বের করে আনলো। তারপর আস্তে সেটাকে চাবির ফুটোয় ঢুকিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে ওপাশের মেঝেতে চাবিটা ফেলে দিলো। পুরনো দরজাটার নিচে প্রায় এক ইঞ্চি মতো ফাঁকা আছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ও ঘরের শেষ মাথায় টুপি ঝোলানোর জায়গাটায় একটা খড়ের টুপি দেখতে পেলো। টুপিটা নিয়ে এসে সেটার সাহায্যে দরজার নিচ থেকে চাবিটা টেনে নিয়ে এলো।

দ্রুত হাতে তালা খুলে দরজাটা খুলে ফেললো ফ্রান্সিস। রুমের ভিতর আগাতেই মোমের আলোয় ছায়াগুলো বিচিত্র নকশা করে সরে যেতে লাগলো। ছোট বেলায় ও এখানকার মসৃণ মেঝেয় পিছলা খেতো। কিন্তু এখন মেঝেটা অমসৃণ আর জায়গায় জায়গায় চলটা উঠে গিয়েছে; বহু বছর হয় পালিশ করা হয় না। দেয়াল জুড়ে সারি সারি খালি বইয়ের তাক; বাকি সব কিছুর মতো বইগুলোও বেঁচে দেওয়া হয়েছে। একসময় যেখানে তরবারি আর ঢাল ঝোলানো থাকতো সেখানের প্লাস্টারে দাগ হয়ে আছে। কোর্টনীদের শৌর্য বীর্যের প্রতীক ছিলো সেগুলো। রূপা আর কাঁচের তৈজসপত্রের মতো ওগুলোও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

ঘরের একদম শেষ মাথায় একটা বিশাল ওকে কাঠের টেবিল। একগাদা কাগজ আর খালি ওয়াইনের বোতল দেখা যাচ্ছে ওটার উপর। কোনো গ্লাস বা আর কোনো পাত্র নেই। ওর বাবা আলুথালুভাবে ওটার পেছনে চেয়ারে বসে আছেন। যেনো ক্লান্ত হয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাগজপত্রের উপরে লাল রঙের একটা তরলে ভরে আছে।

ফ্রান্সিস থমকে দাঁড়ালো। তারপর আচমকা দৌড় মেরে অবয়বটার কাছে। পৌঁছে সেটাকে টেনে সোজা করলো। কিন্তু ছেড়ে দিতেই দেহটা টেবিলের উপর পড়ে টেবিল শুদ্ধ উলটে পড়ে গেলো। ওর বাবা মেঝের উপর আছড়ে পড়ে একদিকে কাত হয়ে গেলেন। একটা হাত থেকে পিস্তল খসে পড়লো।

সারা শরীর কাঁপিয়ে বমি পেলো ফ্রান্সিসের। বহু কষ্টে সামলালো ও সেটা। “বাবা?”

স্যার ওয়াল্টার লেইটন একসময় বেশ সুপুরুষ ছিলেন। কিন্তু মাদকের নেশা তার সব শেষ করে দিয়েছে। এমনকি মারা যাওয়ার পরেও তার চেহারায় এক অদম্য শক্তিমত্তার ভাব ফুটে আছে। ছোট বেলার কথা মনে পড়লো ফ্রান্সিসের। বাবা ওকে বাতাসে ছুঁড়ে মেরে আবার ধরে ফেলতেন, ঘোড়ায় চড়ে বেড়া ডিঙ্গাতে পারলে একটা স্বর্ণমুদ্রা বখশিশ দিতেন, বলা নেই কওয়া নেই লন্ডনে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। এখন তার নিষ্প্রাণ নীল চোখ জোড়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন ওর কাছে ক্ষমা চাইছে। সামনের দিক থেকে তাকালে আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। শুধু ভালো করে খেয়াল করলেই কপালের উপরের দিকের ক্ষতটা চোখে পড়ে, যেখান দিয়ে পিস্তলের গুলি তার ঘিলুকে পিছন দিয়ে বের করে দিয়েছে।

পিছনে একটা খনখনে চিৎকারে সম্বিত ফিরলো ফ্রান্সিসের। ও ঘুরে তাকালো সেদিকে। এলিস দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। মুখে হাত চাপা দেওয়া। মেঝেতে পড়ে থাকা লাশটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন।

“তোমাকে বলেছিলাম উপরেই থাকতে,” ফ্রান্সিস বললো। ওনাকে এই দৃশ্য দেখতে দিতে চায়নি মোটেও। ও দ্রুত এগিয়ে এলিসকে জড়িয়ে ধরলো। মুখটা নিজের কাঁধে চেপে ধরলো যাতে ভয়াবহ দৃশটা তাকে দেখতে না হয়।

এলিস ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন, “এরকম কেনো করলেন উনি?”

ফ্রান্সিস এলিসকে একটা চামড়ার চেয়ারের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বসিয়ে দিলো। ওখান থেকে লাশটা দেখা যাবে না। তারপর গায়ের শালটা আরো ভালোভাবে তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আবার টেবিলটার কাছে। ফিরে গেলো। এলিস আর ওঠার চেষ্টা করলেন না।

ফ্রান্সিস কাগজের গাদা থেকে সবার উপরের কাগজটা তুলে নিয়ে আলোর বিপরীতে ধরলো। লন্ডনের একটা ফার্মের একজন উকিলের চিঠি ওটা। ও জীবনেও নাম শোনেনি আগে। আইনের নানান গালভরা ধারা আর শব্দে ভরা চিঠিটা। ফলে বুঝলো না কিছুই। একটা প্যারার কিছুটা বুঝলো শুধু।

যদি আপনি উনিশে অক্টোবর মাঝরাতের আগে এই ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে দেওয়ান পাঠিয়ে উল্লেখিত সম্পত্তি আর তাতে অবস্থিত যা কিছু আছে সব দখল করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

“এখানে আসলে হাই উইল্ড এর কথা বলা হয়েছে,” ফ্রান্সিস বুঝতে পারলো। “আর দিনটাও আজ রাতেই।” ও ঘড়ির দিকে তাকালো। যতোটা ভেবেছিলো, তার চাইতে বেশি রাত এখন। পাহাড়ের উপরের গির্জায় এগারোটার ঘণ্টা বাজানো হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু ও সেটা খেয়াল করেনি। হঠাৎ প্রচণ্ড আতংক গ্রাস করলো ওকে। “ওদের আসতে আর এক ঘণ্টাও নেই।”

ফ্রান্সিস আবার ওর বাবার লাশটার দিকে তাকালো। ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো ও, এতোক্ষণের দুঃখিত ভাবটা কেটে যাচ্ছে সেটার কারণে! ওর ঠিক মনে নেই কতোদিন আগে ও টের পেয়েছিলো যে ওর বাবা আসলে একজন জাত জুয়াড়ি। প্রায়ই দেখা যেতো ওদের বাড়ি থেকে রহস্যজনকভাবে রৌপ্যমুদ্রা উধাও হয়ে যাচ্ছে, আবার কয়েক মাস পর দেখা যেতো সেসব আবার ফিরে আসছে। মাঝে মাঝে বসার ঘরে তাসের আসর বসতো। অনেক রাত পর্যন্ত চলতো সেগুলো, ফ্রান্সিসের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলো না। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলেও দেখতে সেগুলো চলছে। ওর বাবার মেজাজও একেক সময় একেক রকম থাকতো। কখনো সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যেতো চুপচাপ, বেজার হয়ে আবার কখনো খুশিতে ঝলমল করতেন। ফ্রান্সিস আর এলিসের জন্যে গাদা গাদা উপহার নিয়ে আসতেন তখন। প্রায়ই দেখা যেতো অপরিচিত লোকজন আসছে বাড়িতে। সিঁড়ির রেলিং-এর আড়াল থেকে তাদেরকে দেখতে ফ্রান্সিস। কিন্তু ধরা পড়লেই এলিস ওকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে আচ্ছাসে বকতেন।

কিন্তু ও কখনো কল্পনাও করেনি যে অবস্থা এতটা খারাপ। বাইরে থেকে তীব্র একটা শব্দ কাঁপিয়ে দিলো আবার বাড়িটাকে। ফ্রান্সিসের মনে হলো দেওয়ানেরা বোধহয় এসেই পড়েছে। আসলে ওগুলো জানালার কপাট বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। ঘড়ির দিকে আর এক নজর তাকিয়ে বুঝলো আর মাত্র পনেরো মিনিট সময় আছে হাতে।

“আমাদেরকে যেতে হবে,” করুণ সুরে বললো ফ্রান্সিস। ও আবার ওর মাকে টেনে দাঁড় করিয়ে উপরের তলায় নিয়ে গেলো। যাওয়ার পথে সদর দরজা বন্ধ করে দিতে ভুললো না। এলিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, হাত পা ঠাণ্ডা। “তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, যা যা নেওয়া সম্ভব সব নাও।”

অবসন্ন ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে দেরাজ খুলে কয়েকটা পোশাক বের করলেন এলিস। ফ্রান্সিস নিজের ঘরে গিয়ে নিজের যৎসামান্য যা আছে তা একটা ব্যাগে ভরে নিলো। প্রতিটা সেকেন্ড পার হওয়াটা অনুভব করতে পারছে ও।

আবার মায়ের ঘরে ফিরে এসে দেখে বিছানা জুড়ে কাপড় ছড়িয়ে উনি চুপচাপ বসে আছেন।

“কি ব্যাপার?” রেগে গেলো ফ্রান্সিস। “ওরা যে কোনো মুহূর্তে চলে আসবে এখানে।” বলতে বলতে নিজেই মায়ের কাপড় একটা ব্যাগে ভরতে শুরু করলো। “যদি আজ আমার বাবা

“ওনাকে ওই নামে ডাকবে না,” ফিসফিস করে বললেন এলিস। “স্যার ওয়াল্টার তোমার বাবা নন।”

“আমি জানি। কিন্তু তুমিই বলেছো যে আমার তাকে-”

“ভুল করেছি আমি। আমি ওনাকে বিয়ে করেছিলাম কারণ আমি ছিলাম এক বিধাব আর তোমার একজন বাবার দরকার ছিলো। উইলিয়াম মারা যাওয়ার পরে আমার পরিবার আমাকে ত্যাজ্য করে দেয়; ওরা এমনকি ওর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও আসেনি। অভিজাত পরিবারগুলোর বাইরের একজন সাধারণ লোককে বিয়ে করার জন্যে বাবা আমাকে খুবই অপছন্দ করতেন। অথচ কোর্টনীদের আমাদের চাইতেও বেশি টাকা পয়সা ছিলো। এরপর উইলিয়াম মারা গেলো, আর মারা যাওয়া নিয়ে যেসব গুজব শোনা যেতে লাগলো… বাবা আমাকে কখনোই ক্ষমা করেননি।”

“এসব তো আগে বলোনি।”

“তুমিতো ছিলে একটা দুধের বাচ্চা। এমনিতেই কতো কষ্ট পেয়েছো তুমি। স্যার ওয়াল্টার লেইটন ছিলেন দারুণ একজন মানুষ। খুব মজা করতে পারতেন। কিন্তু আমি ওনার আসল রূপটা ধরতে পারিনি। ঠিক যেমন আমি তোমার বাবাকেও চিনতে ভুল করেছিলাম। যখন বুঝেছি ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”

“কিন্তু তুমি সবসময় বলেছো যে আমার বাবা, মানে আমার আসল বাবা, উইলিয়াম কোর্টনী ছিলেন ভালো মানুষ। একজন দয়ালু মহৎ লোক।”

এলিসের চেহারায় ভাঁজ পড়লো। “ওহ ফ্রান্সিস, সবই ছিলো মিথ্যে। উইলিয়াম কোর্টনী কেমন মানুষ ছিলো সেটা জানলে তুমি কতটা কষ্ট পাবে সেই ভয়েই আমি কিছু বলতে সাহস করিনি। ও ছিলো একটা কুৎসিত মনের নরপশু। নিজের বাবা মারা যাওয়ার পর ও খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো; আমার উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে, বেঁচে থাকলে তোমার উপরেও করতো। ও নিজের আপন ভাই টমাসকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো।”

ফ্রান্সিসের মনে হলো পায়ে কোনো বল পাচ্ছে না। ও ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লো। রাগের চোটে চোখে পানি এসে গেলো ওর। “না। আমিতো জানি টমাস ওনাকে খুন করেছেন। তুমিই বলেছো মা। তুমি নিজে বলেছো।”

“সেটা সত্যি। টম উইলিয়ামকে মেরেছে,” স্বীকার করলো এলিস। “কিন্তু সেটা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে।”

“তুমি সেখানে ছিলে?” টম জোর দিয়ে বললো। “নিজের চোখে দেখেছো?”

“উইলিয়াম লন্ডনে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। টম ওকে খুন করেছে এমন খবর চাউর হয়ে যায়। কিন্তু আমি জানি টম যদি ওকে আসলেই খুন করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে আগে উসকে দেওয়া হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় নিজের আপন ভাইকে খুন করার লোক টম না।”

ফ্রান্সিসের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। কিন্তু আসলে উনি সেটাই।”

আচমকা নিচে করাঘাত শোনা গেলো। মাপা কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী। শব্দটা কিসের সেটা ধরতে এবার আর কোনো কষ্ট হলো না। ভারী দরজায় শক্তিশালী একটা হাতের আঘাত। ফ্রান্সিস চাপা আওয়াজ শুনতে পেলো। কেউ একজন দরজার হাতল ঘোরানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

এলিস ফ্রান্সিসকে আঁকড়ে ধরলেন। “তুমি এখন বড় হয়েছে। সত্যিটা এখন তোমার জানা দরকার।”

“মিথ্যা বলছো তুমি।” ও ঝাড়ি মেরে এলিসের হাত ছুটিয়ে দিয়ে তার ব্যাগ তুলে নিলো। আবারও দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের আওয়াজ পাওয়া গেলো। আমি আজ রাতে একটা বাবাকে হারিয়েছি। আর এখন তুমি বাকিজনেরও স্মৃতি নষ্ট করে দিচ্ছো।”

“দরজা খুলুন,” একটা ভারি গলা শোনা গেলো। এই ঝড়ের মাঝেও স্পষ্ট। “আমরা আইনের লোক।”

ফ্রান্সিস দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। “আমাদের যেতে হবে। ওরা আমাদেরকে এখানে পেলে সব কিছু নিয়ে নেবে।”

“আমি যাবো না,” গায়ের শালটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললেন এলিস। “ওরা নিশ্চয়ই একজন গরীব বিধবাকে এভাবে বাড়িছাড়া করবে না। আর ওয়াল্টার যেহেতু মারা গিয়েছে, তার মানে এতো সহজে ওড়া ওর ঋণের শোধ পাবে না। যদি ওরা বাড়িটা নিতে চায় তো নিক। এই বাড়িটায় আমার একমাত্র আনন্দ হচ্ছে তোমার জন্ম। এটা বাদে বাড়িটায় শুধু দুঃখই পেয়েছি।”

ফ্রান্সিস এলিসের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবেগা দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর; অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না।

“দরজা খুলুন,” নিচ থেকে হাক শোনা গেলো আবার।

ফ্রান্সিস দৌড় দিলো। পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোনে চলে এলো ও। আস্তাবলের সব কর্মচারীকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; ও যেসব ঘোড়ার শাবকে চড়ে বড় হয়েছে সেসবকেও বহু আগেই নয়ন মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। শুধু একটা ঘোড়াই বাকি আছে-নাম হাইপেরিয়ন। তেরোতম জন্মদিনে ওর সৎ বাবা ওকে এই উজ্জ্বল বাদামী ঘোড়াটা উপহার দিয়েছিলো। ফ্রান্সিসের পদধ্বনি শুনে ঘোড়াটা মৃদু হ্রেষা ধ্বনি করে উঠলো।

ফ্রান্সিস একটা বাতি জ্বালিয়ে দ্রুত হাতে ঘোড়ার পিঠে কম্বল চাপালো। দেওয়ানের লোকজন কিছুক্ষণ পরেই পিছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢোকা যায় কিনা সেটা খুঁজতে চলে আসবে। ও দেয়ালে ঝোলানো একটা পানিরোধী কাপড় কাঁধে চাপিয়ে হাইপেরিয়নকে উঠোনে নিয়ে এলো।

একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে।

“মা?” এলিসকে দেখা মাত্র ফ্রান্সিসের রাগ পানি হয়ে গেলো, আস্তাবলের ছায়ায় ওনাকে ভূতের মতো লাগছে। ওনার শুকিয়ে যাওয়া শরীরে ঝুলতে থাকা কাপড় বেয়ে পানি ঝরছে, যেনো একটা বাচ্চা মেয়ে বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। ওনার হাতে একটা ছোট ভেলভেটের ব্যাগ।

“বিদায় না বলেই তোমাকে ছাড়ি কিভাবে বলো?”

ফ্রান্সিস–কে জড়িয়ে ধরলো। “গুডবাই মা।”

“কোথায় যাবে তুমি?” ঝড়ের কারণে ফ্রান্সিসের কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচাতে হচ্ছে এলিসের।

ফ্রান্সিসের মাথায় চিন্তাটা আগে আসেনি। কিন্ত আসামত্র ও উত্তরটা পেয়ে গেলো।

“দুনিয়াতে পরিবার বলতে আমার আর আছে গাই চাচা। উনিতো এখন আছে বোম্বেতে। আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডন অফিসে যাবো। গিয়ে একটা চাকরি আর ওদের জাহাজে করে ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে বলবো।” ফ্রান্সিস বিশাল বাড়িটার দিকে তাকালো। কতো শত স্মৃতিতে ভরপুর। “একদিন অনেক টাকা কামিয়ে আবার ফিরে আসবো। আবার হাই উইল্ডকে ফিরিয়ে নেবো।”

এলিস হাতের আঙুলে ঝোলানো ভেলভেটের ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরলেন। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিজের একমাত্র ছেলেকে বিদায় দেওয়ার ব্যথাকে চাপতে।

“ভালোই বলেছো। গাই চাচার সাথে সাবধানে থাকবে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে ওদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরেরা বাদে তুমি হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার। মাত্র দুই বছর বয়সেই তুমি এটার মালিক হয়েছিলে। তোমার দাদা হাল বিশ হাজারেরও বেশি শেয়ার কিনেছিলেন। আর উইলিয়াম এতো কম বয়সে মারা যাওয়ার পরে তুমিই ছিলে ওগুলোর মালিক। ওগুলোকে একটা ট্রাস্টের মাধ্যমে রেখে দেওয়া যেতো। কিন্তু গাই বলেছিলো ওগুলো বিক্রি করে দিতে। আমি ওর কথাই শুনি। কিন্তু আমার মনে সন্দেহ যে আসলেই আমাদেরকে আমাদের ন্যায্য পাওনা দেওয়া হয়েছিলো কিনা। আমরা যদি শেয়ারগুলো ট্রাস্টে রাখতাম তাহলে ওয়াল্টার কখনোই ওগুলোর নাগাল পেতো না। ওগুলোকে নগদ টাকায় ভাঙ্গানোর পরেই…”

এলিস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উইলিয়াম যেমন মানুষই হোক না কেনো, ও। মারা যাওয়ার পর এলিস ছিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী বিধাব। কিন্তু বিগত পনেরো বছর ধরে সেই সম্পত্তিকে তার সদ্য প্রয়াত স্বামী ঋণ আর কর্জের বোঝা বানিয়ে ফেলেছে। কোন মুখে উনি ফ্রান্সিসকে থেকে যেতে বলবেন? ওর জন্যে এখানে কিছুই নেই। স্যার ওয়াল্টার সব খেয়ে দিয়েছেন।

“এটা নাও।” বলে উনি ভেলভেটের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিলেন। বৃষ্টিতে কাপড়টা ভিজে গিয়েছে কিন্তু ফ্রান্সিস হাতে নিয়েই বুঝলো যে ভিতরে শক্ত কিছু একটা আছে। ও ব্যাগটা খুললো।

বিগত কয়েক মাসের দারিদ্রের পরে ভিতরের দৃশ্যটা একেবারে স্বর্গীয় বলা চলে। আস্তাবলের মশালের আলোয় ও দেখতে পেলো জিনিসটা একটা সোনার পদক। ঝকড়া কেশরওয়ালা একটা সিংহ খোদাই করা আছে তাতে। সিংহটা নিজের পায়ের থাবায় পুরো পৃথিবীকে ধরে রেখেছে। আর উপরের মীনা করা নীল আকাশ থেকে হীরার তারা আলো ছড়াচ্ছে।

“কি এটা?”

“দ্য অর্ডার অফ দ্য সেন্ট জর্জ অ্যান্ড হলি গ্রেইল। কোর্টনীরা বংশ পরম্পরায় এটা গলায় পরে। এটার মালিক এখন তুমি।”

“কিন্তু…” ফ্রান্সিস ইতস্তত করতে লাগলো। যেনো একজন ক্ষুধার্ত লোককে একগাদা খাবারের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। “এরতে বিশাল দাম। শুধুমাত্র হীরাগুলোইতো… এটা বেঁচেই তো আমরা হাই উইল্ড রেখে দিতে পারি।”

“না।” ওর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বললেন এলিস। “এটা কোর্টনীদের ইজ্জতের ব্যাপার। যেখানেই যাও, যা-ই করো, এটা কখনো যেনো হাতছাড়া না হয়।”

কাছেই চিৎকার শোনা গেলো। বাড়ির পাশ থেকেই। এলিস ফ্রান্সিসের হাত ধরে কপালে চুমু খেলেন।

“যাও। লন্ডনে গিয়ে স্যার নিকোলাস চিন্ডস এর সাথে দেখা করবে। উনি তোমার দাদার বন্ধু ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ওনার প্রভাব এখনো অনেক। যদি কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারেন তো উনিই পারবেন।”

*

ছোট থাকতে ফ্রান্সিস অনেকবার লন্ডন এসেছে। কিন্তু সবসময়েই সাথে ওর বাবা মা ছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরতো ওরা। কোচোয়ান চাবুক দিয়ে বাতাসে সপাং করে বাড়ি দিয়ে সামনের লোকদের সরিয়ে দিতে। সাথে একটা চাকরও থাকতো যে প্রতিটা থামার জায়গায় কিছু লাগলে এনে দিতো। আর এবার লন্ডন যেতে লাগলো প্রায় এক সপ্তাহ। ভাঙাচোরা রাস্তা আর শরতের ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস উঠে গেলো ওর। রাত কাটালো কোনো খানা খন্দের ভিতরে। হাইপেরিয়নকে বেঁধে রাখতো ঝোঁপের আড়ালে যাতে কারো চোখে না পড়ে। কারণ সবসময় দুশ্চিন্তা হতো যে কোনো শয়তানের কবলে পড়ে ও জামার নিচে লুকানো লাল ভেলভেটের ব্যাগটা হারিয়ে ফেলবে। স্যালিসবুরি পৌঁছার পর এক সকালে ওর ঘুম ভাঙলো শেরিফের লোকজনের ডাকে। ওরা ওকে ঘোড়া চোর মনে করে ধাওয়া দিলো। বেশ কয়েকটা মাঠ পেরিয়ে এসে তারপর পালাতে সক্ষম হলো ফ্রান্সিস। রিচমন্ড পৌঁছে, সাথে থাকা শেষ কয়েকটা মুদ্রা দিয়ে ও হাইপেরিয়নের জন্যে এক ব্যাগ ওট আর নিজের জন্যে এক মগ বিয়ার কিনলো। লন্ডন পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘোড়াটা প্রায় পঙ্গু হওয়ার জোগাড় হলো। আর ফ্রান্সিসও দেখা গেলো ময়লা-কাদা মেখে ভূত হয়ে গিয়েছে।

শহরের কোলাহলে ঘোড়াটা ভয় পেয়ে গেলো। লোকজনের হট্টগোল, পাথরের রাস্তায় গাড়ির ক্যাচকোচ শব্দ-নীরবতা নেই এক ফোঁটা। ফ্রান্সিস হাইপেরিয়নের উপর থেকে নেমে লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চললো। সাথে কানে কানে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ব্যস্ত রাস্তায় বেশিরভাগ লোকই ওকে কোনো পাত্তা দিলো না, কিন্তু ওদের চোখের দৃষ্টি ফ্রান্সিসের নজর এড়ালো না। এক ভবঘুরে ছেলের সাথে এরকম সুন্দর একটা ঘোড়া-ব্যাপারটা সবার কাছেই সন্দেহজনক। সেটা বুঝতে পেরে ফ্রান্সিসের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো; এর আগে কখনো ওর এতোটা একাকী লাগেনি।

অবশেষে একটা আস্তাবল খুঁজে পেলো ফ্রান্সিস। কিন্তু ওখানকার লোকটা ফ্রান্সিসকে এক নজর দেখেই ঘোষণা দিলো যে ওকে আগাম টাকা দিতে হবে। ভাড়া হচ্ছে পাঁচ শিলিং।

ফ্রান্সিস নিজের পকেট চাপড়ে বললো, “আমার কাছে কিছু নেই।”

“তাহলে আমারও কিছুই করার নেই।”

“প্লীজ।” রাত নেমে আসছে। এই ভয়ানক শহরে এভাবে চলার কথা মাথায় আসতেই ভয় লাগছে ফ্রান্সিসের। “আমি কালই আপনার টাকা দিয়ে দেবো।”

ধূর্ত চোখে ফ্রান্সিসকে আপাদমস্তক মাপলো লোকটা। ওর মরিয়া ভাবটা ভালোই টের পেয়েছে। “ঘোড়াটাকে বেচে দাও তাহলে।”

আতংকিত চোখে চেয়ে রইলো ফ্রান্সিস। প্রস্তাবটা বাতিল করতে মুখ খুললো, কিন্তু কথা বের হলো না। কারণ হঠাৎ খেয়াল হলো যে, ও যদি ভারতে নতুন জীবন শুরু করতে যায় তাহলে হাইপেরিয়নকে সাথে নিতে পারবে না।

চোখে পানি জমলো ফ্রান্সিসের কিন্তু সেটা পড়তে দিলো না।

“কতো দেবেন?”

“আমার জন্যে না। আমি দেখি কেনার মতো কাউকে পাই কিনা। ততোক্ষণ ও এখানেই থাক।”

ফ্রান্সিস ঘোড়াটার গলা জড়িয়ে ধরে কেশরে মুখ গুঁজে দিলো। হাইপেরিয়ন গরগর করে উঠলো। আস্তাবলের পরিচিত শব্দ আর গন্ধে আবার ভালো লাগছে ওর।

“রাতে থাকার জন্যে একটু জায়গা পাওয়া যাবে?”

লোকটা আবার ওর আপাদমস্তক তাকালো একবার। “চাইলে আস্তাবলে ঘুমাতে পারো।”

*

রাতে ফ্রান্সিসের ভালো ঘুম হলো না। ভোরেই উঠে পড়লো তাই। একটা পাত্র থেকে পানি নিয়ে যতোটা সম্ভব নিজেকে পরিষ্কার করে নিলো। ঘোড়ার গা পরিষ্কার করার ব্রাশ দিয়ে কাপড়ের কাদা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না বেশি একটা। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দোকানের কাছে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে শুকনো হাসি ফুটলো ওর মুখে। চুলগুলো কাকের বাসার মতো.হয়ে আছে। চোখের চারপাশে বেগুনি দাগ, যেনো কেউ ঘুষি মেরেছে। গাল জুড়ে সদ্য গজানো দাড়ি। কাপড় ছিঁড়ে আছে এখানে সেখানে। আর কাদা না থাকলেও দাগ ঠিকই লেগে আছে সবখানে। ডান পায়ের জুতোর ছেঁড়া দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আঙুল।

ফ্রান্সিস লন্ডনের অন্যতম সেরা ধনীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। স্যার নিকোলাস চিল্ডস-ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটা ছোট সওদাগরী কোম্পানি থেকে অর্ধেক দুনিয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী এক মহীরুহে রূপান্তরিত করেছেন। ফ্রান্সিস অনেক ছোট থাকতেই ওনার নাম শুনেছিলো। কিন্তু ওর সৎ বাবা যখনই ওনার প্রসঙ্গ তুলতেন ওর মা তখন অন্য ব্যাপারে কথা বলতেন।

ফ্রান্সিসের মনে হলো লন্ডনের প্রায় সবাই-ই লেডেনহল স্ট্রীট-এর বাড়িটাকে চেনে, তাই কোনদিকে যাবে সেটা বের করতে ওর কোনোরকম বেগই পেতে হলো না। প্রথম দর্শনে বাড়িটার খুব আলাদা কিছুই চোখে পড়বে না। কাঠের জানালা আর একজোড়া ভারী দরজা কৌতূহলী পথিকের দৃষ্টি থেকে বাড়িটাকে আড়াল করে রেখেছে; অলঙ্করণ বলতে আছে শুধু দরজার দুপাশে বিশাল দুটো থাম। তার পাশে একজন পোশাক পরা দারোয়ান দাঁড়ানো। কিন্তু যদি চোখ তুলে দেখা হয়, তাহলে অনেক বিস্তারিত ধরা পড়বে। তখন বোঝা যাবে যে আসলে ভবনটা কতোটা বিশাল। দোতলায় একটা কাঠের ব্যালকনি রাস্তা পর্যন্ত এসে পড়েছে। পিছনে কাঁচ ঘেরা বারান্দা। তার ঠিক উপরে, তিনতলায় একটা রাজকীয় প্রতীক সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। তার উপরে কার্ণিসে যতোদূর চোখ যায় ততোদূর একটা সমুদ্রে ভাসমান পালতোলা জাহাজের মুরাল আঁকা। জাহাজের পাশে ডলফিনেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। ওটার মাঝে আছে রানি এলিজাবেথের একজন নাবিকের ভাস্কর্য। নাবিকটা লন্ডনের বাড়িগুলোর চুড়া আর চিমনীগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।

জানা না থাকলে, প্রথম দর্শনে কারো মনে হতে পারে যে এটা বোধহয় জাহাজের জিনিসপত্রের দোকান। ভুল করে শহরের মাঝখানে দোকানটা দিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আসলে জায়গাটা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান কয়েকজন লোকের সদরদপ্তর।

ফ্রান্সিস ইতস্তত করতে লাগলো, সাহসে কুলাচ্ছে না। শেষমেশ দারোয়ানের দিকে আগালো ও।

“কষ্ট করে স্যার নিকোলাস চিল্ডসকে গিয়ে একটু বলবেন যে, ফ্রান্সিস কোর্টনী ওনার সাথে জরুরি কাজে দেখা করতে চায়।” উৎকণ্ঠায় স্বাভাবিকের চাইতে বেশি জোরে বলে ফেললো কথাগুলো। মনে মনে এরকম বাচ্চামির জন্যে মরমে মরে গেলো ফ্রান্সিস।

দারোয়ান ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। “স্যার নিকোলাস চিল্ডস আজ খুব ব্যস্ত। আর স্যার ফ্রান্সিস কোর্টনী তো সেই রাজা চার্লসের আমলেই মারা গিয়েছেন।”

“আমি ওনার নাতীর নাতী। একটু দয়া করুন, আমার স্যার নিকোলাসের সাথে দেখা করাটা জরুরি।” বলে ও ভারি দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলো। একটা শক্ত হাত ওর পথ আটকে দাঁড়ালো, তারপর ধাক্কা দিয়ে আবার পিছনে ঠেলে দিলো।

“স্যার নিকোলাস কারো সাথে দেখা করছেন না।” জোর দেওয়ার জন্যে দারোয়ান প্রতিটা শব্দ বলার সময় আঙুল দিয়ে ফ্রান্সিসের বুকে খোঁচা দিলো। “আর যদি আপনি এরকম দরজা ধাক্কা দিতে আসেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনবো।”

ফ্রান্সিস রাস্তার উল্টোপাশে একটা কফির দোকানের ছায়ায় এসে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে দেখতে পেলো লোকজন টেবিল ঘিরে বসে নানা আলাপ আলোচনা করছে, পত্রিকা পড়ছে আর ফাঁকে ফাঁকে ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। ওর আর ওদের মাঝে বাধা শুধু একটা কাঁচ, অথচ মনে হচ্ছে ওটা সম্পূর্ণ অন্য একটা দুনিয়া।

একটা অক্ষম ক্রোধ বয়ে গেলো ফ্রান্সিসের ভিতর দিয়ে। একেবারে ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিলো সেটা। বিগত কয়েক বছরে ওর মাঝে মাঝে মনে হতো যে ওর আসলে কিছুই নেই। আসলে ফ্রান্সিস কখনো বোঝেইনি যে ওর কতোটা ছিলো। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে টাকা পয়সা না থাকার হতাশায় আসলে ও কতোটা কাবু হয়ে পড়েছে। টাকা ছাড়া কিছুই সম্ভব না। এটার কমতি থাকাতেই ওর সৎ বাবা মারা পড়লো, ওকে ওর মায়ের কাছে থেকে আলাদা হয়ে যেতে হলো, ওর বাড়ি, ওর ঘোড়া সব ছাড়তে হলো। পরনের কাপড় আর গলায় ঝোলানো পদকটা ছাড়া ওর আর এখন কিছুই নেই।

ফ্রান্সিস আবারও কফির দোকানটার ভিতরে তাকিয়ে নিজেকে সেখানে কল্পনা করতে লাগলো। মনে মনে দেখতে পেলো ওর সাথের ব্যবসায়ীদের সাথে বসে ও ভারত থেকে সদ্য সেরে আসা ব্যবসা আর সেটা থেকে পাওয়া বিশাল মুনাফার কথা আলোচনা করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিতে যা করা দরকার ও সেটা করতে প্রস্তুত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যেতে প্রস্তুত, যে কোনো কষ্ট সইতে রাজি, যে কোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হবে না। সফল হওয়ার জন্যে এমনকি মানুষও খুন করতে পারবে। যদিও চিন্তাটা মাথায় আসতেই ওর কাপুনি ধরে গেলো। ফ্রান্সিস মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো যে ও ওর ভাগ্যকে জয় করবেই নয়তো চেষ্টা করে জান দিতে হলেও দেবে।

অপেক্ষা করবে বলেই ঠিক করলো ফ্রান্সিস। প্রতিবার যখন দোকানটার দরজা খুলছিলো তখন ভিতরের খাবারের সুগন্ধে ওর জিভে জল চলে আসছিলো। সকালটা পড়ে আসতেই দেখা গেলো লোকজন মাংসের পাই বা গরম পেস্ট্রি হাতে গন্তব্যে হেঁটে যাচ্ছে। ওর গলায় ঝুলানো ব্যাগটার ওজন ওর কাছে ক্রমশ আরো ভারি লাগতে লাগলো; জিনিসটা এতো বেশি দামি, অথচ এটা বিক্রির কথা ভাবতেও পারে না। ও একবার ভাবলো আস্তাবলে ফিরে গিয়ে দেখে যে লোকটা হাইপেরিয়নকে বেচতে পেরেছে কিনা, কিন্তু স্যার নিকোলাসের সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ যদি হাতছাড়া হয়ে যায় সেজন্যে যেতেও পারছে না।

ফ্রান্সিস জানে না যে কিভাবে স্যার নিকোলাসকে চিনবে। মা বলেছে যে চিল্ডস ওর দাদা হাল এর বন্ধু ছিলেন, তার মানে ওনার বয়স নিশ্চয়ই এখন অনেক বেশি। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটার ভিতরে লোকজুনের আসা যাওয়া দেখতে লাগলো। পরিপাটি পরচুলা পরা বৃদ্ধ লোকেরা যেমন আসছে, তেমনি বই আর কাগজপত্রের বোঝা নিয়ে যুবকদেরকেও দেখা গেলো ভিতরে যেতে। প্রতিবার যখনই দরজা খোলা হচ্ছিলো দারোয়ানটা ওর দিকে সন্দেহজনকভাবে তাকিয়ে থাকছিলো, কিন্তু ফ্রান্সিস একবারও রাস্তা পার হলো না। একবার ওর মনে হলো যে কেউ একজন দোতলার ব্যালকনির ছায়া থেকে ওর দিকে। খেয়াল রাখছে। কিন্তু ও ভালো করে দেখার আগেই লোকটা ভিতরে চলে গেলো।

অক্টোবরের দিনটা বয়ে চললো। ছায়াগুলো লম্বা হলো আরো; খালি হয়ে গেলো কফির দোকানটা। গির্জার ঘণ্টা বাজিয়ে সন্ধ্যার প্রার্থনার সংকেত দেওয়া শুরু হলো। ফ্রান্সিস ভেবে পেলো না এখন ও কোথায় যাবে বা কি খাবে। দুপুরে দেখা সব দিবাস্বপ্নের কথা ভুলে গিয়েছে ততোক্ষণে। এখন ওর মাথায় ঘুরছে শুধু খাওয়ার কথা। ও ভেলভেটের ব্যাগটা স্পর্শ করে নাড়াচাড়া করলো কিছুক্ষণ। আস্তাবলের কাছেই ও একটা মহাজনের দোকান দেখেছিলো; ওখানে বন্ধক রেখে নিশ্চয়ই ভালো টাকা পাওয়া যাবে। কয়েকদিনই তো, হাইপেরিয়নের টাকাটা পেলাই শোধ করে দেবে। কিন্তু চিন্তাটা মাথায় আসতেই নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে লজ্জা হতে লাগলো ওর।

চিন্তায় ডুবে থাকায় ফ্রান্সিস খেয়াল করলো না যে চাপরাসটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতে টের পেলো। লোকটার হাতে একটা কাগজে মোড়ানো গরম কেক।

“সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে আছো দেখলাম। কিছু তো খাও নি।”

ফ্রান্সিস লোকটার হাত থেকে কেকটা প্রায় কেড়ে নিয়ে গপাগপ খেতে আরম্ভ করে দিলো। কেকটার মিষ্টি স্বাদ আর আলমন্ডের সুঘ্রাণ আস্বাদনের অবস্থায় নেই ও আর এখন।

ফ্রান্সিস খাওয়ায় এতোই ব্যস্ত ছিলো যে দারোয়ানের সাথে আরো দুজন লোক এসেছে সেটা ও খেয়াল করার ফুরসত পায়নি। আচমকা এক জোড়া শক্ত হাত ওর হাত জোড়া চেপে ধরলো, আর একটা হাত চেপে ধরলো ওর মুখ। আর দারোয়ানটা হাতের লাঠি চেপে ধরলো ওর গলায়। দম বন্ধ হয়ে এলো ফ্রান্সিসের। অর্ধেক খাওয়া কেকটা মাটিতে পড়ে গেলো, আর একটু পরেই বুটের তলায় চাপা পড়ে মিশে গেলো রাস্তায়।

ফ্রান্সিস নিজেকে ছোটানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুই করতে পারলো না। দারোয়ান আর তার লোকেরা ওকে চ্যাং দোলা করে রাস্তা পেরিয়ে দালানের ভিতরে নিয়ে গেলো। ও এমনকি একটা চিৎকারও দিতে পারলো না। রাস্তার কেউ যদি ঘটনাটা দেখেও থাকে, তারা ভালোই জানে যে এসব ক্ষেত্রে না দেখার ভান করাটাই মঙ্গল।

*

বাইরের থেকে দেখে যা মনে হয়, ভিতরে আসলে বাড়িটা আরো বেশি বড়। লোকগুলো ফ্রান্সিসকে ধরে একটা লম্বা করিডোরে নিয়ে এলো। লবঙ্গ আর মরিচের গন্ধে ভারি হয়ে আছে জায়গাটা। ওখান থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো ওরা। ফ্রান্সিস হাসি ঠাট্টা আর আলাপের শব্দ শুনতে পেলো, কিন্তু আশেপাশের সব দরজাই বন্ধ, তাই ওদের শব্দ কেউ শুনতে পেলো না।

লোকগুলো ওকে সবার উপরের তলার একটা বিশাল দরজার সামনে নিয়ে এলো। দরজার হাতলটা পিতলের। দেখতে ঠিক শিকার ধরতে উদ্যত একটা সিংহের মতো। দারোয়ান সম্ভ্রমের সাথে টোকা দিলো। এমনকি দরজা খোলার আগেও কিছুটা ইতস্তত করলো, যেনো কোনো ভয়ঙ্কর জানোয়ারের খাঁচায় ঢুকতে যাচ্ছে।

ভিতরটা অন্ধকার। বাতাসও গরম আর ভ্যাপসা। যেনো একটা কাঁচের ঘর। ফায়ারপ্লেসে ছোট একটু আগুন জ্বলছে। পিছনের দেয়ালের সাথে একটা বিশাল ডেস্ক, তার উপরেও একটা মোমবাতি জ্বলছে, কিন্তু দুটোর আলোয় পর্দায় ঘেরা ঘরটা আলোকিত হচ্ছে না মোটেও। দেয়ালগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেনো হেলে পড়ছে। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিশাল বিশাল সব জাহাজ আর যুদ্ধের ছবি ঝুলানো। গিলটি করা ফ্রেমে বাধাই করা ওগুলোর। বাতাসে কটু গন্ধ, যেন এক টুকরো কাঁচা মাংস বহুদিন ধরে এখানে পড়ে আছে। ফ্রান্সিস অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু কাউকে চোখে পড়লো না। শুধু ডেস্কের পিছনে একটা টিপির মতো দেখা যাচ্ছে, যেনো গাদা করা ময়লা কাপড়ের ভূপ।

ওকে ধরে আনা লোকগুলো ওকে ছেড়ে দিয়ে টুপি খুলে দাঁড়ালো। আচমকা বাধন আলগা হওয়ায় ফ্রান্সিস ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে প্রায় উল্টে পড়ে যেতে যেতে সামলালো। তারপর গলায় হাত ডলতে লাগলো।

ডেস্কের পিছনে ভেজা, খড়খড়ে কাশির শব্দ পাওয়া গেলো। তারপরেই টিপিটা নড়তে শুরু করলো। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই ফ্রান্সিস বুঝলো ওটা একটা মানুষ। ঠিকভাবে বললে, বিশাল ভুড়িওয়ালা একটা মানুষ। পরনে রেশমের ড্রেসিং গাউন, আর হাঁটুর উপর একটা কম্বল রাখা। থলথলে থুতনির পিছনে ঘাড় দেখাই যাচ্ছে না। লোকটার মাথা কামানো, কিন্তু ঠিকভাবে না, তাই ইতস্তত সাদা চুলগুলো তুলা গাছের কাটার মতো বের হয়ে আছে। গাল জুড়ে নীল হয়ে ফুটে আছে শিরা-উপশিরা। শুধু তার কোটরে বসে যাওয়া, মাংসের আড়ালে লুকানো চোখগুলোতেই একটু যা জীবনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

“কে তুই?” মাথা না তুলেই জানতে চাইলো লোকটা। ফ্রান্সিস ধারণা। করলো লোকটার সম্ভবত মাথা তোলার শক্তি-ই নেই। অনেক পরে ও জেনেছিলো যে ওর ধারণা অর্ধেক সত্যি। যদি কোনো বিরল উপলক্ষে উনি এই ঘর ছেড়ে বের হতে চাইতেন, তাহলে ওনার চেয়ারের সাথে লাগানো লোহার আংটাগুলো ধরে চেয়ারসমেত তাকে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হতো। যখন প্রাকৃতিক কর্ম সারার দরকার হতো তখন নাকি তিনজন লোক তাকে বয়ে নিয়ে যেতো, তারপর কাজ শেষ হলে তারাই শৌচকার্য সেরে দিতো।

একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের পেটে ঘুষি বসিয়ে দিলো। “স্যার নিকোলাস যখন কিছু জিজ্ঞে করবে তখন চুপ না থেকে কথা বলবি।”

ফ্রান্সিস কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুষি খেয়ে ওর দম বেরিয়ে গিয়েছে পুরোটা, ফলে কোনো কথাই বেরুলো না।

“কে পাঠিয়েছে তোকে? নরিস আর ওর ডোগেটের লোকজন?”

“কে?” হাফাতে হাফাতে বললো ফ্রান্সিস। এই নামের কাউকে চিনি না। আমি।”

“আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করিস না ছোঁড়া।” স্যার নিকোলাস মাথাটা সামান্য নাড়তেই আরো একটা ঘুষি পড়লো পেটে। তবে ফ্রান্সিস এবার পেট শক্ত করে রেখেছিলো, তাই আগেরবারের মতো অতোটা জোরে লাগলো না। “সারাদিন আমার বাড়ির উপর নজর রেখেছিস। কার উপর গোয়েন্দাগিরি করছিস?”

“মোটেও না”।

“তোকে কি ঐ ইন্টারলোপারগুলো পাঠিয়েছে নাকি? ওরা কি জানে না আমার ব্যবসা চুরির চেষ্টা করার পরিণাম কি হতে পারে? যদি একবার ধরতে পারি তাহলে সবগুলো জাহাজ পুড়িয়ে দিয়ে ভারতের জেলে পচিয়ে মারবো।”

“প্লীজ,” বলতে গেলে ফ্রান্সিস, কিন্তু কিডনী বরাবর আর একটা ঘুষি পড়ায় থেমে যেতে হলো। “আমি ফ্রান্সিস কোর্টনী। আমার মা আমাকে পাঠিয়েছেন।”

স্যার নিকোলাসের চেহারা রাগে লাল হয়ে গেলো। “ফাজলামি করিস আমার সাথে? স্যার ফ্রান্সিস কোর্টনী কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর আগে মারা গিয়েছেন।”

“উনি আমার পরদাদা।” ফ্রান্সিস হন্তদন্ত হয়ে জামার ভিতর থেকে ভেলভেটের ব্যাগটা বের করার চেষ্টা করলো। প্রহরী দেখে ভাবলো ও বোধহয় কোনো অস্ত্র বের করছে। সে ফ্রান্সিসের পায়ে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো, সাথে সাথে আবার পা তুললো ওর বুকে লাথি মারার জন্যে।

ফ্রান্সিস ব্যাগটা বের করে আনলো। প্রহরী ওর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে, মুখটা খুলে ঝাঁকি দিতেই ভিতর থেকে সিংহখচিত পদকটা মেঝেতে গিয়ে পড়লো।

প্রহরী মারার জন্যে আবার হাত তুললো।

“থামো,” স্যার নিকোলাস বললেন। “দেখি আমি ওটা।”

লোক দুজন ফ্রান্সিসকে টেনে তুললো, আর একজন খানসামা সোনার সিংহটা তুলে নিয়ে ডেস্কের উপর রাখলো। স্যার নিকোলাস ওটা তুলে ধরলেন, মোমের আলোয় ওটায় খোদাই করা চুনি আর হীরাগুলো ঝিকিয়ে উঠলো।

“কোথায় পেয়েছিস এটা?” ফ্রান্সিসকে ধমক দিয়ে জানতে চাইলেন উনি।

“এটা আমাদের পরিবারের। আমার বাবা আমাকে এটা দিয়ে গিয়েছেন।”

স্যার নিকোলাস পদকটাকে উলটে পালটে দেখলেন কিছুক্ষণ, তারপর লোকদেরকে হাতের ইশারায় ফ্রান্সিসকে ছেড়ে দিতে বললেন।

“কে তুমি?” স্যার নিকোলাস আবার জিজ্ঞেস করলেন কথাটা। তবে এবার আর তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই।

ফ্রান্সিস সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নড়তেই সারা শরীরে অবর্ণনীয় ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে অগ্রাহ্য করলো সেটাকে। এই প্রশ্নটা শুনলে কি বলবে সেই কথাগুলো সারাদিন বার বার আওড়েছে ও। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে কথাগুলো বলতে হতে পারে সেটা কল্পনাও করেনি।

“আমি ফ্রান্সিস কোর্টনী, বাবা উইলিয়াম কোর্টনী। আর দাদা হচ্ছেন হাল কোর্টনী। ডার্টমাউথ এর ব্যারন আর অর্ডার অফ সেন্ট জর্জ অ্যান্ড দ্য হলি গ্রেইল এর নৌবাহিনির নাইট। বিশ বছর আগে আমার দাদা আপনার কোম্পানির জাহাজ রক্ষা করতে ফিয়ে জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। এখন আমি শুধু একটু সহায়তা চাচ্ছি। আমি কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ চাই।”

চিল্ডস এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন যেনো ও একটা প্রেতাত্মা।

“তোমরা যাও,” নিজের লোকদের আদেশ দিলেন উনি।

ওরা চলে গেলো। চিল্ডস আপাদমস্তক ফ্রান্সিসকে জরিপ করলেন। কয়েক যুগ ধরে উনি নিজের সম্পত্তির মতো করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেখাশোনা করছেন। এই লেডেনহলের অফিস থেকে শুরু করে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত নিজের হাতকে প্রসারিত করেছেন উনি। কতো রাজা, মন্ত্রী আসলো গেলো। কেউ কেউ দাবি করেছিলো কোম্পানি খুব বেশি ক্ষমতাধর হয়ে যাচ্ছে, এর ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু উনি তাদের প্রত্যেককে দেখে নিয়েছেন। একে একে তার প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হটিয়ে দিয়ে আজও টিকে আছেন, আর তাদের চাইতে বেশিদিন বেঁচেও আছেন।

কোর্টনীরাও অনেকেই এসেছে গিয়েছে। পরিবারটা একসময় খুবই ভালো কাজের লোক হিসেবে তাকে সেবা দিয়েছে এবং এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আর কাজ শেষ হওয়ার পর উনি ওনার শত্রুদের মতোই ওদেরকেও সহজেই সরিয়ে দিয়েছেন। এসব করতে ওনার এক ফোঁটা বিবেকে বাঁধেনি। বোম্বেতে ওনার নিজের বাড়িতে বসে উনি টম কোর্টনীকে ওর ভাই উইলিয়ামের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার ফাঁদ পাতেন। কিন্তু ওনাকে অবাক করে দিয়ে টম সেই ফাঁদ কেটে বেরিয়ে উল্টো উইলিয়ামকেই মেরে বসে। তবে তাতে চিল্ডসের কোনো সমস্যা হয়নি। টম ফেরারি হয়ে পালিয়ে যায় আর উইলিয়ামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাত শতাংশ ভাগ চলে যায় ওর শিশুপুত্রের উত্তরাধিকারে। আর এক বিধবাকে ফুসলিয়ে সেই ভাগটা তার কাছে বিক্রি করানোর জন্যে মোটেও কোনো কষ্ট হয়নি। ফলে কোম্পানির উপর তার প্রভাব এখন একচেটিয়া করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উনি এই ফ্রান্সিস কোর্টনীর কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলেন।

ছেলেটা এখন তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, প্রায় যুবক হওয়ার দশা। লোকগুলো ওর গলার যেখানে চেপে ধরেছিলো সেখানে একটা নীলচে দাগ হয়ে আছে। চেহারা ফ্যাকাশে কিন্তু তাতেও একটা চাপা আভিজাত্য ঠিকই প্রকাশ পাচ্ছে, যা চিল্ডস বিশ বছর আগে ওর দাদা হাল-এর মাঝে দেখেছিলেন। এই ছেলেটা তার খুব কাজেও লাগতে পারে, আবার তার জন্যে বিপজ্জনকও হয়ে দাঁড়াতে পারে।

“শোন বাছা,” উনি আগের চাইতে অনেক নরম আর স্নেহময় কণ্ঠে বললেন। “কাছে এসো যাতে তোমাকে আরো ভালো দেখতে পারি।”

উনি ইচ্ছে করে এমনটা করতে বললেন। ওনার শরীর নষ্ট হয়ে গেলেও নীল চোখজোড়া এখনো ওনার মস্তিষ্কের মতোই ক্ষুরধার আছে।

ফ্রান্সিস টলোমলো পায়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো।

“তোমার সাথে এরকম বাজে আচরণ করার জন্যে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি,” চিল্ডস বললেন। “আমার শত্রুদের গুপ্তচরের অভাব নেই। আরা আমাকে আর আমার কোম্পানির ক্ষতি করতে ওরা কিছুতেই থামবে না। খুব বেশি ব্যথা পাওনি তো, না?”

ফ্রান্সিস ওর হাতের পাশটা একটু ঘষলো। না দেখেও টের পাচ্ছে যে ওসব জায়গায় রক্ত জমাটবেঁধে গিয়েছে।

“আমি খুব ক্ষুধার্ত, মহামান্য।”

“আরে তাইতো।” চিল্ডস ওনার ডেস্কের কোনায় বসানো একটা বেল বাজালেন। তারপর ধমক দিয়ে একজন চাকরকে খাবার আনতে আদেশ দিলেন। “এখন বসো দেখি। আর আমাকে সব খুলে বলো। এখানে এলে কিভাবে? চিঠি লিখে যদি আসতে তাহলেতো তোমাকে এতো ঝামেলা পোহাতে হতো না।”

ফ্রান্সিস ব্যথা সামলে চেয়ারে বসলো। “আমার সৎ বাবা গত সপ্তাহে মারা গিয়েছেন। এই সোনার পদকটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি উনি।”

চিল্ডস একটা রুমাল দিয়ে নিজের প্রু মুছলেন। “শুনে খারাপ লাগলো। তোমার মা হয়তো কখনো বলেনি তোমাকে, কিন্তু আমি সবসময়েই তোমার বড় হওয়ার খোঁজখবর রেখেছি। আর তোমার বাবা যেভাবে মারা, গেলেন-আমার নিজেকেও ব্যাপারটার জন্যে দোষী মনে হয়। কারণ তোমার টম চাচা ঐ জঘন্য কাজটা করতে যাওয়ার আগে আমিই ছিলাম শেষ লোক যে তাকে দেখেছিলো। আমার সবসময়েই মনে হয়েছে যে আমি কি কিছু বলে বা করে ওর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারতাম? আমি কি একটু খেয়াল করলে ওর অভিসন্ধি ধরতে পারতাম আর ওকে আটকাতে পারতাম?”

বলতে বলতে কাশির দমকে বাকা হয়ে গেলেন উনি। রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন সাথে সাথে। রুমালটা সরাতেই দেখা গেলো ওটায় টকটকে তাজা রক্ত লেগে আছে।

“আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে আপনার কিছুই করার ছিলো না, স্যার, “ ফ্রান্সিস প্রতিবাদ করলো।

তবে ওর মায়ের বলা কথাগুলো মাথায় আসতেই ওর মনে একটা অসুস্থ চিন্তা আবার নাড়া দিয়ে গেলো।

“আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলতে পারি?”

“অবশ্যই। নিজের বাবা মতো ভাবতে পারো আমাকে।”

“বাড়ি ছেড়ে আসার আগে আমার মা খুব আজব একটা কথা বলেছিলেন। উনি বলেছিলেন যে উনি বিশ্বাস করেন টম চাচা নাকি আসলে নির্দোষ। উনি নাকি বাবাকে মেরেছিলেন নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে।”

চিল্ডস এতো জোরে মাথা নাড়লেন যে ওনার থলথলে থুতনী দুলতে লাগলো। “উনি ভুল ভেবেছেন। আসলে অধিক শোকে ওনার বুদ্ধি ঠিকমতো কাজ করছে না। বেচারী! উইলিয়াম কোর্টনী যেদিন মারা যায় আমি সেদিন তাকে হাউস অফ লর্ডসে দেখেছিলাম। নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে যে দুশ্চিন্তার কথা সেদিন ও বলেছিলো বা তার জন্যে যে ভালোবাসা আর স্নেহের ভাব আমি দেখেছিলাম সেটা ছিলো সম্পূর্ণ খাঁটি। সেদিনই উইলিয়াম আমাকে বলেছিলো যে ও টমকে দশ হাজার পাউন্ড দেবে, যাতে টম একটা জাহাজ নিয়ে ওদের ভাই ডোরিয়ানকে উদ্ধার করে আনতে পারে। ডোরিয়ানকে দস্যুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো-পরে জানা যায় যে ছেলেটা মারা গিয়েছে। তবে সেটায় টম কোর্টনীর লোভ মিটলো না। ও টেমসের ধারে উইলিয়ামকে পিছন থেকে আক্রমণ করে ওর বাবার সম্পত্তির আরো বেশি ভাগ দাবি করে। উইলিয়াম রাজি না হতেই ও নির্দয়ের মতো ওর গলা কেটে মেরে ফেলে।”

দৃশ্যটা কল্পনা করে ফ্রান্সিস শিউরে উঠলো। “আপনি নিশ্চিত?”

“এক মাঝি পুরো ঘটনাটা দেখেছিলো। ও আমাকে সব বলেছে। এমনকি এতোদিন পরেও আমার সব মনে আছে।”

একজন চাকর দরজায় আঘাত করে একটা রূপার ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকলো। তারপর খাবারের পাত্রগুলো চিল্ডসের ডেস্কে নামিয়ে রাখলো। ঝলসানো মাংস দেখা গেলো ওগুলোয়। দুই গ্লাস ক্লারেট মদ ঢেলে দিয়ে সে বিদায় নিলো। ফ্রান্সিস আর দেরি না করে বলা চলে ঝাঁপিয়ে পড়লো খাবারের উপর।

চিল্ডসও প্রায় ফ্রান্সিসের মতোই বুভুক্ষের মতোই খেতে লাগলেন। ওনার গাল বেয়ে ঝোল পড়ে জামার সামনের দিকটা ভরে গেলো।

“তুমি কি বাবার মৃত্যুর বদলা নিতে চাও?” প্রশ্নটা করতে গিয়ে চিল্ডসের মুখ থেকে খাবারের কণা ছুটে বেরিয়ে এলো। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলা শুরু করলেন, “অবশ্যই তুমি চাও। তুমি একজন কোর্টনী। আর তোমার শরীরে কেমন রক্ত বইছে সেটা আমার ভালোই জানা আছে।”

ফ্রান্সিস ঢাকাঢক করে খানিকটা ওয়াইন গিললো। “জ্বী স্যার। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।”

“আজ এখানে তোমার উপস্থিতি আমি ভাগ্যের খেল ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছি না; যেনো তোমাকে তোমার কপালই এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। এক সপ্তাহ আগে একটা জাহাজ ভারত থেকে ডেপ্টফোর্ডে নোঙ্গর করে। নাম ডাওজার। ক্যাপ্টেনের নাম হচ্ছে ইঞ্চবার্ড। ওর কাছে থেকে সেই একটা ঘটনা শুনলাম আমি। বোম্বে থেকে রওনা দেওয়ার বাইশ দিন পরে, মাদাগাস্কারের কাছাকাছি ওদের জাহাজকে দস্যুরা আক্রমণ করে বসে। ওরা প্রায় দখল করেই ফেলেছিল জাহাজটা। প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় সেদিন। কিন্তু ওরা যখন প্রাণপণ লড়াই করছিলো তখন একটা ছোট জাহাজ ওদের সাথে যোগ দেয়। আর ওটার ক্যাপ্টেন ছিলো আমাদের টম কোর্টনী।”

ফ্রান্সিসের মনে হলো ঘরটা ওর চারপাশে দুলছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো যেনো ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ওয়াইন ওর মাথায় চড়ে বসছে। “এ কিভাবে সম্ভব? টম কোর্টনীতে অনেক আগেই আফ্রিকায় মারা গিয়েছেন। আমার গাই চাচা বলেছেন সেটা।”

“তোমার চাচা ভুল জেনেছিলেন। টম কোর্টনী বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। আফ্রিকার উপকূলে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছে। ইঞ্চবার্ডের ধারণা সমুদ্রে না বের হলে সে কেপ টাউনে থাকে।”

চিল্ডস তার কাটা চামচ আর ছুরি নামিয়ে রাখলেন। “তুমি কোম্পানিতে একটা চাকরি চেয়েছিলে। তোমার দাদার জন্যে যে ভালোবাসা আমার আছে, বা তোমার পরিবারের সাথে আমাদের যে দীর্ঘ সম্পর্ক সেটার জন্যে আমি তোমাকে খুশি মনে তোমার গাই চাচার সাথে একটা কেরানির চাকরি দিয়ে দিতে পারি। আমাদের একটা জাহাজে করে তুমি ফ্রি-তেই যেতে পারবে ভারত। কিন্তু আমি তোমাকে এর চাইতে ভালো কিছু দিতে পারি। জাহাজকে বলবো কেপ টাউন হয়ে বোম্বে যেতে। ছোটখাটো মেরামত আর রসদ সংগ্রহ করতে ওখানে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। যদি তুমি চাও তো জাহাজ থেকে নেমে তোমার চাচাকে খুঁজে বের করতে পারো।”

ফ্রান্সিস আরো এক টুকরো মাংস গিলে নিলো। এতোগুলো খবরের ধাক্কা সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। চিল্ডস সামনে ঝুঁকে এলেন। ওয়াইনের কারণে তার ঠোঁট রক্তের মতো লাল হয়ে আছে।

“টম কোর্টনী যখন ইংল্যান্ড ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন আমরা ওকে ধরার জন্যে পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই পুরস্কারের জিম্মা নিচ্ছি। এখনো সেটা বলবত আছে। পাঁচ হাজার পাউন্ড।” আবার বললেন চিল্ডস। “যে কোনো মানুষের জন্যে বিশাল একটা টাকা, আর তোমার মতো বয়সীর কথা তো ছেড়েই দিলাম। আর টাকাটা যদি তুমি বোম্বেতে ঠিকমতো খাটাতে পারো তাহলে ফিরতে ফিরতে তুমি এটা দ্বিগুণ কি তিনগুণ-ও করে ফেলতে পারবে।”

ফ্রান্সিস টাকার অঙ্কটা একবার কল্পনা করার চেষ্টা করলো। বিশাল একটা গাড়িতে করে হাই উইল্ডে ফিরে আবার বাড়িটা দখল নেওয়ার কথা ভাবলো। ওর মাকে আবার ওখানকার কত্রী হিসেবে দেখার কথা ভাবলো। জায়গাটাকে আবার সেই ছোট বেলার মতো আনন্দ আর খুশিতে ভরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলো।

ওয়াইন খাওয়ার কারণে ওর গরম লাগতে লাগলো। ও জানে যে এরকম অনেকক্ষণ উপোস থাকার পর এভাবে দ্রুত পান করা ঠিক না, কিন্তু ও থামাতে পারছিলো না। ও বুঝতে পারছিলো যে ওর আরো কিছু প্রশ্ন করা দরকার, গাই টম আর ওর উত্তরাধিকারের ব্যাপারে। কিন্তু চিল্ডসের স্বর শুনে বোঝা গেলো এ ব্যাপারে উনি আলাপ করতে আগ্রহী না। উনি যখন আরো ওয়াইন ঢেলে দিলেন ফ্রান্সিস কৃতজ্ঞচিত্তেই সেটা খেয়ে নিলো।

“এই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেই তুমি সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করছো,” চিল্ডস বললেন। “আমাদের দুজনেরই পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আদায় হবে এবার।”

সেন্ট জর্জের পদকটা তখনো টেবিলেই পড়ে আছে, অর্ধেকটা এক তাড়া কাগজের নিচে ঢাকা। ফ্রান্সিস ওটা তুলে নিতেই চিল্ডসের চেহারা বেজার হয়ে গেলো, কিন্তু ফ্রান্সিস সেটা খেয়াল করলো না। এতোটা মদ খেয়ে ও এখন ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না।

“আমার বাবার ইজ্জতের কসম, স্যার নিকোলাস। আমি টম কোর্টনীকে খুঁজে বের করে তাকে তার উপযুক্ত শাস্তিই দেবো।”

*

টম আর ডোরিয়ান পানশালার বাইরে বসে আছে। মাঝে মাঝে পানপাত্রে চুমুক দিচ্ছে আর টেবিল উপসাগরে নোঙ্গর করে থাকা জাহাজগুলোর দিকে নজর বুলাচ্ছে। টম খাচ্ছে মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত ওয়াইন, তবে ডোরিয়ান ওর নতুন গ্রহণ করা ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের মদ জাতীয় পানীয় পরিহার করে চলে। তাই ও খাচ্ছে কমলার রস। ওদের পিছনে টেবিল পর্বত আকাশ জুড়ে আঁকারাকা রেখা টেনে ফুটে আছে। ডেভিলস পিক আর লাতনক পিক এর ছোট চূড়াগুলো উপসাগরকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, মনে হচ্ছে কোনো প্রাকৃতিক গ্যালারি। পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলের নিচে প্রায় শ-খানেক সাদা রঙ করা পাথুরে বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উত্তর প্রান্তে একটা দুর্গ, নেদারল্যান্ডের তিনরঙ্গা পতাকা উড়ছে সেখানে। দুর্গে পাঁচটা গম্বুজ। দেখেই বোঝা যায় এই উপনিবেশে কারা ক্ষমতাবান।

একটা ইন্ডিয়াম্যান (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ) হেলে দুলে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। গায়ের রঙ আর দড়াদড়ির অবস্থা দেখে টম বুঝলো ওটা ইংল্যান্ড থেকে এবারই প্রথম সমুদ্র নামানো হয়েছে। জাহাজটার আগমনের ফলে কি কি হতে পারে সে ব্যাপারে দ্রুত হিসাব করে নিলো টম। আইভরির দাম বেড়ে যাবে, কারণ এই ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভারত পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে রসদপত্র কিনবে; বিনিময়ে ওরা দেবে ইংল্যান্ড থেকে আনা ছুরি আর ইস্পাতের পাত্র। জাহাজটা দেরি করে এসেছে, বেশিরভাগ আইভরিই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তবে টম গতবারের অভিযান থেকে আনা কয়েকটা হাতীর দাঁত কি মনে করে যেনো রেখে দিয়েছিলো। এখন এদের কাছে কতোটা লাভ করতে পারবে সেই চিন্তা মাথায় আসতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো ওর।

একটু পরেই টম আর ডোরিয়ান, ওরা যে বোর্ডিং হাউসটায় উঠেছে সেটায় ফিরে যাবে। কেপ টাউনে ওরা সবসময় ওখানেই থাকে। আমস্টারডাম ব্যাঙ্কের একটা অফিস আছে এখানে। সেটায় দশ হাজার পাউন্ড জমা আছে টমের, কিন্তু ও সেটা দিয়ে নিজের বাড়ি বানানোর চেষ্টা করেনি কখনো। ডাচ কর্তৃপক্ষ ভিনদেশী কাউকে এই উপনিবেশে বাড়ি বানানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তবে জায়গা মতো কিছু রিক্স-ডলার (সাউথ আফ্রিকার তৎকালীন মুদ্রা) ছাড়লেই নিষেধের বেড়াজাল আলগা হয়ে যায়। টম অবশ্য কখনো চেষ্টা করেনি। বছরের পর বছর ধরে ও মৌসুমের শেষ সময়টা এই বোর্ডিং হাউসেই কাটিয়ে দেয় আর ধৈর্য ধরে পরের মৌসুম শুরুর অপেক্ষা করে।

“বিরক্ত হয়ে গিয়েছে নাকি টম?” ডোরিয়ান জিজ্ঞেস করলো। জবাবে টম ওর হাত সামনে বাড়িয়ে পাহাড়, সমুদ্র, আর তার উপরের তুলোর পেজার মতো মেঘ আর দিগন্তে ডুবতে বসা সুর্যের দিকে দেখালো। “এতো কিছু থাকার পরেও বিরক্ত কিভাবে হই বলো তো?”

“আমি তোমাকে খুব ভালোই চিনি, ভাইয়া,” মৃদু হেসে বললো ডোরিয়ান “ঐ দস্যু লেগ্রাঞ্জের হাত থেকে ডাওজারকে উদ্ধার করে আনার পর থেকে তুমি একটা বারও বন্দুকের গুলি ছোড়োনি। আর সেটাও ঘটেছিলো প্রায় এক বছর আগে।”

এবার আফ্রিকায় হাতীর দাঁত সংগ্রহের অভিযানটা ছিলো একেবারেই সাদামাটা। টম আর ডোরিয়ান জাম্বেসি নদীর প্রায় দুইশো লীগ পর্যন্ত ভিতরে অভিযান চালায়, কিন্তু এর আগে যেসব দাস ব্যবসায়ীদের সাথে ঝামেলা বেধেছিলো তাদের কারো সাথেই এবার আর দেখা হয়নি। এমনকি শিকারও বিগত বছরগুলোর মতো হয়নি। সেন্টারাস এবার মাত্র অর্ধেক খোল ভরে আইভরি নিয়ে ফিরে এসেছে।

“ঝামেলায় জড়ানো ব্যবসার জন্যে ক্ষতিকর,” দৃঢ় বিশ্বাসীর ভঙ্গিতে বললো টম।

তারপর দিগন্তে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলো ও। চোখ পিট পিট করে দেখলো কয়েকবার। যেখানে সূর্যের শেষ কিরণটাও মিলিয়ে যাচ্ছিলো সেখানে এমন সবুজ একটা রঙ দেখা গেলো যা টম এর আগে কখনোই দেখেনি। একেবারে চমকে গেলো ও; যদিও এরকম ঘটনার কথা আগেও শুনেছে, কিন্তু এবারই প্রথম চাক্ষুষ দেখার ভাগ্য হলো।

“ব্যাপারটা দেখেছো?” টম জিজ্ঞেস করলো। দুজনেই উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাকিয়ে আছে দূর দিগন্তে।

“তা আর বলতে!” ডোরিয়ানও সমান উত্তেজিত হয়ে আছে। “এটাকে বলে নেপচুন-এর চোখ টিপ।” এটাও একটা রহস্য-ঠিক সেন্ট এলমোর আগুন-এর মতো। পৃথিবীর দুর্গম সমুদ্রগুলোয় যাত্রা করলে নাকি মাঝে মাঝে দেখা যায় সেটা।

“আমি শুনেছি যারা এটা দেখে তারা নাকি বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়, আবার চেয়ারে বসতে বসতে আগ্রহের সাথে বললো টম।

“তোমার জন্যে তাহলে ভালোই হবে,” ডোরিয়ান ফোড়ন কাটলো। “এখন যা আছে সেটা তো বহু আগেই ব্যবহার করে শেষ করে ফেলেছে।”

প্রত্যুত্তরে টম হেসে ওর গ্লাসের তলানিটুকু ডোরিয়ানের মাথায় ঢেলে দিলো। “বড় ভাইয়ের সাথে বেয়াদবির শাস্তি স্বরূপ এখন আর এক গ্লাস ওয়াইন কিনে নিয়ে আসো।”

ডোরিয়ান বার থেকে টমের জন্যে আর এক গ্লাস পানীয় এনে টেবিলের উপর রাখলো, তারপর আবার চুপচাপ দুজন তারিয়ে তারিয়ে নৈঃশব্দটা উপভোগ করতে লাগলো। একটু পরেই দেখা গেলো ইন্ডিয়াম্যানটা ঘাটে এসে নোঙ্গর ফেললো।

অন্ধকার পানিতে নোঙ্গর ফেলার ঝপাস শব্দ হতেই তীর থেকে ঝাক বেঁধে নৌকা ছুটে গেলো জাহাজটার দিকে। ঠিক মায়ের দুধ খেতে ছাগলের বাচ্চা যেভাবে ছুটে যায়।

“এরা সকালের আগে মালপত্র ডাঙ্গায় আনবে না,” টম বললো। “এদের কাছে কি কি বেঁচা যায় সেটা আগে পরখ করে নিলেই ভালো হবে।”

টম পানীয়ের দাম হিসেবে একটা কয়েন টেবিলের উপর রাখলো, তারপর দুজন মিলে আবার পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললো। রাস্তাটার নাম হচ্ছে ডাই হেরেংগ্ৰাচ (Die Heerengracht), অর্থ ভদ্রলোকের রাস্তা। কোম্পানির বাগান থেকে প্যারেড গ্রাউন্ড পর্যন্ত লম্বা রাস্তাটা। দুজনে কথায় মশগুল থাকায় উল্টো দিক থেকে আসা মহিলাটাকে খেয়াল করলো না কেউই। একেবারে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার উপক্রম হতে টের পেলো দুজন।

“টম কোর্টনী?” মেয়েটা বললো। চেহারায় নিখাদ বিস্ময়।

“অ্যানা দুয়ার্তে?” টম জবাব দিলো। ওর চেহারাও খুশিতে ভরে গিয়েছে।

“আমাকে মনে আছে আপনার?”

“আপনাকে কিভাবে ভুলি বলেন? মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি আর আমার ভাই, মাত্রই আপনার সাথে যেদিন দেখা হয়েছিলো সেদিনের কথা আলাপ করছিলাম। কিন্তু আপনি যে কেপ টাউনে সেটা জানা ছিলো না।”

“আমার জাহাজ দুই দিন আগে মাদ্রাজ থেকে এসেছে।”

“এবার নিশ্চয়ই গতবারের মতো কিছু হয়নি?”

মেয়েটা নিজের গলায় ঝুলানো একটা রুপালি ক্রুশ চেপে ধরে বললো, “না, ভাগ্যটা এবার ভালো ছিলো।”

আচমকা টমের ঐ সবুজ দ্যুতিটার কথা মাথায় এলো। যদিও ও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, কিন্তু কেনো যেনো মনে হলো ওটা এই অপ্রত্যাশিত মোলাকাতটাকেই ইঙ্গিত করেছিলো বোধহয়।

“আজ রাতে আমাদের সাথে খেতে হবে,” ডোরিয়ান বলে উঠলো। “সারাহ আর ইয়াসমিনি আপনাকে দেখে খুব খুশি হবে।”

“তাহলেতো খুবই ভালো হয়,” অ্যানা হাসলো। “সত্যি কথা হচ্ছে আমি নিজেই চাচ্ছিলাম আপনাদের সাথে বসতে। আমার পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব আছে আপনাদের জন্যে।”

 ২. কোর্টনীদের বোর্ডিং হাউস

কোর্টনীদের বোর্ডিং হাউসটা শহরের একদম শেষ মাথায়, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাগানের দেয়ালের ঠিক নিচে। ওদের মালয় হাউসকীপার মিসেস লাই সবসময় ঝেড়ে পুছে তকতকে করে রাখে জায়গাটা। ওনার রান্না সাধারণ কিন্তু স্বাদ দারুণ। তার বড় একটা কারণ সম্ভবত টমের পরামর্শ মতো উনি ইংলিশ খাবার ভারতীয় মশলা দিয়ে রান্না করেন তাই।

বোতল থেকে এক গ্লাস ওয়াইন ছেলে নিলো টম। ডোরিয়ান আগের মতোই ফলের রস খেলো শুধু।

“আপনি ওয়াইন খান না?” অ্যানা খেয়াল করলো ব্যাপারটা।

“আমি মুসলিম।”

“ইংল্যান্ডে কি অনেক মুসলমান আছে নাকি?”

“উমম… সেটা আসলে এক লম্বা কাহিনি।”

“তবে অনেক ভালো একটা কাহিনি কিন্তু, টম বললো।

“তাহলেতো সেটা শুনতেই হয়,” অ্যানা বললো।

অ্যানার আগ্রহ দেখে ডারিয়ান নিজের জীবন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে যতটা সম্ভব বললো ওকে। কিভাবে ও মাত্র এগারো বছর বয়সে আরব দস্যুদের হাতে বন্দী হয়, তারপর কিভাবে ওমানের এক প্রিন্স ওর লাল চুলের জন্যে ওকে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান, কারণ নবী মুহম্মদেরও (স.) নাকি চুল লাল ছিলো। ক্রীতদাস হলেও প্রিন্সের বাড়িতে ও একজন পালিত পুত্রের মতোই বড় হয়। একজন মুসলিম সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে করতে বড় হয়ে শেষমেশ এই বিশ্বাসটাকেই গ্রহণ করে ও।

অ্যানা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ডোরিয়ানের সব কাহিনি শুনলো। ডোরিয়ানের বলা শেষ হলে পরে শান্ত স্বরে বললো, “আপনাদের সবার মাথার জন্যেই দেখি দাম ধরা আছে!”

“তুমি কিভাবে জানো?” টম জানতে চাইলো। সম্বোধন বদলে গিয়েছে ততোক্ষণে।

“মাদ্রাজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ভালোই জানাশোনা আছে আমার। ওদের কাছ থেকে জেনেছি যে বোম্বের গভর্নরের নাম গাই কোর্টনী। আর একটু খোঁজ খবর করতেই জানতে পারি যে আপনারা আত্মীয়।”

টম আর ডোরিয়ান অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলো।

“গাই আমাদের ভাই,” টম স্বীকার করলো। “তবে ও জানে যে ডোরিয়ান ওমানে মারা গিয়েছে আর আমি আফ্রিকার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছি।”

“ওনাকে জানাননি যে আপনারা বেঁচে আছেন?”

“খবরটা পেলে গাই মোটেও খুশি হতো না। সত্যি কথা হচ্ছে আমরা মারা যাওয়াতেই বরং ও বেশি খুশি।”

অ্যানা নিজের গ্লাসে চুমুক দিলো। যেনো কথাটা খুবই স্বাভাবিক। “থাক, আপনাদের মাঝে কি হয়েছিলো সেটা জানতে চাই না।” অনুচ্চ স্বরে বললো ও।

“মেয়ে সংক্রান্ত ব্যাপার, ডোরিয়ান সরাসরি বলে দিলো।

“আর মেয়েটা হচ্ছে আমার বোন, প্রথমবারের মতো কথা বললো সারাহ। “ডোরিয়ান যেবার দস্যুদের হাতে ধরা পড়ে, সেই জাহাজে আমরাও ছিলাম। আমি তখনও ছোট কিন্তু আমার বড় বোন ক্যারোলিন ছিলো পূর্ণ যুবতী। বোকা মেয়ে; ও আসলে নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে বেড়াতে পছন্দ করতো। বলা যায় একেবার স্বেচ্ছায় ও টমের সাথে শোয়।”

“পাউডার ম্যাগাজিন রাখার জায়গাটায়, তাই না?” শয়তানি হাসি হেসে বললো ডোরিয়ান। “জাহাজে শুধুমাত্র ওখানেই একটু নিরিবিলি ছিলো।”

“ভুলটা আসলে ছিলো আমার,” টম বললো। অ্যানার সামনে এরকম একটা ঘটনা ফাস হয়ে যাওয়ায় বিব্রত। “আমার আসলে বোঝা উচিত ছিলো যে গাই ওকে ভালোবাসে।”

“গাই মোটেও ক্যারোলিনকে ভালোবাসতো না,” সারাহ বললো। “গাই ওকে শুধু নিজের কর্তৃত্বে রাখতে চাইতো। ঠিক যেভাবে মানুষ নিজের গাড়ি ঘোড়া বা এক ব্যাগ স্বর্ণকে অধিকারে রাখে। বিয়ে করার পর থেকেই গাই আর ক্যারোলিনকে কোন দাম দিতো না। তুমি ভুলে গিয়েছে যে ওদের বিয়ের পর আমি অনেকদিন ওদের বাসায় থেকেছি। গাই ওর সাথে কেমন ব্যবহার করে সেটা আমার নিজের চোখে দেখা।” বলতে বলতে চোখ বন্ধ করে ফেললো সারাহ। “ও মোটেও ক্যারোলিনকে ভালোবাসতো না, খোদা সাক্ষী।”

“আর উনিতো ক্যারোলিনকে বিয়ে করেই ফেলেছেন, তবুও আপনার সাথে ঝামেলা মেটেনি?” অ্যানা টমকে জিজ্ঞেস করলো।

“আসলে আরো কিছু ব্যাপার ছিলো। মানে…” টম আর বলতে পারলো না। কিছু কিছু ব্যাপার আসলে অ্যানার সাথে আলাপ করা সম্ভব না।

কি করেছি আমি? নিজেকে জিজ্ঞেস করলো টম। এক ভাইকে খুন করেছি, আর একজনও আমার মরণ চায়। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দুটো ভুল, আর সেগুলো শোধরানোরও আর কোনো উপায় নেই।

আবার ওর আগের রাতে দেখে সবুজ ঝলকটার কথা মনে হলো। খোদা আমাকে জ্ঞান দাও।

অ্যানা বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। “প্রতিটা পরিবারেই কিছু গোপনীয় ব্যাপার থাকে।”

“তবে তুমি কিন্তু খুবই সাহসী,” অ্যানাকে বললো সারাহ। প্রসঙ্গ পাল্টে পরিবেশ হালকা করতে চাচ্ছে। এই দুজন দাগী আসামীর সাথে বসে খাবার খাচ্ছো!”

“আপনারা আমার জীবন বাঁচিয়েছেন, আপনারা সবাই!” টেবিলের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো অ্যানা। “আপনাদের কিন্তু কোনো দরকার ছিলো না। আপনারা চাইলেই আমাদেরকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারতেন। একশো জনে নিরানব্বই জন লোকই সেই কাজটাই করতো।”

“কারণ একশো জনের মধ্যে নিরানব্বই জনেরই সারাহ বা ইয়াসমিনির মতো কেউ নেই যারা তাদেরকে বলে দেবে যে কোন কাজটা অবশ্যই করতে হবে,” হেসে বললো ডোরিয়ান। “আমরা কিন্তু যেতে চাইনি!”

আলাপ চলতে থাকলো। রাতের খাবারের পরে সবাই বসার ঘরে গিয়ে বসলো। সারাহ সবাইকে উইলিয়াম বাবেল-এর বুক অফ লেডিজ এন্টারটেইনমেন্ট-এর একটা অংশ হার্প-এ বাজিয়ে শোনালো। টম সেই ইংল্যান্ড থেকে এটা অর্ডার দিয়ে আনিয়েছে।

“আমার আগের হাপটা টম নদীতে ফেলে দিয়েছে, বাজানোর ফাঁকে অ্যানাকে জানালো সারাহ।

“পুরো কথাটা তো বলল না। আমাদের জাহাজ যে একটা চরে আটকা পড়েছিলো সেটা তো বললে না! একদল আরব যে আমাদেরকে খুন করার জন্যে পিছু নিয়েছিলো সেটা মনে নেই? মরতে মরতে বেঁচেছিলাম সেবার, ডোরিয়ান বললো। মেঝেতে একটা কুশন পেতে বসে আছে ও।

“আমি নিশ্চিত মিস দুয়ার্তে ঠিকই বুঝেছেন যে পরিস্থিতি এরকম কিছু একটাই ছিলো,” ইয়াসমিনি বললো।

সারাহ আরো কিছুক্ষণ বাজিয়ে একটা ঝঙ্কার তুলে বাজানো থামালো। হাত তালি দিয়ে উঠলো বাকিরা। সারাহ গিয়ে টমের পাশে বসলো।

“মিস দুয়ার্তে,” টম বলা শুরু করলো। “কাল যখন দেখে হয়েছিলো তখন বলেছিলে যে আমাদের জন্যে নাকি কি একটা প্রস্তাব আছে?”

অ্যানা হাত দিয়ে ডলে নিজের কাপড় সোজা করলো। এই ঘরের বাকিদের চাইতে ও কমপক্ষে বারো বছরের ছোট। কিন্তু ওর শান্ত শিষ্ট ভাব দেখে সেটা মনে হয় না।

“ভারত সম্পর্কে কি জানেন?” টমকে জিজ্ঞেস করলো অ্যানা।

টম হাতের ওয়াইনের গ্লাসটা নাড়লো কিছুক্ষণ। তলানির দিকে তাকিয়ে আছে। “বেশি কিছু না। নাবিকদের কাছে যা শুনেছি তাই। বুড়ো সম্রাট মারা যাওয়ার পর থেকে নাকি দেশটার অবস্থা বেশি সুবিধার না।”

“বৃদ্ধ আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর থেকে দেশটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে আছে,” অ্যানা-ও সায় দিলো কথাটায়। তার তিন পুত্র উত্তরাধিকার নিয়ে লড়াই করেই যাচ্ছে। আর যখনই ওরা যুদ্ধ শুরু করে, তখন দেখা যায় অন্যান্য জমিদার বা নবাবেরাও প্রতিবেশীকে আক্রমণ করে বসে। পশ্চিম দিকে মারাঠারা নিজেদের পাহাড়ের দুর্গ থেকে প্রায় তিরিশ বছর ধরে মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। মালাবার উপকূলে দস্যু আংরিয়া নিজের একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। টিরাকোলার দুর্ভেদ্য এক দুর্গ থেকে ও রাজ্য চালনা করে। দক্ষিণের সব নবাবেরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বলা যায় মুঘল সাম্রাজ্য একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।”

“ব্যবসার জন্যে খারাপ,” ডোরিয়ান মন্তব্য করলো।

টম কিছু বললো না তবে অ্যানা ইতস্তত করতে লাগলো। যেনো এরপরে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

“প্রস্তাবটা দেওয়ার আগে মনে হয় আমার আসলে নিজের আর আমার পরিবার সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া উচিত। আমার বাবা ছিলেন এক পর্তুগীজ ব্যবসায়ী। উনি ভারতে গোয়াতেই বসত গাড়েন। আমার মা ছিলেন ভারতীয়। স্থানীয় মানসবদারের মেয়ে। দুই পরিবারের কেউই বিয়েটা মেনে নেননি, তাই তারা মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ দুর্গে পালিয়ে যান। ওটা ছিলো ব্রিটিশদের অধীনে। কপর্দকহীন অবস্থায় শুরু করলেও কঠোর পরিশ্রমের জোরে ধীরে ধীরে তারা কাপড়ের ব্যবসায় প্রচুর উন্নতি করেন। মাদ্রাজের তাঁতিদের কাছে থেকে সুতি কাপড় কিনতেন তারা, তারপর সেগুলো ইউরোপে রপ্তানি করতেন। প্রথম প্রথম অবশ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে-ই বিক্রি করতেন, কিন্তু কোম্পানি বরাবরই প্রচণ্ড লোভী; ওরা আমাদেরকে দামে কম দিতো। বাবা তাই বিকল্প রাস্তা খুঁজে বের করেন। উনি এক ড্যানিশ জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের মালগুলো বয়ে নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করেন।

“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্ট গাই কোর্টনীর কানে পৌঁছে যায় ব্যাপারটা। যেসব ব্যবসায়ীরা কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তাদেরকে ওরা কি বলে জানেন? ইন্টারলোপার।” থুতু ছিটানোর মতো করে কথাটা বললো অ্যানা। “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন মনে করে যে এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আসলে ওদের সাজানো বাগানে ঢুকে পড়া সাপ বাদে আর কিছু না। তাই প্রেসিডেন্ট জলদস্যুদের জানিয়ে দেন যে আমাদের জাহাজ কোথা থেকে ছাড়বে। কেপ কর্মোরিনের কাছে ওরা আমাদেরকে আক্রমণ করে বসে। একটা লোকও বেঁচে ফিরতে পারেনি।

“আমার বাবা তার সব পুঁজি ঐ অভিযানটায় খাঁটিয়েছিলেন। এতো বড় ঝুঁকি জানার পরেও। যদি ব্যাপারটা কোনো দুর্ঘটনা হতো তাহলে বাবা এই ধাক্কা সামলাতে পারতেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কোর্টনী শুধু ঐটুকু করেই ক্ষান্ত দেননি। উনি আমাদেরকে ওনার বাড়িতে ডেকে নিয়ে মুখের সামনে ঘোষণা দিয়ে জানান যে উনি কি কি করেছেন। এটা নাকি আমাদের আর বাকিদের প্রতি একটা সতর্কবার্তা। আমাদের কিছুই করার ছিলো না, ন্যায় বিচার পাবো সেই আশাও ছিলো না। প্রেসিডেন্টই ওখানে আইন।

“বাবা এর কয়েক মাস পরেই মারা যান। প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েছিলেন উনি।” বলতে বলতে কেঁপে গেলো অ্যানার কণ্ঠ। সারাহ ওর কাধ চেপে ধরলো। “এরপর থেকে আমিই ব্যবসা দেখাশোনা করি। সেজন্যেই ডাওজারে উঠেছিলাম। ক্যাপ্টেন আমার মালগুলো বহনের জন্যে অনেক বেশি ভাড়া হেকেছিলেন। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম যে একটা ইন্ডিয়াম্যান-এ চাপলে যাত্রাটা নিরাপদ হবে।”

“এই দস্যুদেরকেও কি তোমার কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো নাকি?”

“না, ওটা ছিলো দুর্ভাগ্য।”

অ্যানা নিজের হাতের আঙুলগুলো একটা আর একটার ভিতরে ভরলো। “আমার কথা হচ্ছে, আমিও আপনাদের মতোই ব্যবসায়ী। আমি আমার মালগুলো সবচে কম খরচে বাজারে আনতে চাই, যাতে সবচেয়ে ভালো দামে বেচতে পারি। মাদ্রাজ থেকে কেপ টাউনে নিরাপদে মাল আনতে গেলে ব্রিটিশদের চাঁদা দেওয়া লাগে, ডাচদের চাঁদা দেওয়া লাগে, দস্যুদের চাঁদা দেওয়া লাগে, মুঘল সম্রাটদের চাঁদা দেওয়া লাগে। এরপরও জাহাজটা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাবে সেই নিশ্চয়তা নেই। কামান দাগার জন্যে আমাকেই লোক রাখতে হয়, আবার সুরক্ষা তহবিলেও চাঁদা দিতে হয়… এতো খরচের পরে আর সেটা আর সম্ভব হয় না।”

“তুমি চাও আমি তোমার মাল বহন করি?”

“এটা শুধু আমার জন্যে না। ভারত মহাসাগর দস্যুতে গিজগিজ করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলো, মানে শুধু ইংলিশ আর ডাচদের জাহাজের ক্ষমতা আছে ওদেরকে আটকানোর। কিন্তু এর জন্যে কোম্পানিগুলো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা টাকা নেয়। তবে কথা হচ্ছে, লন্ডনে, আমস্টারডামে বা অস্টেন্ডে বা এরকম আরো ডজনখানেক শহরে আরো অনেক সওদাগর, দালাল আর ব্যবসায়ী আছে যারা আরো সহজ শর্তে এসব ব্যবসায়ে অর্থ লগ্নি করতে রাজি, শুধু যদি তারা এই জাহাজের নিরাপত্তার ব্যপারে নিশ্চয়তা পেতো তাহলেই হয়।

“ইংল্যান্ড থেকে ভারত পর্যন্ত সরাসরি মাল পরিবহনের ব্যবসাটায় আসলে একচেটিয়া রাজত্ব চলছে। ভারতীয় মহাসাগরের বন্দরগুলোয় ব্যবসা পুরোপুরি উন্মুক্ত। যাত্রাটাকে যদি তাই দুই ভাগে ভাগ করা যায়, মানে মালগুলোকে যদি কেপ টাউনে একবার খালাস করা যায়, তাহলে আর এই একচেটিয়া কারবারটা থাকে না। এভাবেই আমি ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ডকে আমার মাল নিতে রাজি করিয়েছিলাম। আপনি যদি ভারত সাগরের এই ঝুঁকিটা নিতে রাজি হন, তাহলে ইউরোপের ব্যবসায়ীরা আপনাকে ভালো পরিমাণ টাকা দেবে। আবার ভারতের ব্যবসায়ীরাও আপনার কাছে ভালো জিনিস বিক্রি করবে, কারণ আপনি কোম্পানির চাইতে বেশি টাকা দেবেন। কিন্তু এরপরেও লাভ ভালোই থাকবে।”

“VOC, মানে দ্য ডাচ ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানি কেপ টাউনের সমস্ত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।”

“আর ওদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজদের ব্যবসাকে দুর্বল করে এরকম যে কোনো উদ্যোগকে ওরা স্বাগতম জানাবে।”

“আমাদেরকে কিন্তু দস্যুদের মোকাবেলা করতে হবে,” টম বললো।

“আপনারা দস্যুদের সাথে কিভাবে লড়েন সেটা আমি দেখেছি। আর শুধু ভারত কেন?” অ্যানা ডোরিয়ানের দিকে ফিরলো। “আপনার পালক বাবা না ওমানের খলিফা বললেন? লামু, মাস্কাট, মোকা বা গন এর মতো আরব বন্দরেও নিশ্চয়ই এরকম অনেক লোক আছে যারা আপনাকে বিশ্বাস করে। আপনি ওদের ভাষাতেই কথা বলেন, ওদের ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করেন।”

“আগের খলিফা ছিলেন আমার পালব বাবা। বর্তমান খলিফা আমার পালক ভাই। তবে সে আমাকে ঠিক ততোটা ঘৃণা করে, যতোটা ঘৃণা গাই টমকে করে। নিজের লাল দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো ডোরিয়ান। “তবে… পরিচিত অনেকেই আছে এখনো।”

“যদি শুধু ঠিকঠাক একবার কাজটা করা যায়, তাহলে পুরো সাগর বাণিজ্যের মালিক হয়ে যাবেন আপনারা।”

প্রস্তাবটা নিয়ে সবাই ভাবনা চিন্তা করত লাগলো।

“আমরা ভেবে দেখবো,” টম বললো। “আমি কাল তোমাকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানবো।”

*

ডোরিয়ান অ্যানাকে ওর থাকার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলো। বোর্ডিং হাউজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদেরকে চলে যেতে দেখলো টম। খাওয়া শেষে ও একেবারে গলা পর্যন্ত পান করেছে, তবে মাথা এখনো পরিষ্কার। ভালোভাবে চিন্তা করার জন্যে শুধু এখন একটু খোলা হাওয়া দরকার।

“আমি একটু বাগানে হাঁটতে যাচ্ছি,” সারাহকে বললো টম।

“তরবারি নিয়ে যাও। নইলে সিংহ ধরে খাবে?”

“লাগবে না,” জবাব দিলো টম। “আমি দাঁত দিয়েই সিংহ মারতে পারি, জানো না?”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো টম। ভাবনায় মগ্ন থাকায় রাস্তার উল্টো দিকের কটেজটার ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অবয়বটাকে খেয়াল করলো না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে শুরু করলো ও। আপনমনে স্প্যানিশ লেডি’ গানটার শিষ বাজাচ্ছে। অল্প পরেই voC-র কাছের গেটটায় পৌঁছে গেলো। গেটটা নানান কারুকার্যে সজ্জিত। বাগানের বাকি তিনদিকে কোনো দেয়াল নেই। তবে বন্য প্রাণীর আনাগোনা থেকে বাঁচতে পরিখা কাটা। ওদিক দিয়েই ডেভিল’স পিক-এর একটা ঢাল এসে মিলেছে। সারাহের সিংহের ব্যাপারে সতর্কবার্তাটা আসলে পুরোপুরি কৌতুক না।

VOC বাগানটা বানিয়েছে কেপ টাউনের স্থানীয়দের বিনোদনের জন্যে। প্রথম যখন ওরা এখানে ঘাটি গাড়ে তখন বাগানটার পিছনে প্রচুর খরচ করেছে, কিন্তু এখন আর এটার বিশেষ যত্ন নেয় না। টম যত ভিতরে যেতে লাগলো ততোই দেখলো বাগানের বেহাল দশা বেড়েই চলেছে। বিশাল বিশাল মাচাগুলো আগাছা দিয়ে ভরা। ওগুলোর জন্যে চাঁদের আলোও বাগানে প্রবেশ করতে পারে না। কয়েকটা মাচা ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে। পুকুরগুলো ময়লা জমে জমে ডোবায় পরিণত হয়েছে। এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কয়েকটা মাত্র ফুলের গাছ টিকে আছে।

টম অবশ্য এসব কিছু খেয়াল করলো না। অ্যানার প্রস্তাবটা নিয়ে ওর মনের মধ্যে ঝড় চলছে। বিশ বছর আগে হলে ও এতো ভাবতো না, ঘরে বসেই রাজি হয়ে যেতো। কিন্তু এখন বয়স বেড়েছে, এখন ও জানে যে কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে কিছুক্ষণ থেমে নিলে ভালো হয়।

আবার মনে হচ্ছে কেননা প্রস্তাবটা নেবে না? কোর্টনীরা সবসময়েই এরকম অস্থির একটা পরিবার; ওদের স্বভাব-ই হচ্ছে নতুন নতুন দেশ, নতুন নতুন অভিযানে নেমে পড়া। আমরা বহুদিন ধরে একই জায়গায় লাঙ্গল ঠেলে চলেছি। মনে মনে ভাবলো টম। এই সুযোগটাই তো আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। এখন কেনো নেবো না?

সামনেই রাতের আধারে ও হায়েনার হাসি শুনতে পেলো। কলোনির ভাগাড়ে মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছে বোধহয়।

গাই এর জন্যে, ওর মনের সতর্ক অংশটা উত্তরটা দিলো। কারণ যদি তুমি এটা করো, তুমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লেজে পাড়া দেবে, আর একসময় না একসময় গাই এর কানে ব্যাপারটা পৌঁছাবেই। শেষ যে দুবার তোমাদের দেখা হয়েছিলো, দুবারই ও তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো। তার মানে আর একবার যদি দেখা হয়, তাহলে দুজনের একজন অবশ্যই মারা পড়বে।

পিছনের রাস্তায় নুড়ি মাড়ানোর শব্দ হলো। টম ঘুরে গেলো সেদিকে। ওর পিছনে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। মাচার ছায়ার কারণে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না, তবে তার ফাঁক দিয়ে যে আলো আসছে তা দিয়ে হাতের খোলা তরবারিটা দেখতে কোনো কষ্ট হলো না। টম নিরস্ত্র।

“আপনি কি টম কোর্টনী,” ইংরেজ টানে জিজ্ঞেস করলো একজন।

“হ্যাঁ, আমিই সে।” লোকটা কথা বলতে শুরু করায় কিছুটা স্বস্তি পেলো টম। তারপর এক পা সামনে বাড়লো কিন্তু লোকটা তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর।

*

কেপ টাউন বন্দরে দ্য প্রফেট যেদিন এসে ভিড়লো, তার পরের দিনই ফ্রান্সিস কোর্টনী একটা ডিঙ্গি নৌকায় করে ডাঙ্গায় চলে এলো। এর আগেই ও জাহাজের কিনারে দাঁড়িয়ে উপসাগরকে বেষ্টন করে রাখা পর্বত চূড়া, সমুদ্রের ঢেউ, আর এই বিশাল মহাদেশটার একদম পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘরগুলো ভালো মতো দেখে নিয়েছে। ছোট বেলায় ওর অভ্যাস ছিলো লাইব্রেরিতে থাকা বিভিন্ন ম্যাপ বের করে বিভিন্ন এলাকার অদ্ভুত সব নাম খুঁজে খুঁজে বের করা। স্কুলের খাতায় ও প্রায়ই নিজের কল্পনা থেকে সব মানচিত্র আঁকতো আর সেসব জায়গা আবিষ্কারের অভিযানে বেরিয়ে পড়তো। আর এতোদিন পর অবশেষে বাস্তবেই ও সেই কাজে বের হয়ে পড়েছে।

প্রথমে বন্দরের মাস্টারের অফিসে গিয়ে ওর আগমন রেজিস্টার করে নিলো।

“নাম? “ কলম থেকে কালি ঝরাতে ঝরাতে জিজ্ঞেস করলো কেরানি।

ফ্রান্সিস কোটের পকেট থেকে একগাদা ভুয়া কাগজপত্র বের করলো। চিল্ডস ওকে এগুলো দিয়েছেন। “আমার নাম ফ্রাংক লেইটন।”

ওখান থেকে বেরিয়ে ও সৈকত ধরে হেঁটে দুর্গে গিয়ে পৌঁছালো। শহর থেকে মাস্কেটের গুলি ছুড়লে যতোদূর যাবে, দুৰ্গটা ততোদূর অবস্থিত। এই বন্দর আর এর আশেপাশের এলাকাটা নিয়ন্ত্রিত হয় এখান থেকে। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ এটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছে যে ওর দাদার দাদা এই গরমে এখানে কাজ করছে। হাই উইন্ডে বড় হওয়ায় ফ্রান্সিসের চারপাশেই ওর পূর্বপুরুষদের নানান স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। ওদের গির্জার সমাধিকক্ষে অনেকের আবক্ষ মূর্তি আছে। তাদের পাওয়া নানা পদক বা ভূষণগুলোও কাঁচের বক্সে রাখা ছিলো, দেয়াল জুড়ে ছিলো পোর্ট্রেট। একে একে সেসব পোর্ট্রেট গায়েব হয়ে যায়। ওর মনে আছে প্রথমবার যখন ও ওদের লম্বা গ্যালারিতে একটা জায়গায় ফাঁকা দেখেছিলো তখন কেমন লেগেছিলো। স্যার ওয়াল্টারের দেনা শোধ করতে প্রতিবার যখন একটা করে ছবি বিক্রি হয়ে যেতো তখনকার কষ্ট ফ্রান্সিস বলে বোঝাতে পারবে না।

কিন্তু আজ ও এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। এখানে দাঁড়ানো অবস্থায় ওর দাদার দাদার একটা ছবি ফ্রান্সিস দেখেছিলো। ওনার চেহারা ছিলো কঠোর, ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা কেশরের মতো কালো চুল। ওর মায়ের কাছে। শুনেছে ওর দাদা হাল-এরও নাকি ওরকম চুল ছিলো। ও মনে মনে কল্পনা করলো ওনারা বেঁচে থাকলে আজ কেমন হতেন। ক্যানভাসের রঙ তুলির না, রক্ত মাংসের জ্যান্ত মানুষ হিসেবে তারা কেমন হতেন।

ওর কেমন অদ্ভুত লাগতে লাগলো। যেনো চারপাশে নিজের পুরুষদের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে। গ্যালারির সবগুলো ছবি যেনো জ্যান্ত হয়ে, ছবির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে ওর পাশে এসে জড়ো হয়েছে। আর কোর্টনী নামটার সব ওজন আর তাদের প্রত্যাশার পুরো চাপটা ওর কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে।

ও যদি টম চাচাকে খুন করে, তাহলে কি ও ঐ খুনীটার চাইতে আলাদা কিছু হতে পারবে?

“আমার বাবার খুনের বদলা এটা,” নিজেকে প্রবোধ দিলো ফ্রান্সিস। স্যার নিকোলাসের প্রতিশ্রুতিমতো পাঁচ হাজার পাউন্ডের পুরস্কারের কথাটা মাথা থেকে জোর করে সরিয়ে দিলো। সামান্য টাকা পয়সার জন্যে এরকম একটা ঘৃণ্য কাজ করতে বাধছে ওর।

ফ্রান্সিস টের পেলো দুর্গের দরজায় দাঁড়ানো প্রহরী ওর দিকে আগ্রহ নিয়ে খেয়াল করছে। ও ঘুরে দ্রুত পানির কাছে চলে এলো আবার। তারপর একটা সরাইতে ঢুকে পানীয়ের অর্ডার দিলো। এই সাত সকালে পুরো সরাই খালি, কিন্তু ওর কিছু পান করা দরকার।

বিয়ারটার রঙ টকটকে লাল। পানি ছাড়া, একদম কড়া। ফ্রান্সিস এক চুমুক দিতেই মনে পড়লো প্রায় দিনই সকালে ও ঘুম ভেঙ্গে নিচে এসেই দেখতো ওর সৎ বাবা অর্ধেক বোতল শেষ করে ফেলেছেন।

একজন মহিলা এসে ওর পাশের টুলে বসলো। মহিলার ঠোঁট লাল, মুখে পুরু পাউডার দিয়ে চেহারার বলিরেখাগুলো ঢেকে রেখেছে।

“ফুর্তি টুর্তি কিছু করার চিন্তা করছো নাকি?” নিজের ব্লাউজের ফিতে নিয়ে খেলতে খেলতে বললো মেয়েটা। “যা চাও তা-ই পাবে আমার কাছে।”

মেয়েটা কি প্রস্তাব করছে সেটা বুঝতে পেরে ফ্রান্সিস লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত কথা-ই বলতে পারলো না। ওর পুরো জীবনটাই কেটেছে হাই উইন্ডে। বাইরে গিয়েছে খুব কম, ফলে এরকম কোনো মহিলার সাথে কখনোই দেখা হয়নি আগে। এমনি অন্যান্য ছেলেদের কাছে এদের ব্যাপারে ফিসফিসানি শুনেছে, এর বেশি কিছু না।

“আমি টমাস কোর্টনীকে খুঁজছি,” কোনোমতে বললো ও। মেয়েটার দৃষ্টিতেই ফুটে উঠলো যে ও টমকে চেনে। তা দেখে ফ্রান্সিস আবার বললো, “আপনি চেনেন ওনাকে?”

ফ্রান্সিস টেবিলে একটা রূপার মুদ্রা রাখলো। মেয়েটা সাথে সাথে তুলে নিলো সেটা। তারপর নিজের কাপড়ে একবার মুছে কাচুলির ভিতর থেকে ছোট একটা ব্যাগ বের করে তার ভিতর রেখে দিলো।

ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো, “তারপর?”

“একটা ড্রিঙ্ক কিনে দেবে না?” ছলনাময়ী কণ্ঠে বললো মেয়েটা। “একজন ভদ্রলোক সবসময়েই একজন ভদ্রমহিলাকে ড্রিঙ্ক কিনে দেয়।”

ফ্রান্সিস আবার লজ্জায় লাল হয়ে বারমেইডকে ডাকলো। লোকটা চুপচাপই আর এক গ্লাস বিয়ার নিয়ে এলো কিন্তু গ্লাসটা রাখার সময় ফ্রান্সিসের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকালো।

“প্রথমবার নাকি?” নিজের বিয়ারে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো বেশ্যাটা। “তোমার মতো একজন তাগড়া জোয়ান? বিশ্বাস হয় না।”

“আমি টমাস কোর্টনীকে খুঁজছি,” ফ্রান্সিস আবার বললো।

“আমি তোমার জন্যে যা করতে পারবো, সে কিন্তু সেসব পারবে না।” বলে মহিলাটা টেবিলের নিচে পা দিয়ে ফ্রান্সিসের পা ঘষতে শুরু করলো। ফ্রান্সিস ত্রস্ত ভঙ্গিতে সেটা সরিয়ে নিলো।

ফ্রান্সিসের অস্বস্তি দেখে খুব আমোদ পেলো মহিলা। “ব্যাগে এরকম আর রুপার মুদ্রা আছে নাকি? ওরকম আর একটা দিলে শুধু বলবো না, তোমাকে একেবারে দেখিয়ে দেবো টম কে?”।

ফ্রান্সিস বুঝলো যে একে আগেভাগেই টাকা দেওয়াটা বোকামি হয়েছে। ও আর একটা মুদ্রা বের করলো কিন্তু সেটাকে এগিয়ে না দিয়ে নিজের আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রাখলো।

“এটা আপনি পাবেন, কিন্তু আগে আমাকে নিয়ে যেতে হবে।”

মহিলাকে হতাশ দেখালো। “বেশ দ্রুত সব শিখে নাও দেখছি। সাথে আর একটা মুদ্রা দিলে আমি এমন জিনিস শিখিয়ে দিতে পারি যা জীবনেও ভুলবে না।”

“আমাকে ওনার কাছে নিয়ে যান,” ফ্রান্সিস প্রসঙ্গ পাল্টালো।

“যেতে হবে না, আমি এখান থেকেই ওনাকে দেখতে পাচ্ছি।”

বলে মহিলা সরাইয়ের জানালা দিয়ে ইশারা করলো। জানালাটা বাতির কালি আর সমুদ্রের লবণে ভরে আছে। পেছনে বন্দরের সম্মুখভাগটা আর ওটার কাঠের জেটিটা দেখা যাচ্ছে। প্রফেটের নৌকাগুলো ওটার পাশেই বাধা, একদল কৃষ্ণাঙ্গ কুলি ওগুলো থেকে মাল নামাচ্ছে। এই হট্টগোলের মাঝে তিনজন লোককে দেখা গেলো দাঁড়িয়ে আলাপ করছে আর একগাদা মাল পরীক্ষা করে দেখছে। ফ্রান্সিস দুজনকে চিনতে পারলো, একজন প্রফেটের ক্যাপ্টেন আর একজন জাহাজঘাটার কেরানী। তৃতীয় লোকটা সবচেয়ে লম্বা, কমপক্ষে ছয় ফুটের উপরে লম্বা, কাঁধ ওনার পাশের কুলিগুলোর মতোই চওড়া। ঘন কালো চুল নাবিকদের মতো বেণী করে রেখেছেন। হাসিমুখেই কথা বলছিলো লোকটা, কিন্তু ভাবেই বোঝা যাচ্ছিলো যে এই লোক কারো কাছে মাথা নোয়ায় না।

“লম্বা লোকটাই হচ্ছে টম কোর্টনী,” মেয়েটা বললো। কণ্ঠে প্রশংসার ছোঁয়া।

ফ্রান্সিসের মনে হতে লাগলো যেনো ওর রক্ত জমে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে টম কোর্টনী ওর জন্যে ছিলো রূপকথার এক দৈত্যের মতো, যে কিনা বার বার ওর দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দিতো। আর এখন সে ওর থেকে মাত্র কয়েক গজ সামনে দাঁড়িয়ে আছে, অন্য লোকদের সাথে হাসাহাসি করছে। ওর জন্য কি করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই।

বেশ্যা মহিলাটা ফ্রান্সিসের চেহারার অভিব্যক্তি পড়তে পারলো।

“তুমি ওনাকে ঘৃণা করো,” মজা পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বললো মহিলা।

“তুমি ওনাকে খুন করতে চাও, তাই না?” আবার বললো সে। ফ্রান্সিস প্রতিবাদের চেষ্টা করতেই বললো, “তর্ক করে লাভ নেই। তোমার চোখে যে দৃষ্টি দেখলাম সেটা আমি আগেও অনেকবার দেখেছি। অবশ্য বেশিরভাগ সময়েই লোকগুলো ছিলো পাড় মাতাল।”

ফ্রান্সিস টমের উপর থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলো না। “যদি চাই তো কি সমস্যা?”

“টম কোর্টনী কিন্তু কোনো ফালতু মাতাল নাবিক না। এখানকার সবচেয়ে বিপজ্জনক লোক সে। তার সম্পর্কে নানান গল্প শোনা যায়,..” বলতে বলতে মাথা নাড়লো মহিলা।

ফ্রান্সিসের সৎ বাবা ওর জন্যে খুব বেশি কিছু করেননি কিন্তু ফ্রান্সিস যেনো তরবারি দিয়ে আর খালি হাতে লড়াইটা ভালোমতো শেখে, সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছিলেন। একাধিকবার স্যার ওয়াল্টারের দেনার কারণে ফ্রান্সিসকে ভোর বেলায় ওনার পক্ষে ডুয়েলে নামতে হয়েছে। তাই ফ্রান্সিস ভালোভাবেই জানে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করতে হয়। স্যার ওয়াল্টার ছিলেন একেবারে জাঁদরেল প্রশিক্ষক। ফ্রান্সিসের মুঠি দিয়ে রক্ত বের হওয়ার আগ পর্যন্ত উনি ওকে এক বিন্দু ছাড় দিতেন না। অনেক সময় এমন হতো যে ব্যথায় ও তরবারিটাও মুঠি করে ধরতে পারতো না।

একদিন এটাই তোমার জীবন বাঁচাবে, উনি প্রায়ই বলতেন কথাটা।

“আমি নিজেকে রক্ষা করতে জানি,” ফ্রান্সিস মহিলাটাকে আশ্বস্ত করলো।

“সেতো তুমি পারবেই সোনা,” কটাক্ষ হেনে বললো মহিলা। “কিন্তু এই ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কি? তোমার তো তরবারিও নেই। কেপ টাউনে তুমিই টম কোর্টনীর একমাত্র শত্রু না। আমি এরকম অনেককেই চিনি যারা তোমাকে খুশি মনেই সাহায্য করবে।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফ্রান্সিস জানালা থেকে রিয়ে মেয়েটার দিকে আবার তাকালো। “কি বলতে চাচ্ছেন?”

“আর একটা ড্রিঙ্ক কিনে দাও, তাহলে বলছি।”

*

অন্ধকার নেমে আসতেই ফ্রান্সিস পাহাড় বেয়ে উঠে এলো। কোমরে গোজা তরবারিটা উরুতে বাড়ি খাচ্ছে। হাতটা ধরে ওটাকে সোজা রাখতে হচ্ছে। তরবারিটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে স্বস্তি পাচ্ছে ফ্রান্সিস। টম কোর্টনীকে কিভাবে খুন করবে সেটাও ঠিক করে রেখেছে; মাস্কেট বা পিস্তলের গুলিতে অজ্ঞাত ভাবে ও খুন করবে না। একেবারে হৃৎপিণ্ডে তরবারি গেঁথে কাজটা সারবে ও। ঠিক যেভাবে টম উইলিয়ামকে মেরেছে।

ফ্রান্সিস নার্ভাস ভঙ্গিতে ওর চারপাশের লোকজনের দিকে তাকালো একবার। অন্ধকারের পটভূমিতে অশরীরী কালো একেকটা অবয়বের মতো লাগছে সবাইকে। অবশ্য চাঁদের আলোয় চামড়া চকচক করে উঠছে। সবার হাতে লম্বা, সোজা ফলার ছুরি। হাতলে আঙুল ভরে ঘোরাচ্ছে।

ফ্রান্সিসের পিছনে আসছে জ্যাকব দ্য ড্রিস। লম্বা পা ফেলে ও পাহাড় বেয়ে উঠছে আর রাস্তার দুধারের ঝোঁপ জঙ্গল তরবারির আঘাতে কেটে দিচ্ছে। ছুরিগুলোর ফলা খুবই ভারি, অনেকটা তরবারির মতো। এগুলো বানানো হয়েছিলো বার্বাডোজের আখের ক্ষেতে ব্যবহারের জন্যে। কোনো এক ব্যবসায়ী হয়তো সেগুলো কেপ টাউনে নিয়ে এসেছে। জ্যাকব এখন সেটার নতুন একটা ব্যবহার খুঁজে পেয়েছে।

পিছন থেকে জ্যাকব-ও ফ্রান্সিসকে জরিপ করলো। একদম নবীশ এই ইংরেজ ছেলেটাকে নিয়ে বেশ কৌতূহল অনুভব করছে ও। যখন বেশ্যা মহিলাটা ওদের পরিচয় করিয়ে দেয় তখন ও ভেবেছিলো যে এটা হয়তো একটা ফাঁদ। ছেলেটা একেবারে তালপাতার সেপাই, সদ্য গজানো দাড়ি এখনো পুরো গাল জুড়ে ছড়ায়নি। দেখা মনে হয় কড়া কোনো পানীয় পেটে পড়লেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। তবে জ্যাকব ছেলেটাকে তরবারির ব্যবস্থা করে দেওয়ার আগে পরখ করে দেখেছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ছেলেটা খুবই ভালো একজন অসিযোদ্ধা। দ্রুত নাড়াচাড়া করতে পারে, সবসময় সতর্ক, আর মাত্র কয়েকটা প্যাঁচ কষেই জ্যাকবের মতো দক্ষ লোককেও অবাক করে দিয়েছে। আর টম কোর্টনীর কথা উঠলেই ছেলেটার চোখে যে আগুন দেখা যায়, সেটা ভুয়া হতে পারে না।

জ্যাকব নিজেও এই অনুভূতিটার সাথে পরিচিত। দুই বছর আগে ও। মোজাম্বিক থেকে জাহাজে করে একদল দাস নিয়ে আসছিলো। আসার পথে ওর জাহাজ চরে আটকে পড়ে। টম কোর্টনী ওদেরকে উদ্ধার করে, কিন্তু বিনিময়ে ও জোর করে সব বন্দীকে মুক্ত করে দেয়। জ্যাকবের সব টাকা জলে যায়। বিশেষ করে একটা সুন্দরি দাসীকে ওর খুব মনে ধরেছিলো। নিজের জন্যেই রাখতে চেয়েছিলো মেয়েটাকে। কিন্তু ওই কুত্তী সারাহ কোর্টনী মেয়েটাকে নিজের কাছে নিয়ে পড়াশোনা আর আচার ব্যবহার শিখিয়ে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেয়, যাতে সে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে।

মেয়েটার কথা মনে হতেই জ্যাকবের শরীরে উত্তেজনার ঢেউ খেলে গেলো। মেয়েটাকে যখন ধরে আনা হয়ে তখন সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছিলো। উদ্ধত স্তন, মাথার চুল ওদের গোষ্ঠীর ঐতিহ্য অনুযায়ী বিশেষভাবে কাটা–জ্যাকবের কল্পনার সবটা ছিলো যেনো সে। ও মেয়েটাকে পেলে কি করতো সেকথা বহুবার ভেবেছে। আর টম কোর্টনী সরে গেলে সারাহ কোর্টনীর কি করবে সেটাও ভেবে রেখেছে অসংখ্যবার।

ওরা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলো। ওখানে মাত্র কয়েকটা ঘর, কিন্তু একটা পুরো খালি। মালিক গিয়েছে আমস্টারডামে। কয়েক মাসের ভিতরে আর ফিরবে না। জ্যাকব আর ওর লোকেরা বাগানের দেয়ালের ছায়ায় লুকিয়ে রইলো, উল্টো পাশের বোর্ডিং হাউজের দিকে লক্ষ্য রাখছে। একটু পরেই হার্পের সুরের মূর্ঘনায় ভরে গেলো চারপাশ। বাড়ির ভিতর উজ্জ্বল আলোর বাতি জ্বলছে। জানালা দিয়ে জ্যাকব দেখলো টম, ওর ভাই আর ওদের স্ত্রীরা বসার ঘরে বসে আছে। ভাইয়ের মাথায় একটা পাগড়ি, কাফিরদের (আফ্রিকান উপজাতি) মতো। জ্যাকব ভাবতে লাগলো ও যখন মুন্ডুটা আলাদা করে ফেলবে তখন কি পাগড়িটা জায়গা মতো থাকবে?

ও ফ্রান্সিসের কাঁধে টোকা দিলো। ছেলেটা এতো জোরে লাফ দিয়ে উঠলো যে মনে হলো ভয়ের চোটে কাপড় ভিজিয়ে ফেলবে। ব্যাপারটা মোটেও ভালো না, ভাবলো জ্যাকব।

“এখন আক্রমণ করবো?”

ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো। জ্যাকব ভেবে পেলো না ছেলেটা এখন আবার মত বদলাচ্ছে নাকি। সেরকম কিছু হলে ছুরির এক কোপে ছেলেটাকে শুইয়ে দেবে। জ্যাকব এরকম অনেক জায়গা চেনে যেখানে লাশ ফেলে দিলে কেউ দেখার আগেই শিয়াল কুকুর শকুন এসে খেয়ে সাবাড় করে ফেলবে।

তবে অপেক্ষা করায় কোনো সমস্যা নেই। কিছুক্ষণ পরেই দরজা খুলে গেলো আর ডোরিয়ান কোর্টনী বেরিয়ে এলো। সাথে এক মহিলা, যাকে জ্যাকব চেনে না। চেহারা দেখে মনে হয় মেয়েটা সংকর জাতের। এখন আপাতত সারাহের সাথে সব কিছু মেটানো যাক, পরে একেও খুঁজে নেওয়া যাবে।

জ্যাকবের নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না। যদিও ও স্বীকার করবে না, কিন্তু এতোগুলো লোক নিয়েও একসাথে দুই কোর্টনী ভাইয়ের সাথে লড়াই করতে ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। কিন্তু এখন একজন একজন করেই লড়া যাবে।

ডোরিয়ান আর মেয়েটা দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো ও। তারপর ফ্রান্সিসের হাত টেনে ধরলো।

“এখন,” হিসিয়ে উঠলো ও।

কিন্তু নড়ার আগেই পুরো রাস্তাটা আলোয় ভরে গেলো। টম বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। জ্যাকব দ্রুত মাথা নিচু করে ফেললো, কিন্তু টম নিজের চিন্তায় এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে খেয়াল করলো না ব্যাপারটা। জ্যাকব আর একবার ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে দেখলো যে টম কোম্পানির বাগানের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সাথে কোনো অস্ত্র নেই।

জ্যাকব খুশিতে শব্দ করে উঠে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। তুই কে জানি না ভাই, মনে মনে ভাবলো ও। কিন্তু একেবারে শয়তানের ভাগ্য নিয়ে এসেছিস।

“এটাই উনি না?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, চোখের মণি বড় বড় হয়ে গিয়েছে। জ্যাকব ভেবে পেলো না এর কি আসলেই টমের সাথে লড়ার সাহস আছে কিনা। যাক ব্যাপার না। তরবারি যার হাতেই থাক, টম কোর্টনী আজ রাতে মারা পড়বেই।

ওরা নিরাপদ দূরত্ব রেখে টমকে অনুসরণ করে চললো। ভাগ্য আবারও ওদের সহায়তা করলো। দেখা গেলো টম বাগানের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে ওদের মারামারির শব্দও কেউ শুনবে না এখন। টম হাঁটছিলো খুব দ্রুত কিন্তু একবারও পিছনে ফিরে তাকালো না।

কাছেই কোথাও হায়েনারা হেসে উঠলো। ফ্রান্সিস তরবারিটা বের করে হাতে নিলো। মরার আগ মুহূর্তে টমের চেহারাটা কেমন হবে সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করছে। ফ্রান্সিস আজ বহুদিন ধরে দৃশ্যটা চিন্তা করে যাচ্ছে, কিন্তু এখন যখন সময় উপস্থিত, তখন ও রাগের চাইতে বরং ভয় বেশি পাচ্ছে। এর আগে কখনো ও কোনো মানুষ খুন করেনি। তরবারিটার ওজন খুব বেশি মনে হতে লাগলো ওর, পা গুলো মনে হলো নরম মোমের তৈরি।

পারতেই হবে ফ্রান্সিস, নিজেকে বললো ও। বাবার জন্যে হলেও পারতে হবে।

সাথে পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার, স্যার নিকোলাসের কণ্ঠ শুনতে পেলো যেনো মাথার ভিতর।

জ্যাকব ওর ইতস্তত ভাবটা বুঝতে পেরে সামনে এগিয়ে গেলো, আখ কাটা ছুরিটা প্রস্তুত। ফ্রান্সিস ওকে ইশারায় পিছনে যেতে বললো। “ওকে আমি মারবো,” ফিসফিসিয়ে বললো ও।

জ্যাকব কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিছিয়ে গেলো। ছেলেটা ওকে টাকা দিচ্ছে যেহেতু, ওকেই সুযোগটা নিতে দেওয়া যাক। শেষমেশ না পারলে জ্যাকব তো আছেই।

ফ্রান্সিস ওর হাতটা সরিয়ে নিলো। ইংল্যান্ড থেকে আসার পথে সমুদ্রে বসে বসে, ও হাজারবার এই দৃশ্যটা কল্পনা করেছে। তবে ঠিক যেরকম ভেবেছিলো ব্যাপারটা সেরকম হচ্ছে না। ভেবেছিলো ও টমের নাম ধরে ডাকতেই টম অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাবে। তারপর ফ্রান্সিস নিজের পরিচয় আর টমকে কেনো মারতে চায় সেটা জানাতেই সেই অবাক দৃষ্টি আতংকে রূপ নেবে। টম শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারবে যে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এরপর হাঁটু ভেঙ্গে বসে নিজের জীবন ভিক্ষা চাবে, কিন্তু ফ্রান্সিস কোনো ক্ষমা করবে না।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যতো তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা শেষ হবে ততোই ভালো। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে; আর নিতে পারছে না।

কোনো ব্যাপার না, নিজেকে বললো ফ্রান্সিস। কাজটা করাটাই আসল, কিভাবে সেটা মুখ্য না। ও টমের কাঁধ বরাবর তরবারিটা তাক করলো। ঠিক ওর সৎ বাবা যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবে। এভাবে ধরলে তরবারিটা বুকের হাড়গুলোর ফাঁক দিয়ে ঢুকবে। ও এক পা সামনে আগালো।

কিন্তু এতো জোরে পা পড়লো যে নিচের পাথরগুলো কড়মড় করে উঠলো। টম ঘুরে গেলো সাথে সাথে। যে লোকটা ওর বাবাকে খুন করেছিলো, জীবনে প্রথমবারের মতো তার মুখোমুখি হলো ফ্রান্সিস।

“আপনি কি টম কোর্টনী?” জিজ্ঞেস করলো ফ্রান্সিস। কণ্ঠ যাতে না কাপে আপ্রাণ সে চেষ্টা করছে।

টমকে দেখে মনে হলো অবাক হয়েছে। “হ্যাঁ, আমিই সে।”

ফ্রান্সিস ঝাঁপিয়ে পড়লো সামনে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূতে সরে গেলো টম। তরবারির ডগায় লেগে ওর জামার সামনের দিকটা ছিঁড়ে গেলো। চামড়ায় ঠাণ্ডা ধাতব স্পর্শ পেলো, কিন্তু সামান্য আচড়ের বেশি লাগলো না। এদিকে আঘাত জায়গামতো না লাগায় ফ্রান্সিস তাল সামলাতে না পেরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। টম চাইলেই ওর হাত থেকে থাবা দিয়ে তরবারিটা ফেলে দিতে পারতো, কিন্তু আর একটা অবয়বকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো ওর দিকে। লোকটা হাতের ভারি ছুরিটা ঠিক টমের মাথা বরাবর ধরে রেখেছে। টম পিছনে সরে গেলো। মাচার ফাঁক দিয়ে ওখানে চাঁদের আলো এসে পড়ছে।

সেই আলোয় দেখা গেলো, ওখানে মোট পাঁচজন আছে। এর মধ্যে জ্যাকব দ্য ভিসকে চেনে টম। বাকি তিনজনেরও চেহারা পরিচিত, এর আগেও জ্যাকবের সাথে দেখেছে। পঞ্চম যে ছোঁড়াটাকে ওকে তরবারি হাতে আক্রমণ করেছিলো তাকে ও জীবনেও আগে দেখেনি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ওর সবকিছু কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছে।

কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই মোটেও। ছেলেটা আবার ওর দিকে এগিয়ে এলো। দীর্ঘদিন ধরে প্রশিক্ষিত মাপা আঘাত করলো সে, টমের হাত প্রায় কেটেই গিয়েছিলো। বাকি মাস্তানগুলো ওকে ঘিরে ফেলেছে ততোক্ষণে। পালানোর পথ বন্ধ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো সামনে।

বোঝা যাচ্ছে ছেলেটাই এদের সর্দার আজ। আক্রমণে ওর দক্ষতা আর ক্ষিপ্রতা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আসলে মারাত্মক বিপজ্জনক সে।

“তুই কে রে?” জানতে চাইলো টম। “তোকে তো চিনি বলে মনে হচ্ছে না।”

কিন্তু উত্তরে ছেলেটা তরবারি বাগিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লো। টম লাফিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে, হামলাকারীর চোখে বিজোয়ল্লাস দেখতে পেলো ও। সেই মুহূতে আক্ষরিক অর্থেই টমের পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। একটা ময়লায় বুজে যাওয়া পুকুরে হুড়মুড়য়ে পড়ে গেল ও। ছেলেটা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ওর নিরস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

জ্যাকব ওর একটা লোকের দিকে তাকালো। “ছেলেটার সাথে থাক এখানে। ও যেনো কাজটা শেষ করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখবি?” টমের মরণ দেখতে ওর খুবই ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু ডোরিয়ান আসার আগেই ওকে টমের বাসায় যেতে হবে। ওর বৌয়ের গলায় একটা ছুরি ধরে থাকলে ডোরিয়ান কিছুই করতে পারবে না। ও ওর বৌকে কি করে সেটা দেখতে বাধ্য : করবে, তারপর সারাহের দিকে নজর দেবে।

জ্যাকব টমের দিকে ঝুঁকে বিশ্রী ভঙ্গিতে বললো, “তোর সুন্দরি বৌকে একটা দেখা দিয়ে আসি। ছেলেটা তোর সাথে হিসাব মেলাক।”

টম কোর্টনীর দিকে আবার একটা উল্লসিত দৃষ্টি দিয়ে ও বোর্ডিং হাউজের দিকে চললো। সাথের দুজন গেলো ওর সাথে। আর একজন থেকে গেলো ফ্রান্সিসকে সাহায্য করার জন্যে।

মাজা পুকুরটার ভিতর ভয়ানক আঠালো কাদা। টম নিজের পা মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। জীবনে ও এতো বেশি লোকের জীবন সংহার করেছে যে এটা জানাই ছিলো একদিন সৌভাগ্যের দেবতা ওকে ছেড়ে যাবে। ওর বাবাও অনেক কম বয়সে মারা গিয়েছেন, ওর দাদা-ও। কিন্তু ও এখনো বুঝতে পারছে না যে ওর এই নিষ্ঠুর শত্রুটা কে।

আর জীবন থাকতে টম জ্যাকব দ্য ভিসকে সারাহের দিকে একটা আঙুলও তুলতে দেবে না। ও কাদার ভিতর হাত ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। ঠিক তখনি ওর হাতে শক্ত ধারালো কিছু একটা বাঁধলো। টম আঙুল দিয়ে টেনে জিনিসটা কাদা থেকে বের করে আনলো-একটা তিন ইঞ্চি পুরু পাইপ। এটায় করে পুকুরে পানি দেওয়া হতো একসময়।

এদিকে ফ্রান্সিস পুকুরের কাদায় ভরা পাড় বেয়ে একজন নাচিয়ের মতো ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে নেমে এলো। তরবারি টমের তালু বরাবর তাক করে রেখেছে। টম হাঁটুতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাতের পাইপটা দিয়ে আঘাতটা আটকালো। ধাতুতে ধাতুতে আঘাত করে ঝংকার উঠলো তাতে। মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে রক্ষা পেলো টমের চেহারা।

ধাক্কা দিয়ে টম ফ্রান্সিসের ভারসাম্য নাড়িয়ে দিলো। ফ্রান্সিসও পা পিছলে পড়ে গেলো কাদার ভিতর। টম নিজেকে কাদা থেকে মুক্ত করে পাইপটা উঁচিয়ে ওর আক্রমণ করতে গেলো। কিন্তু তার আগেই রয়ে যাওয়া লোকটা আখ কাটার ছুরি নিয়ে তেড়ে এলো ওর দিকে। টম সেদিকে ঘুরে মাথা নামিয়ে আঘাতটা এড়ালো। তারপর লোকটার ছুরি ধরা হাতের কবজি ধরে ফেলে লোকটার জড়তাকে ব্যবহার করে ভারসাম্য নাড়িয়ে দিলো। একই সাথে হাতটা টেনে পিঠের পিছনে নিয়ে এলো। প্রায় সাথেসাথেই লোকটার কাঁধের জোড়াটা মট করে আলাদা হয়ে গেলো। লোকটা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো। টম ওর ডান হাতে ধরে থাকা লোহার পাইপটা লোকটার মাথা বরাবর সজোরে নামিয়ে আনতেই সে মুখ থুবড়ে কাদায় পড়ে গেলো।

টম আখ কাটার ছুরিটা কাদা থেকে তুলে নিয়ে ফ্রান্সিসের দিকে ফিরলো। কিন্তু ফ্রান্সিস ততোক্ষণে কাদায় গড়াগড়ি করে ভূত হয়ে গিয়েছে, আর পড়ার সময় হাত থেকে তরবারিটাও গিয়েছে ছুটে। নিরস্ত্র অবস্থায় টমের মুখোমুখি হওয়ার চাইতে পালানোই ভালো মনে করলো ও। তাই ঘুরে টলতে টলতে পুকুরের পাড় বেয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। ভয় আর লজ্জায় ফোপাচ্ছে ও। টম লোহার পাইপটা ওর দিকে ছুঁড়ে মারলো। ওটা থ্যাপ করে ফ্রান্সিসের পিঠের মাঝ বরাবর গিয়ে লাগলো। ফ্রান্সিস ব্যথায় কাতরে উঠলো কিন্তু থামলো না। সামান্য পরেই অন্ধকারে উধাও হয়ে গেলো, টম আর ওকে ধরতে গেলো না। আগে সারাহকে বাঁচাতে হবে।

জ্যাকব দ্য ভ্রিসের হুমকিটা কানে বাজতেই ও দৌড়াতে শুরু করলো। তোমার সুন্দরি বৌকে একটা দেখা দিয়ে আসি।

*

টম বাগানের দরজা দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে মিসেস লাই এর বোর্ডিং হাউজের দিকে ছুটলো। বাড়িটার খোলা দরজার সামনে জ্যাকবের দুই সাঙাত পাহারা দিচ্ছে। ওরা টমকে আসতে দেখলেও অন্ধকারে চিনতে পারলো না। আর ওর হাতে আখ কাটা ছুরিটা থাকায় ওরা ভেবেছে টম বুঝি বাগানে থেকে যাওয়া ওদের দলের লোকটা।

“ধীরে সুস্থে, হেনড্রিক,” একজন স্বাগত জানালো ওকে। “জ্যাকব, কোর্টনী মাগী দুটোর সাথে কেবল মজা শুরু করেছে।”

বাড়ির ভিতর থেকে একটা তীক্ষ্ণ মেয়ে কণ্ঠের চিৎকার শোনা গেলো। প্রহরী দুজন হেসে সেদিকে ঘুরলো ঘটনা দেখার জন্যে। একজন মরার আগে জানলোও না কি তাকে আঘাত করলো। দ্বিতীয় জন আঘাত আর লাশটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে ঘুরতে গেলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। টমের আখ কাটার ছুরিটা ওর ঘাড়ের পাশ দিয়ে নেমে গেলো। ওর মেরুদণ্ড দুই ভাগ হয়ে গেলো তাতে। মাথাটা তখনও ঘাড়ের সাথে লেগে ছিলো। সেটা সামনের দিকে ভাঁজ হয়ে বুকের উপর ঝুলে পড়লো।

টম লাফিয়ে লাশ দুটো পেরিয়ে দরজা ধরে ছুটলো। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা ঘোড়ার বেগে লাফাচ্ছে। আচমকা পিস্তলের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো। টম না থেমেই হুড়মুড় করে বসার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। রুমের উল্টো দিকে টমের দিকে মুখ করে সারাহ দাঁড়িয়ে আছে। বন্দুকের ধোয়ার পাতলা একটা আবরণে ঢেকে রেখেছে ওকে। তার পিছনে মিসেস লাই সারাহের জামা ধরে ভয়ে ফোপাচ্ছেন।

ডান হাতে সারাহ ওর ছোট ফ্লিন্ট-লক ডেরিঞ্জারটা ধরে আছে, হাত সামনে বাড়ানো। সামনে মেঝেতে উপুড় হয়ে চার হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে জ্যাকব দ্য ভিস। খুলির পিছনে যেদিক দিয়ে বুলেট বেরিয়েছে সেই স্থানটা হা হয়ে আছে। মিসেস লাই-এর দামি কার্পেট ভরে গিয়েছে হলদেটে ঘিলুতে।

সারাহ আর টম সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পরিমাণ সময় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সারাহ হাতের খালি পিস্তলটা ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো টমের বুকে।

“টম কোর্টনী!” কেঁদে উঠলো সারাহ। ওর কণ্ঠে অর্ধেক ছিলো ফোপানি, বাকি অর্ধেক বাধ ভাঙা আনন্দ। “তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে আমাকে ভালবাসবে, সম্মান করবে আর রক্ষা করবে। কিন্তু দরকারের সময়েই কোথায় ছিলে তুমি?”

“ও, আমার সোনা, আমার লক্ষী সোনা।” ও হাতের ছুরিটা ফেলে সারাহকে জড়িয়ে ধরলো। “আর কক্ষনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না। কক্ষনো না! কক্ষনো না!” দেখা গেলো দুজনেই একসাথে কথা বলছে।

সামনে দরজায় আবার হল্লা শোনা গেলো। একটু পরেই ডোরিয়ান ঢুকলো ভিতরে। সাথে একটা কাদা মাখা ভুতকে ধরে এনেছে।

“সারাহ! টম!” ডোরিয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। “আল্লাহর শুকরিয়া যে তোমরা ঠিক আছে। আমি ফেরার পথে পিস্তলের আওয়াজ শুনলাম, তারপরেই এই জানোয়ারটাকে দেখি পাহাড় ধরে নেমে যাচ্ছে।” বলে ও ওর বন্দীর পায়ের পেছনে একটা লাথি মারলো। ছেলেটা হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লো মেঝেতে। “দেখেই বুঝেছি যে এর কোনো কুমতলব আছে, তাই ধরে এনেছি।”

টম দেখলো এ হচ্ছে ওকে আক্রমণকারী সেই কম বয়সী ছেলেটা।

“হ্যাঁ, এ ওদের দলেরই। সম্ভবত দলের সর্দার।” গম্ভীর কণ্ঠে বললো টম। সারাহের কাঁধে এক হাত জড়িয়ে রেখে ও মেঝেতে বসে থাকা ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ালো।

“কে তুই?” ঠাণ্ডা স্বরে জানতে চাইলো টম। “তোর সাঙ্গপাঙ্গগুলোকে যেভাবে মেরেছি তোকেও কেন সেভাবে মারবো না, বল দেখি?”

ছেলেটা ওর দিকে তাকালো। তারপর প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের আতংক সামলে উল্টো চোখ রাঙ্গিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “হ্যাঁ, টমাস কোর্টনী। দুই হচ্ছিস এক জন্ম খুনী। তুই আমার বাবাকে মেরেছিস-তার ছেলের সাথেও তো একই কাজই করবি।”

টম ওর প্রতি আনা অভিযোগ আর বলার হিংস্রতায় চমকে গেলো। ফলে ওর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিটাও আর থাকলো না। কয়েক সেকেন্ড কেমন যেনো ওর মাথা কাজ করলো না ঠিকমতো।

“ঠিক আছে, তা কাকে খুন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমাকে?” জানতে চাইলো ও।

“আমার বাবা উইলিয়াম কোর্টনী। তোর সৎ ভাই।”

“উইলিয়াম…” টমের মুখের কথা আটকে গেলো। “তার মানে বিলি? ব্ল্যাক বিলি তোমার বাবা?”

“জ্বী হ্যাঁ, উইলিয়ামই আমার বাবা।”

“তার মানে তুমি হচ্ছে ফ্রান্সিস; ফ্রান্সিস কোর্টনী।”

আবারও টমের সেদিন মারমেইডস উইঙ্ক-এ দেখা সবুজ দ্যুতির কথা মনে পড়লো। একটা আত্মা আবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসবে।

ও সামনে ঝুঁকে ফ্রান্সিসের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো। “বোঝাই যাচ্ছে যে তোমার আর আমার অনেক কথা বলা বাকি।” ওর স্বর শান্ত কিন্তু অনুতাপে ভরা। “তোমাকে অন্তত সবকিছু ব্যাখ্যা করে বলা উচিত।”

*

ফ্রান্সিস ঘুম ভেঙে দেখলো একটা পালকের বিছানায় শুয়ে আছে। প্রায় একমাস যাবত জাহাজের একটা সরু খাটে শোয়ার পর শয্যাটা ছিলো একেবারে স্বর্গশয্যার মতো। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ও বোধহয় হাই উইন্ডে ফিরে গিয়েছে আবার। চাকরেরা একটু পরেই ওর জন্যে সকালের নাস্তা নিয়ে আসবে।

পাশ ফিরে শুতে গেলো ফ্রান্সিস। তীব্র একটা ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তেই সব মনে পড়ে গেলো ওর। ও হাই উইন্ডে নেই। আছে কেপ টাউনে। ওর সারা শরীরে আঘাত।

চোখ খুলে তাকালো ও। কফির মতো গায়ের রঙের এক মহিলা ওর পাশে এসে বসলো। মাথার উপর একটা শাল জড়ানো। তার পেছনে মুখে দাগওয়ালা এক বিশাল কৃষ্ণাঙ্গ লোক দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

“আমি কোথায়?”

“টম আর ডোরিয়ান কোর্টনীর বাসায়, কালো লোকটা বললো।

ফ্রান্সিস লাফ দিয়ে উঠে বসলো। একটু বেশিই জোরে হয়ে যাওয়ায় সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো আবার। ও বিছানা ছেড়ে নামার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যথার চোটে পারলো না।

“আমাকে এখানে পেলে টম কোর্টনী মেরেই ফেলবে,” কোনোমতে বললো ও।

“টম কোর্টনী তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। তোমার ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে একজন ভদ্রলোক হিসেবে তোমার সেবা করতে কে বলে দিয়েছে বলে তোমার মনে হয়?”

“এটা খাও,” মহিলাটা বললো! বিশ্রী গন্ধযুক্ত একপাত্র তরল ওর ঠোঁটের সামনে ধরলো সে। ফ্রান্সিস একটু চেখে ওয়াক করে পাত্রটা একদিকে ঠেকে দিলো। চেহারায় দাগওয়ালা কালো লোকটা এগিয়ে আসলো বিছানার দিকে। তারপর ফ্রান্সিসের নাক টিপে ধরলো যাতে ও মুখ খুলতে বাধ্য হয়।

“মিস ইয়াসমিনি তোমাকে খেতে বলেছে, চুপচাপ খেয়ে নাও!” মহিলাটা আবার ওর ঠোঁটের ফাঁকে পাত্রটা ধরলো। ফ্রান্সিস আর ঝামেলা না করে চুপচাপ খেয়ে নিলো। সাথে সাথে কাজ হলো ওষুধে। অবিশ্বাস্যভাবে ওর ব্যথা গায়েব হয়ে গেলো। তবে মাথাটাও ঝিম ঝিম করে উঠলো। বিছানাটাও এতে নরম। না চাইতেও চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর।

ইয়াসমিনি ওর ক্ষতগুলো পরিষ্কার করে দিলো; ওগুলো অবশ্য খুব বেশি গভীর না। বন্য গুল্ম কেটে তৈরি করা একটা মলম ওখানে লাগিয়ে দিলো। এসব গুলা ও নিজেই সংগ্রহ করেছে। আল্লাহর রহমতে ক্ষত নিখুঁত ভাবেই সেরে যায়।

“আমি ভাবছি ও কি আসলেই টম আর ডোরিয়ানের ভাতিজা?” ইয়াসমিনি বললো।

“যদি না হয়, তা হলে একটা মাত্র মিথ্যা বলার জন্যে ও অনেক দূর চলে এসেছে,” মাথা নেড়ে বললো আবোলি। “জন্মের পর থেকে আমি উইলিয়াম কোর্টনীকে চিনি। এই ছেলেটা একেবারে ওর মতোই। আর এই ব্যাপারটাও আছে।”

ও তাকের উপর রাখা একটা পদক দেখালো। চুনির চোখওয়ালা একটা সোনালি সিংহ। ওটার পায়ের নিচে পৃথিবী, আর উপরে হীরার তারা খচিত আকাশ। “এটা ছিলো ক্লিবি-র বাবার। ছেলেটার জামার নিচে পেয়েছি। এতেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় যে ও আসলে কে।

“কিন্তু সবাই জানে যে টম উইলিয়ামকে খুন করেছে। আর এজন্যেই ও আর কখনো ইংল্যান্ড ফিরতে পারবে না। উইলিয়ামের সাথে যা হয়েছে সেজন্যে টম এখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। ছেলের সাথে নিশ্চয়ই ও একই ভুল করবে না,” আবোলি বললো।

দরজায় টোকা শোনা গেলো। টম উঁকি দিলো সেখান দিয়ে। “রোগীর অবস্থা কি?”

“ওকে মারতে ব্যর্থ হয়েছেন আপনি,” খোঁচা মেরে বললো ইয়াসমিনি। “আবার যদি মারধোর না করেন তাহলে এ যাত্রা বেঁচে যাবে।”

টম বিছানার কাছে গিয়ে ঘুমন্ত ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বাবার মতোই ঘন কালো চুল হয়েছে ফ্রান্সিসের, কিন্তু বাকি সব বৈশিষ্ট্য নরম সরম। অনেকটা মেয়েদের মতোই সুন্দর। মোটেও ওর বাবার মতো না। টম আশা করলো ওর স্বভাবও যেনো এরকম উল্টো হয়।

টম হিসেব করতে বসলো শেষ কবে ও হাই উইল্ডের সিঁড়িতে ছোট্ট ফ্রান্সিসকে খেলতে দেখেছিলো। ছেলেটার বয়স এখন কমপক্ষে সতেরো। টম ও বাড়ি ছেড়েছিলো ঠিক এই বয়সে। বা বলা যায় ওকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। আর কখনোই ও হাই উইল্ড বা ইংল্যান্ড ফিরতে পারেনি। একজন ফেরারি আসামী-যার হাতে লেগে আছে তার ভাইয়ের রক্ত। সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটাকে এখনো ভুলতে পারে না টম। টেমস নদীর ঘাটের অন্ধকার গলিতে ও লোকটাকে মেরেছিলো শুধু নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে। অথচ টুপি সরিয়ে দেখা গেলো লোকটা ওর নিজের ভাই।

অর্ডার অফ দ্য সেন্ট জর্জের পদকটা তুলে নিলো টম। ও নিজেও নৌবাহিনির খেতাব প্রাপ্ত নাইট, তবে কখনোই পদকটা পরে না। উইলিয়াম অবশ্য সবসময়েই পরে থাকতো।

“ও উঠলে আমাকে ডাক দিও,” আবোলিকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো টম।

আমি ওর বাবাকে বাঁচাতে পারিনি। ছেলেকে দিয়ে সেই ঋণ আমি শোধ করতে পারি।

*

ফ্রান্সিস আবার জেগে উঠে দেখতে পেলো মহিলাটা ঘরে নেই। তবে কালো লোকটা তখনও দরজা পাহারা দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে এক চুলও নড়েনি জায়গা থেকে; ফ্রান্সিস একবার ভাবলো যে লোকটা কাঠের তৈরি নাতো?

ও সাবধানে উঠে বসলো। নাড়াচাড়া আস্তে করলে ব্যথা কম লাগে। বিছানা থেকে পা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর। কিন্তু ভারসাম্য রাখতে দেয়াল ধরে রাখা লাগলো। তবে আবোলি ওকে কিছু করলো না।

“ইয়াসমিনির ওষুধে কাজ করছে তাহলে,” মন্তব্য করলো ও।

ফ্রান্সিস আবোলির দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ। তারপর দেয়ালের জানালাটার দিকে তাকালো। এদিক দিয়ে কি বের হওয়া যাবে? ওর পরনে শুধু একটা নাইট শার্ট। এই পোশাক কেপ টাউনের রাস্তায় ওকে দেখতে একটা উন্মাদের মতো লাগবে। ওকে কি তখন গ্রেপ্তার করা হবে?

আবোলি ঘরের অন্যদিকে ইঙ্গিত করলো। সেখানে চেয়ারের উপর একটা জামা আর একটা পায়জামা ভাজ করে রাখা আছে।

“পালাতে চাইলে কাপড় পরে নেওয়াই ভালো।”

“আমাকে থামাবেন না?”

আবোলি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। “তুমি এখানে নিরাপদ। কিন্তু যদি তুমি পালাতেই চাও…”

ওকে কথা শেষ করতে দিলো না ফ্রান্সিস, “নিরাপদ?” ব্যঙ্গ ঝরলো ওর কণ্ঠ থেকে। “টম কোর্টনী আমার বাবাকে খুন করেছে।” ও চেয়েছিলো কথাটা বলে আবোলিকে চমকে দেবে, কিন্তু আবোলি শুধু মাথা ঝাঁকালো একটু। “আপনি সেটা বিশ্বাস করেন না?”

“তোমার বাবাকে আমি জন্মের দিন থেকে চিনি,” মাপা স্বরে বললো আবোলি। “আমি মন থেকে বলতে পারি সে কতটা খারাপ লোক ছিলো। উইলিয়াম মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে টম হাই উইন্ডে গিয়েছিলো ওদের ভাইয়ের ব্যাপারে সাহায্য চাইতে, আর উইলিয়াম সাহায্যের বদলে টমের উপর চড়াও হয়। ও টমকে মেরেই ফেলতো সেদিন, কিন্তু টম তরবারি চালোনায় ওর চাইতে দক্ষ ছিলো। তাই শেষে দেখা গেলো টম-ই উইলিয়ামের গলায় তরবারি ধরে আছে। কিন্তু টম শেষ আঘাতটা করতে পারেনি। ওর হাত ওর কথা শোনেনি। এর এক সপ্তাহ পরে লন্ডনে উইলিয়াম টেমস নদীর ঘাটে কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই টমকে আক্রমণ করে বসে; সাথে লোকবল ছিলো। কিন্তু সাথের লোকগুলো যখন পারলো না, তখন ও পিস্তল বের করে টমকে গুলি করতে যায়। আমি সেখানে ছিলাম। টম সেসময় তোমার বাবার বুকে তরবারি না বসালে নিশ্চিত তখনই মারা পড়তো।”

আবোলি বলে চললো, ছেলেটার উপর ওর, কথার কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা সেদিকে খেয়াল নেই। এমনকি যদি এই ঘটনার আগে তোমার বাবা তার চেহারা দেখাতো-যদি টম জানতো যে লোকটা আসলে কে-তাহলে টম আঘাতটা করতে পারতো না।”

“আপনি এসব কেনো বলছেন আমাকে?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো। “আমাকে আমার বাবার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে?”

“কথাগুলো সত্যি তাই,” আবোলি বললো। “তুমি এটা মেনে নিতে পারো, নাও নিতে পারো; সেটা তোমার ব্যাপার। তবে যদি তুমি একটা মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকো তাহলে সেটা একসময় তোমাকে ধ্বংস করে দেবে।” তারপর সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, “কাপড় পরে নাও।”

আবোলি বেরিয়ে যাওয়ার পর ফ্রান্সিস দীর্ঘ সময় খাটের পাশে বসে রইলো। ওর ভিতরে যে উন্মত্ততা ছিলো সেটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে; ও যে আসলে এখন কে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। চেয়ারের উপরের কাপড়গুলোর দিকে তাকালো ফ্রান্সিস, ওগুলো পরতে পারবে কিনা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত না। আবোলির কথাগুলো ওর মাথার ভিতর বন বন করে ঘুরছে। একসময় ওর মনে হলো যে মাথাটা দুই ভাগ হয়ে যাবে।

গত রাতের সব কথা ওর মনে নেই, তবে একটা জিনিস স্পষ্ট মনে আছে। টম চাইলেই ওকে মেরে ফেলতে পারতো, কিন্তু সেরকম কিছুই করেনি।

আর এই একটা কারণেই ফ্রান্সিসের সকল বিশ্বাস ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। ওর মনে পড়লো যে ওর মা কি বলেছিলেন। টম ঠাণ্ডা মাথায় নিজের ভাইকে খুন করার লোক না। কথাটা বিশ্বাস হয়নি ওর। আর এখন যখন ও টম কোর্টনীর কবলে পড়েও বেঁচে গিয়েছে, তখন মনে হচ্ছে যে মায়ের কথাটা সত্যি হলেও হতে পারে।

ওখানে বসে বসে ও নিজেকে এক নতুন দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। বেশ্যা আর মাস্তানদের সাথে আঁতাত করছে, নিজের পরিবারের একজন সদস্যুকে খুন করার চেষ্টা করছে-এ কেমন মানুষে পরিণত হয়েছে ও? আর বিনিময়ে টম কোর্টনী ওকে দিয়েছে দয়া আর করুনা।

যদি তুমি একটা মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকো তাহলে সেটা একসময় তোমাকে ধ্বংস করে দেবে।

কিন্তু ওর কি মিথ্যটাকে ত্যাগ করার মতো সৎ সাহস আছে?

*

ফ্রান্সিস নিচে নেমে এসে দেখে টম বসার ঘরের চেয়ারে বসে অর্ডার অফ দ্য সেন্ট জর্জের পদকটা হাতে নিয়ে দেখছে। ফ্রান্সিসের পরনে ডোরিয়ানের পায়জামা আর গায়ে টমের জামা। দেখে মনে হচ্ছে মাস্তুল থেকে পাল ঝুলছে বুঝি। ও সিঁড়ির মাঝপথে থেমে গেলো; টম ভেবেছিলো ওকে দেখেই হয়তো ফ্রান্সিস দৌড়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ফ্রান্সিস জানে যে এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। ও ভয়টাকে গিলে নামতে শুরু করলো আবার।

সিঁড়ির গোড়ায় নেমে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

টম-ই নীরবতা ভাঙলল। “মাঝে মাঝে তরবারি হাতে কারো সাথে দেখা হলেই ভালো হয়, দুঃখিত কণ্ঠে বললো ও। “তাহলে কি বলতে হবে সেটা ভাবতে হয় না।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকালো। তারপর আচমকা ওর ভিতর থেকে কথা ফুটে বেরুতে লাগলো। “আমার যত্ন নেওয়ার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। আমি… আপনি চাইলেই আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারতেন। বা চাইলে আরো খারাপ কিছু করতে পারতেন।”

“আমরা এভাবে শান্তভাবে কথা বলতে পারছি তাতেই আমি খুশি,” টম বললো। ও এমনভাবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো যে কোনো মুহূর্তে ও গায়েব হয়ে যাবে। “তুমি কি আসলেই বিলির ছেলে?”

ফ্রান্সিস কাটা কাটা ভাবে বললো, “হ্যাঁ, আমি।”

“তাহলে তুমি ঐ ভ্রিস এর মতো গুণ্ডাদের সাথে মিশলে কিভাবে?”

“একটা সরাইতে দেখা হয়েছিলো। একটা… মেয়েমানুষ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো।” ফ্রান্সিসকে দেখে বোঝা গেলো যে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। “আপনাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললেই ভালো হবে।”

টম ডোরিয়ান আর আবোলিকেও গল্প শোনার জন্যে ডেকে আনলো। টম অবাক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আবোলির চেহারার কাটা দাগ, আর ডোরিয়ানের মাথার পাগড়ি আর আরব পোশাক-দুটোই অবাক করেছে ওকে। আর ডোরিয়ান আসলে কে সেটা জানার পর ওর মুখ আক্ষরিক অর্থেই হাঁ হয়ে গেলো।

“আমাকে যা যা বলা হয়েছে সব দেখি মিথ্যে। আমি জানতাম যে আপনি আর বেঁচে নেই।”

“সে এক লম্বা কাহিনি,” ডোরিয়ান বললো। “বলবো পরে একসময়। কিন্তু তার আগে তুমি এখানে কিভাবে এলে আর আমাদেরকে খুঁজে পেলে সেই কাহিনি শোনাও দেখি।”

ছিন্নভিন্ন কুশনগুলোতে বসেই ফ্রান্সিস ওদেরকে সব খুলে বললো। শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে গেলো টম। স্যার ওয়াল্টারের কর্মকাণ্ড শুনে ও জোরে জোরেই গালাগাল করে উঠলো।

“বেচারা এলিস। যেদিন আমি বিলিকে খুন করলাম, সেদিন থেকেই আসলে দুর্দশার শুরু।”

“ও উইলিয়ামের সাথেও সুখী হতে পারতো না,” আবোলি বললো। “ও ওর সাথে কেমন ব্যবহার করতো তা তো দেখেছিলেই। যেভাবে ওকে মারধোর করতো, তাতে মনে হয় উইলিয়াম এলিস আর ফ্রান্সিস দুজনকেই মেরে ফেলতে।” টম ওকে ইশারায় থামতে বললো। কিন্তু আবোলি প্রতিবাদ করে বললো, “না, ছেলেটার নিজের বাবা সম্পর্কে সব সত্যি জানার অধিকার আছে।”

“আমি জানি, ফ্রান্সিস বললো। আমি আসার আগে মা আমাকে বাবা। সম্পর্কে সব সত্যিটা বলেছিলেন। বাবা কেমন মানুষ ছিলেন সেটাও বলেছেন। উনি বলেছেন আপনি যা করেছেন নিজেকে রক্ষা করতে করেছেন।” তারপর বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, “আমি তার কথা বিশ্বাস করিনি।”

“আচ্ছা,” সেদিনের ভয়াবহ রাতটার কথা মনে পড়লো টমের। “তবে ওটা পুরোটাই বিলির দোষ ছিলো না। লর্ড চিল্ডস বলে না দিলে ওর জানার কথা ছিলো না যে আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে।”

ফ্রান্সিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “স্যার নিকোলাস চিল্ডস? তার মানে আমার সাথে দুই নম্বরি করা হয়েছে? আমাকেতো উনিই পাঠিয়েছেন। আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে সেই খবর উনিই দিয়েছেন আমাকে। আপনাকে মারতে পারলে পাঁচ হাজার পাউন্ডও দেবেন বলে কথা দিয়েছেন।”

“পাঁচ হাজার পাউন্ড এর লোভ দেখালে তো আমিও কাজটা করতাম, মজা করে বললো ডোরিয়ান। কিন্তু টম মজার মেজাজে নেই।

“টাকা তুমি জীবনেও পেতে না। চিল্ডস একটা মাকড়সা। পৃথিবীর সমস্ত কোনায় কোনায় জাল বুনে রেখেছে সে। লেডেনহল স্ট্রিটে নিজের ডেরায় বসে বসে ও কুমতলব আটে আর এক পয়সার লাভেরও কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তাকে জালে আটকে শেষ করে দেয়। আমি তাকে প্রায় বিশ হাজার পাউন্ড লাভ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু সামান্য একটা এক মাস্তুলের জাহাজের বখরা দিতে অস্বীকার করায় উনি আমাকে খুন করার চক্রান্ত করেন। আস্ত একটা শয়তান লোকটা।”

“এখন আমি বুঝতে পারছি।”

“তোমার চাইতে অনেক বুদ্ধিমান লোক ওনার শয়তানির ফাঁদে পড়ে সব হারিয়েছেন। আমার ধারণা এমনকি তোমার বাবা বিলিও তার শিকার। ও বুঝতে পারেনি যে আসলে ও চিল্ডসের কুমন্ত্রণার এক সামান্য ঘুটি মাত্র! বিলি আমাকে খুন করতে চাইতো সেটা ঠিক, কিন্তু চিল্ডসই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। কোনো সন্দেহ নেই যদি সেদিন বিলি সফল হতো তাহলে ওর এই অপরাধটা চিল্ডস ওর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতো।”

ফ্রান্সিসের ভ্রু কুঁচকে গেলো। “তাহলে এখন আমি কি করবো? লর্ড চিল্ডস গাই চাচা আর বোম্বেতে কোম্পানির অফিসে দেওয়ার জন্যে একটা চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু-” টমের মুখভঙ্গি বদলে যেতে দেখে ও থেমে গেলো। “কি হয়েছে?”

“গাই তো আর এক চীজ।”

“কিন্তু ফ্রান্সিস একজন কোর্টনী। আর আমাদের পরিবারের সম্পূর্ণ ইতিহাস জানার অধিকার ওর আছে,” নরম স্বরে বললো ডোরিয়ান। “এসব গোপন কথা আর অর্ধ সত্যগুলোই আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। এসব কারণেই লর্ড চিল্ডসের মতো শয়তানগুলো আমাদেরকেই আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ফায়দা উঠাচ্ছে।”

টম জবাব দেওয়ার আগেই দরজায় করাঘাতের আওয়াজ পাওয়া গেলো। অ্যানা দুয়ার্তে ঢুকলো ভিতরে।

“বিরক্ত করলাম নাকি? আজ সকালে আমার প্রস্তাবটার ব্যাপারে আর একবার আলোচনা করার কথা ছিলো না?” তারপর ফ্রান্সিসের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ইনি কে?”

ওর চেহারায় কৌতূহলের ভাব স্পষ্ট। এমনভাবে ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে রইলো যেনো এই ঘরে ও-ই একমাত্র পুরুষ মানুষ। আনমনেই নিজের জামার গলার কাছটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিলো অ্যানা।

টম ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো। “এ হচ্ছে আমার ভাতিজা, ফ্রান্সিস। ইংল্যান্ড থেকে এসেছে। গতরাতেই। আমরা অবশ্য জানতাম না। ফ্রান্সিস, এ হচ্ছে অ্যানা দুয়ার্তে। উনি আমাদের ব্যবসায়িক পার্টনার। অবশ্য এখনো সবকিছু চূড়ান্ত হয়নি।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকালো। যেনো একটা ঘোরের মাঝে আছে-যেন ওর দেখা সবচে স্পষ্ট স্বপ্নটা দেখছে এখন। অ্যানার সবকিছুই যেন একেবার সূক্ষ্মভাবে ওর চোখে ধরা পড়ছে। ওর কানের পেছন দিয়ে এক গোছা চুল বেরিয়ে আছে; ওর ঠোঁটের বাক; ওর চোখে আটকে থাকা অ্যানার বাদামী চোখের গভীরতা-সব।

কিছুক্ষণ কেউ কিছু বললো না। সবাই আশা করছিলো যে ফ্রান্সিস কিছু বলবে, কিন্তু ও কিছু বলার সাহস পেলো না।

“ফ্রান্সিস কাল রাতে মাথায় আঘাত পেয়েছে। সম্ভবত এখনো পুরোপুরি ব্যথা যায়নি,” টম বললো।

অ্যানার চোখ দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেলো। “ইশ! বেশি ব্যথা পেয়েছে? কি হয়েছিলো?”

“ও আমাদেরকে খুন করে ফেলার চেষ্টা করছিলো, তাই টম মাথায় বাড়ি মেরে ঠাণ্ডা করেছে, ডোরিয়ান বললো।

অ্যানা দুই ভাইয়ের দিকে খেয়াল করলো আবার। এবার ওদের চেহারা আর হাতের কাটাছেঁড়াগুলো নজরে এলো ওর। আসার সময় বাতাসে পোড়া গানপাউডারের গন্ধ পেয়েছিলো। আর কার্পেটে ছিটিয়ে থাকা রক্তের দাগও দেখেছে। মিসেস লাই পুরোপুরি পরিষ্কার করতে পারেননি দাগটা।

“এখন নিশ্চয়ই ওনার সে ইচ্ছা চলে গিয়েছে?”

ডোরিয়ান ফ্রান্সিসকে আড়চোখে একবার দেখলো। “সেরকম-ই আশা করি। কারণ ও এতোদিন যা জানতো, ভুল জানতো।”

ফ্রান্সিস সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। এখনো পায়ে পুরোপুরি বল আসেনি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। “আমাকে আসলে ভুল পথে চালানো হয়েছিলো।”

হঠাৎ ও বুঝলো কথাটা আসলে ঠিক হলো না। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, বিশেষ করে অ্যানা। নিজের দোষ নিজের কাঁধে নিতে শিখতে হবে ওকে।

“আমি অন্য লোকের মিথ্যে কথাগুলো বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু যাদের কথা শোনা উচিত ছিলো তাদেরকে পাত্তা দেইনি। আমি আপনাদের যে বিপদে ফেলেছিলাম সেজন্যে ক্ষমা চাচ্ছি, এসবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমাকে যা করতে বলবেন তা আমি খুশি মনেই করবো। আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।”

টম ওর কাঁধে হাত রাখলো। “ঠিক আছে। এখন শোনো, কাল রাতে মিস দুয়ার্তে আমাদেরকে তার ব্যবসার অংশিদার হওয়ার একটা প্রস্তাব এনেছিলেন। তুমিও ইংল্যান্ড ছেড়েছো ভাগ্য গড়তে; আমরা তোমাকে সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবো বলে মনে হয়।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে সবার সাথে খাবার ঘরের দিকে আগালো। ব্যথা শরীরেও দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে সাহায্য করলো অ্যানাকে।

অ্যানা আসার কারণে যে কথোপকথনটা থেমে গিয়েছিলো সেটার কথা ও বেমালুম ভুলে গিয়েছে। অনেক পরে ওর খেয়াল হলো, আচ্ছা গাই চাচার কথা বলায় টম চাচা ওরকম আচরণ করলো কেনো?

*

প্রখর রোদের কারণে সমুদ্রের উপরিভাগ এতোটা মসৃণ আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। যে মনে হচ্ছে পাথর কুঁদে পুরো জিনিসটা বানানো। এমনকি ছোট ছোট ঢেউগুলো যখন তীর এসে পড়ছিলো তারাও কোনো আলোড়ন না তুলে একেবার নিখুঁতভাবে ছড়িয়ে পড়ছিলো। সৈকতেই দুটো ইন্ডিয়াম্যান অলস ভাবে নোঙ্গর ফেলে ভেসে আছে।

মোহনায় কয়েকটা ছোট ছোট চর মাথা তুলে আছে। প্রতিটা পাহাড়ের চুড়ায় একটা করে পাথরের তৈরি দুর্গ। একগাদা বট গাছের ভিতর থেকে বিশাল একটা প্যাগোডার সুউচ্চ মিনার আর গম্বুজ মাথা তুলে আছে। ওখান থেকে একটা মাস্কটের গুলির দূরত্বের চাইতেও কম চওড়া একটা খাড়ি পার হলেই বিশিষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশ।

দুর্গ থেকে দুপুরের সংকেতদায়ী কামানের বুম শব্দ কানে এলো ক্রিস্টোফার কোর্টনীর। মুখ থেকে ঘাম মুছলো ও। নিজের সেরা জামা আর প্যান্টটা পরে আছে আজ। বোম্বের যত সওদাগর আছে তারা সবাই-ই আজ সকাল সকাল ব্যবসাপাতি গুটিয়ে, ঘরের ভিতরের তুলনামূলক ঠাণ্ডা পরিবেশ ফিরে গিয়েছে। এই মুহূর্তে ও বাদে জাহাজে আর কেউ নেই।

Two monsoons are the age of a man,’ বোম্বের পুরনো প্রবাদ এটা। মাত্র দুই বছরেই ক্রিস্টোফার সেই কোটা পূরণ করে ফেলেছে। সৈকতের পাশের লবণের ঘেরগুলো থেকে ভেসে আসা কটু গন্ধের সাথে শুকাতে দেওয়া পচা মাছের দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। ফলে কেউ না দেখাও বলে দিতে পারবে যে ওরা তীরের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। পচা মাছগুলো স্থানীয় লোকেরা নারিকেল গাছের গোড়ায় সার হিসেবে দেয়। তীরেও কাউকেই দেখা গেলো না। সবাই ঘরের ভিতর বসে বসে মুনাফা গুনছে আর দিন গুনছে কবে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে জান বাঁচাবে।

ক্রিস্টোফার প্রায় পনেরোটা বর্ষা পার করে ফেলেছে এখানে-মানে ওর প্রায় পুরো জীবনটাই, মাঝে শুধু তিন বছর ছিলো জাঞ্জিবারে। ভারতের গরম পরিবেশে এসে দেখা যায় অনেকেই নিস্তেজ হয়ে এমনকি মারাও পড়ে, সেখানে ক্রিস্টোফারের চেহারা আরো খোলতাই হয়েছে। লম্বা একহারা গড়ন, শক্ত চোয়াল, গাঢ় বাদামী চোখ। ওর বাবার কোনো বৈশিষ্ট্যই পায়নি বলা চলে। সবাই কথাটা বলে তবে অবশ্যই ওর বাবার আবডালে।

এই গরমের মাঝেও ও কাঁপছে। এক কাহিল হয়ে যাওয়া প্রহরী ওকে ফটক দিয়ে ঢুকতে দিলো। উঠোন পেরিয়ে ও গভর্নরের বাসভবনে চলে এলো। দ্বীপটা যখন পর্তুগিজদের অধীনে ছিলো সেই সময়কার একটা ধ্বংসাবশেষ এই কুঠিটা। একটা মনোরম তিন-তলা বাড়ি, এখনো সদর দরজায় পর্তুগিজ প্রতীক খোদাই করা আছে। দুর্গের দেয়াল ছাড়িয়ে ওটার মাথা দেখা যায়। মূলত ইংরেজরা দখল নেওয়ার পর ওরা বাড়িটাকে ঘিরে দুৰ্গটা নির্মাণ করে।

যদিও এটা নিজের বাড়ি, তবুও ভিতরে ঢুকতে যেতেই দুশ্চিন্তায় ক্রিস্টোফারের শ্বাস ভারি হয়ে এলো। সিঁড়ির বেয়ে উঠে গভর্নরের অফিসের ভারি কাঠের দরজায় আস্তে টোকা দিলো ও।

“এসো,” পরিচিত কণ্ঠটা গর্জে উঠলো।

গাই কোর্টনী নিজের ডেস্কের পিছনে বসে আছে। উল্টোদিকে তিনটা বিশাল বিশাল জানালা। এগুলো দিয়ে সে সহজেই ঘাটের প্রতিটা জাহাজের উপর নজর রাখতে পারে। ডেস্কের উপর কাগজপত্র পরিপাটি করে সাজানো-চিঠিপত্র, আইনের বই, বিভিন্ন ঘোষণাপত্র, টাকার রসিদ। এসব দিয়েই চালিত হয় কোম্পানির ব্যবসা। লোকে বলে কোম্পানির ব্যবসা নাকি জাহাজের গায়ে লাগা বাতাসের চাইতেও দ্রুত চলে। দেয়ালের বাম দিকে গাই-এর বাবা হাল এর একটা তৈলচিত্র ঝোলানো। ওনার হাতে একটা দুর্দান্ত সুন্দর তরবারি। সোনালি হাতলে একটা বিশাল নীলকান্ত মণি খোদাই করা তাতে। ছবিটা আঁকা-ও হয়েছে এতো দারুণভাবে যে ছবির ভিতর থেকেই পাথরটা দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

একজন কৃষ্ণাঙ্গ চাকর গাই-এর পাশে দাঁড়িয়ে ময়ূরের পেখম দিয়ে বানানো পাখা দিয়ে বাতাস করছে। গাই ক্রিস্টোফারের দিকে ফিরেও তাকালো না।

“কি হয়েছে?” সপাং করে জানতে চাইলো গাই।

ক্রিস্টোফার ওর হ্যাঁটের কোনাটা একটু তুলে লম্বা একটা দম নিলো। “আমি বিয়ে করতে চাই, বাবা।”

গাই হতভম্ব হয়ে গেলো। “বিয়ে?” ও এমনভাবে শব্দটা আবার বললো যেনো ওটা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। “এই ভূত মাথায় চাপলো কি করে?”

“আমার বয়স হয়েছে।”

“সেটা কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। তা তোমার মোটা বুদ্ধিতে কোন মেয়েটাকে মনে ধরেছে শুনি?”

“রুথ রেড্ডি।”

“কে?”

“কর্পোরাল রেড্ডির মেয়ে। দুর্গের সৈন্যদলে আছেন উনি।”

“ঐ ফালতু মেয়েটা? ও তো একটা মাগী ছাড়া কিছু না!” গাই-এর অভিব্যক্তি বদলে গেলো। মাথাটা পিছনে হেলিয়ে হাসতে লাগলো সে। “আমিতো ভেবেছিলাম তুমি আসলেই বিয়ে করতে চাও। তোমাদেরকে প্রায়ই একসাথে দেখা যায় সেই খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম হয়তো তোমার বয়সী বাকি ছেলেপুলেরা যেমন করে সেরকম তুমিও বোধহয় সুযোগ পেলে আস্তাবলের পিছনে নিয়ে ওর সাথে একটু ঢলাঢলি করো। আমি বোধহয় তোমার সম্পর্কে একটু বেশিই ভেবে বসেছিলাম।

“আমি ওকে ভালোবাসি।”

গাই অর্ধনিমীলিত চোখে তার ছেলেকে জরিপ করলো। ছেলেটা সবসময়েই ওর বাবার মতোই গোঁয়ার। কিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, কিন্তু একবার নিলে আর ফেরানো যায় না। একজন ডাকসাইটে ব্যবসায়ী হওয়ার সমস্ত লক্ষণ ওর মাঝে আছে। দুর্দান্ত মেধাবী, গাই অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলতেও পিছপা হয়নি, উদ্দেশ্য ছিলো শুধু ওর ভিতরে যতো অপছন্দনীয় গুণাবলি আছে সেগুলো যাতে দূরীভূত হয়। যাতে ভবিষ্যতের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ও শতভাগ প্রস্তুত থাকতে পারে। কিন্তু এখনো ছেলেটা কিছুই শিখলো না।

সম্ভবত জবরদস্তি করার চাইতে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজ আদায় করা সহজ। গাই তাই স্বর নরম করে বললো।

“তোমার বয়সে কেমন লাগে সেটা আমি জানি। আমি যখন তোমার মতো কমবয়সী এক বেকুব ছিলাম তখন এক মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এতোটাই বেশি যে আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম তার জন্যে। কিন্তু পরে আবিস্কার করলাম যে মেয়েটা আসলে একটা বাজারের মাগী। সামান্য কয়েক রুপি পেলেও সে যে কারো সাথে শুয়ে পড়ে।”

এতো বছর পরেও স্মৃতিটা মনে আসতেই গাই রাগে গরম হয়ে গেলো। জোর করে নিজেকে শান্ত করলো ও। তবে একবার তার বৌ হওয়ার পর ও বহুবার এর বদলা সুদে আসলে আদায় করেছে।

“আপনার ভুল আমার ভাবার বিষয় না বাবা।”

“কিন্তু তোমারগুলো আমার চিন্তার বিষয়। তুমি এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারবে না। শুধু তোমার বাবা হিসেবে না। বোম্বে প্রদেশের গভর্নর হিসেবে আমি এই বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা দিলাম। জানো নিশ্চয়ই আমার অনুমোদন ছাড়া এখানে কোনো বিয়েই বৈধ হয় না।”

“নিজের ছেলের সাথে এমন করবেন আপনি?”

“যখন সে উল্টা পাল্টা কাজ করে? অবশ্যই, গাই চেয়ারে হেলান দিলো। “তোমার বিয়ে করার শখ? আমি ব্যবস্থা করবো। তোমার বয়স হয়েছে, তোমার বিয়ে করার ইচ্ছা হতেই পারে। আমার আগেই এ ব্যাপারটা দেখা উচিত ছিলো। তাহলে আজকের এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। আমি তোমার জন্যে উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে বের করবো। স্যার নিকোলাস চিল্ডসের একজন ভাতিজি আছে। অথবা আর্ল অফ গোডলফিনের নাতনীকেও দেখা যায়। এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যার সাথে বিয়ে হলে তোমার ভবিষ্যতের পথটাও মসৃণ হয়।”

সাথে আমারও, মনে মনে ভাবলো গাই। অবশ্য না বললেও বোঝা কষ্ট না। ছেলে যদি বাবার কাজে না লাগে তো সেই ছেলের দরকার কি? এর মধ্যেই গাই মনে মনে হিসেব করা শুরু করেছে যে জায়গা মতো বিয়ে হলে ও কোম্পানির আরো কতোগুলো শেয়ার বাগাতে পারবে। হয়তো কোর্ট অফ ডিরেক্টরসেও একটা জায়গা পাওয়া যাবে, এমনকি রাজদূত হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু হবে না।’

ক্রিস্টোফার কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতো সাধ্য সাধনার পরেও ছেলেটা সারাজীবন রামগড়রের ছানা-ই থেকে গেলো, মনে মনে ভাবলো গাই। অকৃতজ্ঞ, গাই ওর জন্যে কতোটা স্বার্থ ত্যাগ করেছে সেটা কোনোদিন বুঝলো না।

“আমি লন্ডন থেকে খবর পেয়েছি যে স্যার নিকোলাস চিল্ডস এর শারীরিক অবস্থা ভালো না,” গাই বলতে লাগলো। “একদিন হয়তো লেডেনহাল স্ট্রিটের ঐ অফিসটায় তুমিই বসবে।”

এতো ভালো একটা খবরেও ছেলেটার চেহারায় কোনো আনন্দের ছাপ পড়লো না। গাই-এর মনে হলো ক্রিস্টোফার সম্ভবত এখনো কর্পোরালের মেয়েটার সাথে শোয়নি। ও সম্ভবত আদর্শ বিয়ে নামের কোনো উদ্ভট চিন্তা থেকে নিজেকে এসব থেকে বিরত রাখছে। গাই-ও যখন এই বয়সী ছিলো, ও ও একটা বিশুদ্ধ আর পবিত্র ভালোবাসায় বিশ্বাস করতো। কিন্তু ওর ভাই টমের কল্যানে সেই বিভ্রম কেটে যায়।

“আমি জানি যে তোমার চাহিদা আছে, সেসবকে অবহেলা করে আমি অপরাধ করেছি,” বলতে বলতে ও ডেস্কের একটা ড্রয়ার থেকে একটা প্যাগোডা খচিত স্বর্ণমুদ্রা বের করে ক্রিস্টোফারের দিকে ছুঁড়ে দিলো। “তোমার ভবিষ্যৎ বৌয়ের কাছে থেকে যৌতুক হিসেবে এর চাইতে অনেক বেশি আদায় করা হবে। আপাতত এটা নিয়ে কাস্টম হাউজের ওখানে যে বেশ্যাপাড়াটা আছে ওখানে যাও। ওটাই সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অফিসারেরা ওখানেই যায়। ওখান থেকেই একটা মেয়েকে নিয়ে একটু ফুর্তি করে এসো।” মিটিমিটি হাসলো গাই। “খোদার দোহাই ওখানেও কারো প্রেমে পড়ে যেও না।”

ক্রিস্টোফার এমনভাবে মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে রইলো যেনো আগে কখনো দেখেনি। ও মুদ্রাটা তুলে ধরলো যাতে ওটার স্বর্ণালি আভা ওর মুখের উপর পড়ে।

“আপনি এতো কিছু করবেন? আমার জন্যে?”

পিতা হিসেবে গাই-এর খানিকটা গর্ব বোধ হলো। “আজীবনই আমি তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করেছি।”

মুদ্রাটা ক্রিস্টোফারের আঙুলের ফাঁক গলে ডেস্কের উপর পড়ে বনবন করে ঘুরতে লাগলো।

“আপনি একটা শয়তান। একটা নিষ্ঠুর, স্বার্থপর দানব। আপনার বুকের হৃৎপিণ্ডের জায়গায় ফাঁকা একটা বক্স বাদে কিছুই নেই। আপনি নিজের স্বার্থ চরিতার্থের জন্যে আপন সন্তানের সুখকেও বিসর্জন দিতে পিছপা হন না। আমি আপনার খেলার ঘুটি হবো না।”

গাই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ালো। এতোটাই রেগে গিয়েছে যে ধাক্কা দিয়ে ডেস্কটাকে সামনে ঠেলে দিলো।

“এতো বড় সাহস তুই আমার কথার উপর কথা বলিস?”

ক্রিস্টোফার তাতে ঘাবড়ালো না। আমি এখন আর ছোট ছেলে নেই যে আপনি যখন ইচ্ছে ধরে পেটাবেন। আমার যেমন ইচ্ছা আমি সেভাবে নিজের জীবন সাজাবো। আপনার পছন্দ মতো না। আমার যেখানে ইচ্ছা আমি যাবো, যাকে ইচ্ছা বিয়ে করবো।”

গাই-এর গলার শিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যেতে লাগলো। “খবরদার, ক্রিস্টোফার! এই সমুদ্রের দুই কূলে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গিয়ে তুই আমার হাত থেকে নিস্তার পাবি।”

“আপনাকে আমি ভয় পাই না।”

“পাওয়া উচিত,” ভয়ানক স্বরে বললো গাই। “তোকে আমি শেষ করে দিতে পারি।”

ক্রিস্টোফার তার দিকে তাকিয়ে রইলো। “কি বলছেন বুঝে বলছেন তো? কোন পদের মানুষ নিজের ছেলেকে এই কথা বলতে পারে? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে আপনি আমার বাবা না।”

কথাটা গাই-এর এমন এক জায়গায় আঘাত করলো যেটা সম্পর্কে ক্রিস্টোফারের কোনো ধারণাই নেই। প্রচণ্ড রাগে মাথা খারাপ করে গাই একটা রূপার কাগজ কাটা ছুরি হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ক্রিস্টোফারের দিকে। ছুরিটা ক্রিস্টোফারের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দরজায় বিধে কাঁপতে লাগলো।

ক্রিস্টোফার এক চুল নড়লো না। এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়েই রইলো। ওরও রাগে সারা শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সামলে রেখেছে। গাই এর আগে খেয়াল করেনি যে তার ছেলে কতোটা লম্বা হয়ে গিয়েছে।

“বিদায়, বাবা। আমাদের আর দেখা না হওয়াই ভালো হবে।”

“দাঁড়াও,” গাই ডাক দিলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার আর ওর ডাক শোনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই।

*

সুর্য কিরণ একেবারে বজ্রপাতের মতো ক্রিস্টোফারের চোখে আঘাত করলো। মাত্র যা করে এসেছে তার ভয়াবহতা মনে হতেই ওর মাথা ঘুরে যাচ্ছে। একরকম টলতে টলতেই রাস্তাটা পার হয়ে এলো। সমুদ্রতীরের সাথে দেখা করলো রুথ। জায়গাটা মরচে পড়া নোঙ্গর আর ছিঁড়ে যাওয়া দড়াদড়িতে ভরা। শেষ দেখা হওয়ার পর এক ঘণ্টাও পার হয়নি, তবুও রুথ দুই হাত বাড়িয়ে এমনভাবে ক্রিস্টোফারকে জড়িয়ে ধরলো যেনো কতোকাল ওদের দেখা হয় না।

নয়মাস আগে রুথ ওর বাবার সাথে এখানে এসেছে। ওরা যে ইন্ডিয়াম্যানে করে এসেছিলো সেটা ক্রিস্টোফারের চোখের সামনেই বন্দরে এসে নোঙ্গর করে। দুর্গের দেয়ালের পাশে বসে ও জাহাজের যাত্রীবাহী ডিঙ্গিটায় রুথকে এক ঝলক দেখতে পায়। মাত্র ষোল বছর বয়স, শঙ্খের মতো গায়ের রঙ, লাল টকটকে চুল, কোনো মেয়েতে এই দুই রঙের সম্মিলন এর আগে দেখেনি ও। নৌকাটা দুর্গের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রুথ চোখ তুলে তাকায়, চোখে ওর নতুন ঠিকানা সম্পর্কে সন্দিহান কৌতূহল। তখনই ক্রিস্টোফারের নজরে পড়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে ও নিজের উরুতে এমন, এক কাঁপুনি টের পায় যা আগে কখনোই পায়নি। কামনার আবেশে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো ওর।

বোম্বেতে এক ইংরেজ মেয়ের আগমন অনেকটা মরুভূমিতে গোলাপ ফোঁটার মতো। আর সেই ফুলের সুবাস নিতে পুরুষ মানুষের অভাব নেই এখানে। কিন্তু গাই কোর্টনীর ছেলে রুথের ব্যাপারে আগ্রহী জেনে সবাই হাত গুটিয়ে নেয়।

তারপরেও সবকিছু হতে সময় লাগে অনেক। ক্রিস্টোফার মেয়েদের সাথে কথাই বলতে পারতো না। কারণ দাসী বাদে আর কোনো মেয়ের সাথে কখনো কথা হয়নি ওর। কতো রাত ও জেগে কাটিয়েছে রুথ এর ঠোঁটের স্বাদ কেমন হবে সেটা চিন্তা করে করে। নিজের কাপুরুষতায় নিজেকে হাজারবার গালাগাল করে কাটিয়েছে আরো কতো রাত।

রুথ নিজেও ছিলো অনেক ধৈর্যশীলা। ও বুঝতে ক্রিস্টোফারের আসলে কেমন লাগে, কিন্তু ওর বাবা মা সেটা বুঝতে না। ও ক্রিস্টোফারের ভিতরের ভালোবাসাটা ধরতে পেরেছিলো, সেটাকেই ও মমতা আর যত্নের দিয়ে বের করে এনেছে। গভর্নরের বাড়িতে একটা সমাবেশ হয়েছিলও একবার। সেখানে সৈন্যদের পরিবারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়, কারণ এখানে মহিলার সংখ্যা ছিলো একদমই কম। সেখানে রুথ ক্রিস্টোফারকে নাচের আমন্ত্রণ জানায়। প্রথম যখন ক্রিস্টোফার রুথকে স্পর্শ করে, ওর সারা শরীর কেপে ওঠে। সারা রাত নেচেছিলো ওরা সেদিন। কিন্তু তাতে ওর প্যান্টের সামনের দিকটা ফুলে আটসাট হয়ে গিয়েছিলো, মনে মনে ভাবছিলো যে সবাই নিশ্চয়ই ওকে দেখে। হাসছে। কিন্তু রুথ হাসলো না। ও ক্রিস্টোফারকে নাচে সাহায্য করতে লাগলো, আর নাচের ফাঁকে যখনই ওরা মুখোমুখি নাচতো তখন ও একটু সামনে এগিয়ে যেতো যাতে ক্রিস্টোফার পরনের পাতলা কাপড়টার উপর দিয়েই ওর শরীরের প্রতিটা বাক টের পায়।

এরপর ওরা দুজন প্রায় প্রতিদিন দেখা করতো। গোলঘরের পিছনে, বা ব্যাক বে-র সৈকতে, নারকেল বাগানের আড়ালে ওরা সময় কাটাতে। হাতে হাত রেখে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে ওরা। রুথ ক্রিস্টোফারকে ইংল্যান্ডের গল্প বলতো। ওখানে ক্রিস্টোফারের বাড়ি হলেও কখনো সেটা দেখার ভাগ্য হয়নি। রুথ এমন অনেক কিছু দেখেছে যা ক্রিস্টোফার শুধু বইয়ের পাতাতেইও পড়েছে বা ওর বাবার অধীনস্তদের আলাপচারিতায় শুনেছে। রুথ ক্রিস্টোফারের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখে কথা বলতো। দেখা যেতো রুথ বকবক করেই চলেছে আর ক্রিস্টোফার ওর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই আছে।

প্রথমবার চুমু খাওয়ার পর ক্রিস্টোফারের মনে হয়েছিলও যে জীবন এর চাইতে মধুর হতে পারেনা। পরে রুথ ক্রিস্টফারকে ওর কাচুলি খুলে বুকে হাত দিতে দিয়েছে। ও নিজেও ক্রিস্টোফারের পায়জামায় হাত ঢুকিয়ে ওর পুরুষাঙ্গ নাড়াচাড়া করেছে। কিন্তু এর বেশি কিছু ক্রিস্টোফারকে করতে দেয়নি। “বিয়ের আগে এসব পারবো না,” জোর দিয়ে বলেছে রুথ। আর ক্রিস্টোফার ওর দুই স্তনের মাঝে মুখ ডুবিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে, “তোমাকেই আমি বিয়ে করব।”

এখন রুথ ক্রিস্টোফারের উভ্রান্ত চেহারা দেখে দুই হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো। “কি বললেন বাবা? বলো সোনা? খারাপ লাগছে? বাবা অনুমতি দিয়েছেন?”

“না।” ক্রিস্টোফার ধপাস করে ডাঙ্গায় তুলে রাখা একটা ভাঙাচোরা নৌকার খোলের উপর বসে পড়লো। ধাক্কায় একগাদা মাছি ভনভনিয়ে উড়ে গেলো।

রুথের নিষ্পাপ নীল চোখে অশ্রু জমলো। “কি করবো আমরা এখন? আমিতো তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। এরচে মরে যাওয়াই ভালো হবে।”

ক্রিস্টোফার চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই চোখ ধাঁধানো আলোয় ঠিকমতো চিন্তা ভাবনা করা যাচ্ছে না। ও কপাল ডলতে ডলতে বাবার সাথে হওয়া কথোপকথনটা আরো একবার ভাবতে বসলো। রুথের জন্যে ওর ভালোবাসাটা এতো খাঁটি, এতো পবিত্র! ওর বাবা কিভাবে সেটাকে অস্বীকার করেন? কতো বড় সাহস তার? ওর এতো বেশি হতাশ লাগতে লাগলো যে একবার চিন্তা করলো একটা নোঙ্গর পায়ে বেঁধে সাগরে ঝাঁপ দেবে কিনা। সব শেষ করে দেবে। দমবন্ধ লাগছে ওর। বাবাকে বোঝানো কখনোই সম্ভব না।

কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না।

“বোষে ছেড়ে চলে যাবো,” আচমকা বললো ও।

“আমিও যাবো তোমার সাথে!”।

ক্রিস্টোফার মাথা নাড়লো। “আমার বাবা আমাকে এটা কানাকড়িও দেবে না। আমাকে নিজের পরিশ্রমে নিজের ভাগ্য গড়তে হবে। আর সেখানে মহিলাদেরকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানেই থাকো, তোমার পরিবারের সাথে, আর আমার ফিরে আসার অপেক্ষা করো।”

“পারবো না।”

“পারতেই হবে। আমি জানি কতোটা কষ্ট হবে তোমার, কিন্তু আমাদের জন্যে তোমাকে পারতেই হবে।” ক্রিস্টোফার উঠে দাঁড়িয়ে রুথকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো। কামনার আগুনে জ্বলে যাচ্ছে ও, কিন্তু তারচে বড় কথা ওর বাবাকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। “তুমি এখানেই থাকো, তাহলে বাবা ভাববেন যে উনি-ই জিতেছেন। কিন্তু যখন আমি ফিরে আসবো, তখন আমার জয় সম্পূর্ণ হবে-সেই সাথে আমাদের দুঃখেরও শেষ হয়ে যাবে।”

রুথ ক্রিস্টোফারের ঠোঁটে চুমু খেলো। “কথা দাও ক্রিস্টোফার, কথা দাও যে তুমি আমাকে সুখী করবে।”

“প্রতিজ্ঞা করলাম সোনা। যদি তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করো, আমি এতো বেশি টাকা কামাবো যে আমার বাবাও আমাদেরকে ছুতে পারবে না।”

“আমি অপেক্ষা করবো। ঈশ্বরের কসম। তুমি বিশ বছর পরেও যদি ফিরে আসো, তবুও আমি অপেক্ষা করবো। প্রতিদিন এখানে বসে তোমার ফেরার অপেক্ষা করবো।”

“ওডিসাস আর পেনেলোপির মতো,” হাত নেড়ে বললো ক্রিস্টোফার।

রুথের ভ্রু কুঁচকে গেলো। “কাদের মতো?”

“কাদের মতো সেটা ব্যাপার না।” বলতে বলতে ও গায়ের কোটটা খুলে ফেললো। ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে গিয়েছে সেটা। আর এখন যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, রওনা দিতে আর তর সইছে না ক্রিস্টোফারের। চোখের উপর হাত দিয়ে ও বন্দরের দিকে তাকালো। ইস্ট ইন্ডিয়াম্যানটা তখনও বাধা অবস্থায় দুলছে। তবে একটা ছোট সওদাগরী জাহাজের ডেক এ নড়াচড়া দেখা গেলো। জাহাজটা সমুদ্রে নামানোর জন্যে প্রস্তুত করছে ওটার ক্রু-রা।

“জোয়ার আসলেই জাহাজটা ছেড়ে যাবে। ওটায় চড়ে কোথায় যাওয়া যায় দেখি।” আবার রুথকে চুমু খেলো ক্রিস্টোফার। ওর শক্ত বাহুর স্পর্শে রুথের শরীরেও শিহরণ বয়ে গেলো।

“আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো কিন্তু।”

“কথা দিচ্ছি করবো।”

*

সাথে নেওয়ার মতো ক্রিস্টোফারের কিছুই নেই। ওর সব সম্পত্তি রয়ে গিয়েছে গভর্নরের বাড়িতে, ওর ঘরে। আর ওখানে ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না। ক্রিস্টোফার ঘাটে গিয়ে একটা ডিঙ্গি নৌকাকে ডেকে বললো ওকে সওদাগরি জাহাজটায় নিয়ে যেতে। জাহাজটার নাম জোসেফ। আলাদা একটা আড়কাঠে খোদাই করে লেখা। ও জাহাজে উঠে পড়লো। বেশিরভাগ ক্রু ই ভারতীয়, সবার গায়ের রঙ গাঢ়, গায়ে কাপড় নেই বললেই চলে। মালপত্র বোঝাই চলেছে। ডেক-এর একমাত্র শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে দেখে মনে হলো সে-ই মাস্টার। লম্বা একটা লোক, চুল একেবারে খুলির সাথে ছেটে রাখা। পেশল বাহুতে একটা মৎস্যকুমারীর ট্যাটু। মালপত্র ওঠানামা তদারকিতে বিরতি দিয়ে ক্রিস্টোফারের দিকে এগিয়ে এলো।

“কি চাই?” গর্জে উঠলো লোকটা।

“আপনার জাহাজে কাজ করতে চাই।”

মাস্টার ওর আপাদমস্তক পরখ করলো। দেখে মুখ বিকৃত করে বললো, “আমি চিনি তোমাকে। তুমি গভর্নরের ছেলে, ক্রিস্টোফার কোর্টনী

ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালো।

“শালা একটা খবিশ?”

লোকটা এটো কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো যে ওর মুখের থুতু এসে ক্রিস্টোফারের মুখে লাগলো। ক্রিস্টোফার নড়লো না।

“তো?” মাস্টার বললো। “আমি তোমার বাবাকে গালাগাল করে যাবো আর তুমি কিছুই বলবে না? কেমন ছেলে তুমি?”

“আমার বাবাকে পরোয়া করলে তো আর আমি এখানে আসতাম না।”

মাস্টার চটাশ করে ওর গালে একটা চড় কষালো। “যথেষ্ট বেয়াদবি হয়েছে। জাহাজে থাকতে হলে বড়দের সম্মান করতে হবে, নইলে ভাগো।”

সাথে সাথে অবশ্য ক্রিস্টোফার প্রত্যুত্তরে মারতে পারে ভেবে নিজের মুখের সামনে হাত তুলে আড়াল করলো। ক্রিস্টোফার বহু কষ্টে আঘাত করা থেকে বিরত থেকে নিজেকে শান্ত রাখলো। ওর বাবার কাছে থেকে যদি একটা জিনিস শিখে থাকে সেটা হচ্ছে মার খেয়ে কিভাবে হজম করতে হয়।

মাস্টার ডেক-এ থুতু ফেললো। ক্রিস্টোফারের পায়ের বুড়ো আঙুলের ঠিক পাশে পড়লো সেটা।

“এর আগে জাহাজে কাজ করেছিস?” সম্বোধন বদলে গেলো মাস্টারের।

“না, স্যার।”

“কখনো সমুদ্রে গিয়েছিস?”

“না, স্যার।”

“তাহলে কোন দুঃখে আমি তোমাকে আমার. জাহাজে নেবো? এটা তো। তোমার বাবার সোনায় মোড়া ইন্ডিয়াম্যান না যে কয়েকশো কামলা থাকবে জাহাজ চালানোর জন্যে। এখানে থাকতে হলে খেটে খেতে হবে, নইলে ঈশ্বরের কসম আমি এতো জোরে তাকে পানিতে ছুঁড়ে মারবো যে পড়ার শব্দটা পর্যন্ত কেউ টের পাবে না।”

“আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পারি স্যার।”

“কঠোর পরিশ্রমের ক সম্পর্কেও তোর ধারণা নেই।” বলে মাস্টার ক্রিস্টোফারের হাতটা টান দিয়ে নিয়ে তালু উল্টে ধরলো। “এই দুধ-সাদা চামড়ার দিকে তাকা। জীবনে এই হাত দিয়ে এক গাছি রশিও পাকাস নাই।” তারপর ঘুরে বললো। “জাহাজ থেকে নেমে যা, নইলে ছুঁড়ে ফেলে দেবো।”

“দাঁড়ান,” ক্রিস্টোফার ডাকলো। তারপর ও ডেক-এর এক কোণে পড়ে থাকা কাপড়ের একটা গাট্টি তুলে নিলো। “কি এটা? কালবেলে? রেশমের সাথে কার্মানিয়া উল দিয়ে বোনা, তাই না? আর এটা হচ্ছে জুরিস, সবচে বেশি দিন টেকে এই সুতি কাপড়। এটা হচ্ছে

“আমার জাহাজ ছেড়ে ভাগ,” মাস্টার ক্রিস্টোফারের জামার গলার কাছে মুঠো করে ধরে শূন্যে তুলে ডেক-এর অন্য পাশে নিয়ে গেলো। তারপর জাহাজের কিনার দিয়ে ঠেলে দিলো নিচে।

‘আট রুপি, হাফাতে হাফাতে বললো ক্রিস্টোফার। “প্রতি গজ আট রুপি। কালবেলের জন্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আট রুপি দেবে আর জুরিস এর জন্যে ছয় রুপি।”

ও জাহাজের পাশ ধরে ঝুলে রইলো। মাস্টার ওর কাছে মুখ নামিয়ে আনলো। পিছনে নীল আকাশের প্রচ্ছদে তার পোড় খাওয়া মুখটা দেখতে অদ্ভুত লাগছে।

“তুই এসব কিভাবে জানিস?”

“বাবার হয়ে অনেক কাজ করেছি আমি। লেজার বইতে জিনিসপত্রের দাম লিখতাম। কোম্পানি কোন বন্দরে কোন মালের জন্যে কতো দাম দেয়, তার সবই আমার জানা।” বিশাল হাতটা ওর গলা চেপে ধরে টেনে আবার তুললো। দম বন্ধ হয়ে এলো ক্রিস্টোফারের। “এসব তথ্য কিন্তু আপনি কাজে লাগাতে পারবেন।”

মাস্টার ক্রিস্টোফারকে ছেড়ে দিলো। ডেক-এ আছাড় খেয়ে পড়লো ও। পড়েই পিঠ চেপে ধরলো।

ভারি বুটের লাথি পড়লো বুক বরাবর।

“উঠে দাঁড়া।”

পিঠের ব্যথা আর বমি বমি ভাব দুটোকেই অগ্রাহ্য করে ক্রিস্টোফার উঠে দাঁড়ালো। মাস্টার ওকে ক্ষুধার্ত হাঙরের দৃষ্টিতে জরিপ করলো কিছুক্ষণ।

“আমি তোকে আমার নবীশ হিসেবে নেবো। মাসে চার রুপি করে পাবি। থাকা খাওয়া এর বাইরে।” ক্রিস্টোফারের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে হেসে দিলো লোকটা। “তোর কি মনে হয়? তোর দাম আরো বেশি? শালা নরম চামড়ার দামড়া ছোঁড়া? তাহলে আর একটা জাহাজ খুঁজে নে, যা।”

ক্রিস্টোফার হাত মুঠি করে ফেললো। কাজটা যে সহজ হবে না তা তো। আগেই জানা ছিলো, নিজেকে বললো ও। নিজের ভাগ্য গড়ার আগে ব্যবসাটা সম্পর্কে জানতে হবে।

“আমি রাজি।”

মাস্টারকে দেখে মনে হলো হতাশ হয়েছে। ক্রিস্টোফার বুঝলো লোকটা ওকে আবার আঘাত করার মওকা খুঁজছিলো। তবে ও খুব বেশি ভয় পেলো না। গাই-এর কাছে বড় হওয়ায় এসব ওর কাছে এখন পানি ভাত হয়ে গিয়েছে।

মাস্টার রেজিস্টার খাতা আনলে ক্রিস্টোফার সেখানে সই করলো। বাকি সব ভারতীয় ক্রুদের কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং-এর মতো লেখার মাঝে ওর ঝকঝকে হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছিলো ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরের মাঝে শান্ত দ্বীপমালা।

গরমের কারণে লেখা শেষ না হতেই কালি শুকিয়ে গেলো। মাস্টার ঠাস করে বইটা বন্ধ করে বললো, “এখন থেকে তোর মালিক আমি। যদি কখনো দেখেছি কাজে ফাঁকিবাজি করছিস, তাহলে যে কি করবো সেটা খোদা মালুম। আমার জাহাজে যতোক্ষণ আছিস ততোক্ষণ তোর বাবার নামের-ও কোনো মূল্য নেই। তোর চামড়া সাদা আর হাতের লেখা ভালো বলে ভাবিস না যে পার পেয়ে যাবি। উল্টাপাল্টা কিছু করলে ওই কালাগুলোর মতোই ঠেঙানি খাবি। বোঝা গিয়েছে?”

“জ্বী স্যার।”

মাস্টার ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ক্রিস্টোফার বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে নিলো। কাধও আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে নেমে গেলো নিচে। ভঙ্গিটা ও ওর বাবার হাতে মার খাওয়ার সময় আয়ত্ত্ব করেছে। মাস্টার ঘোত ঘোত করলো কিন্তু আর কিছু বললো না।

“এখন কাজে যা।”

মাত্র দশ মিনিটের মাঝে ক্রিস্টোফার বুঝে ফেললো কোন পাকে এসে পড়েছে ও। গায়ের দামি উলের পোশাকটা খুলে কোমরে বেঁধে বাকি খালাসিদের সাথে হাত লাগিয়ে কপিকল দিয়ে নোঙ্গর তোলা শুরু করলো। ওর নগ্ন পিঠে আগুন ছড়াতে লাগলো সূর্য। কপিকলের দড়ির টানে হাতে কড়া পড়ে গেলো। তবুও ও মাথা তুলে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করলো। ডাঙ্গায় তাকাতেই দেখলো পানির ধারে একটা জটলা, কোম্পানির ইউনিফর্ম পরা একদল লোক জোসেফ-এর দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। ওটা কি ওর বাবা? হয়তো উনি নিজের মন বদলে ফেলেছেন।

আচমকা পিঠে প্রচণ্ড একটা গুতো খেয়ে সম্বিত ফিরলো ওর। ঝাঁকি দিয়ে উঠে ফিরে দেখে কপিকলের দণ্ডটা ঝুলতে ঝুলতে ওর পিঠে এসে বাড়ি খেয়েছে। ও আবার ওটা ধরে নিজের কাজ করা শুরু করলো। আড়চোখে দেখলো মাস্টার জাহাজের পাশ থেকে ওর দিকে নজর রাখছে আর হাতে ছোট এক টুকরো মোটা দড়ি দোলাচ্ছে। উদ্দেশ্য ওটা দিয়ে ওকে মারবে।

“মন কোথায় যায় রে মুরগির বাচ্চা? আর একবার ভুল করবি তো কি করি দেখিস।”

“ওর কথায় ক্ষেপে যেওনা যেনো,” পিছন থেকে ফিসফিস করে বললো কেউ। লোকটা বলছে পর্তুগিজ ভাষায়। মালাবার উপকূলে এটাই হচ্ছে লিংগুয়া ফ্রাংকা (সবাই ব্যবহার করে এমন সাধারণ ভাষা)। ক্রিস্টোফার গলা লম্বা করে পিছনে হেললো। তখনও কপিকল টেনে চলেছে। একটা একহারা ছেলে নজরে এলো। গায়ের রঙ কালো কিন্তু চোখ জোড়া বেশ উজ্জ্বল। ওর পরের দণ্ডটাই ঠেলছে সে। ক্রিস্টোফারের চাইতে ওর বয়স কম, কিন্তু হাতে কড়া পড়ে শক্ত হয়ে আছে, এই বয়সেই গায়ে কিলবিল করছে পেশি।

“ক্যাপ্টেন ক্রফোর্ড একটা আস্ত শয়তান, আবার ফিসফিসিয়ে বললো ও। কপিকলের ক্যাচকোচের কারণে শোনাই যায়না বলা যায়। কিন্তু ওনাকে এড়ানোর উপায়ও আছে। তুমি যতোই ওনার সাথে শক্তি দেখাবে, উনি ততোই তোমাকে ভাঙার চেষ্টা করবে।”

অবশেষে উঠে এলো নোঙ্গরটা। দ্রুত ওটাকে শক্ত করে জায়গামতো বেঁধে ফেলা হলো। পালগুলো তুলে দিতেই কিছুক্ষণের মাঝে সাগর ছুঁয়ে আসা বিকেলের মৃদুমন্দ বাতাসে ফুলে উঠলো ওগুলো। আদেশমতো ক্রিস্টোফার পালের দড়িগুলো টেনে ধরে রাখলো। সেটা করতে গিয়ে কয়েকবার ক্রফোর্ডের দড়ির বাড়িও পড়লো পিঠে। কিন্তু একটা বারও পিছু ফিরে দেখলো না।

সেই রাতে ও জাহাজের পিছন দিকে ডেক-এর উপর বিছানা পাতলো। পিঠের নিচে শক্ত কাঠের তক্তা। তার উপর ব্যথায় সারা শরীর কাতরাচ্ছে। দাতে চেপে সেগুলো সহ্য করে তারার দিকে চেয়ে রইলো। আজ সকালেও ও গভর্নরের বাড়ির পালকের বিছানায় ঘুম থেকে উঠেছে। চাকরেরা বলার আগে ওর প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট হয়েছে। আর এখন শোয়ার জন্যে ওর এমনকি একটা কম্বল পর্যন্ত নেই।

একটা কালো অবয়ব এসে ওর পাশে বসলো। অন্ধকার সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠলো লোকটার। কপিকল টানার সময় যার সাথে কথা হয়েছিলো সেই ছেলেটা।

“আমার নাম দানেশ,” নিজের পরিচয় দিলো ছেলেটা।

“ক্রিস্টোফার।”

“তোমার বাবা আসলেই বোম্বের গভর্নর?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি ওনাকে খুন ঘেন্না করো, তাই না?”

ক্রিস্টোফারের গাই-এর চোখের দৃষ্টিটা মনে পড়লো।

“হ্যাঁ, করি।”

দানেশ ওকে একটা কম্বল ধরিয়ে দিলো। “আর এই অভিযান শেষ হতে হতে তুমি ক্রফোর্ডোকে আরো বেশি ঘৃণা করবে।”

*

পরের তিন সপ্তাহ ছিলো ক্রিস্টোফারের জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর সময়। দ্বিতীয় দিন ক্রফোর্ড ওকে মাস্তুলের মাথায় উঠে পাল খাটাতে আদেশ দেয়। মাস্তুলে অর্ধেক ওঠার পর ক্রিস্টোফার নিচে তাকিয়ে দেখে যে আর কেউ ওর সাথে উঠছে না। সবাই ডেক-এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে বাজি ধরছে।

সেই মুহূর্তে দমকা বাতাসে একদিকে হেলে পড়লো জাহাজটা। খুবই সামান্য, কিন্তু ক্রিস্টোফারের মনে হলো যেনো হারিকেন বয়ে গেলো। ও উল্টোদিকে হেলে পড়ে একদিকে কাত হয়ে গেলো। ঢেউগুলো দেখে মনে হলো ওর দিকে ছুটে আসছে। ডেক-এর লোকগুলো কেউ শিষ দিয়ে উঠলো, কেউবা হেসে উঠলো হো হো করে। ক্রফোর্ড চিৎকার করে কিছু একটা বললো, কিন্তু ক্রিস্টোফারের হৃৎপিণ্ড এতো জোরে ধুকপুক করছিলো যে সেসব ও কিছুই শুনতে পেলো না। ওর হাত ফসকে যেতে শুরু করলো।

জাহাজটা আবার সোজা হলো। ক্রিস্টোফারের ভয়টাও কাটলো কিছুটা। বুঝতে পারলো যে, ও যদি সাগরের দিকে তাকায় তাহলে আর এখানে থাকতে পারবে না, পড়ে যাবে। জোর করে ও উপরের দিকে দৃষ্টি ফেরালো-মাস্তুলের একদম মাথায়। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে উপরে উঠতে লাগলো। এক হাত প্রথমে তোলে তারপর অন্য হাতটা দিয়ে নিজেকে টেনে তোলে। প্রতিটা ধাপ পার হতে গিয়ে অবর্ণনীয় আতংক বয়ে গেলো ওর ভিতর দিয়ে। শেষে একটা রশির নাগাল পেতেই এমনভাবে আঁকড়ে ধরলো-যেভাবে বাচ্চা তার মায়ের আঙুল আঁকড়ে ধরে।

কিভাবে মাস্তুলের মাথায় পৌঁছালো তা জানে না ও। তবে এটাই সবার উঁচু না, প্রধান মাস্তুল আরো উঁচু। ক্রিস্টোফারের মনে হচ্ছিলো ও বুঝি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করে ফেলেছে।

কিন্তু নিচ থেকে কেউ উল্লাস প্রকাশ করলো না। অবাক হয়ে ক্রিস্টোফার। বুঝতে পারলো ও এতো কষ্ট করে যা করলো তাতে কেউই তেমন খুশি হয়নি। বরং সবাই চেয়েছিলো যাতে ও পড়ে যায়। এটাই ওর জীবনের পরিণতি এখন-অন্যের বিনোদনের খোরাক হওয়া।

তবে ওদের আশা শেষ হয়নি এখনো, কারণ ক্রিস্টোফারের অগ্নিপরীক্ষা আরও বাকি। উপরে ওঠা হয়েছে, এখন ওকে আড়কাঠের কিনারায় যেতে হবে। ওর পায়ের নিচে তখন সরু একগাছি দড়ি বাদে আর কিছুই থাকবে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরো কয়েকজন নাবিক ওর সাথে যোগ দিলো। ওরা সবাই আড়কাঠ ধরে বানরের দক্ষতায় চলাফেরা করতে লাগলো। জাহাজের দুলুনিতে সামান্য কিছুও হলো না। কয়েকজন ইচ্ছা করে ক্রিস্টোফারকে ঠেলা দিলো, ওর হাতের উপর পাড়া দিলো বা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাঁধে ধাক্কা দিলো।

ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায়।

পাল বাধার দড়িটার গিটু খুলতে গিয়ে আঙুল বারবার পিছলে যেতে লাগলো ক্রিস্টোফারের। পায়ের নিচে দড়িটাও নড়েচড়ে গেলো বারবার। ওটা এতো চিকন যে ক্রিস্টোফারের মনে হতে লাগলো বাতাসের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। এরপর শুরু হলো নতুন এক আতংক, নিচে নামা। এক পা, এক পা করে নামিয়ে স্পর্শ করে করে পা বাধানোর জায়গাটা খুঁজে খুঁজে নামলো ও। কারণ নিচে তাকানোর সাহস হচ্ছিলো না।

নেমে এসে মাস্তুলটা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ক্রিস্টোফার। কারণ পায়ে মনে হচ্ছিলো একটুও বল নেই। বহু কষ্টে বমি আটকালো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব খুশি লাগছিলো নিজের উপর। ও কাজটা পেরেছে। ডেক এর উল্টো পাশ থেকে দানেশ ঠোঁট নেড়ে বলললো, “সাবাস।”

পিঠের উপর কাটা দড়ির ঘা পড়তে সম্বিত ফিরলো ওর। ব্যথায় মুখ বিকৃত করে ঘুরে দেখে ক্রফোর্ড ওর দিকে ঝুঁকে আছে।

“আমিতো তোকে নামতে বলিনি।”

ক্রিস্টোফার জবাব দিয়েই ফেলেছিলো প্রায় সামলে নিলো শেষ মুহূর্তে। আপনাআপনি মাথা নিচু করে ক্রফোর্ডের রাগ কমার অপেক্ষা করতে লাগলো।

“তুই উপর থেকে লক্ষ্য রাখবি। এসব এলাকায় জলদস্যু আছে। ওদের কেউ যদি আমাদের জাহাজের এক মাইলের ভিতর আসতে পারে তো জ্যান্ত তোর চামড়া ছাড়িয়ে নেবো।”

ক্রিস্টোফার এমনভাবে বাঁকা হয়ে গেলো যেনো ওর গায়ে আবার আঘাত করা হয়েছে। প্রধান মাস্তুলের মাথায় তাকালো ও, অসম্ভব উঁচু। আবার কি ওখানে উঠতে পারবে?

ক্রিস্টোফারের দৃষ্টি খেয়াল করে শয়তানি হাসি খেলে গেলো ক্রফোর্ডের ঠোঁটে।

“এখানে দাঁড়িয়ে কিছুই দেখা যাবে না। তুই উঠে ক্রসট্রেসে দাঁড়িয়ে থাকবি।”

ক্রসট্রেস হচ্ছে প্রধান মাস্তুলেরও উপরে একসাথে জোড়া লাগানো দুটো সরু আড়াআড়ি কাঠ। খুবই ছোট। ক্রিস্টোফার নিচ থেকে ওটাকে দেখতেই পাচ্ছে না। এমনকি সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো।

ও নড়লো না। ক্রফোর্ড জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে হাতের দড়িটা প্যাচাতে লাগলো। তারপর আবার সোজা করে ওটার জোর পরীক্ষা করলো।

“কথা কানে যাচ্ছে না?”

ক্রিস্টোফার বহু কষ্টে চোখে উপচে ওঠা অশ্রু সামলালো। ক্রফোর্ডোকে ও জিততে দেবে না কিছুতেই।

“যাচ্ছি স্যার।”

“তাহলে আবার বলার আগেই তোর ফর্সা পাছাটা মাস্তুলের উপরে তুলে ফেল। আর আমি বলার আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবি।”

ক্রিস্টোফার আর কিছু না বলে উঠতে শুরু করলো।

*

জীবনে ক্রিস্টোফার অনেককেই ঘৃণা করে, কিন্তু বর্তমান জীবনটাকে ও অন্য সব কিছুর চাইতে বেশি ঘৃণা করে। এমনকি ওর বাবার চাইতেও। তবে গাই এর কথা ওর আর মনে পড়ে না বললেই চলে। জাহাজ সামলানোর অবিরত কাজ-এটা সেটা করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলা–সবসময় সবার শেষে নিজের দায়িত্ব শেষ করতে পারাওর এখন অলস চিন্তা করার বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই। যখন কাজের ফাঁকে একটু সময় পায়, তখনি ও থাকার জায়গায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে আর ব্যথার জায়গাগুলোতে তেল মালিশ করে। ওর শরীরে এখন সেই প্যাগোডা খচিত মুদ্রার সমান একেকটা ফোস্কা।

জাহাজের বাকি লোকজন ওকে এড়িয়ে চলে। গায়ের রঙ সাদা হওয়ায় ও যেনো ভিন গ্রহের কোনো প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয় সবার কাছে। আর নাবিক হিসেবে সবাই ওকে করুণার চোখে দেখে। শুধু দানেশ ওর প্রতি সদয়। তবে ও-ও সবসময় সতর্ক থাকে যাতে ক্রিস্টোফারের সাথে ওর মেশাটা কেউ দেখে না ফেলে। জীবনে এতোটা একা কখনো লাগেনি আগে। এ কারণেই কয়েকদিন পরেই দেখা গেলো ও মাস্তুলের মাথায় ওঠার আদেশ পাওয়ার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় করা শুরু করেছে। তবে এখনো ওখান থেকে নিচে তাকানোর সাহস অর্জন করতে পারেনি। উপরে পালের মাঝে বসে থাকার সময়, ওর নিজেকে মেঘের মাঝে বসে থাকা কোনো দেবতার মতো মনে হয়। মরণশীল মানুষ আর তাদের ঘৃণ্য আচরণ থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। ওখানে বসে বসে ও রুথের সাথে নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে। কোথায় ওরা থাকবে, রুথকে কি কি উপহার কিনে দেবে-এইসব। কিন্তু যখনই ওর বাবা বা। ক্রফোর্ডে অথবা ওর সাথে শত্রুতা করেছে এমন সবার উপর প্রতিশোধের কথাটা মাথায় আসে তখন দেখা যায় সেসব স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে।

এক বিকেলে নজর রাখা শেষে ও নিচে গেলো পানি আনতে। নিচে খোলের ভিতর যেতে ভালো লাগে ওর। কাপড়ের গাটরি আর নতুন প্যাকেট করা কাপড় থেকে যে ঘ্রাণটা ভেসে আসে তা ওকে কোম্পানির গুদামগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। ছোটবেলায় ওটাই ছিলো ওর খেলার জায়গা।

“ক্রিস,” অন্ধকার থেকে হিসিয়ে ডাকলো দানেশ। “এটা দেখো।”

ওর হাতের তালুতে কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে। একটা পিতলের চাবি।

“কিসের চাবি?”

“সিন্দুকের,” দানেশ ফিসফিস করে বললো। “ক্রফোর্ড যখন দড়িগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলো তখন ওর কেবিন থেকে চুরি করেছি।”

গুদাম ঘরের সিন্দুকের ভিতর স্পিরিট রাখা। ওগুলো আসলে ক্রুদের ব্যবহারের জন্যে। কিন্তু গুজব শোনা যাচ্ছে যে ক্রফোর্ড সেটা নাকি বিক্রি করে দেওয়ার পায়তারা করছে।

ক্রিস্টোফার কাঁধের উপর দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে ইতিউতি তাকালো। “ধরা পড়ে গেলে?”

“কয়েক বোতল গায়েব হলে ও টের পাবে না। আমরা পরের বন্দরে ওগুলো বেঁচে দেবো। তাড়াতাড়ি।”

দানেশ চাবিটা তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিলো। খোলা দরজা দিয়ে পিরিটের তীব্র ঝাঝালো গন্ধ নাকে এলো ওর।

“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দাও। ধরা খেলে ক্রফোর্ড কিন্তু জ্যান্ত ছাল তুলে ফেলবে।”

দানেশ ওকে চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লো। ক্রিস্টোফার ওখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ওর মন বলছে দানেশকে এভাবেই ফেলে পালিয়ে যেতে। যদি ধরা পড়ে তাহলে সব অস্বীকার করলেই হবে যে ও এসবের মধ্যে নেই। কিন্তু দানেশই হচ্ছে একমাত্র লোক যাকে ও বন্ধুর কাছাকাছি একজন হিসেবে ধরতে পারে। ও যদি না থাকে তাহলে জাহাজে ক্রিস্টোফারের আর কেউই থাকবে না।

উপরের ডেক-এ পদশব্দ শোনা গেলো। জাহাজের দুলুনির কারণে উপরের হ্যাচওয়ে দিয়ে যে আলোটা আসে তাতে ছায়াগুলো একেক সময় একের রকম আকার ধারণ করছে, তাই বোঝা গেলো না যে লোকটা কে।

“তাড়াতাড়ি,” ক্রিস্টোফার বললো। “কেউ আসছে।”

দানেশ বেরিয়ে এলো। বগলে চার বোতল ব্রান্ডি ধরে রেখেছে। সেগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখলো ও।

“এখানকার সব তো হাতীও খেয়ে শেষ করতে পারবে না,” ফিসফিসিয়ে বললো ও। “আর কয়েকটা আনতে পারলেই আমাদের দুজনের হয়ে যাবে।”

“না,” হিসিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। “এখন চলো। আমরা

ভারী কিছুর চাপে ঝাঁকিয়ে উঠলো কাঠের সিঁড়িটা। এক জোড়া জুতা দেখা গেলো সেখানে, তার উপরে দেখা গেলো সাদা মোজা পরা এক জোড়া গোদা পা। এরপর এক জোড়া চোঙ্গা প্যান্ট। তারপর একটা থলথলে দেহ নেমে এলো, গায়ের জামার বোতামগুলো টানটান হয়ে ছিঁড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে।

দানেশ দ্রুত নোঙ্গরের দড়ির পিছনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওটার বিশাল কুণ্ডলীর ভিতর একজন মানুষ অনায়াসে লুকিয়ে পড়তে পারবে। ক্রিস্টোফার

এক চুলও নড়লো না। যেনো পাথর হয়ে গিয়েছে। ক্রফোর্ড মাথা নিচু করে হ্যাচওয়েটা পার হয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে এলো। সব দেখে শুনে শান্তভাবে সিন্দুকের খোলা দরজাটা লাগালো, তারপর ক্রিস্টোফারের পায়ের কাছে নামিয়ে রাখা বোতল দুটো আর চাবিটা তুলে নিলো।

“যখন খেয়াল করলাম যে চাবিটা পাওয়া যাচ্ছে না তখনই ভেবেছিলাম যে এখানে কাউকে পাওয়া যাবে।”

ক্রিস্টোফার কিছুই বললো না।

“তুই এটা পেলি কিভাবে? আর কে আছে তোর সাথে?”

ক্রিস্টোফার সোজা ক্রফোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো। দৃষ্টি কোনোদিকে সরাচ্ছে না; যাতে করে ক্রফোর্ড ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দানেশের অবস্থান টের না পেয়ে যায়। কিন্তু ক্রফোর্ড এটাকে ঔদ্ধত্য হিসেবে নিলো।

“তোর বাপ বোম্বের গভর্নর বলে কি ভাবিস যে তুই এখানকার সবার চাইতে সেরা? তুই কি ভাবিস সেই ক্ষমতাবলে তুই আমার জিনিস চুরি করতে পারবি?”

ক্রফোর্ডের চেহারা ক্রোধে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। যেনো ঘন কালো মেঘ জমেছে আকাশে। ক্রিস্টোফার এই দৃষ্টি চেনে। ও ইষ্টনাম জপ করা শুরু করলো।

“সারেং,” চিৎকার করে ডাকলো ক্রফোর্ড। “মি. কোর্টনীকে ডেক-এ নিয়ে আয়। আর সবাইকে খবর দে। সবার সামনে শাস্তি দেবো আমি ওকে।”

কয়েকটা কঠোর হাত ওকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে গেলো। উঠেই দেখে বাকি সবাই প্রধান মাস্তুলের পিছনে বসানো একটা কামানের চারপাশে জড়ো হয়ে গিয়েছে। ক্রফোর্ড নিজের ঘরে গিয়ে খানিকটা রশি নিয়ে এলো। ও হাতে করে যে রশি নিয়ে ঘোরে এটা তার চাইতে সরু আর নমনীয়। কিছুক্ষণ আঙুলের ফাঁকে রশিটা নাড়াচাড়া করে সামনের দিকে দুটো গিট দিয়ে নিলা।

“বন্দীকে প্রস্তুত কর,” আদেশ দিলো ক্রফোর্ড।

ওরা ক্রিস্টোফারকে ব্যারেলের উপর শুইয়ে দিলো। সারাদিন রোদের তাপে গনগনে হয়ে থাকা লোহার কড়াগুলো সাথে সাথে ওর নগ্ন বুকে ছ্যাকা দিলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার জানে যন্ত্রণা সবে শুরু। সারেং ওর হাত চেপে ধরে আছে, আর অন্য একজন নাবিক ধরে আছে ওর পা। ঠিক একটা ময়লা কাপড়ের মতো ও ব্যারেলটার উপর লম্বা হয়ে আছে।

পিছনেই জামার হাতা গুটিয়ে নিজেও প্রস্তুত হলো ক্রফোর্ড। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে রশিটার প্যাঁচ খুলে ফেলে, প্রথমে ডেক এর উপর কয়েকবার বাড়ি দিয়ে দড়িটাকে আরো নমনীয় করে নিলো। তারপর পা শক্ত করে হাত পিছনে নিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে ক্রিস্টোফারের পিঠের উপর নামিয়ে আনলো সেটা। শব্দ শুনে মনে হলো মাস্কেটের গুলি লেগেছে পিঠে। ব্যথার পরিমাণ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ক্রিস্টোফার দাঁতের ফাঁকে একটা পাটের দড়ি কামড়ে ধরে রইলো। কাঁদবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। প্রথম আঘাতের পর নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়টুকুও না দিয়ে আবার ক্রফোর্ড ওর দড়ির চাবুক হাকালো। এবার শোল্ডার ব্লেডের মাঝ বরাবর। এরপর তৃতীয়টা। তারপর

ক্রফোর্ড খেই হারিয়ে ফেললো। ঢেউয়ের মতো ব্যথা আসতে লাগলো। একের পর এক-এতো দ্রুত যে সবগুলো মিলে কিছুক্ষণ পর ক্রিস্টোফার অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়লো। অত্যাচারের চূড়ান্ত করলো ক্রফোর্ড। বর্বরতম আচরণ বলে যাকে, যেনো ওর ইচ্ছা ক্রিস্টোফারের শরীরের সকল হাড় গুড়ো করে ফেলবে।

তবে ক্রিস্টোফার এতো যন্ত্রণার মাঝেও প্রতিটা বাড়ি গুণে রাখলো। এভাবেই ও ওর বাবার মার খাওয়ার সময় মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখতো। এই মারটাও হজম করে ফেলতে পারলো তাই। যতোগুলো মার খায় সেই সংখ্যা থেকে যেনো ওর শরীরে শক্তি উতসরিত হয়। একটা কল্পিত লেজারে ও মারগুলো টুকে রাখে। একদিন সুদ সমেত আদায় করবে। যতদিন এভাবে মারের সংখ্যা গুণতে পারবে ততোদিন ও সব অত্যাচারই সহ্য করতে পারবে।

আস্তে আস্তে মারের জোর কমে এলো। ক্রফোর্ড আগের আক্রোশেই হাত চালিয়ে গেলো, কিন্তু ক্লান্ত হয়ে গেলো একটু পরেই। ও দড়িটা ফেলে দিলো। ওটার পাক খুলে গিয়েছে, এখন সেখানে ক্রিস্টোফারের রক্ত আর চামড়া লেগে আছে। লোকজন সবাই নিজেদের কাজে ফিরে যেতেই যারা ক্রিস্টোফারকে ধরে রেখেছিলো তারাও ছেড়ে দিলো। ওদের শরীরও রক্তে ভরে আছে। ক্রিস্টোফার ব্যারেল থেকে গড়িয়ে নেমে ডেক এর উপর স্তূপ হয়ে পড়ে রইলো। এতো ব্যথা সারা শরীরে যে চোখের পাতা বন্ধ করতেও কষ্ট হলো ওর।

কেউ একজন ওর ঠোঁটে এক মগ রাম এনে ধরলো। তৃষ্ণার্তের মতো তা খেয়ে নিলো ও। লোকটা দানেশ। রাম খেয়ে ব্যথা না গেলেও কমলো কিছুটা।

দানেশ ক্রিস্টোফারের পিঠ ধুয়ে দিলো। ক্রফোর্ড ক্রিস্টোফারকে পরিষ্কার পানি দিতে নিষেধ করেছে, দানেশ তাই জাহাজের পাশ দিয়ে বালতি ডুবিয়ে পানি নিয়ে এসেছে। নোনা পানির ছোঁয়ায় চাবুকের বাড়ির চাইতেও বেশি ব্যথা করে উঠলো। সহসাই একটা কালো পর্দা নেমে আসতে লাগলো ওর চোখের সামনে। ও নাড়াচাড়া করতে চাইলো কিন্তু ওর হাত পা কথা শুনলো না।

“উনপঞ্চাশ,” যেনো এক ঘোরের মাঝে বললো ক্রিস্টোফার।

“মানে?”

“ঊনপঞ্চাশটা বাড়ি।” হেসে বললো ক্রিস্টোফার। ঠোঁট নাড়তে গিয়েও অপরিমেয় ব্যথা হচ্ছে ওর। “পঞ্চাশটাও মারতে পারলো না। কাপুরুষ।” বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গেলো ও।

৩. জোসেফ ত্রিভান্ড্রাম বন্দর

এক সপ্তাহ পর জোসেফ ত্রিভান্ড্রাম বন্দরে নোঙ্গর করলো। কু-রা সবাই তো মহা খুশি। বোম্বে ছাড়ার পর আর ওদের ডাঙ্গায় পা দেওয়া হয়নি। পুরো সময়টা ফুর্তিতে কাটাবে বলে ঠিক করলো সবাই। ক্রফোর্ড একটা টুল আর টেবিল নিয়ে ডেক-এ গিয়ে বসলো। নাবিকরা ওর চারপাশে জড় হলো যার যার পাওনা নিতে।

খাতায় নিজের নাম সই করে, হাতে কয়েকটা পয়সা নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে যেতে লাগলো সবাই। ক্রিস্টোফার ছিলো সবার শেষে। ক্রফোর্ডের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। ক্রফোর্ড সরু চোখে তাকালো ওর দিকে।

“কি চাই?”

“আমার বেতন।”

“অবশ্যই,” বলে ক্রফোর্ড মহা আয়োজন করে টাকা গুণতে বসলো। শেষে কয়েকটা মুদ্রা বের করে সেগুলো টেবিলের উপর দিয়ে ঠেলে দিলো সামনে। কিন্তু ক্রিস্টোফার ওগুলো তুলে নিতেই ক্রফোর্ড ওর কবজি ধরে ধরে ফেললো। তারপর মোচড় দিয়ে মুদ্রাগুলো ওর হাত থেকে আবার ফেলে দিলো টেবিলের উপর।

“আবার এসব কি করছিস?”

ব্যথায় ক্রিস্টোফারের চোখ ফেটে পানি চলে এলো। মনে হলো কবজিটা বোধহয় ভেঙেই গিয়েছে।

“আমার বেতন নিচ্ছি।”

“আবার আমার কাছ থেকে চুরি করছিস?”

“প্রতি সপ্তাহে চার রুপি দেওয়ার কথা ছিলো আপনার।”

“তুই আমার নবীশ হিসেবে জাহাজে উঠেছিস। তার মানে তোর সব বেতন আমার কাছে আসবে।” বলে ক্রফোর্ড ক্রিস্টোফারের হাত ছেড়ে দিলো। আচমকা বন্ধন মুক্ত হওয়ায় ক্রিস্টোফার পিছনে উল্টে ডেক-এর উপর পড়ে গেলো। এতোগুলো লোক চেয়ে চেয়ে দেখলো, কেউ ধরতে পর্যন্ত আগালো না। ক্রফোর্ড পয়সাগুলো নিয়ে আবার ওর বক্সে ভরে রাখলো। তারপর ঠাস করে মুখটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে বাঁধা ছুরিটা নাড়তে লাগলো।

“সব পরিষ্কার?”

ক্রিস্টোফার ওখানেই পড়ে রইলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ। প্রতিশোধের নেশা পেয়ে বসেছে ওকে। শুধু ইচ্ছা করছে ছুরিটা ক্রফোর্ডের পেটে গেঁথে দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে ওর মৃত্যুটা দেখতে। ও টের পেলো সবগুলো ক্রু ওকে দেখছে, ওর দুরবস্থা উপভোগ করছে। এদেরকেও ও চরম ঘৃণা করে।

ক্রিস্টোফার নিজেকে টেনে তুলে সোজা ক্রফোর্ডের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলো। কবজির ব্যথাটাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ওকে দাঁড়াতে দেখে অবাক হয়ে গেলো ক্রফোর্ড।

“সব পরিষ্কার,” কাটা কাটা ভাবে বললো ক্রিস্টোফার। আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না ওর।

ক্রফোর্ড আরো একবার ওকে ক্ষেপিয়ে তুলতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেলো। মাত্র কয়েক সপ্তাহেই ক্রিস্টোফার এখন আর বোম্বেতে দেখা সেই নাদুসনুদুস বাচ্চাটা নেই। কাঁধ চওড়া হয়ে গিয়েছে, শরীরও পেশিবহুল হয়েছে আরো বেশি। এখন আর আগের মতো বিনীতও নেই। তবে এতো কিছুর মধ্যে ওর চেহারার পরিবর্তনটা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে। কঠোর আর শক্ত হয়ে গিয়েছে চেহারা। কালো চোখের মণিতে কেমন অস্থিরতা, অথচ দৃষ্টি অনেক গভীর। ক্রফোর্ড মুখে স্বীকার করবে না, কিন্তু চোখ জোড়া দেখে ও নিজেও ভয় পায়।

ক্রফোর্ড ঘুরে আদেশ দিলো, “নৌকা নামাও। আমরা ডাঙ্গায় যাবো। তুই বাদে।” ক্রিস্টোফারের দিকে ঘেউ ঘেউ করে বললো ও। “তুই জাহাজে বসে নোঙ্গরের দিকে খেয়াল রাখবি। যদি আমার জাহাজের কিছু হয়, তাহলে তোকে মাস্তুলে পেরেক দিয়ে গেঁথে কাক দিয়ে খাওয়াবো। বুঝেছিস?”

ক্রিস্টোফার দেখলো শুধু দানেশে ওর দিকে সহানুভুতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বাকিরা ফিরেও তাকালো না। ক্রিস্টোফার বসে বসে দেখলো সবাই নৌকা বেয়ে ডাঙ্গার দিকে চলে গেলো। দানেশ-ও গেলো। একদল মহিলা তীরে দাঁড়িয়ে আছে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে। নামতে না নামতেই সবাইকে প্রায় টেনে হেঁচড়ে কাছের বেশ্যালয়ে নিয়ে গেলো মেয়েগুলো। রাত পোহানোর আগেই এদের সব ইনকাম হাওয়া হয়ে যাবে। তবে তাতে ক্রিস্টোফারের কোনো সান্ত্বনা নেই।

ও জাহাজের ছাউনির ছায়ায় বসে ছুরি দিয়ে একটা কাঠে আঁকিবুকি আকলো কিছুক্ষণ। পুরো জাহাজে ও একা, এই একাকীত্বটাই ওর কাছে ভালো লাগতে লাগলো। সারাজীবন বলতে গেলে ও একা-ই বড় হয়েছে। কুঠির অন্য ছেলেদের সাথে মেশা ওর বারণ ছিলো। কারণ ওর বাবার চোখে বাকিরা ছিলো ওদের চাইতে নিম্ন শ্রেণির। যে গুটি কয়েকের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়েছিলো তারা সব মারা পড়েছে নাহয় ইংল্যান্ড ফিরে গিয়েছে। ওর মা, বাবার ভয়ে কখনো নিজের ঘর ছেড়ে বের হন না। তাই ও সবসময় একা-ই বড় হয়েছে।

ও বুঝতে পারছে যে ওর পক্ষে এভাবে ভাগ্য গড়া সম্ভব হবে না। যদি ও ক্রফোর্ডের অত্যাচার সহ্য করে বেঁচে-ও যায়, তবুও ওকে একটা সস্তা কাপড়ের জামা বানানোর টাকা জমাতেও কয়েক বছর লেগে যাবে। রুথকে তো আর এতো দিন অপেক্ষা করিয়ে রাখা সম্ভব না।

ওর বাবার কাছ থেকে ক্রিস্টোফার আর একটা জিনিস শিখেছে। গভর্নরের অফিসে চুপচাপ সবার অলক্ষ্যে বসে থেকে থেকে ও অনেক মানুষকে অফিসে আসা যাওয়া করতে দেখেছে। নীরব ঘরটায় দূর থেকেও কথোপকথন শোনা যেতো। মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হলে লোজন ওর বাবাকে এমন কুৎসিত। ভাষায় গালি দিতে যা ও কল্পনাও করতে পারে না। এরপরেও ওর বাবা তাদেরকে মাথা উঁচু করেই ওদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দিতো। ওরা মনে মনে ভাবতো যে খুব জেতা জিতেছে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর ও তাদেরকেই দেখেছে হতদরিদ্র অবস্থায় ইংল্যান্ডের জাহাজে চড়ে বসতে। সব হারিয়ে পথের ফকির হয়ে গিয়েছে তারা। একজনকে তো গ্রেপ্তার করে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, কারণ তাকে একজন সেপাহী ছোঁকড়ার সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ধরা পড়েছিলো সে।

কখনো ভুলবে না, কখনো ক্ষমা করবে না। আর এমন সময় বদলা নেবে যখন সেটা তোমার শত্রুকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। ক্রিস্টোফারের মনে হলো ও যেনো নতুন কোনো সত্য আবিস্কার করে ফেলেছে।

ও ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো। সূর্যমামা ডুবে গিয়ে অন্ধকার ভরে গেলো চারপাশ। ক্রিস্টোফার হ্যাচ গলে নিচের ডেক-এ নেমে এলো। রান্নাঘরে গিয়ে বাবুর্চির রেখে যাওয়া একটা পাত্র থেকে খানিকটা স্ট্য নিয়ে উদরপূর্তি করলো। তারপর খোঁজাখুঁজি করে লুকানো জায়গা থেকে বের করে আনলো এক বোতল আরক। জিনিসটা আসলে ধেনো মদ। ছিপি খুলেই bক ঢক করে কয়েক ঢোক পেটে চালানরে দিলো। জ্বলন্ত তরলটা পেটে পড়তেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেলো ওর। এক অদ্ভুত সাহস অনুভব করতে লাগলো নিজের ভিতর।

“আর এক শয়তানের দাস হয়ে থাকবো বলে আমি আমার বাবাকে ছেড়ে আসিনি,” নিজেকেই শোনালো ও। আর একটা হ্যাচ গলে একেবারে নিচের ডেক-এ চলে এলো ক্রিস্টোফার। জোসেফ-এর বেশিরভাগ মালপত্রই একেকটা বিশাল গাট্টি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কাপড়ের গাট্টি বা চাউলের বস্তাগুলো বেশি বড়, ওগুলো দিয়ে ওর উদ্দেশ্য সাধন হবে না। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে রেশমি কাপড়ের একটা ছোট বোঁচকা খুঁজে পেলো। এতেই চলবে।

পানির কাছাকাছি থাকায় ক্রিস্টোফার জাহাজের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলো। জাহাজের প্রতিটা ক্যাচকোচ শব্দ মাস্তুল বেয়ে নিচে নেমে আসছে। খোলের গায়ে শব্দ করে কিছু একটা বাড়ি খেলো, সম্ভবত ঢেউ। বা পানিতে ভেসে আসা কোনো কাঠের টুকরো। কিন্তু তাতেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলো ও। হাতের তালু ঘেমে পিছলে গেলো বোঁচকা। মদটা গলার কাছে উঠে এসে তেতো অনুভুতির সৃষ্টি করলো।

একটা বস্তা থেকে সুপারি নিয়ে পকেটে ভরলো ক্রিস্টোফার, তারপর সিল্কের বোঁচকাটা কাঁধে ফেলে আবার উঠে এলো উপরে। ডিঙ্গি নৌকাগুলো এখনো তীরে, কিন্তু ঠিকই একটা ছোট নৌকা রয়ে গিয়েছে যা ও নিজেই বাইতে পারবে। ও নিজের ছুরিটা বের করে নৌকা বাধা দড়িগুলো কাটতে লাগলো।

“যাচ্ছিস কোথায়?” গর্জে উঠলো ক্রফোর্ড। জাহাজের পিছনে জ্বালানো মশালের আবছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ডেক-এ বিশাল লম্বা ছায়া পড়েছে ওর। “আবার তুই চুরি করছিস। একবার মার খেয়ে শিক্ষা হয়নি?”

ক্রফোর্ড কখন জাহাজে এসেছে সেটা ক্রিস্টোফার টের পায়নি। হয় ও ক্রিস্টোফারকে বিশ্বাস করে না, নয়তো কোনো সাক্ষী ছাড়া ওকে শেষ করে দিতে এসেছে। কিন্তু ক্রিস্টোফার কারণটা কখনো জানতে পারেনি। ক্রফোর্ড সামনে এগিয়ে এসে এতো জোরে ক্রিস্টোফারের চেহারায় ঘুষি দিলো যে ও উড়ে পিছনের দড়াদড়ির উপর গিয়ে পড়লো।

“আমাকে মেরে ফেলতে হলে এর চাইতে জোরে মারতে হবে, ক্রিস্টোফার বললো। ওর কণ্ঠে এক ভয়ানক হিংস্রতা খেলা করছে। একটা বুড়ি মহিলার মতো আঘাত করেন আপনি।”

একটা হুংকার ছেড়ে ক্রফোর্ড পেয়ে গেলো সামনের দিকে। ক্রিস্টোফার উঠে দাঁড়িয়েছে। আত্মরক্ষার্থে নিজের হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে ধরলো ও, এক হাতে যে ছুরি ধরা সেটা খেয়াল নেই। অন্ধকারে ষাড়ের মতো ধেয়ে আসা ক্রফোর্ড-ও খেয়াল করলো না ব্যাপারটা।

সহজাত প্রবৃত্তির বশেই ক্রিস্টোফার ক্রফোর্ডের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। বিশাল লোকটা ওকে আঁকড়ে ধরতে যেতেই ও-ও সজোরে ধাক্কা দিলো সামনের দিকে।

ক্রিস্টোফার কিছু বোঝার আগেই হাতের ছুরিটা ক্রফোর্ডের ভূড়ি ফাঁসিয়ে দিলো। গরম রক্ত বেরিয়ে এলো সেদিক দিয়ে। ক্রফোর্ড চিৎকার দিয়ে উঠে মোচড়া মুচড়ি করে ছুরিটা শরীর থেকে বের করার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু টানাটানিতে ওর জখম আরো বড় হওয়া ছাড়া আর কিছু হলো না। ওর নাড়িভুড়ি বেরিয়ে ক্রিস্টোফারের হাতের উপর এসে পড়লো।

ক্রিস্টোফার লাফিয়ে সরে গেলো দূরে। ছুরিটা টান দিয়ে বের করে ফেলেছে। ক্রফোর্ড নিজের পেট চেপে ধরে চেষ্টা করলো সবকিছু আবার ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার। ব্যথায় একটা আহত ষাড়ের মতো গোঁ গোঁ করছে ও।

ক্রফোর্ডের চিৎকার নিশ্চয়ই পানি পেরিয়ে ডাঙ্গায়ও পৌঁছাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যাবে ডাঙ্গা থেকে কেউ না কেউ শব্দটা শুনে কি হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখতে চলে আসবে। আর ক্রিস্টোফারকে এভাবে উদ্দত ছুরি হাতে দেখলেই যা বোঝার বুঝে নেবে সবাই। ওকে এর শেষ করতে হবে।

এছাড়া ওর আর কোনো উপায় নেই। ক্রিস্টোফার শক্ত হাতে ছুরিটা ধরলো আবার, তারপর ওপরে তুলে সোজা ক্রফোর্ডের হৃৎপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিলো।

ক্রফোর্ডের চিৎকার চেঁচামেচি সর থেমে গেলো সাথে সাথেই। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পায়ের কাছে পড়ে থাকা লাশটার দিকে চেয়ে রইলো ক্রিস্টোফার। হাত থেকে ছুরিটা পড়ে গেলো ওর। সারা শরীর কাঁপছে।

‘তুমি একটা খুনী-গাই এর মতো ঠাণ্ডা স্বরের কেউ এসে ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেলো কথাটা।

লাশটা থেকে নিজের দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলো না ও। একটু আগেও যে একজন জলজ্যান্ত মানুষ ছিলো, সে এখন কাটা মাংসের স্তূপ ছাড়া কিছু না।

‘তুমিই করেছো সব’-কণ্ঠটা আবার বললো।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর অপরাধবোধ কমে এলো খানিকটা। আস্তে আস্তে শরীরে উষ্ণতাও ফিরে এলো। কাঁপাকাপি গেলো থেমে। যে লোকটা ওকে পিটিয়েছিলো, ঠেঙিয়েছিল, অত্যাচার করেছিলো, ধোঁকা দিয়েছিলো-সে এখন মৃত। ও আর কখনো ক্রিস্টোফারের গায়ে হাত তুলতে পারবে না।

“আমিই কাজটা করেছি, নিজেকে নিজে বললল ও। ভাবনাটা মাথায় খেলতেই পুরো শরীর শিউরে উঠলো ওর। ঠাণ্ডার দিনে গোসল করতে গেলে যেরকম হয় সেরকম। “এতোদিন ধরে কাপুরুষের মতো কেননা বেঁচে আছি। আমি? নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে তো কিছুই জানতাম না।”

নিজের রক্তাক্ত হাত দুটো ক্রফোর্ডের পায়জামায় মুছে নিলো ক্রিস্টোফার, তারপর লাশটা হাতড়ে ক্রফোর্ডের টাকার থলেটা খুঁজে বের করলো। ভিতরে পয়সার ঝনঝনানি শোনা গেলো-ওর টাকা এগুলো সব। ও থলেটা নিয়ে নিজের পায়জামার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।

আর একটা জিনিস খেয়াল হলো ওর। একটা চাবি-ক্রফোর্ডের গলায় একটা রশি দিয়ে ঝোলানো। পিরিট রাখার সিন্দুকটার চাবির চাইতে অনেক ছোটো। তবে এই চাবিটাও ও সকালে দেখেছিলো। এটা হচ্ছে টাকার সিন্দুকের চাবি। ক্রফোর্ডের বুকের ছিদ্র থেকে রক্ত বেরিয়ে লাল হয়ে আছে। ক্রিস্টোফার টান মেরে চাবিটা ছুটিয়ে নিয়ে দ্রুত ক্যাপ্টেনের কেবিনের দিকে ছুটে গেলো। ক্রফোর্ডের খাটের নিচে টাকার সিন্দুকটা লুকানো থাকে। সবাই বেতন তুলে নেওয়ার পরেও ওর সিন্দুকটা বের করে আনতে ঘাম ছুটে গেলো। ভালো লক্ষণ।

নিচে ভাড়ার ঘরে গিয়ে এক বোতল কপির তেল খুঁজে পেলো ক্রিস্টোফার। জাহাজের খোলের ভিতর থাকা কাপড়ের গাড়িগুলোর উপর ঢেলে দিলো তেলটা, তারপর একটা ছোট পিপা থেকে গান পাউডার বের করে খোলের উপর ছড়িয়ে দিলো। এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতা আর শক্তির অনুভূতি কাজ করছে ওর ভিতরে। দ্রুত হাতে কাজ করতে লাগলো ও। ওর কাছে এই কাজটা একটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত বলে মনে হচ্ছে। এতে করে ক্রফোর্ডের লাশও পুড়ে যাবে আর জাহাজের কোনো ত্রু-ও ওকে খোঁজার কথা চিন্তা করবে না। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে ও কাজটা শুরু করেছিলো ভিতরে থাকা প্রচণ্ড আক্রোশ থেকে, এতো কথা ভেবে না।

সিঁড়ির অর্ধেক উঠে এসে, ও ঘুরে হাতের কুপিটা অন্ধকারে ছুঁড়ে দিলো। কাঁচ ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে, আর তেলে ভেজা কাপড়ে আগুন ধরে গেলো মুহূর্তেই। লকলকে শিখায় ভরে গেলো খোল।

ক্রিস্টোফার তাকিয়ে থাকলো সেদিকে, নিজের কাজে নিজেই সম্মোহিত হয়ে গিয়েছে যেনো। আমিই করেছি সব, আবার ভাবলো ও। সামনের ধ্বংসলীলা ওর রক্তে আফিমের নেশার মতোই প্রবাহিত হতে লাগলো।

নিচ থেকে আসা গরম বাতাস এসে লাগলো ওর মুখে। বুঝলো যে আর থাকা যাবে না। সিঁড়ি বেয়ে উঠে ক্রফোর্ডের লাশের কাছে গিয়ে রেগে আবারও একটা লাথি দিলো ক্রিস্টোফার। ডিঙ্গিটা নামানোর সময় আর নেই, তবে গাছের গুঁড়ির যে ডোঙ্গাটায় করে ক্রফোর্ড এসেছে সেটা জাহাজের সাথে বাধা ই আছে। একটা রশিতে বেঁধে প্রথমে সিন্দুকটা নামিয়ে দিলো ডোঙায়, তারপর নিজেও নেমে এসে দাঁড়টা তুলে নিলো। দেরি না করে সমস্ত শক্তি দিয়ে বাওয়া শুরু করলো ও, পিছনের জাহাজটা ততোক্ষণে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।

একটু পরেই বালিতে এসে ঠেকলো ওর নৌকাটা। সিন্দুকটা কাঁধে তুলে নিয়ে ঝপাশ করে পানিতে নেমে পড়লো ক্রিস্টোফার। তারপর সোজা দিলো দৌড়। একটানে তীরের গাছগুলোর আড়ালে পৌঁছে তারপর পিছনে ফিরে তাকালো। জোসেফ দেখতে তখন বন ফায়ারের গানপাউডার ট্রিজন ডে-র মতো লাগছে। শহরের লোকজন অন্যপাশের পানির ধারে ছুটে আসছে কি হয়েছে দেখতে। প্রায় সবাই-ই অর্ধ উলঙ্গ। হাঁ করে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। জাহাজের কয়েকজনকেও দেখা গেলো, সাথের মেয়েগুলো তখনও সেটে আছে সাথে। ও ভেবে পেলো না ওরা কিভাবে বাড়ি যাবে? আর একটা জাহাজ খুঁজে পেতে কতো দিন লাগবে আর?

গাছের ফাঁকে মুক্ত বাতাস পাওয়ার আগ পর্যন্ত ও ভিতর হাঁটতেই থাকলো। বন্দরে যাওয়ার সাহস ওর নেই। অন্তত যতোক্ষণ জোসেফ-এর লোজন ওখানে থাকবে ততোক্ষণতো না-ই। তবে ও আসার পথে তীর দিয়ে অনেকগুলো শহর আর গ্রাম দেখেছে যেখানে আশ্রয় নিতে পারবে। সে উদ্দেশ্যেই দিক বদলে উত্তরে ঘুরতে যাবে কিন্তু দেখতে পেলো বনের ফাঁক দিয়ে আলো ছুটে আসছে। ও সিন্দুকটা টেনে সরিয়ে দিয়ে এক ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

অবয়বটা আরো কাছে এগিয়ে এলো, লাউয়ের খোল দিয়ে বানানো একটা বাতি ধরে আছে সাথে। ক্রিস্টোফারের লুকানো জায়গাটার একদম সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা। ধুলোমাখা পথে ওর পায়ের ছাপ আর সিন্দুক টেনে নেওয়ার দাগ দেখেই বুঝেছে কোথায় লুকিয়েছে।

“ক্রিস?” ডাকলো অবয়বটা।

ওটা হচ্ছে দানেশ। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্রিস্টোফার লুকানো জায়গাটা থেকে মাথা তুলোলো। দানেশ আতংকে পিছিয়ে গেলো, চিনতে পারেনি ওকে। দানেশের কাছে মনে হচ্ছিলো ওর সামনে রক্ত আর ধুলোয় ভরা একটা অর্ধ উলঙ্গ দানব দাঁড়িয়ে আছে।

“ক্রিস?” ও তাকিয়েই রইলো। “আমি তোমাকে ডাঙ্গায় উঠতে দেখেছি।” তারপর রক্ত আর ওর চোখের উভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে বললো, “করেছছা কি তুমি?”

“আমি ওকে খুন করেছি,” বহু কষ্টে বললো ক্রিস্টোফার। মনে মনে বলার চেয়ে মুখে বলা অনেক কষ্ট। কিন্তু দানেশের চোখে তাকাতেই ওর প্রতি ‘দানেশের আলাদা একটা সম্ভম দেখতে পেলো।

“আর জাহাজ?”

“নেই। জ্বালিয়ে দিয়েছি আমি ওটাকে।”

দানেশের মুখ কালো হয়ে গেলো। “জাহাজটা দিয়েই পেট চালাতাম আমরা।”

“পেট চালানো? ক্রফোর্ড আমাকে কিছুই দেয়নি, মনে নেই?” ও ঝোঁপের পিছনে ফিরে গিয়ে আবার সিন্দুকটা তুলে নিয়ে এলো। “এটা দেখেছো? আমরা এখন নিজেরাই মালপত্র কিনতে পারবো। একটা জাহাজ ভাড়া করবো। আর দড়ি ধরেও ঝুলতে হবে না, বা ওর দড়ির বাড়িও খেতে হবে না। আমরাই এখন হবো সর্দার। আর কয়েকটা অভিযান ভালোয় ভালোয় করতে পারলেই আরো বড় একটা জাহাজ কিনে ফেলতে পারবো। তারপর আর একটা।” ও এর মধ্যেই কল্পনায় একটা বিশাল সওদাগরি জাহাজে করে বোম্বে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে শুরু করেছে। ওর জাহাজের কামানের খোপগুলো সোনার পাতে মোড়ানো থাকবে। তীরে রুথ দাঁড়িয়ে থাকবে ওর অপেক্ষায়, ডাঙায় নামতেই দুই হাত বাড়িয়ে দৌড়ে আসবে ওর দিকে। আর ওর বাবা যখন জানবেন খবরটা, তখন পরাজয়ের রাগে দুঃখে ক্ষোভে লাল হয়ে যাবেন।

দানেশের অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো। “চাবি? ওটা এনেছো তো?”

ক্রিস্টোফার কবজিতে বাঁধা চাবিটা বের করে তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিলো। ঝট করে খুলে গেলো তালা, ঢাকনা সরতেই দেখা গেলো ভিতএ সোনা আর রূপা চকচক করছে।

“এ দিয়ে তো…” দানেশ এক মুঠো মুদ্রা বের করে হাতে নাড়তে লাগলো। “পুরো রাজার হালে থাকা সম্ভব।”

“সাবধান,” ক্রিস্টোফার হাসলো। “আমাদের কিন্তু সব টাকা একবারে খরচ করা যাবে না। যদি ঠিকমতো খাটাতে পারি তাহলে এর চাইতে দশ গুণ বেশি কামাতে পারবো।”

ঘুষিটা কোন দিক থেকে এলো সেটা টেরও পেলো না ক্রিস্টোফার। এতে জোরে ওর চোয়ালে লাগলো যে ও পিছন দিকে উলটে পড়ে গেলো। দানেশের গায়ে মাংস কম, কিন্তু ও সেই দশ বছর বয়স থেকে জাহাজে কাজ করছে। রশির মতো পাকানো ওর শরীর-আর ক্রিস্টোফার এতোক্ষণের ধকলে অবসন্ন। হয়ে আছে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার একটা শিকড়ে বেঁধে পড়ে গেলো ও। আবারও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে যেতেই আর একটা ঘুষিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

দানেশ ক্রিস্টোফারের কোমরের দড়ি দিয়ে বানানো বেল্টটা খুলে নিয়ে সিন্দুকের হাতলে ভরে একটা কাজ চালানোর মতো ফাস বানিয়ে ফেললো। আর বেল্টটা খুলে নেওয়ায় ও ক্রিস্টোফারের ছুরি আর ক্রফোর্ডের টাকার থলে দুটোই পেয়ে গেলো। ওগুলোও ও নিয়ে নিলো সাথে।

ক্রিস্টোফারের ততোক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে। থুথু দিয়ে মুখ থেকে খানিকটা রক্ত ফেলে, এক হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো ও। কিন্তু দানেশের মারমুখি ভঙ্গি দেখে আর বেশি ওঠার সাহস করলো না।

“আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার বন্ধ,” করুণ কণ্ঠে বললো ক্রিস্টোফার।

দানেশ এমনভাবে তাকালো যেনো ক্রিস্টোফার বাচ্চাদের মতো কোনো কথা বলেছে, “এতো বেকুব তুমি। স্বর্ণের কাছে কোনো বন্ধু নেই।”

দানেশ সিন্দুকটা কাঁধে তুলে নিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলো। ক্রিস্টোফার পিছু নেওয়ার চেষ্টা করলো না। ওখানেই শুয়ে শুয়ে দানেশের হাতের আলোটা ফিকে হয়ে যেতে দেখলো। তারপরেও না উঠে অন্ধকারেই শুয়ে রইলো ও।

*

“আপনি কি আমাকে মারতে চান?”

ক্রিস্টোফার চোখ খুললো। রাস্তার অপর পাশে একটা অপরিচিত লোককে দেখতে পেলো ও। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে ওর দিকে। লোকটার শরীর একহারা কিন্তু শক্তপোক্ত, মুখের দাড়ির রঙ ধূসর হয়ে এসেছে।

“আপনি কি আমাকে মারতে চান?” আবার বললো লোকটা। পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলছে সে, যদিও চেহারা আর পোশাকআশাক দুটোই ভারতীয়।

ক্রিস্টোফার হাত দিয়ে ওর কপাল ডললো। চোয়াল ফুলে আছে, সামান্য নাড়াচাড়াতেই সারা শরীরে ব্যথা করে উঠলো একযোগে।

“আমাকে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে?” গরগর করে বললো ও।

“এই এলাকায় ডাকাতের অভাব নেই। কেউ কেউ এভাবে ভান করে শুয়ে থাকে, যেনো কেউ তাকে ছিনতাই করেছে। যখন নিরীহ কেউ তাকে সাহায্য করার জন্যে থামে তখন তাকে আক্রমণ করে।”

“আমি উঠেও বসতে পারছি না।”

লোকটা তবুও নড়লো না। “কোত্থেকে এসেছেন আপনি?”

“আমার জাহাজে আগুন লেগেছিলো। আমি সাঁতরে ডাঙায় উঠেছি।”

লোকটা চিন্তিত মুখে মাথা ঝাঁকালো। তারপর ক্রিস্টোফারের গায়ের শুকিয়ে আসা রক্ত আর চেহারার নীলচে দাগগুলো দেখলো কিছুক্ষণ।

“আমি আপনাকে ত্রিভান্ড্রামে আপনার জাহাজের বাকি লোকগুলোর কাছে নিয়ে যেতে পারি। ওরা নিশ্চয়ই আপনার জন্যে দুশ্চিন্তা করছে।”

ক্রিস্টোফার মাথা নেড়ে, ওর বাম দিকে, মানে ত্ৰিভাল্লামের উল্টোদিকে ইঙ্গিত করলো। “আমি যাচ্ছি ওইদিকে।”

“আহ, লোকটার ঠোঁটে একটা শুকনো হাসি দেখা গেলো। আমিও।”

“আমাকে আপনার সাথে নেবেন?”

লোকটা উত্তর না দিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। সেকেন্ড তিনেক ভেবেই, এতো দ্রুত ক্রিস্টোফারের দিকে ধেয়ে এলো যে, ও ঠাহরও করতে পেলো না কখন লোকটা এসে ওর মাথায় তার লাঠিটা তাক করে ধরেছে। এতোদর আসতে বড়জোর মাত্র দুইবার পা ফেলতে হয়েছে তাকে। ক্রিস্টোফার প্রতিরক্ষার্থে হাত তুলে ধরলো, যদিও তাতে খুব বেশি লাভ হতো না। লাঠিটার ডগা ওর চোখ থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে এসে থামলো। বৃদ্ধ লোকটা ঠিক ওর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু নাগালের বাইরে। এতে দ্রুত এতো কিছু করার পরেও তার শ্বাসের গতি সামান্যও বাড়েনি।

“যদি আপনার কথা মিথ্যে হয়-যদি আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেন-তাহলে আপনাকে খুন করবো আমি,” সাবধান করলো লোকটা।

ক্রিস্টোফার তার দিকে তাকিয়ে রইলো, “কে আপনি?”

“এমন একজন যে নিজেকে রক্ষা করতে জানে।” বলে লোকটা লাঠির ডগা দিয়ে ক্রিস্টোফারের মুখের কালশিটে দাগটা স্পর্শ করলো। “কিন্তু আপনাকে দেখে সেরকম কেউ মনে হচ্ছে না।”

ক্রিস্টোফার কোমরে হাত দিলো, “আমার সাথে এমনকি একটা ছুরি-ও নেই।”

“মানুষকে মেরে ফেলার অনেক রাস্তা আছে, সেগুলো খুব শক্ত-ও না। এদেশে এমন ডাকাতও আছে যারা পরনের ধুতি পেচিয়েও মানুষ মারতে পারে।”

লোকটার কণ্ঠের নিশ্চয়তা শুনে ক্রিস্টোফারের আচমকা মনে হলো যে সে একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলো বলছে।

“আপনি কি ডাকাত?”

“এখন কি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছেন?” সহাস্যে বললো লোকটা। তারপর লাঠির মাথাটা এমন ভাবে ধরলো যাতে ক্রিস্টোফার ওটা ধরে নিজেকে টেনে তুলতে পারে।

“নাম কি আপনার?” জিজ্ঞেস করলো লোকটা।

ক্রিস্টোফার নিজের আসল নাম বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কারণ ক্রিস্টোফার কোর্টনী একটা জাহাজ ডাকাতি করেছে, একজন লোককে খুন করেছে। ক্রিস্টোফার কোর্টনী একজন ফেরারি। আর সবচে বাজে ব্যাপার হচ্ছে ক্রিস্টোফার কোর্টনী, গাই কোর্টনীর ছেলে।

বোম্বেতে থাকাতে রবিবার সকালে গির্জায় যাওয়ার কথা মনে পড়লো ওর। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে, মাছির অত্যাচার সয়ে ওকে বসে বসে পাদ্রির বকবক শুনতে হতো। সেখানে শোনা বাইবেলের গল্পগুলোর মধ্যে একটা মনে পড়লো ওর। রাজা ডেভিডের ছেলের গল্প-যে কিনা তার বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়।

“আমার নাম আবসালম,” ক্রিস্টোফার বললো।

বৃদ্ধ লোকটা সরু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো, যেনো ওর ভিতরের মিথ্যে আর অপরাধগুলো সব দেখে নিতে পারছে।

গাধা, ক্রিস্টোফার নিজেকে বুঝালো। এগুলো শুধু আমার চোখ; দেহের একটা অংশ, ঠিক আমার পা বা কনুই এর মতোই।

“আমি রঞ্জন।” সামনের দিকে তাকিয়ে বললো লোকটা। “আমি আপনাকে পাশের গ্রামে নিয়ে যাবো।” কথাটা শুনে ক্রিস্টোফারের মনে হলো কাঁধ থেকে একটা বিশাল বোঝা নেমে গেলো যেনো।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। সূর্য উঠে গিয়েছে ততোক্ষণে। রাস্তায় লোকের চলাচলও বেড়েছে। রাস্তার দুই ধারে পাম গাছগুলোয় রসের হাঁড়ি ঝুলানো, দেখে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো মাকড়সা যেন শুড় দিয়ে রস চুষে খাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটা একটা শব্দও বললো না। কিন্তু ক্রিস্টোফার বকবক করেই চললো। বারবার ও ক্রফোর্ডের অত্যাচারের বর্ণনা দিতে লাগলো। কিভাবে ও ক্রফোর্ডের পেট ফেড়ে দিয়েছে সেটা বলতে গিয়ে কণ্ঠে গর্ব ফুটে উঠলে ওর। ইচ্ছা করছিলো আবার জাহাজে ফিরে গিয়ে আবার যদি কাজটা করতে পারতো তাহলে আরো ভালো লাগতো।

গ্রামটা একদমই নিরিবিলি। পাম গাছের পাতায় ছাওয়া মাটির ঘর দেখা গেলো কয়েকটা। তার ফাঁক দিয়ে চিমসানো কয়েকটা গবাদি পশু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তীরে জেলেরা নিজেদের জাল গোটাচ্ছে, ওটা দিয়ে ধরা মাছগুলো পড়ে আছে বালির উপর।

“তা কি করবেন এখানে?” রঞ্জন জানতে চাইলেন।

ক্রিস্টোফার মাথা নাড়লো। এসব ভেবে দেখেনি। চাইলে জেলে হতে পারে, তবে এখানকার সবচে বড় নৌকাটাও সম্ভবত জোসেফ-এর ডিঙ্গি নৌকার সমান হবে। কিন্তু আবারও সমুদ্রে যাওয়ার চিন্তাটা ওকে আতংকিত করে তুললো।

“আপনার কাছে খাবার আছে? টাকা? পরিচিত কেউ আছে?” রঞ্জন-ই জিজ্ঞেস করলেন আবার।

“নাহ,” জবাব দিলো ক্রিস্টোফার।

“তাহলে বরং আমার সাথে চলেন।”

ওরা চলতেই থাকলো, মাইলের পর মাইল। আরো অনেকগুলো জেলে গ্রাম, প্যাগোডা আর লম্বা, বালুকাময় সৈকত পেরিয়ে সুর্যাস্তের আগে আগে ওদের গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছালো। মোটামুটি বড় একটা শহর এটা। সাগরের তীর থেকে একটু ভিতরে যদিও, তবে আসার পথের গ্রামগুলোর তুলনায় অনেক বড়। বড় বড় বাজার, মন্দির সবই আছে এখানে।

রঞ্জন ক্রিস্টোফারকে শহরের শেষ মাথার একটা বিশাল বাড়িতে নিয়ে এলেন। বাইরে থেকে দেখে ক্রিস্টোফার ভেবেছিলো এটা একটা মন্দির। রঞ্জন লোকটার হাবভাব এতে সাধু সাধু যে ওনার পক্ষে একজন সন্নাসী হওয়া অবাক হওয়ার মতো কিছু না।

শুধু ধুতি পরা এক বাচ্চা ছেলে দরজা খুলে দিলো। ক্রিস্টোফার ভিতরে ঢুকতেই ছেলেটা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ভিতরে দেখা গেলো একদল অর্ধনগ্ন ছেলে মারামারি করছে। কয়েকজন এক কোনায় কাঠ দিয়ে বানানো লম্বা একটা লাঠি দিয়ে নানান কসরত করছে, অনেকটা বৃদ্ধের হাতের লাঠির মতোই। আর এক জায়গায় চাঁদের মতো বাকা তরবারি দিয়ে যুদ্ধ চলছে। একটু পর পর ঝনঝন আওয়াজ আসছে সেদিক থেকে। কয়েকজনকে দেখা গেলো খালি হাতে মারামারি করতে। এমন মোহনীয় ভঙ্গিতে ওরা নাড়াচাড়া করছে যে বোঝাই যাচ্ছে ওদের লাথি বা ঘুষি সবই সহজাত ভাবেই হচ্ছে, জোর করে কিছু করা লাগছে না।

“এ কোন জায়গা?” অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো ক্রিস্টোফার।

“এটা হচ্ছে কালারি-যোদ্ধাদের স্কুল বলতে পারেন। আমরা এখানে কালারিপায়াত্ত শেখাই। এটা হচ্ছে যুযুৎসু-র অতি প্রাচীন একটা রূপ। কারো কারো মতে সবচেয়ে প্রাচীন।”

“আপনি এসব পারেন?”

“আমি হচ্ছি আসান, মানে এদের গুরু।”

ভাবনার চেয়েও দ্রুত এদের নাড়াচাড়া, হাতাহতি, ঘাম আর রক্তের গন্ধ সব ক্রিস্টোফারকে অবাক করে দিলো। ও সারাজীবনে যতো মার খেয়েছে সেসব মনে পড়লো ওর। ওর বাবার হাতে, ক্রফোর্ডের হাতে, এমনকি দানেশের হাতে। ও মুখ বুজে সব সহ্য করেছে কারণ ওর নিজেকে রক্ষা করার সামর্থ্য ছিলো না।

এখানকার সব লোকই নিজেকে রক্ষা করতে জানে।

“আমাকে শেখাবেন?”

“এখানকার সবাই সেই বাচ্চাকাল থেকে এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে,” রঞ্জন সাবধান করলেন ওকে।

“আমি শিখতে পারবো।”

রঞ্জন ওর চোখের দিকে তাকালেন। আবারও ক্রিস্টোফারের মনে হলো। ঊনি এমন সব জিনিস দেখে নিচ্ছেন যা কিনা ক্রিস্টোফার নিজেও জানে না।

“হ্যাঁ,” উনি বুঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। “আমার মনে হয় আপনি পারবেন।”

*

জাহাজের জীবনটা কষ্টের ছিলো সন্দেহ নেই, তবে কালারি-র জীবন আরো কঠিন। জাহাজে মার খাওয়ার ঘটনা ঘটতো হঠাৎ-সটাৎ, আর এখানে মারামারিটাই দিনের একমাত্র কাজ। ক্রিস্টোফার গায়ের কালশিটে দাগগুলো গোনা বন্ধ করে দিলো একসময়। কতোবার বুকের পাঁজরের হাড় ভাঙলো বা মার খেয়ে চোখ ফুলে ঢোল হলো সেই হিসাবও থাকলো না। ভাঙা পাঁজরের কারণে নিঃশ্বাস নিতে পারতো না মাঝে মাঝে। কিন্তু সেসব নিয়ে কখনো ঘ্যান ঘ্যান তো দূরে থাক একদিনের জন্যেও প্রশিক্ষণও বাদ দেয়নি ও।

দ্রুতই ওর শরীরে আমূল পরিবর্তন চলে এলো। জাহাজে থাকতেই যেসব পেশি গঠন শুরু হয়েছিলও সেগুলো আরো বেশি শক্তপোক্ত হলো, একেবারে পাথরের মতো। আরো বেশি সরু হলো কোমর। একেবারে সোজা হয়ে হাঁটতে শিখলো, আগের চাইতে লম্বা লাগতে লাগলো তাই। মোটকথা বোম্বে থেকে পালিয়ে আসা সেই নাদুসনুদুস ছেলেটা বা কথায় কথায় মার খাওয়া ভীতু নাবিকটা আর রইলো না ও। ওর সতীর্থ সবাই স্থানীয় ভারতীয়। তাই বাকি সবার চাইতেই ও লম্বা। অনেকেই এজন্যে আসানের কাছে অভিযোগ করলো যে ক্রিস্টোফার এতে অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রঞ্জন ওদেরকে এই বলে বিদায় করলো যে, “ভগবানই তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিক করে দেন।”

ক্রিস্টোফার খুব দ্রুত শিখে নিতে লাগলো সব। অষ্ট ধাপ আর অষ্ট ভঙ্গি শিখলো। একশো আটটা মামরা শিখলো; মামরা মানে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মধ্যে আছে বৈকালকারা অংশ, যেগুলো মানুষকে অসাড় করে দিতে পারে, আছে বিন্দু অংশ, যেখানে একটা মাত্র আঘাতই মেরে ফেলতে পারে যে কাউকে। চিৎকার করে মন্ত্র পড়ে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে বের করে আনা শিখলো। কারো চেহারা আর দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখেই তার পরবর্তী আক্রমণটা কোনদিক থেকে আসবে সেটা শিখলো। লাঠি আর তরবারি দুটো দিয়েই যুদ্ধ করা শিখে ফেললো। বাকা চাঁদের মতো দেখতে থোট্টি চালনাও শিখে নিলো একসময়।

এছাড়াও, প্রতিটা দিন শেষে কিভাবে নিজেকে সুস্থ্য করে তুলতে হয় সেটাও শিখলো। কিভাবে সারা শরীরে তেল মর্দন করতে হয়, কোন কোন জায়গায় কিভাবে মালিশ করলে সবচেয়ে দ্রুত ব্যথা সেরে যায়, সেগুলোও জেনে নিলো। ফলে পরের দিন আবার যুদ্ধে নামতে আর সমস্যা হতো না ওর।

বাড়িটার উঠোনের মাঝখানে দড়ি দিয়ে ঘেরা একটা মঞ্চ বানানো আছে। সপ্তাহে একদিন সব ছাত্ররা ওটার চারপাশে জড়ো হয় আর সেরা ছাত্ররা মঞ্চের উপর উঠে লড়াই করে। ওদের নাড়াচাড়া এতে মসৃণ আর দ্রুত যে শুরুতে ক্রিস্টোফার মাঝে মাঝে বুঝতো-ও না যে কোনদিক কোনদিক দিয়ে আঘাতটা হচ্ছে। তবে পরে যখন ও নিজেও ওগুলো শিখলো তখন একটু একটু ধরতে পারতো। এরপর থেকে যখন ও লড়াইগুলো দেখতো তখন ওর নিজের শরীরও আপনাআপনি সেগুলোর তালে বেকে যেতো, মনে মনে ও নিজেকে মঞ্চের উপরে কল্পনা করতো, আর লড়াই শেষে আরো মরিয়া হয়ে সেই কসরতগুলো অনুশীলন করতো।

অন্য ছাত্ররা ক্রিস্টোফারকে পাত্তা দিতে না বেশি। কিন্তু রঞ্জন ওকে সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। একদিন উনি ক্রিস্টোফারকে একজন কাঠ মিস্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলেন। জায়গাটা তেল আর বার্নিশের গন্ধে ভরা। অনেকগুলো অর্ধেক বানানো গণেশের মূর্তি রাখা তাকের উপর।

ক্রিস্টোফার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলো। মনে মনে অপেক্ষা করছে কখন আসান ওকে এখানে নিয়ে আসার কারণটা বলবেন। মিস্ত্রী তার হাতের বাটালি দিয়ে কাঠের গায়ে আঘাত করছে, প্রতি আঘাতে একটু একটু করে কাঠের চলটা উঠে আসছে।

ওর দিকে না তাকিয়েই মিস্ত্রীটা কিছু একটা বললো। কিন্তু ভাষাটা এখানকার স্থানীয় হওয়ায় ক্রিস্টোফার বিন্দু বিসর্গ-ও বুঝলো না।

“কি বললেন উনি?”

“বললো যে এই মূর্তিটা আগে থেকেই কাঠের ভিতরে আছে। ওর কাজ হচ্ছে শুধু বাইরের অতিরিক্ত অংশটা বাদ দিয়ে ভিতরে যা আছে বের করে আনা। বাটালির প্রতিটা আঘাতে আসলে জিনিসটা আরো বেশি নিজেতে পরিণত হচ্ছে।” বলে রঞ্জন ক্রিস্টোফারের দিকে তাকালেন। “তোমার কি মনে হয় কাঠের অনুভূতি আছে?”

“না।“

“হিন্দু পুরানি অনুযায়ী প্রতিটা জীবিত জিনিসের চেতনা আছে। এমনকি গাছেরাও অনেক কিছু অনুভব করতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে কি তোমার মনে হয় যে কাঠ এই নিজের শরীরে খোদাই করাটা উপভোগ করে?”

মিস্ত্রী আবার হাতুড়ি চালালো, বাটালির ধারালো মাথা কামড় বসালো কাঠের গায়ে।

“প্রচণ্ড ব্যথা পাওয়ার কথা।”

“প্রতিটা আঘাত কিন্তু ও যে জিনিস সেটাতেই পরিণত করছে ওকে। রাস্ত টিা অনেক কঠিন, আবসালম-কিন্তু গন্তব্য…” বলে উনি একটা গণেশের মূর্তির গায়ে চাপড় মারলেন। মূর্তির মাথাটা হাতীর। এতোটাই নিখুঁত যে ক্রিস্টোফারের মনে হলো যে কোনো মুহূর্তে ওটা শুড় নেড়ে উঠে দাঁড়াবে।

“গন্তব্যই আমাদের আসল পরিচয়টা বের করে আনে।”

*

যখন অনুশীলন করে না, তখন ক্রিস্টোফার কাজ করে নিজের থাকা খাওয়ার ব্যয় মেটায়। শুরুর দিকে গাছ কেটে লাকড়ি সংগ্রহ করতে বা সবজির বাগানে কাজ করতো। যখন এক জিনিস খেতে খেতে সবাই বিরক্ত হয়ে যেতো তখন রঞ্জন ওকে বাজারে পণ্য বিনিময় করতে পাঠাতেন। লড়াই করার সময়টা বাদে এই সময়টা ক্রিস্টোফারের খুব ভালো লাগতো। বহু কষ্টে ও স্থানীয় ভাষা আয়ত্ত করেছে। তবে বেশ তাড়াতাড়িই পেরেছে শিখতে। বার বার আসা যাওয়া করতে করতে সওদাগরেরো চিনে ফেললো ওকে। তবে ক্রিস্টোফার দোকানে আসলে মোটেও খুশি হতো না তারা। কারণ ও দামাদামিতে খুবই পটু, একেবারে একটা পয়সা পর্যন্ত ছাড় দিতে রাজি হয় না।

একদিন বাজারের ভিতর এক ভারতীয় ওর সাথে কথা বলতে এগিয়ে এলো। হাত ভরা সোনার আংটি তার সাথের চাকরেরা বাতাস করে পাশের মাছি তাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রিস্টোফার লোকটাকে এড়িয়ে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু লোকটার চেহারায় চোখ পড়তেই থমকে গেলো ও। একজন চাকর এগিয়ে এলো ওর দিকে। লোকটার পরনে চটকদার পোশাক, মাথার পাগড়িতে একটা পান্না বসানো পিন লাগানো। গায়ের কাপড়ে সোনার সুতোর কাজ করা-এক ধনী লোকের দেওয়ানের যেমনটা হওয়া উচিত, ঠিক তেমন। লোকটার পুরু ঠোঁট, পানের লাল রসে আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে আছে।

“ইনি হচ্ছেন আমার মালিক পরশুরাম,” ঘোষণা দিলো দেওয়ান লোকটা। ক্রিস্টোফারের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে সে, উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা এমনটাই করে। পরদেশীদের স্পর্শে নাকি ওদের জাত যায়। “উনি এই শহরের সবচেয়ে ধনী সওদাগর।”

পরশুরাম ক্রিস্টোফারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “তোমার কথা শুনেছি আমি। তুমি নাকি কালারির এক ভীষণ যোদ্ধা!”

ক্রিস্টোফার মাথা নোয়ালো।

“সবাই বলে তুমি নাকি দামাদামিতে সওদাগরদের একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়ো?”

“আমার বাবা শিখিয়েছেন যে, দামাদামিতে শেষ বলে কিছু নেই।”

“সেটাই-তবে সবাই কিন্তু সেটা পারেনা। তোমার মতো একজন হলে আমার খুব সুবিধা হয়।”

“আমাদের মালিকের কিছু জিনিস নিয়ুর শহরে নিতে হবে,” দেওয়ান। বললো আবার। “রাস্তাঘাট ভালো না আর ওটা যখন এসে পৌঁছাবে তখন সবচেয়ে সেরা দামেই বিক্রি করতে ইচ্ছুক উনি। সেজন্যে তুমিই সবচে উপযুক্ত লোক।”

“জিনিসটা কি?”

“লবণ।”

“বিনিময়ে, পরাম বললেন। “লাভের পাঁচ ভাগ দেবো আমি তোমাকে।”

“বিশ ভাগ, ক্রিস্টোফার বললো।

ক্রিস্টোফারের দাবি শুনে দেওয়ান হতভম্ব হয়ে গেলো, তবে পরশুরাম হেসে দিলেন। “আসলেই তোমার গুণ আছে। ঠিক আছে দশ ভাগে রাজি হয়ে যাও।” কিন্তু ক্রিস্টোফারের চেহারায় না বোধক অভিব্যক্তি দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি যোগ করলেন, “যদি এবার সব ভালোয় ভালোয় করতে পারো, তাহলে সামনে আরো কাজ দেবো তোমাকে। আমি অনেক জিনিসের ব্যবসা করি। লবণের চাইতেও আরো অনেক বেশি দামি জিনিসের ব্যবসা আমার আছে।”

“আমাকে আমার মালিকের অনুমতি নিতে হবে,” বলে ক্রিস্টোফার বিদায় নিলো।

রঞ্জনকে বলতেই উনি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

“আমি তোমার মালিক নই, বা তুমিও আমার গোলাম নও। তুমি যতোক্ষণ আমার সাথে থাকবে আমি ততোক্ষণ তোমাকে শিক্ষা দেবো। তুমি যদি অন্য কিছু পছন্দ করো তো যেতে পারো।”

“আমি কি প্রস্তুত?”

রঞ্জন নিজের হাতের তালুর দিকে তাকালেন, “লড়াইয়ের প্রথম নীতিটা কি?”

“কখনো ইচ্ছা করে লড়াই করবে না, তখনই যুদ্ধ করবে যখন সেটা এড়ানো সম্ভব না হয়।”

“এটা মনে রাখলে তোমার খুব বেশি ঝামেলা হবে না।”

যাত্রায় কোনো ঝামেলা হলো না। সেজন্যে নিয়ুরের যে বাড়িতে যাওয়ার কথা সেখানে পৌঁছে ক্রিস্টোফার হতাশ-ই হলো বলা চলে। ও চরম মাত্রায় দর কষাকষি শুরু করলো, এক পর্যায়ে ও চাকরদের আদেশ দিলো খচ্চরগুলোয় মালপত্র তুলে ফিরে যাওয়ার জন্যে। সদর দরজা দিয়ে অর্ধেকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর ওকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো।

পরের দিন বাড়ি ফিরে ও পরশুরামের বাড়িতে উপস্থিত হলো। সব কামাই বুঝিয়ে দিলো তাকে।

“কতো পেয়েছো লবণ থেকে?”

“বিশ রুপি” ক্রিস্টোফার জবাব দিলো।

দেওয়ান সন্দেহজনক ভঙ্গিতে মুদ্রাগুলো গুনলো। প্রতিটা পয়সা কামড়ে দেখে নিলো যে ঠিক আছে কিনা। তারপর ছোট্ট একটা নিক্তিতে মেপে দেখলো।

“ঠিক আছে,” কেমন বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো লোকটা।

পরশুরাম ক্রিস্টোফারের দিকে চেয়ে হাসলো। “আমার দেওয়ান, জয়ন্তন তোমাকে বিশ্বাস করে না। সেজন্যে লবণের প্রথম বস্তাটার ভিতর নিয়ুরের সওদাগরের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম আমি। তাতে লিখে দিয়েছিলাম যে, লবণ কতো দামে বিক্রি হলো সেটা জানিয়ে যেনো তার সবচেয়ে দ্রুতগামী লোকটাকে পাঠিয়ে দেয়।”

ক্রিস্টোফারের চেহারা লাল হয়ে গেলো। “আপনি আমাকে টাকা পয়সার ব্যাপারে বিশ্বাস করেন না?”

“এখন করি।” বলে উনি দুটো পয়সা নিয়ে ক্রিস্টোফারকে দিলেন। “আপাতত এটা তোমার ভাগ। তবে শিগগিরিই আবার খবর পাঠাবো। আমি যাদেরকে বিশ্বাস করি তাদের জন্যে কাজের অভাব হয় না।”

পরের কয়েক মাস ক্রিস্টোফার দারুণ কাজ দেখালো। ভিন্ন ভিন্ন শহর, ভিন্ন ভিন্ন মালামাল। কখনো ক্রিস্টোফার একা গেলো, কখনো সাথে থাকলো কেউ। কয়েকবার অবশ্য মাস্তানের খপ্পরে পড়েছিলো, কিন্তু ক্রিস্টোফারের তরবারি দেখেই ভেগেছে সব। প্রতিবারই ক্রিস্টোফার তাই হতাশ-ই হয়েছে। ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ফুটছে ও, একেবার ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আছে বলা যায়। উত্তেজনা কমাতে মঞ্চের লড়াইতে এতো ভয়ংকরভাবে লড়াই করতে যে একদিন একজনকে প্রায় অন্ধ-ই করে ফেলেছিলো।

“তোমাকে দুই নম্বরে কোন নীতিটা শিখিয়েছি?” রঞ্জন জিজ্ঞেস করলেন।

“ছানিগা,” গোমড়া মুখে বললো ক্রিস্টোফার।

“আর ছানিগা কি জিনিস?”

“ধৈর্য।”

*

একদিন পরশুরামের দেওয়ান জয়ন্তন কালারি-তে এসে উপস্থিত। “মালিক তোমাকে খবর দিয়েছেন।”

পরশুরামের বাড়িতে পৌঁছালে উনি ক্রিস্টোফারকে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। ওটার কাঠের জালির ঢাকনার ভিতর দিয়ে নরম আলোয় অনেকগুলো চুনি ঝিকমিকিয়ে উঠলো।

“মাদুরা-তে এক তামিল সওদাগরের কাছে নিয়ে যেতে হবে এগুলো। শহরটা পাহাড়ের ওপাশে। যেতেও সময় লাগবে অনেক। আর পাহাড়ের রাস্তাটা ডাকাত দিয়ে ভরা।”

ক্রিস্টোফারের কানে কথাগুলো গেলো বলে মনে হলো না। ও একদৃষ্টিতে চুনিগুলো দেখছে। বেশ্যাখানার দরজায় দাঁড়ানো এক বেশ্যার মতোই ওগুলো যেনো ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপছে। একটা শয়তানি চিন্তার উদয় হলো ওর মনেঃ চাইলে এই দুজনকে খুন করে এগুলো নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। তাহলেই ওর রুথকে বিয়ে করার মতো যথেষ্ট রুপি হয়ে যাবে। ক্রিস্টোফারের সারা শরীরে শিহরণ বইতে লাগলো। নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে ওর।

তিন নম্বর নীতিটা কি? রঞ্জনের কণ্ঠ ভেসে এলো ওর কানে।

আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, নিজের ভিতরের সত্ত্বা জবাব দিলো।

ও জোর করে নিজের চিন্তা আড়াল করলো।

“জয়ন্তন তোমার সাথে যাবে,” পরশুরাম বললেন। মৃত্যুর কতো কাছে থেকে মাত্র ফিরে এসেছেন সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই। শুধু তোমরা দুজন। আমি এক গাড়ি ভর্তি লোক পাঠাতে পারতাম-কিন্তু তাতে করে সবাই ই ব্যাপারটা খেয়াল করবে। আর সেই গন্ধে এখান থেক দিল্লি পর্যন্ত সব শয়তানের দলে এসে হাজির হবে। তাই বিশ জনের পক্ষে সম্ভব না হলেও দুই জনে আশা করা যায় যে ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারবে।”

ক্রিস্টোফার মাথা ঝোঁকালো, “আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো।”

পরের দিনই বের হয়ে গেলো ওরা। সমুদ্র পিছনে রেখে আরো ভিতরের দিকে গন্তব্য ওদের। রাস্তাটা একটা উপবনের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে। বৃষ্টির কারণে কাদা জমে আছে এখানে সেখানে। গাড়ি-ঘোড়া নেই বললেই চলে। রাস্তার দু’ধারে তেঁতুল গাছের সারি। সেখান থেকে ভেসে আসছে নানা পাখির ডাক। তবে সেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে তাঁত যন্ত্রের খটখট শব্দে। রাস্তার ধারে বসে তাঁতিরা কাপড় বুনছে।

ক্রিস্টোফার ওর জীবনের প্রায় পুরোটাই ভারতে কাটিয়েছে, কিন্তু এই প্রথম ও সমুদ্র থেকে এতো ভিতরে আসলো। এমনকি পরশুরামের হয়ে কাজ করতে যেসব জায়গায় গিয়েছে সেগুলোও ছিলো সব সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা। বেলা বাড়তেই জনমানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এলো। একটু পরেই তাঁতের খট খট শব্দ মিলিয়ে গিয়ে, অজানা সব পাখির ডাক ভেসে আসতে লাগলো কানে।

প্রথম রাত ওরা রাস্তার ধারের একটা মন্দিরে কাটালো। পরের দিনে দেখা গেলো রাস্তা সোজা ঘাট বরাবর উঠে গিয়েছে। ঘাট হচ্ছে বিশাল এক পর্বতের সারি। ভারতের পশ্চিম উপকূলে ওগুলো ঠিক এক সারি দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে এলো। আশেপাশের জঙ্গলও ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে। ওরা বিশাল বিশাল কাঠের গাছ আর বাঁশ দিয়ে ভরা এক বনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চললো। আগে কখনো এখানে মানুষের পা পড়েছে কিনা কেউ জানে না। প্রকাণ্ড সব লতা গুলা আর অর্কিড-ও দেখা গেলো। প্রচুর আগাছা মাটিতে, তুলা গাছের লাল রঙের ফুল পড়ে আছে সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে, দেখে মনে হচ্ছে রক্তের ফোঁটা।

ওরা অবশ্য রাস্তায় একা ছিলো না। কয়েকজন কুলিও ছিলো সাথে। বিশাল ভারি বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছে মাথায়। ওগুলোতে আছে নারিকেলের ছোবড়ার পার্টি, ফলের ঝুড়ি। প্রতিবারই ওরা কাছাকাছি আসতেই জয়ন্তন ক্রিস্টোফারের হাত চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, “খুব সাবধান।”

তবে ওরা জয়ন্তনের উচ্চ জাত চিনতে পারার সাথে সাথে সাথে মাটিতে উপুড় হয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। যতোক্ষণ না ক্রিস্টোফার আর জয়ন্তন চোখের আড়ালে গেলো ততোক্ষণ ওরা ওভাবেই রইলো।

“অন্তত এই মেয়েটা নিশ্চয়ই ডাকাত না,” ক্রিস্টোফার তরুণী বয়সী এক মেয়েকে দেখিয়ে বললো। মেয়েটার সাথে একটা গাধা। আম ভর্তি বস্তা গাধাটার পিঠে। মেয়েটার পরনে একটা সুন্দর শাড়ি। হাতে আর বাহুতে তামার বালা।

যেনো ক্রিস্টোফারের কথা শুনতে পেয়েই মেয়েটা ওর দিকে ফিরে তাকালো। অন্যদের মতো ও মাথা ঝোকালো না বা ওদের উচ্চ জাত টের পেয়ে সরেও গেলো না। বরং ও-ও বড় বড় চোখ করে ক্রিস্টোফারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, অনেকটা লাজুক একটা হাসি। সেই হাসিতে যেনো ক্রিস্টোফারের সমস্ত কল্পনা লুকিয়ে আছে। ওর সারা শরীরে কামনা ছড়িয়ে পড়লো।

“বেহায়া মাগী, গাল দিয়ে উঠলো জয়ন্তন। “শালীকে বেয়াদবির জন্যে ধরে চাবকানো উচিত।”

কোনো তাড়াহুড়া ছাড়াই মেয়েটা তার গাধাকে রাস্তার মাথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো আর ওদেরকে চলে যেতে দিলো। ক্রিস্টোফার আর একবার তার চোখে চোখে তাকাতে চেষ্টা করলো কিন্তু মেয়েটা গাধার পিঠের বোঝার বাঁধন টেনেটুনে দেখছিলো, তাই আর চোখ তুলে তাকালো না।

জয়ন্তন আর ক্রিস্টোফার রাস্তার পাশের একটা ছোট মঠ পেরিয়ে এলো। একটা গণেশের মূর্তি দেখে গেলো সেখানে। গলেয় ফুলের মালার স্তূপ।

জয়ন্তন ক্রিস্টোফারের কোমরের তরবারিটার দিকে তাকালো। “জিনিসটা সময়মতো ব্যবহার করতে পারবে তো? এই মঠের এখানেই কিন্তু ডাকাতেরা একজনকে খুন করেছিলো।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা খনখনে চিৎকার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিলো। এক মুহূর্ত পড়েই ত্রাহি রব ছাড়তে ছাড়তে এক পাল খচ্চর রাস্তার উল্টোপাশ দিয়ে তীর বেগে ছুটে এলো। ক্রিস্টোফার তরবারি বের করে মাত্র যেদিক দিয়ে এসেছে সেদিকে দৌড় দিলো।

“আরে থামো থামো,” চিৎকার করে ডাকলো জয়ন্তন। “তোমার কাজ আমাকে বাঁচানো।”

ক্রিস্টোফার ওর কথায় কান না দিয়ে দৌড়াতেই থাকলো। পায়ের ধাক্কায় ধুলো উড়ছে চারপাশে। রাস্তার বাঁকে পৌঁছাতেই ও সেই মেয়েটাকে দেখতে পেলো। মাটিতে চিত হয়ে শোয়া। কাপড় কোমর পর্যন্ত তোলা, কাচুলি ছিঁড়ে সদ্য প্রস্ফুটিত স্তন বেরিয়ে আছে। একটা দশাশই কালো চামড়ার লোক মেয়েটার দুই পায়ের ফাঁকে বসে তাকে মাটির সাথে চেপে ধরে রেখেছে।

কালারিতে শেখা রণহুংকার ছেড়ে ক্রিস্টোফার লোকটাকে আক্রমণ করলো। কিন্তু শয়তানটা কামনায় একবারে দিশা হারিয়ে ফেলেনি। সে ক্রিস্টোফারকে আসতে দেখেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর ক্রিস্টোফারের হাতের তরবারির দিকে এক নজর যেতেই জান হাতে নিয়ে দিলো দৌড়।

ক্রিস্টোফার যথেষ্ট জোরে দৌড়াতে পারে, কিন্তু লোকটা আরো বেশি দ্রুত। খানিকটা দৌড়ানোর পরে ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো সোজাসুজি দৌড়ে ও কখনো লোকটাকে ধরতে পারবে না। ও থেমে দাঁড়িয়ে তরবারিটা মাটিতে ফেলে দিলো। দুই হাত মুক্ত হওয়ার পর ক্রিস্টোফার ওর ধুতি গুটিয়ে নিলো।

কোমরে একটা উরুমি পেচিয়ে পরেছে ক্রিস্টোফার। সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়বে না সেটা। উরুমি হচ্ছে দুই প্রান্তেই ধারালো, ফুট দশেক লম্বা একটা পাতলা ইস্পাতের পাত। চাবুকের কশ এর মতোই নমনীয়।

কালারিতে এটার ব্যবহারই সর্বশেষ শিখেছিলে ও। আর এটায় দক্ষতা অর্জন করাই ছিলো সবচেয়ে কঠিন। ঠিকমতো ব্যবহার করতে না পারলে ব্যবহারকারীরই গলা কাটা পড়ার সম্ভাবনা আছে।

উরুমি-র হাতীর দাঁতের হাতলটা ওর হাতের মুঠোয় ঠিকঠাক বসে গেলো। কবজির মোচড়ে ও ফলাটা ছুড়ে দিলো সামনে। দেখে মনে হতে লাগলো জিনিসটা জ্যান্ত বুঝি। বাতাসে একেবেকে সোজা হল ওটা। ধর্ষক লোকটা ছিলো

উরুমি-র একেবারে ডগায়। ওটার বাকা ডগাটা লোকটার গোড়ালিতে সাপের মতো ছোবল দিয়ে ফাসের মতো আটকে ফেললো। তারপর পর্যায়ক্রমে ওটা গোড়ালির চামড়া, মাংস, রগ ভেদ করে শেষমেশ হাড়ও ভেঙ্গে দিলো। ব্যথায় প্রচণ্ড জোরে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলো লোকটা।

ক্রিস্টোফার লোকটার কাছে এগিয়ে গেলো। কোন তাড়াহুড়া নেই! আস্তে টান দিয়ে উরুমির ফলাটা গুটিয়ে নিলো ও। পথের ধুলোয় একটা গোখরার চলার পথের মতো দাগ করে ওর হাতের মুঠোয় কুণ্ডলী পাকিয়ে গেলো ওটা।

ক্রিস্টোফার লোকটার গায়ের উপর দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। “বন্ধু, তোমার সময় যে শেষ সেটা আশা করি বুঝতে পারছো? দুনিয়াকে বিদায় বলে দাও।” ও কথা বলছিলো ইংরেজিতে। ফলে লোকটা কিছুই বুঝলো না। তবে বলার ভঙ্গি আর ধরনেই যা বোঝার বুঝে নিলো। লোকটা গোঙাতে গোঙাতে প্রাণ ভিক্ষা চাইলো কিন্তু ক্রিস্টোফার হাসতে হাসতেই আবার ওর কবজি মোচড় দিলো। উরুমি-টা কুণ্ডলী খুলে ছুটে গিয়ে লোকটার গলায় স্পর্শ করলো এবার। দেখে মনে ওখানে আর একটা মুখের সৃষ্টি হয়েছে। ফুসফুসের সব বাতাস বেরিয়ে যেতে লাগলো সেদিক দিয়ে। এক মুহূর্ত পরেই ক্যারোটিড ধমনী দিয়ে সবেগে ছুটে বের হলো রক্ত, হৃৎপিণ্ডের ছন্দের তালে সেখানে রক্তের পরিমাণ কমতে বাড়তে লাগলো। ক্রিস্টোফারের পায়েও লাগলো রক্ত, তবে ও সরে যাওয়ার কোনো চেষ্টা করলো না। আস্তে আস্তে রক্তের বেগ কমতে কমতে একসময় পুরোপুরি থেমে গেলো। তারপর ও উবু হয়ে লাশটার পরনের কাপড়ের ভিতর হাত চালালো। ধুতির নিচে চামড়ার একটা থলে বাধলো হাতে। বেল্টে বাঁধা। ও থলেটার বাঁধন খুলে ভিতরের সবকিছু অন্য হাতে ঢেলে দিলো। বেশিরভাগ মুদ্রাই ছিলো তামার, তবে যথেষ্ট রুপা-ও আছে দেখে মুখে হাসি ফুটলো ওর।

যে মেয়েটাকে ধর্ষকটা আক্রমণ করেছিলো সে ক্রিস্টোফারের দিকে এগিয়ে এসে ওর হাতের দিকে ঝুঁকে দেখলো যে ও কি পেয়েছে। তখনও মেয়েটা নিজের কাপড় চোপড় ঠিকঠাক করছে। ক্রিস্টোফার মেয়েটার দিকে তাকালো। এতো কাছ থেকে ওকে দুর্দান্ত সুন্দর লাগছে। চুল খুবই ঘন, বেণী করে বাধা। নিয়মিত তেল দিয়ে আচড়ানোর কারণে চকচক করছে। ওর ছেঁড়া ব্লাউজের ভিতর তখনও একটা স্তন বেরিয়ে আছে। মেয়েটাও ক্রিস্টোফারের দৃষ্টি খেয়াল করে ইচ্ছে করেই সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে সেটাকে ভিতরে ঠেলে দিলো।

“ধন্যবাদ সাহেব। ভগবান আপনার ভালো করুক। এই পশুটার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার উপর।” মেয়েটার কণ্ঠ খুবই নরম আর মিষ্টি। বলতে বলতে সে ক্রিস্টোফারের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিলো। ক্রিস্টোফারের মনে হলো নিজেকে আর সামলাতে পারবে না।

কিন্তু মেয়েটাকে দেখে মনে হলো সে এসবের কিছুই টের পাচ্ছে না।

“আপনার সাথের লোকটা কই?” জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা।

“ও সুইট খ্রাইস্ট!” ক্রিস্টোফারের সম্বিত ফিরলো। জয়ন্তনের কথা ভুলেই গিয়েছিলো ও। বিদ্যুতবেগে দৌড়ে আবার রাস্তার বাকে ফিরে এলো। জয়ন্তন-ও এদিকেই আসছিলো। সামান্যের জন্যে দুজন মুখোমুখি বাড়ি খেলো না।

“কত বড় সাহস তুমি আমাকে রেখে চলে যাও?” প্রচণ্ড রেগে আছে ও। “মালিক খবটা জানতে পারলে-”

“ওই মেয়েটা একটা ডাকাতের হাতে পড়েছিলো,” ঠাণ্ডা গলায় বললো ক্রিস্টোফার। “আমার কি করা উচিত ছিলো?”

“যদি এটা একটা ফাঁদ হতো? যদি ডাকাতের সাঙাতের ওঁত পেতে থাকতো, আর তুমি ওদিকে ধাওয়া করা মাত্র আমাকে আক্রমণ করতে? একটা ছোট জাতের বেহায়া মাগীর জন্যে নিজের দায়িত্ব ভুলে যেও না।”

ক্রিস্টোফার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে সামলালো। মৃত লোকটার গরম রক্ত তখনও ওর পায়ে লেগে আছে, আর খুন করার নেশা তখনও ওর ভেতর জ্বলছে। ওর সাথে এভাবে কথা বলার জন্যে উরুমি দিয়ে চাইলেই ও জয়ন্তনের জিহ্বাটা কেটে দিতে পারতো।

তা না করে ও আবার আগের জায়গায় ফিরে গেলো। মেয়েটা পড়ে যাওয়া আমগুলো কুড়িয়ে আবার গাধার পিঠের বস্তায় তুলে রাখছে। ক্রিস্টোফারকে একটা সাধলো ও।

“নিন না,” বললো মেয়েটা। “এর বেশি কিছু দেওয়ার মতো নেই আমার।”

ক্রিস্টোফার মেয়েটাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দিয়ে ছুরি দিয়ে আমটা কেটে খেতে শুরু করলো। দারুণ সুস্বাদু আম।

“খুব মিষ্টি,” ক্রিস্টোফার বললো। “ঠিক তোমার মতোই।”

মেয়েটা লজ্জা পেয়ে হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। “আমার নাম তামান্না, মেয়েটা বললো।

“ক্রিস…” বলতে গিয়ে থেমে গেলো ক্রিস্টোফার। “আবসালম।” মেয়েটার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একটু হলে আসল নামটাই বলে ফেলেছিলো। ও জয়ন্তনের দিকে তাকালো। কিন্তু দেওয়ানজী খেয়াল করেছে বলে মনে হলো না।

মেয়েটা সামনের ফাঁকা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো। “আমার সাথে একটু যাবেন, আবসালম? আমার ভয় করছে।”

“না,” বললো জয়ন্তন।

“হ্যাঁ,” বললো ক্রিস্টোফার।

“না,” আবার বললো জয়ন্তন। ওর কণ্ঠে অধৈর্য। “তোমাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্যে আর আমার কথা শোনার জন্যে।”

ক্রিস্টোফার দুই পা ফাঁক করে, বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ালো। “আপনি নিজে যেতে চান তো যেতে পারেন। তবে আমি এই ভদ্রমহিলার সাথেই যাবো।”

“যখন মালিকের কানে খবরটা যাবে…” রাগের চোটে জয়ন্তনের কথা জড়িয়ে গেলো। বুকের যেখানে চুনি ভরা থলেটা রাখা সেখানে ধরে দেখলো।

তামান্না ওদের মাঝে এসে দাঁড়ালো। আমার জন্যে আপনাদের মধ্য ঝামেলা করবেন না।”

“উনি আমার বন্ধু-ও না, আমার মালিকও না, ক্রিস্টোফার গাধার লাগামটা ধরে হাঁটা শুরু করে দিলো। “তাছাড়া যেখানে বলা হয়েছে সেখানেই যাচ্ছি আমি।”

“ওনার কি হবে?” রক্তে ভরা লাশটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো মেয়েটা। এর মধ্যেই মাছি ভনভন করতে শুরু করেছে সেখানে।

ক্রিস্টোফার কাঁধ ঝাঁকালো “ওখানেই থাক। অন্যদের জন্যে হুশিয়ারি হয়ে থাকবে।”

*

বাকি দিনটা ওরা হেঁটেই কাটালো। জয়ন্তন চুপচাপ সামনে, ক্রিস্টোফার আর তামান্না পিছনে। জয়ন্তন তামান্নার দিকে তাকালোই না বলা চলে। কারণ ও হচ্ছে নীচু জাত, তাই ওর কাছে বস্তুতঃ মেয়েটার অস্তিত্ব নেই। এদিকে ক্রিস্টোফার তামান্নার উপর থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না। কারণ, যা দেখেছে সেটা কিছুতেই মন থেকে সরছে না। ছিন্ন ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা প্রস্ফুটিত স্তন আর ধর্ষক লোকটা যখন কোমর পর্যন্ত ওর শাড়ি তুলে ফেলেছিলো তখন ও দুইপায়ের সংযোগস্থলটাও দেখতে পেয়েছিলো।

রুথ এর কথা ভাবো, নিজেকে বললো ক্রিস্টোফার। যখন স্বামী স্ত্রী হিসেবে একসাথে থাকবে তখন ব্যাপারটা কতোটা মিষ্টি হবে সেটা চিন্তা করো।

কিন্তু তামান্নাকে পাশে রেখে রুথ এর কথা ভাবাটা বেশ শক্তই বটে। রুখের কথা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো ওর। কিন্তু তামান্নার হাসি আর কথায় সেসব উড়ে গেলো সহসাই। মেয়েটা বয়সে ওর চাইতে খুব বেশি বড় না, কিন্তু একেবারে চপল আর ইচড়ে পাকা। সেই সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ আর উদার মনের অধিকারি। সম্ভবত এই শ্যামল প্রকৃতির কোলে বড় হয়েছে বলেই এমন স্বভাব। তামান্নার বাবা একজন কৃষক। সমুদ্রতীরের কাছে এক গ্রামে বাড়ি ওদের। ওর বাবা নাকি এক পথচারীর কাছে শুনেছেন যে হায়দ্রাবাদের নিজামের সাথে যুদ্ধ চলার কারণে পাহাড়ের ওপাশে খাবার ঘাটতি চলছে। তাই তামান্না ওখানে আম নিয়ে চলছে, ভালো দাম পাওয়ার আশায়।

“তুমি একাই বেরিয়ে পড়েছো?” ক্রিস্টোফার অবাক হলো।

“আমার ভাইদেরকে মাঠে কাজ করতে হবে।”

“তোমার স্বামী?”

বলতে বলতে আবার ক্রিস্টোফার মেয়েটার দিকে তাকালো। সেটা দেখে তামান্নার চেহারা লাল হয়ে গেলো। লাজুক একটা হাসি হাসলো ও।

“আমার বিয়ে হয়নি। আমার বাবার যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আর সত্যি কথা হচ্ছে মাঠের কাজে আমাকেও লাগে।”

ক্রিস্টোফার ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “তোমার মতো সুন্দরিকে কেউ এখনো বিয়ে করেনি সেটা আমার বিশ্বাস হয় না।”

তামান্না দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। “আমাকেত বাবার আদেশ মানতেই হবে।”

সন্ধ্যা নাগাদ ওরা এক মন্দিরে এসে উপস্থিত হলো। আশেপাশে আর কিছুই নেই। পাহাড়ের চূড়া ওখান থেকে কাছেই। ছোট ঘরটার চারপাশে এক চিলতে দেয়াল। উঠোন জুড়ে আগাছা আর কাটা ঝোঁপ। পোড়া ছাই দেখে বোঝা গেলো এর আগেও অনেকেই এখানে আশ্রয় নিয়েছে।

জয়ন্তন প্যাগোড়ার ভিতরে কম্বল পেতে নিলো। ক্রিস্টোফার দরজার কাছের ঝোঁপ জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানেই নিজের বিছানা পাতলো।

“আমি বাইরেই ঘুমাবো,” তামান্নাকে বললো ক্রিস্টোফার। “ভিতরে পোকামাকড়ের বাসা। গায়ের উপর হাঁটবে।”

কারো দৃষ্টি আকর্ষণের ভয়ে ওরা কোনো আগুন জ্বাললো না। ভাত আর ডাল দিয়ে রাতের খাবার সারলো সবাই। তারপর খেলো তামান্নার আম। ক্রিস্টোফার জোর করে দাম দিয়ে দিলো। “নইলে পাহাড় পার হতে হতে তোমার আর আম একটাও থাকবে না। শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হবে।”

ঘুমাতে অনেক সময় লেগে গেলো ক্রিস্টোফারের। ঘাসের উপর শুয়ে ও রাতের নিস্তব্ধতা শুনতে লাগলো। দেয়ালের ওপাশে জঙ্গলে পশু পাখিরা উচ্চস্বরে চিৎকার করে চলেছে। এই পর্বতে বাঘ আছে নিশ্চিত, আর কি আছে তা ঈশ্বরই জানেন। জঙ্গলে হাজার হাজার জায়গা আছে যেখান থেকে ওদের দিকে নজর রাখা সম্ভব। কে জানে, কেউ হয়তো সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে।

কিছু একটা শব্দ করে উঠলো। জঙ্গলে না, দেয়ালের ভিতরেই। ও তরবারির দিকে হাত বাড়ালো। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে, তবে সেটা ভয়ের জন্যে না। আবার লড়াইয়ের সম্ভাবনায় ওর শরীর জেগে উঠেছে।

“আবসালম?”

কোমর সমান উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে এলো তামান্না। কাটাঝোঁপ এড়াতে শাড়ি দুই হাতে উঁচিয়ে রেখেছে। এসে ক্রিস্টোফারের পাশে বসলো ও। এতো কাছে যে ওদের কাধ স্পর্শ করলো।

“আমার ঘুম আসছে না। চোখ বুজলেই…” শিউরে উঠলো তামান্না। “আপনি ভাবতেও পারবেন না।”

“এখন আর কোনো চিন্তা নেই, ক্রিস্টোফার আশ্বাস দিলো ওকে।

তামান্না ওর গায়ে হেলান দিয়ে কাঁধে মাথা গুঁজে দিলো। ক্রিস্টোফার বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলো। মেয়েটাকে চুমু খাওয়ার জন্যে ওর সারা শরীর একযোগে চিৎকার শুরু করেছে যেনো।

ও দাঁতে দাঁত চাপলো। রুথ, নিজেকে বললো ও। রুথের জন্যে নিজেকে শক্ত করো।

“আপনি যেভাবে ঐ শয়তানটাকে সামলালেন! আমি জীবনেও কাউকে এরকম করতে দেখিনি। আপনার ওই অস্ত্রটা মারাত্মক কিন্তু এতো ভালো করে কোত্থেকে শিখলেন?”

“কালারিতে শিখেছি।”

তামান্না নিজের ভর বদল করতে সামান্য বাকা হলো, ভারসাম্য রাখতে ও ক্রিস্টোফারের হাঁটুতে ভর দিলো।

“ওখানে অনেকদিন আছেন, তাই না?”

“বেশি দিন না। আমার বাড়ি এখানে না। বোম্বেতে।”

তামান্নাকে বেশ কৌতূহলী দেখালো। “আপনি কি তাহলে এদেশী না?”

“না,” প্রশ্নটা ক্রিস্টোফারকে অবাক করেনি মোটেও। ওর কালো চুল আর কালো চোখের কারণে ওকে স্থানীয় বলেই মনে হয়। আর কালারিতে ঘণ্টার পর ঘন্টা রোদে অনুশীলন করার পর ওর চামড়া-ও পুড়ে গাঢ় বাদামী হয়ে গিয়েছে। ফলে এখন আর চেনার উপায় নেই। শুধু আকৃতির দিক থেকে অন্যদের চাইতে আলাদা ও।

“আমার বাবা ইংরেজ, তবে আমি সারা জীবনই এদেশেই থেকেছি।”

তামান্নার হাত ক্রিস্টোফারের হাঁটু থেকে উরুতে নেমে এলো। তারপর দুই পায়ের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা সেখানে ঝুলে রইলো।

“ইংল্যান্ডে কি খুব গরম?”

“না। বাবাতো বলেন খুব ঠাণ্ডা আর সারাদিন নাকি বৃষ্টি হয়।”

“বর্ষাকালে এখানে যেমন হয়?”

“সম্ভবত।”

তামান্নার হাত আবার নড়ে উঠলো। এবার সেটা দুই পায়ের সংযোগস্থলে আলতোভাবে গিয়ে স্থির হলো। ওর হাত পাতলা কাপড়টা ভেদ করে বিদ্যুতের মতো উত্তেজনা ছড়াতে লাগলো। ওকে থামাও, ক্রিস্টোফারের মন আদেশ দিলো। কিন্তু ওর শরীর শুনলো না-তামান্নার স্পর্শ পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব।

“কাজটা ঠিক হচ্ছে না, কোনোমতে বললো ক্রিস্টোফার। “মানে… আমার আর একজন আছে।”

“বুঝেছি,” তামান্না বললো কিন্তু হাত সরালো না। “আপনি বিবাহিত।”

“না”

“তাহলে সমস্যা কি?” তামান্নার হাতের নাড়াচাড়া আরো দ্রুত হলো। এতো দ্রুত মালিশ করতে লাগলো যে ক্রিস্টোফারের মনে হলো কামনার আবেশে ও উড়ে যাবে।

“কখনো কোন মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছেন?”

“না,” স্বীকার করলো ক্রিস্টোফার।

তামান্না নিজের কাচুলি খুলে বক্ষ উন্মুক্ত করে ফেললো। তারপর ক্রিস্টোফারের একটা হাত নিয়ে আঙুলগুলো ফাঁক করে একটা স্তনের উপর রাখলো। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে স্তনের বোটা শক্ত আর উদ্ধত হয়ে আছে। ক্রিস্টোফার বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ওখানে চাপ দিতেই ও অস্ফুট শব্দ করে উঠলো।

“আস্তে,” ফিসফিস করে বললো তামান্না। ওর লম্বা ঘন চুল ক্রিস্টোফারের বুকে লাগতে লাগলো; চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো একজন আর একজনকে। তামান্না ক্রিস্টোফারকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে পিষতে লাগলো ওর সাথে।

রুথ, ক্রিস্টোফারের মনের গহীন একটা কোণ থেক আর্তনাদ ভেসে এলো। কিন্তু ও পাত্তা দিলো না। কামনা ওকে বশ করে ফেলেছে। মনে হচ্ছে শরীরের ভিতর একটা আগুন বইছে। এই আগুন চাপিয়ে রাখা আর ওর পক্ষে সম্ভব না।

*

ক্রিস্টোফারের ঘুম ভাঙলো দেরিতে। কালারিতে যখন থাকে তখন সবসময়ই ও সূর্য ওঠার আগেই উঠে নিজের যা কাজকর্ম সব সেরে নেয়। কারণ সূর্য উঠতে না উঠতেই অনুশীলন শুরু হয়ে যায়। শেষ কবে সূর্যোদয়ের পর ঘুম ভেঙ্গেছে মনে নেই ওর।

আরামটা ও উপভোগ করলো কিছুক্ষণ। কাল রাতের সবকিছু মনে আসছে, এতে স্পষ্টভাবে যে আবারও ওর কামনা জাগ্রত হতে শুরু করলো। আসলেই কি কাল রাতের সব সত্যি ছিলো? নাকি সব স্বপ্ন? না। তামান্নার শরীরের ঘ্রাণ এখনো নিজের শরীরে লাগে আছে ওর। নারিকেল, সুগন্ধি আর ঘামের গন্ধ।

চেহারায় চওড়া একটা হাসি খেলে গেলো ওর। শরীর এখনো ম্যাজ ম্যাজ করছে, তাই চামড়ার উপর সূর্যের নরম উত্তাপটা আরো বেশি ভালো লাগছে। ও একটা হাত বাড়িয়ে দিলো, কিন্তু তামান্না পাশে নেই। সম্ভবত ও চায়নি জয়ন্তন যেনো ওদেরকে একসাথে দেখে ফেলে। ক্রিস্টোফার উঠে বসে চারপাশে তাকালো।

তামান্নার কম্বলটা দেখা যাচ্ছে। মাড়ানো ঘাসের উপর পড়ে আছে। গাধাটাও একই জায়গায় বাঁধা। আগাছা চিবুচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা কোথাও নেই।

একটা কাক এসে মন্দিরের গম্বুজের উপর বসলো। বেলা হয়ে গেলেও, জয়ন্তন কেন এখনো ওকে জাগিয়ে দেয়নি ভেবে অবাক হলো ক্রিস্টোফার। সাধারণত, ওর কোনো ত্রুটি ধরতে পারলে বিমলানন্দ লাভ করে জয়ন্তন।

নিতান্ত অনিচ্ছায় ও জয়ন্তনকে খুঁজতে গেলো। মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখলো কাকটা দরজার ভিতরে, মাটিতে পড়ে থাকা কিছু একটায় ঠোকরাচ্ছে। কিন্তু ক্রিস্টোফারের অবস্থান থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে জিনিসটা কি। কাকের পাশে একদল মাছি ভনভন করছে। সিঁড়ির মাথায় উঠে আসতেই ওকে দেখে কয়েকটা ইঁদুর দৌড়ে পালালো। জয়ন্তনকে দেওয়া ওর সাবধানবাণী মনে পড়লো। এসব পুরনো দালান হচ্ছে পোকা মাকড়ের আখড়া।

বাইরের উজ্জ্বল সূর্যালোকের কারণে অন্ধকারে চোখ সয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগলো ক্রিস্টোফারের। তারপর আরো কিছুটা সময় লাগলো মাটিতে পড়ে থাকা জিনিসটা কি সেটা বুঝতে।

জয়ন্তন চিত হয়ে শুয়ে আছে, তবে সে ঘুমাচ্ছে না। গলা থেকে বুকের মাঝ বরাবর নিখুঁতভাবে কাটা। এতো বড় হা হয়ে আছে জায়গাটা যে নিচের মেরুদণ্ড পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। চুনি ভরা ব্যাগটা নেই। চারপাশ ঘিরে শুকিয়ে আসা রক্তের ছোটখাটো একটা পুকুর দেখা যাচ্ছে। মাছিতে ভরে আছে সেটা। রক্তের কিনারায় পাথরের উপর ছোট একটা পায়ের ছাপ। গত রাতে এই পা টাই ওকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো।

রাগে উন্মাদ হয়ে বাইরে দৌড়ে এলো ক্রিস্টোফার। দুত হাতে তরবারিটা তুলে নিলো ও। তারপর উরুমি-টা বেঁধে ছুটে গেলো রাস্তায়।

ভোরের কুয়াশায় রাস্তার ধুলো মরে গিয়েছে। আর এতো সকালে এখানে আর কারোই আসার সম্ভাবনা নেই। তাই তামান্নার খালি পায়ের ছাপগুলো স্পষ্টভাবেই দেখতে পেলো ও। সেগুলো অনুসরণ করে পাহাড়ে উঠে এলো ক্রিস্টোফার। প্রতিটা পদক্ষেপে রাগ আরো বাড়ছে ওর। কোমরে ঝুলানো উরুমি-টা হিস হিস করছে। আর ও মনে অনে ভাবছে তামান্নাকে ধরার পর এটা দিয়ে ওকে কি করবে।

রাস্তা ধরে কিছুদুর যাওয়ার পরেই পায়ের ছাপ দিক পরিবর্তন করে একটা ছাগল চরার রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়েছে। একটা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে মিশেছে সেটা। রাস্তাটা পাথরের। তামান্নার হালকা পা তাই এখানে কোনো ছাপ ফেলেনি। ও কি এদিক দিয়েই গিয়েছে? নাকি ওর পিছু নেওয়া থামানোর জন্যে ধোঁকাবাজি করেছে।

তামান্না শুরু থেকেই ক্রিস্টোফারকে ধোঁকা দিয়ে এসেছে। আমের বাগান, গরীব বাবা যে কিনা ওর যৌতুক দিতে পারে না-সব মিথ্যা। ধর্ষণটাও নাটক। জয়ন্তনের কথা-ই ঠিক 1. কিন্তু অতিরিক্ত রাগের কারণে ক্রিস্টোফার অনুতাপ বোধ করলো না। ওই ধর্ষক লোকটাও নিশ্চয়ই তামান্নারই সাথের কেউ। ক্রিস্টোফার কাছে আসামাত্র পালিয়ে যাবে, পরে রাত নামলে তামান্নার কাছে ফিরে আসবে-এই ছিলো ওদের পরিকল্পনা। তবে ওদের পরিকল্পনার এই অংশটুকু মাঠে মারা গিয়েছে।

কিন্তু সুযোগ থাকার পরেও তামান্না কেন ওকে খুন করেনি সেটা ভেবে অবাক হচ্ছে ও। আবেগ? ওর সাথে থাকার সময় তামান্নার কেমন লাগতো সেটা মনে পড়লো ওর। ওর স্পর্শের অনুভূতি মনে আসতেই রাগে হাত মুঠো করে ফেললো ও। একবার ধরতে পারলে জীবনের শিক্ষা দিয়ে দেবে।

ক্রিস্টোফার রাস্তা ধরে আরো কিছুটা গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো, কিন্তু আর কোনো পায়ের ছাপ পাওয়া গেলো না। তার মানে ছাগল চলার রাস্তা ধরেই গিয়েছে মেয়েটা। ও-ও সেদিকেই এগিয়ে পর্বতের খাড়া গা বেয়ে উঠতে শুরু করলো। ও মাটিতে ছাপ বের করায় খুব বেশি দক্ষ না, তবে এক জায়গায় সামান্য নরম মাটিতে ও আবার একটা পায়ের ছাপ খুঁজে পেলো। এখনো তাজা। উরুমির প্যাঁচ খুলতে খুলতে আরো জোরে ছুটলো ও।

পথটা পর্বতের চারপাশ ঘুরে তারপর উপরে উঠেছে। খানিকটা উঠতেই আচমকা একটা গিরিখাত দেখা গেলো সামনে। আর ওখানেই তামান্না  দাঁড়িয়ে। একাকী। একটা পাথরের চাই-এর উপর নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। ও নিশ্চয়ই ক্রিস্টোফারের আসার শব্দ শুনেছে কিন্তু পালানোর কোনো চেষ্টাই করেনি দেখা যাচ্ছে। এখন আর শাড়ি পরা নেই। শুধু কাচুলি আর হরিণের চামড়ার পায়জামা পরনে। ওটা ক্রিস্টোফার আগে দেখেনি।

“আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছো?” তামান্না অবাক হয়েছে বোঝা গেলো।

রাগের চোটে ক্রিস্টোফারের ইচ্ছে করছিলো তখনি দৌড়ে গিয়ে ওর টুটি চেপে ধরে। কিন্তু তামান্নার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিলো, যে জন্য ও সামনে আগালোে না। যেনো ওর ভিতর লুকানো একটা শক্তি আছে-আর সেজন্যেই ওর চেহারায় এক অদ্ভুত আত্মতুষ্টি ফুটে আছে। এই ব্যাপারটাই ক্রিস্টোফারের রাগকে কমিয়ে সচেতন করে তুললো।

“চুনিগুলো কোথায়?” জানতে চাইলো ক্রিস্টোফার।

“নিরাপদ কোনো জায়গায়। তোমার বন্ধু জয়ন্তন কিন্তু খুবই বিশ্বস্ত। আমাকে আসতে দেখে ও চেষ্টা করেছিলো পাথরগুলো গিলে ফেলতে, যাতে ওর মালিকের সম্পদ রক্ষা পায়। শেষে তাই ওর বুক কেটে সেগুলো বের করতে হয়েছে।”

“এজন্যে তোকে পস্তাতে হবে।”

“তুমিও একই কাজ করতে। ওর দিকে তুমি কিভাবে তাকাও সেটা আমি কালই দেখেছি। তোমার মনের ভিতর কি আছে জানি আমি।”

ক্রিস্টোফার ওর কথার প্রতিবাদ করলো না। কিন্তু এখনতো আমি তোকে বাগে পেয়েছি।”

“তাই নাকি?” জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করলো তামান্না। পাথরের আড়াল থেকে পাঁচজন লোক বেরিয়ে এলো। চেহারা রুক্ষ, মুখে না কামানো দাড়ি, পরনে ছেঁড়া পোশাক। সবার হাতে ধরলো ছোরা।

“আমার তো মনে হচ্ছে তোমাকে বাগে পেয়ে গিয়েছি।”

“আমাকে আটকাতে হলে এই কয়জন দিয়ে হবে না।” বলতে বলতে ক্রিস্টোফার তামান্নার পাশে দাঁড়ানো লোকগুলোর চেহারা দেখে নিলো। কে সবচে দ্রুত বা কে সবার আগে আক্রমণ করতে পারে সেই চিন্তা করছে। কাকে খুন করতে সবচেয়ে কষ্ট হবে? কিন্তু সেরকম কিছুই ঠাহর করতে পারলো না।

“যে কাছে আসবে, তারই কল্লা ফেলে দেবো,” সাবধান করলো ক্রিস্টোফার। তামান্না দশ গজ মতো দূরে দাঁড়িয়ে। উরুমির আওতার সামান্য বাইরে। ও সামনে এগিয়ে আক্রমণের লক্ষ্যে শরীরকে প্রস্তুত করে ফেললো।

তামান্না শরীরের পিছনে হাত দিয়ে কোমর থেকে একটা লম্বা পিতলের নলের পিস্তল বের করে আনলো। তারপর আলতো করে সেটা ক্রিস্টোফারের দিকে তাক করে হ্যাঁমার টেনে ধরলো।

ক্রিস্টোফার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলো। ওর মুখের অক্ষম ক্রোধ দেখতে পেয়ে হেসে দিলো তামান্না। “কালারির সেরা যোদ্ধার পক্ষেও বুলেটের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব না।”

“তাহলে আমাকে এখানে টেনে আনার মানে কি? জয়ন্তনের মতো আমাকে ঘুমের মধ্যে মেরে রেখে আসলেই তো হতো।”

“কারণ আমি তোমাকে খুন করতে চাইনি।” ক্রিস্টোফার আরো এক চুল আগালো। কিন্তু আর একটুও সামনে বাড়ার চেষ্টা করলে সেটা করতে বাধ্য হবো।”

“কেনো?”

“বাকি জীবন কি এই আনা নেওয়ার কাজই করে যেতে চাও? ওই ভোটকা ব্যাটার সেবা করে যেতে চাও যাকে তুমি এক ঘুষিতে পরপারে পাঠিয়ে দিতে পারবে? শুধু টাকা আছে বলে ওরা তোমার উপর ছড়ি ঘুরিয়া যাবে? তুমি কিভাবে ঊরুমি চালাতে পারো সেটা আমি দেখেছি। তোমার মতো একজন যোদ্ধা মালাবার উপকূলের ত্রাস হতে পারবে।”

“তাতে কি হবো আমি? দস্যু?”

“মুক্ত হবে।”

তামান্না বন্দুকের নলটা নামালো। ওর বাহু অনেক সরু, কিন্তু একবারের জন্যেও সেটা কাপলো না।

“কোন পক্ষে যোগ দিতে চাও ভেবে দেখো?”

*

“আমরা ঠিক কাজটাই করছি, তাই না?” টম জোরে জোরে চিন্তা করছে।

ও আর ডোরিয়ান পানসি নৌকাটার পিছন দিকে বসে আছে। এক হাতে হালটা ধরে আছে টম। টেবিল উপসাগরের বন্দরে ভীড়ে থাকা সওদাগরি জাহাজগুলোর ফাঁক দিয়ে পানসিটা এগিয়ে যাচ্ছে। সারাহ, ইয়াসমিনি আর অ্যানা বসেছে মুখোমুখি। ওদের পিছনে আলফ উইলসন আর তার সহযোগীরা নিখুঁত ঐকতানে দাঁড় বাইছে। আলফের বাবার বাড়ি ছিলো ব্রিস্টলে। তবে ওর গায়ের গাঢ় রঙটা পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন উচ্চ বংশের মঙ্গোলিয়ান মহিলা। আলফ নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে পেরে কতোটা আনন্দিত সেটা টম বুঝতে পারছে।

“যদি আমরা সব ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারতাম যে কি হতে যাচ্ছে তাহলে বলতাম যে অবশ্যই ভুল পথে যাচ্ছি আমরা,” হেসে বললো ডোরিয়ান। “অনিশ্চয়তাই তো রোমাঞ্চের কারণ।”

সারাহ টমের দিকে ভ্রুকুটি করলো। “তোমাকেতো এরকম অস্থির দেখিনা কখনো।”

“আমি আসলে জোরে জোরে চিন্তা করছিলাম।” সত্যি কথা হচ্ছে ফ্রান্সিস ওকে খুন করার অভিপ্রায়ে উদয় হওয়ার সেই রুদ্ধশ্বাস রাতটার পর থেকে ও অনিশ্চয়তায় থাকার আর কোনো সুযোগ পায়নি। কারণ এরপর থেকেই শুরু হয় অনবরত কাজ : একটা জাহাজ কিনে সেটাকে সুসজ্জিত করা, ওটায় এমন সব মাল ভর্তি করা যেগুলো ভারতে বিক্রি করলে প্রাচুর দাম পাওয়া যাবে, তারপর জাহাজকে চালানোর জন্য লোকবল জোগাড় করা। টম এসবের প্রতিটা খুঁটিনাটি নিজে নজরদারি করেছে। প্রতিদিন সূর্যের আগে ঘুম ভাঙতে ওর, বাসায় ফিরতে গভীর রাতে। ফিরেই লণ্ঠনের আলোয় সারাদিনের ব্যয়ের হিসেব কষতে বসে যেতো।

“অনেকের স্বামী-ই সমুদ্রে গিয়ে আর ফিরে আসে না। এরকম কিন্তু অনেক নজির আছে,” সারাহ বললো। “জাহাজে থাকার সময় তাই ওকে সবসময় চোখে চোখে রাখি।”

টম ওর হাত ধরলো। “যখন আমরা সমুদ্রে থাকবো, তখন আমার চোখ থাকবে শুধু তোমার দিকে।”

“তোমার চোখ থাকবে দিগন্তে, আবহাওয়ায়, পাল খাটানোয় আর তোমার লোকেদের দেখাশোনায়,” মুখ বাঁকিয়ে বললো সারাহ। “তবে আমার কাছ থেকে বেশি দূরে তো আর যেতে পারবে না।”

“ভারত যেতে অনেক সময় লাগবে রে পাগল,” জ্বলজ্বলে চোখে বললো টম।

একটা অতিরিক্ত বোঝাই ইন্ডিয়াম্যানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো পানসিটা। দুপুরের কড়া রোদে ওটা সোনার পাত বসানো কামানের খোপগুলো ঝকমক করছে। তা দেখে টমের শেরপা জাহাজটার কথা মনে পড়লো। ওটায় করেই ও প্রথম আফ্রিকায় এসেছিলো। ওর বাবা হাল-এর সাথে এসেছিলো ও। সোনা দিয়ে এরকম গিলটি করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কতো টাকা খরচ হতে পারে ভাবলো টম। তবে ওদের মোট লাভের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ এই বিলাসিতা দ্বারা প্রকাশ পায়।

“ওরে আল্লাহ্! এতে তো অনেক টাকা লাগার কথা!” ইয়াসমিনি বললো।

টম জানে ও ইন্ডিয়াম্যানটা সম্পর্কে কথা বলছে না। ও বলছে গত কয়েক সপ্তাহে ওদের খরচ করা টাকা সম্পর্কে। জাহাজটার দামই অনেক, কেপ টাউনে এরকম জাহাজ মাত্র কয়েকটাই আছে। শুরুতে ওটার মালিক দাম কমাতেই চাইছিলো না। কেনার আশা তাই এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছিলো টম। ব্যাংক অফ হীরেনগ্রাচট-এ রাখা সব টাকা খরচের পরেও দেখা গেলো আরো টাকা দরকার ওদের। গত দশ বছর ধরে ইউরোপ জুড়ে স্প্যানিশ আগ্রাসন চলছে। সেই যুদ্ধের কারণে বন্দুক, পাউডার, গুলি, কার্তুজসহ আরো প্রায় শখানেক দরকারি জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছে।

“তবে টাকা দিয়ে কি পেয়েছি দেখো।” বলে টম পানসির মুখ সোজা করলো। ইন্ডিয়াম্যানের লেজের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো পানসিটা। সামনেই ওদের নতুন জাহাজটা দাঁড়িয়ে। ডাচ নকশায় বানানো একটা তিন মাস্তুলের জাহাজ। এগুলোকে বলা হয় স্কুনিয়ার্স, অর্থ ‘অত্যন্ত সুন্দর। ইংরেজিতে শব্দটা হচ্ছে ‘স্কুনার্স। এই নামটা যথাযথ। জাহাজটা বিশাল ইন্ডিয়াম্যানগুলোর চাইতে লম্বা কিন্তু সরু, সারা গায়ে মার্জত নকশা কাটা। ওটার সামনে লাগানো সমুদ্র পরীর ভাস্কর্য থেকে শুরু করে পিছন দিকের থাকার জায়গা পর্যন্ত সবই মনোহর। জাহাজটা কেপ টাউনে আসামাত্র টমের মনে ধরে যায়। ও জাহাজটার নাম দিয়েছে কেস্ট্রেল-একটা পাখির নাম। ডেভনে থাকার সময় টম প্রায়ই এই পাখি শিকারে যেভো। নামের সার্থকতা রাখতেই যেনো জাহজাটা সামান্য বাতাসেও প্রায় উড়ে চলতে পারে।

বন্দরের জাহাজের সারির পিছনে ওটাকে নোঙ্গর করে রাখা। পাশেই ভাসছে কোর্টনীদের আদি আর অকৃত্রিম সেবক সেন্টারাস। জায়গাটা দুর্গের কামানের গোলার আওতার বাইরে। এই আগাম সতর্কতাটা টম শিখেছে ওর বাবার কাছ থেকে।

টম পানসিটা কেট্রেল-এর পাশে এনে দাঁড় করালো। তারপর একজন একজন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে। আবোলি আগেই এসে উঠেছে, শেষ সময়ের প্রস্তুতি তদারকি করছে। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর হাতের খাতায় লিখে রাখছে।

সিঁড়ির মাথায় টমের মাথাটা দেখা যেতেই ও দৌড়ে গেলো সেদিকে।

“আসেন চাচা। সবকিছু রেডি। বাতাসও আছে প্রচুর। আবোলি বললো আপনার আদেশ পেলেই নোঙ্গর তুলে ফেলা যাবে।”

ছেলেটার আগ্রহ দেখে হাসলো টম। কেস্ট্রেল কেনা শেষ হওয়া মাত্র টম ফ্রান্সিসকে জাহাজে থাকতে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। যাতে লোকজন জ্যাকব দ্য সি আর অন্যান্য লোকগুলোর নিখোঁজ হওয়ার সাথে ফ্রান্সিসের আগমনকে মেলাতে না পারে। আবোলি ওকে সব ভালো খবরই দিলো। ফ্রান্সিস খুবই আগ্রহী ছাত্র। খুব দ্রুত সব শিখে নেয়, আর কাজকর্মেও পটু। যদিও আফ্রিকা আসার আগে কোনোদিনও কোনো জাহাজে পা দেয়নি ও। তবে সব দেখেশুনে টম ওর মধ্যে এক দুর্দান্ত নাবিকের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।

“ব্যবসার ক্ষেত্রে ওর মাথা ব্ল্যাক বিলির মতোই,” একরাতে আবোলি বলেছিলো টমকে। “কিন্তু মনটা একদম ওর মায়ের মতো।”

টম হঠাৎ খেয়াল করলো ফ্রান্সিস আর ওর দিকে তাকিয়ে নেই, ওর কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। জাহাজ বা এটার কোনোকিছুই যেনো আর ওর মাথায় নেই। চেহারা বিমলানন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। অ্যানা উঠে এসেছে জাহাজে।

এই দুজনের দিকে নজর রাখতে হবে, মনে মনে বললো টম। আবোলি শুধু ফ্রান্সিসের শেখার দক্ষতা সম্পর্কেই টমকে বলেনি। ও আরো জানিয়েছে, “ছেলেটা প্রেমে পড়েছে, ক্লিবি। যখনই অ্যানা জাহাজে আসে ও সব কাজ ভুলে ওকে নিয়েই পড়ে থাকে।”

“আরে বাচ্চা একটা ছেলে।” টম অবাক হয়ে বলেছে। “আর অ্যানা বড় একটা মেয়ে।” তবে ভালো করে ভেবে বুঝলো দুজনের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না। “অ্যানারও কি একইরকম অবস্থা নাকি?”

“অ্যানা এখনো ফ্রান্সিসকে ঐ নজরে দেখে না,” আবোলি বলেছে। “কিন্তু আমাদের যাত্রাটা অনেক লম্বা হবে। আর সে জন্যেই সম্ভবত ফ্রান্সিস বেশি বেশি আশা করছে।”

টম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফ্রান্সিস বা অ্যানা দুজনের কেউই আর ছোট নেই। দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে ওরা। কিন্তু ও ফ্রান্সিসের জন্যে একটা দায়িতুবোধ অনুভব করে, নিজের আপন সন্তান থাকলেও এমনটাই অনুভব করতো। আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ও খুব ভাল মতোই জানে যে জাহাজের মতো এইরকম বদ্ধ পরিবেশে যে ভালোবাসার সম্পর্কগুলো হয়, সেগুলোর পরিণতি সাধারণত শেষমেশ ভালো হয় না।

সারাহ ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। “ফ্রান্সিস, মিষ্টি করে ডাকলো ও। “তুমি কি কষ্ট করে মিস দুয়ার্তের ব্যাগপত্র তার বার্থে দিয়ে আসতে পারবে?”

“তুমি ওকে এসবের মাঝে ঠেলে দিচ্ছো কেনো?” ওরা নিচে নেমে যেতেই নালিশের সুরে বললো টম।

“আমি ঠেলে দেই বা না দেই তাতে কিছুই যায় আসে না,” সারাহ জবাব দিলো। “যা হওয়ার তা হবেই। আর কেউ না হোক, অন্তত তোমার সেটা জানা থাকার কথা।”

ডোরিয়ান এগিয়ে এলো ওদের দিকে। “দারুণ কিন্তু জাহাজটা,” প্রশংসা করলো ও। “ঠিক আছে, আপাতত বিদায় তাহলে দেখা হবে শীঘ্রই।”

“আচ্ছা।”

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে করা পরিকল্পনা মোতাবেক, টম আর সারাহ, ফ্রান্সিস আর অ্যানাকে নিয়ে কেস্ট্রেল-এ করে মাদ্রাজ যাবে। ডোরিয়ান, ইয়াসমিনি আর আবোলি সেন্টারাস-কে নিয়ে আফ্রিকার উপকূল ধরে আরবের গুম্বন আর মোকা বন্দরে যাবে। সেখান থেকে ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে একশো মাইল দূরে লাকুইডিভা নামের এক দ্বীপপুঞ্জে আবার একসাথে মিলবে ওরা। তারপর একসাথে বাড়ি ফিরবে।

টম ওর ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি করলো। “সাবধানে থেকো!”

“তুমিও নিরাপদে ফিরে এসো।”

“তাতে আসতেই হবে,” টম বললো। “সব টাকা ঢেলেছি এটার পিছনে।”

ছোট ভাইয়ের গমন পথের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা বেদনা অনুভব করলো টম। প্রায় দশটা বছর টম জানতো যে ও মারা গিয়েছে। তাই এখন সামান্য সময়ের জন্যেও যদি আলাদা হতে হয় তো ওর ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। এটাই যদি আমাদের শেষ দেখা হয়?

“ডোরিয়ান চাচা চলে গিয়েছেন?”

ফ্রান্সিস উঠে এসেছে উপরে। ও আর অ্যানা কতক্ষণ নিচে ছিলো ভেবে অবাক হলো টম।

“বিদায় দেওয়ার জন্যে একেবারে ঠিক সময়ে চলে এসেছো তুমি।”

আবোলি, ইয়াসমিনি আর ডোরিয়ানকে নিয়ে নৌকাটা আবার দূরে সরে গেলো। ওরা হাত নাড়লো নৌকা থেকে। নৌকাটা দৃষ্টির আড়াল হতেই নোঙ্গর তোলার আদেশ দিলো টম। কু-রা কপিকল ঘোরানো শুরু করলো। নোঙ্গর উঠে আসা শুরু হতেই পায়ের নিচে সেই সুপরিচিত দুলুনিটা অনুভব করতে পারলো টম।

সাগরের অবাধ স্বাধীনতা টমের খুব পছন্দ। তবে এবার কাঁধে ঋণের বোঝার কারণে কিছুটা চিন্তিত ও। সারা জীবনে কখনো কারো কাছে থেকে ঋণ নেয়নি ও। তাই সারাক্ষণ ব্যাপারটা খচখচ করছে মনের ভিতর। এবারের যাত্রাটা তাই দ্রুত শেষ করার জন্যে মুখিয়ে আছে টম। দ্রুত সব শেষ করে লাভের টাকা দিয়ে দেনা শোধ করতে পারলে তবেই শান্তি। তারপরেই মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারবে ও।

*

সমুদ্র ওদের অনুকূলেই থাকলো। যদিও এখন মৌসুমের শেষ সময়, তবুও টম মনে করতে পারলো না কবে এতো ঝামেলাহীন যাত্রা করেছে ওরা। ক্রমাগত বাজে আবহাওয়া থাকার কারণে কেপ অফ গুড হোপ-এর নাম বদলে এখন সবাই কেপ অফ স্টর্মস ডাকা শুরু করেছে। কিন্তু ওখানেও ঝড়ের কোনো চিহ্ন দেখা গেলো না। কেস্ট্রেল-ও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করলো। বাতাসের আগে আগে ছুটলো ওটা, যেনো খোলের তলে পানি না, পাতলা বাতাস। প্রতিদিনই টম এমন নতুন কিছু না কিছু আবিস্কার করতে লাগলো যা ওকে ওর নতুন জাহাজটা সম্পর্কে অবাক করেই চললো।

টম, ফ্রান্সিসের সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে লাগলো। ও যা যা পারে সবই ছেলেটাকে শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক ওর বাবাও যেভাবে প্রথম যাত্রায় ওকে সব শিখিয়েছিলো। ও ফ্রান্সিসকে জাহাজ চালনা শেখালোঃ কিভাবে সূর্যের অবস্থান দেখে অক্ষাংশ বের করতে হয়, কিভাবে লগ লাইন দিয়ে জাহাজের গতি মাপতে হয়। কপাস দিয়ে কিভাবে দিক ঠিক রাখতে হয়, কিভাবে হাল-এর পাশে বসানো ট্রাভার্স বোর্ডের সাহায্যে জাহাজ কতদূর অগ্রসর হলো সেটা বের করতে হয়-সবই শেখালো।

“অনেক চেষ্টার পরেও দ্রাঘিমাংশ বের করার কোনো পদ্ধতি এখনো কেউ বের করতে পারেনি,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। “জাহাজের অবস্থান কতোটা পূর্ব বা পশ্চিমে তা সূর্য দেখে জানা যায়, কিন্তু উত্তর বা দক্ষিণে কতদূর আসলাম সেটা জানা সম্ভব না। সেটার জন্যে আমাদেরকে জাহাজের গতি আর স্রোত দেখে অনুমান করতে হবে।”

বিকেলে, অবসরে ওরা তরবারি দিয়ে অনুশীলন করতো। ফ্রান্সিস ওর সৎ বাবার কাছে থেকে ভালোই শিখেছে, সেই সাথে ওর নিজের বাবার কাছ থেকে পাওয়া স্বাভাবিক ক্ষিপ্রতা তো আছেই। আর এখন টমের তত্ত্বাবধানে ও সত্যিকার অর্থেই এক ভয়ানক যোদ্ধায় রূপান্তরিত হলো।

মাঝে মাঝে ভারি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়েও অনুশীলন চলতো। কেস্ট্রেল-এ দশটা নয় পাউন্ডের কামান আছে। প্রতিদিন টম ওর সব লোকদেরকে সেগুলোর ব্যবহার প্রশিক্ষণ দিতে। কারণ, কোনো ঝামেলা ছাড়া ভারত পৌঁছাবে এটা ওরা কল্পনাতেও ভাবে না। আর সেজন্যে টম কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন নাবিক একেবারে ইংরেজ সৈন্যদলের সদস্যের মতো দ্রুত গোলা ছুঁড়তে পারে ততোক্ষণ টম অনুশীলন করিয়েই যেতো। সময়টা হচ্ছে সর্বোচ্চ দুই মিনিট। ফ্রান্সিসও বাকি সবার সাথে অনুশীলন করে। গেলো। অচিরেই ও বাকিদের মতো কামানের নল মুছে, তাতে গোলা ভরে, তাক করে ছোঁড়া শিখে গেলো।

“যদি সেরকম জরুরি পরিস্থিতি হয়-ই, তাহলে সেসময় যেনো প্রতি জোড়া হাতই আমাদের কাজে লাগে,” এক সন্ধ্যায় কথাটা বললো টম। “আমি আমার শেষ পয়সাটা পর্যন্ত এই যাত্রার পিছনে খরচ করেছি। কোনো ফালতু দস্যু এসে আরামে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তা আমি হতে দেবো না।”

“আপনি নিশ্চিত যে দস্যুরা আমাদেরকে আক্রমণ করবে?” ফ্রান্সিসের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে টম হাসি গোপন করলো। ছেলেটা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণের জন্যে আগ্রহে ফেটে পড়ছে।

ব্যাপারটা ভালোই, টম নিজেকে বললো। তুমি নিজেও এরকম ছিলে। ওর মনে আছে, ওকে জাহাজে নেওয়ার জন্যে ও ওর বাবার প্রধান নিয়োগ কর্মকর্তা বিগ ড্যানিয়েল ফিশারের শুধু পা ধরা বাদ রেখেছিলো। এরপর ওর বাবা যখন অনুমতি দিলো, সেদিনটা ছিলো ওর জীবনের অন্যতম আনন্দের দিন।

“শুধু তো দস্যুদের কথা বললাম,” সাবধান করলো টম। “গাই যদি একবার আমাদের এই ইন্টারলোপিং অভিযানের কথা জানতে পারে, তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমগ্র বহর আমাদের পিছনে লেলিয়ে দেবে।”

রোদের চোটে ফ্রান্সিসের চোখ ছোট ছোট হয়ে আছে। “গাই চাচা আপনাকে এতো বেশি অপছন্দ করে কেননা? কেপ টাউনে আমাকে কথাটা বলেননি।”

“সে এক লম্বা কাহিনি।” এড়িয়ে যেতে চাইলো টম। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজের খুব কম কৃতকর্মের জন্যেই ও লজ্জা বোধ করে, আর ওর ভাই সম্পর্কে বলাটা সেগুলোর মধ্যে একটা। “তখন আমারদের বয়স এই তোমার মতোই…”।

একটা পালে বাতাস লেগে ফুলে উঠতেই হ্যাচকা টানে ওটায় বাঁধা একটা রশি গেলো খুলে। তারপর ওটার মাথা ডেক-এ ছোটাছুটি করতে লাগলো। জাহাজের গতিও পরিবর্তিত হয়ে গেলে সাথে সাথে।

“আগে এটা সামলিয়ে আসি,” ফ্রান্সিসের কাঁধ চাপড় দিয়ে বললো টম। “আর একদিন বলবো। প্রমিস, বলবো।”

ফ্রান্সিস অবশ্য আর জিজ্ঞেস করেনি। একটা কারণ হচ্ছে, টম যে এ ব্যাপারে আলাপে অনাগ্রহী সেটা টের পেয়েছে ও। আর আসল কারণটা হচ্ছে ওর মাথায় সারাক্ষণ শুধু অ্যানার চিন্তা ঘোরে। মেয়েদের সাথে মেলামেশার খুব বেশি সুযোগ ওর হয়নি। যতোদিনে বয়স বেড়ে উপযুক্ত হয়েছে বলা যায়, তততদিনে দারিদ্র ঝাঁকিয়ে বসেছে ওদের পরিবারে। হাই উইল্ডের বিশালতু দেখে কয়েকটা মেয়ে অবশ্য কিছু আগ্রহ দেখিয়েছিলো, কিন্তু সেটাও একদিনের বেশি টেকেনি। কারণ বাড়ির ভিতরের খালি দেয়াল আর ফাঁকা ঘর দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলো তারা।

কিন্তু অ্যানার সাথে ওর ওরকম কিছুই হচ্ছে না। অ্যানা ওকে ওর চরম দুরবস্থায় পাওয়ার পরেও দূরে ঠেলে দেয়নি। ওর সাথে একদম সহজভাবে, নরম সুরে কথা বলে অ্যানা। তবে এটায় একটা সমস্যাও আছে। ফ্রান্সিস ধরতে পারে না কথার আড়ালে ওর জন্যে অ্যানার আসল মনোভাবটা কি। ওর সারাক্ষণ অ্যানার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে হয়। ফলে যদি কখনো অ্যানা ওকে একটু এড়িয়ে যায় বা একটু বেখেয়াল হয়, তাহলে ওর সারাটা দিন খারাপ কাটে। যতোবার অ্যানা ডেক-এ উঠে আসে, ফ্রান্সিস কোনো কাজেই মন বসাতে পারে না। ট্রাভার্স বোর্ড নিয়ে খাবি খায় তখন, বা সূর্যের কৌণিক অবস্থান বের করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে।

“তুমি দেখি আমাদেরকে গ্রিনল্যান্ডের অক্ষাংশে অবস্থান দেখিয়েছো,” টম একদিন ওকে ডেকে বকুনি দিলো। সেদিনের হিসাবে বিশাল একটা গড়মিল করে ফেলেছিলো ফ্রান্সিস।

“ভুল হয়ে গিয়েছে, চাচা।”

“অ্যাডমিরাল স্যার ক্লাউডেসলি শোভেল-এর কথা শুনেছো? দুই বছর আগে, উনি নিজের অবস্থান বের করতে ভুল করে ফেলেন আর ওনার পুরো বহর নিয়ে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের দিকে চলে যান। ওখানকার পানির নিচের পাহাড়ে বেধে ওনার চারটা জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যায় দুই হাজার মানুষ। উনি নিজেও ছিলেন তার ভেতর। তাতে করে অবশ্য আত্মহত্যা করার ঝামেলা থেকে বেঁচে যান উনি।”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আচ্ছা, বুঝেছি।”

টম ওর স্বর নরম করলো। “তোমাকে বুঝতে হবে, ফ্রান্সিস। জাহাজে মাত্র তিনজন লোক আছে যারা সূর্যের অবস্থান নিখুঁতভাবে বের করতে পারে। এখন যদি আমার বা আলফ উইলসনের কিছু একটা হয়-ধরো কোনো ঝড়, বা দস্যুর আক্রমণ, বা জাহাজ কিছুর সাথে ধাক্কা খায়-তাহলে একমাত্র তুমিই আছো যে কিনা জাহজটাকে নিরাপদে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।”

“আমি আসলে সেভাবে ভেবে দেখিনি।”

“আমি এই জাহাজের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারি না। কেপ টাউনের জাহাজঘাটার কেরানি vOC-র হয়ে কাজ করে। আমার কাছে থেকে সে ইচ্ছে করে বেশি টাকা নিয়েছে। আমার নিজের সব টাকা তো বটেই, তার সাথেও বাড়তি অনেক টাকা এই অভিযানের সাথে জড়ানো। যদি জাহজটা ডোবে তাহলে আমিও ডুবে যাবো।”

*

“ওর উপর ওর সৎ বাবার প্রভাব নিয়ে ভয় হয় আমার,” নিজেদের কেবিনে শুয়ে এক রাতে সারাহকে বললো টম। জাহাজে প্রতি কেবিনে একজনের শোয়ার মতো করে খাট ছিলো, কিন্তু টম কাঠ মিস্ত্রিকে বলে ওর ঘরের খাটটা দুজন শোয়ার মতো করে বানিয়েছে। পাশাপাশি শুয়ে আছে ওরা। ভ্যাপসা আবহাওয়ার কারণে দুজনেরই পরনে কোনো কাপড় নেই। ওনার মতো একজন জুয়াড়ির নিশ্চয়ই নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। যদি ফ্রান্সিসও সেসব শিখে নেয়?”

“তাহলে সেসব অভ্যাস ছাড়িয়ে দেওয়া হবে,” সারাহ পাশ ফিরে শুলো। টম এর বুকে মাথা রেখে ওর হৃৎস্পন্দন শুনছে।

“আর তার উপর ওর শরীরে বিলির রক্ত বইছে,” টম আবার বললো।

“আমার বাবা আজীবন শুধু লাত্রে ধান্দা করেছেন, আর আমার মায়ের ধ্যান জ্ঞান ছিলো শুধু খাওয়া। আর আমি কি তাদের মতো অতপ্ত দানব হয়েছি?”।

টম মাথার উপরের নিচু ছাদটার দিকে চেয়ে রইলো। উপর থেকে পাহারাদারের মাপা পদধ্বনি ভেসে আসছে।

“একজন মানুষের মানুষ হওয়ার পিছনে কি থাকে?” জোরে জোরে চিন্তা করতে লাগলো টম। “এটা কি বংশগত? নাকি পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেয় সবাই?”

সারাহ কনুইতে ভর দিয়ে হাতের উপর মাথা রাখলো। ওর বয়স সবে তিরিশ পেরিয়েছে। কিন্তু এখনো কিশোরী মেয়েদের মতোই চপল। ওর সোনালি আভার চামড়া একেবারে মসৃণ, স্তন নিখুঁত আর উন্নত আর চোখ ঠিক ডেভনের আকাশের মতোই পরিষ্কার আর নীল।

‘ফ্রান্সিস বংশগতভাবে যে গুণাবলিই পাক বা কারো কাছ থেকে যা কিছুই শিখুক-ও কিন্তু সেই সবার চাইতে আলাদা একটা মানুষ হবে। তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো। ও সঠিক পথে না হাঁটলে সেটা তোমার দায় না।”

সারাহের লম্বা কেশরাজি টমের বুকের উপর ছড়িয়ে আছে, ওর কেমন সুড়সুড়ি লাগছে তাতে। সারাহ আঙুল দিয়ে টমের পেশির বাইরের দিকটায় বুলাতে লাগলো। ধীরে ধীরে নিজের কাজ করছে ও। টম টের পেলো ওর ভাবনা অন্যদিকে সরে যাচ্ছে।

সারাহ টমের ঠোঁটে চুমু খেলো। ওর চোখ চকচক করছে। তবে আমি কিন্তু মায়ের প্রভাব থেকে পুরো মুক্ত নই। কিছু কিছু ব্যাপারে আমার লোভ খুব বেশি! যেমন তোমার আদর।”

*

কেপ কোমোরিন পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ওদের ভাগ্য সুপ্রসন্নই থাকলো। এটা হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ব দক্ষিণ প্রান্ত। জায়গাটা একবার পার হতে পারলেই ওদের আর মৌসুমি বায়ুর ভয় থাকবে না। ইদানীং ঝড়ের জন্যে পশ্চিম উপকূলে জাহাজ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“একবার অন্তরীপটা পার হতে পারলেই আর চিন্তা নেই। সিলন ঘুরে মাদ্রাজ পর্যন্ত একেবারে মাখনের মতো রাস্তা,” টম বললো। সামনের টেবিলে একটা চার্ট বিছানো। সেটার দিকে তাকিয়ে যেনো জোর করেই নিজেকে আশ্বস্ত করলো টম। ওরা ঠিক ঋতু বদলের সময়টাতে এখানে এসে পৌঁছেছে, তার উপর আজ সারা বিকেল বাতাস স্থির হয়ে আছে। এখনো নিরাপদ না ওরা।

“সিলনে নীলার খনি আছে,” অ্যানা বললো। “ওগুলো হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দামী পাথর। রানি সেবার মন জয় করার জন্যে রাজা সলোমন নাকি তাকে এই পাথরা উপহার দিয়েছিলেন।”

টেবিলের উল্টো পাশে বসা ফ্রান্সিসের মুখভঙ্গি দেখছে টম। ও কি ভাবছে সেটা পড়ার চেষ্টা করছে। সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ও অ্যানার দিকে তাকালো, কথাটা কি অ্যানা ইচ্ছেকৃতভাবে ফ্রান্সিসের মাথায় ঢোকানোর জন্যে বললো কিনা সেটা ভাবছে।

“আমরা কি সিলনে একবার নামতে পারি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“ফেরার পথে দেখা যাবে,” টম বললো। “এই মুহূর্তে আমাদের এক দলা পনির কেনারও সামর্থ্য নেই।” পরের কথাটা ও ঠাট্টার ছলে বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু কেনো যেনো সেটা বেশ রুঢ় শোনালো।

“দামী পাথরের ব্যবসা কিন্তু অনেক লাভের,” অ্যানা বললো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে টম কোনো ছলনা দেখতে পেলো না। শুধু এক ব্যবসায়ীর বেশি লাভ করার অভিপ্রায়। “কয়েক বছর আগে মাদ্রাজের গভর্নর স্যার থমাস পিট বিশাল বড় একটা হীরা কিনেছিলেন। ওটার ওজন ছিলো প্রায় সোয়া এক পাউন্ড, চারশো দশ ক্যারেট ছিলো পাথরটা।”

শুনে এবার টমও আগ্রহী হয়ে উঠলো। মৃদু স্বরে শিষ দিয়ে উঠলো ও।

“এক ভারতীয় শ্রমিক গোলকান্দার খনিগুলোর একটা থেকে চুরি করে এনেছিলো হীরাটা। লোকটার পায়ে বিশাল একটা দগদগে ঘা ছিলো। তার ভিতরে লুকিয়ে খনি থেকে বের করে এনেছিলো হীরাটা। খনির পাহারাদারেরা কিছুই টের পায়নি। পিট ওটার জন্যে বিশ হাজার পাউন্ড দিয়েছিলেন। পাথরটা কেটে পালিশ করার পর ওটার দাম লক্ষ পাউন্ড ছাড়াবে।”

“গোলকান্দা কি মাদ্রাজের কাছে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“দুইশো মাইল ভিতরে। তবে সব ভালো ভালো পাথরই মাদ্রাজে আসে।”

“তাহলে দোয়া করো যেনো আমরা এতো বেশি লাভ করতে পারি যা দিয়ে কয়েকটা পাথর কেপ টাউনে কিনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়,” টম বললো। “আমি বাজি-”

টম কথা থামিয়ে চুপ করে গেলো হঠাৎ। কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকছে ওর কাছে। যেনো জাহাজের কাঠের ভিতর দিয়ে ওর কাছে খবর পৌঁছে গিয়েছে। ও উঠে দাঁড়ালো, সাথে সাথেই শব্দ হলো দরজায়।

“দুঃখিত স্যার,” মেট বললো। “বাতাস পড়ে গিয়েছে। আবহাওয়ার মতি গতিও ভালো ঠেকছে না। মাস্টার বললেন একটা ঝড় নাকি আসছে।”

টম প্রায় দৌড়ে ডেক-এ উঠে এলো। ওরা নিচে গিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। এইটুকুতেই সমুদ্র ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। বিশাল বিশাল ঢেউ ফুলে উঠছে চারপাশে; দড়িগুলোতে বাধা পেয়ে বাতাস যেনো আর্তচিৎকার করে বেড়াচ্ছে। এক অশুভ, নীলচে-লাল আলোয় ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রের উপরিভাগ। দিগন্তে সূর্যের আলো মেঘের ফাঁক দিয়ে মাথা গলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু পারছে না।

“সব পাল নামাও এখনি, শুধু মাঝেরটা রাখো,” টম আদেশ দিলো। “ওটাকেও অর্ধেক তুলে রাখো। উপর থেকে গজ খানেক থাকবে শুধু। সমুদ্রের নোঙ্গরগুলো প্রস্তুত করে রাখো তাড়াতাড়ি।”

লোকজন ঝটপট কাজে লেগে গেলো। দড়ি ধরে টেনে পাল গুটিয়ে ফেলছে। টম ফ্রান্সিসকে ডাকলো।

“কুয়োর গভীরতা কতোটুকু মেপে আসো।” কুয়োটা আসলে জাহাজের ঠিক মাঝের একটা গর্ত। জাহাজের পেটে যতো পানি ঢোকে তা ওখানে জমা হয়। সাগর যতোই ঠাণ্ডা হোক, বা জাহাজটা যতোই ভালো করে বানানো হোক কেন, খোলে পানি ঢুকবেই। আর ঝড়ের কারণে জাহাজের তক্তাগুলোর উপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। ঢেউ এসে খোলে বাড়ি দিয়ে তক্তাগুলো নাড়িয়ে দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই ফুটো হবে অনেকগুলো। যদি পানি ঠিকমতো সেচ দিয়ে বের করা না যায় তাহলে পানির কারণে জাহাজের ওজন আরো বেড়ে যাবে, তখন ওটা ঠিকমতো চালানোও যাবে না, ফলে জাহাজ ঢেউয়ের প্রতি আরো বেশি নাজুক হয়ে যাবে। আর জাহাজ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।

ফ্রান্সিস পানি মাপার কাঠিটা হাতে ফিরে এলো। “ছয় ইঞ্চি।”

“খারাপ না।” তবে টম কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না। “পালগুলো গোটানো হলেই সবাইকে পানি সেচতে পাঠিয়ে দেবে। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর লোক বদল করবে।”

“আচ্ছা।” বলে ফ্রান্সিস দৌড়ে গেলো আদেশ পালন করতে। টম ঘুরে দেখলো অ্যানা আর সারাহ শাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“ঝামেলা কি খুব বেশি?” সারাহ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো। বাতাসের তোড়ে ওর মাথার চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে।

“আমাদের সামনে আরো একশো মাইল খোলা সাগর,” টম বললো। “কেস্ট্রেল অনেক ভালো একটা জাহাজ। তাই ভাগ্যের সহায়তা পেলে আশা করছি ঝড়ের আগেই জায়গাটা পেরিয়ে যেতে পারবো।”

“আর এখন?” সারাহ বললো। “আমি আর মিস দুয়ার্তে কি করতে পারি?”

“নিচে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকো। আর প্রার্থনা করো যেনো ঝড় চলে যায় দ্রুত।”

*

বাতাসের বেগ বাড়তেই লাগলো। সাগর ফুলে ফুলে উঠছে। ঢেউগুলো একেকটা এতো বড় যে ওটার উপর দিয়ে ওপাশে আর দেখার উপায় রইলো না। কেস্ট্রেল একবার ঢেউয়ের মাথায় উঠছে আবার ঝপাস করে আছড়ে পড়ছে। পানির তোড়ে ডেক-এর উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে টমের। রাত নামলো একসময়, তবে দিনের বেলাতেই এতো বেশি অন্ধকার ছিলো যে তফাতটা খুব বেশি বোঝা গেলো না। কেউ ঘুমাতে পারলো না। টম ডেক-এ পায়চারি করতে লাগলো, হালীকে এই বৈরি সাগরেরো ঠিকভাবে হাল ধরে রাখতে সাহায্য করলো। জাহাজের ছেঁড়া দড়াদড়ি আর মাস্তুলের দিকে কড়া নজর রাখলো। এতো দ্রুত ঝড়টা এগিয়ে এলো যে অর্ধেক ভোলা পালটা নামানোরও সময় পেলো না টম। শেষ পর্যন্ত ওর জাহাজের কোনো অংশ আস্ত থাকবে কিনা সেটা নিয়েই চিন্তায় পড়ে গেলো

ওর আশংকাই সত্যি হলো। মাঝরাতের একটু পরে, জাহাজটা প্রচণ্ড জোরে কেঁপে উঠলো। এতো জোরে শব্দ হলো যে ঝড়ের মাঝেও স্পষ্ট শোনা গেলো। আলফ উইলসন দৌড়ে এলো অন্ধকার থেকে।

“সামনের পরীটা ভেঙ্গে পড়েছে।”

“এখুনি ওটাকে কেটে ফেলো, এখুনি।” আদেশ দিলো টম।

পরীটার ভাঙা অংশটুকু ডেক-এ টেনে আনতেই টম টের পেলো যে ওর জাহাজ উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করেছে। যদি জাহাজটা বাতাসের আড়াআড়ি চলে আসে, তাহলে বাতাস ধাক্কা দিয়ে জাহাজটা একটা পিপার মতো করে উল্টে ফেলবে। হালী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আবার আগের দিকে ঘোরাতে। কিন্তু জড়তার কারণে পারছে না। সাগর আজ এতো শক্তিশালী যে, যে কোন সময় পুরো হালটাই ভেঙ্গে যেতে পারে।

টম নিজে সব কাজে নেতৃত্ব দিতে লাগলো। জাহাজের উপর যে ঢেউগুলো। এসে পড়ছে সেগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে। ওগুলোকে আটকানো অসম্ভবই বটে, কোমরে রশি বেঁধে না রাখলে জাহাজ থেকে পড়েই যেতো। চেহারায় ঢেউয়ের বাড়ি খেলো, চোখে ছোবল খেলো। বলা যায় অন্ধই হয়ে গেলো ও, হাতের কুড়ালটা দিয়ে যে জাহাজের কিনারে বাঁধা দড়াদড়ি কেটে দেবে সেই উপায়ও রইলো না। আরো একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো।

জাহাজের সবচে বড় মাস্তুলের সাথে বাধা দড়িটার দিকে কুড়াল চালালো। টম। প্রবল বাতাসে ওটা টানটান হয়েই ছিলো। ওটা কাটা না হলে পুরো মাস্তুলটাকেই ভেঙ্গে ফেলতো।

ওর কুড়ালের কোপে কেটে গেলো দড়িটা। আচমকা প্রচণ্ড টান মুক্ত হওয়ায় ওটার মুক্ত প্রান্ত বাতাস কেটে একদিকে ছুটে গেলো। টম তীরবেগে ওটার পথ থেকে সরে গেলো। এক ইঞ্চির জন্যে সেটা ওর চোখে এড়িয়ে পিছনের লোকটার চেহারায় গিয়ে লাগলো। চিৎকার করে উঠে পড়ে গেলো লোকটা। সাথে সাথে একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো তাকে। তারপর একটানে জাহাজের কিনারে টেনে নিয়ে গেলো।

লোকটার কোমরে একটা দড়ি বাঁধা, কিন্ত জাহজ থেকে পড়ে গেলে সেটা কোনো কাজেই আসবে না। কেউ তাকে জাহাজের খোলের গায়ে পিষে মারবে। টম দৌড় দিলো। ভয়ানক পিচ্ছিল হয়ে আছে তক্তাগুলো। ও ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার কোমর আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে আসলো, ঠিক সেই মুহূর্তে আর একটা ঢেউ ভেঙ্গে পড়লো ওদের উপর।

দড়াম করে একটা শব্দ হয়ে পুরো ডেক কেঁপে উঠলো। এক মুহূর্তের জন্যে টমের মনে হলো একটা মাস্তুল বুঝি ভেঙ্গে পড়েছে। ও উপরে তাকালো, ভেবেছে দেখবে যে ওটা ভেঙ্গে ওর উপরেই পড়ছে। কিন্তু দেখা গেলো মাস্তুল ঠিকই আছে, একটা ছেঁড়া পাল ওটা থেকে পতপত করে উড়ছে।

“কিছুতে বাড়ি খেয়েছি নাকি আমরা?” এই অঞ্চলে পানির কোনো নিচে লুকানো পাহাড় বা প্রবাল প্রাচীর নেই। তবে ঝড়ের তোড়ে ওরা যে কোথায় এসেছে সে সম্পর্কে টমের কোনো ধারণাই নেই।

“পরীটা স্যার, আলফ চেঁচিয়ে জবাব দিলো। “কেটে ফেলার পর ডেক এ আছড়ে পড়েছে।”

টম জাহাজের পিছন দিকে সরে আসতেই দেখে ফ্রান্সিস উপরে ওঠার হ্যাচটা দিয়ে উঠে আসছে। টলতে টলতে ও এগিয়ে এলো টমের দিকে। ওর হাত ফোস্কায় ভরে গিয়েছে।

“পানি বাড়ছে।” ঝড়ের ভিতরে কথাগুলো টমের কানে পৌঁছাতে ওকে ফুসফুসের সবটুকু বাতাস খরচ করতে হলো। “এতো বেশি উঠছে যে আমরা সেঁচে সারতে পারছি না।”

“চেষ্টা করে যাও। তুমিই আমার শেষ ভরসা।”

*

রাতটা মনে হচ্ছিলো শেষই হবে না। ঝড়ের বেগ এক ফোঁটাও কমলো না। কখন যে ভোর হয়ে সকাল হয়েছে কেউ টেরই পায়নি। যখন বৃষ্টি চোখে পডলো তখন টম ব্যাপারটা ধরতে পারলো। ও নিজের লবণে ভরা চোখটা ডলে জাহাজের দিকে নজর দিলো। শুধু পরীটা না, জাহাজের সামনের আর মূল মাস্তুলটাও ভেঙ্গে পড়েছে, ওগুলোয় বাঁধা দড়িগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। পালগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে ফিতার মতো ঝুলছে। বাকি মাস্তুলটাও পুরোপুরি ফাঁকা। তবে তাতেও জাহাজটার গতি খুব একটা কমেনি। সেই সাথে বাতাসের বেগও মনে হচ্ছে আরো বেড়েছে।

“আরো খারাপ হতে পারতো অবস্থা,” নিজেকে সান্ত্বনা দিলো টম। জাহাজটা এখনো ভাসছে, আর ওর সব লোকজনই এখনো অক্ষত। ওদের কাছে এখনো যথেষ্ট ক্যানভাস কাপড় আর অতিরিক্ত মাস্তুল আছে যা দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করে মাদ্রাজ পর্যন্ত চলে যাওয়া যাবে। কুয়োর ভিতরের পানি বেড়েই চলেছে, তবে এখন দিন হওয়ায় খোলের গায়ের ছিদ্রগুলো মেরামত করা সম্ভব হবে। ফ্রান্সিস সারা রাত খোলের ভিতরেই ছিলো। নিজেও পালাক্রমে পানি সেঁচেছে আবার অক্লান্তভাবে অন্যদেরকেও উৎসাহ দিয়েছে। টমের বুক ভরে গিয়েছে ওকে দেখে।

আরো খানিকটা আলো বাড়লো। মাঝে মাঝে জাহাজটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে দুলে উঠছে, ঝাপসাভাবে হলেও তখন দিগন্তে শান্ত পানি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত কেটে যাচ্ছে ঝড়টা।

“ওটা কি?” হালী বলে উঠলো।

টম সেদিকে তাকালো। “কি?”

কিন্তু জাহাজটা তখন ঢেউয়ের মাথা থেকে নেমে যাওয়ায় কিছুই দেখা গেলো না। আবার জাহাজটা আর একটা ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসতেই টম দিগন্তে সাদাটে কিছু একটা দেখা গেলো।

“ডুবো পাহাড়,” চিৎকার দিয়ে উঠলো একজন নাবিক। “সামনেই ডুবো পাহাড়।”

টম একটা পাই গ্লাস নিয়ে চোখে লাগালো। “অসম্ভব। আমরা পাড় থেকে কমপক্ষে পঞ্চাশ মাইল দূরে থাকার কথা।”

আবারও কেস্ট্রেল ঢেউয়ের মাঝে নেমে যেতেই সামনের দৃশ্যটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। এক মুহূর্ত পরেই আর একটা ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসলো জাহাজটা। আর এবার স্পষ্ট দেখা গেলো সবকিছু।

“ডাঙা।” ডাঙাটা এতোক্ষণ অদৃশ্য হয়ে ছিলো। কালো আকাশের কারণে আবছায়ায় কারো চোখে পড়েনি। কিন্তু ডুবো পাহাড়ের সারি স্পষ্ট বোঝ যাচ্ছে। দিগন্তে একসারি ধারালো দাঁতের মতো কিড়মিড় করছে ওগুলো।

হতে পারে ওটা আসলে একটা অজানা প্রবাল প্রাচীর বা কোনো উপকূলের শেষ মাথা, যেটা ওখানে থাকার কথা না। এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই টমের। আর এই মুহূর্তে এটা নিয়ে ভাবারও বিন্দুমাত্র সময় নেই।

কেবিনের দরজা খুলে সারাহ এসে হাজির হলো। হাতে বিস্কুট আর একটা লবণ মাখানো মাংসের টুকরো। জাহাজের দুলুনির সাথে তাল রেখে এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো ও।

“সারা রাত কিছু খাওনি। কিছু খেতে হবে এখন।” তারপর টমের মুখের ভঙ্গি দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”

“সামনেই ডাঙা,” টম বললো। “কিভাবে এখানে আসলো জানিনা। স্রোতের ধাক্কায় মনে হয় ধারণার চাইতেও দূরে চলে এসেছি।” তারপর টের পেলো কথা বলে ওর মহামূল্যবান সময়ের অপচয় করছে। “যেটাই হোক, এখন সামনেই ডাঙা, আর দ্রুত কিছু করতে না পারলে সোজা ওটায় গিয়ে ধাক্কা খাবো।”

সারাহ টমের চেহারা দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলো। এতো বছর একসাথে সমুদ্রে কাটিয়ে এতো এতো ভয়াল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরেও ও খুব কমই টমকে এতোটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখেছে।

টম ডেক-এর মাঝখানে দৌড়ে গেলো। “জাহাজকে ঘুরিয়ে ফেলতে হবে।”

আলফ উইলসন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “এই আবহাওয়ায়? জাহাজের সবগুলো মাস্তুল ভেঙ্গে যাবে তো-আরো খারাপ কিছু হতে পারে।”

“সেটা না করলে সোজা ডাঙ্গায় গিয়ে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবো।”

সেটা সবাই বুঝতে পেরেছে। দড়াদড়ির যেটুকু অবশিষ্ট ছিলো তাই নিয়েই দৌড়ে গেলো নাবিকেরা। একটা পাল খাটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বাতাসের কারণে কাজটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। ক্যানভাসটা বার বার ফুলে উঠে হাত থেকে ছুটে যেতে লাগলো। শত চেষ্টা করেও ধরে রাখা গেলো না। মূল মাস্তুলের অবশিষ্টাংশ ভেঙে সাগরে গিয়ে পড়লো।

“এরপরে দেখা যাবে নাবিকদের কেউ পানিতে গিয়ে পড়েছে,” আলফ বললো।

“যদি পাল খাটানোনা যায় তাহলে আমরা সবাই ডুবে মরবো।”

পাল ছাড়া এই বাতাসের বিরুদ্ধে লড়ে ওরা কিছুতেই ডাঙা থেকে দূরে যেতে পারবে না। এমনকি পাল খাটানোর পরেও পুরো নিশ্চয়তা নেই। এই ফুঁসে ওঠা প্রমত্তা সাগর আর প্রবল বাতাসের বিরুদ্ধে গিয়ে জাহাজটা উল্টো দিকে চালাতে হবে ওদের। আর হাতে আছে খুবই কম সময়।

“উপকূল কাছিয়ে আসছে,” আলফ বললো। ঝড়ের কারণে কিছুই। ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, তাই টম বুঝতে পারছে না যে ওরা আসলে ঠিক কতোদূরে আছে। এখান থেকে স্পষ্ট সৈকতের সাদা বালু আর বাতাসের তোড়ে সারসের গলার মতো বেকে যাওয়া পাম গাছগুলো দেখা যাচ্ছে।

ঈশ্বর, মাঝে যেনো কোনো পাথর বা প্রবাল না থাকে, মনে মনে প্রার্থনা করলো টম। ও ঢেউয়ের দিকে তাকালো, ওদিক থেকে আবার বিপদ আরো বাড়ে কিনা নজর রাখছে।

একজন নাবিক ধপ করে ডেক এর উপর পড়ে গেলো। টম ভাবলো লোকটার হাত-পা কিছু ভেঙ্গে টেঙ্গে গেলো কিনা। তবে লোকটা পিঠ ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়ালো। পড়ার পর ডেক-এ পিছলে যাওয়ার কারণে জ্বলছে সেখানে।

“পাল খাটানো হয়েছে স্যার।”

টম উপরে তাকিয়ে দেখে অবশেষে ক্যানভাসের টুকরোটা বশ মেনেছে। যদিও বাকা হয়ে ঝুলছে ওটা। ঠিকমতো বাঁধতে না পারায় ফাঁকা জায়গা দিয়ে বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে এতেও চলবে।

“ঘুরিয়ে ফেলো জাহাজ।”

“সোজা দিকে জায়গা নেই অতো,” আলফ মনে করিয়ে দিলো।

“ক্লাব হলিং করে ঘোরাবো জাহাজকে,” টম ঠিক করলো। ক্লাব হলিং হচ্ছে শেষ ভরসা। এই কৌশলে জাহাজের সামনের দিকটাকে জবরদস্তির মাধ্যমে বাতাসের বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এখন ওদের আর কোনো উপায় নেই। নাবিকেরা নোঙ্গরের গায়ে এক কাছি দড়ি বেঁধে জাহাজের সামনের দিকে বেঁধে দিলো।

“আপনি কি নিশ্চিত?” মেট বললো। “নোঙ্গরটা গেলে কিন্তু আমরা পুরোপুরি সাগরের দয়ায় পড়ে যাবো।”

“আমাদেরকে ডাঙা থেকে দূরে সরে যেতে হবে,” টম চেঁচিয়ে জবাব দিলো। “নোঙ্গর ছুঁড়ে মারো।”

নোঙ্গর পানিতে গিয়ে পড়লো। একই সাথে সর্বশক্তি দিয়ে হাল টেনে ধরা হলো। খুবই আস্তে, একটু একটু করে ঘুরে যেতে লাগলো জাহাজের মুখ। ঢেউয়ের সাথে সমান্তরালে চলে আসায় জাহাজ কাত হয়ে গেলো একদিকে। প্রচণ্ড জোরে কাঁপছে।

“দড়ি কেটে দাও।” কুড়াল হাতের লোকগুলো নোঙ্গরের সামনের দিকের দড়ি কেটে দিলো। জাহাজটা ঝাঁকি দিয়ে ভারমুক্ত হলো। এবার জাহাজের পিছনের দিকের দড়িতে টান পড়লো। আর জাহাজটা ঘুরতে লাগলো।

তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না ব্যাপারটা। ঢেউ আর বাতাস একসাথে দুটো প্রতিপক্ষের কারণে, জাহাজটা পর্যাপ্ত গতি পাচ্ছিলো না। আবার ওটা বাতাসের দিকে ঘুরে যেতে লাগলো।

আরো দুজন লোক হালীর সাথে যোগ দিলো। সবাই মিলে টেনে ধরলো। হাল। জাহাজের নাকটা সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আচমকা ওরা সবাই হুড়মুড় করে ডেক-এর উপড় আছড়ে পড়লো। আর হালের চাকাটা বনবন করে ঘুরতেই লাগলো। ওটার সাথে আর কোনো কিছুর সংযোগ নেই।

“হালটা গেলো,” চেঁচিয়ে উঠলো হালী।

“সাথে পাল-ও,” বললো আলফ। পালটা একেবারে মাঝ বরাবর ফেসে গিয়েছে। জামার সামনের দিকের মতো লাগছে এখন ওটাকে।

কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কেস্ট্রেল আবার পিছনে সরে গেলো। ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগলো ওটার খোলের উপর। আস্তে আস্তে আবার সমুদ্রের সমান্তরালে চলে আসছে ওটা। টম জাহাজের বামপাশে তাকাতেই দেখলো বিশাল একটা ঢেউ ওদের মাথার উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে।

“সাবধান!”

ঢেউটা একদম সোজা কেস্ট্রেল-এর পাশে এসে আঘাত করলো। জাহাজটা উল্টে যেতে যেতে গেলো না। দুনিয়াটাই উল্টে গেলো যেনো। জাহাজের পাটাতন একেবার সমুদ্রতলের সাথে লম্ব হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। মাস্তুলগুলো এতোটাই ঝুঁকে গিয়েছিলো যে ঢেউ স্পর্শ করলো ওগুলো। যারা কিছু আঁকড়ে ধরার সময় পায়নি, তারা অকস্মাৎ খেয়াল করলো পায়ের নিচে কিছু নেই। সোজা সমুদ্রে গিয়ে পড়লো তারা। কয়েকজন দড়িদড়া আকড়ে ধরেছিলো; বাকিরা ভেসে গেলো। টম দেখলো একটা লোকের মাথা সোজা নোঙ্গরের কপিকলের একটা কাঠে গিয়ে বাড়ি খেলো। সাথে সাথে ডুবে গেলো লোকটা, আর ভাসলো না।

ডানদিকের একটা কামানের বাধন আলগা হয়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে উল্টো দিকের কিনারাটা গুঁড়িয়ে পানিতে ডুবে গেলো। বাকি কামানগুলোও টান টান হয়ে থাকলো।

“মাস্তুলগুলো গোড়া থেকে কেটে ফেলো,” চিৎকার করে ডাকলো টম। একটু পরেই জাহাজটা আবার সোজা হবে, আর তখন মাস্তুলগুলো এটাকে একটা পেন্ডুলামের মতো উল্টোদিকে বাঁকিয়ে ফেলবে। আর এভাবে হতে থাকলে জাহাজটা দুলতে দুলতে উল্টেই যাবে।

কয়েকজনের হাতে তখনও কুড়াল ধরা ছিলো। ফেনায় ভরা ডেক-এ পিছলে পড়তে পড়তে ওরা দৌড়ে গেলো বড় মাস্তুলটার দিকে। বেশি কষ্ট করতে হলো না। সামান্য কেটে দিতেই অভিকর্ষ আর সাগরই বাকি কাজটা সারলো। দড়াদড়ি আর ক্যানভাস সহ ওটা ঝপাস করে গিয়ে পড়লো সাগরে। লোকজন লাফ দিয়ে ওটার রাস্তা থেকে সরে গেলো।

আবার সোজা হতে শুরু করলো কেস্ট্রেল। ডেক পুরো নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে উল্টোদিকে বেঁকে যেতে লাগলো। আরো, আরো… এতো বেশি যে পাশ দিয়ে পানি উঠে এলো।

ভাঙা মাস্তুলটাই বাঁচিয়ে দিলো ওদেরকে। পানিতে ঝুলে থাকায় ওটার ভর জাহাজটাকে সোজা রেখে উল্টে যাওয়া থেকে বিরত রাখলো। অল্পের জন্যে রক্ষা পেলো ওরা।

সব শেষ, টম ভাবলো। জাহাজের ডানপাশ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে; সেদিক দিয়ে কলকল করে পানি ঢুকছে। কিছুক্ষণের মাঝেই জাহাজ ডুবে যাবে। সব দেখে কাউকে যে কিছু করতে আদেশ দেবে সেই মনোবল ওর থাকলো না।

ফ্রান্সিস ওর হাত ধরে ফেললো। টম ওকে ডেক-এ উঠে আসতে দেখেনি। “জাহাজের খোল পানিতে ভরে গিয়েছে; পাম্পগুলোও আর কাজ করছে না।”

কথাগুলো টমের শেষ আশাটাকেও মরীচিৎকার মতো মিলিয়ে দিলো। “জাহাজ ছেড়ে নেমে যাও,” আদেশ দিলো ও। “নৌকা নামাও।”

নৌকা নামানোর কথা কারো মাথায় ছিলো না। নৌকায় নামার সিঁড়িগুলো ভেসে গিয়েছে। টম নৌকার দড়িগুলো কেটে দিতেই ওগুলো বাঁকা হয়ে থাকা ডেক থেকে পিছলে পানিতে গিয়ে পড়লো। ঢেউ ওটাকে ভাসিয়ে নেওয়ার আগেই লোকজন যতো দ্রুত সম্ভব হুড়োহুড়ি করে নৌকায় চড়ে বসলো।

সারাহ কেবিন থেকে উপরে উঠে এলো। ওর হাতে কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে। ঝড়ের অমানিশার মাঝেও উজ্জ্বলতা কমছে না জিনিসটার। ওটা হচ্ছে। সেই নেপচুন তরবারি, গিলটি করা খাপে ভরা। টম যে কতোটা খুশি হলো বলতে পারবে না। সারাহ জানে এই ভাঙা জাহাজ থেকে একটা জিনিস যদি টম বাঁচাতে চায় তাহলে সেটা হচ্ছে এই তরবারিটা।

“নৌকায় ওঠো।” বলে টম পিছল ডেকটায় সারাহের হাত ধরে নিয়ে চললো যাতে ও পড়ে না যায়। আর একটা ঢেউ এসে নৌকাটাকে সরিয়ে নিয়ে গেলো। সারাহ লাফ দিলো। নৌকায় পড়া মাত্র ওর ধাক্কায় নৌকাটা উল্টেই গিয়েছিলো প্রায়। তবে ও তরবারিটা ছাড়লো না।

“এবার তুমি,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। ওকেও ও এই ধ্বংসস্তূপের ভিতরে হাত ধরে নিয়ে চললো।

“লাফ দাও।”

ফ্রান্সিস না দিয়ে বললো। “অ্যানা কোথায়?”

টম চারপাশ তাকালো। ডেক ফাঁকা।

“ও সম্ভবত নৌকায় উঠে পড়েছে।” দেরি করার সময় নেই। টম ফ্রান্সিসকে ধাক্কা দিয়ে নৌকায় ফেলে দিয়ে নিজেও লাফ দিলো। একেবারে ফ্রান্সিসের উপর এসে পড়লো ও। দুজনে জড়াজড়ি করে গড়িয়ে গেলো আর নৌকাটাও দুলে উঠলো প্রচণ্ডভাবে।

ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। “অ্যানা কোথায়?” আবার বললো ও।

টম আশেপাশের মুখগুলো জরিপ করলো। অ্যানা নৌকায় নেই।

“ও তো আমার সাথেই কেবিনের দিকে গিয়েছিলো,” সারাহ বললো।

ফ্রান্সিসের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। “আর উপরে আসেনি?”

“আমাকে বলেছিলো তোমাকে খুঁজতে যাবে।”

জাহাজটা কেঁপে উঠলো। একটা আহত জন্তুর মতো গোঙ্গাচ্ছে ওটা। কাটা মাস্তুলটা বিচ্ছিন্ন হয়ে সাগরে পড়ে গেলো। এতো কাছে যে আর একটু হলে নৌকার উপরেই পড়তো। টম ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রেখে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, “এখন আর কিছুই করার নেই।”

“না”

আচমকা একটা ঢেউ এসে নৌকাটাকে এতো উপরে তুলে দিলো যে ওটা জাহাজের খোলের গায়ে বাড়ি খাওয়ার উপক্রম হলো। টম কিছু করার আগেই লাফ দিলো ফ্রান্সিস। চিৎকার দিয়ে উঠে আতংকিত চোখে টম দেখলো যে ফ্রান্সিস উন্মত্ত সাগর পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে জাহাজের দিকে। ওর বাড়িয়ে রাখা দুই হাত পাখির ডানার মতো বাতাসে ঝাঁপটাচ্ছে। একটা ঢেউ এসে জাহাজের উপর আছড়ে পড়তেই ও ডুবে গেলো পানির নিচে। টমও ঝাঁপ দিতে গেলে কিন্তু ঐ ঢেউটাই নৌকাটাকে এক ধাক্কায় জাহাজ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিলো।

তবে ফ্রান্সিস তখনও টিকে আছে। ফেনা সরে যেতেই টম দেখলো ফ্রান্সিস জাহাজের একটা রশি আঁকড়ে ভেসে আছে, আর জাহাজ থেকে বেরিয়ে আসা পানির বিপরীতে নিজেকে টেনে সামনে আগানোর চেষ্টা করছে।

“আমাদেরকে ওকে উদ্ধার করতে হবে,” আলফের উদ্দেশ্যে চেঁচালো টম।

কিন্তু বলামাত্র আরো একটা ঢেউ এসে নৌকাটাকে আরো দূরে নিয়ে গেলো। অর্ধেক দাঁড় পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। আর বাকি অর্ধেক ভাঙা। যদি এখন ওরা সাগরের সাথে লড়াই করতে যায় তাহলে নৌকা উল্টে সবাই ডুবে যাবে।

ফ্রান্সিসের এখন নিজেকেই যা করার করতে হবে।

৪. ফ্রান্সিস কেস্ট্রেল

ফ্রান্সিস কেস্ট্রেল-এর ভাঙা দিকটা দিয়ে নিজেকে টেনে তুললো। তারপর কাত হয়ে থাকা ডেক ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। মনে মনে প্রার্থনা করছে যেনো কোনো কামান দড়ি ছিঁড়ে ছুটে না আসে। হ্যাচের কাছে পৌঁছে মাথা গলিয়ে দিলো ভিতরে। নিচে নামার সিঁড়িটা ভেঙ্গে গিয়েছে। খোলের ভিতর আস্তে আস্তে পানিতে ভরে যাচ্ছে। ওর বুকটা ধড়াস করে উঠলো। কেউ কি এর মধ্যে বেঁচে আছে? ওর মনে হচ্ছে না।

শুধু কালো রঙের পানি দেখা যাচ্ছে।

অ্যানা?” চিৎকার করে ডাকলো ও।

কোনো উত্তর এলো না।

খোলের আরো খানিকটা ভেঙ্গে পড়তেই জাহাজটা আরো একটু কাত হয়ে গেলো। ওর হাতে একদম সময় নেই। ও কিনারটা আঁকড়ে ধরে নিচের পানিতে নেমে এলো। নিচের দিকটা পানিতে পুরোপুরি ভরে গেলেও উপরের দিকে ঠিকই বাতাস আছে। ও জাহাজের এটা সেটা ধরে ধরে পানির উপর নাক উঁচিয়ে সামনে আগাতে লাগলো।

জাহাজটা উল্টে গেলেই এর ভিতর আটকে যাবো, ভাবলো ফ্রান্সিস। জোর করে নিজেকে আতংকিত হওয়া থেকে বিরত রাখলো ও ভারসাম্য রাখতে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই কি যেন একটা ঠেকলো

লাশ। ঠাণ্ডা আর ভেজা, তবে ও নিশ্চিত যে ওটা একটা মানুষের শরীর। এই অন্ধকারে ওর পক্ষে বলা সম্ভব না যে এটা অ্যানা কিনা। ও শরীরটাকে নিজের দিকে টেনে এনে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করলো মাথাটা। তারপর ঘাড়ে হাত রাখতেই মৃদু পালস টের পেলো।

জাহাজটা আবারও কাত হলো কিছুটা, পানিও ঢুকলো আরো। ফলে ফাঁকা জায়গা আর থাকলো না। পানিতে ডুবে যাওয়ার আগে ফ্রান্সিস আর মাত্র একবার শ্বাস নিতে পারলো।

হ্যাচের কাছে যাও, নিজেকে বললো ও। পানি ওকে ঠেলে ছাদের সাথে ঠেসে ধরছে। অজ্ঞান শরীরটা হাত দিয়ে চেপে ধরে ও ডুব দিলো। নোনা জলের ভিতরে চোখ খোলা রাখতে খবর হয়ে যাচ্ছে। আবার ভোলা না রেখেও উপায় নেই। হ্যাচের খোলা জায়গাটা দিয়ে সূর্যের কিরণ দেখেতে পাওয়া মাত্র মরিয়া হয়ে পানিতে পা চালালো ও। ভাঙা কাঠের টুকরো এসে আঘাত করলো ওকে। একটুর জন্যে ছাদে আটকানো একটা লোহার হুক চোখে বিধলো না। তবে শেষমেশ ঠিকই হ্যাচ-এর কাছে পৌঁছাতে পারলো। এবার সাগরই বরং সাহায্য করলো ওকে। ফুলে ওঠা পানিই ওকে হ্যাচ দিয়ে বের করে ভাঙা সিঁড়ির উপর দিয়ে ডেক-এ টেনে তুললো।

এতোক্ষণে ও দেখতে পেলো কাকে উদ্ধার করেছে। অ্যানাকেই-অবশ্য এখন এখান থেকে যেতে না পারলে এতো কষ্টের কোন মানেই থাকবে না। ওদের হাতে কয়েক সেকেন্ড সময় আছে মাত্র। জাহাজ ডুবে যাচ্ছে।

“জাহাজ ছেড়ে যেতে হবে,” ফ্রান্সিস চিৎকার করলো। চারপাশের পানি জাহাজের ভাঙা টুকরো টাকরা দিয়ে ভরে গিয়েছে। এর ভিতর দিয়ে সাঁতরাতে গেলে ওগুলোর আঘাতে ভর্তা হয়ে যেতে হবে। তবে মাস্তুলটা সবকিছুর উপর দিয়ে একটা সাঁকোর মতো শুয়ে আছে। ওটার অমসৃণ গা ওটাকে সরতে দিচ্ছে না।

ওর কোলে অ্যানা নড়ে উঠলো। চোখ খুলে তাকালো সাথেসাথেই।

“কি-?”

“সময় নেই।” ফ্রান্সিস ওর পিঠে চাপড় দিলো। একগাদা নোনা পানি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। “নড়তে পারবে তুমি?”

অ্যানা মাথা ঝাঁকালো। “মনে হয়।”

“তাহলে চলো, জাহাজ থেকে নামতে হবে।” ফ্রান্সিস অ্যানার হাত ধরে মাস্তুলটার কাছে নিয়ে গেলো। কাছে গিয়ে ওকে বলতে হলো না, একাই ওটা ধরে হামাগুড়ি দিয়ে পানির উপর দিয়ে আগাতে লাগলো। ফ্রান্সিসও আগালো পিছু পিছু।

এ যেনো এক বুনো ঘোড়ার পিঠে চড়া। এখনো পোষ মানেনি, গায়ে স্যাডলও পরানো নেই-এরকম কোনো ঘোড়া। মাস্তুলটা ক্রমাগত নড়ছে। মোচড়াচ্ছে, ঢেউয়ের আঘাতে দুলছে। ফ্রান্সিস চার হাত পা দিয়ে গুঁড়িটা আঁকড়ে ধরে ইঞ্চি ইঞ্চি করে আগাচ্ছে। মাঝে মাঝে উপরে উঠে আসছে, বাকি সময়টা গাছে ঝোলা বানরের মতো হাত পা দিয়ে ধরে ঝুলে থাকছে। ঠিক নিচেই গর্জন করছে ঢেউ।

সামনেই দেখতে পেলো জাহাজ থেকে আশেপাশে নজর রাখতে ক্রোজ নেস্ট নামের গোল গামলার মতো যে জায়গাটা ব্যবহার করা হয়, সেটা তখনও মাস্তুলের সাথে আটকে আছে। হামাগুড়ি দিয়ে ওটায় গিয়ে নামলো ফ্রান্সিস। অ্যানা আগেই নেমে একটা পাশ আঁকড়ে ধরে বসে আছে। ফ্রান্সিস-ও অ্যানার পাশে হেলান দিয়ে বসলো। অবশেষে একটা আশ্রয় মিললো, যদিও ঝড় থেকে এখানে ওদের নিরাপত্তা খুবই কম।

ওখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। জাহাজটা এখনো ঝড়ের ধাক্কায় ঘুরছে; যে কোনো সময় মাস্তুলটা গড়ান খেয়ে ওদেরকে শুঙ্কু পানির নিচে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওরা ধ্বংসাবশেষের অংশটুকু পেরিয়ে এসেছে, কিন্তু এখনো একটা ঢেউই ওদের কম্ম কাবার করে দিতে পারে। ফ্রান্সিস ঝড়ের মাঝেই চেষ্টা করলো নৌকাটাকে দেখার, আশা করছে টম আর বাকিরা নিরাপদেই আছে। কিন্তু ওদের কোন নিশানা পেলো না ও।

“সাঁতরাতে পারবে তুমি?” ফ্রান্সিস চিৎকার করে বললো অ্যানাকে।

অ্যানা মাথা নাড়লো। ফ্রান্সিস আর দেরি করলো না। অ্যানাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কয়েকশো গজ দূরেই ডাঙা দেখতে পাচ্ছে। তবে ও সোজা ওটার দিকে সাঁতরালো না। তার বদলে সমস্ত : শক্তি ব্যয় করলো শুধু ভেসে থাকার পিছনে। ও অ্যানার কোমরের নিচে হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে যাতে ওর মাথাটা পানির উপরে থাকে। অর্থাৎ স্রোতের কাছেই নিজেদের সঁপে দিয়েছে। স্রোতই ভাঙা জাহাজটা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে। একসময় ধ্বংসস্তূপের শেষ অংশটাও পেরিয়ে এলো ওরা। এরপরেই শুরু করলো সাঁতার।

এতো কষ্টের পর আসলে ফ্রান্সিস স্রোতের ধাক্কা আর অনুভবই করছিলো না। ওগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারও চেষ্টা করলো না। স্রোতের টানে পানির নিচে ডুবে গেলো একবার, তারপর আবার লাথি মেরে মেরে উপরে উঠে এলো। আচমকা ও পায়ের নিচে শক্ত কিছু একটা অনুভব করতে পারলো। যে ঢেউগুলো ওদের এই ক্ষতির জন্যে দায়ী, সেই ঢেউই অবশেষে কৃপা করলো : ওদেরকে তুলে নিয়ে সৈকতের বালিতে আছড়ে ফেললো।

শরীরের শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে অ্যানাকে টেনে পানি থেকে দূরে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেলো ফ্রান্সিস। যাতে স্রোতের টানে আবার ভেসে না যায়। সামনেই একসারি পাম গাছ দেখা গেলো। ওগুলোর নিচে গেলে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা যায়, কিন্তু ফ্রান্সিস ফাঁকা জায়গাতেই থাকবে ঠিক করলো। বাতাসের চোটে গাছগুলো উলুখাগড়ার মতো বেঁকে যাচ্ছে, গাছের পাতা আর ফল প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে একেক দিকে। গাছ থেকে পড়া নারিকেল কামানের গোলার মতোই মারাত্মক।

ফ্রান্সিসের সারা শরীর ব্যথা করছে। সাঁতার কেটে পা-গুলো এতোটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে যে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটাও আর নেই। ঝড়ো বাতাস এসে বিঁধছে ওর গায়ে। ইচ্ছে করছে বালি খুঁড়ে তার ভিতর শুয়ে থেকে ঝড় থামার অপেক্ষা করে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। টম এখনো সমুদ্রে, সাথে আছে সারাহ আর বাকি সব লোকজন।

ফ্রান্সিস অ্যানাকে শুইয়ে রেখে বাকিদের খুঁজতে বের হলো। অ্যানার জ্ঞান নেই প্রায়। কিছু জায়গা ফ্রান্সিস হামাগুড়ি দিলো, কোথাও দৌড়ে দৌড়ে সৈকত ধরে এগিয়ে চললো। উষ্ণ বৃষ্টির পানি পড়তে লাগলো ওর চেহারায়। বাতাসের ধাক্কায় বালি উড়ে এসে লাগতে লাগলো সারা গায়ে। কিন্তু তবুও থামার কথা চিন্তাও করলো না। টমের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সারা সৈকত খুঁজতে লাগলো। একসময় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতে লাগলো ওর। শেষে কাউকেই না পেয়ে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই সর্বনাশা দুর্যোগের ভিতরে ওই ছোট্ট নৌকাটা টেকার সম্ভাবনা খুবই কম।

আর একটু এগিয়ে, সৈকতের পাশেই ফ্রান্সিস দেখলো বালির উপর একগাদা কাঠ পড়ে আছে। দৌড়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো ও। ওটা একটা ডিঙ্গি নৌকা, দুমড়ে মুচড়ে উল্টে পড়ে আছে। তবে এখনো আস্তই আছে। ওটার পাশের কালো অবয়বগুলো আসলে মানুষ। নৌকা থেকে যে যেখানে পড়েছে সেখানেই শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস দৌড়ে সবার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলো। এক সময় সারাহকে খুঁজে পেলো, সবার শেষে পেলো টমকে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আপনাদেরকে খুঁজে পেয়েছি।”

“আর অ্যানা?” সমুদ্রের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে বললো টম।

ফ্রান্সিস যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে দেখালো। “ও নিরাপদেই আছে।”

“আমরা এখন কোথায়?” খড়খড়ে কণ্ঠে বলে উঠলো সারাহ। লবণাক্ত পানি ঢুকে ওর গলা ছুলে গিয়েছে। পাশের বালিতে হাত ডুবিয়ে দিলো ও। টম নেপচুন তরবারির ঝিলিক দেখতে পেলো। এতো কিছুর পরেও সারাহ কিভাবে যেনো ঠিকই ওটাকে ধরে রেখেছে।

টম কাঁধ ঝাঁকালো। “বেচে আছি-এখন এটাই একমাত্র ব্যাপার।” জোর করে ও জাহাজডুবির ফলে যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে সেসব ভাবা থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। সেসব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে।

সারাহ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ধপ করে চার হাত-পায়ে বসে পড়ে বালির উপর বমি করে দিলো।

“এখানেই অপেক্ষা করো,” বললো টম।

টম আর ফ্রান্সিস অ্যানাকে আনতে গেলো। ওখানে পৌঁছে দেখে অ্যানার জ্ঞান ফিরেছে পুরোপুরি। কিন্তু নিজেই হেঁটে যাবে বলে জোর করে উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে আবার ফ্রান্সিসের গায়ে ঢলে পড়লো।

“আমি ভেবেছিলাম আমি মরেই গিয়েছি।”

“আমি সেটা হতে দিতাম না।”

টম বুঝলো ঝড়টা ফ্রান্সিসকে বদলে দিয়েছে। ওর মনের জোর এখন অন্য এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। ফ্রান্সিস অ্যানাকে আবার উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো, আর টম অ্যানার চোখের দৃষ্টি খেয়াল করলো। সেই দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতার চাইতেও আরো বেশি কিছু আছে। এখন আর অ্যানা ফ্রান্সিসকে একটা বাচ্চা ছেলে মনে করছে না, বরং পুরুষ হিসেবে দেখছে। হঠাৎ টমের নিজেকে কাবাবমে হাড্ডি মনে হতে লাগলো।

“আমাদের এখন যাওয়া উচিত।”

বেলা বাড়তেই পড়ে গেলো বাতাস, বৃষ্টির জোরও কমে গুঁড়ি গুঁড়ি পড়তে লাগলো। কিন্তু স্রোতের চেহারা পাল্টালো না; সৈকতে তাণ্ডব চালাতেই লাগলো। প্রতিবার আছড়ে পড়ার সময় শব্দ শুনে মনে হতে লাগলো যেনো বজ্রপাত হচ্ছে। নৌকাটা গায়েব হয়ে গিয়েছে। স্রোতে টেনে নিয়ে আছাড় মেরে গুড়ো গুড়ো করে ফেলেছে হয়তো। টমের প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগতে লাগলো, কিন্তু তবুও ও পুরো সৈকত চষে ফেলে কেস্ট্রেল-এর যে কয়জন তীরে আসতে পেরেছিলো তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করলো। আলফ উইলসনকে এদের মধ্যে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ও। তারপর সবাইকে নিয়ে যতোদূর সম্ভব সৈকতের উপরে উঠে গিয়ে, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে বসে রইলো।

সাগরে তখনও কেস্ট্রেল-এর খোলটা দেখা যাচ্ছে। স্রোত ভেঙ্গে পড়ছে। ওটার উপর। মাঝে মাঝে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, আবার ভাসছে। একবার সেদিকে তাকিয়েই টম বুঝলো যে ওটার পক্ষে আর কোনোদিন সমুদ্রে নামা সম্ভব হবে না। ওটার পিছন দিক ভেঙ্গে গিয়েছে, ফলে খোলটা একেবার হা হয়ে খুলে আছে। মুল মাস্তুলের শুধু গোড়াটুকু আছে। বাকি দুটো ভেসে গিয়েছে কোথায় কে জানে? জাহাজের অর্ধেক তক্তা ভেসে ভেসে সৈকতে চলে এসেছে। ওটার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা জিনিসপত্রের উপর সামুদ্রিক পাখি এসে বসছে। যেনো কোনো শকুন একটা লাশকে ঠুকরে খাওয়ার অপেক্ষায় আছে।

দৃশ্যটা সহ্য হলো না টমের। তারপরেই মনে পড়লো মারা যাওয়া লোকগুলোর কথা, লজ্জিত বোধ করতে লাগলো ও। লোকগুলোর জীবনের বিনিময়ে এই জাহাজ, মালপত্র সব আরো দুইবার হলেও দিয়ে দিতে রাজি টম।

“আমরা এখন কি করবো?” ফ্রান্সিস বললো।

“উপায় একটা বের হবেই,” সারাহ বললো। চেহারায় রঙ ফিরেছে ওর। নড়েচড়ে বেড়াতে পারছে এখন। তাই নাবিকদের ক্ষতের পরিচর্যা করছে যতোটা সম্ভব। যার যার গায়ের কাপড় ছিঁড়েই তাদের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে। ভেসে আসা কাঠ দিয়ে চটা বানাচ্ছে।

“বসে বসে নাকি কান্না কাঁদলে কখনো কিছু ঠিক হয়ে যায় না,” বলতে বলতে টম উঠে দাঁড়ালা। তারপর সৈকত ধরে আরো খানিকটা উঠে এসে পাম গাছের গায়ের কাটা দাগগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো ও। দা দিয়ে নারিকেল কাটার দাগ ওগুলো।

“কেউ এই গাছগুলো লাগিয়েছে। কাছেই কোনো গ্রাম আছে নিশ্চয়ই।”

কিছুদূর আরো আগাতেই ওরা একটা ছোট্ট খাড়ি দেখতে পেলো যেটা ভিতরের দিকে চলে গিয়েছে। ওটার পাড় দিয়ে একটা পায়ে চলা পথে দেখা গলো। কাদার ভিতরে অনেকগুলো পায়ের ছাপ সেখানে।

“আমি আর ফ্রান্সিস গিয়ে দেখে আসছি,” নেপচুন তরবারিটা কোমরে বেঁধে বললো টম। “সারাহ আর অ্যানা, আলফ আর বাকিদের সাথে থাকো।”

“না,” জোর গলায় বললো সারাহ। “আজ একটুর জন্যে আমরা বেঁচে গিয়েছি। আমি আর তোমার কাছ ছাড়া হবো না।”

টম জানে যে তর্ক করে লাভ নেই। আলফকে বাকিদের দায়িত্বে রেখে ওরা চারজন রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চললো। একটা নারিকেল আর কাঁঠাল গাছের বনের ভিতর দিয়ে গিয়েছে রাস্তাটা। লাল মাটির উপর উজ্জ্বল সবুজ। বৃষ্টির কারণে বনের ভিতর থেকে অদ্ভুত সব ঘ্রাণ বেরুচ্ছে। বাতাস তাই সোদা মাটি আর কচি কান্ডের ঘ্রাণে ভারি হয়ে আছে।

কিছুদূর আগানোর পরেই ফ্রান্সিস চিৎকার দিয়ে উঠলো। সেদিকে তাকিয়ে সামনেই একটা কাঁটা ঝোঁপের বেড়া দেওয়া বাড়ি দেখতে পেলো বাকিরা। বাড়িটা ছোট, মাটির তৈরি। সামনে এক চিলতে উঠোন। ওটার পরেই খাড়ির ধারে আরো অনেকগুলো বাড়ি দেখা গেলো। প্রতিটা বাড়িই নির্দিষ্ট দুরত্বে বানানো। সব মিলে গ্রামটা আধা মাইলটাক চওড়া। খাড়িতে একজন মহিলা কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে কাপড় ধুচ্ছে। মহিলা বেশ কৃশকায়, আর কোমরে বাঁধা ছোট্ট একটা পাতলা কাপড় বাদে গায়ে আর কোন কাপড় নেই। এই শুলির মতো জোরালো বৃষ্টিতেও কোনো বিকার নেই তার।

“এদের কি কোনো লজ্জা শরম নেই নাকি?” ফ্রান্সিস অবাক হলো।

“আমরা লন্ডনের সমাজ থেকে এখন বহু দূরে,” টম মনে করিয়ে দিলো।

“এদের ধর্মে নগ্নতায় লজ্জার কিছু নেই,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “আর এই আবহাওয়ায় কাপড় আসলে খুব একটা গায়ে রাখাও যায় না।”

মহিলা ওদের গোলার আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। তারপর চিৎকার দিয়ে হাতের কাপড়চোপড় এক করে ডাঙ্গার দিকে দিলো দৌড়।

“দাঁড়ান,” টম ডাকলো। মহিলা কাছের একটা কুঁড়েতে ঢুকে গেলো, চেঁচানো থামছেই না। টম কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুঁড়ের ভিতর থেকে এক লোক শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। এর পরনেও মহিলাটার মতোই পোশাক। হট্টগোল শুনতে পেয়ে অন্য কুঁড়েগুলো থেকেও লোকজন বেরিয়ে এলো। একটু পরেই সারা গ্রাম এসে জড়ো হলো ওদের পাশে। বিচিত্র ভাষায় ওদেরকে দেখিয়ে কি সব বলতে লাগলো।

চুল-দাড়ি সাদা হয়ে যাওয়া এক কুজো বুড়ো এগিয়ে এলো সামনে। সম্ভবত ইনি-ই হচ্ছেন গ্রামের মাতবর। অ্যানা প্রথমে পর্তুগিজ ভাষায় তার সাথে কথা বললো। তারপর ভারতীয় একটা ভাষায়। কিন্তু মাতবরের মুখের ভঙ্গি বদলালো না। টেনে টেনে কথা বলতে লাগলো সে।

“তুমি এদের কথা বুঝতে পারছো?” অ্যানাকে জিজ্ঞেস করলো টম।

“মালায়ালম ভাষার একটা কথ্য রূপে কথা বলছে এরা, অ্যানা জানালো। “অনেকটা তামিলের মতোই। তাই ইনি কি বলছেন বুঝতে পারছি।”

“বলো যে আমাদের খাবার লাগবে। আর কাছের বন্দরটা কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করো।”

অ্যানা কথা বলতে লাগলো। আলাপ শেষ হওয়ার পর মাতবর কিছু একটা আদেশ দিলেন। একটা তালপাতার সেপাই ছেলে বনের ভিতর দৌড়ে গেলো। কয়েকজন মহিলা গেলো খাবার আনতে। আর একজন মহিলা শুকিয়ে আসা কাদার মতো দেখতে কিছু একটা হাতে নিয়ে পাশের একটা কুঁড়েতে ঢুকে গেলো। প্রথমে সে জিনিসটা ফেটে যাওয়া মাটির মেঝেতে লেপে দিলো, তারপর সারা দেওয়ালে একই কাজ করতে লাগলো।

“কি করছেন উনি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“বাড়িটা পরিষ্কার করছে।”

“কাদা দিয়ে?”

অ্যানা মুখ টিপে হাসলো। “ওটা কাদা না, গোবর।”

“গোবর?” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস। খুবই অবাক হয়েছে। ময়লা জিনিস দিয়ে ওরা ঘর পরিষ্কার করে?”

“গরু এদের কাছে খুব পবিত্র,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “ওটার বর্জ্যও তাই ঘরকে শূচি করে।”

মহিলাটা বেরিয়ে এলে মাতবর ওদেরকে ভিতরে যেতে ইঙ্গিত করলো।

“উনি আমাদেরকে ভিতরে যেতে বলছেন।”

টম ঢুকে গেলো। দরজাটা অনেক নিচু। আর ভিতর কোনো জানালা-ও নেই। শুধু দেয়ালের ফাটা থেকে চুঁইয়ে কিছু আলো আসছে। বেশি ফাটা জায়গায় আবার গোবর দিয়ে পট্টি মারা। তবে মেঝেটা শুকনো, বৃষ্টি ঢুকছে না ভিতরে। মাঝখানে একটা পাথরের চক্রের ভিতরে ছোট্ট একটা আগুন জ্বলছে।

তবুও জায়গাটা মানুষের থাকার জায়গার বদলে জন্তু জানোয়ারের থাকার জায়গা বলে মনে হতে লাগলো। টমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, এই অজানা দেশে, অচেনা মানুষের মাঝে এরকম বদ্ধ ঘরে প্রবেশ করতে ওকে নিষেধ করতে লাগলো।

“আমার বাইরেই ভালো লাগছে।”

অ্যানা গ্রামবাসীকে সেটা বললো। হয় ওরা ব্যাপারটা বুঝলো না অথবা ব্যাপারটা ওদের কাছে আদবের বিশাল একটা বরখেলাফ। ওরা কোর্টনীদের চারপাশে জড়ো হয়ে জোর করে দরজার দিকে ঠেলে দিতে লাগলো। অনেকেই আবার টমের কোমরে বাধা নেপচুন তরবারিটা ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। ওটার কারিগরি নৈপুণ্য আর বাটে বানো নীলকান্তমণিটার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নানান কথা বলাবলি করছে সবাই।

মেঝেতেই বসলো ওরা সবাই, আর গ্রামবাসীরা দরজায় অপেক্ষা করতে লাগলো। বৃষ্টিতে ভিজছে, কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না। উলঙ্গ বাচ্চারা তাদের বাবা মায়ের পায়ের ফাঁক দিয়ে ওদেরকে দেখার জন্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মহিলারা ওদের জন্যে এক বাটি ভাত আর আঙ্গুরের বিশাল একটা পাতায় করে ডাল নিয়ে এলো। টম গোগ্রাসে গিলতে লাগলো সেসব। পেট পুরে খেয়েও খিদে মিটলো না ওর। কিন্তু সবার হাড্ডিসার শরীর দেখে বুঝতে পারলো, ওদের যা কিছু ছিলো তার সবই সম্ভবত মেহমানদারিতে শেষ করে ফেলেছে।

খাওয়া শেষ করে টম দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু লোকজন একটুও নড়লো না।

“ওরা বলছে আমাদেরকে নাকি এখানেই থাকতে হবে,” আনা জানালো।

“কেন?”

“আমি যতোদূর বুঝতে পারছি, ওরা সম্ভবত ওদের স্থানীয় সর্দারকে খবর দিতে গিয়েছে,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “উনি আসলে হয়তো আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন।”

টম নিজের জাগায় ফিরে গিয়ে হতাশ হয়ে মাটিতে বসে মেঝেতে আঙুল দিয়ে ড্রাম বাজাতে লাগলো। “আমরা কোথায় আছি সেটা কি বলেছে ওরা?”

“না। আমাদের জাহাজের নিশানা যা ছিলো তাতে আমরা কোনদিকে আসছিলাম সেটা বলতে পারেন না?”

টম কাঁধ ঝাঁকালো। ঝড়টা এতো জোরে আমাদেরকে টেনে এনেছে যে পঞ্চাশ মাইলের ভিতরে কোথায় কি আছে তা বুঝতে পারছি না। জায়গাটা সিলন হতে পারে…”

“এটা সিলন না,” অ্যানা বললো। “ওদের ভাষা আলাদা।”

“তার মানে ভারত। মালাবার উপকূল সম্ভবত।”

অ্যানা মাথা ঝাঁকালো। “সেটাই মনে হয়-তাহলে আমাদের জন্যে ভালোই হবে। উপকূল জুড়ে ব্রিটিশ আর পর্তুগিদের কুঠি আছে। আমরাও একটা খুঁজে বের করতে পারবো।”

“ওরা আমাদেরকে সাহায্য করবে?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো।’

“আমাদের জাহাজ গভীর পানিতে ডোবেনি,” সারাহ বললো। “ঝড় কমলে হয়তো ওটার মালপত্রগুলো উদ্ধার করা যাবে। দরকার হলে তা দিয়েই ওদের সাহায্য কিনে নেওয়া যাবে। মানে যদি ওরা আমাদেরকে এমনিতে সাহায্য করতে না চায় আরকি।”

“তবে আমার মনে হচ্ছে বেশিরভাগ মালই নষ্ট হয়ে যাবে,” টম বললো। “আইভরিগুলো হয়তো উদ্ধার করা যাবে। আর ডোরিয়ান আর আবোলির কাছে তো সেন্টারাস আছেই। ওদের সাথেও ভালো ব্যবসা করার মতো যথেষ্ট মালামাল আছে। আমরা যদি জায়গামতো না পৌঁছাই, ওরা কেপ টাউনে ফিরে যাবে। আর আমরা যদি ফিরে যাওয়ার মতো কোনো জাহাজ পেয়ে যাই, তাহলে এবারের মতো অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে যাবো আশা করি।”

ওরা অপেক্ষা করতেই লাগলো। মাথার উপর ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা নড়লো না।

“ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে,” ফ্রান্সিস মন্তব্য করলো।

“ওদের সর্দারের জন্যে,” অ্যানা বললো। ও বসেছে ফ্রান্সিসের পাশে। উষ্ণতার জন্যে ওর গায়ের সাথে গা লাগিয়ে আছে। “এই লোকগুলো এদের। সর্দারকে সাংঘাতিক ভয় পায়। অনুমতি ছাড়া এক পা-ও নড়বে না।”

“আশা করি এদের সর্দারের কাছে আমার মাপের এক সেট শুকনো কাপড় পাবো,” সারাহ বললো। এতোক্ষণ ধরে ভেজার পরে এই লবণ মাখা জামাটা পরে থাকতে থাকতে ওর গায়ে চুলকানি শুরু হয়েছে। কিন্তু ওগুলো পাল্টে পরার মতো কিছুই নেই সাথে।

“সাথে আমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে একটা জাহাজ,” বললো ফ্রান্সিস।

“সাথে একটা খাসীর ঠ্যাং,” ঘুম জড়ানো গলায় বললো টম। মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে ও। আগুনের তাপে উষ্ণ হতে শুরু করেছে। গত দুই দিন এক ফোঁটা ঘুমায়নি। ওর চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো।

ঘুমিয়ো না, নিজেকে বললো টম। এখনো নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাওনি।

ঘুম তাড়ানোর আশায় নিজের গালে চিমটি কাটলো ও। কিন্তু কিছুই অনুভব করতে পারলো না। আর ওর পক্ষে জেগে থাকা সম্ভব না। নিজের মনের এক অতল কালো গর্তের ভিতর ডুবে যেতে লাগলো ও।

*

টমের ঘুম ভাঙলো কারো হাতের ঝাঁকুনিতে। সারাহকে স্বপ্নে দেখছিলো ও। তাই প্রথমে মনে হলো সারাহই বুঝি ঝাঁকাচ্ছে ওকে।

ঝট করে চোখ খুললো টম। ওরা আর এখন কুঁড়ের ভিতর একা না। কয়েকজন গ্রামবাসী ভিতরে ঢুকে ওকে ধরে টানছে। টেনে তারা সোজা দাঁড় করিয়ে দিলো ওকে। সারাহ আর বাকিদের খোঁজে চারপাশে তাকালো ও, কিন্তু কাউকেই দেখা গেলো না। সহসা ও পুরো সজাগ হয়ে গেলো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর হাত ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দিলো। তারপর দরজার চৌকাঠ দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো বাইরে।

সারাহ, অ্যানা আর ফ্রান্সিসকে ঘিরে গ্রামবাসীরা বিশাল একটা চক্র করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সামনেই সাতজন অদ্ভুতদর্শন লোক ঘোড়ার পিঠে বসা। প্রত্যেকের চেহারাই কঠোর, মুখে কাটাকুটির দাগ; গায়ে বর্ম, আর মাথার পাগড়িটা ইস্পাতের শিরস্ত্রাণের উপরে পেচানো। প্রত্যেকেই ভারি অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত। কোমরে পিস্তল আর ছোট আকারের তরবারিও দেখা গেলো। চারজনের হাতে বর্শা, বাকি তিনজন তরবারি হাতে।

টম, সারাহ আর অ্যানার সামনে গিয়ে ওদেরকে আড়াল করে দাঁড়ালো। “কারা এরা?” জানতে চাইলো ও।

সর্দার মতো লোকটা ঘোড়ায় লাথি মেরে সামনে এগিয়ে ওদের চারপাশে চক্কর দিতে দিতে অগ্নিদৃষ্টিতে ওদেরকে দেখতে লাগলো। লোকটার মাথার পাগড়িতে একটা হলুদ রঙের পাখির পালক গোজা, আর ওর বুকের বর্মটার চারপাশ স্বর্ণ দিয়ে বাঁধানো। একটা সরু ক্ষতচিহ্ন তার কপাল বেয়ে চোখের মাঝ দিয়ে নাকে এসে থেমেছে। তাতে চেহারায় একটা আলাদা শয়তানি ভাব প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। যেনো ওর মাথাটা কেউ দুই ভাগ করে দিয়েছিলো, তারপর আবার কোনোমতে জোড়ে লাগিয়ে দিয়েছে।

লোকটা চিৎকার করে গ্রামের মাতবরকে কিছু একটা বললো। মাতবর আমতা আমতা জবাব দিল প্রশ্নের। কথা বলার সময় দুই হাত ক্ষমার ভঙ্গিতে জড়ো করে মাথা নিচু করে রেখেছে।

“এই ব্যাটার নাম হচ্ছে টুঙ্গার,” অ্যানা অনুবাদ করে শোনালো। “ও এখানকার স্থানীয় প্রশাসক, চিত্তাত্তিঙ্কারা-র রানির একজন সুবলদার।”

টুঙ্গার জুলজুলে চোখে নেপচুন তরবারিটার নীলার দিকে তাকিয়ে রইলো। টমও হাতলে হাত রেখে চেয়ে রইলো ওর দিকে।

“ওকে বল যে আমাদের জাহাজ ভেঙ্গে পড়েছে, আর আমরা শুধু একটু খাবার চাই আর নিরাপদে কাছাকাছি ইউরোপিয়ান কোনো উপনিবেশে যেতে চাই, আর কিছু না।”

অ্যানা বললো, কিন্তু বোঝা গেলো টুঙ্গারের ওর কথার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। এমনকি ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ও বেয়াদবের মতো রূঢ় ভাষায় অ্যানাকে থামিয়ে দিলো।

“কি বলে ও?” টম জিজ্ঞেস করলো।

“বলছে এদেশে যে-ই আসুক না কেন, তাকে নাকি রানিকে কিছু একটা উপঢৌকন দিতে হবে।”

“ওকে বল যে আমাদের সব কিছুই জাহাজডুবিতে ভেসে গিয়েছে।”

অ্যানা কথাটা বলতেই টুঙ্গার টমের দিকে টিটকারির ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর সামনে ঝুঁকে ঘোড়ার চাবুকটা দিয়ে ওর নেপচুন তরবারিটা দেখালো।

“না,” টম মাথা নাড়লো। “এটা কোনোদিনও না। এটা আমার পারিবারিক ঐতিহ্য। যাই হোক। আমাদের জাহাজে আইভরি ছিলো কিছু। সাগর শান্ত হলে আমরা ওগুলো উদ্ধার করে এনে রানিকে উপহার দেবো।”

টুঙ্গার লম্বা চাবুকটার প্যাঁচ খুলে, জ্যান্ত সাপের মতো সামনে ছুঁড়ে মারলো। ওটার আগা গিয়ে টমের কবজি পেঁচিয়ে ধরে, ওর হাতটাকে আঁকি দিয়ে তরবারির হাতল থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর পায়ের গুতোয় টুঙ্গার ওর ঘোড়াটাকে পিছিয়ে নিতে গলো যতক্ষণ না চাবুকটা টানটান হয়ে যায়। দুজন লোক ঘোড়া থেকে নেমে এসে তরবারিটা নিতে গেলো। টম ওদের দিকে লাথি ছুঁড়ে মোচড় দিয়ে সরে গেলো একদিকে। আরো দুজন লোক নেমে এসে টমকে ঘিরে ধরলো। ওদের বর্মগুলো টমের বুক বরাবর তাক করা। রেগেমেগে টম বাম হাত দিয়ে তরবারিটা খাপ থেকে বের করে এনে ওকে ঘিরে থাকা লোকগুলোকে ভয় দেখাতে লাগলো।

কিন্তু সারাহ চিৎকার করে উঠলো, “ওদেরকে দিয়ে দাও ওটা, টম! ঈশ্বরের দোহাই, এই তরবারির জন্যে মরতে হবে না তোমাকে। ওরা ছয়জন আর তুমি একা। কুচি কুচি করে কেটে ফেলবে ওরা তোমাকে।”

টমও জানে ব্যাপারটা। ও তরবারিটা নামিয়ে টুঙ্গারের দিকে ছুঁড়ে দিলো। তরবারিটার ডগার দিকটা মাটিতে গেঁথে ঠরঠর করে কাঁপতে লাগলো। কবজির একটা মাত্র মোচড়ে টুঙ্গার টমের হাত থেকে ওর চাবুকটা ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে বাড়ার জন্যে ঘোড়ার পেটে গুতো দিলো।

সামনে এগিয়ে ও ঘোড়ার পিঠ থেকেই ঝুঁকে তরবারিটার হাতল ধরে টান দিয়ে ছুটিয়ে নিলো। তারপর সেটাকে সোজা টমের চেহারা বরাবর তাক করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। টম অনড় দাঁড়িয়ে রইলো। সারাহ চিৎকার দিয়ে ওর দিকে দৌড় দিলো যাতে টমকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করতে পারে। কিন্তু অ্যানা আর ফ্রান্সিস ওকে টেনে ধরে রাখলো।

একেবারে শেষ মুহূর্তে টুঙ্গার তরবারিটা সরিয়ে নিয়ে হাতলের নীলাটা দিয়ে টমের কপালের মাঝখানে আঘাত করে ওকে ছাড়িয়ে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলো। টম কপালের জায়গাটা চেপে ধরে বসে পড়লো মাটিতে। ওখান থেকে রক্ত বেরিয়ে ওর মুখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে লাগলো।

টুঙ্গার ওর ঘোড়াকে আবার ফিরিয়ে এনে টমের সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখে শয়তানি হাসি, টমকে এভাবে ভড়কে দিতে পেরে নিজের উল্লাস লুকানোর কোনো চেষ্টাই করছে না।

“এই শুয়োরের বাচ্চাটা বলছে কি?” অঝোর ধারায় কাঁদছে সারাহ।

“ও বলছে ওর মালকিন, মহামহিম রানি, এই উপহার পেয়ে খুবই খুশি হবেন। আর উনি এমনকি আমাদেরকে কিছু খাবার ভিক্ষাও দিতে পারেন, তারপর যেখান থেকে এসেছি সেখানেই পাঠিয়ে দেবেন।”

টুঙ্গারের মজা নেওয়া শেষ। সে দাঁড়ানো লোকগুলোকে ধমক দিয়ে কিছু একটা বলতেই সবাই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে পড়লো। চলে যাওয়ার আগে ও অ্যানার দিকে চেয়ে কিছু একটা বললো, তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে ঝড়ের বেগে প্রস্থান করলো। একটু পরেই খাড়িটা ধরে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেলো সবাই।

সারাহ টমের পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো, “বেশি ব্যথা পেয়েছো?”

টম ওর কপাল থেকে রক্ত মুছলো। কাটাটা খুব বেশি গভীর না, তবে বিশাল একটা কালশিটে পড়ে যাবে। “এরচে খারাপ অবস্থা বহুবার হয়েছে।”

কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো ওর। “যাওয়ার সময় কি বলে গেলো শয়তানটা?”

“উপকূল ধরে কয়েক মাইল গেলে নাকি একটা টুপিওয়ালাদের থাকার জায়গা আছে। গ্রামের মাতবরকে বললে একজন লোক সাথে দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবে।”

“টুপিওয়ালা?” টম মাথা ঝাঁকিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো।

“ইউরোপিয়ানদের ওরা এই নামে ডাকে। এরা পাগড়ি পরে, আমরা পরি টুপি।”

“হুম, ঠিকই আছে,” টম বললো।

অ্যানা ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশে যাওয়ার জন্যে গ্রামের মাতবরের সাথে ওদের সাথে একজনকে দেওয়ার ব্যাপারে আলাপ করলো। টম লোকটাকে পুরস্কার হিসেবে ওর তরবারিটার বেল্টটা দেবে বলে কথা দিলো। ওটার আর কোনো দরকার নেই। কিন্তু লোকটা খুশি হয়ে গেলো ওটা পেয়ে।

গ্রাম ছাড়িয়ে আগে আলফ উইলসন আর কেস্ট্রেল-এর বেঁচে যাওয়া বাকি লোকদের খুঁজতে গেলো ওরা।

তারপর ওদের গাইড উপকূলের বন ধরে উত্তর দিকে যাওয়া শুরু করলো। রাস্তাটা সম্ভবত ব্যবহার হয় না অনেক দিন। কখনো বন ছাড়িয়ে খোলা সৈকত দিয়ে আগালো ওরা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নদী বা সাগরের জমে থাকা পানি হেঁটে পার হতে হলো।

দলের প্রত্যেকেই ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে, গায়ে একদমই শক্তি নেই। পথিমধ্যে কয়েকটা পচা আম পাওয়া গেলো, যারা পেড়েছিলো, তারাই সম্ভবত ফেলে গিয়েছে।

অবশেষে বড়সড় একটা নদীর কিনারে এসে পৌঁছালো ওরা। নদীটা সাগরে গিয়ে মিশেছে। নদীর অপর পাড়ে একটা পাথরের দুর্গ দেখা যাচ্ছে। ওটার চুড়ায় ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা উড়ছে লাল আর সাদা ডোরা কাটা আর এক কোনায় ইউনিয়ন জ্যাক (ব্রিটেনের পতাকা)।

দুর্গের সামনে ভারী ব্রেকার (ঢেউ ভেঙে দেওয়ার জন্যে বসানো বাধ) বসানো। ঢেউ আছড়ে পড়ে ফেনায়িত হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে চারদিকে। পানির সীমার উপরে, বালির ভিতর কয়কেটা চোখা মাথার নৌকা তুলে রাখা হয়েছে। দুর্গের পিছনে ছয়টা গোডাউন আর গোলাঘর, ওখানে কোম্পানির মালামাল রাখা হয়। পাম গাছের পাতা দিয়ে ছাওয়া কয়েকটা কুটির দেখা গেলো ওগুলোর পাশে।

“এই পতাকাটা দেখে যে কোনোদিন এতো খুশি হবো, তা স্বপ্নেও ভাবিনি,” টম স্বগোক্তি করলো।

ওদের গাইড শিষ বাজাতেই কয়েকজন স্থানীয় মাঝি নৌকা নিয়ে এগিয়ে এলো। ওদেরকে পার করে দিতে প্রস্তুত। নদীর অপর পাড়ে পৌঁছাতেই দেখলো দুর্গ থেকে কয়েকজনের একটা দল ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাল পোশাক পরা প্রায় ডজনখানেক সৈন্য দেখতে পেলো টম। নীল পোশাক পরা কর্মচারীরাও আছে সাথে। তিন চারজন মহিলাকেও দেখা গেলো তাদের ছোট ছোট ছাতার নিচ থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মনে হলো অবশেষে ওরা আবার সভ্য কোনো জায়গায় পৌঁছেছে। এবার ওদের কষ্টের অবসান হবে।

দর্শকদের ভেতর থেকে লাল রঙের আঁটসাঁট পোশাক পরা দশাসই এক লোক এগিয়ে এলো। এই ভ্যাপসা গরমের মাঝেও সে একটা পরচুলা পরে আছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে মুখের পাউডার ধুয়ে মুখ আর কাপড়ে সাদা রঙের সর্পিল রেখা একে দিয়েছে।

“আপনারা কারা? কি চান এখানে?” ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো সে।

“আমার আসল নাম বলো না,” ফিসফিসিয়ে বললো টম সবাইকে। “এখানে গাই-এর লোক থাকতে পারে। গাই যদি টের পায় যা আমরা ওদের সদর দরজায় এসে হাজির হয়েছি তাহলে কি দশা হবে মনে রেখো।”

“টম উইল্ড,” মোটা লোকটাকে বললো টম। “আমার ভাতিজা ফ্রান্সিস, আমার স্ত্রী সারাহ। আমাদের সফরসঙ্গী অ্যানা দুয়ার্তে।”

টম জানে ওদেরকে কতোটা উস্কুখুস্কু আর নোংরা দেখাচ্ছে। সে কারণেই সম্ভবত লোকটা ওদের দিকে চরম বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

“লরেন্স ফয়,” লোকটা জানালো। “আমি ব্রিঞ্জোয়ানের ব্রিটিশ কুঠির গভর্নর।”

“ঝড়ে আমাদের জাহাজ ডুবে গিয়েছে,” টম ব্যাখ্যা করলো।

“জাহাজ?” ফয় সন্দেহের দৃষ্টিতে টমকে দেখতে লাগলো। “কোন জাহাজ?”

“কেস্ট্রেল। কেপ টাউন থেকে গুড হোপ হয়ে মাদ্রাজে যাচ্ছিলাম আমরা।”

“এই নামের কোম্পানির কোনো জাহাজের কথা তো শুনিনি,” ফয় বললো। “ইন্টারলোপার নাতো আপনারা?”

টম প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেলো। “এই মুহূর্তে স্যার, আমরা কয়েকজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নাবিক বাদে আর কিছুই নই।”

ফয় নাক সিটকালো। “হায় ঈশ্বর, আপনার গা থেকে আসছে।”

“কাপড় বদলাতে পারলে আমরাও বেঁচে যাই,” টম বললো।

ফয় নিজের ঠোঁট চেপে ভাবলো কিছু একটা। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছে-যেনো বায়ু ত্যাগ করতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। টম মনে মনে হাসলো। ও জানে ফয় আপ্রাণ ভেবে বের করার চেষ্টা করছে যে, এই অনাহূত নোকগুলোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার ভদ্র কোনো উপায় আছে কি না।

“ঠিক আছে ভিতরে এসে আগে খুলে বলুন সব,” কর্কশ কণ্ঠে বললো ফয়।

ওদেরকে দুর্গের ভিতরে নিয়ে গেলো ফয়। এক নজর দেখেই টম বুঝলো এখানে নিয়ম শৃঙ্খলা ঠিকভাবে মানা হয় না। দরজায় কোনো পাহারাদার নেই, শুধু দুর্গের ছাদে একজনকে দেখা গেলো, সে-ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটা কার্ণিশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে গভর্নরের থাকার জায়গাটা কাঠ দিয়ে বানানো, উপরে তালপাতার ছাউনি। গরমের মৌসুমে এই জিনিস বন ফায়ারের মতো জ্বলবে।

“এখানকার লোকজনের সাথে নিশ্চয়ই খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আপনার?” টম জিজ্ঞেস করলো।

ফয় হাত নেড়ে একটা মাছি তাড়ালো। “ওরা মাঝে মাঝে একটু আধটু ঝামেলা করে, কিন্তু উপযুক্ত জবাব পেয়ে ওদের টনক নড়েছে।”

টমের ঐ ঘোড়সওয়ারটার কথা মনে পড়লো, যে ওর তরবারিটা কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সে সম্পর্কে কিছু বললো না। বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো মেঝে বালিতে ভরে আছে, বাতাসের বেগ তখনো কমেনি। একজন অর্ধ উলঙ্গ ছোট ভারতীয় বাচ্চা বসে বসে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছে। তাতে বাতাসের স্রোতের দিক বদল হচ্ছে শুধু, গরম এক বিন্দুও কমছে না।

ফয় ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো। এক বাটি খেজুর তার সামনের ডেস্কে রাখা। ও একসাথে তিনটা মুখে পুরে দিলো, কিন্তু অতিথিদেরকে নেওয়ার জন্যে বললো না। এমনকি বসতেও বললো না। ক্ষুধায় টমের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।

“আচ্ছা,” মুখভর্তি ফল নিয়ে বললো ফয়। “আপনাদের জাহাজডুবি হয়েছে বলছেন। কি ছিলো আপনাদের জাহাজে?”

প্রশ্নটা শুনে টম অবাক হয়ে গেলো। “সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, স্যার।”

“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।” সরু চোখে টমের দিকে তাকিয়ে বললো ফয়। টম টের পেলো এই ভালোমানুষি পোশাকটার নিচে আসলে ফয় একটা কুৎসিত আর কূট বুদ্ধির মানুষ।

“আইভরি, কাপড়, কিছু হাতে বোনা জিনিস।”

“ইউরোপিয়ান মালপত্র।”

“আমরা কেপ টাউন থেকে কিনেছি সব।”

“সেটা তো আপনাদের কথা। আপনাদের কাছে লগ বই আছে? বা কোনো ইশতেহার? রশিদ? মানে আপনাদের কথার প্রমাণের পক্ষে কিছু আছে?”

রাগ সামলাতে কষ্ট হলো টমের। “আমাদের সব কাগজপত্র জাহাজের সাথেই ডুবে গিয়েছে।”

“তাই নাকি?” বলে ফয় মুখ থেকে খেজুরের বিচি ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। “কোম্পানি ইন্টারলোপারদের কি করে জানেন তো? আমি চাইলে আপনাদেরকে গ্রেপ্তার করে ডাণ্ডা বেড়ি পরিয়ে আবার ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠাতে পারি। বোম্বেতে পাঠিয়ে গভর্নর কোর্টনীর হাতে তুলে দিতে পারি। বোম্বেতে কিন্তু ইংরেজ আইন সবসময় চলে না। ওখানে গভর্নরের আদেশই আইন।”

ফয় চুপ করে কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “তবে আমরা যদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারি তাহলে ভিন্ন কথা।”

শালা ঘুষ চায়! টম বুঝলো। কিছুটা শান্ত হলো ও। এধরনের পরিস্থিতিতে বহুবার পড়েছে ও, তাই ব্যাপারটা ভালোই বুঝতে পারছে।

“কিন্তু জাহাজডুবির পর আমরা এখন নিঃস্ব,” খুবই হতাশার একটা ভঙ্গি করলো টম।

ফয় ওর আঙুল তুললো। “খুবই দুঃখজনক।”

“যাইহোক,” টম বলে চললো। “আমাদের সাথে আইভরির একটা চালান ছিলো। যদি ঝড়ে আমাদের জাহাজের তলা ফেটে না যায় তাহলে ওটা জাহাজের ভিতরেই থাকবে। আর জাহাজ কম পানিতেই ডুবেছে। আমাদেরকে যদি একটা নৌকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে ওখান থেকে যা উদ্ধার হবে তার চার ভাগের এক ভাগ আপনাকে দিতে আমার আপত্তি নেই।”

“এটা আবার কি ধরনের প্রস্তাব?” ফয় এমনভাবে মুখ বিকৃত করলো যাতে টম বুঝতে পারে যে ও আসলে কতোটা আহত হয়েছে। “আমিতো চাইলে নিজেই সব উদ্ধার করে আমার বলে দাবি করতে পারি।”

“কিন্তু সেজন্যে আপনাকে লন্ডনের নৌ আদালতে যেতে হবে,” টম বললো। ডাওজার-এর ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ডের সাথে ওর কথোপকথন মনে পড়লো টমের। “লন্ডনে আমার প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধব আছে। একবার যদি ওখানে কেস ওঠে তাহলে আপনার সব বাণিজ্যের চালান খতিয়ে দেখা হতে পারে। তখন কিন্তু আপনার সারা বছরের সব মুনাফাই হারাবেন।”

ফয় গরগর শব্দ করে উঠলো, ঠিক যেনো একটা অসন্তুষ্ট কুকুর। “আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন স্যার?”

“আরে না, না! কি যে বলেন। আমি আপনাকে বোঝাতে চাচ্ছি যে আমরা চাইলেই এমন একটা সমঝোতায় আসতে পারি যেটায় দুজনেরই লাভ হয়।”

ফয় ভ্রু কুঁচকে ডেস্কে রাখা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আবার একটা খেজুর মুখে পুরে শব্দ করে চাবাতে লাগলো।

“অর্ধেক,” ফয় বললো।

“আচ্ছা,” টম রাজি হলো। “তবে আমাদের বাড়ি ফেরার উপায় হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার এখানেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”

“আপনারা সৈন্যদের ব্যারাকে থাকতে পারবেন, আর কোম্পানির ক্যান্টিনে খাবেন। আমি সব খরচ পরে কেটে নেবো।” তারপর অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললো, “এখন আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার হাতে যথেষ্ট কাজ আছে।”

টম ভাবলো এ আবার ওদের সম্পর্কে গাইকে লিখে জানাবে না-তো? ও দরজার সামনে থেমে দাঁড়ালো। “আপনি বোম্বের গভর্নর কোর্টনীর কথা বললেন। আপনারা কি পরিচিত?”

ফয়ের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। শুধু পরিচিত? খুবই ঘনিষ্ট আমরা। গাই কোর্টনী আমার গুরুর মতো-না, আমার বন্ধু। ওনার জন্যেই আজ আমি এই অবস্থানে এসেছি। অবশ্য আমিও ওনাকে সুরাটের সওদাগরদেরকে ঠাণ্ডা করতে ছোটখাটো কিছু সাহায্য করেছিলাম।”

টম মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো যে ও ফয়কে নিজের আসল পরিচয় বলেনি। “উনি ভালো আছেন?”

“আছেন ভালো মন্দ মিলিয়ে। এই বাজে আবহাওয়ায় ইদানিং আর ঘর ছেড়ে তেমন একটা বের হন না।”

“আর ওনার পরিবার? ওনারতো একটা ছেলে ছিলো, তাই না?”

টমের পাশ সারাহ নাক সিটকালো। ও কনুই দিয়ে টমের পাজরে তো দিলো কিন্তু ফয় তখন গাই-এর সাথে নিজের ঘনিষ্টতা প্রমাণে ব্যস্ত, তাই খেয়াল করলো না ব্যাপারটা।

“আহ! ওনার ছেলেটা আসলে একটা কুলাঙ্গার। বড়সড় কুলাঙ্গার,” আবার বললো ও। “বাবার আদেশ অমান্য করে পালিয়ে গিয়েছে বাড়ি ছেড়ে। এরপর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। গাই বলেন যে এটা ওর মায়ের প্রভাবে হয়েছে।”

টম আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিলো, কিন্তু ফয় দেরিতে হলেও টমের কণ্ঠে আগ্রহের ব্যাপারটা খেয়াল করে ফেললো। ওর চোখে কেমন একটা ঈর্ষা দেখতে পেলো টম।

“আপনারা পরিচিত নাকি?”

“বহু দিন আগের কথা,” টম বললো। “উনি এই ফ্যাক্টরির খোঁজ খবর রাখেন নাকি?”

“নাহ! উনি এখন পর্যন্ত একবারও তার পদধূলি দেননি এখানে।” ব্যাপারটা নিয়ে যায় যে আসলেই দুঃখিত তা স্পষ্টতই বোঝা গেলো। “তবে তার ভায়রা এখানে আছেন। এই দুর্গেই এখন আছেন উনি।”

একটা ঠাণ্ডা স্রোত টমের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো। ওকে কি চিনে ফেলেছে? ‘গাইয়ের ভায়রা’ মানে? টম আর গাই দুই বোনকে বিয়ে করেছে, কিন্তু ওরা তো আপন ভাই।

“বুঝলাম না,” যতোটা সম্ভব নির্মোহ গলায় বললো টম। ঘরের ভিতর একটা অস্ত্রের খোঁজে তাকালো ও। ব্যবহার করতে পারে এরকম যে কোন কিছু। দরজার প্রহরীর কাছ থেকে মাস্কেটটা কেড়ে নেবে কিনা ভাবলো। গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো সৈন্যদলের এখানে পৌঁছাতে কতোক্ষণ লাগতে পারে?

ফয় নিজের কপালের ঘাম মুছলো। ওর কথা শুনে টমের কি অবস্থা হচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। “ক্যাপটেন হিকস আর তার স্ত্রী জানুয়ারী থেকে ব্রিঞ্জোয়ানে আছেন। গাই-ই এক প্রকার জোর করে ওদেরকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

টম থেমে গেলো। কি বলছেন এসব? বলতে চাইলো ও। কিন্তু কিছু বলার আগেই সারাহ কথা বলে উঠলো।

“ও আচ্ছা,” খুশি হওয়ার ভঙ্গিতে বললো ও। “ক্যাপ্টেন হিকস অ্যাগনেস বিয়াত্তিকে বিয়ে করেছেন। গাইয়ের স্ত্রী ক্যারোলিনের বোন। আহা অ্যাগনেস। ইয়র্কে থাকার সময় আমরা খুবই কাছের বান্ধবী ছিলাম।”

টম ডেস্কের উপর ঝুঁকে এলো। “আপনি বলতে চাচ্ছেন অ্যাগনেস বিয়াত্তি আছে এখানে?”

“উনি এখন অ্যাগনেস হিকস। আজ সকালেই তো দেখলাম। ওনার স্বামী আমাদের সৈন্যদলের প্রধান।” ফয়-এর চোখে এখন আর টমের প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই। কারণ এরা ওর ধারণার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে ও ঠিক নিশ্চিত না যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই ব্যাপারটাই ওকে উদ্বিগ্ন। করে তুললো। ওর পেশাগত উন্নতির পুরোটাই হয়েছে গাই কোর্টোনীর লেজুড়বৃত্তি করে। আর গাই অসম্ভষ্ট হলে তোটা রেগে যায়, সেটা ওর ভালোই জানা আছে। আবার যদিও যতোটা ভাব দেখাচ্ছে আসলে গাই-এর সাথে ও ততোটা ঘনিষ্ট, কিন্তু তবুও ও জানে যে গাই নিইজের পরিবারের লোকদেরকে খুব বেশি গোণে না। খুব কৌশলে সব সামলাতে হবে ওকে।

আগে এই অতিথিদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাক। ও চওড়া একটা হাসি দিলো। “আপনারা থাকার জায়গা চেয়াছিলেন। আমি নিশ্চিত ক্যাপ্টেন হিকস আর তার স্ত্রী আপনাদেরকে খুশি মনেই স্বাগত জানাবেন। আমি এখুনি আপনাদেরকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।”

*

যাওয়ার পথে টম স্বাভাবিক কৌতূহলবশতই চারপাশ দেখতে লাগলো। দুর্গের দেয়াল খুবই শক্ত, পাথরের তৈরি, ফাঁকে ফাঁকে তিনকোণা গম্বুজ। ওখান থেকে গুলি করা সহজ। তবে পুরো দুৰ্গটাই বালির উপরে বানানো।

“দুর্গে খাওয়ার পানির ব্যবস্থা কি?” জিজ্ঞেস করলো টম।

“নদী থেকে পানি আনা হয়,” ফয় জবাব দিলো। আবারও দরদর করে ঘামতে আরম্ভ করেছে সে। হাত দিয়ে নদীর ঘাট পর্যন্ত একটা পথ দেখালো। প্রায় চারশ গজ মতো দূরে।

“কেউ অবরোধ করলে তো পানির অভাবেই মরে যাবেন,” মন্তব্য করলো ফ্রান্সিস।

“ওহ! সেরকম কিছু হবে না। এই কালাগুলোর লড়াই করারই হিম্মত নেই। একটা গুলিই যথেষ্ট, সোটার শব্দেই ওরা জঙ্গলে গিয়ে পালাবে।”

সারাহ হাচি দিলো একটা। ওরা গোডাউনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। আর কালো মরিচের গন্ধে ওর নাকে সুড়সুড়ি লাগছে। গোলাঘরের দরজাগুলো বন্ধ, কারণ এখন উপসাগরে কোনো জাহাজ নেই।

“বর্ষাকাল শুরু হয়ে গিয়েছে, এখন আর এদিক দিয়ে কোনো জাহাজ যাবে না। শরতের আগ পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্য পুরো বন্ধ।” দুঃখিত গলায় বললো ফয়।

“মরিচ কি আপনার মূল ব্যবসা নাকি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

ফয় মাথা ঝাঁকালো। “আগের মতো এখন আর দাম পাওয়া যায় না। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলোতে করে নির্দিষ্ট পরিমাণ মশলা সবসময় পাঠাতেই হয়। স্থানীয়দের সাথে চুক্তির কারণে এখানকার যতো মরিচ চাষ হয়। সবকিছুর একচেটিয়া খরিদ্দার আমরা, তাই কেনা আর বেচা দুটো ব্যবসা-ই আমাদের। যদি ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকে তাহলে সামান্য কিছু লাভ শেষ পর্যন্ত থাকে।”

টম বুঝতে পারলো ‘ঠিক ব্যবস্থাপনা’ বলতে ফয় আসলে কি বুঝিয়েছে। ও যতোদূর শুনেছে, কোম্পানির এসব ছোট ছোট দূরবর্তী কুঠিকে সেখানকার গভর্নরেরা নিজেদের ব্যক্তিগত জায়গীর মনে করে। এরা স্থানীয়দেরকে যেমন ঠকায়, তেমন এদের উপরওয়ালাদের সাথেও দুই নম্বরি করে। ফয় যেটুকু লাভই করুক না কেন, তার খুব সামান্যই লেডেনহল স্ট্রিটে পৌঁছায়।

“এখানকার চাষীরা এতে খুশি?” অ্যানা জানতে চাইলো।

“খুশি?” ফয় যেনো আঁতকে উঠলো কথাটা শুনে। “আমার দেওয়া দামে যদি ওরা খুশি থাকে তাহলে সেটাকে আমি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নেবো।”

“ব্যবসা ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে হলে উভয় পক্ষকেই লাভবান হতে হয়।”

“আবার বলছি, এরা হচ্ছে অশিক্ষিত বর্বর একেকটা। এক মাস আগে কয়েকজন স্থানীয় চাষী আমার কাছে মাল বেচতে অস্বীকৃতি জানায়। আমি ওদের গলায় একটা তরবারি ধরে সোজা মাল আনতে পাঠিয়ে দেই। ওদের কিছু করার নেই। ওদের রানির আদেশ এমনই।”

টম থমকে দাঁড়ালো। “চিত্তাত্তিঙ্কারা-র রানি?”

আবারও ফয় সন্দিহান চোখে ওর দিকে তাকালো। “ওনার সাথেও আপনার খাতির আছে নাকি?”

“ডাঙায় ওঠার পর ওনার কিছু লোকের সাথে দেখা হয়েছিলো। আমার কাছ থেকে একটা দামি জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছে ওরা।”

“দামি? কি রকম?” ফয়ের চেহারা আগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে গেলো। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ওরা ভারতীয় কায়দায় বানানো একটা একতলা কিন্তু চওড়া বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এধরনের বাড়িকে বলে বাংলো। “চলে এসেছি।”

ফয় দরজায় টোকা দিলো। পিছনে সারাহ আর টম উদ্বিগ্ন দৃষ্টি বিনিময় করলো। সারাহ ওর বোনকে সর্বশেষ দেখেছে সেই ষোল বছর আগে। এখনো কি ও আগের মতো আছে?

একটা ভারতীয় কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। ফয়কে দেখে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখালো সে।

“তোমার মালকিনকে বলো যে কয়েকজন মেহমান এসেছেন।”

কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই একজন মহিলাকে দেখা গেলো দরজায়। এসে দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দলটাকে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো সে। ভাল মতো দেখার জন্যে কয়েকবার চোখ পিটপিট করতে হলো তাকে।

“সারাহ?” দম আটকে বললো মহিলাটা। “আমি কি স্বপ্নে দেখছি নাকি?”

আনন্দের অতিশয্যে কাঁপতে শুরু করলো সে। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ভেবে টম দ্রুত গিয়ে তাকে ধরলো।

“অ্যাগনেস, কান্না চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করে কোনোমতো বললো সারাহ। “আমিতো ভেবেছিলাম তোমার পুরনো বন্ধু সারাহ উইল্ডকে চিনতেই পারবে না।”

ফয় সরু চোখে ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করছে।

“আপনার এক বোনের নামও না সারাহ ছিলো, মিসেস হিকস?”

“বেচারি, কয়েক বছর আগে সে মারা গিয়েছে।” অ্যাগনেস বুদ্ধি করে বললো। ও সারাহের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলো। “ভিতরে আসো। তোমার সাথের ওদেরকেও আসতে বলল।” টম, ফ্রান্সিস আর অ্যানার দিকে ইঙ্গিত করলো ও। “ইশ! কতদিন পর। অনেক গল্প হবে আজ। আপনিও থাকবেন নাকি, মি. ফয়?”

“দুঃখিত, আমার কিছু জরুরি কাজ আছে।” টুপির কোনা ধরে বললো ফয়। “আজকের মতো আসি। গুড ডে।”

ফয় যাওয়ার পর দরজা বন্ধ হতেই অ্যাগনেস এক প্রকার ঝাঁপিয়েই পড়লো সারাহের উপর। এতো জোরে জড়িয়ে ধরলো যে সারাহের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো।

“সারাহ,” নিচু স্বরে কাঁদতে লাগলো অ্যাগনেস। “আসলেই তুমি? আমি ভেবেছিলাম তুমি আফ্রিকাতে মারা গিয়েছে।”

“মরতে মরতে বেঁচেছি-তাও কয়েকবার।” অ্যাগনেসের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো সারাহ। তারপর ওর চেহারা থেকে কান্নায় ভিজে যাওয়া চুলগুলো সরিয়ে দিলো। “কিন্তু এইতো দেখা হলো।”

“তুমি এখনো বেঁচে আছে সেটা আমাকে জানাওনি কেন?”

“তুমি কোথায় আছ সেটা তো জানা ছিলো না। আর চিঠি দিলেও সেটা যে গাই-এর হাতে পড়বে না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলাম না।”

তারপর একটু সরে টমের দিকে মাথা দিয়ে ইঙ্গিত করলো।

“টম কোর্টনীকে মনে আছে?”

অ্যাগনেস আসলে অধিক আনন্দে পাথর হয়ে গিয়েছে। টমের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো ও। তারপর নরম স্বরে বললো, “তার মানে ক্যারোলিনের কথা-ই সত্যি। তুমি আর সারাহ জাঞ্জিবার থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে।”

টম কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো। “শেরপা-তে করে আমরা প্লইমাউথ থেকে চলে আসি।” সারাহ আর অ্যাগনেস তখন অনেক ছোট। এমনকি তখন টম ওদের দুজনকে আলাদা করে চিনতো-ও না। ও তখন ওদের বড় বোন ক্যারোলিনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু সে শেষমেশ গাইকে বিয়ে করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দুই বোনের চেহারায় যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। সারাহের তুলনায় অ্যাগনেসের চুল বেশি কালো, আর গায়ের রঙ বেশি ফর্সা। চেহারার টানটানে ভাব দেখেই বোঝা যায় ভালোই যত্ন নেয় ও নিজের। একসময় যে দুরন্ত কিশোরি ছিলো, তা আর এখন নেই। অবশ্য ওরা কেউই আর আগের মতো নেই।

সবাই অ্যাগনেসের বসার ঘরে বসলো। পনের বছর আগে সারাহ আর টম গাই-এর কাছ থেকে জাঞ্জিবার ছেড়ে পালানোর পর থেকে যা যা হয়েছে সব খুলে বললো সারাহ। আফ্রিকায় ওদের অভিযান, কেপ টাউনে বিয়ে করার কথা থেকে শুরু করে ফ্রান্সিসের সাথে দেখা হওয়া আর এখানে এসে জাহজডুবি, সবকিছুই সংক্ষেপে জানালো অ্যাগনেসকে।

অ্যাগনেস মোহাবিষ্টের মতো চুপচাপ শুনে গেলো সব। পুরোটা সময় ও সারাহের হাত ধরে রাখলো, এমন ভাব যেনো ছেড়ে দিলে সারাহ আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে।

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি আমার সামনে বসে আছো,” ফ্যাসফেসে গলায় বললো ও। “আর উইলিয়াম কোর্টনীর ছেলে ফ্রান্সিস এতো বড় হয়ে গিয়েছে। পুরোটাই অলৌকিক লাগছে আমার কাছে।”

“ভাগ্যের নির্মম খেলায় আমরা আবার একসাথে হলাম,” টম স্বীকার করলো। “তবে এখন আগে ভাবতে হবে এই ঝামেলা থেকে পালাবো কিভাবে। আপনার স্বামীকে কি বিশ্বাস করা যায়?”

অ্যাগনেস মাথা ঝাঁকালো। “ক্যাপ্টেন হিকসের সাথে গাই কোর্টনীর কোনো খাতির নেই। বোম্বেতে গাই যতোভাবে পারে আমাদেরকে অপমান করেছে। আমার মনে হয় সে আমাদেরকে দেখতেই পারে না। গাই নিজে শয়তানি করে আমার স্বামীকে এই জঘন্য জায়গায় পাঠিয়েছে।”

“আর মিস্টার ফয়?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞে করলো।

“মিস্টার ফয় আছে শুধু নিজের ধান্দায়। গভর্নর হিসেবে উনি এখানকার সৈন্যদলের প্রধান, আর সেটা আমার স্বামীকে বারবার মনে করিয়ে দিতে ছাড়েন না। ওনার বৌ-টাও ওরকম। তবে আমি আর আমার স্বামী খেয়াল রাখবো যাতে ওরা আমাদের আসল সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই না জানে।”

“তাহলে ঠিক আছে, সারাহ বললো। “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।”

বলেই ও জ্ঞান হারিয়ে ধপ করে অ্যাগনেসের কোলের উপর পড়ে গেলো।

“হায় হায়,” আর্তনাদ করে উঠলো অ্যাগনেস। “করেছি কি? আপনারা সবাই না খেয়ে, ভেজা কাপড়েই বসে আছেন। আর আমি কিনা বকবক করেই যাচ্ছি। আপনাদের এখন খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করা দরকার।”

টম আর ফ্রান্সিস ধরাধরি করে সারাহকে ভিতরে নিয়ে গেলো। ওর গা গরম হয়ে আছে, জ্বর আসছে সম্ভবত। ওকে এতো কষ্ট দেওয়ার জন্যে টম মনে মনে নিজেকে গালাগাল করতে লাগলো। বিছানায় শুইয়ে একটা কম্বল দিয়ে সারাহের শরীরটা ঢেকে দিলো ও। অ্যাগনেস ডাল আর লেবুর তৈরি একটা স্যুপ নিয়ে এলো। তারপর সারাহের পাশে বসে যত্ন করে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগলো।

সদর দরজা খুলে গেলো। সামনের ঘর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ অ্যাগনেসের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভিতরে এসে ঢুকলো। কয়েক মুহূর্ত পর এঘরের দরজায় দেখা গেলো তাকে। একজন লম্বা, একহারা লোক। বালু রঙের চুল একেবারে খুলির সাথে লাগিয়ে কাটা। চামড়া রোদে পুড়ে লাল হয়ে আছে। বোম্বে রেজিমেন্টের লাল, সবুজে মেশানো পোশাক পরনে ওনার।

“ফয় বললো বাসায় নাকি মেহমান এসেছে।” আগন্তুকদের দিকে নজর বুলাতে বুলাতে সে হাত বাড়িয়ে দিলো। “এলিয়াহ হিকস, অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।”

“টম…” টম ইতস্তত করলো। “টম কোর্টনী।”

“কোর্টনী?” হিকসের স্বর বিস্ময় আর সন্দেহে ভারী হয়ে গেলো। সে অ্যাগনেসের দিকে ফিরলো। “তুমি এদেরকে…”

“এরা সবাই ঘরের লোক, সারাহের ফ্যাকাশে, উষ্ণ গাল মালিশ করতে করতে অ্যাগনেস বললো। “এ হচ্ছে আমার বোন সারাহ। বিশ বছর পরে ওকে দেখলাম আমি। আমাদের ভাতিজা ফ্রান্সিস কোর্টনী। উইলিয়ামের ছেলে।”

হিকস কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। টম আর ফ্রান্সিসের সাথে করমর্দন করে অ্যানার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালো ও। তারপর অ্যাগনেস সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিলো। “ওর বিশ্রাম দরকার। এখানে এতে হৈ চৈ করলে হবে না। যাও সবাই!”

মহিলাদেরকে ওখানে রেখে আবার বসার ঘরে ফিরে এলো বাকিরা। হিকস ছেলেদের জন্যে বোয়া জামা আর পায়জামা এনে দিলো। ফ্রান্সিসের ঠিকমতোই হলো, তবে টম জামার বোতাম লাগাতে গলদঘর্ম হয়ে গেলো।  ওয়াইন দিয়ে ওদেরকে আপ্যায়ন করলো হিকস। সামান্য পরেই টেবিলে মাছ আর ভাত সাজিয়ে ওদেরকে ডাক দিলো কাজের মেয়েটা।

“এই জঘন্য গরম,” হিকস অভিযোগের সুরে বললো। “ঈশ্বর জানে কিভাবে এখনো টিকে আছি।”

খাওয়া শেষে আবার ওয়াইন খেতে খেতে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলো ওরা। হিকস কম কথার মানুষ, আর এখন এই সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিদেরকে ও কি বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিলো না।

টম ও গ্লাসটা দুর্গের দিকে তাক করে বললো, “জায়গাটায় নিরাপত্তা দেখলাম তেমন ভালো না।”

হিকস মুখ বেজার করে বললো, “এসব ফয়ের কারবার। লোকটা এতো বেশি হিংসুটে যে আমি যা-ই বলি না কেন, তার কাছে মনে হয় যে তাকে ছোট করার জন্য বলছি। তাই আমার পরামর্শের উল্টোটা করে সবসময়। আমি আমার লোকদের নিয়ে মহড়া করতে পারি না, বা এলাকাটা একটু টহলও দিতে পারি না। সে কোন না কোনো ছুতো তুলে আমার কাজে বাগড়া দেবেই।”

টম খুশি হলো যে এখানকার এই দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যে অ্যাগনেসের স্বামী কোনোভাবেই দায়ী না। সত্যি কথা বলতে লোকটার সোজা সাপ্টা হাবভাব আর সরাসরি সত্যিটা বলার মানসিকতা টমের খুবই পছন্দ হলো। এমন একজনকে ওদের পক্ষে পেয়ে ভালোই হয়েছে।

আর এ হচ্ছে আমার ভায়রা ভাই, মনে মনে ভাবলো টম। এতোদিন পর পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা দুই বোন আবার ভাগ্যের ফেরে কিভাবে একত্রিত হলো সেটা ভেবে টম অবাক হলো।

“স্থানীয় লোকজন কেমন?”

“খুব বেশি পছন্দ করে না আমাদেরকে। ফয় তাদেরকে ক্রমাগত খুঁচিয়েই চলে। তার শুধু নিজের লাভের চিন্তা। তাই এসব করতে গিয়ে ও যে আসলে কি ক্ষতিটা করছে সেটা চোখে পড়ে না। লোকজন না খেয়ে মরলেও ফয় নিজের মর্জির বাইরে এক দানা মরিচও কেনে না। এখানকার ব্যবসায়ীদেরকে বাধ্য করে ওর বলা দামে সব বিক্রি করতে। যদি তারা রাজি না হয় তাহলে কি করে তা আর না-ই বলি।”

“ওরা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু করে না?”

“ফয়ের বিশ্বাস রানি এসব সামাল দেবেন।”

টমের চেহারা বাঙলা পাঁচের মতো হয়ে গেলো। “এই নিয়ে তৃতীয়বার এই রানির কথা শুনলাম। কে ইনি?”

“স্থানীয় রানি। বয়স খুবই কম। কিন্তু আমি যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে মানসিকতার দিকে থেকে সে আসলে একটা সাপের চাইতে কম না। তার দরবারে দুটো পক্ষ। একদল আমাদের সাথে ব্যবসা করতে রাজি, আর একদল আমাদেরকে তাড়িয়ে দিতে চায়। সে এদের দুই দলকেই সামলে রাখে। তবে উপায়টা খুব বেশি সুন্দর না।” :

“কিন্তু আমিতো দেখলাম রানির লোকজন ইংরেজদের সাথে খুব বেশি ভালো আচরণ করে না।”

টম, হিকসকে গ্রামের ঘটনাটা খুলে বললো। হিকস মাথা ঝাঁকালো।

“টুঙ্গারকে চিনি। রানির সেনাপতিদের একজন। ও ইংরেজদের পছন্দ করে না। কারণ আমরা আসার আগে ওর চাচা-ই মরিচের ব্যবসা সব নিয়ন্ত্রণ করতো।”

“ও আমার মূল্যবান একটা জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছে। একটা তরবারি। আমার পরিবারের কাছে কয়েক প্রজন্ম ধরে আছে ওটা। ওটাকে উদ্ধার করতে হবে।”

খাওয়াদাওয়া আর শুকনো কাপড় পাওয়ার পর টমের মন আপনাআপনি আবার নীলাখচিত তরবারিটার দিকে চলে যাচ্ছে। ওটা শুধু একটা অস্ত্র না, ওর কাছে ওটা কোটনী পরিবারের গৌরব আর ইজ্জতের প্রতিনিধি। এখনতো হাই উইন্ডও হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। আছে শুধু তরবারিটাই। টম ওখানে বসেই একটা প্রতিজ্ঞা করলো : তরবারিটা উদ্ধার না করে ও এই জায়গা ছেড়ে নড়বে না।

“ফয়ের ইচ্ছা আগামী তিনদিনের মধ্যে রানির দরবারে দেখা করতে যাবে, হিকস বললো। “শুনে টুঙ্গার আবারও ঝামেলা করছে। তাই ফয় ওর একটা বিহিত করতে চাচ্ছে। আপনিও এই ফাঁকে রানির সাথে ওটা ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আলাপ করতে পারেন। তবে রানি উপহার নিতেই পছন্দ করেন, মনে হয় না ফেরত দিতে সম্মত হবেন। সে-ও মিস্টার ফয়-এর মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

“তাহলেতো ভালোই ঝামেলা হবে মনে হচ্ছে,” চিন্তিত মুখে শেষমেশ বললো টম।

*

সেরাতে টম মরার মতো ঘুমালো। ঘুম থেকে উঠে দেখে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। সারাহের অবস্থাও আগের চাইতে ভালো। তবে সকালে অ্যাগনেস যখন ওকে খাওয়াতে গেলো তখন কয়েক চামচের বেশি খেতে পারলো না।

একজন কাজের লোক একটা চিরকুট এনে টমকে দিলো। ফয় পাঠিয়েছে। টম ভেবে পেলো না কি এমন খবর যে ফয় নিজে ওর অফিস থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে এই বাসায় এসে দিতে পারলো না।

আশা করি আপনি আমাদের মধ্যকার চুক্তিটা ভুলে যাননি, চিরকুটে লেখা।

“তার মানে সে এখনি আমাকে জাহাজডুবির ওখানে গিয়ে দেখতে বলছে যে কিছু পাওয়া যায় কিনা,” টম বুঝতে পারলো। “বুঝতে পারছি যে আমরা যদি খরচাপাতি পরিশোধ করতে না পারি তাহলে তার জন্যে বাড়তি ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবো।”

“আমি যাবো নাহয় আপনাদের সাথে,” হিকস বললো।

“তাহলেতো ভালোই হয়,” কৃতজ্ঞচিত্তে বললো টম। “তবে এখানে আপনার কাজের যেনো আবার গাফিলতি না হয়।”

হিকস মুখ দিয়ে অবজ্ঞাসূচক একটা শব্দ করলো। আমি সারাদিনে যা করি, তার চাইতে নারিকেল কুড়ানো ভালো। মিস্টার ফয় সারাদিনে আমার চেহারা না দেখতে পেলে বরং খুশিই হবেন।”

টম কেস্ট্রেল-এর লোকদের মধ্যে আটজনকে পেলো যারা এখনো অক্ষত দেহে আছে। হিকস ওর লোকদের মধ্য থেকে চারজন সেপাইকে নিলো ওদের সাথে। নেতৃত্বে থাকলো মোহিত নামের এক হাবিলদার। লোকটার মোচটা বেশ দর্শনীয়। হাবিলদার হচ্ছে বোম্বের সেনাবাহিনির সার্জেন্টের সমতুল্য। দুজনের মধ্যেকার আন্তরিকতা দেখেই টম বুঝলল হিকস এর উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে।

একটা ভাড়া করা স্থানীয় নৌকায় রওনা দিলো ওরা। এগুলোকে গালিভাত বলে ডাকা হয়। জাহাজের ডিঙির সমানই বড়, তবে পাল খাটানো যায়। টম চিন্তিত মুখে আকাশের দিকে খেয়াল করতে লাগলো। তবে ঝড়টা শেষ পর্যন্ত কেটেই গিয়েছে। বাতাসের টানে মসৃণভাবে ভেসে চললো গালিভাত। ওটার তিনকোণা পালটা একদম পুরোটা ফুলে ফেঁপে আছে।

“ডোরিয়ান থাকলে ভালো হতো,” আক্ষেপ করে টম বললো। “ও ঠিকই ভাঙা জাহাজ থেকেও অনেক কিছু বের করে ফেলতো।”

“ভাগ্য ভালো হলে, কয়েকদিন পরেই উনি গনের সৈকতে বসে আবোলির সাথে কফি খেতে খেতে কেমন কামাই করলেন সেসব হিসাব করবেন,” ফ্রান্সিস বললো।

ব্রিঞ্জোয়ানে ওরা এসেছিলো হাটা পথে, টম সেসময় সৈকতের কিছুই দেখতে পায়নি। দিগন্ত বরাবর কয়েক ঘণ্টা নৌকা চালালো ওরা। আকাশ পুরোপুরি মেঘমুক্ত না, যেকোনো সময় আবার প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে যেতে পারে।

ওরা একটা ছোট বেরিয়ে থাকা চড়া পেরিয়ে একটা লম্বা কিন্তু অগভীর অংশে এসে পৌঁছালো। টমের মনে হলো কেঁদেই দেবে। কেস্ট্রেলকে দেখা যাচ্ছে সামনে। একটা বিশাল ধ্বংসস্তূপ। বাতাস আর ঢেউ ওটাকে তীরের কাছাকাছি ঠেলে এনেছে। পানি এখানে এতো কম যে ওটার ভাঙা ডেক পানির উপরে উঠে আছে।

তবে জাহাজটা খালি না। তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে ওটার উপর। সৈকতে দাঁড়ানো আরো একদল লোককে চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। সৈকতের লোকগুলো একপাল ষাঁড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের গায়ে একটা শেকল বেঁধে অপর প্রান্ত বাধা হয়েছে ষাঁড়গুলোর সাথে। টম দেখলো লোকগুলো সপাং করে ষাড়ের গায়ে বাড়ি দিলো আর জম্ভগুলো ঝাঁকি মেরে সামনে বাড়লো। ওদের গায়ে বাঁধা শেকলগুলোর সমুদ্রের পানি থেকে বেরিয়ে এলো। পানি ঝরছে ওগুলো থেকে। বঁড়গুলো সৈকত ধরে উঠতে উঠতে গাছের সারির ওপাশে হারিয়ে গেলো। ওখানে কিছু পাম গাছ কেটে জায়গা করা হয়েছে।

“ওরা কি পুরো জাহাজটাকেই ডাঙায় টেনে তুলবে নাকি?” ফ্রান্সিস অবাক হলো।

হিকস হাতের টেলিস্কোপটা দিয়ে সৈকতের দিকে নজর রাখছে। ও সেটা টমের হাতে ধরিয়ে দিলো। ওটা দিয়ে টম পানির নিচে একটা কালো হাঙরের আকৃতির জিনিস দেখতে পেলো।

ষাঁড়গুলো ওটাকে ঢেউয়ের নিচ থেকে টেনে তুলতেই দেখা গেলো ওদের জাহাজের নয় পাউন্ডের কামানগুলোর একটা। ওটা পানির উপরে উঠে আসতেই লোকজন দৌড়ে গিয়ে ওটাকে থেকে একটা কাঠের খাঁচার মধ্যে তুলে দিলো যাতে আর গড়িয়ে না যেতে পারে।

“এরা করছেটা কি?”

“ইউরোপিয়ান কামান এখানকার লোকের কাছে সাত রাজার ধনের মতো,” হিকস বললো। “ওদের রানি এগুলোর জন্যে এগুলোর ওজনের সমান স্বর্ণ দিতে রাজি। কিন্তু তোমার ভাই গাই পর্যন্ত অস্ত্র বেচা-কেনা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করেছে। লাভ যতোই হোক, এগুলো যে একসময় কোম্পানির জাহাজ বা কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না তার নিশ্চয়তা কি?”

টম আবার সৈকতটা পর্যবেক্ষণ করলো। কামানটা গাছের সারির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর ষাঁড়গুলোকে আবারও নিয়ে আসা হলো পানির কাছে। দুজন লোক শেকলের মাথা হাতে নিয়ে ভাঙা জাহাজটার দিকে এগিয়ে গেলো। বোঝাই যাচ্ছে ওরা সবগুলো কামানই উদ্ধার করতে চায়।

টেলিস্কোপ দিয়ে টম ওদের সর্দারকে দেখতে পেলো। লম্বা, চওড়া কাধ, অন্য সবার চাইতে তার মাথা উঁচিয়ে আছে। লোকটার উর্ধাঙ্গে কোনো কাপড় নেই। কোমরে পিস্তল গোজা, আর বুকে কোনাকুণিভাবে ঝুলছে কার্তুজের বেল্ট। দুটো তরবারিও দেখা গেলো। ছোট ছোট সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে কাজ করাচ্ছে সে। তবে লোকগুলোর যেভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে কাজে ছুটছে সেটা দেখে অবাক হলো টম। এরা যে খুব ভালমতো প্রশিক্ষিত তা-ই না, এরা লোকটাকে প্রচণ্ড ভয়ও পায়।

“একেবারে জবরদস্ত এক লোক দেখি,” টম বিড়বিড় করে বললো। লোকটাকে দেখে মনে কু ডাক ডাকছে ওর। “এ আবার কে?

হিকস টেলিস্কোপটা নিলো আবার। “একে আগে কখনো দেখিনি। সম্ভবত রানির নতুন লোক।”

“অথবা ডাকাতও হতে পারে।”

“রানির এলাকা থেকে জাহাজডুবির মাল লুট করতে হলে বুকের পাটা থাকতে হবে। আর কামান সরানো আর লোকজনের টাকার ব্যাগ মেরে দেওয়া এক জিনিস না। এতো গুলো লোক নিয়ে আসা, এতোগুলো ষাড় জোগাড় করা… আর নিয়ে যাওয়ার ঝামেলার কথা বাদই দিলাম। রানির অনুমতি ছাড়া এতোসব সম্ভব না।”

“তাহলেতো দেখা যাচ্ছে রানির সাথে দেখা করতে গেলে আমার তরবারির সাথে সাথে আরো অনেক কিছুই ফেরত চাইতে হবে।”

হিকসের ভ্রু কুঁচকে গেলো। “আমার এসব পছন্দ হচ্ছে না। ওই মহিলা নিশ্চিত কোনো শয়তানি ফন্দি আঁটছে। আমি নিশ্চিত।”

সৈকতের লোকেরা গালিভাতটাকে দেখতে পেলো। চিৎকার করে হাত ছুঁড়তে লাগলো তারা। তবে ওদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে নাকি সরে যেতে হুশিয়ার করছে সেটা বোঝা গেলো না। টম আবার টেলিস্কোপে চোখ দিলো।

“সোজা যেতে থাকো,” হাল ধরে রাখা আলফ উইলসনকে বললো টম। “ওরা সংখ্যায় অনেক, আর আমরা যে ওদেরকে এসব করতে দেখে ফেলেছি। সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না।” ওর মনে হয় না যে সৈকতের লোকগুলোর কাছে কোনো স্পাই গ্লাস থাকবে। ভাগ্য ভালো হলে ওরা বুঝবেই না যে নৌকার লোকগুলো বিদেশি।

হিকস ওর চিন্তা ধরতে পারলো। “যদি বোঝাতে চান যে আমরা নিরীহ যাত্রী, তাহলে টেলিস্কোপটা নামিয়ে রাখলেই ভালো হবে। এখানকার জেলেরা এরকম কিছু ব্যবহার করে না।”

তবুও টম আরো একবার সর্দার লোকটাকে না দেখে পারলো না। কিন্তু ও টেলিস্কোপটা চোখে দিতেই লোকটাও সোজা ওর দিকে তাকালো। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়, কিন্তু টমের মনে হলো এতো দূর থেকেও সে টের পেয়ে গিয়েছে। লেন্সের ভিতর দিয়ে লোকটার চোখ দেখতে পেলো টম। ও নিশ্চিত যে একে জীবনেও কখনো দেখেনি, কিন্তু তবুও চেহারাটা নজরে আসতেই মেরুদণ্ড। বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেলো। অব্যাখ্যেয় কোন কারণে ওর মনে হলো একে বহুদিন ধরে চেনে, মনে হলো যেনো আয়নায় নিজের চেহারাটাই দেখতে পেলো।

ও টেলিস্কোপটা নামিয়ে আবার চামড়ার ব্যাগে রেখে দিলো। শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে, হয় ভুল দেখেছে নইলে ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ কেপ টাউনে দেখা সেই সবুজ দ্যুতির কথা মনে পড়লো ওর। একটা আত্মা আবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসবে।

টেলিস্কোপ ছাড়া সৈকতের লোকটাকে এখন পিঁপড়ার মতো ছোট লাগছে। কিন্তু তবুও টম ওর উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। ওরা জায়গাটা চক্কর দিয়ে আবার উল্টোদিকে ফিরে যেতে যেতে যখন জায়গাটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো, তখনই টম চোখ নামালো।

আবারও ব্রিঞ্জোয়ানে ফিরতে লাগলো ওরা। হিকসের সতর্কবার্তাটা কানে বাজছে টমের। ওই মহিলা নিশ্চিত কোনো শয়তানি ফন্দি আঁটছে।

*

পেটের উপর ভর দিয়ে ক্রিস্টোফার খাড়া পাহাড়টার ধার দিয়ে নিজেকে টেনে তুললো। ওখান থেকে একটা পচা গাছের উপর দিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো নিচের বহরটা। সবার সামনে আছে একটা পর্দায় ঘেরা পালকি, আটজন ডুলি বইছে সেটা। পিছনে আছে বিশজন সশস্ত্র লোক।

তামান্না উঠে এলো ওর পাশে। “বলেছিলাম না যে অপেক্ষা করলে ভালো

এই একই বহরটাকে তিনদিন আগে এই রাস্তা দিয়েই উল্টোদিকে যেতে দেখেছে ওরা। ক্রিস্টোফার চেয়েছিলো তখনই আক্রমণ করতে, কিন্তু তামান্না বলেছিলো ধৈর্য ধরতে। “এরা ব্রিঞ্জোয়ানের ইংরেজ কুঠিতে কাপড় নিয়ে যাচ্ছে। যখন ফিরে আসবে তখন এদের কাছে থাকবে বিক্রি করে পাওয়া স্বর্ণ।”

এখন সেটার সত্যতা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে ক্রিস্টোফার। তিন দিন আগের বহরে প্রায় একশো স্থানীয় কুলি ছিলো পালকিটার পিছনে। সবার মাথায় ছিলো নিখুঁতভাবে বোনা সৃতি কাপড়ের গাঁটরি। এখন আর ওরা নেই। তার বদলে আছে একটা মাত্র খচ্চর। ওটার পিঠের বস্তাটার যে অনেক ওজন তা জটার চলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে। এতোগুলো পাহারাদারের ভীড়ে ওটা যে নির্ভয়ে চলছে। তাতেই ক্রিস্টোফার বেশ অবাক হলো। সব দেখে একটু পিছনে সরে এলো ও।

মনের ভিতর কেমন যেনো একটা আশংকা দোলা দিয়ে গেলো ওর, কেনো এমনটা হলো ভেবে পেলো না। ব্যাপারটা যে ওর বিবেকের দংশন না সেটা ও নিশ্চিত। ছয় মাস হয় ও তামান্নার ডাকাত দলে যোগ দিয়েছে, আর এর মাঝে কতোবার যে এই কাজ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। একাকী পথচারীদেরকে ছিনতাই করে খুন করেছে, কড়া পাহারায় থাকা ক্যারাভানও লুট করেছে। অব্যাহত সফলতার কারণে ওদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। লাভ ক্ষতি দুটোই হয়েছে তাতে। লাভ হচ্ছে ওদের দলে এখন এক ডজন লোক। আর ঝামেলা হচ্ছে ওদেরকে আরো উত্তরে চিত্তাত্তিস্কারাতে পালিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ আগের জায়গার রাজা ওদেরকে ধরার জন্যে মরণ পণ করেছিলেন।

“এখনই আক্রমণ করবো?”

তামান্না একটা শয়তানি হাসি হাসলো। “বেচারা খচ্চরটার পিঠটাই ভেঙে যাবে যদি আমরা ওর পিঠের বোঝাটা কমিয়ে না দেই। ভয় পাচ্ছো নাকি?”

“আরে নাহ।”

“তাহলে ওরা পালানোর আগেই ফাঁদটা পেতে ফেলা যাক।”

জায়গাটা আক্রমণের জন্যে একেবারে উপযুক্ত। রাস্তাটা এখানে মোড় নিয়ে একটা সরু গলিতে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে। কাদা কাদা অবস্থা। উপরের চড়াটা ভাঙা পাথরের টুকরো দিয়ে ভরা, ফলে লুকিয়ে থাকার জন্যে প্রচুর জায়গা পাওয়া যায়। প্রহরীরাও জানে ব্যাপারটা। ক্রিস্টোফার দেখলো প্রহরীরা সবাই নিজেদের তরবারি খাপমুক্ত করে হাতে তুলে নিলো। এদের সর্দার হচ্ছে লাল পাগড়ি পরা বিশালকায় একটা লোক। সে কিছু একটা আদেশ দিলো। ওদের চারজনের হাতে বন্দুক আছে, তারা সবাই বন্দুকের ঘোড়ায় আগুন জ্বেলে প্রস্তুত করে নিলো, যাতে দরকার হওয়া মাত্র গুলি ছুঁড়তে পারে। খাড়া ধারটায় কড়া নজর রেখে আগাতে লাগলো ওরা, সামান্য নাড়াচাড়াও চোখ এড়াচেই না। তবে ক্রিস্টোফারও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ওস্তাদ। দম বন্ধ করে পড়ে রইলো ও।

ক্যারাভানটা বাঁক ঘুরতেই একটা আতংকিত চিৎকার শোনা গেলো আর দলটা থেমে পড়লো। একটা গাছ ভেঙে পড়ে পুরো রাস্তা আটকে দিয়েছে। প্রহরীরা খচ্চরটাকে ঘিরে একটা চক্র করে দাঁড়িয়ে গেলো, চেহারা পাথরগুলোর দিকে। ক্রিস্টোফার দেখলো সর্দার লোকটা গাছের গোড়াটা পরীক্ষা করে দেখছে। নিজের কাজ ভালোই জানে সে। যদি খুঁড়িটায় কুড়ালের আঘাতের চিহ্ন থাকে তাহলে ঠিকই বুঝে যাবে যে ইচ্ছা করে গাছটা ফেলা হয়েছে।

কুড়ালের কোনো দাগ নেই। ক্রিস্টোফারের লোকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটি খুঁড়ে এমন অবস্থা করে রাখে যাতে গাছগুলো নিজের ভারেই ঢলে পড়ে। তাতে করে মনে হয় যে ব্যাপয়ারটা আপনাআপনিই ঘটেছে।

সর্দারও ধোকা খেয়ে গেলো ব্যাপারটায়। বন্দুকধারী লোকগুলো পাহারায় থাকলো আর বাকিরা অস্ত্র নামিয়ে রেখে গাছটা ঠেলে সরানোর কাজে লেগে গেলো। ঝটপট কাজ করতে লাগলো তারা। মুলত জানের ভয়েই যতো দ্রুত সম্ভব এলাকাটা পার হতে চায়। সেই সাথে সর্দারের গালাগাল তো আছেই। কয়েক মিনিটের ভিতরে ওরা ভারি গাছটাকে ঠেলে সরিয়ে ফেললো। কোনো আক্রমণ এলো না দেখে ওদের দুশ্চিন্তাও কমলো কিছুটা। ক্রিস্টোফার ওদের ঠোঁটে হাসি দেখতে পেলো, হাসির শব্দও কানে এলো ওর। এতে ভয় পেয়ে যাওয়ায় এখন সবাই কেমন লজ্জা পাচ্ছে। পালকির পর্দার ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এলো। ইশারায় রওনা দেওয়ার জন্যে আদেশ করছে।

প্রথম তীরটা সরাসরি সর্দারের গলা এফোড় ওফোড় করে দিলো। পরেরটা লাগলো খচ্চরের গায়ে। তামান্নার লোকেদের বন্দুক আছে, কিন্তু ওরা সবসময় প্রথম আক্রমণটা করে তীর দিয়ে। এতে করে শিকার দিশেহারা হয়ে। যায়। কারণ তীর ছুড়লে কোনো ধোয়া বা অন্য কিছু দেখা যায় না যা দিয়ে কেউ অনুমান করবে যে আক্রমণ ঠিক কোথা থেকে আসছে।

সর্দার না থাকায় দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। এলোপাথাড়ি গুলি করতে লাগলো ওরা। খামাখা বন্দুকের গুলিও খরচ হলো আবার গুলির ধোঁয়ায় নিজেরাই কিছু দেখতে পেলো না আর। বন্দুকে আবার গুলি ভরতে পারার আগেই তামান্না আর ওর লোকেরা ঢাল বেয়ে নেমে এসে আক্রমণ করলো। ক্রিস্টোফার উরুমিটা অবমুক্ত করে যোগ দিলো ওদের সাথে। ধোয়ার ভিতর দিয়েও দেখতে পেলো একজন প্রহরী মরিয়া হয়ে বন্দুকে গুলি ভরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। উরুমিটা সোজা উড়ে গিয়ে ওর বুকটা চিরে দিলো। দক্ষ হাতে ক্রিস্টোফার আবার ওটাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে হাতল ঘুরিয়ে আর একটা প্রহরীর দিকে ছুঁড়ে দিলো। তার হাঁটু কেটে বেরিয়ে এলো ওটা। আর্তনাদ করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো লোকটা।

কিছুদিন আগেও ক্রিস্টোফারও ছিলো এরকমই একজন প্রহরী। ধোয়ার ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলো ও, কিন্তু তামান্নার লোকেরা আগেই সব সেরে রেখেছে। উরুমিটা আর ব্যবহার করতে হলো না ওকে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেলো আটজন ডুলি বাদে আর কেউই জ্যান্ত নেই। শরীরের উর্ধাংশে কিছুই নেই লোকগুলোর আক্রমণের প্রচণ্ডতা আর দ্রুততায় ওরা আর জায়গা ছেড়ে নড়ার সময় পায়নি।

হাতে অস্ত্র থাকলে এরাও কঠিন প্রতিপক্ষ হতে পারতো। তবে ক্রিস্টোফার ভারত সম্পর্কে একটা জিনিস জানে, এখানে জাত ব্যাপারটা খুব কড়াভাবে মানা হয়। একজন ডুলি কখনো লড়াই করবে না, আবার একজন যোদ্ধা কখনো গরুর দুধ দুইবে না। একজন লোকের জন্মই তার নিয়তি ঠিক করে দেয় এখানে।

তাই ওরা যখন পালকি ফেলে ছুট দিলো তখন ক্রিস্টোফার বিশেষ অবাক হলো না। এমনটাই আশা করেছিলো এদের কাছ থেকে। ওদেরকে যেতে দিয়ে পালকিটার দিকে আগালো ও।

পর্দা সরে গেলো। একজন বেটে, মোটাসোটা লোক মাথা বের করলো ভিতর থেকে। পরনে সবুজ রঙের রেশমি কাপড়। বাইরের দৃশ্য চোখে পড়তেই চেহারার প্রচণ্ড রাগের অনুভূতি পাল্টে নির্জলা আতংক ভর করলো সেখানে। ক্রিস্টোফার ঠিক সামনেই তার দিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।

লোকটা হাতের আংটিগুলো খুলে ক্রিস্টোফারের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিতে শুরু করলো। মোটা আঙুল থেকে আংটি খোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখে খুব মজা পেলো ক্রিস্টোফার।

“এর চাইতে আঙুলগুলো কেটে দিলে তাড়াতাড়ি খুলবে,” সাহায্য করার ভঙ্গিতে বললো ক্রিস্টোফার।

লোকটা বিলাপ করতে করতে আরো জোরে চেষ্টা করতে লাগলো। কার্নেলিয়ান আর চুনি বসানো একটা আংটি এতো বেশি এঁটে ছিলো যে খোলার সময় চামড়া সমেত উঠে এলো। রক্ত উপচে পড়তে লাগলো ক্ষত থেকে।

ক্রিস্টোফার তরবারির ডগাটা লোকটার গলায় ঠেকালো। যেনো নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেলো লোকটা।

“এতো কষ্ট করতে হবে না। তোকে মারার পর আমি নিজেই খুলে নেবো।”

ভয় পেয়ে আবার নিজের পালকির ভিতরে সেধিয়ে গেলো লোকটা। টান দিয়ে পর্দাগুলো ছিঁড়ে ফেললো ক্রিস্টোফার। ভিতরে দেখা গেলো অনেকগুলো নকশা করা বালিশ। ওগুলো থেকে সুগন্ধ ভেসে আসছে। ক্রিস্টোফারের পছন্দ হলো বালিশগুলো। এগুলোতে রক্ত যাতে না লাগে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

“দয়া করুন,” লোকটা অনুনয় করলো। “আপনি কি জানেন, আমি কে?”

“না,” ক্রিস্টোফার বললো।

ওর চোখ লোকটার টাকা পয়সার হিসাব কষতে ব্যস্ত থাকায়, সওদাগরের চোখের ধূর্ত দৃষ্টিটা খেয়াল হলো না।

“আমার নাম মহেন্দ্র পুলা। আমার ভাইয়েরা সব বড় বড় ব্যবসায়ী। আমাকে ছেড়ে দিলে ওনারা অনেক টাকা দেবেন।”

“আমরা কাউকে অপহরণ করি না,” শান্ত স্বরে ব্যাখা করলো ক্রিস্টোফার।

“আমার ভাইয়েরা এখান থেকে কাছেই থাকে। সব কিছুর ব্যবস্থা করতে কয়েকটা দিন লাগবে মাত্র।” লোকটা হাঁটু মুড়ে বসে অনুনয় করতে লাগলো। “সামনেই বর্ষাকাল আসছে, তখন রাস্তাঘাটে আর পালকি চলবে না। বর্ষার আগে তাই বড়সড় একটা দাও মারতে পারলে আপনাদেরই লাভ।”

“ঐ খচ্চরে যে স্বর্ণ আছে তা দিয়েই হেসে খেলে চলে যাবে অনেকদিন।”

সওদাগরের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। “ওটার জন্যে আপনারা আমার লোকগুলোকে মেরেছেন? ওই খচ্চরের পিঠের জিনিসের জন্যে?”

“তাছাড়া কি?” ক্রিস্টোফার কোপ দেওয়ার জন্যে তরবারি তুললো। লোকটার চেহারার আতংক তারিয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে। বালিশ জাহান্নামে যাক। ওগুলো কোনো অশিক্ষিত চাষীর কাছে বেঁচে দেবে। রক্তের দাগ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা থাকার কথা না। তরবারি নামিয়ে কোপ দিলো ও।

“থামো।”

তামান্নার গলা শুনে সওদাগরের ঘাড়ের এক ইঞ্চি আগে ক্রিস্টোফারের তরবারি থেমে গেলো। এই একটা মাত্র কণ্ঠই ক্রিস্টোফারকে থামাতে পারে। ঘুরে দেখে তামান্না একটা মোটা সোটা বস্তা নিয়ে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। সওদাগর ততোক্ষণে আকূল হয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।

“কি হয়েছে?”

কোনো কথা না বলে তামান্না লোকটাকে টেন দাঁড় করিয়ে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বললো, “স্বর্ণ সব কোথায়?”

“খচরে নেই?” জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

বাম হাত দিয়ে তামান্না উপুড় করে দিলো বস্তাটা। চেরির বানানো ব্রান্ডির ছোট একটা বোতল মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে গেলো। তারপরেই কাগজে মোড়া আরো কিছু জিনিস ধুপধাপ পড়তে লাগলো মাটিতে। ক্রিস্টোফার তরবারির ডগা দিয়ে একটা মোড়ক ছিঁড়ে ফেলতেই ভেতর থেকে কিছু ধাতব খণ্ড বেরিয়ে এলো। একটা তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই বেকে গেলো সেটা।’

“সীসা?”

সওদাগর একটা আক্রমণ আশা করে হাত দিয়ে মুখ আড়াল করলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে জিজ্ঞেস করলো, “স্বর্ণ কোথায়?”

“স্বর্ণ নেই।”

“তাহলে তিনদিন আগে ব্রিঞ্জোয়ানে যে কাপড়গুলো নিয়ে গেলি সেগুলোর কি হয়েছে?” তামান্না জানতে চাইলো।

“ওখানকার ইংরেজ লোকটা একটা পাক্কা চোর। আমার জিনিস নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু টাকা দেয়নি। তার বদলে আপাতত এই সীসা দিয়েছে। গরমের সময় আসলে বাকি টাকা স্বর্ণে পরিশোধ করবে বলেছে।”

“মিথ্যা কথা,” ঠাণ্ডা স্বরে বললো তামান্না। “এর কাপড়চোপড় সব খুলে পরীক্ষা করে দেখো, আর যদি কাপড়ের নিচে কিছু না পাও তাহলে চামড়া খুলে দেখো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে স্বর্ণ।”

“না,” আর্তনাদ করে উঠলো লোকটা। “আমি মরে গেলে আপনাদের কোনোই লাভ হবে না। জ্যান্ত থাকলে কিন্তু লাভ করতে পারবেন।”

“এ চাচ্ছে আমরা যেনো ওকে না মেরে ওর ভাইদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করি,” ক্রিস্টোফার বললো।

“আমরা কাউকে অপহরণ করি না,” সোজাসুজি বলে দিলো তামান্না। “আর ধরা না পড়ে মুক্তিপণ আদায় করবোই বা কিভাবে? তোর পরিবারের লোকজন আমাদের সাথে দরদরি করতে চাইবে। আর প্রতিবার খবর দেওয়া নেওয়ার সময়ে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।”

“কোন দরাদরি করতে হবে না,” সওদাগর ওয়াদা করলো। “কতে চান বলুন শুধু। আমি আমার ভাইদের কাছে খবর পাঠাবো যাতে বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা দিয়ে দেয়। আপনারা যেখানে চান সেখানেই ওরা টাকাটা রেখে আসবে।”

“যদি তোকে জ্যান্ত ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে ওরা কেনোই বা টাকা দেবে?”

“কারণ তাহলে আমাকে ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর থাকবে না।” সওদাগরের চেহারার রঙ ফিরে আসছে আবার। সে হাতের শেষ আংটিটা খুলে তামান্নার সামনে তুলে ধররলো। “আমি এক সামান্য ব্যবসায়ী। চলুন এমন কিছু করি যাতে দুজনেই লাভবান হতে পারি।”

*

“আমি একে বিশ্বাস করি না, তামান্না বললো। একটা পাথরের আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে বসে নিচু স্বরে কথা বলছে ওরা। গভীর রাত এখন। আকাশে চাঁদ আছে, কিন্তু চাঁদনী নেই। ফলে অন্ধকার আরো জাঁকিয়ে বসেছে। ব্যাপারটা অবশ্য কাকতালীয় কিছু না। আজকের সব কিছু অনেকবার আলোচনা আর তর্কাতর্কির পর ঠিক করা হয়েছে। স্থান, সময়, দিক নির্দেশনা-সব। প্রায় ডজনখানেক পরিকল্পনা নাকচ করে শেষে এটা নির্ধারণ করেছে ওরা। ক্রিস্টোফার বেশ কয়েকবার ভেবেছে তামান্না বোধহয় বন্দিকে খুন করে সব তর্ক অবসান করে দেবে। এখনো অবশ্য সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় নি।

রাতের বাতাসে একটা অস্পষ্ট পেঁচার ডাক ভেসে এলো। কিন্তু ডাকটা হুবহু পেঁচার মতো না। ক্রিস্টোফার শক্ত হয়ে গেলো।

“সংকেত দিচ্ছে।”

পাহাড়ের উপর একটা পাথুরে গুহা নির্ধারণ করেছে ওরা। রাস্তা বা গ্রাম থেকে বহু দূরে। রাস্তা ভরে পাহারাদার রেখেছে, যাতে ওরা কোনো চালাকি করার চেষ্টা করলে সাথে সাথে ধরা পড়ে যায়। এখনই প্রমাণ হবে পুলা কি আসলেই কথা দিয়ে কথা রাখে কিনা।

“টাকা পেলেও আমাদের কিন্তু ওকে মেরেই ফেলা উচিত, তামান্না অস্থির হয়ে উঠছে। “ও আমাদের চেহারা আর নাম দুটোই জানে। ও বাড়ি ফিরেই রানির কাছে অভিযোগ করবে, আর রানিও আমাদের ধরার জন্যে সৈন্য পাঠিয়ে দেবে।”

“এ একটা বলদ,” ক্রিস্টোফার বললো। “জান নিয়ে যে পালাতে পারছে সে জন্যেই ওর ঈশ্বরদের ধন্যবাদ দেবে। আর এতেই সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। তাছাড়া, মুক্তিপণ নেওয়ার পরেও যদি খুন করি তাহলে কথাটা জানাজানি হয়ে যাবে। পরের বার কাউকে অপহরণ করলে আর কেউ টাকা দেবে না।”

তামান্না কাঁধ ঝাঁকালো, “আমাদের যথেষ্ট স্বর্ণ আছে।”

“যথেষ্ট স্বর্ণ বলে দুনিয়াতে কোনো কিছু নেই।”

পাথুরে মেঝেতে পদশব্দ পেতেই ওরা চুপ করে গেলো। দুজন কুলি এসে দাঁড়ালো গুহাটার মুখে। পিঠে বিশাল ওজনের দুটো সিন্দুক। চাপে ওদের পিঠ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ওরা সিন্দুক দুটো নামিয়ে রেখে হাত ডলতে ডলতে অন্ধকারে ইতিউতি তাকাতে লাগলো।

“মালিক পুলাকে নিতে এসেছি আমরা,” একজন বললো।

ক্রিস্টোফার টের পেলো তামান্না পিস্তল তুলে নিচ্ছে। ক্রিস্টোফার ওকে বাধা দিলো। “আগে শুনে নেই কি বলে?”

“আমরা বলেছিলাম মাত্র একজন পাঠাতে,” জিজ্ঞেস করলো তামান্না। ওর কথা পাথরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। ফলে কোথা থেকে কথা বলছে। সেটা বোঝা গেলো না। কুলিগুলো এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। এই অন্ধকারেও ওদের আতংকিত চেহারা দেখতে পেলো ক্রিস্টোফার।

“সিন্দুকটা একজনের পক্ষে টেনে আনা সম্ভব না,” একজন কুলি উচ্চস্বরে মিনতি করলো।

“তাহলে তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।”

“মালিকের কি হবে?”

“টাকা গোণা শেষ হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এখন ভাগ।” তামান্না পিস্তল তুলে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লো। প্রতিধ্বনির কারণে মনে হলো যেনো পুরো এক কোম্পানি বন্দুকধারী সৈনিক একযোগে গুলি ছুঁড়েছে।

কুলিগুলো যাওয়ার পরেও ক্রিস্টোফার আর তামান্না নড়লো না। গুহার মাঝখানে একটা প্যাগান বেদীর মতো বসে আছে সিন্দুকটা। হাতের তালু চুলকাতে লাগলো ক্রিস্টোফার। সিন্দুকটা খুলতে আর তর সইছে না। কিন্তু প্রহরী এসে সব ঠিক আছে সেই সংকেত দেওয়ার আগ পর্যন্ত ওঠার উপায় নেই।

“ওরা একারাই এসেছিলো,” নিশ্চিত করলো লোকটা। “এমনভাবে পালিয়েছে যেনো বাঘে তাড়া করছে।”

ক্রিস্টোফার সিন্দুকটার দিকে এগিয়ে গেলো। ভারি মেহগনী কাঠ দিয়ে বানানো ওটা। গায়ে চমৎকার নকশা। জিনিসটা সম্ভবত মশলা অথবা ওষুধ রাখার কাজে ব্যবহার হতো। কারণ ভিতর থেকে মৌরির সুঘ্রাণ ভেসে আসছে।

টান দিয়ে ঢাকনাটা খুললো ও। এই মরা চাঁদের আলোতেও ঝিকমিকিয়ে উঠলো ভিতরটা।

এক হাতা মুদ্রা তুলে নিলো ক্রিস্টোফার। ধাতুগুলো আঙুলের ফাঁক দিয়ে নাড়াচাড়া করতেই অন্যরকম একটা অনুভূতি হতে লাগলো ওর। তামান্না সেগুলো ওর হাত থেকে ফেলে আবার ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলো।

“পরে। আগে এখান থেকে ভাগতে হবে। ওই কুলিগুলো লোকজন নিয়ে ফিরে আসতে পারে আবার।”

“আর পুলা?”

তামান্নার চোখের জ্বলজ্বলে ভাব দেখেই ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো ওর মনের ভিতর কি চলছে। ও নিজের আঙুলে একটা ছুরির ধার পরীক্ষা করলো।

ক্রিস্টোফার সিন্দুকটায় লাথি মেরে বললো, “একবার ডাকাতি করে যতো টাকা পাওয়া যায় তার চাইতে বহু গুণ এর ভিতর আছে।”

“ওর জিভটা কেটে দেওয়া যায় যাতে আর আমাদের কথা কাউকে বলতে না পারে, তামান্না জবাব দিলো।

“ও কিন্তু লিখতে পারবে,” ক্রিস্টোফার ধরিয়ে দিলো।

“তাহলেতো হাতটাও কেটে ফেলতে হবে।”

“ওর পরিবার কিন্তু ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নেবে না,” ক্রিস্টোফার বোঝানোর চেষ্টা করলো। এরকম জরুরি অবস্থায় তামান্না কি ওর সাথে মজা করছে নাকি আসলেই এসব বলছে তা ও ধরতে পারছে না।

কোনো জবাব না দিয়ে তামান্না ওর লোকদের শিষ দিয়ে পুলাকে আনতে বললো। ওরা ঠেলতে ঠেলতে পুলাকে গুহার ভিতরে নিয়ে এলো। পুলার চোখ বাধা, হাতও পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর এই ভ্যাপসা গরম রাতেও ও ঠকঠক করে কাঁপছে সে।

ক্রিস্টোফার তামান্নার মুখোভঙ্গি পড়ার চেষ্টা করছে। তবে অনেক চেষ্টা করেও ওর উদ্দেশ্যটা ধরতে পারছে না।

“আচ্ছা টাকাই যদি আসল না হয়, তাহলে আমরা এসব করছি কেনো?” ক্রিস্টোফার শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো।

তামান্না ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে ছুরিটা ওর বেল্টের খাপে ঢুকিয়ে রেখে দিলো। চুপিসারে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ক্রিস্টোফার। পুলার জন্যে ওর বিন্দুমাত্র দরদ নেই। লাভের সম্ভাবনা থাকলে ও নিজেই খুশি মনে পুলার উপর যতো ইচ্ছা অত্যাচার করতো। কিন্তু এখন ওকে অক্ষত ছেড়ে দেওয়াই লাভ বেশি।

“তুই এখানেই থাক,” তামান্না পুলাকে বললো। “আর মনে মনে ভগবানকে ডাক যাতে সাপ আর হায়েনার আগেই তোকে অন্য কেউ যেনো খুঁজে পায়।”

“দয়া করে বাঁধন খুলে দিয়ে একটা তরবারি রেখে যান,” অনুনয় করলো পুলা।

“ভালোমতো টানাটানি করলে বাধন এমনিই খুলে যাবে,” তামান্না বললো। “আর তোর বাড়ির লোকেরাও খুঁজতে খুঁজতে চলে আসবে।”

কথাটা বলে যাওয়ার জন্যে ঘুরলো তামান্না।

“আগে টাকাটা গুনে নিলে ভালো হতো না?” ক্রিস্টোফার বললো। “যদি ওরা কম দেয়?”

“তাহলে ওরা দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, সেখানে গিয়ে ওদের খুন করে আসবো। ওদের বৌ বাচ্চা সবগুলোকে মারবো। এমনকি ভাই, বোন, চাকরবাকর সব। আর সবার শেষে মারবো একে।” বলে পুলার গায়ে একটা লাথি হাকালো। “বুঝতে পেরেছিস?”

“হ্যাঁ,” গোঙাতে গোঙাতে বললো পুলা। “ওরা একটা পয়সাও কম দেবে না। ভগবানের কসম।”

“এখানে দেরি করা মানেই ধরা পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া-আর সাথেও কাউকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ও থাকলে আমাদের ঝামেলা বাড়বে। আর তুমি যেহেতু একে বাঁচিয়ে রাখতে এতো বেশি আগ্রহী…” বলে ও কাঠের সিন্দুকটার দিকে ইঙ্গিত করলো। “তুমিই তাহলে নাও ওটা।”

ক্রিস্টোফার সিন্দুকটা তুলতে গিয়ে বুঝতে পারলো যে কুলিগুলো এটার ওজন সম্পর্কে বাড়িয়ে বলেনি কিছু। ও অনেক শক্তিশালী, তবুও ওটাকে কাঁধ পর্যন্ত তুলতে পারলো না। ব্যথায় কাতরে উঠতেই দুজন লোক দৌড়ে এলো সাহায্য করতে। দুজনে দুপাশের দুটো হাতল ধরলো কিন্তু জায়গাটা সমতল না হওয়ায় হোঁচট খেয়ে গেলো পড়ে। তামান্না এগিয়ে গিয়ে ওদেরকে বকতে লাগলো।

পাহাড় থেকে নেমে এসে নিচের ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেলো ওরা। এখানে চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। শুধু বন্য প্রাণী আর ডাকাতেরা ঘরে এদিক দিয়ে। ক্রিস্টোফারের হাতের ব্যথা বাড়তেই লাগলো। পুলার প্রতি প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা জন্ম নিলো ওর। শেষে মনে মনে কিভাবে পুলাকে মারা যায় সেসব কল্পনা করে ব্যথাটা ভুলে থাকার চেষ্টা করতে লাগলো।

অবশেষে একটা ফাঁকামতো জায়গায় এসে তামান্না থামার আদেশ দিলো। ক্রিস্টোফার যেইমাত্র সিন্দুকটা খুলে স্বর্ণমুদ্রাগুলো গোনা শুরু করলো তখনি যাদুমন্ত্রের মতো ওর হাতের ব্যথা দূর হয়ে গেলো। প্রায় আধা ঘণ্টা লাগলো গুণে শেষ করতে। শেষ করার পর দেখা গেলো সবার মুখেই চওড়া হাসি। পুরোটাই আছে এখানে। এমনকি তামান্নাও কঠিন ভাব ছেড়ে ক্রিস্টোফারের পাশে এসে বসে ওর পায়ের উপর হাত রেখে উরুতে চিমটি দিতে লাগলো।

“বেশিক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যাবে না কিন্তু,” সাবধান করলো তামান্না। “একটা। শহরে পালিয়ে যেতে হবে, বড় কোনো শহরে। যেখানে আমাদেরকে কেউ খেয়াল করবে না বা চিনবেও না। ওখানে রসদপত্র কিনে বর্ষাটা কাটিয়ে দেবো। তারপর একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে বের করে অপেক্ষা করতে থাকবো। আবার যখন লোকজন রাস্তাটা ব্যবহার শুরু করবে তখন কাজে নেমে পড়বো।”

বর্ষাকালের দীর্ঘ বৃষ্টিময় বিকেলগুলোর কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো ক্রিস্টোফারের। ও আর তামান্না কিভাবে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারবে সেটা জানা আছে ওর। ভাবনাটা মাথায় আসতেই পায়জামার ভিতরে একটা শিহরণ অনুভব করলো যেনো। তামান্নার হাতটা টেনে নিয়ে নিচের দিকে ঠেলে দিলো ও। তামান্নাও হেসে দুষ্টুমিভরা চোখে চাইলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ক্রিস্টোফারের হাত ধরে টেনে জঙ্গলের আরও ভিতরে একটা ঘাসে ছাওয়া জায়গায় নিয়ে এলো। পা দিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে ঘাস মাড়িয়ে দিলো যাতে সাপ খোপ থাকলে সরে যায়।

মুহূর্ত পরেই এই জগত ছেড়ে অন্য আর এক অলৌকিক জগতে হারিয়ে গেলো যেনো ওরা। যে জগতে কামনা আর সুখ বাদে আর কিছু নেই।

*

ওরা জেগে উঠে একজন আর একজনের বাহুডোরে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কি জন্যে ঘুম ভেঙেছে বুঝতে পারছে না ক্রিস্টোফার। আশেপাশে টু শব্দটাও নেই, কেমন একটা অশুভ নীরবতায় ছেয়ে আছে চারপাশ। ভয়ানক আতংক ছড়িয়ে বুকের ওপর চেপে বসছে সেটা।

“কি হয়েছে?” তামান্না বলতে গিয়েও থেমে গেলো, কারণ দুজনেই কুকুরের ডাক শুনতে পেয়েছে। ওরা দ্রুত উঠে পড়ে ত্রস্ত হাতে কাপড় খুঁজতে লাগলো।

ক্রিস্টোফার তামান্নার হাত ধরলো। “ওরা শিকারে বেরিয়েছে, আর আমরা হচ্ছি শিকার।”

“স্বর্ণটা নিয়ে আসি চলো।”

“এখন ওসব নেওয়া যাবে না। ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারবো না। এক মাইল যাওয়ার আগেই কুকুর ধরে ফেলবে। তাড়াতাড়ি!” ওরা যেখানে ওদের সঙ্গীসাথী আর স্বর্ণে ভরা সিন্দুকটা রেখেছিলো সেখানে দৌড়ে গেলো।

লোকজন এলোমেলো ভাবে জায়গাটায় ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বেশিরভাগই আরকের বোতল খুলে বসেছে। ক্রিস্টোফার গালাগাল করতে করতে সবচে কাছের লোকটার গায়ে লাথি ছুড়লো।

“ওঠ, শালা মাতালের দল।”

“ছাড়ো ওদের, যা আসছে তা ওদের প্রাপ্য, তামান্না আদেশ দিলো ক্রিস্টোফারকে। “পকেটে যতোটা সম্ভব স্বর্ণ নিয়ে নাও, তারপরেই আমরা পালাবো।”

সিন্দুকটা তখনও মাঝে রাখা। ওরা দৌড়ে গেলো ওটার দিকে। ক্রিস্টোফার ঢাকনা খুলে যতোগুলো পারলো স্বর্ণের প্যাগোড়া নিজের পকেটে ভরে নিলো।

“হয়েছে!” তামান্না দড়াম করে ঢাকনাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর কান পেতে আশেপাশে শোনার চেষ্টা করলো। কুকুরের ডাক আরো জোরে শোনা গেলো, আর ক্রিস্টোফারের মনে হলো ওগুলোর পায়ের ধাক্কায় জমি থরথর করে কাঁপছে।

“ঘোড়া!” অবাক হলো ক্রিস্টোফার। “তার মানে ওরা আসলেই আমাদের পিছু নিয়েছে।” এতোগুলো মাস ধরে ওরা এসব রাস্তায় চরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঁচ কি ছয়জনের বেশি ঘোড়সওয়ার চোখে পড়েনি। যার একটা ঘোড়া পালার সামর্থ্য আছে, তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। ক্রিস্টোফার আবার মাথা কাত করে শোনার চেষ্টা করলো। শুনে মনে হলো পুরো একটা অশ্বারোহী দল ওদেরকে ধরতে বেরিয়েছে।

তামান্নার হাত ধরে জঙ্গলের ভিতরের দিকে দৌড় দিলো ও। মাটি আগাছায় ভরে, আর ওগুলোর অনেকগুলোই কাঁটাওয়ালা। আধা মাইল যাওয়ার আগেই দুজনের হাত পা ছড়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। পিছনে ঘোড়ার হ্রেষা ডাক আরো কাছিয়ে আসছে। মাতাল লোকগুলো আর স্বর্ণ ভরা সিন্দুকটা খুঁজে পাওয়া মাত্র ওদের ধাওয়াকারীদের উল্লাস ধ্বনিও কানে আসলো।

ক্রিস্টোফার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আশা করলো যাতে গাছের ফাঁক দিয়ে ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণটা চোখে পড়ে। কারণ রাতের অন্ধকারে ও কোনদিকে যে দৌড়াচ্ছে তার কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। ওরা শুধু পিছনের ঘোড়ার শব্দের আগে আগে দৌড়ে চললো। সূর্য পুরোপুরি ওঠার আগ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও থামলো না।

আচমকা ওদের সামনে জঙ্গল শেষ হয়ে গেলো। ঝোঁপ জঙ্গল মাড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিলো ওরা। তাই ব্যাপারটা প্রথমে খেয়াল করতে পারলো না। একেবারে শেষ মুহূর্তে ক্রিস্টোফারের চোখে পড়লো যে সামনে কিছুই নেই। ও তামান্নাকে টান দিয়ে একটা হাত দিয়ে কাঁধের পিছন দিকে জড়িয়ে ধরলো। একটুর জন্যে বেঁচে গেলো ওরা। নইলে দুজনেই একসাথে খাড়া খামায় পা হড়কে সোজা কয়েকশো ফুট নিচে এক শুকনো পাথুরে নদীবক্ষে গিয়ে পড়তো।

বর্ষাকালে নদীটা প্রমত্তা হয়ে ওঠে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন সেটা চোখা পাথরের ভরা একটা খাদ বাদে আর কিছু না।

কিছুক্ষণ ওটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তামান্না। তারপর মাথা ঘুরিয়ে পিছনের শব্দ শোনার চেষ্টা করলো। কুকুরগুলো খুবই কাছাকাছি চলে এসেছে। ওদের ঘ্রাণ কাছিয়ে আসায় উত্তেজনায় গরগর করছে।

“আমি এদের হাতে ধরা দেবো না।” তামান্না মন ঠিক করে ফেললো। তারপর ক্রিস্টোফারের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “আমি লাফ দিচ্ছি।”

“না, আমি তা করতে দেবো না।” ক্রিস্টোফার আরো জোরে তামান্নার কবজি চেপে ধরলো। পিছনে ঘোড়া আর কুকুরের আগমন ও নিজেও টের পাচ্ছে। সেই সাথে এখন যোগ হয়েছে মানুষের পদশব্দ।

“তাড়াতাড়ি মরবো এতে। ওরা যদি ধরতে পারে, তাহলে এতো অত্যাচার করবে যা সহ্য করার চেয়ে মরাই ভালো।”

“আই লাভ ইউ, ক্রিস্টোফার ওর মুখের সামনে বললো। “আর আমরা যতোক্ষণ বেঁচে আছি, ততোক্ষণ কোনো না কোনো উপায় বের হবেই।”

তামান্না হাত মুচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। আমি একবার তোমার কথা শুনে এখন পস্তাচ্ছি। আর না। জীবন থাকতে আমি ওদের হাতে ধরা দেবো না।”

তামান্না মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে প্রায় ছাড়িয়েই নিয়েছিলো, কিন্তু ক্রিস্টোফার আচমকা ওর উপর নিজের সমস্ত ভর চাপিয়ে দিয়ে জোর করে মাটিতে শুইয়ে দিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রথম কুকুরটা ওদের পিছনের আগাছার জঙ্গল থেকে লাফ দিয়ে সামনে বাড়লো। কুকুরগুলোর পরে উর্দিপরা লোকজন ছুটে এলো পিছনে। হাতে মুগুর। ওরা দৌড়াতে গিয়ে সোজা মাটিতে পড়ে থাকা ক্রিস্টোফার আর তামান্নার উপর হোঁচট খেলো। তখনও ধ্বস্তাধস্তি করে যাচ্ছে ওরা। সৈন্যরা হাতের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে অর্ধ অচেতন করে ফেললো ওদেরকে। তারপর ঝটপট হাতে হাতকড়া পরিয়ে গলায় শেকল বাঁধা। বেড়ি পরিয়ে দিলো। শেকলের অপর প্রান্ত দুটো ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা। ঘোড়া দিয়ে টেনে ওদেরকে আবার সেই ফাঁকা জায়গাটায় নিয়ে ব্রাসা হলো। যেখানে ওরা সিন্দুকটা আর মাতাল সঙ্গীদের ছেড়ে গিয়েছিলো।

সেখানে পৌঁছার পর ক্রিস্টোফার ওদের বন্দিকারীদের দেখতে পেলো। এরা সবাই নির্ভীক সৈনিক আর খুব ভালো ঘোড়সওয়ার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবার পরনে একই রকম ভারী কাপড়ের উর্দি, ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ, আর কোমরে কমলা রঙের একটা কাপড় বাধা। দেখেই বোঝা যায় এদের আত্মবিশ্বাস পাহাড় সমান। ক্রিস্টোফার ঠিক করলো যে ও মোটেও আগ্রাসী মনোভাব দেখাবে না, বা ও যে দক্ষ যোদ্ধা সেটাও প্রকাশ করবে না, বরং বিনয়ী আর ভদ্র ভাব দেখাবে। সেজন্যেই চোখ নিচু করে ওরা যা যা বললো তা শুনতে লাগলো।

ওদের সাবেক বন্দী, পুলা দাঁড়িয়ে আছে একেবারে মাঝখানে। এইতো খানিকক্ষণ আগেও যে ও নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে তোতলাচ্ছিলো বারবার তা বোঝার কোনো উপায় এখন নেই। নতুন কাপড় পরেছে সে। চুল দাড়ি আচড়ে সোজা হয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিস্টোফার আর তামান্নাকে দেখতে পেয়ে সন্তুষ্টির হাসি হাসলো সে।

“বাতাস এখন উল্টোদিকে মনে হচ্ছে, কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো ও।

“এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে খুঁজে পেলেন আমাদের?” কণ্ঠে যতোটা সম্ভব ভয় ঢেলে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

“স্বর্ণের গন্ধ পাই আমি।” পুলা কাঠের সিন্দুকটায় লাথি মেরে বললো। তারপর ঢাকনা খুলে নাক টেনে লম্বা একটা দম নিলো। “এটা থেকে যে মৌরির ঘ্রাণ আসছে সেটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিস? তোদের ধারণা আমার বাড়ির লোকজন মুক্তিপণের টাকা খামাখা এরকম একটা ভারি সিন্দুকে ভরে পাঠিয়েছে শুধু তোদেরকে একটু কষ্ট দেওয়ার জন্যে? প্রতিবার যখনই এটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখেছিস, তখনি সেখানে একটা করে চিহ্ন থেকে গিয়েছে। আরো ভালো করে বললে গন্ধ থেকে গিয়েছে। টুঙ্গার আর ওর কুকুরগুলোর সেই গন্ধ শুঁকে পিছু নিতে তাই কোনো কষ্টই হয়নি।”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ইঙ্গিতে দেখালো পুলা। চলনে বলনে সব দিক থেকে পুলা-র উল্টো সে। পুলা হচ্ছে বেঁটে, মোটা আর চেহারা গোল আলুর মতো। টুঙ্গার লম্বা, দেখতে ভয়ঙ্কর। চেহারার মাঝ বরাবর একটা কাটা দাগ। এতো জোরে আঘাত পাওয়ার পরেও লোকটা বেঁচে আছে কিভাবে ভেবে পেলো না ক্রিস্টোফার। পাগড়িতে একটা হলুদ রঙের পাখির পালক আটকানো। লোকটাকে দেখেই বোঝা যায় হুকুম করার জন্যেই জন্ম হয়েছে তার।

“আর আপনি তাহলে আসলে কে?” ক্রিস্টোফার জিজ্ঞে করলো।

“আমি কোনো সওদাগর না,” পুলা জবাব দিলো। আমি মহামান্য চিত্তাত্তিস্কারার রানি-র একজন উপদেষ্টা। উনি তার প্রজাদের দুঃখ কষ্ট একদম পছন্দ করেন না। তাকে যারা অসন্তুষ্ট করে উনি তাদের কেমন শিক্ষা দেন তা তোরা একটু পরেই দেখতে পাবি।”

টুঙ্গারের লোকজন সাথে আনা একটা গাড়িতে সিন্দুকটা তুলে নিলো। তামান্নার দলের সবাইকেই ঘোড়ার পিছনে শেকল দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। দলটা আগে বাড়লো।

ক্রিস্টোফার ঠিক জানে না যে কতোদূর হাঁটতে হলো ওদের। টুঙ্গার যখন থামার আদেশ দিলো তখন ওর পা এতো বেশি ব্যথা করে উঠলো যে মনে হলো আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না। বন্দীরা সবাই ধপ ধপ করে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়লো। মাছি এসে বসতে লাগলো ক্রিস্টোফারের উপর; পিঁপড়া আর নানা পোকামাকড় ওর ছড়ে যাওয়া পায়ের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু হাত বাঁধা থাকায় ওগুলোকে তাড়িয়েও দিতে পারলো না।

কয়েকজন প্রহরী বনের ভিতরে চলে গেলো। এই ব্যথার ভিতরেও ক্রিস্টোফার কাঠ কাটার ছন্দময় কুড়ালের শব্দ শুনতে পেলো। সম্ভবত ওরা রান্না করার জন্যে লাকড়ি কাটছে। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ও।

“আমাদেরকে কি করবেন?” পুলাকে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার। ওর মাথায় একটা বুদ্ধির উদয় হয়েছে। “রানির কাছে নিয়ে যাবেন?”

পুলা অবজ্ঞাসূচক একটা শব্দ করলো। “তোর মতো একটা অসভ্য ইতরের জন্যে আমি মহামান্য রানির সময় নষ্ট করাবো না।”

“আমদেরকে ওনার কাছে নিয়ে যান, ক্রিস্টোফার অনুনয় করল। “আমার যে দক্ষতা তা ওনার ভালোই কাজে লাগবে।”

“হ্যাঁ, তোর জন্যে ওনার একটা কাজ আছে,” পুলা গোমড়া মুখে ওকে আশ্বস্ত করল। “তবে সেজন্যে ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কিছুই করা লাগবে না।”

প্রহরীরা বনের ভিতর থেকে একটা গাছ টেনে নিয়ে আসলো। একজন মানুষের বাহুর সমান মোটা। ওরা বাকল চেঁছে ফেলে এক প্রান্ত কেটে একটা সূচালো গজালের মতো বানিয়ে ফেললো। বাকিরা হাতের শাবল দিয়ে রাস্তার ধারেই একটা গর্ত খুঁড়তে লাগলো। বন্দী ডাকাতেরা চেয়ে রইলো সেদিকে। গলায় বেড়ি পরে থাকার পরেও তারা আতংকে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো ওরা। বুঝতে পেরেছে যে ওদেরকে দিয়ে এরা কি করতে যাচ্ছে।

পুলা ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর হাতটা অর্ধেক তুলে সবার দিকে একে একে তাক করতে লাগলো, যেনো সে কসাইয়ের দোকানের কোনো খরিদ্দার, ঠিক বাছাই করতে পারছে না কোনটা থেকে মাংস নেবে। ক্রিস্টোফারের উপর ওর দৃষ্টি এসে স্থির হলো।

“তুই সবার শেষে,” ওকে বললো পুলা। “তোর সামনে একে একে তোর সব সঙ্গী সাথী মরবে এখন।”

ক্রিস্টোফারের পাশে বসে থাকা একজনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো ও। কৃশকায় একজন লোক, নাম বিজয়। বিজয়ের দায়িত্ব ছিলো পুলার দিকে নজর রাখা। আর দায়িত্ব পালনের সময় ও মোটেও খুব বেশি ভালো আচরণ করেনি। টুঙ্গারের লোকেরা ঘোড়া থেকে শেকলটা খুলে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে এসে দাঁড় করালো ওকে। ধ্বস্তাধস্তি শুরু করলো বিজয়। কিন্তু সৈন্যেরা ওকে উপুড় করে মাটির সাথে চেপে ধরলো। টুঙ্গার এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো ওর পাশে।

টুঙ্গারের হাতে এক টুকরো খাসীর চর্বি দেখা গেলো। এটা দিয়ে রাইফেলের কার্তুজে তেল দেয় ও। চর্বিটা ও চোখা খুটিটার গায়ে লেপে দিলো। ওর লোকেরা উল্লাস করে নোংরা ইংগিত করতে লাগলো।

বিজয় মোচড়ামুচড়ি করতে করতে এতো জোরে চিৎকার করতে লাগলো যে প্রহরীরা ওর মুখের ভিতরে একটা ন্যাকড়া ঢুকিয়ে দিলো।

যে প্রহরীগুলো বিজয়ের পা ধরে রেখেছিলো, তারা ও দুটোকে দুদিকে টেনে ধরলো। আরও দুজন লোক এসে সূচালো দণ্ডটা এনে ওর নিতম্বের মাঝে চেপে ধরলো। ক্রিস্টোফারের সহ্য হলো না দৃশ্যটা। চোখ বন্ধ করে ফেললো। তবে হাত বাঁধা থাকায় কান চাপা দিতে পারলো না। বিজয় ওর মুখের ন্যাকড়াটা ঠেলে ফেলে দিয়েছে। শুলটা ওর পায়ুপথ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতেই প্রচণ্ড আর্তনাদে জঙ্গল দুই ভাগ হয়ে গেলো যেনো। এরা এদের কাজ কর্ম ভালোই পারে। বিজয়ের চিৎকার থেকেই ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো যে এরা এমনভাবে শূলটা ঢুকিয়েছে যাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গে খোঁচা না লাগে। তাহলে খুব তাড়াতাড়ি মরে যাবে বন্দী।

ক্রিস্টোফার চোখ খুললো। বিজয় পড়ে আছে মাটিতে, চিৎকার চলছেই। চিৎকার দ্বিগুণ হয়ে গেলো যখন প্রহরীরা শূলটা সোজা উপরের দিকে তুলে ধরলো। বিজয় দণ্ডটা বরাবর নিচে নেমে এলো, আর চোখা মাথাটা ওর শরীরের আরো গভীরে ঢুকে গেলো। কিন্তু প্রহরীরা দণ্ডটার মাঝ বরাবর একটা আড়কাঠ লাগিয়ে দিয়েছে যাতে খুব বেশি ভিতরে না ঢোকে। বিজয় তড়পাতে তড়পাতে একসময় নিস্তেজ হয়ে শিকে ঢোকানো মুরগির মতো ঝুলে রইলো। ওর পায়ু দিয়ে রক্ত বেরিয়ে নিচেই একটা ছোটোখাটো পুকুর হয়ে গিয়েছে। মাছির দল তাতে মহানন্দে সাঁতার কাটছে।

প্রহরীরা শূলটার গোড়া একটু আগে খোঁড়া গর্তে ঢুকিয়ে আবার মাটি আর পাথর দিয়ে ভরে দিলো, যাতে ওটা খাড়া হয়ে থাকে। তারপর পিছনে সরে এসে নিজেদের কাজ উপভোগ করতে লাগলো। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। বিজয় কতক্ষণ টিকবে তা নিয়েও নিজেদের মধ্যে বাজি ধরতে শুনলো ক্রিস্টোফার। বেশিরভাগই বললো দুই কি তিন দিন। বিজয় এখন আর চিৎকার করছে না, ফোঁপাচ্ছে আর বাতাসের জন্যে হাঁসফাস করছে। কারণ দণ্ডটার খোঁচায় ওর ফুসফুস ছ্যাদা হয়ে গিয়েছে।

পুলা সামনে এগিয়ে এসে চেহারায় একজন ধর্ষকামীর আনন্দ নিয়ে ক্রিস্টোফারের দিকে চেয়ে রইলো।

“এখান থেকে চিত্তাত্তিঙ্কারা প্রায় বিশ মাইল। প্রতি দুই মাইল পর পর তোর একজন লোকের এই হাল করবো আমি। তারপর যখন রানির মহলে পৌঁছাবো, তখন তোকে আর তোর ঐ মাগীটাকে সদর দরজার দুই পাশে গেঁথে রাখবো। তাহলেই সবার শিক্ষা হবে যে যারা রানির কর্মচারীদের গায়ে আঙুল তোলে বা তার ব্যবসায় বাধা দেয়, তাদের কি অবস্থা হয়।”

*

পরের দুই দিন ধরে পুলা তার হুমকি অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। একে একে সবগুলো ডাকাতকেই ধরে নিয়ে রাস্তার ধারে শূলে চড়িয়ে দেওয়া হলো। অবশেষে যখন ওরা পাহাড়ের নিচের মহলে পৌঁছালো তখন শুধু ক্রিস্টোফার আর তামান্নাই বাকি আছে।

ক্রিস্টোফার ভেবেছিলো বারবার একই দৃশ্য দেখতে দেখতে হয়তো ওর আর এ বাপারে কোনো অনুভূতি থাকবে না। কিন্তু দেখা গেলো এতে করে। আতংক আরো কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। যতোবার ও কারো পিছন দিক। দিয়ে গজাল ঢুকে যাওয়া দেখলো, ততোবার ওর নিজের পায়ুর পেশিও সঙ্কুচিত হতে লাগলো। শত চেষ্টা করেও এই ভয়ানক দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলো না। টানা কয়েকদিন দানা পানি না পেয়ে ও উল্টাপাল্টা দেখা আরম্ভ করলো। স্বপ্নে দেখতে লাগলো যে ও ওর বাবার পড়ার ঘরে উপস্থিত, পায়জামা গোড়ালি পর্যন্ত নামানো, একটা চেয়ারের উপর বাঁকা হয়ে অপেক্ষা করছে কখন চাবুকের বাড়ি পড়বে। আর ওর মা চুপচাপ ঘরের এ কোণে বসে ওকে শক্ত হতে বলছে। একবার স্বপ্নে দেখলো ও তামান্নাকে আদর করছে। আবেশে তামান্না হাত ক্রিস্টোফারের পিঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তামান্না যখন ওর হাত সামনে আনলো, ক্রিস্টোফার দেখলো সেই হাত দিয়ে ওর পিঠ থেকে এক তাল মাংস খুবলে নিয়ে এসেছে।

দ্বিতীয় দিন বিকেলের শেষে ওরা মহলের সদর দরজায় গিয়ে পৌঁছালো। ওদের ঠিক উপরে আকাশে পাখিরা চক্কর দিচ্ছে। যেন ওরা আগেই টের পেয়েছে যে একটু পরেই ওদের ভোজের জন্যে পচা মাংস পাওয়া যাবে। মহলের ভিতরের লোকেরাও বেরিয়ে এলো কাহিনি দেখার জন্যে।

টুঙ্গারের লোকেরা জঙ্গলে থাকতেই গাছ কেটে, এক প্রান্ত চোখা বানিয়ে প্রস্তুত করে রেখেছে। ক্রিস্টোফার আর তামান্নাকে উলঙ্গ করে রাস্তার মাঝে বসিয়ে দিলো সৈন্যরা। দুজনের মাঝে দূরত্ব কয়েক ফুট। পুলা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে সমাগত লোকজনের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে লাগলো। ওর উচ্চ কিন্তু আত্মম্ভরি গলায় ক্রিস্টোফার আর তামান্নার সকল অপরাধের গা শিউরানো বর্ণনা দিলো প্রথমে। দর্শকেরা সবাই আঁতকে উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের ঘামে ভেজা চোখ দিয়েও ওদের চেহারা পড়তে পারলো ক্রিস্টোফার। ভয় পেলেও ওরা সবাই মজা দেখতে আগ্রহী।

পুলা তার বক্তব্য শেষ করলো রানির অকুণ্ঠ প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে। ক্রিস্টোফার ইতিউতি তাকাতে লাগলো। রানি ওর শাস্তি দেখতে এসছেন কিনা দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে কোথাও দেখা গেলো না। পুলা টুঙ্গারের দিকে ইংগিত করতেই ও ওর একজন লোককে কিছু একটা আদেশ দিলো।

ওরা শূল দুটো নিয়ে এলো! উঁচিয়ে ধরে রেখেছে যাতে দর্শকেরা ওটার তীক্ষ্ণতা ভালোমতো দেখতে পায়। ওগুলো কিভাবে ওদের শরীরে ঢুকে যাবে সেটা ভেবে অনেকেই শিহরিত হলো। শূল দুটো দেখেই ক্রিস্টোফারের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়লো। উল্টোপাল্টা বকতে আরম্ভ করলো ও। ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিচু গলায় বিড়বিড় করতে লাগলো। “আমাকে মাফ করে দাও। আমি ভালো হয়ে যাবো। দরকার হলে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে রানির পায়ে চুমু খাবো। আমি ওনার দাস হয়ে থাকবো। সারাজীবন ওনার সেবা করবো। ও ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও।”

দর্শকেরা মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। ওকে নকল করে ভেংচি কাটতে লাগলো অনেকে। আতংকের চোটে না বুঝেই ক্রিস্টোফার ইংরেজিতে বকবক আরম্ভ করেছে। এমনকি তামান্নাও ওকে আগে কখনো ইংরেজিতে কথা বলতে শোনেনি।

“চোপ,” নিজের ভাষায় বললো তামান্না। “মরবি তো মাথা উঁচু করে মর।”

পুলা বিরক্ত হয়ে, ভ্রু কুঁচকে লোকদেরকে দ্রুত কাজ শেষ করতে বললো। শুলটা প্রস্তুত করে ফেললো সৈন্যরা। ডগা থেকে খাসীর চর্বি ঝরে পড়ছে।

কিন্তু টুঙ্গারের মাথায় তখন অন্য চিন্তা খেলছে। ও পুলাকে ডেকে নিয়ে ক্রিস্টোফারকে দেখিয়ে রেগেমেগে কিছু একটা বলা শুরু করলো। মাথা ঠিকমতো কাজ না করায় ক্রিস্টোফার বুঝতে পারলো না যে ওরা কি বলছে। তবে বোঝা গেলো যে ব্যাপারটা জরুরি। সম্ভবত ওদেরকে অত্যাচার করার নতুন কোনো পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করছে।

তবে নতুন কোনো আদেশ নিষেধ আসার আগেই ওর নিতম্বের ভিতর দিয়ে ঢুকে গেলো শূল। টানা দুই দিন ধরে দেখতে থাকা ভয়ানক দৃশ্যগুলোর কারণে শূলটা শরীর স্পর্শ করা মাত্র চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। উপুড় হয়ে ধুলোর মধ্যে শুয়ে ও তামান্নার চোখের দিকে তাকালো। ও একদম সোজা হয়ে আছে। একটু শব্দ করছে না।

“ভালোবাসি তোমাকে,” ঠোঁট নেড়ে বললো তামান্না।

ওর মনের জোর দেখে লজ্জা লাগলো ক্রিস্টোফারের। ও-ও ঠোঁট কামড়ে পড়ে রইলো যতোক্ষণ না রক্ত বের হয়। শূলটা. প্রবেশের ব্যথা গিলে নেওয়ার চেষ্টা করলো পুরোটা। প্রহরীরা ওর সাথে শয়তানী করছিলো আরো বেশি। সামান্য একটু ঢুকিয়ে আবার বের করে নিচ্ছিলো। প্রতিটা কাতর ধ্বনিতে মজা পাচ্ছিলো ওরা। মারা পড়তে কতোক্ষণ লাগবে সেটাই ভাবছিলো ক্রিস্টোফার।

আবার ওটাকে বের করে নেওয়া হলো। একেবারে পুরোটা। ক্রিস্টোফার নিজেকে শক্ত করে নিলো। ওরা নিশ্চিত এবার এক ধাক্কায় পুরোটা একবারে সেঁধিয়ে দেবে। ওকে চিরে একেবার শরীরের ভিতরটা পর্যন্ত চলে যাবে শূল।

কিন্তু আর খোঁচা দিলো না কেউ। টুঙ্গার ওর লোকদেরকে চিৎকার করে কিছু একটা বললো। আর পুলা টুঙ্গারের সাথে রাগারাগি করতে লাগলো। ক্রিস্টোফার তার এক বর্ণও বুঝলো না। দর্শকেরা দুয়ো ধ্বনি দিতে শুরু করলো। তবে টুঙ্গার একবার চোখ গরম করে তাকাতেই পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এলো ভীড়ের মাঝে। আস্তে আস্তে ভীড় পাতলা হয়ে এলো।

প্রহরীরা ক্রিস্টোফার আর তামান্নাকে টেনে দাঁড় করিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভিতরে নিয়ে গেলো।

*

মহলের ভিতরের কয়েদখানায় প্রবেশের পর ওদের দুজনকে দুই জায়গায় নিয়ে গেলো প্রহরীরা। ক্রিস্টোফারকে একটা খুপরির ভিতর ঢুকিয়ে বেঁধে রাখা হলো। তবে তামান্নাকে কি করা হলো তা ও জানে না। কয়েদখানার পাথরের দেয়ালের সাথে শেকল দিয়ে ওকে বেঁধে রেখে চলে গেলো সবাই।

ওখানে থাকতে থাকতে সময়ের হিসাব ভুলে গেলো ক্রিস্টোফার। এই নিঃসীম অন্ধকারে একাকী থাকতে থাকতে ওর মনে হতে বোধহয় কবরে শুয়ে আছে। শুধু গায়ের ব্যথাটা মনে করিয়ে দিতো যে ও বেঁচে আছে। ওর কবজি আর ঘাড় শেকলে ঘষা খেয়ে ছুলে গিয়েছে, সেখানে ব্যথা করে। পায়ুপথে রক্ত আর পায়খানা শক্ত হয়ে জমে আছে। ভয়ানক ক্ষুধায় থেকে থেকে মোচড় দিয়ে উঠছে পেট। মেঝের একটা গর্ত থেকে পানি প্রবাহের শব্দ শোনা যায়। কয়েদখানার নিচ দিয়ে একটা নদী চলে গিয়েছে সম্ভবত। এদিকে পিপাসায় ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। তাই ব্যথার চাইতে ওর জন্যে এটাই সবচে বড় অত্যাচার। শুধু মনে হয় পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ ভরে ঠাণ্ডা পানি খাবে।

অবশেষে প্রহরীরা এলো। তবে কেউই ওকে সামান্যতম দয়াও দেখালো না। বাধন খুলে টানতে টানতে নিয়ে গেলো মহলের ভিতর দিয়ে। তখনও উলঙ্গ ও। মহলের ভিতরের দুই ধার সুদৃশ্য ভাস্কর্য দিয়ে ভরা, দেয়াল জুড়ে বিশাল বিশাল কাঠের জানালা। কোনদিকে যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার কিছুই টের পেলো না ক্রিস্টোফার। অনেকবার দিক বদলের পর একটা ভারি পিতলের দরজার সামনে এসে উপস্থিত হলো ওরা। ওখানকার দরজার পাহারাদার ক্রিস্টোফারকে দেখে নাক সিটকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো। কিন্তু ওকে ধরে আনা প্রহরীরা ধমক দিলো তাকে।

“রানির আদেশ।”

দরজা খুলে গেলো। ভিতরের ঘরটা বোম্বের দুর্গের বিশাল পার্টি রুমটার চাইতেও বড়। সুদৃশ্য পর্দা আর দামী চিত্রকর্ম ঝুলছে দেয়ালে। প্রহরীরা ঘরের শেষ মাথার বাঘের ছালের তৈরি কার্পেটের উপর নিয়ে দাঁড় করালো ওকে। পুলা আর টুঙ্গার ওখানে একটা সুন্দর নকশা কাটা মেহগনী কাঠের সিংহাসনের সামনে মাথা নত করে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। আর সিংহাসনে বসে আছে একজন কম বয়সী সুন্দরি মহিলা। চোখ নিচু করে রাখায় ক্রিস্টোফার অবশ্য ভালো করে তার চেহারাটা দেখতে পেলো না। প্রহরীরা ওকে ধাক্কা দিয়ে হাঁটু ভেঙে বসিয়ে দিলো। তবে মেয়েটার অপার্থিব সৌন্দর্য, তার পরনের আড়ম্বর পোশাক আর মাথার মুকুটটা দেখে ক্রিস্টোফারের বুঝতে বাকি রইলো না যে ইনিই হচ্ছেন চিত্তাত্তিঙ্কারার রানি।

পুলা আর টুঙ্গার কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছিলো। রাগে লাল হয়ে আছে। পুলার চেহারা। আর টুঙ্গারের কাটা দাগটা মনে হলো দপদপ করছে। ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে রাগ সামলাতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে তাদের।

“ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই,” পুলা বললো। “আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই ওদের উপর নির্ভরশীল।”

“আমরা না, আপনি ওদের উপর নির্ভরশীল,” টুঙ্গার জবাব দিলো।

“রানিকে ওদের একচেটিয়া ব্যবসার পক্ষে রাখার জন্যে ইংরেজরা আপনাকে কতে দেয়?”

“আমি শুধু চাই আমাদের কাপড়গুলোর জন্যে একটা লাভজনক বাজার। ইংরেজরা ছাড়া সেগুলো আর কেউ কিনবে না।”

“টুপিওয়ালা আরো আছে। ওরা আমাদেরকে এর চাইতে বেশি টাকা দেবে।”

ক্রিস্টোফারের আগমনে কোনো ভাবান্তরই হলো না ওদের। ও জবুথবু হয়ে মেঝেতে বসে বসে কেনো ওকে কয়েদখানা থেকে এখানে আনা হলো সেটা ভাবতে লাগলো।

সিংহাসনে বসা মহিলাটা তার হাত তুললেন। হাতের সোনার বালাগুলো শব্দ করে উঠলো তাতে। সাথে সাথে লোক দুজন চুপ করে গিয়ে একান্ত বাধ্যগতের মতো মাথা নিচু করে রইলো।

“ব্রিঞ্জোয়ানের ইংরেজগুলো একেকটা পাতি শেয়াল। ওরা আমাদের লোকজনকে চুষে খাচ্ছে,” ঘোষণা দিলেন মহিলা। “এতোবার সাবধান করার পরেও ওরা আমাদেরকে কাঁচকলা দেখিয়েই চলেছে।”

টুঙ্গার খোঁচা মারা হাসি হাসলো একটা। পুলা মাথা নিচু করে রানির কথাই মেনে নিলো। “জ্বী, মহামান্য।”

“যাই হোক। আমরা প্রতিহিংসাপরায়ণ নই। আর কোনো উপায় না থাকলে শুধুমাত্র তখনই যুদ্ধ হবে।” রানি বললেন।

এখন পুলা-ও সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো।

“তুই কি টুপিওয়ালা নাকি?” রানি জিজ্ঞেস করলেন।

মেঝেতে মাথা নামিয়ে বসে থাকায় ক্রিস্টোফার বুঝতে পারেনি যে ওকেই করা হয়েছে প্রশ্নটা। টুঙ্গার ওর পাজরে একটা লাথি কষিয়ে ওর সম্বিত ফেরালো। “মহামান্য রানি তোকে কি জিজ্ঞেস করেছে শুনতে পাসনি?”

ক্রিস্টোফার শশব্যস্ত হয়ে হাঁটুর উপর ভর করে বসে রানির দিকে তাকালো। ঠিক একজন হিন্দু দেবীর সৌন্দর্য নিয়ে তার সিংহাসনে বসে আছেন রানি। সারা বাহুতে স্বর্ণ আর আইভরির বালা; কাপড় সেলানো হয়েছে সোনার সুতা দিয়ে। তাতে মুক্তা বসানো। মাথায় একটা রাজমুকুট, ওটা থেকে একটা টকটকে লাল চুনি নেমে এসে ঠিক তার দুই চোখের মাঝখানে ঝুলছে। কালারিতে পড়াশোনার সুবাদে ক্রিস্টোফার জানে যে ওটা দিয়ে আসলে ষষ্ঠ চক্রকে বোঝানো হয়। জিনিসটা হচ্ছে নিগঢ় জ্ঞানের আধার। আলমন্ডের মতো দেখতে চোখ দুটো ওর দিকেই তাক করা, সে চোখের ভাষা পড়ার সাধ্য কারো নেই।

“জ্বী,” মাথা ঝাঁকালো ক্রিস্টোফার। “আমি টুপিওয়ালা।”

“তাহলে এর মানে কি?”

রানি চোখ দিয়ে এক চাকরকে ইশারা করলেন। লোকটার হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ। রানির প্রতিটা নাড়াচাড়া সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করতে করতে সে সামনে এসে হাতের ব্যাগটা উপুড় করে দিলো। উরুমিটা বেরিয়ে এসে থ্যাপ করে পড়লোমেঝের উপর। ক্রিস্টোফার ওটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক যেরকম করে একটা বিড়াল পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে হিসেব কষছে ওটা কতো দূরে, আর ওর ঐ পর্যন্ত পৌঁছাতে কতো সময় লাগতে পারে।

টুঙ্গার পা দিয়ে উরুমিটা চেপে ধরে নিজের তরবারির হাতলে হাত রাখলো। যা বোঝার বুঝে নিলো ক্রিস্টোফার।

“আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি,” ক্রিস্টোফার ব্যাখ্যা করলো। “একজন আসান আমাকে তার কালারিতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওখানেই আমি কালারিপায়াত্ত শিখেছি।”

“মিথ্যে বলছে ও,” পুলা বললো।

“একজন ইংরেজকে ডেকে আনুন। আমার কথা শুনলেই উনি বুঝবেন যে আমি কোন দেশের মানুষ,” ক্রিস্টোফার অনুরোধ করলো। কারণটা জানে না, তবে এটা বুঝতে পারছে ওর জীবন মরণ এখন ওর জাতীয়তার উপর নির্ভর করছে।

“আমার সৈন্যদের উরুমি চালানো শেখাতে পারবি?”

টুঙ্গার প্রতিবাদ করতে গেলো কিন্তু রানি ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। ক্রিস্টোফারের উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছেন উনি।

“পারবো,” ঘোষণা দিলো ক্রিস্টোফার। কিন্তু রানি আরও কিছু শুনতে চাচ্ছিলেন। “আমি ওদেরকে রণকৌশল-ও শেখাতে পারবো, যেভাবে টুপিওয়ালারা যুদ্ধ করে। ওদেরকে আরো দ্রুত কামানের গোলা ছোঁড়া-ও শেখাতে পারবো। আমি ওদেরকে এমন এক সৈন্যদলে রূপান্তরিত করতে পারবো যা এদেশের কেউ কখনো দেখেনি।”

“এসবের কোনো দরকার নেই,” পুলা আপত্তি করলো। “ব্যবসা-ই হচ্ছে ক্ষমতার মূলমন্ত্র। যারা-ই যুদ্ধ করে, তারা না খেয়ে মরে।”

রানি ওর দিকে এমনভাবে তাকালেন যে সেই দৃষ্টিতে একটা হাতীও কুপোকাত হয়ে যেতো। “ঐ টুপিওয়ালাদের জন্যে আমার অনেক লোক আহত হয়েছে, রানি বললেন। “ওদেরও জানা দরকার যে আমরাও মাথা উঁচু করতে চলতে জানি। ওদের জাহাজ আর কামানের ভয় করি না। ওরা যদি আমার সামনে মাথা নত না করে, তাহলে এমন শিক্ষা দেবো যে সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না।”

টুঙ্গার ওর গালে হাত বুলালো। মুখের ক্ষতটায় মালিশ করছে। “মহামান্য রানিই ভালো বোঝেন।”

“তবে তার আগে আমাকে এই জানোয়ারটার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।” রানি এমনভাবে কথা বললো যেনো ক্রিস্টোফার এখানে নেই। সবাই যখন ওর দিকে একযোগে তাকালো তখন ও কথাটার অর্থ ধরতে পারলো।

ও কুর্নিশ করে বললো, “আমি শুধু আপনার আনুগত্য করবো।”

রানি সিংহাসনে বসেই সামনে ঝুঁকে এলেন। “তুই আমার প্রজাদের লুট করেছিস, নিরীহ লোকজনকে খুন করেছিস, আমার উপদেষ্টাকে হেনস্থা করেছিস। তোর মতো লোকদেরকে আমরা কি শাস্তি দেই সেটা কি জানা আছে?

ক্রিস্টোফারের রাস্তার দুই ধারে শূলে চড়ানো লোকগুলোর কথা মনে এলো। এর মধ্যে প্রথমজন, মানে বিজয়ের এতোক্ষণে মারা যাওয়ার কথা। ও ভয়ার্ত মুখে মাথা ঝাঁকালো।

“তোর কি মনে হয় যে তোকে মাফ করে দেওয়া উচিত?”

“আমি মহানুভবের করুণা ভিক্ষা চাচ্ছি। সর্বস্ব দিয়ে আপনার সেবা করার সুযোগ দিয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের একটা সুযোগ দিন।”

রানি ভাবতে লাগলেন। “তোর এক ডাকাত সহযোগী এখনো বেঁচে আছে,” বললেন উনি।

রানি আর কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন, সেই দৃষ্টি দেখেই ক্রিস্টোফার বুঝে গেলো উনি কি বোঝাচ্ছেন। এটাই ওর ছড়ান্ত পরীক্ষা-ওর আনুগত্য প্রমাণ করে, জীবন বাঁচিয়ে মুক্তি পাওয়ার এটাই সর্বশেষ উপায়। একজন সত্যিকার ক্ষমতাবানের মতো রানি ঠিকই টের পেয়েছেন দুনিয়াতে ওর কাছে মূল্যবান আর কি আছে। উনি চান ক্রিস্টোফার তামান্নাকে খুন করুক।

ক্রিস্টোফার কি তামান্নাকে জঙ্গলের ওই ঢালটা থেকে লাফ দিতে দেয়নি এভাবে মরার জন্যে? ও পারবে না। চোখের কোনা দিয়ে আরো একবার উরুমিটার দিকে তাকালো ও। একবার যদি জিনিসটা হাতে পান্তু তাহলে এদের সবাইকে খুন করতে পারবে; তারপর প্রহরীদেরকেও মেরে কয়েদখানায় গিয়ে তামান্নাকে মুক্ত করে পালিয়ে যাবে। এখানে নিশ্চয়ই আস্তাবল আছে। ঘোড়ায় চড়ে দরকার হলে চীন চলে যাবে। নতুন পরিচয়ে, নতুন করে শুরু করবে জীবন।

কিন্তু সকল কল্পনা এক আছাড়ে বাস্তবতায় নেমে এলো। ঘরে বিশজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। ও উরুমিটা ছোঁয়ার আগেই মারা পড়বে। অথবা আরো খারাপ কিছু হতে পারে, হয়তো ওকে না মেরে আবার কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়া হবে। শূলে বিদ্ধ হওয়ার তীব্র যন্ত্রণা মনে পড়লো ওর। কয়েদখানার নিঃসীম অন্ধকারের কথা মনে পড়লো। বুঝলো যে আর কোনো উপায় নেই।

“আমি ওকে খুন করবো,” রাজি হলো ক্রিস্টোফার। “আমাকে উরুমিটা দিন, ওকে মেরে ওর কাটা মুণ্ডু আপনার সামনে পেশ করবো।”

রানির মুখোভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হলো না। কিন্তু তার চোখের আড়ালে যেনো এক প্রেতাত্মার হাসি দেখা গেলো ক্রিস্টোফার।

“আমি চাই তুই শুধু ঐ ডাকাত মহিলাকে খুন কর। মহলের সবাইকে না।”

রানি তুড়ি বাজাতেই একজন চাকর এগিয়ে এসে রানির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে একটা আইভরির নকশা কাটা কাঠের বক্স সামনে তুলে ধরলো। রানি ঢাকনিটা তুলতেই দেখা গেলো ভিতরে রেশমি কাপড়ের উপর একটা ছোট ছুরি শুয়ে আছে। হাতলটা একটা স্বর্ণের আংটির মতো, ভাঁজ করা ফলাটা পালিশ করা ইস্পাতের তৈরি, সর্বোচ্চ দুই ইঞ্চি লম্বা। রানি ওটা বক্স থেকে বের করে, একটা বাচ্চার প্রিয় খেলনার মতো করে আদর করতে লাগলেন।

“এটার নাম বাঘের-নখ, ক্রিস্টোফারকে বললেন রানি। “আমার মনে হয় না কালারিতে এরকম কিছু ছিলো।”

ক্রিস্টোফার মাথা নাড়লো। “এটা খুবই সুন্দর,” ফিসফিসিয়ে বললো ও। ছুরিটার ফলায় উপরের জানালা থেকে আলোক রশ্মি এসে পড়তেই ওটার খোদাইগুলো থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। ক্রিস্টোফার বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো।

রানি তার ডান হাতের তর্জনীতে আংটিটা পরে নিলেন। ফলাটা ভাঁজ হয়ে তার হাতের তালুতে লুকিয়ে থাকলো। হাত মুঠ করতেই আর ওটা দেখা গেলো না।

“এটা নে। দেখা যাক তোর হাতে এটা মাপমতো হয় নাকি।”

ক্রিস্টোফার ওটাকে আঙুলে পরে হাত মুঠি করে স্বর্ণের নখরটাকে ঢেকে রাখলো। হাতটা খুলতেই ওটার ভাজ আপনা আপনিই খুলে ছুটে গেলো সামনে। ও হাতটা একবার ডানে আর একবার বামে চালালো, আর ছুরিটা হিসহিসিয়ে বাতাস কেটে দিলো।

“মেয়েটাকে নিয়ে আসুন,” নিরাসক্ত গলায় বললো ক্রিস্টোফার। রানি মাথা ঝাঁকাতেই টুঙ্গার এক প্রহরীকে আদেশ দিলো।

চুপচাপ দরবারে বসে রইলো ওরা। টু শব্দটিও করলো না কেউ। এমনকি রানিও না।

অবশেষে নিচের ঘর থেকে উপরে আসার সিঁড়িতে পদশব্দ পাওয়া গেলো। একটু পরেই রানির চারজন প্রহরী আবার দরবারে প্রবেশ করলো।

ওদের মাঝখানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে তামান্না। এটা যে তামান্না তা চেনাই যাচ্ছে না। চামড়া ফেটে রক্ত বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ওর পায়ের পাতায় চাবুক মারা হয়েছে। গায়ে একটা সূতাও নেই। কবজি শরীরের সামনের একসাথে বাঁধা। সারা পিঠে জুড়ে চাবুকের দাগ লাল হয়ে ফুটে আছে। চুল আলুথালু হয়ে কোমর পর্যন্ত ঝুলছে, ঘাম আর রক্তে ভিজে সপসপে। চোখ টকটকে লাল, কোটরের গভীরে ঢুকে গিয়েছে। চোখের পাতে ফুলে আছে, খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে ওর। ঘুষি মেরে ওর প্রায় সবগুলো দাঁতই ফেলে দেওয়া হয়েছে, চোয়ালটাও ভেঙে গিয়েছে, ফলে ওর রক্তাক্ত, ফুলে ঢোল ঠোঁট দুটো বন্ধ করতে পারছে না।

ও অনিশ্চিত ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। ফুলে ওঠা পায়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে কষ্ট হচ্ছে। ওর চোখ ক্রিস্টোফারের উপর দিয়ে ঘুরে গেলো কিন্তু তাতে পরিচিতির কোনো আভাস পাওয়া গেলো না। ভাঙা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় শিষের মতো শব্দ হচ্ছে।

“তামান্না!” প্রায় কেঁদে উঠলো ক্রিস্টোফার। তামান্না উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। পরিচিত কণ্ঠটা কোত্থেকে আসছে ধরতে পারছে না।

“ওরা আমাদেরকে ছেড়ে দিচ্ছে!” তামান্নাকে বললো ক্রিস্টোফার। তামান্না নীরবে কাঁদতে শুরু করতেই ওর চেহারা আরো বিকৃত হয়ে গেলো। ওর বুক ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। সারা শরীর কাঁপছে।

“ছে…ড়ে… দেবে,” ওর ঠোঁট নড়লো কিন্তু শব্দটা শোনা গেলো না। ক্রিস্টোফার ওর দিকে এগিয়ে গেলো। প্রহরীদের ইশারা করলো ওকে ছেড়ে দিতে। ওরা পিছিয়ে গেলো।

“হ্যাঁ, এখান থেকে আমরা আরো সুন্দর, আরো অনেক ভালো একটা জায়গায় যাবো। আমরা পাখির মতো যেখানে খুশি উড়ে যাবো।”

“পাখি…” আবার বললো তামান্না। ক্রিস্টোফারকে চিনতে পেরে ফোঁপাতে শুরু করেছে। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে টলতে টলতে ওর দিকে আগাতে লাগলো। ক্রিস্টোফারও এগিয়ে গেলো। ডান হাতে বাঘের নখর খুলে রেখেছে।

“আর কোনো বাধা থাকবে না,” নরম সুরে বললো ক্রিস্টোফার। ও তামান্নার হাতের বাঁধন কেটে দিতেই ও ক্রিস্টোফারের উপর ঢলে পড়লো। ওর ফোলা ঠোঁটে চুমু খেলো ক্রিস্টোফার। তামান্না মরিয়া হয়ে ক্রিস্টোফারকে জড়িয়ে ধরতেই ও বাঘের নখটার ডগাটা তামান্নার ডান কানের নিচ বরাবর ঢুকিয়ে দিলো। তারপর এক পোচে ক্যারটিড ধমনী সহ সবগুলো প্রধান রক্তবাহিকা দিলো কেটে। গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্ত। দুজনেই ভিজে গেলো তাতে। তামান্না খুব দুর্বলভাবে বাধা দিতে চাইলো। কিন্তু ক্রিস্টোফার ওকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে ওর কানে বিড়বিড় করে নরম সুরে কথা বলতে লাগলো। আস্তে আস্তে প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেলো তামান্নার।

রানি নিজের সিংহাসনে সামনের দিকে ঝুঁকে আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখছেন। তামান্নার মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে যথেষ্ট আমোদ পেয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। দরবারের কেউ এক চুল নড়লো না বা কোনো কথা বললো না।

আচমকা তামান্না ওর কাটা শ্বাসনালী দিয়ে ঘড়ঘড় করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে স্থির হয়ে গেলো। ক্রিস্টোফারের কোলে আরাম করে ঘুমাচ্ছে যেনো। একটু পরেই ওর মাথা কাত হয়ে ক্রিস্টোফারের কাঁধে ঢলে পড়লো। পা শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। ক্রিস্টোফার আলতো করে লাশটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো।

“সাবাস!” হাতে তালি দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠলেন রানি। ক্রিস্টোফার হতবাক হয়ে দেখলো রানি কাঁদছেন। “জীবনে এরচে সুন্দর আর মর্মস্পর্শী কিছু দেখিনি আমি।”

৫. ওয়ার্ম অ্যান্ড স্পঞ্জ

“ওয়ার্ম অ্যান্ড স্পঞ্জ!”

ক্রিস্টোফার মহলের উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রানির সৈন্যদের কামান দাগানো অনুশীলন করাচ্ছে। এখন আর ওকে সেই হতভাগ্য বন্দীর সাথে মেলানো যাবে না-যে কিনা একমাস আগেও কয়েদখানায় পচে মরার জোগাড় হয়েছিলো। পরিপাটি করে দাড়ি আঁচড়ানো, মাথার চুল পাগড়িতে ঢাকা। পরিষ্কার পোশাক পরনে এখন। তার উপর একটা কোট পরা।

তামান্নাকে হারানোর ক্ষত এখনো ওর মনে দগদগে ঘা হয়ে আছে, কিন্তু ক্রিস্টোফার কালারিতে থাকতেই নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। তবে এটা ও কোনোদিনও ভুলবে না, ঠিক সময়ে প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। ওর কোমরের কমলা কোমরবন্ধ থেকে একটা বাকানো ছুরি আর ধারালো তরবারি ঝুলছে। রানির সেনাবাহিনিতে ও কতোদূর এসেছে এটা দিয়ে তা বোঝা যাচ্ছে। তবে এক মুহূর্তের জন্যেও নিজেকে নিরাপদ মনে করে না ও। খুব দ্রুতই ধরে ফেলেছে যে দরবারের লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত : একদল হচ্ছে পুলা-র দলে। এরা ইংরেজদের সাথে ব্যবসা করে লাভ করতে চায়। আর এক দলের সর্দার হচ্ছে টুঙ্গার। ও চায় লড়াই করতে। ক্রিস্টোফার বেঁচে আছে শুধু রানির বদৌলতে। রানি ঘুরে ফিরে একদলকে দিয়ে অন্য দলকে খেলিয়ে নেয়, ফলে দুই দলই সামলে থাকে। ক্রিস্টোফার না চাইতেও এই খেলার একটা ঘুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ও ভালোমতোই জানে যে। যখন সময় আসবে তখন সবার আগে ওকেই বলির পাঠা বানানো হবে। আর এই প্রাসাদে শুধুমাত্র ক্রিস্টোফার একাই প্রতিশোধের নেশায় দিন গুনছে না।

ক্রিস্টোফারের জীবন মরণ এখন নির্ভর করছে রানি ওকে যে দায়িত্ব দেয় সেটা হুবহু পালনের মধ্যে। বোম্বের গভর্নর হিসেবে ওর বাবাও আনুষ্ঠানিকভাবে বোম্বে আর্মির সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। প্রতি রবিবার দুপুরে উনি সমস্ত সৈন্যকে কুঁচকাওয়াজ করাতেন। নানা পদের মহড়া দেওয়াতেন। সত্যিকার সেনা কর্মকর্তারা রোদে ঘামতে ঘামতে তাকে গালাগাল দিতে দিতে আদেশ পালন করতো। ক্রিস্টোফারকেও জোর করে ধরে নিয়ে যেতেন। পরনে থাকতে পুরু একটা সানডে স্যুট, যেটা কিনা ইংল্যান্ডের শীতে ঘরের ভিতর পরা যায় কিন্তু এই ভারতীয় গরমে মোটেও না। কিন্তু এখন ব্যাপারটার জন্যে মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছে ও।

“গোলা ভরো।”

কামানের ক্রু-রা জায়গা মতো দাঁড়িয়ে গেলো। কিন্তু এতো আস্তে যে ওর মনে চাইলে চাবকে সবকটার পাছের চামড়া তুলে দিতে। কিন্তু সেটা পছন্দ করবেন না-অন্তত এখনি না। ক্রিস্টোফারকে তাই গালাগালি চিৎকার করেই মনের ঝাল মেটাতে হচ্ছে। এরা ক্রমাগত প্রতিটা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে, বারুদ ঠাসার কাঠিটা ভুল ভাবে ঠেসে দিয়ে পাউডারের বস্তা খুলে ছড়িয়ে ফেলছে বা গোলাটাই হাত থেকে ফেলে দিচ্ছে।

“ও ঈশ্বর! যদি একজন ইংরেজ এভাবে কামান দাগার চেষ্টা করে তাহলে মুঘল সম্রাটেরাই বরং এখন লন্ডনে গিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকতো। আমি তখন তোদের চাকরের কাজ করতাম আর সকাল বিকাল পাছায় খেতাম।”

বিস্ফোরণের শব্দে ওর আওয়াজ চাপা পড়ে গেলো। কামানের গোলা বিস্ফোরিত হয়েছে। কামানের আশেপাশের লোকেরা সাথে সাথে ছিন্নভিন্ন হয়ে মাংসের স্তূপে পরিণত হলো। আহতদের চিৎকারে কান পাতা দায়। যে সুবলদারটা কার্তুজ ঠাসার কাঠিটা ধরে ছিলো সে শখানেক ফুট দূরে গিয়ে পড়েছে। পেট চেপে ধরে পড়ে আছে সে। হাতের কাঠিটা ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে, এখন খোলা পেট দিয়ে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছে সব।

“শালা নরকের কীট,” ক্রিস্টোফার মৃতপ্রায় লোকটার উপরেই ঝাড়লো। “তুই নিশ্চয়ই ঠিকমতো কামানটা মুছিসনি।” এই ভেজা স্পর্শের কাজ হচ্ছে একবার গোলা ছোঁড়ার পর যদি ভিতরে কোনো ফুলকি থেকে যায় তাহলে সেটাকে নিভিয়ে ফেলা। এতে করে নতুন করে বারুদ ঠেসে দিলেও আর বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে না।

কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই টুঙ্গার ওর একদল সৈন্য কোথাও থেকে আসছিলো। ও ঘোড়া থেক নেমে ভাঙা কামানটা দেখে তারপর লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে এলো।

“তোর কাজ রানির সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাদেরকে ধ্বংস করা না।

ক্রিস্টোফার চুপচাপ খোঁচাটা হজম করলো। কামান, চিৎকাররত লোকজন, রানির অসন্তুস্তি-সব বেমালুম ভুলে গিয়ে এক দৃষ্টিতে টুঙ্গার কোমরে বাঁধা তরবারিটার দিকে তাকিয়ে আছে ও। এক অনিন্দ্য তরবারি, হাতলে একটা বড়সড় নীলা পাথর বসানো।

তরবারিটাকে চেনে ও, বোম্বেতে ওর বাবার অফিসে স্যার ফ্রান্সিসকে ছবিতে বহুবার দেখেছে। ছোট থাকতে ও ছবিটার দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতো। এমনকি হয়তো কোনো জরুরি কাজ পড়ে আছে, তবু দেখা যেতো ও ঘুরে ফিরে এসে ছবিটা দেখছে। দেখতো আর কল্পনা করত এই অনিন্দ্য সুন্দর অস্ত্রটা ওর কোমরে ঝুলছে বা ডান হাতে আঁকড়ে আছে। এভাবে বসে বসে দিবাস্বপ্ন দেখার জন্যে ও গাই-এর হাতে অসংখ্য পিটুনি খেয়েছে। কিন্তু তাতেও দমে যায়নি ক্রিস্টোফার। ওর বাবাকে ক্রুরা বিরক্ত করতেই থাকে। তারপর একদিন ওর বাবা ওকে নেপচুন তরবারিটার কাহিনি খুলে বলে। স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক, চার্লস কোর্টনী–ওর দাদা বা পরদাদাদের নামগুলো শুনলেই ওর ভিতর কেমন একটা সম্ভ্রম ভাব জেগে উঠতে ওর ভিতর।

“তরবারিটা এখন কোথায়?” প্রবল আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে জানতে চেয়েছিলো ক্রিস্টোফার।

“তোমার টম চাচা ওটা হাই উইল্ড থেকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। উইলিয়ামকে খুন করার কয়েকদিন আগে,” গাই বলেছিলো ওকে। ক্রিস্টোফার তখন ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলো। গাই টম সম্পর্কে একটা কথাও বলত না। আর ভুলেও যদি কখনো তার নাম উচ্চারিত হতো, তাহলে ক্ষেপে যেতো। “যখন ও আফ্রিকায় মারা যায় তখন ওটা ওর সাথেই ছিলো সম্ভবত। এখন হয়তো কোনো দস্যু বা ডাকাতের হাতে পড়েছে।”

ক্রিস্টোফার কল্পনাও করতে পারছে না যে কিভাবে এটা মালাবার উপকূলে এসে পৌঁছেছে; আর কিভাবেই বা টুঙ্গারের মতো শয়তানের হাতে পড়েছে।

টুঙ্গারও ক্রিস্টোফারের হতবাক অবস্থাটা খেয়াল করলো। ও তরবারিটা খাপ থেকে বের করে ডানে বামে বাতাসে কয়েকটা কোপ দিলো। ক্রিস্টোফারের মুখের ঠিক সামনে থেকে বাতাস কেটে সাই করে সরে গেলো চকচকে ফলাটা।

“কয়েকদিন আগে টুপিওয়ালাদের একটা জাহাজ ডুবি হয়েছে উপকূলে। ওখানকার বেঁচে যাওয়া একজনের কাছ থেকে নিয়েছি এটা।” ক্রিস্টোফার পিঠের পিছনে হাত নিয়ে মুঠি পাকিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে রাখলো। ওর প্রচণ্ডত্ম ইচ্ছে করছিলো তরবারিটী কেড়ে নিয়ে সোজা টুঙ্গারের গলায় ঢুকিয়ে দিতে। তরবারিটা ওর সম্পত্তি। ও হচ্ছে বেঁচে থাকা ভাইদের মধ্যে সবচে বড় জনের বড় ছেলে, কোর্টনীদের উত্তরাধিকারি। এটা এমনিতেই ওর হবে : নইলে ভাগ্যের ফেরে ওর কাছেই বা কেন এটা চলে আসবে। ইতোমধ্যেই ও মনে মনে হিসেব করা শুরু করেছে কিভাবে ও তরবারিটা হস্তগত করতে পারবে। টুঙ্গারকে একা পাওয়াটা শক্ত। কারণ ও লোকজন নিয়ে একটা কুকুরের পালের মতো ঘোরে সবসময়। যেখানে যায় সাথে এরা থাকে। কিন্তু একটা না একটা উপায় বের করতেই হবে।

“টুপিওয়ালাদের কি করেছো? সবাইকে খুন করে রেখে এসেছেন?” যতোটা পারলো আগ্রহ গোপন করে জানতে চাইলো ক্রিস্টোফার।

“একটা শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। মহামান্য রানি এখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত না।” তারপর টুঙ্গার আহত সৈন্যদের দিকে ইংগিত করে বললো, “আর এভাবে চলতে থাকলে কোনোদিন হবেনও না। তাড়াতাড়ি পরিষ্কার কর সব। নইলে তোকে দিয়েই সব চাটিয়ে পরিষ্কার করাবো।”

*

টুঙ্গার যাওয়া মাত্র ক্রিস্টোফার আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া আনিয়ে সৈকতের দিকে ছুটলো। গ্রামের মাতবর ওকে দেখে ভয় খেয়ে গেলো। অবশ্য স্বীকার করলো যে টুপিওয়ালারা এসেছিলো এখানে। তবে এখন তারা ব্রিঞ্জোয়ানের দুর্গের দিকে চলে গিয়েছে। মাতবর চাচ্ছিলো না যে এইসব বাইরের অপবিত্র লোক তার গ্রামে থাকুক। ওরা যা কিছু ছুঁয়ে দেখেছে তার সবকিছু খুব ভালো মতো ধুয়ে গোবর দিয়ে ঘষে পবিত্র করে নেওয়া হয়েছে।

ক্রিস্টোফার ওখান থেকে চলে এলো। ও জানে যে ওর মহলে ফিরে যাওয়া উচিত, তবে আগে সৈকতটা দেখতে গেলো। ঝড় থেমে গিয়েছে ততোক্ষণে, ডুবে যাওয়া জাহাজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। ওটা মাস্তুলের ভাঙা অংশটা ঢেউয়ের তালে ডুবছে আর ভাসছে। আর সাগরও এতো পরিষ্কার ছিলো যে ওটার কালো রঙের খোলটাও পানির ভিতর দিয়ে বোঝা যাচ্ছিলো। ইন্ডিয়াম্যান না জাহাজটা। ও বোম্বেতে ইন্ডিয়াম্যান এতো এতো দেখেছে যে দেখা মাত্র এধরনের জাহাজ চিনতে পারে। কোনো আরব দস্যুদের জাহাজও না-এটা একটা ইউরোপিয়ান জাহাজ। কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন জাহাজ ছিলো সম্ভবত, আরো ভালো করে বললে একজন ইন্টারলোপারের জাহাজ।

ওর মনে অনেকগুলো সম্ভাবনা এসে ভীড় করলো। যদি এটা ইংল্যান্ড থেকে এসে থাকে তাহলে নিশ্চিত কেপ টাউনে থেমেছিলো। সম্ভবত তরবারিটা তখনই জাহাজের কেউ কিনেছে। হয়তো এরা আফ্রিকার উপকূলের সব গোত্রে মালপত্র কেনাবেচা করে কেপটাউন থেকে এই দুর্ভাগ্যের যাত্রা শুরু করেছিলো। তরবারিটার দাম কত ছিলো? নাকি বাজি ধরে জিতেছে? কে জানে কাউকে খুন করে ছিনিয়ে নিয়েছে কিনা।

এসব কোনো ব্যাপার না। উত্তরাধিকার সূত্রেই নেপচুন তরবারিটা ওর। আর সমুদ্রই ওটা ওর কাছে এনে দিয়েছে। এখন ওর কাজ হচ্ছে টুঙ্গারকে শেষ করে তরবারিটা কেড়ে নেওয়া। আর কালারিতে প্রশিক্ষণ নেওয়া একজন লোকের কাছে সেটা পানিভাতের মতোই।

এরপরেও ও জাহাজটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঝড় ওটাকে পাড়ের কাছেই এনে ফেলেছে। এতো কাছে যে ওর মনে হলো ও হেঁটেই ওটার কাছে চলে যেতে পারবে। ওটার উপর ঢেউ এসে পড়ছে, আর ওটার ভাঙ্গা তক্তাগুলো দোলনার মতো দুলছে।

চোখের উপর হাত চাপা দিয়ে দেখতে লাগলো ক্রিস্টোফার। ঢেউ সরে যেতেই জাহাজের পাশ দিয়ে একটা লম্বা সরু জিনিস বের হয়ে থাকতে দেখা গেলো।

ওটা কি একটা কামান নাকি! নিজের সৌভাগ্যে নিজেই অবাক হয়ে গেলো ও জাহাজটায় কামান ছিলো। তার মানে নিশ্চয়ই আরো কামান আছে। সম্ভবত এখনো জাহাজে আটকে আছে, নইলে পড়ে আছে আশেপাশেই। একটা লম্বা দড়ি আর টানতে পারে এমন কিছু জানোয়ার পেলেই তুলে আনা যাবে।

ও ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো সবকিছু। কামানগুলো উদ্ধারের সমস্যা আর সম্ভাবনাগুলো যাচাই করে দেখছে। সবশেষে কাঁঠাল গাছে বাঁধা ওর ঘোড়াটার কাছে এগিয়ে লাফ দিয়ে উঠে মহলের দিকে ছুটলো।

অনুমতি ছাড়া মহলের বাইরে আসায় টুঙ্গার নিশ্চিত ওকে শাস্তি দিতে চাইবে, কিন্তু ক্রিস্টোফার কি পেয়েছে সেটা জানা মাত্রই পরিস্থিতি ঘুরে যাবে নিশ্চিত। ওর বিশ্বস্ততা নিয়ে তখন আর কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না।

*

তিন দিন পর, ক্রিস্টোফার আবারও একই সৈকতে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকতের যেদিক দিয়ে কামানের নলটা টেনে নেওয়া হয়েছে সেদিকে বালিতে গভীর গর্ত হয়ে গিয়েছে। ভালোই কাজ হয়েছে আজ, রানি খুব খুশি হবেন। কিন্তু কেন যেনো ওর মনটা খচখচ করছে।

আবারও দূর দিয়ে ভেসে যাওয়া নৌকাটার দিকে তাকালো ও। আজ প্রায় সারাদিনই ওটাকে দেখা গিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে চলেছে। কাছে আসার কোনো চেষ্টাই করছে না। সম্ভবত জেলে নৌকা। কিন্তু তবুও কেনো যেনো কেমন কেমন লাগছে ওর। কেন যেনো মনে হচ্ছে কেউ ওর উপর নজর রাখছে। ঝড়ের আগে যেরকম বাতাসে স্থির বিদ্যুতের আভাস পাওয়া যায়, সেরকম লাগছে ওর কাছে।

খামাখা ভাবছি আমি, নিজেকে বললো ও। কামানগুলো রানির কাছে নিয়ে যাওয়ার পর রানি নিশ্চয়ই ওকে পুরষ্কার দিতে চাইবেন। এমনকি ওকে টুঙ্গার এর উপরেও পদোন্নতি দিয়ে দিতে পারেন।

*

ধ্বংসাবশেষের কাছ থেকে ঘুরে চলে আসার পরদিন থেকে আবার ঝড় শুরু হলো। পুরো এক সপ্তাহ থাকলো এবার। টম আর বাকিরা অ্যাগনেসের বাংলোতেই থাকলো। বসে বসে ভাবনা চিন্তা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই ওদের। সারাহের জ্বর কমেছে খানিকটা; যদিও এখনো অনেক দুর্বল, আর যথেষ্ট পীড়াপাড়ি করে খাবার খাওয়াতে হয়। ব্রিঞ্জোয়ানে কোনো ডাক্তার নেই, তাই অ্যানা আর অ্যাগনেসই যতোটা পারে ওর যত্ন নিচ্ছে।

টম বেশিরভাগ সময়েই জানালার ধারে বসে বসে বৃষ্টি দেখে কাটিয়ে দিলো। বসে বসে হয় সারাহের কথা ভাবে, নয়তো নেপচুন তরবারিটার কথা ভাবে।

তবে এখন লরেন্স ফয়-এর ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বাঁচতে পারছে ও। গভর্নর এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত রানির দরবারে দেখা করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। নিজের ইশতেহার আর বক্তৃতাটা বার বার ঘষে মেজে ঠিকঠাক করছে। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে দিনের পর দিন ওকে দেরি করতে হলো।

“আমার স্বামী রানির সামনে একটা ভেজা কাকের মতো তো আর গিয়ে দাঁড়াতে পারে না, তাই না?” ফয়-এর স্ত্রী ঘোষণা দিলো। সে একবার বেড়াতে এসেছিলো এই বাড়িতে। ভাব দেখাচ্ছিলো যে সারাহকে দেখতে এসেছে, কিন্তু টমের ধারণা আসলে এসেছিলো ওরা এখন কি করবে না করবে সেসব খোঁজ করতে। “মহিলা কিন্তু নিজের স্বামীর ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর,” অ্যাগনেস আগেই বলে রেখেছিলো টমকে। “আর ওনার ধারণা তুমি ওনার ক্ষতির কারণ হতে পারো।”

টম মহিলাকে আশ্বস্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করলো। ওরা যে যতো দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে যেতে উদগ্রীব সেটা জানালো। মহিলা যাতে ওর সম্পর্কে খুব বেশি প্রশ্ন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখলো। কিন্তু তবুও দেখা গেলো ওর উত্তরে মহিলা সম্ভষ্ট হচ্ছে না। বেশ কয়েকবার টম খেয়াল করলো মহিলা তার পাখির মতো চোখগুলো দিয়ে ওকে খেয়াল করছে আর নাক সিটকে এমন ভাব করছে যেনো সে টমের কাজে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। মহিলা এক আজব চিড়িয়াঃ স্বামীর চাইতে বিশ বছরের ছোট, মাত্র সতেরো বছর বয়স। কিন্তু চলাফেরা এমন যা তার চাইতে তিনগুণ বেশি বয়সী মহিলার মাঝেও দেখা যায় না।

“মেয়েটা এর মধ্যেই একবার বিধাব হয়েছে, চুপিচুপি বলেছে অ্যাগনেস। “ভারতে এসেছিলো ওর বাবার সাথে। কিন্তু জাহাজ থেকে নামতে না নামতেই তেল্লিচেরির প্রধান গোমস্তার সাথে বাগদান হয়ে যায়। ব্যাটা ছিলো ইয়া ভুড়িওয়ালা এক বুড়ো। নাম কুপার। আস্ত খাটাস একটা লোক। যখন প্রথম বোম্বে আসে তখন ডিনারের টেবিলের নিচ দিয়ে মহিলাদের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতো। আর মেয়েটার বয়স তখন পনেরও হয়নি। কুপার এক বছরের মাঝে মারা পড়ে। তার সব সম্পত্তির মালিক হয় মেয়েটা। সেটা যৌতুক দিয়েই মিস্টার ফয়কে বিয়ে করেছে সে।”

এখন টম অ্যাগনেসের বসার ঘরে বসে আছে আর চেষ্টা করছে সবার সাথে তাল মেলাতে। ওর অবশ্য বেশি কিছু বলারও নেই। মিসেস ফয়-এর মাথায় হাজার হাজার বুদ্ধি। সে গড়গড় করে সব বলে গেলো; নিজের ব্যক্তিত্ব বা অন্য কোনো গুণ দিয়ে না, বরং বলা যায় জবরদস্তি করেই সে সবার উপর প্রভাব বিস্তারের আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো। মেয়েটা খুব বেশি সুন্দর না। নাক চোখা, চোখা ড্যাবড্যাবে, মুখের কাটাও বেশি বড় গায়ে মাংস নেই কিন্তু স্তনের আকার বড় হওয়ায় গায়ের পোশাকটা ঠিকমতো আঁটেনি। কিন্তু তবুও এক অফুরন্ত শক্তির বলে সে ঘরের সমস্ত মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নিলো। টম দেখলো ফ্রান্সিস হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অ্যানা চুপিসারে কনুই দিয়ে গুতো দেওয়ার পড়ে চোখ নামিয়ে নিলো।

“একবার আমার স্বামী এই হামবড়া কালা রানিটার সাথে সব ঠিকঠাক করে ফেলতে পারলেই আমি নিশ্চিত, গভর্নর কোর্টনী ওকে ভালো পুরস্কার দেবেন। আরো ভালো কোথাও পাঠাবেন,” একটা কাগজের পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললো মিসেস ফয়। “মাদ্রাজ বা ফোর্ট উইলিয়ামেও পাঠাতে পারেন।”

“কিন্তু মহলেই তো যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না,” ফয় বললো।

মিসেস ফয়ের চোখ ছোট ছোট হয়ে গেলো। “আশা করি কাল আবহাওয়ার উন্নতি হবে।”

*

সেটাই হলো। পরের সকালে উত্তাপ ছড়াতে ছড়াতে উদয় হলো সূর্য। যদিও মেঘ আছে আকাশে। উত্তাপে আরো বড় হচ্ছে আকারে, পুরো দুনিয়াই মনে হতে লাগলো জলীয় বাষ্পে উত্তপ্ত হয়ে আছে। বিছানা থেকে মাথা তুলতে না তুলতেই টমের সারা শরীর পাতলা ঘামের আস্তরণে ঢেকে গেলো। প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে গায়ে কোট চাপালো ও। কোটটা ক্যাপ্টেন হিকসের, অ্যাগনেস ওকে দিয়েছে। ফয় আদেশ জারি করেছে যেনো প্রতিটা লোককে একদম পরিপাটি দেখায়।

দুর্গের বাইরের বালুকাময় জায়গাটায় গিয়ে জড়ো হলো ওরা। ফয় প্রত্যেক সমর্থ পুরুষকে সাথে নিয়ে এসেছে। যাতে রানি ওকে দেখে সমীহ করে। এক কোম্পানি সৈন্যও আছে সাথে। আয়নার মতো চকচক করছে ওদের বুট। কোম্পানির মুনশি আর ব্যাপারীরা পরেছে নীল পোশাক; আরও আছে একগাদা বেয়ারা আর চাকর। চাকরদের হাতে রানির জন্যে উপহার সামগ্রী। বাকিরা সবাই এসেছে শুধুমাত্র ফয়ের ক্ষমতা দেখানোর অংশ হিসেবে।

যারা সাথে গেলো না তারা পাশেই দাঁড়িয়ে বিদায় দিলো ওদের কয়েকজন বৃদ্ধ লোক আর ছোট বাচ্চা, কেস্ট্রেল-এর নাবিকেরা আর মহিলারা।

*

ফয় দাঁড়িয়ে আছে সারির একদম সবার সামনে। একটা মেরুন রঙের কোট, লম্বা কোকড়ানো পরচুলা, উটপাখির পালক বসানো টুপি আর সোনার আঙটা বসানো জুতো পরে একবারে ফুলবাবু সেজে আছে। মনে হচ্ছে কূটনীতিতে না পারলেও, ওর পোশাকই রানির উপর ভালোই প্রভাব ফেলবে। চেহারা গরমে একেবারে টকটকে লাল হয়ে আছে। কোটের কাঁধের দিকটা ঘামে প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে গিয়েছে এরমধ্যেই। রানির মহল ওখান থেকে ছয় মাইল। টম ভাবতে লাগলো ফয় ততোক্ষণ টিকবে কিনা।

“ওনাকে খুবই ভালো লাগছে, তাই না?” অ্যানাকে বললো টম। ও ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।

“একেবারে ময়ূর পক্ষী, মুচকি হেসে বললো অ্যানা। “সাথে ঘিলুও সেই পরিমাণ। রানির কথা এ বুঝবে কিনা সেটাই সন্দেহ আমার।”

“তুমি কিন্তু দোভাষীর কাজ করতে পারো।” বলে টম এগিয়ে গিয়ে ফয়কে কথাটা বললো। শুনে ফয় হতভম্ব হয়ে গেলো।

“আপনার মাথা খারাপ? এসব কোনো হালকা বিষয় না-পুরো কোম্পানির ব্যবসা নির্ভর করছে এর উপর। একজন মহিলার মাধ্যমে সেটা চালানো সম্ভব না।” মহিলা শব্দটায় ফয় বিশেষ জোর দিলো। “আমার সম্মানহানি হবে তাতে।”

“আমার মনে হয় না রানি এই কথার সাথে একমত হবে,” টমের কানে কানে বললো ফ্রান্সিস।

টম দেখলো অ্যানা আরো একবার যাওয়ার জন্যে জেদ করতে যাচ্ছে। ও ওকে হটিয়ে দিলো।

“তুমি এখানেই থাকো। সারাহকে দেখাশোনা করতে হবে। আমাদের যদি কিছু হয় তাহলে ওর যত্ন নেওয়ার জন্যে তোমাকে থাকতে হবে।”

অ্যানার রাগ মুহূর্তে উদ্বেগে রূপান্তরিত হলো। “আপনাদের বিপদ হতে পারে?”

“রানির কর্মচারীরা কেমন আচরণ করে তা তো দেখেছোই।”

“তাহলে আপনার যাওয়ার দরকার নেই,” মিনতি করলো অ্যানা। “ফ্রান্সিসও থাক। মিস্টার ফয়-এর ব্যাপার স্যাপারে আপনারা না গেলেও হবে।”

“না, যাওয়া লাগবে। বদমাইশ টুঙ্গারের কাছ থেকে তরবারিটা ফেরত আনতে হবে। এটাই সবচে ভালো সুযোগ। আর ফ্রান্সিস চাইলে থেকে যেতে পারে। কিন্তু ওর যা বয়স তাতে বিপদের কথায় ও আরো নেচে উঠবে যাওয়ার জন্যে। আমি তাই পারলেও ওকে বারণ করবো না। তবে আলফ উইলসন আর বাকিরা আছে তোমাদেরকে রক্ষা করার জন্যে।”

ওরা ফয়-এর পিছু পিছু রওনা দিলো। টম হাটছে ক্যাপ্টেন হিকসের পাশে। উনিই সৈন্যদলের দায়িত্বে আছেন। টম খেয়াল করলো ফয় এমনকি একজন প্রহরীও রেখে যায়নি দুর্গে। একটা অমঙ্গলের চিন্তা ওর মনে খেলে গেলো। ওর কি আসলেই সারাহ, অ্যানা আর অ্যাগনেসকে এভাবে অরক্ষিত রেখে চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে?

নেপচুন তরবারি, নিজেকে মনে করিয়ে দিলো।

মানুষের সারিটা আস্তে আস্তে সামনে আগাতে লাগলো। কমপক্ষে একশো লোক যাচ্ছে একসাথে। বৃষ্টির কারণে সব রাস্তাঘাট একেকটা ছোটোখাটো জলায় পরিণত হয়েছে। একটু পরেই দেখা গেলো কাদার প্রলেপ পড়ে যায় এর সোনার আঙটার জুতো আর চেনা যাচ্ছে না। আর সিপাহিদের উর্দির প্রায় কোমর পর্যন্ত কাদার ছিটেয় ভরে গিয়েছে। এক ঘণ্টা পরে দেখা গেলো ওরা মাত্র এক মাইল পার হয়েছে।

টম স্থানীয় কুলিদের মাথার বস্তা আর ব্যাগগুলোর দিখে খেয়াল করলো। “ফয় কার বুদ্ধিতে রানির জন্যে এতো দিলখোলা আচরণ করছে? ওনার স্বভাবতো এরকম না।”

হিকস হেসে দিলো। “ফয় দরকার ছাড়া নিজের এক ফোঁটা প্রস্রাবও খরচ করবে না। ওগুলো হচ্ছে পাউডার আর গুলির বস্তা।”

“সৈন্যরা নিজেরা নিজেদেরটা নেয় না?”

“মিস্টার ফয় আমাদের স্থানীয় সৈন্যদেরকে বিশ্বাস করেন না। ওনার দুশ্চিন্তা যে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে না আবার লেগে যায়। রাস্তার একটা নুড়ি পাথরে লাথি দিলো হিকস। “শালা খালি গায়ের চামড়ার রঙ দেখে, বিশ্বস্ততা দেখে না।”

টমের মনের দুশ্চিন্তা আরো বাড়লো। নিজের পিস্তলের ঘোড়া ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলো ও হিকসের কাছ থেকে ধার নিয়েছে এটা। একটা ছুরি আর একটা কাজ চালানোর মতো সেনাবাহিনির কোমরবন্ধনীও দিয়েছে। ওটা পরার পর থেকে নেপচুন তরবারিটার জন্যে আরো বেশি চুলকনি উঠে গিয়েছে ওর।

ওরা কষ্টে সৃষ্টে এগিয়ে চললো। পুরো দেশটা মনে হচ্ছে পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। টমের মনে হলো নূহের নৌকার অধিবাসীরা নৌকা থেকে নেমে আসার পর, তাদের কাছে সম্ভবত পুরো দুনিয়াটা এরকম লেগেছিলো। গাছপালা ঘাড় ভেঙে পড়ে আছে, রাস্তা ভরে গর্ত। আর গাছের ফাঁক দিয়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসা পানি এদিকে সেদিকে নালা সৃষ্টি করে ধাঁধার মতো ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই অনন্ত পানির মধ্যে চলতে চলতেও ওদের সবচে বড় কষ্টের নাম হচ্ছে তৃষ্ণা। কাদা ভাঙতে ভাঙতে ওদের উলের কোট আর টুপির ওজন আস্তে আস্তে বেড়েই চলেছে বলে মনে হতে লাগলো। এতো গরম যে মনে হচ্ছে ওরা কোন যুদ্ধক্ষেত্রে কামান ছুড়ছে। টমের মনে হচ্ছে যেনো ওর শরীরের সমস্ত তরল পদার্থ নিংড়ে ওর কাপড়ের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে।

“সামনের বাকটা পার হলেই একটা কুয়ো আছে,” হিকস বললো। “ওখানে পানি খেয়ে নেওয়া যাবে।”

টম মনোযোগ সরাতে রাস্তার দু’ধারের দৃশ্য দেখায় মন দিলো। ও আফ্রিকার বনভূমিতে প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ আলাদা। এতো এতো অদ্ভুত সব গাছ আর ফুল ফুটে আছে চারপাশে যেগুলো ও জীবনেও দেখেনি। চোখা মাথার পাইন গাছ, এক পা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আতা, পেয়ারা, পেপে গাছ; জামপাতার মতো দেখতে পাতাওয়ালা একটা ঝোঁপ গাছ, উজ্জ্বল বেগুনি ফুল ফুটে আছে তাতে।

“এতো দেখি স্বর্গের বাগান,” ফ্রান্সিস বিস্মিত কণ্ঠে বললো।

“দুই সপ্তাহ আগেও ছিলো খরায় পোড়া, হিকস বললো। “নদীগুলো ছিলো নালার মতো সরু, গাছগুলো সব অর্ধেক মরে ছিলো। বৃষ্টি হওয়ার পর এক রাতের মাঝেই পুরো পাল্টে গিয়েছে।”

কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে এলো ওরা। জাহাজডুবির পর যেরকম গ্রামে গিয়েছিলো, এগুলোও সেরকমই। তাল পাতায় ছাওয়া ঘর সব, বাঁশের মাচায় মাছ ধরার জাল শুকোচ্ছে। নদী থেক ছোট ছোট নালা বেরিয়ে এখানে সেখানে পুকুর তৈরি করেছে, সেগুলোতে বাদামী রঙের শাঁসালো জিনিস দিয়ে ভরা। হিকস জানালো যে এগুলোতা নারিকেলের ছোবড়া জাগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে ছোবড়া কয়েক মাস পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়, তারপর নরম হলে সেগুলো দিয়ে সুতা বানানো হয়। সেটা দিয়েই পরবর্তীতে তৈরি হয় জাহাজের কাছি। কয়েক জায়গায় টম দেখলো মহিলারা ছোট লাঠি দিয়ে ছোবড়াগুলো পিটাচ্ছে।

বড় হোক আর বাচ্চা হোক, ওদেরকে দেখামাত্র সবাই কাজ ফেলে রেখে ছুটে এসে জুলজুল করে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু টমের কেনো যেনো মনে হলো এদের এই অবার দৃষ্টির পেছনে শুধু কৌতূহল না, আরো কিছু আছে। গ্রাম ছাড়িয়ে বহুদূর চলে আসার পরেও ও ঝোঁপঝাড়ে নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো, কয়েকবার দেখলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কালো রঙের কিছু অবয়ব ওদের আগে আগে দৌড়ে যাচ্ছে। ও জীবনে যথেষ্ট বিপদ মোকাবেলা করেছে, নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উপর তাই ওর যথেষ্ট আস্থা। নিজেকে এখন ফাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়া পশুর মতো মনে হচ্ছে ওর।

ওরা একটা চৌরাস্তা পেরিয়ে এসে দেখে একটা খাড়ির উপর কাঠ দিয়ে একটা সাঁকো বানানো। পাশেই বানর দেবতা হনুমানের একটা মন্দির। মন্দিরের চারপাশে হলুদ রঙের জংলী ফুল ফুটে আছে। তার পাশেই একটা কুয়ো।

ফয় সবাইকে থামতে বলে দৌড়ে গেলো কুয়োর দিকে। কিন্তু ভেতরে তাকিয়েই আর্তনাদ করে উঠলো।

“শুকিয়ে গিয়েছে।”

টম ওর কাছে এগিয়ে নিচে তাকালো। পাথর আর নুড়ি ফেলে রাখা হয়েছে ভেতরে। কিন্তু ওটা এতোই গভীর যে এই ভয়ানক বৃষ্টিপাতের পরেও পানি উপরে ওঠেনি।

“ব্যাপার না,” খিটিমিট করে বললো ফয়। গরমে ওর চেহারার লাল রঙ সরে এখন সাদাটে হওয়া শুরু করেছে। আমরা মহলে পৌঁছালেই রানি আমাদেরকে আপ্যায়ন করবেন।”

টম ওর কাছে এসে অন্য কেউ যাতে শুনতে না পায় এমনভাবে বললো, “আমার কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। কেউ ইচ্ছে করে কুয়োটা বন্ধ করে রেখেছে। ওরা ভালোমতোই জানে গরমের আমাদের অবস্থা কেমন হয়। ওরা চায় আমরা যাতে মহলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ি। আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।”

“ফিরে যাবো?” প্রায় চিৎকার করে উঠলো ফয়। “পাগল নাকি? আমাদের সাথে প্রায় একশো শোক আছে। রানি আর ওর অশিক্ষিত লোকগুলো আমাদের কি-ইবা এমন করতে পারবে? বিপদের আঁচ পেলেই পালিয়ে যাওয়া একজন ইন্টারলেপারের স্বভাব হতে পারে, কিন্তু কোম্পানির কাজ করে যেসব লোক তাদের সাহস অন্যরকম।”

ফয়কে কুয়োর ভেতর ফেলে দিলে ঠিক কি কি হতে পারে সেটা নিয়ে টম এক মুহূর্ত ভাবলো। শেষে কি ভেবে বাদ দিলো চিন্তাটা। ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় ওকে বলছে ফিরে যেতে। কিন্তু তরবারিটা যেনো সাইরেনের (পৌরাণিক দানব, যারা গান গেয়ে নাবিকদের পথভ্রষ্ট করতো) মতো করে ওকে সামনের দিকে ডাকছে।

রাস্তাটা এরপর একটা লাল পাহাড়ে উঠে গিয়েছে। পশ্চিম ঘাটের প্রথম পাহাড় এটা। ওটার ঢাল ধান ক্ষেত আর নারিকেল গাছ দিয়ে ভরা। সামনেই গাছে ভরা পর্বতগাত্রের মাঝে একটা উপত্যকা মতো জায়গায় মহলটা সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

দুর্গ ছেড়ে আসার পর এটাই প্রথম পাথরের বাড়ি চোখে পড়লো টমের। মানে অন্তত এটার কিছুটা অংশ হলেও পাথরের। পুরো প্রাসাদটা আসলে গত এক যুগ ধরে এলোমেলো ভাবে বানানো অনেকগুলো ভবনের সমাহার। সুন্দর একটা বাগানের মাঝে আগাছার মতো। যখন যে-ই এই মহলে থেকেছে তার ইচ্ছে মতো যেদিকে খুশি নতুন নতুন চত্বর বা ভবন বানানো হয়েছে। বাইরে একটা লম্বা কাঠের দেয়াল। রানি আর তার প্রজাদেরকে আলাদা করেছে ওটা।

ফয় লোকের সারিটাকে নিয়ে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এক ডজন প্রহরী কুঁচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। পরনে মোটা কাপড়ের উর্দি। তার উপরে লম্বা সাদা কোটি, আর কোমরে কমলা কোমরবন্ধ। সবার পরনে রুপালি শিরস্ত্রাণ। সেগুলো নাক ছাড়িয়ে চেহারার এতো নিচে নেমে এসেছে যে সৈনিকদের আর চেনা যাচ্ছে না। হাতের বন্দুকগুলো খাড়া করে দুই ফাইলে এগিয়ে এলো ওরা। একজন লোক দুই ফাইলের মাঝে এগিয়ে আসছে।

তাকে দেখে শক্ত হয়ে গেলো টম। হাত আপনাআপনি চলে গেলো কোমরের পিস্তলে। লোকটা টুঙ্গার। নিজের সৈনিকের পোশাক ছেড়ে আজ পরেছে রেশমি কাপড়ের জোব্বা। পাড়ে নকশা করা। শিরস্ত্রাণের জায়গায় পরেছে পাগড়ি। কিন্তু তাতেও ওর ফাটা চেহারার শয়তানি একটুও কমেনি।

হিকস টমের হাতের উপর হাত রাখলো। “এখন না,” ফিসফিস করে বললো ও।

টুঙ্গার ওদেরকে মালায়ালাম ভাষায় স্বাগত জানালো। অতিরিক্ত বিনয়ে গলে হাসছে হে হে করে। তাতে ওর কালচে দাঁতই দেখা হলো শুধু। একজন কমবয়সী ভারতীয় ছেলে সামনে এগিয়ে এসে দোভাষীর কাজ করতে লাগলো।

“উনি বলছেন রানির শরীর খারাপ। গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন। আপনারা অপেক্ষা করুন।”

“শুনুন,” কপালের গাম মুছতে মুছতে কড়া গলায় বললো ফয়। “আমরা অনেক দূর থেকে নানা জিনিসপত্র উপহার নিয়ে এসেছি আপনাদের ঐ উঁইফোড় রানির জন্যে। আমরা এভাবে বাইরে অপেক্ষা করতে পারবো না।”

তোষামদের ভঙ্গিতে টুঙ্গারের হাসি আরো চওড়া হলো। তারপর বললো কিছু একটা।

“অপেক্ষা করুন, দোভাষী বললো।

“রাখ তোর অপেক্ষা। আমি-”

টুঙ্গার ঘুরে অলস পায়ে ফিরে যেতে লাগলো। ফয় পিছু পিছু যেতে গেলে কিন্তু রানির প্রহরীরা সামনে এগিয়ে এসে ওর পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হলো সদর দরজা।

“আমরা তাহলে এখন কি করবো?” জানতে চাইলো ফয়।

“অপেক্ষা করুন,” আবার বললো দোভাষী।

*

ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতে লাগলো। এই তীব্র গরমের মধ্যেও সবাইকে সাবধান অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখলো ফয়। যখন হিকস পরামর্শ দিলো সবাইকে বিশ্রাম নিতে দেওয়ার জন্যে, ফয় প্রচণ্ড রেগেমেগে ওকে তাড়িয়ে দিলো। “রানির সামনে আমাকে অপদস্থ করতে চান? আমি নিশ্চিত যে কোনো মুহূর্তে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হবে।”

কিন্তু দরজা বন্ধই থাকলো।

টমের মনে হলো ওর গালের ভিতর ওটা জিহ্বা না, ইটের টুকরো। যাত্রাটা বেশি দূর হবে না মনে করে ওরা সাথে করে খাবার পানি কিছুই আনননি। বিকেল গড়িয়ে গেলে ক্ষুধায় সবার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হলো। কুলিদের মধ্যে এগারো বারো বছরের এক হ্যাংলা ছেলে ছিলো, অজ্ঞান হয়ে পড়েই গেলো সে। ওর বন্ধুরা ওকে তুলতে গেলো কিন্তু ফয় আদেশ দিলো ও যেখানে আছে সেখানেই যেনো পড়ে থাকে।

নেপচুন তরবারির ব্যাপারটা না থাকলে টম বহু আগেই ফ্রান্সিসকে সাথে নিয়ে কুঠিতে ফিরে যেতো। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়ার মতো দিনের আলো অবশিষ্ট আছে কিনা এ ব্যাপারে ও সন্দিহান।

“রানির সাথে দেখা হওয়ার পর আমার তরবারিটার খোঁজ করতে ভুলবেন না,” ফয়কে মনে করিয়ে দিলো টম।

ফয় অবজ্ঞা মিশ্রিত একটা হাসি দিলো। কিন্তু ওর গলা এতোটা শুকিয়ে আছে যে শুনে মনে হলো, ভেতর ব্যাঙ ঢুকেছে। “আমরা এসেছি কূটনৈতিক কাজে। আপনার ঐ তুচ্ছ খেলনার জন্যে পুরো প্রদেশে ব্যবসার সম্ভাবনার ঝুঁকি নিতে পারবো না।”

টম কিছু বলার আগেই দরজা খুলে গেলো। আবারও হাজির হলো টুঙ্গার। আবারও বেরিয়ে এলো ওর কালো দাঁতের সারি।

“রানি আপনাদের সাথে দেখে করতে সম্মত হয়েছেন।”

“দেখেছেন,” ফয় বললো। “বলেছিলাম না যে সব ঠিকই হবে।”

টুঙ্গারের সৈন্যরা পথে দেখিয়ে ওদেরকে ভিতরে নিয়ে গেলো। দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রথমে পড়লো একটা চত্বর। সেটা পেরিয়ে আর একটা নিচু খিলানে ঢাকা পথে আগালো ওরা। টম ইতস্তত করতে লাগলো। সবকিছুই কেমন গোলমেলে ঠেকছে। কিন্তু ফ্রান্সিস আর হিকস এর মধ্যেই ঢুকে পড়েছে। আর পিছনের সিপাহীর দলও ঠেলা দিচ্ছে আগাতে। আর উপায় না দেখে সামনেই বাড়লো ও।

চত্বরটা পেরিয়ে আসতেই পিছনে সদর দরজার কাছে একটা সংঘর্ষের আওয়াজ পেলো টম। দেখা গেলো যে সব কয়জন চাকরকে না ঢুকিয়েই সদর দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মাথা উঁচিয়ে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করলো টম। কিন্তু লোকজনের চাপে খিলানের ভিতরে ঢুকে পড়লো।

সামনে আর একটা চতুর। অনেকগুলো বাঁকানো তোরণ দেখা গেলো সেখানে। বেশিরভাগ তোরণই নারিকেলের ছোবড়ার পাটি দিয়ে ঢাকা, ফলে ওগুলোর ভিতরে কি আছে তা দেখার উপয়া নেই। লম্বা লম্বা বর্শা হাতে প্রহরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। সামনের উঁচু দেয়ালগুলোর গায়ে গাছপালা আর পশুপাখির নকশা কাটা। জানালা ঢেকে রাখা জালিগুলোর পেছনে নাড়াচাড়া দেখা গেলো। কিন্তু টম সেগুলোকে ঠিকমতো দেখার সুযোগ পেলো না।

ঠিক ওর উল্টোদিকে, দ্বিতীয় তলা থেকে একটা ব্যালকনি চতুরের উপর বেরিয়ে এসেছে। মহলের দরজায় আরো ছয়জন প্রহরী দাঁড়ানো। এদের শিরস্ত্রাণ সোনা দিয়ে বাধাই করা, হাতে পিতলের বন্দুক। কাছে যেতেই ওরা দরজাটা খুলে ধরলো।

চত্বরে সব লোক আটছিলো না। যেসব কুলিরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলো, ওরা ফয়-এর পাশে ওদের পিঠের মালপত্র নামিয়ে রাখতে হিমশিম খেয়ে গেলো। টম ভীড়ের ভিতরে টুঙ্গারকে খুঁজলো, কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না।

ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো। দোভাষীটা ফিরে এলো আবার।

“টুঙ্গার বলেছেন যখন রানি আসবে, তখন যেনো আপনার লোকেরা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে সম্ভাষণ জানায়।”

“অবশ্যই,” বলে ও ছেলেটাকে বিদায় জানালো ফয়। “ব্যাটা কি মনে করে যে আমি আদব কায়দা কিছুই জানি না? এসব কালাগুলো একটু শব্দ টক শুনলেই গলে যায়।”

টম গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর ভিতর দিয়ে কসরত করে এগিয়ে চত্বরটার এক পাশে চলে এলো। তোরণগুলোকে ঢকে রাখা পাটিগুলো দেখে ওর মনটা খচখচ করছে। তোরণের খুটির গায়ে হেলান দিয়ে পাটিটার কোনা ধরে সামান্য সরিয়ে ভিতর উঁকি দিলো ও। ভিতরের আবছায়ার ভিতর অনেক লোকজন আর সৈন্য দেখা গেলো। ধীরে ধীরে জ্বলে এমন একটা বাতি জ্বালা ভেতরে। আর লোকগুলোর মাঝে বড়সড় কিছু একটা তেরপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।

একটা শক্ত হাত ওর কাধ চেপে ওখান থেকে সরিয়ে দিলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখে একজন প্রহরী চোখ গরম করে তাকিয়ে মাথা নাড়ছে ওর দিকে। সে ব্যালকনির দিকে দেখালো, দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে সেদিকে। তারপর নিজের ঠোঁটের উপর একটা আঙুল রেখে চুপ করে থাকার ইশারা করলো।

টম ঝাড়ি মেরে প্রহরীর হাত ছুটিয়ে দিলো। ওকে ফয়কে সাবধান করতে হবে যে রানির লোকজন নিশ্চিত কোনো কুমতলব আটছে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে রানি নিজে ব্যালকনিতে এসে উপস্থিত হলেন। পরনে মূল্যবান সব পাথর খচিত পাটের তৈরি মিহি কাপড়। চল্লিশজন সিপাহী তাকে স্বসস্ত্র সালাম জানাতে মাস্কেটগুলো আকাশের দিকে তুলে ধরলো।

“থামো,” মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো টম। কিন্তু কথাটা ফয়-এর কানে যাওয়ার আগেই সিপাহীদের ফাঁকা গুলির বুম বুম আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেলো।

প্রত্যুত্তরে রানি ব্যালকনি থেকে মুচকি হেসে, অলস ভঙ্গিতে হাতটা উপরে তুলে আবার ছেড়ে দিলেন। টম বুঝতে পারলো এটা কোনো একটা সংকেত। চত্বরের চারপাশের তোরণগুলোর সামনের পাটিগুলো পড়ে গেলো। আর ভিতরে দেখা গেলো কালো রঙের সব কামান নল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিকে।

টম দেয়ালের দিকে ঝাঁপ দিলো, সাথে সাথে সবগুলো কামান গর্জে উঠলো একত্রে। মনে হলো একসাথে অনেকগুলো বজ্রপাত হলো। ধোয়ায় ভরে গেলো চারপাশ। মাস্কেটের গুলি, ভাঙ্গা ধাতুর টুকরা, মরচে পড়া পেরেকের একটা ঝড় ছুটে এলো গাদাগাদি করে চতুরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে। মহলের দেয়ালগুলো কেপে উঠলো বিস্ফোরণের ধাক্কায়।

এক মুহূর্তে চত্বরটা একটা কসাইখানায় পরিণত হলো। শুধু যারা পেছনে ছিলো তারা বেঁচে গেলো, কারণ সামনের লোকগুলোর শরীর ওদের জন্যে ঢালের কাজ করেছে। যারা সরাসরি সামনে পড়েছে তাদেরকে আর মানুষ বলে চেনা যাচ্ছে না। আহতদের আর্তনাদ আর সাথে বাকিদের চিৎকার চেঁচামেচিতে নরক গুলজার হয়ে গেলো জায়গাটায়। সৈন্যদের মাস্কেট সব রানিকে অভিবাদন জানাতে গিয়ে খালি হয়ে গিয়েছে। ওরা কি করবে বুঝে না পেয়ে যারা জীবিত আছে তাদেরকে একসাথে জড়ো করতে লাগলো। কিন্তু তখনি চতুরের চারিধারের ব্যালকনিগুলো থেকে লুকানো আততায়ীরা গুলি ছুঁড়তে লাগলো। উদ্ৰান্ত সেপাহীরা টপাটপ পড়ে যেতে লাগলো তাতে। বল্লমধারী পাহারাদারেরা আক্রমণ চালালো এবার। কামানের লোকেরাও তাদের তরবারি তুলে নিয়ে যোগ দিলো ওদের সাথে।

এই তুমুল হট্টগোলের মাঝেই কোথাও আছে ফ্রান্সিস। টম ওকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে ও নিশ্চিত রানির ব্যালকনির নিচে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। যে লোকগুলো তাদের মাঝে ও আছে। আততায়ীর গুলি ওখানে পৌঁছাবে না। টম, হিকস আর ওর মোচওয়াল হাবিলদারকে দেখতে পেলো। বেঁচে থাকা সিপাহীরা ওদের চারপাশ ঘিরে একটা চক্র তৈরি করেছে। মরিয়া হয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করছে সবাই। কিন্তু রানিকে স্যালুট দিতে গিয়ে ওরা অস্ত্র খালি করে ফেলেছে। আর ওদের অতিরিক্ত পুলি আর পাউডার রয়ে গিয়েছে দরজার বাইরে-যেসব কুলিকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাদের কাছে। কয়েকজন অবশ্য বেয়নেট জুড়ে নিতে পেরেছে; আর বাকিরা তাদের বন্দুকটা মুগুরের মতো ব্যবহার করছে।

টম নিজের তরবারি বের করলো। যুদ্ধ শুরুর উত্তেজনায় টম যে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে সেটা কেউ খেয়াল করেনি। বর্ম আর দীর্ঘ শিরস্ত্রাণের কারণে রানির সৈন্যদের গলা আর পিঠ সুরক্ষিত থাকছে। কিন্তু ওদের পা পুরো অরক্ষিত। টম একজনের হ্যামস্ট্রিং পেশি দুই ভাগ করে দিলো। লোকটা পড়ে যেতেই টম তার শিরস্ত্রাণটা খুলে নিয়ে নিজের মাথায় গলিয়ে নিলো। তারপর তার পরে থাকা বল্লমটা তুলে নিয়ে ক্ষ্যাপা শুয়োরের মতো পাশের আর একজনকে আক্রমণ করলো।

লোকটা চেঁচিয়ে উঠতেই, সবার দৃষ্টি ঘুরে গেলো টমের দিকে। একজন দৌড়ে এলো ওর দিকে, হাতে খোলা তরবারি। টম প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই লোকটা পিঠে গুলি খেয়ে হাঁটু মুড়ে পড়ে গেলো। পিঠের ক্ষত থেকে ফোয়ারার মতো রক্ত বের হচ্ছে। উল্টোপাশের একটা ব্যালকনিতে, ধোয়ার আড়ালে একজন আততায়ীকে দেখতে পেলো টম। গুলিটা আসলে ওকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছিলো।

সেই মুহূর্তেই ফ্রান্সিসকে চোখে পড়লো ওর। ব্যালকনির নিচে যারা প্রতিরোধ গড়েছে তাদের মধ্যে সামনের সারিতেই আছে। টম ওর দিকে এগিয়ে গেলো। যেতে যেতে সামনে যাকেই পেলো তাকে বল্লমের আঘাতে শুইয়ে দিতে লাগলো। একজন কুড়াল হাতে আক্রমণ করলো ওকে, মাথা নিচু করে এড়ালো আঘাতটা। তারপর বল্লমের খোঁচায় তার ভুড়ি ফাঁসিয়ে দিলো। ব্যালকনির নিচে পৌঁছে গেলো টম। রানির একজন প্রহরী চক্রটা ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলো প্রায়। হিকস এগিয়ে এসে হাতের পিস্তলটা খালি করলো তার চেহারা বরাবর।

“এখানে থাকা যাবে না,” চেঁচিয়ে বললো টম। আক্ষরিক অর্থেই দেয়ালে পিঠ ঠেকা এখন ওদের। লড়াই করার মতো বন্দুক, বা জনবল কোনটাই নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই যারা বেঁচে আছে তারাও কচুকাটা হবে। এখন উপায় একটাই যেভাবেই হোক এখান থেকে বেরিয়ে কোম্পানির কুঠিতে পালিয়ে যাওয়া।

“আপনাকে যে পিস্তলগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো আছে?” হিকস জানতে চাইলো।

টম মাথা ঝাঁকালো। ও একটা বের করে কক করলো। হিকস হাতেরটায় গুলি ভরলো আবার।

“আমার সাথে সাথে… এখন।”

সবাই একসাথে গুলি ছুড়লো ওরা, ওদেরকে ঘিরে থাকা সৈন্যগুলোর মাঝে একটু জায়গা ফাঁকা হলো তাতে। আক্রমণকারীরা পিছু হটলো। টম ওর তরবারি বাগিয়ে আক্রমণ করলো। হিকস ওর ডানে, আর ফ্রান্সিস বামে।

“একসাথে থাকবেন!,” চিৎকার করে বললো ও। একবার ব্যালকনি নিচ থেকে বের হতেই ওরা আবার আততায়ীর গুলির আওতায় চলে এলো। প্রমাণ স্বরূপ সাথে সাথেই মাস্কেটের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো আর সেটা টমের মাথা থেকে কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে গিয়ে পাশের দেওয়ালের খানিকটা প্লাস্টার উড়িয়ে দিলো। একটা টুকরো ছুটে এসে গালে বিধলো ওর। টম পিস্তল ধরা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রক্তটা মুছে, ঐ অবস্থাতেই তাক করে গুলি ছুড়লো। যে লোকটা ওর দিকে গুলি ছুঁড়েছিলো তার একেবারে কপালে গিয়ে লাগলো গুলিটা। ব্যালকনির রেলিং থেকে গড়ান দিয়ে নিচে ধপাস করে এসে পড়লো সে। টম লাশটা থেকে বন্দুকটা আর কোমর থেকে গোলার বেল্টটা টান দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে, দুটোই ফ্রান্সিসের দিকে ছুঁড়ে দিলো।

“আততায়ীগুলো যেনো মাথা বের করতে না পারে।”

ফ্রান্সিস হাঁটু মুড়ে বসে গুলি ভরে গুলি ছুড়লো। ব্যালকনিতে একজন পেট চেপে ধরে টলতে টলতে পিছিয়ে গেলো। বাকিরাও ভিতরে ঢুকে গেলো সাথে সাথে। ওদের প্রতিরোধে ভয় পাচ্ছে।

“তাড়াতাড়ি,” চেঁচালো টম। যুদ্ধে ভাটা পড়ায় সামনে একটা ফাঁকা জায়গা বেরিয়ে পড়েছে। এখন আর অতো চিন্তা ভাবনা করার সময় নেই, টম সেদিকে দৌড় দিলো। প্রথমবার কামানের গোলায় যারা মারা পড়েছিলো তাদের লাশগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছে। পাথরের চতুরটা রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে, টম একবার পা পিছলে পড়তে পড়তে পড়লো না। আবার ব্যালকনি থেক গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো। ওর পাশের দুজন লোক পড়ে গেলো। একজন সৈন্য এখান থেকে বের হওয়ার জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে লম্বা একটা বল্লম। হাবিলদার তার বেয়নেট পরানো মাস্কেটটা একটা জ্যভেলিনের মতো করে ধরে ছুঁড়ে দিলো। সৈন্যটার গলা ফাঁক হয়ে গেলো তাতে। ওদের পায়ের সামনে পড়ে গেলো সে।

টম হামাগুড়ি দিয়ে নিচু একটা দেয়াল পার হয়ে খিলানে ঘেরা জায়গাটায় এসে পৌঁছালো। কামানগুলো এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমবার গোলা ছোঁড়ার পর এখন আর ওগুলোর কাছে কেউ নেই। ওগুলোর পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়ার সময় নলের উপরের জোড়া তরবারির ছাপগুলো নজরে এলো টমের। যে ঢালাইখানায় ওগুলো বানানো হয়েছিলো সেটার প্রতীক। ও চিনলো ছাপটা, যা আশংকা করেছিলো তাই। এটা কেস্ট্রেল-এর একটা কামান। উদ্ধার করে, পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন ওগুলো টম আর ওর বন্ধুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। সব দেখে ও রাগে কাঁপতে লাগলো।

কিন্তু এখন এসব নিয়ে কিছু করার সময় নেই। রানির প্রহরীরা আবার জড়ো হচ্ছে। ওর সামনে একটা দরজা খুলে গেলো, কিন্তু সেটা যে কোথায় গিয়েছে সেই চিন্তা ভাবনা না করেই টম ঢুকে গেলো সেদিক দিয়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে করিডোর ধরে কয়েকটা খোলা ঘরের পাশ কাটিয়ে এলো ও। তারপরেই গাছপালা আর কৃত্রিম ঝর্ণায় ভরা একটা বাগানে এসে উপস্থিত হলো। বাগানটার উপরে অনেকগুলো বন্ধ জানালা। এক কোনায় সিঁড়ি দেখা গেলো। ওটা দিয়ে প্রাসাদের উপরের তলায় যাওয়া যাবে।

পিছু পিছু আসা লোকগুলোর সংখ্যা গুনে নিলো টম। ফ্রান্সিস আছে, সাথে একটা যুবক সওদাগর। ফয়-এর সহকারীদের একজনকে দেখা গেলো। যুবক ছেলেটা বাচ্চাদের মতো চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেছে। জামায় অন্য কারো রক্ত মাখা। টম হিকসকে ফেলে এসেছে কোথাও। তবে হাবিলদার আর ছয়জন সেপাই এসেছে। এর মধ্যে চারজনের হাতে মাস্কেট আছে।

পিছনে ত্বরিত পদক্ষেপ শোনা গেলো। টম ওর তরবারিটা উঁচু করে ধরলো। হিকস ছুটে এলো করিডোর ধরে। পিছনে খঞ্জর হাতে ধাওয়া করছে এক সৈন্য। হিকস ঘুরে গিয়ে সোজা সৈন্যটার বুক বরাবর গুলি করলো। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলো সৈন্যটা। আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করার আগেই ফ্রান্সিস বুদ্ধি করে সামনে এগিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিলো তাকে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আপনি ঠিক আছেন,” টম বললো। “আপনাকে আস্ত অবস্থায় ঘরে ফিরিয়ে নিতে না পারলে আমার শ্যালিকা জীবনেও আমাকে ক্ষমা করতো না।”

“আমার শ্যালিকাও কিন্তু আমাকে ছাড়বে না,” পিস্তলে গুলি ভরতে ভরতে বললো হিকস। “শালা গাধার বাচ্চা, ফয়।”

“কোথায় সে?”

“শেষ দেখছি ও ঐ কুত্তী রানিটার সাথে হে হে করে হাত মেলাচ্ছে।”

“সম্ভবত মারা পড়েছে এতোক্ষণে।” কিন্তু কেউই ফিরে গিয়ে ওকে উদ্ধারে আগ্রহ দেখালো না।

ফ্রান্সিস দ্রুত বাগানটা এক পাক ঘুরে এসেছে। ও গোমড়া মুখে হিকসের কাছে ছুটে এলো।

“বের হওয়ার কোনো দরজা নেই। আমরা আটকা পড়েছি এখানে।”

যেনো ওর কথা প্রমাণ করতেই করিডোরের মাথায় চিৎকার শোনা গেলো।

“এখান থেকে পালাতে হবে,” বললো হিকস। “আমার পিছু পিছু আসো।”

হিকস সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো। এরকম গুরুতর পরিস্থিতিতেও বিন্দুমাত্র আতংকিত হচ্ছে না। এমন ঠাণ্ডা মাথা দেখে টম আলাদা একটা সম্মান বোধ করলো ওর প্রতি। অ্যাগনেস নিজের জন্যে ঠিক মানুষটাই বেছে নিয়েছে।

ওরা সিঁড়ির শেষ বাকটা ঘুরতেই একটা বারান্দায় উঠে এলো। খোলা দরজা দিয়ে টম দেখতে পেলো সবগুলো ঘরই দামি আসবাবপত্রে ভরা। ওরা দৌড়ে চললো। কোনোদিকে যাচ্ছে ঠিক নেই। এখন গতিই আসল ব্যাপার, থেমে ভাবনা চিন্তার সময় নেই। পিছনের ধাওয়াকারী দলটা ওদেরকে না ধরতে পারলেই হবে।

আর একটা ঘরে ঢুকতেই নিচের লড়াইয়ের শব্দ আবার শোনা যেতে লাগলো। টম গালাগাল করে উঠলো। এতো কষ্টের পরে আবার সেই বটতলাতেই ফিরে এসেছে চত্বরের উপরের বারান্দায়। কাঠের কপাটের ফাঁক দিয়ে ধোয়া ঢুকছে ঘরে। নিচে তাকিয়ে টম গণহত্যার ভয়াবহতাটা একসাথে দেখতে পেলো। পুরো জায়গাটা জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। কয়েক জায়গায় স্তূপ হয়ে আছে; দেয়ালে আর পাথরের উপর রক্ত জমে পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে। ছিন্নভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সব জায়গায়।

আর এই তাণ্ডবের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেদিন সৈকতে দেখা সেই লোকটা। কেস্ট্রেল-এর জিনিসপত্র উদ্ধার করছিলো যে। টম যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে সেদিক থেকে লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তবুও টম শুধু ওর দৈহিক গঠন দেখেই এক নিমিষেই চিনে ফেলেছে। এতে লাশের মাঝেও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, আর সৈন্যদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। তখনও যারা বেঁচে আছে তাদেরকে যমের দুয়ারে পাঠাচ্ছে এরা। এই লোকটাই টমের কামান চুরি করে টমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে।

টম পিস্তল তুললো। কিন্তু জানালার ঝাজরির ছিদ্রগুলো এতো ছোট যে এর ভিতর দিয়ে গুলি করা সম্ভব না। তারপর সম্ভবত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাড়নাতেই, লোকটা এদিকে ঘুরে টমের দিকে তাকিয়ে রইলো। যদিও টম ওর কাছে পর্দার আড়ালের একটা অবয়ব হিসেবে ধরা দিচ্ছে শুধু। আবারও টমের মনে হলো যেনো ও নিজের প্রেতাত্মার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটা একজন প্রহরীকে কিছু একটা নির্দেশ দিলো। প্রহরী ওর হাতে একটা বন্দুক ধরিয়ে দিলো। তারপর হ্যাঁমার টেন টমের দিকে তাক করলো সে।

সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললো টম। সামনের পর্দাটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। টম সদ্য সৃষ্ট ছিদ্রটা দিয়ে নিজের পিস্তলের নলটা ঢুকিয়ে লোকটাকে খুঁজতে লাগলো।

কিন্তু সে উধাও হয়ে গিয়েছে।

“তাড়াতাড়ি,” ডাকলো হিকস। টম ঘুরে ওর পিছু নিতে গেলো-কিন্তু সাথে সাথে হিকস মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় একটুর জন্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়া থেকে বেঁচে গেলো।

“সৈন্য,” সাবধান করলো হিকস। অর্ধ ডজন সোনার কাজ করা শিরস্ত্রাণ পরা প্রহরী এগিয়ে আসছে এদিকে। আর ওদের মাঝখানে আছে টুঙ্গার। এখন ওর মাথায় কিছু নেই, ফলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কাটা দাগটা। নেপচুন তরবারিটা ওর হাতে; হাতলের নীলাটা আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে। টম, হিকসের দেওয়া ছুরিটা হাতে তুলে নিলো।

সৈন্যরা হাঁটু মুড়ে বসে ওদের দিকে মাস্কেট তাক করলো। ওদের লম্বা নলের মাস্কেটগুলো চালানো বেশ কষ্টকর। এতো ভারী যে নলের মাথায় তেপায়া লাগিয়ে নিতে হয়েছে। কোনো বদ্ধ জায়গায়, লড়াইয়ের উপযুক্ত না এগুলো। টম আর বাকিরা বারান্দার দেয়ালের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। গুলিগুলো ওদের কোনো ক্ষতি না করেই ছুটে গেলো পাশ দিয়ে। কিন্তু আবার গুলি ভরার আগেই টম আর বাকিরা আক্রমণ করলো।

মাস্কেট ফেলে তরবারির দিকে হাত বাড়ালো সৈন্যরা, কিন্তু তার আগেই সিপাহীরা ওদের কাছে পৌঁছে গেল। বিন্দুমাত্র দয়া দেখালো না কেউ। ওরা ওদেরকে বেয়নেটে বিদ্ধ করলো, নয়তো বন্দুকের বাট দিয়ে পিটিয়ে ছাতু বানালো। টুঙ্গারের টমের মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই। উল্টো ঘুরে পালিয়ে গেলো ও। বাকি সৈন্যরাও গেল সাথে।

“এই মরণ ফাঁদ থেকে বের হওয়ার এটাই সুযোগ!” চেঁচিয়ে বললো হিকস। একটা খোলা জানালার দিকে ইংগিত করছে ও। ইট বসানো ছাদে নামা যায় ওটা দিয়ে। এদিক দিয়ে বের হওয়া যাবে।”

কিন্তু টম জানে যে ও নেপচুন তরবারিটা ছাড়া এখান থেকে যেতে পারবে না। ওটার টান সাইরেনের সঙ্গীতের মতো আবার ওর মাথার ভিতর বাজতে লাগলো।

“আপনারা আগান। আমি আসছি।”

হিকসের প্রতিবাদের জন্যে অপেক্ষা না করে টম টুঙ্গারের পিছে ধাওয়া করলো। প্রথম মোড়টা ঘুরতেই এক আতংকিত কাজের মেয়েকে প্রায় খুন। করেই ফেলেছিলো। মেয়েটা ভয় পেয়ে দৌড়ে আসছিলো এদিকে। টম, মেয়েটাকে একদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো। একটা ছোট করিডোর আর কয়েকটা খোলা পিতলের দরজা পেরিয়ে এলো ও।

টম থেমে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। বিশাল একটা ঘরে চলে এসেছে, এতো বড় ঘর ও এর আগে কখনো দেখেনি। দামি পর্দা ঝুলছে জানালায়, এক প্রান্তে একটা বেদির উপর স্বর্ণখচিত মেহগনি কাঠের একটা সিংহাসন দেখা যাচ্ছে; ওটার দুই দিকে দুটো ব্যালকনির দরজা। ওখানে লুকিয়েই আততায়ীরা গণহত্যা চালিয়েছে। সিংহাসনের সামনে একটা বাঘের ছাল বিধানো; মাথাটা সোজা করে রাখা, যেনো নীরব গর্জনে ফেটে পড়ছে।

টম একটা ব্যালকনি পরীক্ষা করে দেখলো, কিন্তু সেটা খালি। অন্য দরজাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তখনি পিছনে কাঠের মেঝেটা ক্যাচকোচ করে উঠলো। সাই করে ঘুরে গেল টম। ঘুরেই দেখে টুঙ্গার সিংহাসনের পেছন থেকে নেপচুন তরবারিটা হাতে ছুটে আসছে ওর দিকে। টমও ওর ছুরিটা বাগিয়ে সময় মতো সরে গেল। একটুর জন্য তরবারির আঘাত লাগলো না গায়ে। প্রতি আক্রমণ করতে গেল টম, কিন্তু আগে কখনো এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার না করায়, ঠিকমতো আক্রমণ করতে পারলো না। ফলে টুঙ্গার আবার পিছিয়ে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।

টম, টুঙ্গারের হাতের তরবারিটা দিয়ে জীবনে অসংখ্য লড়াই করেছে। কিন্তু আজ ও তরবারির বিপরীত পার্শ্বে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওটা হাতে থাকায় সারাজীবন কতোটা সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু এখন ঐ নিষ্ঠুর ফলাটা ওর দিকেই তাক করা। ওটার চকচকে অশুভ ফলাটার সামনে টমের সাহস টলে গেলো। খানিকটা।

টুঙ্গার দ্রুত হাতে টমের দিকে কয়েকটা কোপ বসালো। টম মরতে মরতে বেঁচে গেলো বলা যায়। টুঙ্গারের চাপে আবার ব্যালকনির দরজার কাছে পিছিয়ে গেলো ও। হারানো সাহস আবার ফিরে এলো ওর। খুব সাবধানে খেয়াল করতে লাগলো টুঙ্গারের নাড়াচাড়া।

ও তরবারির ডগার চাইতে ধার দিয়ে মারতে পছন্দ করে। টম জানে যে এই জ্ঞানটা কাজে লাগবে ওর।

টম এক পাশে সরে গেলো, চেষ্টা করছে টুঙ্গারকে ওর বাম হাতের দিকে নিয়ে আসতে। টুঙ্গার সেটা ধরতে পেরে ওকে আবার পিছনের দিকে ঠেলে দিলো। টুঙ্গার চেষ্টা করছে টমকে ব্যালকনির রেলিং-এর কাছে ঠেলে দিতে, যাতে ও নিচে দাঁড়ানো কারো সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। টম চরকি কেটে ঘুরে গিয়ে আবার ঘরের মাঝে চলে এলো। তাতে অল্পই সুবিধা হলো ওর। টমের মনে হচ্ছে সীসা নির্মিত কোনো তরবারি দিয়ে লড়াই করছে। প্রতিটা আঘাত টলে যাচ্ছে, নয়তো নির্দিষ্ট সময়ের চাইতে সামান্য হলেও পরে হচ্ছে। হয়তো সেকেন্ডের ভগ্নাংশ, কিন্তু মোট যোগ করলে বেড়ে যাচ্ছিলো অনেক।

টম বাম দিকে আক্রমণের ভাব করলো, তাতে করে খুব ছোট একটু ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হলো। কিন্তু টুঙ্গারও সেটা ধরে ফেললো সাথে সাথে। এই পরিস্থিতিতে তরবারির ডগা দিয়ে খোঁচা মারাটাই স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু প্রবৃত্তি বশত ও কোপ মারতে গেলো। ঠিক টম যেরকমটা ভেবেছিলো, সেই মতো টুঙ্গার হাত উঁচু করলো কোপ দেবে বলে। কিন্তু তরবারিটা নেমে আসার আগেই টম ঝাঁপ দিলো সামনে। ওর সমস্ত ওজন এক করে ধাক্কাটা দিলো ও, যাতে টুঙ্গারের বর্মটা ভেদ করতে পারে।

টুঙ্গার মুচড়ে সরে গেলো। টমের ছুরি ওর বর্মে আঘাত করে আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে পিছলে তো গেলোই, সেই সাথে টমের হাত থেকে ফসকে আর একদিকে ছুটে গেলো। মরিয়া হয়ে টম টুঙ্গারের কবজি চেপে ধরে মেঝেতে পেড়ে ফেললো। তারপর দুজনেই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। টম ওর বুট পরা দুটো পা-ই টুঙ্গারের বুকের উপর তুলে দিয়ে ওকে চেপে ধরে রেখে ওর ছুরিটার জন্যে হাতড়াতে লাগলো, কিন্তু ওটা তখনও কয়েক ফুট দূরে পড়ে আছে। ও হাত বাড়িয়ে ছুরিটার হাতল নাগালে পেতেই টান দিলো। কিন্তু বেশি তাড়াহুড়া করে ফেলায় ছুরিটার ফলা গেলো বাঘটার খিঁচিয়ে থাকা দাঁতের ফাঁকে আটকে। টম আবার টান দিলো কিন্তু ছুটলো না।

টমের অবস্থা দেখে টুঙ্গার আবার উঠে দাঁড়িয়ে নেপচুন তরবারিটা উঁচিয়ে ধরলো। আবারও ও ডগার বদলে ফলা ব্যবহার করছে। মালায়ালাম ভাষায় কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিলো ও। অর্থ না বুঝলেও ভাবার্থ ঠিকই বুঝলো টম।

সমস্ত শক্তি দিয়ে তরবারিটা সোজা নামিয়ে আনলো টুঙ্গার। টম ওর বুট পরা পা চালালো। সেটা গিয়ে লাগলো টুঙ্গারের হাঁটুর মালাই চাকিতে। ওর গালিগালাজ আচমকা আর্তনাদের আড়ালে চাপা পড়ে গেলো। হিস করে বাতাস কেটে টমের মাথার পাশ দিয়ে সরে গেলো তরবারিটা। কিন্তু যতো ব্যথাই পাক না কেন, টুঙ্গার তরবারির হাতলটা ছাড়েনি। ও টলতে টলতে আবারও উঠে দাঁড়ালো। ব্যথা পাওয়া পা-টা খোঁড়াচ্ছে। টম-ও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ছুটে গেলো।

আরো একবার টুঙ্গারকে চেপে ধরলো ও। তবে এবার পেছন থেক বগলের নিচ দিয়ে। যাতে করে টুঙ্গার তরবারির ফলাটা এদিকে ঘোরাতে না পারে। টম ওকে ঠেলে চত্বরের উপরের ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে এলো। ভাঙা মালাই চাকের কারণে টুঙ্গার বাধা দিতে পারলো না। টম ওকে কাঠের রেলিং-এর গায়ে নিয়ে ঠেসে ধরলো। চেষ্টা করছে ওকে নেপচুন তরবারিটা ফেলে দিতে বাধ্য করতে।

কিন্তু এরকম দুজন বলশালী লোকের ধ্বস্তাধস্তির অভিঘাত নেওয়ার মতো সামর্থ্য কাঠের রেলিংটার ছিলো না। হয়তো যুদ্ধের সময়ের গোলাগুলিতে ওটা দুর্বল হয়ে গিয়ে হোক বা টমের ধাক্কার জোরে হোক, রেলিংটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো। টুঙ্গার ভাঙা জায়গাটা দিয়ে নিচে পড়ে গেলো। এক মুহূর্ত মনে হলো ও দুই হাত দুদিকে প্রসারিত করে কিনারে ঝুলে আছে বোধহয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই ঝপ করে নিচে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো।

জড়তার কারণে টমও প্রায় পড়েই গিয়েছিলো, কিন্তু একটা শক্ত হাত ওর ঘাড়ে কাপড় ধরে টান দিয়ে ওকে কিনার থেক সরিয়ে নিয়ে এলো।

টম ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিলো, তারপর পিছনে ফিরলো। হিকস দাঁড়িয়ে আছে পিছনে, কাঁধে একটা মাস্কেট। কিন্তু টম ওকে কিছু না বলে রেলিং-এর ভাঙা জায়গাটা দিয়ে নিচে উঁকি দিলো।

একগাদা লাশের উপর পড়ে আছে টুঙ্গার। ডান হাতটা একটা ভাঙা ডানার মতো একদিকে বেঁকে আছে। কিন্তু তখনও হাতের মুঠিতে নেপচুন তরবারিটা ধরা। পতনের ফলে তরবারিটার কোনো ক্ষতি হয়নি, অক্ষতই আছে।

টম হিসেবি চোখে উচ্চতাটা মেপে দেখলো, তারপর সোজা হয়ে লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। কিন্তু হিকস ওকে ধরে ফেললো আবার। “বোকামি কোরো না, টম! তোমার হাত পা সৰ ছাতু হয়ে যাবে। ঘাড়টাও মটকাতে পারে। একটা তরবারিই তো, হলি গ্রেইল তো আর না।” ওরা আরো কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করলো।

কিন্তু এতোক্ষণ যারা এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা লাশগুলো থেকে জিনিসপত্র লুট করছিলো তারা টুঙ্গারের কাছে ছুটে এলো। কয়েকজন উপরে তাকিয়ে ব্যালকনিতে ওদের দুজনকে দেখতে পেয়ে চিৎকার জুড়ে দিলো। একই সাথে পিস্তল বের করে তাক করলো ওদের দিকে।

তা দেখে টম জোর খাটানো বন্ধ করে দিতেই হিকস ওকে টেনে আবার দরবার কক্ষে টেনে নিয়ে এলো।

“আমি আপনাকে ফিরে আসতে নিষেধ করেছিলাম,” রাগ ঝাড়লো টম।

“এসেই যখন গিয়েছি, কি আর করা,” শুষ্ক কণ্ঠে হিকস বললো। “তবে এখন মনে হয় আমাদের বাড়ির দিকে পালানোর চেষ্টা করাই ভালো। রানি আর তার সৈন্যদল আমাদেরকে ধাওয়া করার আগেই।” টম বুঝতে পারল ও আসলে ওর নিজেদের লোকেরই জীবনবিপন্ন করে দিচ্ছিলো। এবার আর হিকসের কথা অমান্য করলো না ও।

আবার হিকস টমকে নিয়ে শিক বসানো জানালাওয়ালা একটা ঘরে এলো। একটা শিক খুলে ফেলা হয়েছে। ওটার পরেই একটা বাইরের ভবনের ইটের ছাদ দেখা যাচ্ছে। হিকস টমকে সেদিকে দিয়ে ঠেলে দিলো আগে, তারপর নিজেও লাফ দিলো সেদিক দিয়ে। ছাদের কিনারা ধরে দৌড়ে ওরা শেষ মাথায় চলে এলো। ওখান থেকে মহলের দেয়ালটা পার হলেই ভোলা প্রান্তর। ফ্রান্সিস আর বাকিরা ওখানে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে।

লাফ দেওয়াটা ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। টম একদম নিচু হয়ে তারপর সব শক্তি এক করে দিলো লাফ। কাদায় ভরা একটা নরম জায়গায় গিয়ে পড়লো ও। তারপর হিকসকে ইশারা করলো লাফ দেওয়ার জন্যে। হিকস নিজের মাস্কেটটা টমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো।

কিন্তু আচমকা বাতাস ফুড়ে যেনো একটা ইস্পাতের সাপ উড়ে এসে হিকসের গোলা পেঁচিয়ে ধরলো। হিকস দুই হাতে ধরে ওটা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। আরো জোরে ওর গলায় এটে বসলো ওটা; থাকতে না পেরে পিছনে উল্টে বসে পড়লো। চেহারা ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। চিৎকার করার জন্যে মুখ খুললো কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। ইস্পাতের বেড়িটা ধরে কেউ টান দিলো। টানে চিত হয়ে পড়ে যেতে গেলো হিকস। সাথে সাথেই দেখা গেলো গলা জুড়ে একটা একটা লাল রেখা আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে।

অসহায় চোখে টম দেখলো একটা অবয়ব এসে উপস্থিত হয়েছে হিকসের পেছনে। সৈকতে দেখা সেই লোকটাই! এই লোকটাই একটু আগে ওর দিকে গুলি ছুঁড়েছে। আর আবারও টমের সেই আজব অনুভূতিটা হতে লাগলো। যেনো এক অমোঘ নিয়তি আজ পূরণ হচ্ছে।

টমের দিকে তাকিয়েই লোকটা তার ডান হাতটা নাড়লো। ক্যাপ্টেন হিকসের গলার ইস্পাতের বেড়িটা আরো কিছুটা এঁটে বসলো। তারপর চামড়া, মাংস, শিরা-ধমনী ভেদ করে অবশেষে তার মেরুদণ্ডের হাড় আর সুষুম্না কাণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেলো ওটা।

ধড় থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে গেলো হিকসের মাথা। মাথাটা কাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতেই কাটা জায়গাটা থেকে তীর বেগে ঝর্নার মতো রক্ত বের হতে লাগলো। নিষ্প্রাণ দেহটা সামনের দিকে ঝুঁকে ছাদের কোনার আর একদিকে গিয়ে পড়লো। টম আর দেখতে পেলো না সেটাকে। খুনীটা আবারও কবজি মোচড় দিতেই ধাতব সাপটা কুণ্ডলী পাকিয়ে তার ডান হাতের ভিতর ঢুকে গেলো।

টম ওর বন্দুক তুকে তাক করে গুলি করলো, কিন্তু নিশান ভুল হয়ে গেলো। খুনী ওর দিকে চেয়ে হো হো করে হাসতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে টম ওর বৈশিষ্ট্যগুলো ধরতে পারলো। ওর হাসির মধ্যে মিশ্রিত ঘৃণার সুরটাও চিনে ফেললো ও। এই লোকটা হচ্ছে ওর ভাই গাই কোর্টনীর একটা প্রতিচ্ছবি। মানে বিশ বছর আগে ওদের যখন শেষ দেখা হয়, গাই তখন এরকমই ছিলো।

কবজির আর একটা মোচড়ে খুনীটা আবার ওর হাতের রুপালি ইস্পাতের সাপটা টমের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ওটা বাতাসে শিষ বাজিয়ে কুণ্ডলী খুলে ছুটে এলো টমের দিকে। কিন্তু পুরোটা খোলার পরও টমের কাছে পৌঁছালো না। মুখের এক ফুট দূরে এসে থেমে গেলো। শিউরে উঠে খানকটা পিছিয়ে গেলো টম।

আবার যখন মুখ তুলে তাকালো, দেখতে পেলো খুনীটা নেই। তবে টম জানে যে ও কোনদিকে একে ভুলতে পারবে না।

মহলের দরজারে দিক থেকে সম্মিলিত চিৎকার ভেসে এলো। একদল কমলা কোমরবন্ধ পরা সৈন্য ধেয়ে এলো ওদের দিকে। তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হত্ৰ দৌড় দিলো টম। কানে খুনীর হাসিটা বাজছে।

মহলের দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস আর বাকি সিপাহীরা টমকে তাড়া দিতে লাগলো। কাছে পৌঁছাতেই টমকে টেনে তুললো ওরা। সাথে সাথেই কয়েকটা মাস্কেটের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলো। একটু আগে যেখানে টম ছিলো সেই বরাবর দেয়ালের প্লাস্টার আর ইট ভেঙে ছড়িয়ে গেলো চারপাশে।

ওরা সবাই দেয়ালের উপর কিন্তু নিরাপদ জায়গা থেক এখনো অনেক দূরে।

জোর করে হিকসের চেহারাটা মাথা থেকে সরিয়ে টম দ্রুত ওরা কয়জন সেটা গুনে নিলো। ফ্রান্সিস, হাবিলদার, পাঁচজন সিপাহী আর সেই যুবক ব্যাপারি। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে নিজের জামার বোতাম ধরে টানাটানি করছে। ওদের কাছে আছে মাত্র চারটা মাস্কেট।

“গুলি আর পাউডার কেমন আছে?”

“কয়েকটা মাত্র। আর এক কৌটা পাউডার।” ব্রিটিশ সেনাবাহিনির মতো, ভারতীয় দলগুলো এখনো গোল কান্ট্রিজ ব্যবহার শুরু করেনি। ওগুলোতে একটা কাগজের মোড়কের ভিতর গুলি আর সঠিক পরিমাণ পাউডার একসাথে ভরা থাকে।

দেয়ালের শেষ প্রান্ত থেকে রানির সেনাবাহিনির এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া গেলো। সদর দরজা খোলা রু হয়েছে। টম ব্যাপারি ছেলেটার কাধ ধরে দাঁড়। করালো।

“আমার দিকে তাকাও,” টম ঝাঁকি দিলো ওকে। “তাকাও আমার দিকে। নাম কি তোমার?”

“কা… কাইফেন, স্যার,” তোতলাতে তোতলাতে বললো ও।

“দৌড়াতে পারবে?”

কাইফেন মাথা ঝাঁকালো।

“তাহলে যতো জোরে পারো দৌড়ে কুঠিতে ফিরে যাও। ওদেরকে বলবে…” কি বলবে ভেবে পেলো না টম। ওরা আসার সময় যে কয়জনকে রেখে এসেছিলো তাদের কথা মনে পড়লো ওর; কয়েকজন মাত্র পুরুষ, মহিলা আর বাচ্চারা। কিভাবে ও এদেরকে নিয়ে দুর্গ রক্ষা করবে?

কিন্তু আর কি-ইবা করার আছে? ওদের একটা মাত্র ছোট নৌকা আছে, আর এই ঝড়ের মৌসুমে এই প্রমত্তা সাগরে ওটার উপর ভরসা করা হবে বড়সড় বোকামি। অন্যদিকে দুর্গের দেয়ালটা যথেষ্ট পুরু আর শক্ত। কেস্ট্রেল এর কামানগুলো উদ্ধার করতে পারলেও রানির সৈন্যদের কাছে খুব বেশি গোলাবারুদ নেই। তার মানে ওরা অবরোধ করে খুব বেশি সময় আটকে রাখতে পারবে না। সেই সাথে ভাগ্য যদি সহায়তা করে আর ঠিকঠাক কৌশল খাটানো যায়, তাহলে পাশার দান উল্টেও যেতে পারে। মাদ্রাজ থেকে সৈন্যদল এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব বলেই মনে হয়।

কাইফেন তখনও আদেশের অপেক্ষায় বসে। টম ওর আদেশের গুরুত্ব বুঝতে পারলো। ওর সিদ্ধান্তের উপরেই অনেকগুলো মানুষের জীবন নির্ভর করছে।

“ওদেরকে অবরোধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে বলবে। আমরা রানির সৈন্যদেরকে যতোক্ষণ পারি আটকে রাখছি।”

কাইফেন এমনভাবে দৌড় দিলো যেনো ওর পায়ে আগুন ধরে গিয়েছে। বাকিরা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকালো। টম ওদেরকে তিন জোড়ায় ভাগ করে দিয়েছে। প্রতি জোড়ায় একটা করে বন্দুক। আর একটা বন্দুক রাখলো নিজের কাছে।

“একজন একজন করে গুলি করবে,” আদেশ দিলো ও। “এক দল গুলি করার পর পরের দল গুলি করবে। তৃতীয় দল গুলি করতে করতে অন্য দল গুলি ভরে ফেলবে আবার। আর চেষ্টা করবে অফিসারগুলোকে তাক করতে। ওদের বিশৃঙ্খলা আর প্রশিক্ষণের অভাবই আমাদের একমাত্র ভরসা।”

*

এখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার চাইতে ফিরে গিয়ে কি করবে, সেই চিন্তাতেই টম আতংকে অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। ওর নিজের জন্যে না। সারাহ আর অ্যাগনেসের জন্যে। ওরা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে ওদের ভাগ্যে কি ঘটবে সেটা ভেবে। ওরা দৌড়াতেই থাকলো, দৌড়াতেই থাকলো। মাঝে মাঝে থেমে গুলি করলো বা বন্দুকে গুলি ভরলো। কখনোই খুব বেশি জোরে দৌড়াতে পারছিলো না, নিজেদের ক্রমেই শেষ হয়ে আসতে থাকা গোলা বারুদ সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। আর পিছনে রানির সৈন্যদল কুকুরের মতো তাড়া করলো ওদের।

টম গুলি করে আবার দৌড় দিলো। আবার গুলি ভরার জন্যে পকেটে হাত দিলো কিন্তু ওটা শূন্য। ফ্রান্সিসকে দেখতে পেলো পাশে, একটা গাছের পাশে গুড়ি মেরে বসে আছে আর ওর সঙ্গী গুলি ভরছে বন্দুকে।

“তোমাদের কাছে আর গুলি আছে?”

“দুটো,” ফ্রান্সিস কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো। “মিস করবেন না কথা দিলে একটা দিতে পারি।”

“তোমার ঋণ কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না!” টমও হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

তখনও দুই কি তিন মাইলের বেশি ওরা পার হতে পারেনি। দিনের আলো আর বেশি বাকি নেই, আর সামনের রাস্তায় যে পরিমাণ কাদা, তাতে মনে হয় না ওরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। রানির ঘোড়া আছে। যদি অশ্বারোহী সৈন্যরা বের হয়, তাহলে রাত নামার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে।

“কাইফেনের জন্যে আরো কিছু সময় বের করতে হবে।”

একটা বিস্ফোরণে কেঁপে গেলো আশপাশ। এতো জোরে যে ধাক্কায় সামনের গাছের পাতায় জমে থাকা পানি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়লো ওদের গায়ে। টম ফিরে তাকালো, আশংকা করছে যে রানির সৈন্যরা হয়তো ওদের সেই বড় বন্দুকগুলো নিয়ে বের হয়েছে। কিন্তু ও কাউকে ধেয়ে আসতে দেখলো না। সাথে সাথে আবারও কানে তালা লাগানো শব্দ হলো আর একটা।

“বজ্রপাত!” টম আর ফ্রান্সিস দুজনেই খুশি হয়ে গেলো।

একটা বড়সড় বৃষ্টির ফোঁটা এসে টমের হাতের উল্টো পিঠে পড়লো। তারপর আর একটা, আরও একটা। একটু পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো। এতো জোরে বৃষ্টি পড়তে লাগলো যে এতো ঘন জঙ্গল ভেদ করেও নিচের মানুষজন ভিজে যেতে লাগলো। বৃষ্টির বেগের চোটে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো ওদের। সামনে কয়েক হাতের বেশি কিছুই যাচ্ছে না।

“ওরা এর মধ্যে আর আগাতে পারবে না, আমরাও অবশ্য কিছু করতে পারবো না,” টম খুশি হয়ে গেলো। “তবে ওদের গান পাউডার ভিজে হালুয়া হয়ে যাবে, আর এর মধ্যে পাথর ঘষেও আগুন জ্বালানো সম্ভব না।” ও হাতের অদরকারী বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে সবাইকে জড়ো করলো। তারপর আবার পালানো শুরু করলো। বারবার কাদায় আছাড় খেয়ে পিছলে গেলো। কিন্তু থামলো না কোথাও। দুর্গে পৌঁছাতে হবে যে করেই হোক।

তবে রানির লোকজনও পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেয়নি। টম যতোবারই থেমে পিছনের তাকালো, ততোবারই দেখলো বৃষ্টির মাঝেও কিছু আবছায়া এগিয়ে আসছে।

সকাল বেলা হনুমানের মন্দিরের পাশের যে সাঁকোটা পার হয়েছিলো সেটার কাছে এসে পৌঁছালো টমের দল। যাওয়ার সময় যতোটা দেখেছিল তার চাইতে এখন পানি আরো পাঁচ ফুট বেশি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চকলেট রঙের পানি সঁকোর বাশের নিচটা ছুঁই ছুঁই করছে প্রায়।

পিছনে ধাওয়াকারীরা এতো দ্রুত এগিয়ে আসছিলো যে টম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ওর দলটাকে সাঁকোর উপর তুলে দিচ্ছিলো প্রায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে ওর খেয়াল হলো কি সুবর্ণ সুযোগ ওর সামনে। ও ঘুরে নিজের বাঁকা ছোরাটা বের করলো।

সৈন্যগুলো একদম সাঁকোর গোড়ায় পৌঁছে দেখতে পেলো যে অন্য পাড়ে টম ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা থেমে গেলো, ভাবছে এটা কোনো ফাঁদ কিনা, কিন্তু ওদের প্রতিপক্ষের সংখ্যাটা নজরে আসতেই হাসি ফুটে উঠলো মুখে। ওরাও অস্ত্র বের করে সামনে বাড়লো।

সৈন্যগুলো সাঁকোর অর্ধেক আসার আগে টম এক চুলও নড়লো না। তারপর আচমকা নিজের ছুরিটা বের করে সাঁকোর গোড়ার নারিকেলের ছোবড়ার কাছি বরাবর পোচ দিলো। তিন পোচেই হয়ে গেলো কাজ। বন্দুকের গুলির মতো শব্দ করে কাছি আলগা হয়ে সাঁকোটা একদিকে কাত হয়ে গেলো। সাথে সাথে বুপ অরে নিচের পানিতে পড়ে গেলো পাঁচ ছয়জন ধাওয়াকারী, সাথে সাথেই স্রোত টেনে নিয়ে গেলো তাদেরকে। বাকিরা মরিয়া হয়ে সাঁকোর পাশের সঁড়ি চেপে ধরলো। কিন্তু ওদের পা ঠিকই পানিতে ডুবে গিয়েছে। টম বাকি যে দড়িটা ছিলো সেদিকে মনোযোগ দিলো এবার। ঝটপট কয়েকটা পোচ বসাতেই আলগা হয়ে গেলো সেটা-ও। যে কয়জন সাঁকো ধরে ঝুলে ছিলো তারাও পড়ে গেলো পানিতে। গায়ের বর্মের ওজনের কারণে ডুবে যেতে সময় লাগলো না মোটেও।

বাকি যেসব সৈন্য তখনও সাঁকোর কাছে এসে পৌঁছেনি তারা দূর থেকেই। তাদের সঙ্গীদের সলিল সমাধির ব্যাপারটা দেখতে পেলো। পানির ধারে এসে তারা আতংক আর বিভ্রান্তিতে পিছিয়ে গেলো কিছুটা।

ঠিক সেই মুহূর্তে কালো ঘোড়ায় চলে এক অশ্বারোহী পিছনের বন থেকে বেরিয়ে এলো। পানির ধারে এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো সে, তারপর পিঠ থেকে না নেমেই অপর পাড়ে দাঁড়ানো টম আর ওর সঙ্গীদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখাচোখি হতেই টমের চেহারা গম্ভীর হয়ে গেলো। এই সেই কামান চোর লোকটা। একটু আগে, এ-ই ইস্পাতের সাপ দিয়ে হিকসের মুণ্ডচ্ছেদ করেছে।

একদৃষ্টিতে ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো, আর নদীটাও এতো বেশি চওড়া না যে দুরত্বের কারণে ওদের প্রতিহিংসা কমে যাবে। অশ্বারোহী চোখ নামিয়ে পানির দিকে তাকালো। হিসেব করছে যে লাফ দেওয়ার একটা চেষ্টা করবে কি-না। তারপর ঘোড়া নিয়ে একদম পানির কিনারে এগিয়ে এলো।

“পালিয়ে কোথায় আর কতোদূর যাবি?” বললো লোকটা। “আমি তোকে ধরবোই।”

অবাক বিস্ময়ে টম খেয়াল করলো লোকটা ইংরেজিতে কথা বলছে। একটুও আটকাচ্ছে না, বা উচ্চারণে কোনো টানও নেই। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া আর বেড়ে ওঠা এক লোকের আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ।

“কে তুই?” পানির গর্জনের ভিতর দিয়েই প্রশ্ন করলো টম।

অশ্বারোহী কোনো জবাব দিলো না। ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে ও আবার জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।

*

ঝড়ের কারণে রাত নেমে এলো দ্রুত। এই অন্ধকার আর বৃষ্টির মাঝে খেই হারিয়ে ফেললো ওরা। একাধিকবার দেখা গেলো ওরা খাড়ির ভিতরে নেমে পড়ছে। কিন্তু টম বিরতি দেওয়ার সাহস করলো না। কারণ, ও খুব ভালোমতোই জানে যে অশ্বারোহী লোকটা ওদেরকে ধাওয়া করা থেকে বিরতি নেবে না।

একটু পরেই ওরা পুরোপুরি পথ হারিয়ে ফেললো। কিন্তু তবুও টম কাউকে থামতে দিলো না বরং জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে দৌড় করিয়ে নিয়ে চললো। মাঝে একবার দম নেওয়ার জন্যে থামতেই ফ্রান্সিস এগিয়ে গেলো টমের দিকে।

“আমাদের থামা উচিত। এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে ঘুরে ফিরে আবার রানির জেলখানায় গিয়ে হাজির হয়েছি।”

টম জানে যে ফ্রান্সিসের কথা ঠিক। কিন্তু এতো সহজে হাল ছেড়ে দিতে রাজি না ও।

“আর কয়েক মিনিট। এর পরেই-” বলে ও থেমে গেলো। বৃষ্টি আর বাতাস দুটোই কমেছে কিছুটা। ফলে এর ফাঁকে নতুন আর একটা শব্দ শোনা যেতে লাগলো। “শোনো।”

ওরা দুজনেই শুনতে পেলো সৈকতে ঢেউ আছড়ে পড়ার নরম ছন্দময় শব্দ। “সমুদ্র,” একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো দুজন।

হাতের ছুরি দিয়ে জঙ্গলের মাঝের পথ পরিষ্কার করতে করতে টম সমুদ্রের শব্দ অনুসরণ করে আগাতে লাগলো। আচমকা জঙ্গল শেষ হয়ে সামনেই দেখা গেলো বালিতে ভরা একটা সৈকত।

“কোনদিকে যাবো?” টম ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু জবাব দেওয়ার আগে টমই ওদের সামনেই জ্বলতে থাকা দুর্গের বাতিটা দেখতে পেলো। তার মানে কাইফেন সময়মতো বার্তাটা পৌঁছে দিতে পেরেছে, আর সবাই ওদের অপেক্ষাই করছে।

টম আর ফ্রান্সিস দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো। কাঁচকোচ শব্দ তুলে দরজাটা খুলে যেতেই দেখা গেলো সামনে দুজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লণ্ঠন, ওদের দিকে মাস্কেট তাক করা।

“মেয়েরা সব কোথায়?” মাস্কেটের নল একদিকে সরিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো টম। “আমার বৌ কোথায়?”

*

উইলিয়াম কাইফেন ঝোঁপ জঙ্গল মাড়িয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলো। আছাড় খেলো, উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটলো। জীবনে কখনো এতো ভয় পায়নি ও।

জীবনে যে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। কাইফেন। জীবনে প্রথম যখন কোম্পানির মুনশির নীল পোশাকটা পরেছিলো, তখন ওর কল্পনায় ছিলো এক গৌরবময় ভবিষ্যতের হাতছানি। স্বপ্ন ছিলো এদেশে এসে কনসোল জেনারেল হয়ে হাতীর পিঠে চড়ে দিল্লির রাজদরবারে যাবে, এমন সব দামী দামী মূল্যবান পাথর বা গয়না উপহার পাবে যেগুলোর একটার দাম-ই হবে ওর বাবার এক বছরের রোজগারের সমান। লিংকনশায়ারের এক গির্জার সহকারী যাজক ছিলো ওর বাবা। কিন্তু এখানে এসে নিজেকে আবিস্কার করলো এই পাণ্ডববর্জিত কুঠিতে। এমন একজন গভর্নরের অধীনে ওকে কাজ করতে হয় যে কিনা ওকে এখানকার স্থানীয় চাকরদের চাইতে বেশি পাত্তা দেয় না।

ঝড়ের গতি বেড়েই চললো। মটমট করে ডাল ভাঙছে নাহয় গাছ থেকে ফল পড়ছে, আর কাইফেনের কানে সেগুলো মনে হচ্ছে মাস্কেটের গুলির আওয়াজ। ব্রিঞ্জোয়ানে পৌঁছে সৈকতে দুর্গের বিশাল বপুটা দেখার পরেও ও জানতো যে এখনো দুর্দশার কিছুই শেষ হয়নি।

ও দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সমস্ত লোক, মানে যারা ওদের সাথে যায়নি, তারা সবাই বেরিয়ে এলো ওর সাথে কথা বলার জন্যে। “টম আর ফ্রান্সিস কোথায়? মিস্টার ফয়? ক্যাপ্টেন হিকস?”

“মিস্টার ফয় আর ক্যাপ্টেন হিকস মারা গিয়েছেন। সবাইকেই মেরে ফেলা হয়েছে। শুধুমাত্র আমিই পালিয়ে আসতে পেরেছি।”

শোনামাত্র অ্যাগনেসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। অ্যানা তাড়াতাড়ি এগিয়ে ধরলো ওকে। নইলে পড়েই যেতো।

এর চাইতে মিসেস ফয় বরং তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ আরো সংযমের সাথে গ্রহণ করলো। কাঁদলো না বা মূর্ছা গেলো না; এমনকি এক ফোঁটা চোখের জলও বের হলো না।

“তাহলে আমাদের এখুনি পালানোর ব্যবস্থা করা উচিত,” সাথে সাথে বললো সে।

কাইফেন একদিকে কাত হয়ে বসে ওর গায়ের ব্যথা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো, “মিস্টার উইল্ড বলেছেন দুর্গকে অবরোধের জন্যে প্রস্তুত করতে।”

“তার মানে টম বেঁচে আছে?” অ্যানা জানতে চাইলো। “ফ্রান্সিস?

“আমি যখন রওনা দেই তখন পর্যন্ত দুজনেই বেঁচে ছিলো।”

“কিন্তু এতোক্ষণে মারা গিয়েছে নিশ্চিত, নির্বিকার গলায় বললো মিসেস ফয়। “দেরি করা যাবে না। একটা মিনিট দেরি করার মানে ওই অসভ্যগুলোর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। আমাদের মতো চারজন ভদ্রমহিলাকে পেলে ওরা যে কি করবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে?”

কাইফেনও বুঝলো যে কি হতে পারে আসলে। কিন্তু ও ইতস্তত করতে লাগলো। কিন্তু মিস্টার উইল্ড বলেছেন

মিসেস ফয়-এর চেহারা পাল্টে গেলো। যেনো এততক্ষণে সে পুরো ঘটনাটা অনুধাবন করতে পেরেছে। তারপর হঠাৎ হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে হাত দিয়ে কাইফেনের কোমর জড়িয়ে ধরে ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো।

“আমার স্বামী আর নেই,” বিলাপ করে উঠলো সে। “মিস্টার কাইফেন, এখন আপনিই পারেন আমাদেরকে বাঁচাতে।”

কাইফেন চোখ নামিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখা মহিলাটার দিকে তাকালো। তারপরেই ও যে সোজা তার বুকের ভাজটার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মিসেস ফয় ফোঁপাচ্ছেন আর তার স্তন ফুলে ফুলে উঠছে।

জীবনে প্রথমবারের মতো কাইফেনের কাছে এরকম সুন্দর কোনো মহিলা তার জীবন বাঁচানোর সবিনয় প্রার্থনা করছে। এর আগে কেউ কখনো তার কাছে কিছুই চায়নি। নিজের ভিতরে একটা দায়িত্ববোধ অনুভব করলো। ও। মিসেস ফয়কে ওর বাঁচাতে হবে। আর সেজন্যে দরকার হলে সেই প্রাচীন আমলের নাইটদের মতো সর্বস্ব বিলিয়ে দেবে। আর এখন সে বিধবা-একজন অসম্ভব ধনী বিধবা-আর এই শোকের দিন পাড়ি দিতে তার একজন পুরুষের শক্ত হাত লাগবে। আর একসময়, তার কৃতজ্ঞতা… নাহ কাইফেন আর ভাবতে পারলো না।

কাইফেন মিসেস ফয়-এর কাঁধে হাত রাখলো। নিজের সাহসে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। “চিন্তা করবেন না,” শক্ত গলায় বললো ও। “এখন থেকে আমিই আপনাকে রক্ষা করবো।”

“আমাদেরকে পালাতে হবে,” মিসেস ফয় বললো। “নৌকাটা প্রস্তুত করুন।”

“মিস্টার উইল্ড বলেছেন-”

“মিস্টার উইল্ড এখানকার হুকুমদাতা না। আপনি।” মিসেস ফয় ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, চোখে অনুনয়। কাইফেন হঠাৎ পাওয়া এই ক্ষমতার উত্তেজনায় শিহরিত হয়ে উঠলো। মিসেস ফয় আবার বললো, “আমরা আপনার উপরেই ভরসা করে আছি।”

কাইফেন জড়ো হওয়া লোকগুলোর দিকে ফিরে নিজের গলা পরিষ্কার করে নিলো। “নৌকাটা প্রস্তুত করো। দরকারি রসদ, পাউডার আর গুলি নিয়ে নাও। এক ঘন্টার মাঝে রওনা দেবো আমরা।”

বৃদ্ধ লোকগুলো আর বাচ্চারা ওর আদেশ পালনে ছুটলো। কিন্তু আর এক কোণে আলফ উইলসন আর তার লোকেরা বুকে হাত ভাঁজ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো। কাইফেন ওদের দিকে অস্থির ভঙ্গিতে তাকাতে লাগলো। কেস্ট্রেল-এর মেট-এর চাউনিটা ভালো লাগছে না ওর। এখানে যদি ওর কর্তৃত্বকে নাকচ করার মতো কেউ থেকে থাকে তাহলে সেটা এই লোকই।

“তাড়াতাড়ি যান,” ধমকের সুরে বললো ও। “একবার ধরতে পারলে কিন্তু রানির লোকেরা শূলে চড়াবে।”

ওর কোথায় পাত্তা না দিয়ে আলফ অ্যাগনেস আর অ্যানার দিকে এগিয়ে গেলো। “আমাকে কি করতে বলেন? টম আর ফ্রান্সিসের কি বাঁচার কোনো সম্ভাবনা আছে?”

ক্রমাগত কান্নার কারণে অ্যাগনেস আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। অ্যানা কথা বললো। নিজের কণ্ঠের আত্মবিশ্বাসে ও নিজেই চমকে গেলো। “আপনার অর্ধেক লোক নিয়ে কেউ বেঁচে আছে কিনা খুঁজতে যান। কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেবেন না। যদি রাস্তায় রানির সৈন্যদের দেখা পান তো সোজা পালিয়ে আসবেন। আর বাকি লোকেরা নাহয় নৌকাটা প্রস্তুত করতে সাহায্য করুক। টম আর ফ্রান্সিস বেঁচে থাক বা মারা যাক, আমার ধারণা, খুব শীঘ্রই নৌকাটা আমাদের কাজে লাগবে।”

অ্যানা অ্যাগনেসকে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলো। ও ভেবে পাচ্ছিলো না সারাহকে কিভাবে খবরটা দেবে। এখনো অসুস্থ্য হয়ে বিছানায় পড়ে আছে সে। ফ্রান্সিস আর টুম কি আসলেই মারা গিয়েছে? এতো প্রাণ প্রাচুর্য্যে ভরা দুটো মানুষ আর নেই, বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

এদিকে দুর্গে লিডিয়া ফয় তখনও কাইফেনের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে ওকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। লিডিয়া একটা চোখ সামান্য খুলে দেখালো লোকজন সবাই যার যার কাজে বিদায় নিয়েছে।

“গোডাউন থেকে কিছু মালপত্র নিয়ে নিতে ভুলবেন না যেনো।”

কাইফেন হতভম্ব হয়ে গেলো। “এই পরিস্থিতিতেও আপনার মাথায় ব্যবসার কথা ঘুরছে?”।

“আমার প্রাণ প্রিয় স্বামী এই ব্যবসার জন্যে প্রাণ দিয়েছেন। তার কাছে এটাই ছিলো সবকিছু। ঐ খুনীগুলোর হাতে তার মালপত্র গুলো ছেড়ে দেওয়া মানে তার স্মৃতিকেই অসম্মান করা।”

মিসেস ফয় উঠে দাঁড়িয়ে চেহারা থেকে অশ্রু মুছে ফেললো। কাইফেনের চাইতেও তিন ইঞ্চি বেশি লম্বা সে। গভীর নীল চোখ জোড়া দিয়ে সে এমনভাবে কাইফেনের দিকে চেয়ে রইলো যে ওর মাথা চক্কর দিতে লাগলো।

“আমরা যদি পালানোর পরেও ঠিকমতো বাঁচতে চাই, তাহলে অবশ্যই নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানোর পর আমাদের ভরণপোষণের জন্যে কিছু জিনিস থাকা উচিত। আমি বুড়ো বয়সে ভিক্ষা করতে চাই না।”

“সেরকম কিছু হবে না, ম্যাডাম। আমি নিজে আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।”

মিসেস ফয় কাইফেনের হাত ধরলো। “ওহ মিস্টার কাইফেন, আপনি কতো ভালো। কিন্তু আমাদের হাতে কিন্তু নষ্ট করার মতো একদম সময় নেই।”

কাইফেন চারজন শক্তিশালী লোককে মিসেস ফয়-এর সাথে ভাড়ার ঘরে যেতে বললো। কোন প্রতিবাদ ছাড়াই সবাই ওরা আদেশ পালন করতে ছুটতেই ব্যাপারটায় খুব সন্তুষ্ট হলো কাইফেন। আদেশ পালন করেই অভ্যস্ত ও, দিয়ে না। আজকের আগ পর্যন্ত ও ছিলো এখানকার সবচে ছোট মুনশি, কোম্পানির ক্ষমতার মইয়ের সর্বনিম্ন ধাপে অবস্থান ওর। বাকিরা ওকে মাড়িয়ে উপরে উঠে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে আজ একেবারে ক্ষমতাবান হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর এই অনুভূতিটা দারুণ সুখানুভূতি দিচ্ছে ওকে।

কিছুক্ষণের মাঝেই নৌকাটা সুতি কাপড়ের গাটরি, ইংল্যান্ড থেকে আসা হাতের কাজ করা কিছু মালামাল, ওয়াইন আর ব্রান্ডির ঝুড়িতে ভরে গেলো। মিসেস ফয় কড়া নজরে সব মালপত্র ভোলা তদারক করলো। সব মালপত্র যাতে একদম ঠিকভাবে রাখা হয়, সেদিকে সতর্ক নজর রাখলো সে। কাজ শেষে সন্তুষ্ট হয়ে আবার কাইফেনকে খুঁজে বের করলো।

“আমার সাথে আসুন,” বললো সে। “আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো।”

কাইফেন সাগ্রহে গভর্নরের বাড়িতে প্রবেশ করলো। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও, নানান চটকদার সম্ভাবনার কথা মাথায় আসতে লাগলো ওর। কিন্তু মিসেস ফয় ওকে সরাসরি তার সদ্য প্রয়াত স্বামীর অফিসে নিয়ে গেলো।

কাইফেন দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগলো। মিস্টার ফয় হয়তো মারা গিয়েছেন, কিন্তু বহুদিনের চর্চিত অভ্যাস মারা যায়নি। মিসেস ফয়-এর অবশ্য এধরনের কোনো সংকোচ নেই। সে লম্বা পা ফেলে ডেস্কের দিকে এগিয়ে গিয়ে একগাদা চামড়ায় বাধানো হিসাবের খাতা জড়ো করে কাইফেনের হাতে ধরিয়ে দিলো।

“এগুলোর আবার কি দরকার?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো কাইফেন।

“নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, যা যা ক্ষয়-ক্ষতি হলো তাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদেরকেই দায়ী করবে। আমাদের কাছেও তাই ওদের দাবীর বিপক্ষের প্রমাণ থাকা দরকার।”

কাইফেন এই মহিলার মানসিক ক্ষমতায় অবাক হয়ে গেলো। এরকম অসহ্য পরিস্থিতিতেও পরিষ্কার চিন্তা করে চলেছে।

“তবে আরো একটা ব্যাপার আছে।”

মিসেস ফয় এক কোনার কাঠের তৈরি একটা দেরাজ খুললো। ভারী দরজাটা খুলতেই কাইফেন বুঝলো ওটা আসলে একটা দেরাজ না। দরজার পেছনেই দেয়ালের মাঝে একটা না, চার চারটা সিন্দুক। সবগুলো লোহার তৈরি। বিশাল আকৃতির তালা ঝোলানো সেগুলোতে।

মিসেস ফয়-এর প্রতি কাইফেনের মুগ্ধতা আরো খানিকটা বাড়লো।

“এগুলো নিতে তো লোক লাগবে,” কাইফেন বললো।

“সাবধানে আনবেন। প্রতিটা সিন্দুকে স্বর্ণে এক হাজার পাউন্ড করে আছে।”

কাইফেন ভেবে পেলো না এই দুর্যোগ কি ওর জন্যে শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদে পরিণত হতে যাচ্ছে নাকি।

“আমাদেরকে তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়তে হবে,” মিসেস ফয় বললো। “তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে যেতে না পারলে আটকা পড়ে যাবো।”

কাইফেন ততোক্ষণে টমের নির্দেশ ভুলে গিয়েছে। সত্যি কথা হচ্ছে, ওর ধারণা টম মারা পড়েছে নাহয় রানির লোকদের হাতে বন্দি হয়েছে। কিন্তু তবুও ও থমকে গেলো।

“নৌকা এমনিতেই কানায় কানায় ভরে আছে; আর আমরা যদি সবাই ওটায় উঠি তাহলে নিশ্চিত ডুবে যাবে।”

“সেটাই,” মিসেস ফয় বললো। “কে কে নৌকায় যাবে সেটা ঠিক করে ফেলুন। বাকিরা এখানে থেকে আমরা ত্রাণ নিয়ে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত, যতোটা সম্ভব দুর্গ রক্ষা করার চেষ্টা করবে।”

স্বর্ণ ভরা সিন্দুকগুলো গালিভাত-এ তোলার পরে নৌকাটা পানিতে এতো বেশি ডেবে গেলো যে কাইফেনের মনে হলো ওটায় আর একজনের পক্ষেও ওঠা সম্ভব হবে না। সব লোকজন পানির ধারে জড়ো হয়েছে। সবাই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। আলফ উইলসন আর তার লোকেরা এখনো ফেরেনি।

অ্যানা নৌকাটার দিকে তাকিয়ে আছে। “এসব কি বলছেন? আপনারা যা পারেন নিয়ে ভেগে গিয়ে আমাদেরকে এখানে রেখে যাবেন? টম আর ফ্রান্সিস কিন্তু এখনো বেঁচে থাকতে পারে।”

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি,” কাইফেন বললো। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের চেষ্টা করছে। কোমরে গোজা পিস্তলের ওজন ওকে বেশ সাহস দিচ্ছে। তবে বৃষ্টির কারণে সম্ভবত ওটা আর ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। “মহিলা আর বাচ্চাদেরকে আমরা নৌকায় করে পাঠিয়ে দেবো। বাকিরা এখানে থেকে লড়াই করবে, আর কেউ যদি পালিয়ে আসতে পাড়ে তার জন্যে অপেক্ষা করবে।”

“খুবই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত,” মিসেস ফয় বললো।

“আলফ উইলসন আর ওর লোকেদের ফিরে আসা পর্যন্ত অন্তত অপেক্ষা করুন। টম আর ফ্রান্সিস সম্পর্কে যদি কিছু জানা যায়, অনুনয় করলো অ্যানা।

কাইফেন মিসেস ফয় এর সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো।

“এতোক্ষণেও যেহেতু ওরা আসেনি, তার মানে নিশ্চিত মারা পড়েছে, মন্তব্য করলো মিসেস ফয়। আমাদেরও সেই অবস্থাই হবে যদি এখুনি না পালাই। মিস্টার কাইফেন কিন্তু আপনাকে যথেষ্ট সমাদর করেছেন, মিস দুয়ার্তে। আপনি এই কুঠির কেউ না; এবং আপনার উদ্দেশ্যও সম্ভবত ছিলো আমাদের ব্যবসার ক্ষতি করা। তবুও মিস্টার কাইফেন আপনাকে পালানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ধন্যবাদের বদলে তার কপালে শুধু দোষারোপ-ই জুটছে।”

অ্যাগনেস সামনে এগিয়ে এলো। “আমি যাবো। কিন্তু সারাহ খুব দুর্বল। ওকে নিয়ে আসার জন্যে লোক দরকার আমার।”

অ্যানা অ্যাগনেসের জামার হাতা টেনে ধরলো। “দাঁড়ান। এদের সাথে আপনি যাবেন মানে?”

“মিস্টার হিকস মারা গিয়েছেন, তিক্ত কণ্ঠে বললো অ্যাগনেস। এখানে থাকার আর কোনো কারণ নেই?”

“টম আর ফ্রন্সিস তত আছে।”

অ্যাগনেস ভোঁতা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “টম আমার স্বামী না, সম্ভবত ও-ও মারা গিয়েছে। এখন আমার বলতে থাকলো শুধু আমার বোন সারাহ।”

অ্যানা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তখন খেয়াল হলো মিসেস ফয় অ্যাগনেসের পিছনে দাঁড়িয়ে কান পেতে ওদের কথা শুনছে। অ্যানার মনে হলো টমের আসল পরিচয়টা এখনো জানানো ঠিক হবে না। এতো বেশি নাটকীয়তার পর ও আসলে কল্পনাও করতে পারছে না যে ভাগ্য ওদেরকে এরপরে কোথায় নিয়ে যাবে।

অ্যাগনেস নৌকায় চড়ে বসলো। তিনজন লোক সারাহকে ধরে এনে নৌকার সামনের দিকে কাপড়ের গাঁটরিগুলোর গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। একটা অতিরিক্ত পাল ওর গায়ের উপর দিয়ে দেওয়া হলো। বাকিদের মধ্য কাইফেন দুটো ছেলে আর আটজন পুরুষকে বাছাই করলো। ও যেহেতু নৌকা বাওয়ার জন্যে লোক খুঁজছে, তাই দেখা গেলো কেস্ট্রেল-এর থেকে যাওয়া নাবিকদেরকেই নির্বাচন করেছে। এদের মাঝে সবচে প্রবীণ লোকটা হচ্ছে একজন সারেং, নাম হেল। ও চোখে প্রশ্ন নিয়ে অ্যানার দিকে তাকালো।

“আমাদের ক্যাপটেন মিস্টার উইলসন আসার আগ পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করা উচিত,” প্রতিবাদ করলো সে।

“আপনার শক্তপোক্ত লোকগুলোকে রেখে যান এখানে,” অ্যানা বললো। “যদি ঈশ্বরের কৃপায় ফ্রান্সিস আর টম ফিরে আসে, তাহলে ওদের কাজে আসবে। তবে টম এসে যদি শোনে যে সারাহ এভাবে সম্পূর্ণ অচেনা লোকজনের সাথে চলে গিয়েছে, তাহলে পছন্দ করবে না।” বলে ও নিচু গলায় বললো, “আমি মিসেস ফয় আর মিস্টার কাইফেনকে বিশ্বাস করি না। অন্তত যদি আপনি আর কেস্ট্রেল-এর কেউ নৌকায় থাকেন, তাহলে ওদেরকে রক্ষা করতে পারবেন।”

“মিসেস কোর্টনীকে এখানেই রেখে দিলে ভালো হয় না?”

“উনি সুস্থ্য হয়ে উঠছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সেটা আসলে-”

ওর কথা থেমে গেলো। কারণ লিডিয়া ফয় এর তাড়ায় নৌকার লোকজন এর মধ্যেই পাল তুলে দিয়েছে।

“যান, সাবধানে থাকবেন। আর সারাহের দিকে খেয়াল রাখবেন।”

হেল মাথা ঝাঁকালো। “উনি আমাদের মালকিনের মতে, মিস।” এরা। সবাই দীর্ঘদিন ধরে কোর্টনীদের হয়ে কাজ করছে। অনেকেতো টমের প্রথম সমুদ্রযাত্রা মানে সেই শেরপা জাহজেও ছিলো। নিজের মায়ের চাইতে সারাহকে ভালো চেনে। যখন ওদের ক্ষতস্থানে মলম লাগানোর প্রয়োজন হতো, যখন ডাঙায় থাকা ওদের বৌবাচ্চার কোনো সমস্যা হতো বা টাকা পয়সার দরকার হয়েছে-সারাহ সবসময় পাশে থেকেছে। ওরা সারাহকে ভালোবাসে, এমনকি জীবন দিতেও পিছপা হবে না। এইতো মাত্র কয়েক সপ্তাহ হয়েছে অ্যানা কোর্টনীদের সাথে কাটিয়েছে, তাতেই ওর নিজেরও এরকম মনে হচ্ছে।

“তুমি আসবে না?” অ্যাগনেস জানতে চাইলো।

অ্যানা মাথা নাড়লো। “ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করবো।”

“থাকুক ও,” মিসেস ফয় বললো। “বোকা মেয়েটা যদি নিজের ভালো না বোঝে তো আমাদের কিছুই করার নেই।”

নৌকাটা ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে এগিয়ে গেলো। তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নানান দুশ্চিন্তা পাক খেয়ে উঠতে লাগলো অ্যানার ভিতরে। আবার যাতে সবাইকে নিরাপদে দেখতে পায় সেজন্যে প্রার্থনা করতে লাগলো মনে মনে।

জঙ্গলের ধারে নাড়াচাড়ার আভাস পাওয়া গেলো। রানির লোকজন কি চলে এসেছে নাকি?

আলফ উইলসন আর লোকেরা বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। কাদা মেখে ভূত হয়ে আছে সবাই; ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে। প্রথম দর্শনে অ্যানা ওদেরকে চিনতেই পারলো না।

“টম বা ফ্রান্সিসের কোনো চিহ্নই নেই,” বললো উইলসন। “যতোর সাহসে কুলিয়েছে গিয়েছিলাম আমরা।”

“অনেক করেছেন।”

“তার মানে কিন্তু এই না যে ওরা বেঁচে নেই।”

“জানি। ধন্যবাদ।”

আলফ উইলসন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে শিষ দিয়ে উঠলো। পরিস্থিতি ধরতে পেরেছে ও।

“আমরা তাহলে থেকে যাবো বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, না?”

আলফের হাসিমুখে মেনে নেওয়াটা আজকের এই ভয়াল দিনটায় কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিলো অ্যানার মনে। আবারও ওর কোর্টনীদের প্রতি মুগ্ধতা বাড়লো, এতোগুলো বিশ্বস্ত লোক সবসময় ওদের সাথে থাকে।

“আমার মনে হয় আমাদেরকে এখানে বহুক্ষণই থাকতে হবে।”

“তাহলে মেহমানদারির জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে ফেললে ভালো হবে।”

*

হট্টগোলের শব্দ শুনে অ্যানা আর আলফ দৌড়ে এলো কি হয়েছে শুনতে। অ্যানা গভর্নরের বাড়িতে শুয়ে ছিল; আলফ-ও একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলো। উঠে দেখে নজর রাখতে রেখছিলো যাদেরকে তারা কেউ জায়গায় নেই। ক্ষেপে বোম হয়ে দরজার কাছে এসে দেখে টম আর ফ্রান্সিস। টম ততোক্ষণে বুড়ো দুজনের কাছ থেকে সব শুনে নিয়েছে।

“এটা যদি সেই শেরপা হতো তাহলে আমি এদের চামড়া তুলে নিতাম,” রাগে গরগর করতে করতে বললো আলফ।

“বাদ দাও,” টম বললো। ভিতরে ঢুকে, অবস্থা দেখে প্রথমে ও নিজেও ক্ষেপে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন সবিস্তারে দেখলো সব, তখন বুঝলো যে এদেরকে আসলে বকাবকি করে লাভ নেই। জ্যেষ্ঠরা এদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। দায়িত্বে অবহেলাটা এমনিতেই এসেছে তাই। এখন যদি ও চায় ওদেরকে নিয়ে ঐ ভয়ানক শত্রুদের বিরুদ্ধে এই দুর্গ রক্ষা করবে, তাহলে অবশ্যই এদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ পরিমাণ আত্মবিশ্বাস আগে ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

টম প্রায় টানা এক দিন আর রাত ঘুমায়নি; মহলের ভিতর আর জঙ্গলেও মরণপণ লড়াই করেছে, আর এসে কিনা দেখে যে সারাহ নেই। ও যদি একটা নৌকাও পেতো-একটা ছোট ডিঙ্গিও যদি হতো তাহলে তখনই বেরিয়ে পড়তো। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। একটু বিশ্রাম, গরম খাবারের জন্যে জন্যে শরীর টানছে, কিন্তু মনটা পড়ে আছে সারাহের কাছে।

টম জোর করে ভাবনাগুলো সরিয়ে দুর্গের উঠোনে সবাইকে জড়ো করলো। গুটিকয়েক উপস্থিতি দেখে নিজের হতাশা লুকাতে পারলো না ও। একুশ জন কোম্পানির লোক, যার মধ্য দুই-তৃতীয়াংশই পঞ্চাশোর্ধ। আর বাকিরা চৌদ্দর নিচে। এদের সাথে আছে রানির মহল থেকে পালিয়ে আসা ঐ হাবিলদার আর তার চার সিপাহী। আলফ উইলসন আর তার চারজন লোক, ফ্রান্সিস-তার মানে টম সহ মোট বত্রিশ জন পুরুষ।

“অস্ত্রপাতি কেমন আছে?”

“গুলি আর পাউডার নিয়ে চিন্তা নেই,” আলফ বললো। ও এর মধ্যেই খুঁজে দেখে এসেছে। কোম্পানি এদেরকে প্রচুর পাঠিয়েছে। কারণ অনেক সময় মাসের পর মাস রসদ পাঠানো সম্ভব হয় না।”

“মাস্কেট?”

“বেশি নেই, তবে আমাদের দরকারের চাইতে বেশি। তরবারি আর বল্লমও আছে অনেকগুলো। ক্যাপ্টেন হিকস তার অস্ত্রপাতি ভালোই গুছিয়ে রেখেছেন। ওনার আত্মা শান্তি পাক। আর হ্যাঁ, কামানও আছে অনেকগুলো।”

ইশ, যদি শুধু ওগুলো চালানোর মতো লোকবল থাকতো, টম ভাবলো। তবে নিজের দুশ্চিন্তা অন্যদের সামনে প্রকাশ করলো না। কারণ এমনিতেই ওর সাথে যারা আছে তাদের অবস্থা সঙ্গিন, আরও খারাপ করতে চায় না। ভাগ্যের ফেরে আজ ওকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি রক্ষার জন্যে লড়তে হচ্ছে।

সবাই টমের দিকে তাকিয়ে আছে। টম বুঝলো ওরা ওর বক্তব্য শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওদের ওর বক্তব্য শোনাটা দরকার।

যে লোকগুলো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে আর কি বলা যায়? কি বললে এরা সান্ত্বনা পাবে?

টম একটা পাথরে উঠে দাঁড়ালো।

“আমি জানি আপনারা এখানে লড়াই করার জন্যে আসেননি,” ও বলা শুরু করলো। কিন্তু শত্রুরা ধেয়ে আসছে, তাই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেয়ালগুলো সুরক্ষিত, অস্ত্রপাতি বা গোলাবারুদের কোনো ঘাটতি নেই। সবচে বড় কথা আমরা এখনো বেঁচে আছি। সবাই মিলে যুদ্ধ করবো আমরা, আর আমরাই আমাদেরকে বাঁচাবো। ঐ রানিকে এমন শিক্ষা দেবো যে আজীবন আমাদের সাথে লাগতে আসার জন্যে আফসোস করবে। বিনা উস্কানিতে কাপুরুষের মতো সে আমাদেরকে আক্রমণ করেছিলো। তার এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত বদলা আমরা নিয়েই ছাড়বো।”

উপস্থিত সবাই হর্ষ ধ্বনি করে উঠলো। এরকম পরিস্থিতিতে এইটুকুই বেশি। অন্তত লড়াই করার আগেই ওরা পরাজয় মেনে নেয়নি।

*

টম সবাইকে কয়েকটা দলে ভাগ করলো। সব দলেই বুড়ো, বাচ্চা, নাবিক আর সিপাহীদেরকে রাখলো। এক দলের নেতৃত্বে থাকলো আলফ উইলসন, আর একটার দায়িত্বে ফ্রান্সিস, তৃতীয় দলটার দায়িত্বে থাকলে সুবলদারটা।

টমের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিলো পানি নিয়ে। যেখানে যতো পিপা, জগ, মগ বা বালতি পাও সব নিয়ে এসো। তারপর নদী থেকে সেগুলোয় পানি ভরে আনো,” ফ্রান্সিসকে নির্দেশ দিলো ও। “অস্ত্রপাতির চাইতে খাবার আর পানির অভাবেই বেশিরভাগ অবরোধ ভেস্তে গিয়েছে।” আর একটা দলে গেলো ভাড়ার ঘর থেকে চাল আর লবণ দেওয়া মাছের বস্তাগুলো আনতে।

টম বাকিদেরকে পাঠালো নিরাপত্তা জোরদার করার কাজে। ওরা সদর দরজার নিচের দিকে কামানের নল ঢোকানো যাবে এমন বড় করে কেটে নিলো। লোকগুলোর মধ্যে একজন ছিলো কাঠমিস্ত্রি। সে কাটা খোপটায় এমনভাবে ঢাকনা লাগিয়ে দিলো যে বাইরে থেকে বোঝার উপায় রইলো না আর। সব শেষে কামানগুলোর উপর তেরপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো যাতে করে বৃষ্টির পানি না লাগে।

কাজ শেষ হলে টম গভর্নরের বাড়িসহ, ভিতরের যতো বাড়িতে তালপাতার ছাউনি ছিলো সেগুলো খুলে ফেলার আদেশ দিলো। শুকনো অবস্থায় ওগুলোতে যে কোনো সময় আগুন ধরে যেতে পারে।

টম দেয়ালের উপর উঠে দুৰ্গটা পরীক্ষা করে, কোনদিক দিয়ে কামান দাগলে বা আক্রমণ করলে ভালো হবে সেগুলো দেখে নিলো। ঘরের ছাউনি খুলে নেওয়ার পরে দুর্গের মাঝের জায়গাটা একটা ফাঁকা খোল-এর মতো হয়ে গেলো। বাতাসে ভেসে এসে বালি জমতে লাগলো সেখানে। যেনো সৈকত আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এই জায়গাটার দখল বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

বহুবারের মতো আবারও টম কোম্পানিকে তাদের অসাবধানতার জন্যে গালাগাল শুরু করলো-এই সবই ওদের অযথা ঔদ্ধত্যের বহিঃপ্রকাশ। যেনো এই উপমহাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করার মাধ্যমে এখানকার সব কিছুর উপরেও কর্তৃত্ববান হয়ে গিয়েছে। গোডাউনগুলো দুর্গের একদমই কাছে। ফলে অবরোধকারীরা চাইলেই ওখানে কামানের ঘাঁটি বানাতে পারবে। আরো খারাপ হচ্ছে, উত্তর দিকের দেয়ালের আড়ালে একটা কুঁড়ে আছে, একজন আততায়ী খুব সহজেই ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে। লোক পাঠিয়ে ওটাকে ভেঙে ফেলতে হবে।

জঙ্গলের ধারে নাড়াচাড়া চোখে এলো ওর। রানির অশ্বারোহী বাহিনির এক ডজন সদস্যু ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। পুরো সৈকতটা জুড়ে পানি ছিটাতে ছিটাতে এগিয়ে এলো ওরা। দুর্গের সামনে থেকে দুইশো গজ মতো সামনে এসে দাঁড়ালো। একজন একটা কাসার টেলিস্কোপ বের করে দুৰ্গটা পর্যবেক্ষণ করলো।

“একটা মাস্কেট আনো দেখি,” টম ডাক দিলো। ছেলেটা ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে এনে দিলো অস্ত্রটা। গুলি ভরা আছে দেখে সন্তুষ্ট হলো টম। সবচেয়ে কাছের অশ্বারোহীর দিকে তাক করে গুলি করলো ও।

টম জানতো যে ওরা নাগালের বাইরে। গুলিটা লোকগুলোর কয়েক কদম সামনে সৈকতের বালি খুবলে নিলো। ঘোড়াগুলো ভয়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। একটাতো সামনের দুই পা এতো বেশি তুলে দিলো যে আরোহী একটু হলে পড়েই যেতো। বাকিরাও পিছিয়ে গেলো।

টম মাস্কেটটা নামিয়ে নিলো। ওদের গায়ে গুলি লাগবে সেটা আশা করেনি। শুধু ওদেরকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলো যে লড়াই না করে ওরা ক্ষান্ত দেবে না। যে ছেলেটা মাস্কেটটা এনেছিলো ওকে আবার সেটা ছুঁড়ে দিলো টম।

“গুলি ভরে রেখো। তাড়াতাড়িই আবার ওটা লাগবে আমাদের।”

দুজন অশ্বারোহী ফিরে গেলে আবার। সন্দেহ নেই পিছনে যে সৈন্যদল আসছে ওদেরকে সতর্ক করতে গিয়েছে। বাকিরা অলস ভঙ্গিতে সৈকতে চক্কর দিতে লাগলো। তবে ভুলেও মাস্কেটের আয়ত্বের মধ্যে আসলো না।

“লোকজন সব ভিতরে এসেছে?”

“পানি আনতে যারা গিয়েছিলো তারা বাদে।”

“ফ্রান্সিস।” টম দৌড়ে গেলো নদীর ধারের দেয়ালটার কাছে। ফ্রান্সিস আর ওর সাথের লোকেরা নদী থেকে ফিরছে কেবল। কাঁধের পিপার ওজনের কারণে কুঁজো হয়ে আছে। গোডাউনের আড়ালে থাকার কারণে ওরা রানির সৈন্যদেরকে দেখতে পায়নি।

*

নদীর ধারে ফ্রান্সিস শক্ত মুখ করে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় ও এতো বেশি নিষ্ঠুরতা দেখেছে যা ওর কল্পনারও বাইরে; আর ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা বাদই দেওয়া হলো। কিন্তু ও বুঝতে পারছিলো যে সাথের লোকগুলো ওকে খেয়াল করছে। ওর নেতৃত্বের উপর ভরসা করছে। ও জানে যে খুব বেশি কিছু ও করেনি, তবে এদের ভরসার প্রতিদান দিতে চায় খুব ভালোভাবেই। নিজেও বাকিদের সাথে হাঁটু পানিতে নেমে, ঝড়ে উড়ে আসা কাঠ আর গাছের পাতা সরিয়ে, এই স্রোতের মাঝেও পিপাগুলো শক্ত করে ধরে রাখতে সাহায্য করতে লাগলো। এটা সেটা বলে সবাইকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিটা ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করলো। সবার নাম শিখে নিলো ও। খেয়াল করলো যে নাম ধরে ডাকলেই ওদের চোখমুখ কেমন উজ্জ্বল হয় উঠছে।

ওরা এরমধ্যেই একবার পিপাগুলো দুর্গের ভিতরে রেখে এসেছে। এখন এসেছে আরো এক সেট নিয়ে। হঠাৎ একজন লোক পানির দিকে কিছু একটা দেখালো। একটা গাছের গুঁড়ি ওদের দিকে ভেসে আসছে।

“ওটা কি?”

ফ্রান্সিস আতংকিত চোখে চেয়ে রইলো। ওটা কোনো গুঁড়ি না, একটা ভেলা। তিনটা লম্বা তক্তা সমান্তরাল রেখে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তক্তাগুলো কোনো রশি দিয়ে বাঁধা হয়নি। ওগুলোকে জোড়া দেওয়া হয়েছে একটা উলঙ্গ মানব শরীর দিয়ে। দেহটা অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ করার মতো গজাল দিয়ে তক্তাগুলোর সাথে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।

“এটাতো মিস্টার ফয়,” একজন আর্তনাদ করে উঠলো। লোকটা এখানকার হিসাবরক্ষক। নাম ইল্কলী।

এটা মিস্টার ফয় না বলে, এটা একসময় মিস্টার ফয় ছিলো বলা ভালো, মনে মনে ভাবলো ফ্রান্সিস। ফয়ের শরীরে নৃশংস অত্যাচারের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মুখ হাঁ করে আছে; দেখে মনে হচ্ছে একটা গর্ত যেনো। ঘাতকেরা ওর জিহ্বা কেটে বুকের সাথে গজাল দিয়ে গেঁথে দিয়েছ।

“ওনার কথা বলার ভঙ্গিটা ওরা পছন্দ করতো না,” ইল্কলী বললো।

ভেলাটা ভেসে চলে গেলো–সর্বোচ্চ এক হাত দূর দিয়ে। কিন্তু কেউই সেটা ধরার চেষ্টা করলো না। স্রোত ওটাকে ভাসিয়ে নিয়ে একটা বাঁক ঘুরে মোহনার কাছে একটা বালুর চড়ায় গিয়ে ঠেকালো।

“আমাদের ওনাকে কবর দেওয়া উচিত,” একজন সিপাহী বললো।

ফান্সিস জোর করে দৃশ্যটা মন থেকে সরিয়ে দিলো। নিজেকে সামলাতে হবে ওর। “বাদ দিন,” নির্বিকারভাবে বললো ও। “যদি সময় পাই তো পরে দেবো নাহয়। আপাতত যারা জ্যান্ত আছে তাদেরকে নিয়ে ভাবতে হবে।”

কেউ ও রকথার প্রতিবাদ করলো না। সবাই ভালো করেই জানে যে এই দুরবস্থার জন্যে শুধু মাত্র ফয়-ই দায়ী। তার জন্যেই ওদের জীবন এখন সুতার উপর ঝুলে আছে।

“সবগুলো পিপা ভরেছে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো। লোকেরা সম্মতি জানাতেই ওরা দুর্গের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্যে রওনা দিলো।

দুটো কাঠের দণ্ডের উপর পিপা বসিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। দুইজনে একটা করে নেওয়ার পরেও নিতে কষ্ট হচ্ছে। পা ভার হয়ে আসতে লাগলো, কাঁধ ব্যথা করতে লাগলো। তবে ওরা থামলো না। বাচ্চা ছেলে দুটো একটা ছোট পিপা নিয়ে আসছে। তবে ওরা আনছে বালির উপর গড়িয়ে গড়িয়ে! দেখে ফ্রান্সিসের গ্রামে বাচ্চাদেরকে চাকা বানিয়ে লাঠি দিয়ে ঠেলে নেওয়া খেলার কথা মনে পড়লো।

আচমকা মাস্কেটের গুলির আওয়াজ আশেপাশের গুমোট নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিলো। একজনের হাত থেকে দণ্ডের মাথা ছুটে গেলো। ঝাঁকিতে পিপার ছিপি খুলে পানি পড়তে লাগলো। ফ্রান্সিস একবার দুর্গের দিকে তাকালো, তারপর জঙ্গলের ধারে, কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না।

“তাড়াতাড়ি,” তাড়া দিলো ও। ও দ্রুত করতে চাচ্ছিলো, কিন্তু পিপার ওজন এতো বেশি যে সম্ভব হচ্ছিলো না। আর বালিতে ওদের পা ডেবে যাচ্ছিলো, ঘামে ভিজে যাওয়ার কারণে হাতগুলোও পিচ্ছিল হয়ে আছে।

ফ্রান্সিস পায়ের নিচে মাটিতে কাপুনি অনুভব করতে পারলো। মাথা তুলে দেখে দুর্গের দরজা খুলে যাচ্ছে। কেউ একজন দরজার ঠিক ওপরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। টম নাকি?

ঠিক সেই মুহূর্তে গোডাউনের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো ছয়জন অশ্বারোহী। ফ্রান্সিস আর সাথের লোকগুলোকে দেখতে পেয়েই ওরা ছুরি বের করে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো।

কাঁধ থেকে পিপা ফেলে পালাতে উদ্যত হলো সবাই। ওদের মহামূল্যবান পানি যে তাতে বালিতে মিশে যেতে লাগলো সেদিকে খেয়াল নেই।

“একসাথে থাকো সবাই,” ফ্রান্সিস চিৎকার করে ডাকলো সবাইকে। ও জানে যে একবার সবাই ছড়িয়ে পড়লে ওদেরকে পশুর মতো ধাওয়া করে মারা হবে। “আমার পাশে।”

দুটো বিশাল পিপা পাশাপাশি পড়ে আছে। ফ্রান্সিস সবাইকে ওটার পিছনে জড় করলো। ওদের কাছে মাস্কেট আছে পাঁচটা, কিন্তু মাত্র দুটোয় গুলি ভরা।

“ওগুলো আমাকে দাও,” বলে ও প্রায় ছিনিয়ে নিলো অস্ত্র দুটো। একটা নিজে নিয়ে আর একটা পাশের সিপাহীকে দিলো। অন্যগুলোতে গুলি ভরার সময় নেই এখন। “বেয়োনেট লাগিয়ে নাও,” আদেশ দিল ও।

অশ্বারোহীরা বিপজ্জনক গতিতে এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ফ্রান্সিস সবার সামনের ঘোড়াটার বুক বরাবর নিশানা করে গুলি করলো। ওটা এতো কাছে এসে পড়েছে যে ফ্রান্সিস ওটার নাকের ফুটো পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলো। নিরীহ প্রাণীটার জন্যে খানিকটা খারাপ লাগলো ওর। কিন্তু তাতে ওর নিশানা নড়লো না। গুলিটা হৃৎপিণ্ড বরাবর গলা দিয়ে ঢুকে গেলো। আশাপাশে বালির মেঘ উড়িয়ে সামনের পা দুটো বাকিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ওটা। ওটার আরোহী চেঁচিয়ে উঠলো, কারণ ঘোড়ার নিচে একটা পা চাপা পড়ে ওর টিবিয়া আর ফিবুলা হাড় দুটো একসাথে ভেঙে গিয়েছে। পিছনের অশ্বারোহীরা দিক বদলে সরে গেলো। কিন্তু একজন ঠিক এটার পিছনেই ছিলো। সে সরতে পারলো না। তার পরিণতিও এর মতোই হলো।

বাকি চারজন অশ্বারোহী লাগাম টেনে থেমে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মুখ আবার ফ্রান্সিস আর ওর সিপাহীদের দিকে ফেরালো। ঠিক সেই মুহূর্তে ফ্রান্সিসের পাশের সিপাহীটা ঠিকমতো তাক না করেই দ্বিতীয় মাস্কেটটা থেকে গুলি ছুড়লো। গুলিটা সোজা একজন অশ্বারোহীর নাকের উপর গিয়ে লাগলো। সৈন্যটা দুদিকে হাত ছড়িয়ে উল্টো হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে পড়ে গেলো। তবে পা তখনও জিনের ফিতেয় আটকে আছে। ঘোড়াটা ভয় পেয়ে সৈকত ধরে দিলো ছুট। আর সৈন্যটার মাথা সৈকত জুড়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরে ধুপধাপ বাড়ি খেতে লাগলো।

ফ্রান্সিস মাস্কেটের নলের সামনের দিকটায় বেয়নেট বসিয়ে প্যাঁচ মেরে আটকে দিলো। তিনজনকে কাবু করা গিয়েছে, কিন্তু এখনো তিনজন বহাল তবিয়তেই আছে। ওদের মধ্যে একজনকে দেখা গেলো পিস্তলে গুলি ভরছে।

তবে কি ভেবে সে গুলি করার বদলে আবার পিস্তলটা কোমরে খুঁজে সঙ্গীদেরকে কিছু একটা বললো। তারপর তিনজনই একসাথে ঘোড়া ছুটিয়ে, নদী পার হয়ে জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে গেলো।

ওরা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেলে, তার পরে ফ্রান্সিস ঘুরে তাকালো। দুর্গের দরজা তখনও খোলা, আর মাস্কেট হাতে প্রায় এক ডজন লোক দৌড়ে আসছে ওদের দিকে। টম আছে সবার সামনে। ওরা যখন দেখলো যে ফ্রান্সিস আর বাকিরা নিরাপদ তখন আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। টম এতোক্ষণ ফ্রান্সিস আর বাকিদের গায়ে লাগার ভয়ে বাকিদেরকে গুলি করার অনুমতি দিতে পারছিলো না। বাকিদের নিশানায় বিশ্বাস করে না ও।

টম ফ্রান্সিসের কাছে দৌড়ে গিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যেন ও টমের নিজের সন্তান। “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তুমি ঠিক আছে।”

লড়াইয়ের উত্তেজনা কমে আসতেই ফ্রান্সিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। টম টের পেলো ফ্রান্সিসের হাত কাঁপছে। ও ওকে শক্ত করে ধরে রইলো।

“দারুণ দেখিয়েছে, বাকি লোকগুলো যাতে শুনতে না পায় এমনভাবে বললো টম। “কতো অভিজ্ঞ লোকও এই অবস্থায় পড়লে, দিশেহারা হয়ে, উল্টোপাল্টা করে শেষে মারা পড়তো।”

ফ্রান্সিস পড়ে থাকা পিপাগুলো দেখালো। “অর্ধেকের বেশি পানি পড়ে গিয়েছে।”

“তাতে কিছুই হয়নি। চাইলেই আবার ভরে নেওয়া যাবে। কিন্তু তোমাকে হারালে পেতাম কই?”

“থ্রি চিয়ার্স ফর ইংল্যান্ড, ফ্রান্সিস বললো। “থ্রি চিয়ার্স ফর রেড, হোয়াইট অ্যান্ড ব্লম। হিপ হিপ-”।

কিন্তু উল্লাস ধ্বনিটা ওদের মুখেই আটকে রইলো। কারণ নদীর অপর পাড়ে আবার অশ্বারোহীরা আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু একটু আগে যেখানে ছিলো তিনজন, এখন সেখানে এসেছে প্রায় একশো জন। দুলকি চালে লম্বা একটা সারি করে জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।

“দুর্গে যাও সবাই,” চেঁচিয়ে উঠলো টম। “এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।

পিপাগুলোকে ফেলে রেখেই ওরা দরজার দিকে দৌড় দিলো। রানির অশ্বারোহী দল নদী পার হয়ে চলে এলো এপারে। তবে দুর্গের কামানের আওতায় আসার অনেক আগেই ঘোড়ার লাগাম টেনে থামিয়ে দিলো। যদি ওরা জানতো যে ভিতরে আসলেই কতো জন আছে, তাহলে হয়তো ঝুঁকিটা নিতো। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা কিছুই জানে না।

টম দরজার কাছে পৌঁছে এক এক করে সবাইকে ভিতরে ঢুকিয়ে সবার শেষে নিজে ভিতরে ঢুকলো। ফ্রান্সিস ওর পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে তাড়া দিতে লাগলো। সবাই ভেতরে ঢোকার পর কোটনীরাও ঢুকে গেলো ভিতরে। আলফ উইলসন দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে হুড়কো টেনে দিলো।

শত্রুর সেনাদল একটা বেষ্টনী রচনা করে ছড়িয়ে পড়লো। দুর্গের চারপাশে বেরিয়ে যাওয়ার সবগুলো পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। কয়েকজন সৈন্য গোডাউন আর গোলাঘরে ঢুকে নানা মূল্যবান মালামাল হাতে বেরিয়ে এলো। দুর্গের ভিতরের সবাই নিষ্ফল আক্রোশে চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু।

দিন শেষে পদাতিক বাহিনি এসে উপস্থিত হলো। সাথে একদল ষড়। প্রত্যেকে কেস্ট্রেল থেকে উদ্ধার করা একটা করে কামান টেনে নিয়ে আসছে। আরো কয়েকটা কামান আছে। কিন্তু ওগুলো খুবই পল্কা। লোহার চাকার উপর বাঁশের নল বসানো।

“ওগুলো আমাদের চাইতে ওদের গোলন্দাজদেরই সমস্যা করবে বেশি, টম মন্তব্য করলো। রানির লোকেরা সবাই জায়গামতো বসাচ্ছে কামানগুলো। ওর নিজের কামান, আর নেপচুন তরবারিটা শত্রুর হাতে পড়ায় মনে মনে ভাগ্যকে শাপ শাপান্ত করলো কিছুক্ষণ। “ওদের হাতে যদি শুধু আমাদের কামানগুলো না থাকতো, তাহলে পরের বর্ষা পর্যন্ত অবরোধে থাকলেও সমস্যা হতো না।”

“ওদের কাছে কিন্তু আপনার পাউডার নেই,” পাশ থেকে অ্যানা বললো।

“ওদের নিজেদেরই আছে।”

“ভারতীয় গানপাউডার আসলে ইংরেজদেরটার মতো অতো ভালো না। আপনার কামানের পাল্লা অনেক বেশি হবে।”

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ম্যাডাম। এরকম টানটান পরিস্থিতিতে আসলে তোমার মতো মেয়েমানুষই দরকার।” বলে টম হাবিলদারকে ডাকলো।

“মিস দুয়ার্তের বিশ্বাস যে ওদের কামানের চাইতে আমাদের কামানের গোলা বেশি দূর যাবে। আমাদের লোকদেরকে সেটা একটু দেখে নিতে বলেন।”

হাবিলদার স্যালুট দিয়ে ওর লোকদের ভাকলো। ওদের কর্মচাঞ্চল্য দেখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটলো টমের মুখে। এদের কাজে দক্ষতার অভাব থাকলেও আগ্রহের ঘাটতি নেই। পাক্কা দশ মিনিট লাগলো ওদের একটা কামানে গোলা ভরতে; সেন্টারাস বা কেস্ট্রেল-এর লোজন হলে দুই মিনিটেই একটা গোলা ছুঁড়তে পারতো।

সবাই পিছিয়ে দাঁড়াতেই হাবিলদার ওর হাতের আগুনটা টাচ হোলে স্পর্শ করালো। মুহূর্ত পরেই কামান গর্জে উঠলো আর আর ধাক্কায় নিচের কাঠের কাঠামোসহ ঝাঁকি দিয়ে উঠলো কামানটা। ধোঁয়ার ভিতরেই টম দেখলো যে গোলাটা শত্রুদের কামানের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে সৈকতের বালি টপকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একদল পদাতিক বাহিনির মাঝে গিয়ে পড়লো। ওরা কামানের গোলন্দাজদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিলো। সৈন্যগুলো গোলার আঘাতে পুতুলের মতো উড়ে গেলো একেক দিকে, কয়েকজনের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো দেহ থেকে। একটা বালিয়াড়ির ভিতর অর্ধেক ঢুকে গিয়ে অবশেষে গোলাটা থামলো। পানির স্পর্শ পেয়ে হিসহিসিয়ে বাষ্প উঠতে লাগলো ওটা থেকে।

একটু পরেই সন্তুষ্ট চিত্তে টম দেখতে পেলো রানির সৈন্যদল কামানগুলোকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আবার তাদের বলদের দল নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।

৬. অবরোধের মুখোমুখি

টম এর আগে কখনোই কোনো অবরোধের মুখোমুখি হয়নি-মানে ভিতর থেকে না। সমুদ্রের কোনো লড়াইয়ে বা ওঁত পেতে থেকে আক্রমণ করা লাগলে, ও ভালোই পারতো; কিন্তু এক্ষেত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু অপেক্ষা করতে করতে ওর সমস্ত সহ্য শক্তি শেষ হয়ে যেতে লাগলো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো। সারাহ থাকলে হয়তো ওকে শান্ত করতে পারতো। কিন্তু ও এখন অনেক দূরে, আর এই ভাবনাটা ওকে আরো রাগিয়ে দিচ্ছে।

এ কেমন পুরুষ আমি? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো ও। কমপক্ষে এক হাজার শক্তিশালী লোকের একটা সৈন্যদল ঘিরে রেখেছে ওকে, প্রতিটা দিনের প্রতিটা মুহূর্তে ও জানে যে এরা ওকে খুন করার জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো ভয় বা রাগ কাজ করছে না; ওর চরম মাত্রায় একঘেয়ে লাগছে।

প্রতিদিন ওরা কামান থেকে কয়েকটা এলোমেলো গোলা ছোড়ে, টম-রাও জবাবে ছোড়ে কয়েকটা। কিন্তু কোনোটাতেই খুব বেশি কিছু হয় না। রানির লোকেরা অবশ্য এরকম বিলম্বে কোনো সমস্যা বোধ করছিলো না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই দেখা গেলো টম ঐ পক্ষের আক্রমণের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এই অচলাবস্থা ভাঙার জন্যে ও যে কোনো কিছুতেই রাজি।

তবে ও শুধু অলস বসে থাকলো না। নিজের লোকেদের মাঝেও একই রকম অবসন্নতা লক্ষ্য করে ও দ্রুত ব্যবস্থা নিলো। কারণ, জানে এখনি কিছু না করলে ঝামেলা হবে পরে। ও বৃষ্টির পানি ধরার জন্যে চৌবাচ্চা খুড়তে লাগিয়ে দিলো সবাইকে, ফয়-এর ভেঙে ফেলা বাড়ি থেকে আনা তক্তা আর পাটের দড়ি দিয়ে ওটার পাশে বেঁধে দিলো। সাগরের দিক থেকে আক্রমণ আসার কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে, ও সাগরের দিকে তাক করিয়ে রাখে একটা কামান এনে উঠোনে বসিয়ে সবাইকে অনুশীলন করাতে লাগলো। ধীরে ধীরে সবাই কামানের নল পরিষ্কার করে আবার গোলা ভরে মাত্র দুই মিনিটেই গোলা ছুঁড়তে পারদর্শি হয়ে উঠলো। সেইদিন রাতে, যে দলগুলো বানিয়ে দিয়েছিলো তাদের মধ্যকার একাত্বতা দেখে টম খুশি হলো খুব। এরা একসাথে খায়, একসাথে পাহারাদারি করে, ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টা এসব তো আছেই। কামানের গোলা ছোঁড়ায় টম ওদেরকে একে অন্যের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু দেখা গেলো যে দলটাই ভালো করুক না কেনো, ওরা একজনের সাফল্যে অন্যজন উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।

আমার হাতে যদি শুধু এরকম একশো লোক থাকতো, তাহলেই আমি রানির শিবির আক্রমণ করে সব কয়টাকে মহল পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে আসতাম, মনে মনে ভাবলো টম। ‘

প্রথম সপ্তাহগুলোতে ওদের সবচেয়ে বড় ঝামেলা ছিলো হচ্ছে আবহাওয়া। দিনের পর দিন সমুদ্র থেকে ঝড় ধেয়ে আসতো। আর এই ভোলা দুর্গে সেগুলো আটকানোর কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। লোকজন সবাই দেয়ালের আড়ালে গাদাগাদি করে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঠকঠক করে কাঁপতো। রানির লোকজন যদি এই অবস্থায় আক্রমণ করতো, তাহলে দুর্গ দখল করতে ওদের একটা গুলিও খরচ করতে হতো না। কয়েকদিন পর ঝড় চলে গেলেও, অব্যাহতভাবে বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। টমের ধারণার চাইতেও বেশিদিন বৃষ্টিপাত চলতেই থাকলো। অবশেষ যখন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঁকি দিলো, তখন টম দীর্ঘদিন কারা ভোগের পর মুক্তি পাওয়া মানুষের মতো সাগ্রহে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।

কিন্তু ওরা হাফ ছাড়ার সময় পেলো না। জামাকাপড় আর পাউডার শুকোতে না শুকোতেই ওরা টের পেলো যে বৃষ্টির চাইতে সূর্য ওদের বড় শত্রু। দিনের মধ্যভাগে দুৰ্গটা একটা গনগনে উনুন হয়ে থাকতো। সবাই একফোঁটা ছায়ার খোঁজে উত্তপ্ত পাথরের গায়ে ঠেসে থাকতেও দ্বিধা করতো না। যে চৌবাচ্চাগুলোতে কয়েকদিন আগেও পানি উপচে পড়ছিলো, এখন সেগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।

শুকনো মৌসুম অবরোধকারীদেরকেও তাতিয়ে দিলো। কাছের গোডাউনটা জ্বালিয়ে দিলো ওরা। তারপর ইটগুলো দিয়ে নিজেদের কামানের জন্যে অবলম্বন বানালো। টম ওদেরকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ওরা ওদের কামানগুলো এনেছিলো রাতের বেলো, আর সকালের মধ্যেই কামানগুলো বসিয়ে এমন গোলাবর্ষণ আরম্ভ করলো যে টম-রা মাথা তোলারও সুযোগ পেলো না।

“ওরা আমাদেরকে আক্রমণ করতে চায়,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। অবরোধ শুরু হয়েছে ছয় সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। সবগুলো মাস্কেটে গুলি ভরে প্রস্তুত করে রাখো।”

গোলন্দাজ বাহিনির পিছু পিছু রানির সৈন্যদলও আগাতে শুরু করেছে। নরম বালিতে একটা পরিখা খুড়ছে ওরা। টম দরজায় করা ছিদ্র দিয়ে ওদেরকে দেখতে লাগলো। ওদের সর্দারের প্রতি বিশেষ নজর ওর। কোনো সন্দেহ নেই লোকটা টুঙ্গার, টেলিস্কোপে ওর চেহারাটা এতো কাছে চলে এলো যে টমের মনে হলো হাত দিয়ে ওর মাথার কাটা দাগটা স্পর্শ করতে পারবে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ও লোকদের নির্দেশ দিচ্ছে। ব্যালকনি থেকে পড়েও মরেনি সে। তবে আহত হয়েছে ভালোই। আর এখনো কোমরে নেপচুন তরবারিটা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাশে দাঁড়ানো লম্বা লোকটার সাথে পরামর্শ করছে সে। এই লোকটা তার অদ্ভুত ইস্পাতের চাবুকটা দিয়ে হিকসকে খুন করেছে। একদম নিখুঁত উচ্চারণে ইংরেজি বলে। একজন ইংরেজ কিভাবে রানির দলে জুটলো সেটা ভেবে পেলো না টম। সম্ভবত বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

গুলি করার জন্যে টমের হাত নিশপিশ করছিলো। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাস্কেটগুলো খুব বেশি ভালো মানের না। একদম খুব হিসেব নিকেশ করে মারতে না পারলে সেটা শুধু পাউডারের অপচয়ই হবে।

টুঙ্গারের পিছনে দেখা গেলো সৈন্যদল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

“ওরা পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করবে,” টম ঘোষণা দিলো। ও নিজের লোকদের জরিপ করলো একবার। ওরাও উঠোনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদে ঝলসে লাল হয়ে আছে চেহারা, ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শুকিয়ে আমসি। এদেরকে মোটেও যোদ্ধার মতো লাগছে না। আর সংখ্যায়ও এরা কতো কম।

“সবাই মাথা নিচু করে রাখবে। গুলি যেনো না লাগে।” টম ভেবেছিলো যে বলবে, “নিজদের জীবন বৃথা যেতে দিও না,” কিন্তু ভেবে দেখলো এটা আসলে একটা ফালতু কথা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই বাতিল কুঠির জন্যে জীবন দেওয়ার কোনো মানে নেই। ওরা লড়াই করছে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্যে।

“আমরা সবাই নিজেদের রক্ষার জন্যে লড়বো, আর সবাই মিলে এই দুর্যোগ পাড়ি দেবোই।”

টম সবাইকে জায়গামতো দাঁড় করিয়ে দিলো। নিজে দাঁড়ালো পূর্ব দিকের দেয়ালে, শক্রদলের মুখোমুখি; হাবিলদার আর আলফ উইলসন দাঁড়ালো উত্তর আর দক্ষিণে।

“তুমি উঠোনে থেকে দরজার কামানটা চালাও,” ফ্রান্সিসকে বললো ও। শুনে হতাশ হলো ফ্রান্সিস।

“চাচা, আপনি যদি আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে থাকেন…”

“আমি আমাদের সবাইকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি। তোমার দলটা হচ্ছে আমাদের শেষ ভরসা।” খেদোক্তি করলো টম। কণ্ঠে দুশ্চিন্তা আর প্রশংসা দুটোই আছে। এই বয়সে ও নিজেও কি এরকম ছিলো না? “তুমিও যুদ্ধ করার সুযোগ পাবে, নিশ্চিত থাকতে পারো।”

শত্রুর কামানগুলো চুপচাপ হয়ে আছে। তবে সৈন্যরা সবাই আড়ালে চলে গিয়েছে। টম ছিদ্র দিয়ে খেয়াল করলো, রানির লোকেরা ওদের কামানের নিচে চলে এসেছে। এতো কাছে যে ওরা চাইলেও কামানের নল এতো বেশি বাঁকা করতে পারবে না। নিজেদেরকে নিরাপদ ভেবে ওরা সামনে বাড়লো। বালির চড়াটার উপর দিয়ে দৌড়ে আসছে।

“তাড়াতাড়ি কামানের কাছে গিয়ে গোলা ছুঁড়তে থাকো,” ফ্রান্সিসকে বললো

আক্রমণকারীরা দরজায় বসানো কামানের ছিদ্রগুলো খেয়াল করেনি প্রথমে। যখন ওগুলোর ঢাকনা তুলে দুটো নাইন পাউন্ডারের লম্বা নল বেরিয়ে এলোতখন বুঝতে পারলো।

“ফায়ার, চেঁচিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস।

এরকম পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলো টম অ্যানা পুরনো চালের বস্তা সেলাই করে ছোট ছোট ব্যাগ বানিয়ে দিয়েছিলো। আর ছেলেরা সেগুলোতে মাস্কেটের গুলি ভরে টোপলা বানিয়ে রেখেছিলো। কামান থেকে ছোঁড়ার কারণে ব্যাগগুলো ছিঁড়ে একসাথে গুলিগুলো ছুটে গেলো। সৈকতের সামনের সারির লোকগুলো পড়ে গেলো সাথে সাথে। দ্বিতীয় সারির লোকেরা টের পেলেও পিছনের লোকের চাপের কারণে সরতে না পেরে লাশের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। ফলে আক্রমণের বেগ কমে গেলো অনেকটাই।

“রি-লোড,” ফ্রান্সিস আদেশ দিলো। তবে বলার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এতোদিনের যন্ত্রণা আর অপেক্ষার অবসান হয়েছে আজ। এতোদিনের প্রশিক্ষণ, হাতে ফোস্কা ফেলে তপ্ত কামানের গোলা দেগে অনুশীলন-সবকিছু প্রমাণের আজই সুযোগ। ওয়ার্ম এন্ড স্পঞ্জ, র‍্যাম দ্য কান্ট্রিজ। হোম! ওয়েডিং। শট। প্রিক দ্য কারররট্রিজ অ্যান্ড প্রাইম দ্য হোল। নিশানা করার দরকার হচ্ছে না কারণ লক্ষ্যবস্তু আকারে বিশাল আর ওদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে।

“ফায়ার।”

দ্বিতীয়বার আগের চাইতেও বেশি ক্ষতি হলো। সৈন্যরা সবাই ছড়িয়ে পড়েছিলো। ফলে মাস্কেটের একটা গুলিও অপচয় হলো না। ছুটোছুটির মাঝে কয়েকজন সৈন্য গুলির আওতা থেকে সরে যেতে পাশের পানিতে নেমে পড়লো। তবে তাতেও কাজ হলো না। ওদের রক্তে পানির রঙ লাল হয়ে গেলো। কয়েকজন মরলো ওদের উপর পড়া লাশের চাপে পানিতে ডুবে।

কিন্তু তবুও ওদের আসা থামলো না। দেয়ালের উপর থেকে টম দেখতে পেলো টুঙ্গার ঘোড়ার উপর বসে আছে। চেহারা সেই লম্বা শিরস্ত্রাণে ঢাকা। নেপচুন তরবারিটা দুর্গের দিকে নিশানা করে সৈন্যদেরকে আক্রমণ করতে উৎসাহ দিচ্ছে ও। একজন সৈন্য আতংকিত হয়ে পালাতে গেলো। টুঙ্গার ঘোড়ার পিঠে বসেই নিচু হয়ে এক কোপে লোকটার কাঁধ থেকে নিতম্ব পর্যন্ত ফেড়ে ফেললো। তারপর ঘোড়া দিয়ে মাড়ালো। খুবই স্বাভাবিক যে সৈন্যরা ওর মুখোমুখি হওয়ার চাইতে দুর্গের কামানের সামনে বুক পেতে দিতেই বেশি আগ্রহী।

টম গুলি করবে ভাবলো কিন্তু ধোয়ার কারণে টুঙ্গারের চেহারা ঢাকা পড়ে গেলো। এদিকে ঝামেলা বাধলো আর একটা। এতে প্রশিক্ষণের পরেও ফ্রান্সিসের লোকজন দ্রুত গোলা ভরাটা আয়ত্বে আনতে পারেনি। রানির লোকজন প্রায় দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। আর যতোই কাছে আসছে, ততোই কামানের গোলা ছোঁড়ার ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। সৈন্যরা দরজার দিকে আর না আগালেও, দেয়ালের দুই দিকে পানির স্রোতের মতো করে ছড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে অনেকেই বাঁশের বানানো লম্বা মই নিয়ে এসেছে।

“কামানের সাথেই থাকো,” ফ্রান্সিসকে ডাকলো ও। যদিও এতো বড় কামানটা দেওয়ালের গায়ে সেঁটে থাকা সৈন্যদের কিছু করতে পারবে না, কিন্তু তারপরেও ওটার কারণে অন্যেরা এদিকে আসতে কিছুটা হলেও ভাববে।

আক্রমণকারী সৈন্যদল দুর্গের তিনদিকের দেয়ালের পাশে জড়ো হলো। কামানের নল রাখার ফাঁকা জায়গাটায় একটা বাশের মই দেখে গেলো। টম এগিয়ে গিয়ে, না দেখেই নিচের দিকে গুলি ছুঁড়ে মইটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। মইটা আছড়ে পড়তেই আর্তনাদ শোনা গেলো। তার পরপরেই টম আর ওর লোকেরা দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিচে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করলো।

টম গুলি ছোড়া মাস্কেটটা একজন ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে, নতুন একটা তুলে নিলো। কিন্তু গুলি করতে দাঁড়াতেই, একযোগে অনেকগুলো গুলি ছুটে এলো ওর দিকে। দেয়ালের পাথরে গর্ত খুড়ে ওর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো গুলিগুলো। সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললো ও।

“এতো সহজে হাল ছাড়বে না এরা, বিড়বিড় করে বললো টম। যেনো ওর কথা প্রমাণ করতেই, আরো একটা মই দেখা গেলো আর এক পাশে। এবার অবশ্য টম আক্রমণকারীদের উঠতে দিলো। একটা খালি মাথা দেখা গেলো; দুটো কালো হাত দেয়ালের কিনার আঁকড়ে ধরলো। কিন্তু লোকটা নিজেকে টেনে তোলার আগেই, ওর গলা ধরে মই থেকে টেনে তুলে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলো টম। নিচ থেকে ছুটে আসা মাস্কেটের গুলি লোকটার শরীরে লাগতেই সে ছটফট করে উঠলো, তবু টম ছাড়লো না। এই ফাঁকে টমের লোকজন মাথা তুলে নিচের সবার দিকে গুলি করা শুরু করলো।

টম ছিন্নভিন্ন লাশটাকে ফেলে দিলো নিচে। আরো একটা সৈন্য মই বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু একটা ছেলে একটা বল্লম হাতে ছুটে এসে তার হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। টম মইটা ধাক্কা দিলো কিন্তু নাড়াতে পারলো না। নিচের লোকেরা মইটাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।

দুর্গের ছাদের দেয়ালের এপাশে, অস্ত্রপাতি আর গোলাবারুদের পাশেই এক ডজন ওয়াইনের বোতল দেখা গেলো। ওগুলো খালি করে ভিতরে পাউডার, তারকাটা আর ভাঙা ধাতুর টুকরো ভরা। আর একটা ন্যাকড়া স্পিরিটে ভিজিয়ে মুখে মধ্য ঠেসে ভরে রাখা হয়েছে।

টম ওর খালি পিস্তলটা একটা বোতলের পাশে ধরে ট্রিগার টিপলো। চকমকি পাথরের ঘষায় ফুলকি সৃষ্টি হয়ে ন্যাকড়াটার উপর পড়তেই আগুন ধরে গেলো। দেয়ালের পাশ দিয়ে বোতলটা ঢিল মারলো ও। মইয়ের গোড়ায় পড়ে বিস্ফোরিত হলো সেটা। যারা মইয়ের গোড়ায় ধরে ছিলো তাদের সবার শরীর মোরব্বা হয়ে গেলো। কারো কারো চোখ, কান, আঙুল উড়ে গেলো। মইটাও পড়ে গেলো সাথে সাথে।

আক্রমণকারীরা দেয়াল থেকে সরে গেলো। ফলে টমের লোকদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো এবার। ওরা বিরতিহীন ভাবে গুলি ছুঁড়ে গেলো। সৈন্যদের দিকে। ফলে আরো খানিকটা পিছিয়ে কামানের গোলার আওতায় চলে এলো তারা।

টম চারপাশে তাকালো। দুর্গের উপরে ভেসে থাকা ধোয়ার মেঘের ভিতর দিয়ে ও দক্ষিণ দিকের দেয়াল হাবিলদারের দলটাকে দেখতে পেলো। ওরাও ভালোই প্রতিরোধ করছে। কিন্তু উত্তর দেয়ালে দেখা গেলো আলফ উইলসন মরিয়া হয়ে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করছে।

মাথা নিচু করে টম দৌড়ে গেলো সেদিকে। আলফকে কিছু বলতে হলো না, টম পৌঁছাতেই বিপদটা দেখতে পেলো। দুর্গ থেকে গজ বিশেক দূরেই একটা পাথরের কুঁড়েঘর আছে। আর ওটার জানালা থেকে অবিরাম মাস্কেটের গুলি এসে দুর্গের দেয়ালকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।

“ওদেরকে ওখান থেকে বের করতে হবে,” টম চিৎকার করে বললো। “ওরা যদি ঐ বাড়িটার দখল রাখতে পারে, তাহলে ওঁত পেতে থাকার জন্যে দারুণ একটা জায়গা পেয়ে যাবে।” ভারতীয় মাস্কেটগুলোর মান ও পাল্লা ভালো হওয়ায়, অবরোধকারীরা ওখান থেকে সহজেই দেয়ালের এদিকে গুলি চালাতে পারছে। এদিক দিয়ে মই তুলতে তাই ওদের কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।

এই আশংকাই করছিলো টম। ওর লোকেরা সংখ্যায় এতো কম যে, কোথাও বেশি সৈন্য লাগলে অন্য কাউকে যে ডাকবে সেই উপায় নাই।

ও চিৎকার করে উঠোনে দাঁড়ানো ফ্রান্সিসের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ফ্রান্সিস তাকাতেই চার আঙুল তুলে দেখালো। মানে চারজন লোকসহ ফ্রান্সিসকে এদিকে আসতে ইংগিত করছে। তাতেও অবশ্য একটা কামান চালানোর জন্যে যথেষ্ট লোক দরজার কাছে থাকবে। আশা করছে এতেই আক্রমণকারীরা দরজার দিকে আগাতে দুইবার ভাববে।

ফ্রান্সিস আর ওর লোকেরা দুর্গের উপর উঠে এসে টমের পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো। দেয়ালের গায়ে মাস্কেটের গুলি লেগে সাই সাই করে ছিটকে যাচ্ছে একেক দিকে। টম ব্যাখ্যা করলো যে কি কি লাগবে।

“কিন্তু নামবো কিভাবে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“দড়ি বেয়ে।”

“আবার উঠবো কিভাবে তাহলে?”

“সেটা ওঠার সময় কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেবো আমি।”

“আমি মানে? আমরা না?”

“না,” টম বললো। “তুমি দেয়ালের উপর থেকে গুলি ছুঁড়ে আমাকে নামার সুযোগ করে দেবে।”

ফ্রান্সিসের চেহারা কালো হয়ে গেলো। প্রতিবাদে কিছু একটা বলতে গেলো ও। “সময় নেই এখন। যদি আমার কিছু হয়, সবাই তোমার দিকে চেয়ে থাকবে।” এক মুহূর্তের জন্যে টমের আর একটা দুর্গে আর একটা। অবরোধের কথা মনে পড়ে গেলো। এই সমুদ্রেরই অপর পাড়ে। সেবার একটা বিস্ফোরণের আঘাতে টমের বাবার পা উড়ে যায়, তখন টম দায়িত্ব নিয়েছিলো আক্রমণের।

ও ঈশ্বর, আমার ভাগ্যটা যেনো সেরকম না হয়, প্রার্থনা করলো টম।

ওরা দড়ি এনে দেয়ালের গায়ের আঙটাগুলোয় বেঁধে দিলো। টম ওর বুকের বেল্টে দুটো পিস্তল আটকে নিলো, আরও দুটো নিলো কোমরের বেল্টে। কাঁধে ঝোলালো একটা মাস্কেট। আর একটা বস্তায় ভরে নিলো আধা ডজন ওয়াইনের বোতলের বোমা।

“তোমার লোকদের ডাকো,” ফ্রান্সিসকে বললো টম। “এখনি।”

সবাই একসাথে গুলি করলো। এতো জোরে শব্দ হলো যে কানে তালা লেগে গেলো টমের। ঝলসানিতে চোখেও দেখলো না এক মুহূর্ত। গুলির চাইতে যে ধোয়াটা বের হলো সেটা বেশি কাজে দিলো ওর। দেয়ালের এপাশটা ঘোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় খোলা দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে থাকার গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকুতে নিরাপদেই থাকলো ওরা। তারপর দড়ি ধরে দিলো লাফ।

টম যাদেরকে বেছে নিয়েছে তারা সবাই কেস্ট্রেল-এর নাবিক। এরা ঘুমন্ত অবস্থায় একটা জাহাজ জ্বালিয়ে দিতে পারে। এতে দ্রুত ওরা দড়ি বেয়ে নেমে এলো যে আক্রমণকারীরা টেরও পেলো না। টম বালিতে নামেই দেরি না করে একটা গড়ান দিয়ে পায়ের উপর উঠে এলো। মাথার উপর ঠা ঠা শব্দ গর্জে উঠলো মাস্কেট। ফ্রান্সিসের লোকেরা আবারও গুলি করেছে, আক্রমণকারীরা যাতে মাখা তুলতে না পারে।

টম তরবারি বের করে ঘরটার দিকে দৌড় দিলো। আলফ উইলসন আছে ওর পাশে। হাতে একটা কুড়াল। একজন সিপাহীর পরশু-র বাট কেটে ছোট করে নিজেই বানিয়েছে এটা। আচমকা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে রানির সৈন্যদল পিছু হটলো।

তবে কুড়েটার ভিতরের আততায়ীরাও জবাব দিতে লাগলো সমানে। এই দাঙ্গার মাঝেও টম খেয়াল করলো ওটার জানালা থেকে ধোয়া বেরুচ্ছে। গুলি নিজেদের লোকের গায়ে লাগবে কিনা সেই পরোয়া করছে না। টমের সামনে এক লম্বা ভারতীয় সৈনিক পড়ে গেলো। মাস্কেটের গুলিতে তার মাথার পিছন দিকটা উড়ে গিয়েছে। তবে সব গুলিই কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না, টমের সাথের একজনের বাহুতে গুলি লাগলো; আর একজন চোখের মাঝে গুলি খেয়ে উল্টে পড়লো।

ওদের সামনে সৈকতটা একটা সরু নালায় গিয়ে মিশেছে। দুর্গ আর নালার মাঝ দিয়ে গিয়েছে সেটা। বাতাস বালি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওদিক দিয়ে। টম নালায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর লোকদেরকেও একই কাজ করতে ইশারা দিলো। ওরা যদি মাটির কাছাকাছি থাকতে পারে, তাহলে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাই ওদের জন্যে আড়াল হয়ে দাঁড়াবে। মাস্কেটের গুলি রানির সৈন্যদের গায়েই লাগবে। আর তাছাড়া ফ্রান্সিসের লোকগুলোও একটু পর পর গুলি করছে, ফলে শত্রুরাও মাথা বের করার সুযোগ পাচ্ছে না।

টম বস্তা থেকে তিনটা ওয়াইনের বোতল বের করলো। একজন নাবিকের দিকে ইশারা করলো ও। লোকটার বাড়ি কর্নিশ, নাম পেনরোজ। “এই তিনটা ফাটার সাথে সাথে তুমি আমার পিছু পিছু আসবে। আর আলফ তুমি গুলি করতে থাকো।” টম আলফকে নিজের দুটো পিস্তল ধরিয়ে দিলো। “প্রস্তুত?”

টম একসাথেই বোতলগুলোর ন্যাকড়ায় আগুন ধরালো। লকলকে শিখায় জ্যান্ত হয়ে উঠলো যেনো ওগুলো। যতোটা সম্ভব মাথা নিচু রেখেই দুটো বোতল বাড়িটার দিকে ছুঁড়ে দিলো। একটা বেশিদূর গেলো না, বালিতেই পড়ে নিভে গেলো। দ্বিতীয়টা বাড়িটার দেয়ালে লেগে চূর্ণ হয়ে গেলো। টম গালাগাল : করতে লাগলো। আর উপায় নেই; ঝুঁকিটা ওকে নিতেই হবে।

আলফ খেয়াল করলো টম কি করতে চাচ্ছে। সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে ও নিজের মাস্কেট উঁচু করে গুলি করলো। ঠিক সেই মুহূর্তে টম নালাটা থেকে মাথা উঁচু করে সবচে কাছের জানালাটার দিকে ঝুঁকে সজোরে বোতলটা ছুঁড়ে দিলো।

বোতলটা খোলা জানালা দিয়ে উড়ে গেলো। ছুঁড়ে মেরেই নালায় মাথা ডুবিয়ে ফেলার কারণে টম দেখতে পেলো না ব্যাপারটা। কিন্তু চাপা বিস্ফোরণের আওয়াজে টের পেলো যে ওর নিশানা ব্যর্থ হয়নি। একদম নিখুঁত লক্ষ্যভেদ যাকে বলে। মেঝেতে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বিস্ফোরিত হলো বোতলটা। ওটার ভিতরের প্রাণঘাতী জিনিসগুলো ছড়িয়ে পড়লো ছোট্ট ঘরটায়।

ভারী কিছু একটা আঘাত করলো টমের কাঁধে। প্রথমে ও ভেবেছিলো যে বোধহয় গুলি লেগেছে। তবে সেটা আসলে আলফ উইলসন। মাথা নিচু করতে ও টমের চাইতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পরিমাণ সময় বেশি নিয়ে ফেলেছে। তাতেই সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেলো। টমের উপর ঢলে পড়লো ও। কলার বোনের ঠিক উপরের একটা ক্ষত দিয়ে গলগল করে বের হচ্ছে রক্ত।

ওকে ধরার মতো সময় নেই টমের হাতে। রানির লোকজন এর মধ্যেই আবার জড়ো হতে শুরু করেছে। ও আলফের জামার হাতাটা কেটে, বুলেটের ক্ষতটার ভিতর ঢুকিয়ে দিলো যাতে অন্তত রক্তপাত বন্ধ হয়। আপাতত এর বেশি সম্ভব না। ওরা এখানে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না। যদি একবার এখানে আটকে যায়, তাহলে মৃত্যু সুনিশ্চিত।

টম মাথা তুলে সামনের দিকে দৌড় দিলো। পেনরোজও দৌড়ালো পিছনে। আর কেস্ট্রেল-এর বাকিরা আলফের সাথে দাঁড়িয়ে গুলি করতে লাগলো। আবারও ধোয়া ওদেরকে শত্রুদের দৃষ্টির আড়াল করে দিলো। টম সৈকত জুড়ে একেবেকে দৌড়াচ্ছে। আর সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই তরবারির কোপে ধরাশায়ী করছে। ধোয়ার ভিতরেও সামনের ডান থেকে গুলির আওয়াজ অবুসরণ করে আগাচ্ছে ও। ওর বোতলের বিস্ফোরণে ঘরের ভিতরের সবাই তখনও মারা পড়েনি।

ঘরটার পাশে ধোয়ার আবরণ এতই পুরু যে টম আর একটু হলেই সোজা গিয়ে ওটার গায়ে বাড়ি খেতো। ঘরটার পাশ ঘুরে এসে দেখে একটা ওক কাঠের খোলা দরজা। আধা ডজনের মতো রানির সৈন্য ওটার ভিতরে। টম ওদের দুজনকে পিস্তল দিয়ে গুলি করলো। ততীয় একজন মাস্কেট হাতে দৌড়ে এলো। টম একপাশে সরে গিয়ে লোকটার সাথে ধ্বস্তাধস্তি করে হাত থেকে অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে মুগুরের মতো করে লোকটার মাথায় বাড়ি দিলো। লোকটা পড়ে যেতেই, টম মাস্কেটের মাথা ঘুরিয়ে পরের লোকটার গলা বরবর সজোরে ব্যাট চালানোর মতো করে মারলো। ঘাড় ভেঙে পড়ে গেলো সে।

পেনরোজ বাকি দুজনকে সামলালো। টম দরজায় লাথি মেরে ভিতরে ঢুকে গেলো, হাতে উদ্দত তরবারি। এখানেই ওর বোতল বোমাটা কাজ সেরেছে। তিনজন লোক মেঝেতে মরে পড়ে আছে। রক্তে রঙিন হয়ে আছে ঘরের দেয়াল। আর একটা দরজা দেখা গেলো, ওটা দিয়ে ভিতরের আর একটা বড় ঘরে যাওয়া যায়। ওটার ভিতর থেকে গুলি করার, তারপর আবার গুলি ভরার আওয়াজ আসছে।

যদি একটা বোতল নিয়ে আসতো, তাহলে সেটা দিয়েই সব ঠাণ্ডা করে দেওয়া যেতো। কিন্তু ওর সাথে একটা তরবারি আর একটু আগে কেড়ে নেওয়া মাস্কেটটা বাদে আর কিছুই নেই। দুর্গ থেকে গুলির পরিমাণ কমে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের লোজন হয় গুলি খেয়েছে, নয়তো গোলাবারুদের ঘাটতি হয়েছে। যদি আক্রমণকারীরা নিজেদেরকে এখানে নিরাপদে রেখে আবার জড়ো হতে। পারে, তাহলে আর কয়েক মিনিটেই দুর্গের পতন হবে।

ঘরের ভিতর এতো লোক গাদাগাদি করে আছে সেটা টম চিন্তাও করেনি। কয়েকজন গুলি করছে, বাকিরা গুলি ভরে দিচ্ছে। কয়েকজন পাউডার আর গুলি এনে দিচ্ছে। প্রায় অসম্ভব একটা কাজ, কিন্তু আর উপায় নেই। ও পেনরোজের দিকে মাথা ঝাঁকালো।

ওরা দুজন ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়লো, এতো দ্রুত এগিয়ে গেলো যে কেউ মাস্কেট তাক করার সময়টাও পেলো না। টম হাতের তরবারিটা দিয়ে সাই সাই করে কোপাতে লাগলো, আর পেনরোজের চালাচ্ছে আলফ উইলসনের কুড়ালটা। এই ছোট জায়গায় এটাই ভয়ানক হয়ে দেখা দিলো। একটু পর দেখা গেলো ওগুলোও ব্যবহার করার দরকার পড়ছে না। ঘরের ভিতর ধ্বস্তাধস্তি করার মতো জায়গা ছাড়া আর জায়গা নেই।

এই যুদ্ধে ওদের জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে পড়লো টম। পেনরোজ পেটে ছুরি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো। সৈন্যদের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে গেলো মুহূর্তেই। টম ওকে ধরতে গেলো কিন্তু সামনেই আগাতে পারলো না।

টম আর এক পা পেছাতেই পিঠ ঠেকে গেলো পাথরের দেয়ালে। ফাঁদে আটকা পশুর মতো অবস্থা ওর এখন। রানির সৈন্যরা একটা অর্ধবৃত্ত করে ঘিরে দাঁড়ালো ওকে। ওদের সর্দার হচ্ছে কালো পাগড়ি পরা বিশাল বপুর একটা লোক। সে সামনে বাড়লো। তারপর নিজের কমলা কোমরবন্ধ থেকে একটা লম্বা নলের পিস্তল বের করে টমের চেহারা বরাবর তাক করলো।

গুলির আওয়াজ পেতেই টম বাঁকা হয়ে গেলো, তবে চোখ খোলাই ছিলো ওর। পিস্তলের ঘোড়া জায়গা ছেড়ে নড়েনি, কিন্তু দেখা গেলো ক্যাপ্টেনের চেহারাটা একটা রক্তের মুখোশে ঢেকে গিয়েছে।

ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে দরজায়, দুই হাতে দুটো পিস্তল। দুই পাশে দুর্গের দুটো লোক বেয়োনেট বসানো মাস্কেট উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হতভম্ব সৈন্যগুলো কিছু করার আগেই ফ্রান্সিসের লোকেরা আক্রমণ করে বসলো। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে টম ওদেরকে যেভাবে ছুরি চালনা শিখিয়েছে সেটা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করে দেখালো ওরা। সৈন্যরা এতো বেশি হতবাক হয়ে গিয়েছিলো যে বলতে গেলে কোনো প্রতিরোধই করলো না। জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা ভবন ছেড়ে পালাতে লাগলো, তাড়াহুড়ায় অস্ত্র নিতেও মনে থাকলো না।

“আমি তোমাকে আসতে নিষেধ করেছিলাম,” টম বললো ফ্রান্সিসকে। “তবে এসেছে বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এখন ঝটপট কাজ শেষ করতে হবে। আমরা এখনো নিরাপদ না।”

রানির লোকেরা ঘরটাকে লম্বা সময় ধরে ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করেছে। পিছনেই টম আর ফ্রান্সিস পাউডারের পিপার একটা ভাণ্ডার খুঁজে পেলো।

“এখানে যা আছে তা তো মাস্কেটের জন্যে অনেক বেশি,” টম বললো। “ওরা নিশ্চয়ই এখানে কামানও নিয়ে আসার চিন্তা করছিলো। এখন ওদের অস্ত্রকে ওদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবো।”

ওরা পিপাগুলোকে ঘরের মাঝখানে জড়ো করে একটা ন্যাকড়া খুঁজে দিলো ভিতরে। দুর্গের পূর্ব প্রান্তে তখনও গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু একদিকে, মানে উত্তর দিকে রানির লোকেরা যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়েছে। টম পাউডারে আগুন ধরাতেই সবাই বাইরের দিকে দৌড়ে গেলো। ছোট নালাটায় নেমে এসে টম বালিতে ছাপ দেখে বুঝতে পারলো একটু আগে ওরা কোথায় লুকিয়ে ছিলো। আলফ উইলসন যেখানে পড়েছিলো সেখানে রক্তে ভরে আছে।

এখন আর ওখানে কেউ নেই। “আলফকে কোথাও সরিয়েছে নাকি?” ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করলো টম। “এখানেই রেখে গিয়েছিলাম ওকে।”

ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো। “আমরা যখন এসেছি তখন কেউ ছিলো না এখানে।”

ঠিক সেই মুহূর্তে কুড়েটা বিস্ফোরিত হলো। বৃষ্টির মতো চূর্ণ পাথর ঝরতে লাগলো সৈকতের উপর। এমনকি দুর্গের দেয়ালের গায়েও লেগে খন খন শব্দ হতে লাগলো। ধোয়া কাটতেই টম দেখলো ঘরটা একেবারে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে।

“শালারা এখানে অন্তত আর কখনো কামান আনতে পারবে না,” সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললো টম।

বিস্ফোরণের পর লড়াইয়ের সর্বশেষ ইচ্ছেটুকুও উবে গেলো আক্রমণকারীদের। দুর্গের পাশ দিয়ে সবাই সেই সরু চড়াটা দিয়ে নিজেদের শিবিরের দিকে দৌড়ে যেতে লাগলো। দরজার কামান থেকে কয়েকটা গোলা তাদের পলায়নের গতিকে বাড়িয়ে দিলো কয়েক গুণ। দুর্গের লোকদের এখনো যুদ্ধ করার খায়েশ মেটেনি।

টম হাতের মাস্কেটটার উপর ভর দিলো। সারা গায়ে ব্যথা করছে ওর। এখন আর ও যুবক নেই। ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো ও। চুল উস্কখুস্কু হয়ে আছে, মুখ ধুলো আর ধোয়ায় ভরা, গায়ের জামা ছিঁড়ে একাকার, ঘামে ভিজে সপসপ করছে। টম যেনো নিজের ছেলের কৃতিত্বে গর্ব বোধ করতে লাগলো।

“তোমার আমাকে উদ্ধার করতে আসা উচিত হয়নি,” নিচু স্বরে বললো ও।

“আপনাকে বাঁচাতে আসিনি আমি,” ফ্রান্সিস বললো। “আমি ভেবেছিলাম আপনি মারা গিয়েছেন। আমি এসেছিলাম আপনার কাজটা শেষ করতে।”

টম ফ্রান্সিসের কাঁধের উপর হাত রাখলো। তারপর দুজন মিলে লাশের মিছিল পেরিয়ে দরজার দিকে যেতে লাগলো।

“তুমি খুবই ভালো দেখিয়েছো,” টম বললো। “কিন্তু একটা মাত্র লড়াই জিতেছি আমরা। সন্দেহ নেই খুব দ্রুতই আবার চেষ্টা করবে ওরা। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এখন আলফ উইলসন গেলো কোথায়?”

কিন্তু দুর্গের কেউই তাকে দেখেনি। “ও খুব আহত ছিলো,” টম কাতর স্বরে বললো। “কেউ নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে এসেছে।”

“আমার কাছে কেউ আনেনি ওকে,” অ্যানা জানালো। ওর পায়ে একটা নোংরা এপ্রন চাপানো। হাত রক্তে লাল হয়ে আছে। ওর নিজের না, যেসব আহতের সেবা করেছে, তাদের। “দুর্গে আনলে তো আমার কাছেই আনতো।”

“তাহলে কোথায়?”

একটা অসুস্থ চিন্তা মাথায় আসতেই টমের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। ও দেয়ালের কাছে দৌড়ে গিয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে সামনে তাকালো। সামনের লাশের স্তূপের ভিতর প্রয় বন্ধুর লাশ খুঁজছে। মাছি ভন ভন করছে লাশগুলোর উপর।

“দেখেন,” ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে উঠলো। “ওরা সাদা পতাকা উড়িয়েছে।”

চারজন অশ্বারোহী রক্তস্নাত বালি পেরিয়ে দুর্গের দিকে এগিয়ে এলো। একজন একটা বল্লম উঁচিয়ে রেখেছে। ওটার ডগায় একটা সাদা কাপড় বাধা। ওদের পাশেই আছে টুঙ্গার। ওদের পিছনে দুজন অশ্বারোহী একজন বন্দীকে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে টেনে নিয়ে আসছে। বন্দীর হাত বাঁধা, সেই দড়ির অপর প্রান্ত ঘোড়ার জিনের সাথে আটকানো। বন্দী সম্ভবত ঘোড়ার সাথে তাল মিলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছে।

দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো দলটা। বন্দী হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসলো।

“ওটাতো আলফ উইলসন,” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

“চুপ,” হিসিয়ে উঠলো টম। নিচে টুঙ্গার শুনতে পেয়েছে ফ্রান্সিসের কথা। ও শয়তানি হাসি দিলো একটা।

“এ তোর বন্ধু?” টুঙ্গার জিজ্ঞেস করলো।

“আমার দলের একজন।” টম যতোটা সম্ভব নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছে। আশা করছে আলফ বুঝবে কেন ও এরকম নির্মম আচরণ করছে। তবে টুঙ্গার এতে বোকা বলো না।

“আমি একটা প্রস্তাব দিতে এসেছি। আত্মসমর্পণ কর। আমি সব বন্দীকে ছেড়ে দেবো।”

“তারপর? আত্মসমর্পণ করে আমরা কোথায় যাবো?”

“পাশের গ্রামে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। ওখান থেকে ট্রাভাঙ্কোর বা কোচিনের ইংরেজ কুঠিতে চলে যেতে পারবি।”

“রানির মহলে যাওয়ার পর মিস্টার ফয়কে যেভাবে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলি, সেরকম তাই না?”

টুঙ্গার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো অনুতপ্ত কণ্ঠে কথা বলার। “রানি এই যুদ্ধের জন্যে খুবই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এখন উনি শুধু চান শান্তি।”

টম খুব ভালোমতোই জানে কোন ধরনের শান্তি রানি চান। তরবারির মাধ্যমে যে শান্তি আসে সেটা। ও না চাইতেও বারবার টমের চোখ আলফের দিকে চলে গেলো। আলফ মাথা তুলে মাথাটা দুর্বোধ্যভাবে নাড়তে লাগলো। আহত, প্রহৃত এবং বন্দী কিন্তু তবুও ওর চেহারা এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতায় দোদীপ্যমান। আলফ-ও টুঙ্গারের কথার আড়ালের চাতুরিতা জানে। নিজের জন্যে ও কখনোই সবার সর্বনাশের কারণ হতে চায় না।

টম এতো জোরে ওর তরবারির বাট চেপে ধরলো যে চামড়ায় দাগ বসে গেলো। শুধুমাত্র বহু বছর ধরে ওর বাবার কাছ থেকে শেখা অন্যকে সম্মান করার অভ্যাসের কারণে ও এখন এই শান্তি আলোচনা ভঙ্গ করে টুঙ্গারের দিকে গুলি ছুঁড়তে পারলো না।

“আমরা আত্মসমর্পণ করবো না,” টম ঘোষণা দিলো। “আর তুই যদি ওর একটা চুলও ছিড়িস, তাহলে আমি নিজে তোদের শিবিরে এসে তোকে এমন শিক্ষা দেবো যা বাপের জন্মেও কল্পনা করিসনি।”

টুঙ্গার তিক্ত একটা হাসি হাসলো। “আমি কি কল্পনা করতে পারি সে সম্পর্কে তোর কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আমার প্রস্তাব না মানলে শীঘ্রই সেটা দেখার সুযোগ পাবি।”

“ভাগ,” চিৎকার করে উঠলো টম। “আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে দিস না।

টুঙ্গার দাঁত বের করে হাসলো। “কসম; আমি ওকে ছোব-ও না।”

তারপর ও ঘুরে চলে গেলো। আলফ উইলসন শেষবারের মতো দুঃখিত চোখে টমের দিকে তাকালো। সৈন্যরা আবার টানতে টানতে নিয়ে গেলো ওকে।

টম উঠোনে নেমে এলো। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলো ফ্রান্সিস বলে উঠছে, “ওরা আলফকে করছেটা কি?”

টম আবার দৌড়ে উঠে এলো দেয়ালের ধারে। শত্রু শিবিরের পিছনেই দেখা গেলো সৈন্যরা আলফের গায়ের কাপড় খুলে ফেলে ওকে একটা পাম গাছের সাথে বাধছে। বাধা শেষ হলে একজন সৈন্য একটা মাটির পাত্রে করে কিছু একটা নিয়ে এলো। তারপর সেই তরলটা আলফের গায়ে মেখে দিলো। সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠলো ওর শরীর।

“এ কেমন শয়তানি?” টম অবাক হলো।

“ও ফিরে আসছে,” ফ্রান্সিস বললো। টুঙ্গার আবার ওর ঘোড়ায় চড়ে সৈকত ধরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। বল্লমের মাথায় সাদা কাপড় বাধা। তবে এবার একা এলো ও।

“কি করেছিস তুই?” প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠলো টম। “তুই কসম কাটলি যে তুই ওকে ধরবি না।”

“ধরিওনি। আমিতো শুধু প্রকৃতির হাতে ওকে ছেড়ে দিয়েছি।” ও ঘোড়াটা ঘুরিয়ে বল্লমের মাথাটা দিয়ে আলফ যে গাছে বাধা সেটার দিকে ইংগিত করলো “নারিকেল গাছে থেকে মিষ্টি একটা রস বের হয়। তাড়ি বলি আমরা। এখানকার লোকজনের তো ওটা পেলে হুশ থাকে না। আবার লাল পিপড়া, ভীমরুল এরাও খুব পছন্দ করে জিনিসটা। সকাল বেলা যখন এই রস বের হয়, তখন এসব পোকা হাজারে হাজারে এসে জড় হয় গাছের গায়ে। সূর্য মাথার উপর ওঠার পর ওরা বিদায় নেয়। পিঁপড়ারা গাছ ছেড়ে গাছের নরম শেকড়ে গিয়ে বাসা বাঁধে।” বলে হাসলো ও। “তবে হ্যাঁ, যদি যাওয়ার পথে আরো রসালো কিছু পায়, যেমন-একজন মানুষের নরম তুলতুলে মাংস, তাহলে ওরা তার শরীরেই বাসা বাধবে। আর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ওদের কামড় ভীমরুলের কামড়ের চাইতে কোনো অংশে কম না। আর আমি ওর শরীরে মধু লেপে দিয়েছি। সেটার লোভে ভীমরুলও আসবে।

“একটা মাস্কেট নিয়ে এসো, টম ফিসফিসিয়ে বললো ফ্রান্সিসকে। “তাড়াতাড়ি।”

“একজন মানুষের এভাবে মরতে তিন দিন পর্যন্ত লাগে,” টুঙ্গার বললো। দুর্গের বেশিরভাগ লোকই দেয়ালের পাশে এগিয়ে এসেছে শোনার জন্যে। কিন্তু টুঙ্গার এমন ভাব করলো যেনো ওদেরকে দেখেনি। ও আরো গলা চড়ালো।

“তোর লোকদের কথাটা বলে দিস। যে সবার আগে দরজা খুলে দেবে আমি তাকে জমি আর স্বর্ণ দিয়ে ভরিয়ে দেবো। আর বাকিরা সবাই মরবে-কিন্তু এমনভাবে মরবে যে সবাই ভাববে, এর চাইতে আগে মরে গেলেই ভালো ছিলো।”

“তোর এই দশা করবো আমি, আর তুই হাজারবার বেশি চাইবি,” টম ফ্রান্সিসের আনা মাস্কেটটা তাক করলো। টম ওর উদ্দেশ্য ধরতে পেরে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে, বালি ছিটিয়ে ফিরে গেলো নিজের শিবিরে। টমের গুলি ওর পেছনের পানিতে ঢেউ তুললো।

টম আবার গুলি ছুঁড়ে আলফ উইলসনের দিকে তাক করলো। আলফ এক চুল নড়ছে না। হয় খুব কষে বাঁধা হয়েছে, নয়তো নিজের দুর্ভাগ্য সম্পর্কে এখনো টের পায়নি। তবে টুঙ্গারের অত্যাচারের কৌশলে কোনো ফাঁক নেই। ভারতীয় মাস্কেটের গুলিও এতোদূর পাড়ি দিয়ে আলফের গায়ে লাগতো না।

তাও প্রচণ্ড রাগে টম ট্রিগার টিপলো। আবারও গুলিটা গিয়ে পড়লো সাগরের পানিতে। ঢেউয়ের ফেনার মাঝে ওটা নতুন কোনো আলোড়নই তুলতে পারলো না।

“এখন কি করবো?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো। ওর চেহারা বালির মতো সাদা হয়ে গিয়েছে।

“কিছুই করার নেই,” জবাব দিলো টম।

*

আলফ উইলসন মারা গেলো তিনদিন পর। দুঃস্বপ্নের চাইতেও ভয়ংকর তিনটা দিন-কাটতেই যেনো চাইছিলো না। কেউ কিছু বললো না, দুর্গের কারো সাহস হলো না টমের চোখের দিকে তাকাতে। প্রতিদিন সন্ধ্যায়, যখন বাতাস উল্টো দিকে বইতো, তখন ওদের কানে আলফের আর্ত চিৎকার ভেসে আসতো, টম বেশ কয়েকবার ভেবেছে রাতের বেলা চুপিচুপি গিয়ে আলফকে মুক্ত করে দিয়ে আসবে। কিন্তু টুঙ্গার ওখানে দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছে, আর রাতের বেলায় বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে রাখতো যাতে চারপাশের সবকিছুই ভালোমতো দেখা যায়। এমনকি আলফ মারা যাওয়ার পরেও ওকে ওভাবেই ফেলে রাখলো। একসময় ওর চেহারা বিকৃত হয়ে আর চেনা গেলো না।

পরের আক্রমণের জন্যে টম অপেক্ষা করে রইলো। যুদ্ধের জন্যে মনটা আঁকুপাঁকু করছে ওর। কারণ শুধু তা হলেই ও টুঙ্গারের উপর আলফকে হত্যা করার প্রতিশোধ নিতে পারবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর এলো না। সেই আগের মতোই শুধু কামানের গোলা বিনিময় করেই কেটে যেতে লাগলো দিন। শুধু কামানের আওয়াজেই টের পাওয়া যেতো যে দুই পক্ষই এখনো আছে।

“ওরা আমাদেরকে না খাইয়ে মারার চেষ্টা করছে,” টম মন্তব্য করলো। ও আজ থেকে সকালের খাবার বন্ধ করে দিয়েছে। আর এখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি আছে মাত্র আর আধা পিপা। এর মধ্যেই লোকজনের অসন্তুষ্ট ঘ্যানঘ্যান শুনতে পেয়েছে। কয়েকদিন পরেই সবাই মরিয়া হয়ে যাবে।

“ওরা মনোবল হারিয়ে ফেলছে,” হাবিলদার বললো। “আমাদের দেশে কেউ জীবন দিয়ে অবরোধ রক্ষা করে না। কেউ তার মালিকের প্রতি এতোটা বিশ্বস্ত না যে তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে। দুর্গের পতন সবসময় বিশ্বাসঘাতকতার জন্যেই হয়।”

ফ্রান্সিস কথাটা শুনে অবাক হলো। “মানুষজন এখানে এতোটাই দুর্বলচিত্ত? কোনো ইংরেজ কখনো এধরনের অসম্মানের কাজ করবে না।”

“উঁহু,” টম বললো। ভাতিজার আদর্শবাদিতা দেখে অবাক হয়েছে। “কাপুরুষতা বা স্বার্থবাদিতা থেকে কোনো জাতি-ই মুক্ত নয়। ইংল্যান্ডের পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে দেখো, আমাদের কতোগুলো দুর্গ বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণার জন্য বেদখল হয়েছে, গুণে শেষ হবে না।”

“আমার ধারণা রানি ঝামেলায় আছে,” অ্যানা বললো। “বর্ষা শেষ হওয়ার আগেই তার এই যুদ্ধ জিততে হবে। কয়েকদিন পরেই আবার ব্যবসার মৌসুম শুরু হবে। সেসময়েও যদি আমাদের সাথে যুদ্ধ চলতে থাকে তাহলে ওনার সওদাগরেরা তাদের কাপড় বা মশলা বিক্রি করার সুযোগ পাবে না। ওরা ওদের ক্ষতির জন্যে রানিকে দোষারোপ করবে, আর রানিও খুব বেশি খাজনা আদায় করতে পারবে না। পুরো রাজ্যেই সংকট সৃষ্টি হবে। রানি খুব ভালোমতোই সেটা জানে।”

টম ওর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালো। এই কঠিন সময়েও মেয়েটা ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবসার কথা ভাবতে পারছে। ও ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। ছেলেটা সারাক্ষণ অ্যানার পিছনে ঘুরঘুর করে, যখন ওর কাজ থাকে না তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে অ্যানার সাথে গল্প করে। অল্প হলেও, নিজের ভাগের ভাত বাঁচিয়ে অ্যানাকে দেয়। এরকম অবস্থাতেও ফ্রান্সিসের এতো প্রেমের নমুনা দেখে টম অভিভূত বলা যায়।

“বর্ষা শেষ হতে আর দেরি নেই।” টম এর মধ্যেই বাতাসে সেটার পরিবর্তন ধরতে পেরেছে। বাতাসের দিক বদলালেই ঠাণ্ডার একটা আমেজ পাওয়া যায় বাতাসে। কে জানে হয়তো রানি তার কর্মপন্থা বদলাতেও পারে।”

*

সোয়া মাইল দূরেই ক্রিস্টোফার বসে আছে টুঙ্গারের তাঁবুতে। তাঁবুর খোলা পর্দার ভিতর দিয়ে ও দেখতে পাচ্ছে যে নাইন-পাউন্ডের কামানগুলো সার বেঁধে ওগুলোর মাচার উপর নিস্কর্মা পড়ে আছে। দৃশ্যটা দেখে ভিতরে ভিতরে রাগ হলো ওর। এতোদিনে দুৰ্গটাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারতো ওগুলো। সাথে ওটার অধিবাসীরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। কিন্তু রানির পাউডার খুবই ফালতু, আর পাথরের গোলার বদলে ওকে ব্যবহার করতে হয় পাথর। সেগুলো শক্ত দেয়ালে লেগে ক্ষতি করার বদলে নিজেরাই চুরচুর হয়ে যায়।

“তোমার কর্মকাণ্ডে রানী খুবই অসন্তুষ্ট,” পুলা বললো। আজ সন্ধ্যায় কোনো খবর না দিয়েই এসে উপস্থিত হয়েছে সে। সাথে রানির পঞ্চাশজন দেহরক্ষী। ক্রিস্টোফারের চরদের দেওয়া তথ্যমতে পুলা নাকি এখন দিন-রাত রানির দরবারে পড়ে থাকে। সম্ভবত সেজন্যেই বসন্তে নতুন কুঁড়ি গজানোর মতো করেই আবার ওর দশ আঙুলে নতুন নতুন স্বর্ণের আংটি চকচক করছে।

যখন সুযোগ পেয়েছিলাম তখন তোর আঙুলগুলো কেটে ফেললেই ভালো হতো, মনে মনে ভাবলো ক্রিস্টোফার। সাথে তোর জিহ্বাও। একটা কাষ্ঠ হাসি হাসলো ও। তারপর অতিথিকে আর এক বাটি তাড়ি ঢেলে দিলো।

“দুর্গতে আরো কয়েক সপ্তাহ আগেই দখল হয়ে যেতো, ঝামেলতো বাধিয়েছে ঐ জাহাজডুবি হওয়া টুপিওয়ালাগুলো,” প্রতিবাদ করলো টুঙ্গার। “ওদের সর্দার যেনো একটা প্রেতাত্না, আস্ত শয়তান লোকটা।”

পুলা তাবুর একটা খুঁটিতে আটকানো নেপচুন তরবারিটার দিকে ইংগিত করলো। কুপির আলোয় ওটার বিশাল নীলাটার একদম গভীর থেকে আভা ছড়াচ্ছে। “যদি তুমি ওর তরবারিটা না নিতে, তাহলে মনে হয় সে আমাদের কথা-ই শুনতো। তার বদলে এখন আমাদেরকেই বাঁশ দিচ্ছে।”

“আপনি আসলে এখানে এসেছেন কেনো?” বেজার কণ্ঠে জানতে চাইলো টুঙ্গার। একটা গুবরে পোকা উড়ে এসে পুলার সামনে রাখা খেজুরের থালার উপর বসলো। শুঁড় নাড়তে নাড়তে ফলগুলোর উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো ওটা।

“বর্ষা প্রায় শেষ। কয়েকদিন পরেই সমুদ্র শান্ত হয়ে যাবে, আর টুপিওয়ালাদের জাহাজও কিন্তু আসতে থাকবে। যদি আমাদের তাঁতী আর কৃষকেরা তাদের মালামাল বিক্রি করার জন্যে কোনো খরিদ্দার না পায়, তাহলে কিন্তু সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।”

“মানে ওরা রানির খাজনা দেবে না,” চাপা স্বরে বললো টুঙ্গার।

“আর এই সৈন্যবাহিনি চালানোর টাকা আসে কোত্থেকে?” পুলা বললো। বলে ও কাশি দিলো একটা। তাড়ির মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে এলো শ্বাস থেকে। “আমি আগেই এই যুদ্ধ বাধাতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু তোমরা রানিকে তাল দিয়েছে। যেহেতু তোমাদের কথাই থেকেছে শেষ পর্যন্ত, তার মানে এখন ব্যাপারটা যাতে ভালোয় ভালোয় শেষ হয় সেটা দেখতে হবে। যদি ব্যর্থ হও, তাহলে চিত্তিত্তিঙ্কারার মহলে আবার তোমাদেরকে স্বাগতম জানানো হবে সেরকম ভেবো না। এই অযথা যুদ্ধে রানির পুরো এক বছরের খাজনা নষ্ট হয়েছে।”

“আপনারও ভালোই পয়সা খসেছে বোঝা যাচ্ছে,” ক্রিস্টোফার বললো।

“রানি হচ্ছেন নদীর মতো, দেদারসে পয়সা বিলাতে তার কোনো সমস্যা হয় না,” বললো পুলা। “তুমি বুঝবে না।” তারপর টুঙ্গারের দিকে তাকালো। “দস্যু আর ডাকাতদের সাথে যুদ্ধ বাধালে এরকমই হয়।”

গুবরে পোকাটা তখনও খেজুরের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। আচমকা টুঙ্গার ওটাকে মারার জন্যে প্রচণ্ড জোরে থাবা দিলো। থালাটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে সব খেজুর মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু গুবরেটা ভো ভো করতে করতে অক্ষত অবস্থায় কুপিটার দিকে এগিয়ে গেলো।

টুঙ্গার থালাটার একটা ভাঙা টুকরো তুলে নিয়ে হাত দিয়ে মুচড়ে গুড়োগুড়ো করে ফেললো। “আমরা এই যুদ্ধ জিতবোই,” শপথ করলো ও। “এখান থেকে চিত্তিঙ্কিারার রাস্তার দুধারে বল্লমের আগায় টুপিওয়ালাদের কাটা মুণ্ড ঝুলিয়ে দেবো। আর যখন, মহলে পৌঁছাবো, তখন তোর মাথাটা সদর দরজার পাশে ঝুলাবো। যারা রানির কান ভাঙায় তাদের জন্য শিক্ষা স্বরূপ।”

ক্রিস্টোফার কিছু বললো না। ও খুব ভালো মতোই জানে যে টুঙ্গার আর পুলার মাঝের এই দ্বন্দ্বই ওকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। যদি যুদ্ধে পরাজয় হয়, তাহলে টুঙ্গারের গর্দান তো যাবেই, সাথে ওরটাও যাবে।

পুলা উঠে দাঁড়ালো। “আমার মনে হয় না আর কিছু আলোচনার বাকি আছে। শুভ রাত্রি।”

তাবুর পর্দাটা তুললো পুলা। বাইরের জ্বলন্ত আগুনের আচমকা উজ্জ্বলতায় আকৃষ্ট হয়ে গুবরে পোকাটা সাই করে উড়ে গেলো সেদিকে। তারপর সোজা আগুনের ভিতর গিয়ে পড়ে, পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।

পুলা হাসলো। “দেখেছো? শত্রুদেরকে ধ্বংস করার কিন্তু অনেক উপায় আছে।”

*

পুলা চলে যাওয়ার পরে, ক্রিস্টোফার আগুনের পাশে বসে বসে ভাবতে লাগলো। ও জানে সবচে ভালো হয় জঙ্গলে পালিয়ে গেলে। কিন্তু তাহলে ওর জন্যে সব শেষ হয়ে যাবে। টুঙ্গার লোক পাঠাবে ওকে ধরে আনার জন্যে। তবে ক্রিস্টোফার ওদের হাত থেকে পালাতে পারবে।

কিন্তু তরবারিটার চিন্তা ও ছাড়তে পারছে না। তরবারিটা ওটার নীল পাথরের চোখ দিয়ে যেনো ওর দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ। ওর উত্তরাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। গত কয়েক মাসে কতোবার যে ও টুঙ্গারকে খুন করে তরবারিটা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু টুঙ্গারের শত্রু অনেক, তাই সর্বক্ষণ পাহারা রাখে চারপাশে। এই কয়েক মাসে ক্রিস্টোফার ওকে একটা বারের জন্যেও একা পায়নি বা তরবারিটাকেও টুঙ্গার কখনো চোখের আড়াল করেনি।

আগুনের উল্টোপাশে হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। কয়েকজন শশব্যস্ত হয়ে কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছে, একটু পরেই তিনজন প্রহরী এক লোককে ধরে নিয়ে এলো ওর কাছে। লোকটার বালি রঙের চুল না দেখলে সে যে বিদেশি সেটা বোঝা যেতো না। ক্রমাগত সূর্যের তাপে পুড়ে ওর গায়ের রঙ স্থানীয়দের মতো গাঢ় হয়ে গিয়েছে। লোকটার গাল ভাঙা, পা দুটো দেখে মনে হচ্ছে দিয়াশলাইয়ের কাঠি। শতছিন্ন জামাটার ভিতর দিয়ে হাড় জিরজিরে বুকটা দেখা যাচ্ছে।

এই লোকগুলো কিভাবে আমাদেরকে দিনের পর দিন আটকে রাখছে? ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো ক্রিস্টোফার। ও ইংরেজদের সর্দার লোকটার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেলো। এই লোকটা সমুদ্রে ডুবে মরতে মরতে বেচে ফিরে এসে ওদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে এখন। যদি দুর্গ দখল হয়, তাহলে লোকটা মরার আগেই তার কাছে থেকে অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব জেনে নিতে

“এই ব্যাটা আমাদের এখানে ঢোকার চেষ্টা করছিলো,” প্রহরীদের প্রধান বললো। “এ নাকি আপনার সাথে কথা বলতে চায়।”

“আমার সাথে?” অবাক হলো ক্রিস্টোফার।

“ও নাকি শুনেছে যে আপনি টুপিওয়ালাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন।”

ক্রিস্টোফার বন্দীর আপাদমস্তক জরিপ করলো। লোকটা চর নয়তো? একবার ভাবলো আগে একটু মারধোর করে সেটা বের করার চেষ্টা করবে কিনা।

পরে ভাবলো যে লাগলে পরেও তা করা যাবে।

“কি বলবি বল, ইংরেজিতে বললো ও। নইলে শেষ যাকে ধরেছিলাম তার মতো অবস্থা করে ছাড়বো।”

বন্দী হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। করুন কণ্ঠে কথা বলছে। “ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক, হুজুর। আমাকে না বললেও চলবে। আমি দেখেছি আপনি কি করেছিলেন। আমি চাইনা আমারো ওরকম হোক। আমি এখানে স্বেচ্ছায় এসেছি। আপনার জন্যে একটা প্রস্তাব নিয়ে।”

“কি প্রস্তাব?”

“আমার নাম হুজুর ইব্দুলী। আমি মিস্টার ফয়-এর হিসাবপত্র দেখতাম। আমি শুনেছি হুজুর, যে আপনাদেরকে দুৰ্গটা খুলে দেবে তাকে নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে। আর সাথে অনেক পুরস্কারও দেওয়া হবে।”

“হ্যাঁ,”

“আমি কাজটা করতে পারবো হুজুর। আমি আপনাদের জন্যে দুর্গের দরজা খুলে দেবো।”

লোকটা জুলজুল চোখে ক্রিস্টোফারের দিকে তাকিয়ে রইলো। ক্রিস্টোফার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। একবার ভাবলো এটা কোনো ফাঁদ নয়তো। আবারও মনে হলো যে ব্যাটাকে কিছুটা কড়কে দিয়ে সত্যটা বের করবে কিনা। কিন্তু কথা হচ্ছে দুর্গে এখন লোকজন খুবই কম। তাই দুর্গপ্রধান। নিশ্চয়ই এর মাঝে ফাঁদ পাতার জন্যে তার একটা লোকের জীবনের ঝুঁকি নেবে না। কারণ ওরা জানে যে ধরা পড়লে কি পরিণতি অপেক্ষা করছে।

“কখন পারবি?”

“কাল রাতে হুজুর। কাল আমাবস্যা, ওরা আপনাদেরকে আসতে দেখবে না।” তারপর হাত জোড় করে বললো, “পুরষ্কার তো পাবো, তাই না হুজুর?”

“তোর পাওনা তুই ঠিকমতোই পাবি,” জোর করে হাসি চেপে লোকটাকে আশ্বস্ত করলো ক্রিস্টোফার।

কৃতজ্ঞচিত্তে মাথা ঝাঁকালো ইক্বলী। “আমি তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরে যাই, হুজুর। আজ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব আমার, পরের জন আসার সময় যদি আমাকে পাওয়া না যায় তাহলে ক্যাপ্টেন আমার খবর করে দেবে। শালা একটা হারামজাদা। প্রতিদিন আমাদের অনুশীলন করারতে করাতে অবস্থা কাহিল করিয়ে দেয়। ভাবুন হুজুর, আমি একজন হিসাব রক্ষক, আর আমাকে দিয়ে এইসব করায়,” অপমানিত হওয়ার স্বরে বললো ইল্কলী।

ক্রিস্টোফার লোকটার প্যানপ্যানানি মন দিয়ে শুনছিলো না। কিন্তু ওদের ক্যাপ্টেনের কথায় মনোযোগ আকর্ষিত হলো ওর।

“তোদের ক্যাপ্টেনের নাম কি?” জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

“টম উইল্ড। মৌসুমের শুরুতে জাহাজডুবি হয়ে এখানে এসে উঠেছে। কেন হুজুর? চেনেন ওনাকে?”

“না কিন্তু কেমন যেনো খুব… পরিচিত মনে হয়।”

ক্রিস্টোফার ওর আশার চাইতেও বেশি জিনিস জেনে ফেলেছে। সোজা হয়ে বসে বললো, “যদি কাল দরজা খোলা পাই, তাহলে তোর ওজনের সমান স্বর্ণ পাবি।” বলে ও লোকটার চোখের দিকে তাকালো। যা দেখতে পেলো তাতে খুব খুশি হলো ওঃ লোভ, ক্ষুধা আর ভয়। “আর যদি না পাই, তাহলে স্বর্ণ গলিয়ে তোর গলা দিয়ে ভরে দেবো। সাবধান করে দিলাম।”

*

ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ। কেন তা ও জানে না। দুর্গের এক কোনায় উষ্ণ বালিতে শুয়ে ঝিমাচ্ছিলো ও। আপনাআপনি ওর হাত পাশে শুইয়ে রাখে মাস্কেটে চলে গেলো। নতুন চাঁদ উঠবে, আকাশ তাই আলকাতরার মতো কালো হয়ে আছে। অনেক আগেই ওদের মোম আর বাতি জ্বালানোর মতো তেল শেষ হয়ে গিয়েছে।

একটা হালকা পদক্ষেপ এগিয়ে এলো ওর দিকে। উঠে বসলো ও।

“ফ্রান্সিস?” অন্ধকারের ভিতর অ্যানার গলা শোনা গেলো। রাতের মতোই। শীতল আর নরম। ফ্রান্সিসের পাশে বসে ও নিজের পোশক টানটান করতে লাগলো। ফ্রান্সিস ওকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছে। ওর শরীর থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে।

“আমি ঘুমাতে পারছি না,” অ্যানা বললো। “দুঃস্বপ্ন দেখলাম একটা। আমি একটা বিশাল দুর্গের ভিতরে দৌড়াচ্ছি আর তোমাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। লোকজন ধাওয়া করছে আমাকে, একটুর জন্য ধরতে পারছে না। আর আমি জানি যে যদি আমি তোমাকে খুঁজে না পাই তাহলে ওরা তোমাকে খুন করে ফেলবে।”

কিছু না ভেবেই ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো অ্যানাকে। তারপর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

“স্বপ্নতো স্বপ্নই।”

অ্যানাকে নিজেকে সামলালো। “আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।”

“এইতো আর কয়েকদিন। সূর্যাস্তের ঠিক আগেই সমুদ্রে একটা পাল দেখেছি আমি। সাগরে জাহাজ চলা শুরু হয়েছে আবার। সারাহ আর অ্যাগনেস যদি মাদ্রাজে একটা খবর পাঠাতে পারে, তাহলেই হবে। ওখানকার গভর্নর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাহায্য পাঠাবে।”

“একটা জাহাজ যদি এসে আমাদেরকে অনেক দূরে কোথাও নিয়ে যেতো?”

অ্যানা অন্ধকার তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর সোজা হলো। ফ্রান্সিস কিছুটা লজ্জা পেয়ে ওর হাত সরিয়ে নিলো। কিন্তু অ্যানা সোজা হয়েছে ওর মুখ ফ্রান্সিসের মুখের সমান উপরে তোলার জন্যে। অ্যানা সামনে ঝুঁকলো, অন্ধকারে ফ্রান্সিসের মুখটা খুঁজছে।

অ্যানার ঠোঁটগুলো শুকনো কাগজের মতো হয়ে আছে। অ্যানা ওর ঠোঁট ফাঁক করে জিহ্বা দিয়ে ফ্রান্সিসের পুরো চেহারা ছুঁয়ে দিলো। ফ্রান্সিস ওকে জড়িয়ে ধরলো আবার। অ্যানার নরম স্তনের ছোঁয়া অনুভব করতে পারলো নিজের শরীরে। অ্যানার চুলের ভিতর আঙুল চালালো ও, তারপর

আচমকা ফ্রান্সিস নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মন খারাপ করে অ্যানা উঠে দাঁড়ালো। “আমি ভেবেছিলাম-”

ফ্রান্সিস ওকে মুখ দিয়ে হিসস শব্দ করে চুপ করিয়ে দিলো। “গন্ধ পাচ্ছো?”

অ্যানা নাক কুঁচকে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করলো। কেমন যেনো… সালফারের মতো গন্ধ।”

“বন্দুকের সলতের গন্ধ,” ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়ালো। মন থেকে সমস্ত প্রেমের চিন্তা উধাও। “আমরা এসব বন্দুক ব্যবহার করি না। আমরা ব্যবহার করি ফ্লিন্টলক বন্দুক (চকমকি পাথর ব্যবহার করে গুলি ছোঁড়া হয় যে বন্দুকে)। শুধু ভারতীয়রাই ম্যাচলক বন্দুক ব্যবহার করে (সলতেয় আগুন ধরিয়ে গুলি ছোঁড়া হয় যে বন্দুকে)।”

মুহূর্তেই অ্যানাও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ফেললো। “পাহারায় কে আছে?”

“ইল্কলী।”

ফ্রান্সিস দেয়াল ধরে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি খুঁজে বের করলো। “চাচাকে ডেকে তোলো,” অ্যানাকে বললো ও। “হয়তো কিছুই না, কিন্তু…”

এতোদিনে দুৰ্গটা ফ্রান্সিসের এতো পরিচিত হয়ে গিয়েছে যে এই অন্ধকারেও দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে কোনো সমস্যা হলো না ওর। সিঁড়ির শেষ মাথায় নেমেই জায়গায় জমে গেলো।

রাতটা ওর ধারণা মতো অতোটা অন্ধকার না। পশ্চিম দিকের আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে তারা জ্বলজ্বল করতে দেখা যাচ্ছে; আর পূর্ব দিগন্তে একটা হালকা লালচে আভা ভোর হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু এসব দেখে ও থমকে যায়নি। ওর নিচেই, দুর্গের চারপাশের সৈকতে একগুচ্ছ কমলা বিন্দু আভা ছড়াতে ছড়াত এগিয়ে আসছে। ঠিক কামারশালায় যেভাবে আগুনের ফুলকি ছড়ায়। ও জানে ওগুলো কি। ওদের শত্রুদের ম্যাচলক বন্দুকের সলতের ধিকিধিকি আলো।

ও আবার উল্টোদিকে উঠতে যেতেই টমের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে ফেলেছিলো প্রায়। “ওরা চলে এসেছে, হাফাতে হাফাতে বললো ফ্রান্সিস। “অনেক সৈন্য। একশোর বেশি। দরজার ঠিক বাইরেই চলে এসেছে।”

“ওদেরকে কেউ দেখেনি? ইল্কলী কোথায়?”

“জানি না। ওকে দেখিনি।”

শব্দ করে দরজা খুলে গেলো। টম আর ফ্রান্সিস ঘুরে গেলো সেদিকে। দ্রুত ভোর হচ্ছে, ক্রান্তীয় অঞ্চলে এরকমটাই হয়। হালকা আলোয় সদর দরজাটা এখন দেখা যাচ্ছে। কিছু একটা নড়ে উঠলো ওখানে।

ইল্কলী ওদেরকে আসতে শোনেনি। অবরোধের শুরুতে, টম ফয়-এর ভেঙে ফেলা বাড়িটা থেকে লোহার বর্গা এনে লাগিয়ে দরজাটাকে অনেক মজবুত করে বানিয়েছে। এখন তাই এই ভারী দরজাটা খুলতে ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসেও ওর ঘাম ছুটে যাচ্ছে। ও কাজটা করার জন্যে খুব বেশি সময় পায়নি, আবার এদিকে রানির লোকজন আগে আগেই নিজেদের বন্দুকের সলতেয় আগুন লাগিয়ে ফেলেছে। প্রচণ্ড ব্যস্ততায় দরজা খোলার চেষ্টা করছে ও, কারণ শত্ৰুদলের সর্দার যদি এসে দেখে এখনো দরজা বন্ধ তাহলে যে ওর কি অবস্থা করবে সেটা ভাবতেও চাচ্ছে না। তিনমাস এই দুর্গে থেকে, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কান্তর হয়ে ইল্কলী সব আশা হারিয়ে ফেলেছে। দুর্গের পতন হতোই। আজ হোক আর কাল হোক। ও শুধু চায় নিজেকে বাঁচাতে।

সর্বশেষ হুড়কোটাও খুলে গেলো। ইল্কলীর ঘামে ভেজা হাত থেকে ছুটে গেলো দণ্ডটা। দড়াম করে নিচে গিয়ে পড়লো সেটা। কে কে শব্দটা শুনেছে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সুযোগ পেলো না ইল্কলী। দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে আছে শত্ৰুদলের সেনাপতি। দরজা খোলামাত্র আক্রমণ করে বসলো সে।

ইল্কলী দণ্ডটা তুলে বালিতে ছুঁড়ে দিলো। তারপর দরজায় কাঁধ ঠেকিয়ে সজোরে ঠেলতে শুরু করলো। বৃষ্টিতে ভিজে মরিচা পড়েছে কজায়, আর যেহেতু ব্যবহার করা হয়, না ময়লা জমে একেবারে ভয়ানক শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে দরজাটা। ইল্কলী আরো জোরে ঠেলা দিলো, নিজের শক্তির বহর দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলো খুব।

কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে বাই করে ঘুরে গেলো ও। টম আর ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। দুজনের হাতেই উদ্যত তরবারি। পিছনেই দেখতে পেলো বাকি সবাই জেগে উঠছে, ফিসফিস করে টমের আদেশ একজন আর একজনকে শুনিয়ে চুপচাপ নিজেদের অস্ত্র নিয়ে জায়গামতো চলে যাচ্ছে।

“একি করছিস তুই?” বেদনাহত কণ্ঠে বলে উঠলো টম।

ইল্কলী উত্তর দিতে গেলো কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। তোতলানো আরম্ভ হলো ওর। “আমি শুধু-”।

ততোক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গিয়েছে। ওর মরিয়া প্রচেষ্টায় দরজাটা ফুটখানে ফাঁকা হয়েছিলো, কিন্তু শত্রুদল এইটুকের অপেক্ষাতেই ছিলো। ফাঁকটা দিয়ে টম দেখতে পেলো একঝাক জ্বলন্ত ফুলকি জোনাকি পোকার মতো করে বালির মধ্য থেকে উড়াল দিলো যেনো। ও দরজার দিকে দৌড় দিলো।

“ওরা আসছে,” হাবিলদার চেঁচিয়ে উঠলো। ও ততোক্ষণে দুর্গের উপরে উঠে গিয়েছে।

টম ধাক্কা দিয়ে ইন্ধলীকে সরিয়ে আবার দরজাটা বন্ধ করার জন্য ধাক্কাতে শুরু করলো। যথেষ্ট আলো এখন চারপাশে। আক্রমণকারীরা ওকে দেখে ফেললো। একটা মাস্কেট ছোঁড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। টমের মাথার সামান্য উপর দিয়ে শিষ কেটে উড়ে গেলো একটা গুলি।

ফ্রান্সিস টমকে টেনে সরিয়ে নিলো। সাথে সাথে আর একটা গুলি এসে লাগলো দরজায়। দরজার লোহার চলটা উঠে ছুটে গেলো পাশ দিয়ে। এক মুহূর্ত আগে ঠিক টমের চোখ ছিলো সেখানে।

টম দরজার কামান দুটোর দিকে তাকালো। ওগুলোতে গোলা ভরে রাখা কিন্তু টাচ হোলে কোনো পাউডার নেই। টম দেয়ালে ঝোলানো একটা পাউডারের কৌটা টেনে নামিয়ে ঢেলে দিলো পুরোটা, তাড়াহুড়ায় ছড়িয়ে ফেললো খানিকটা। ফ্রান্সিস একটা দেয়াশলাই নিয়ে এলো।

আক্রমণকারীরা এর মধ্যেই দরজাটা খোলার জন্যে ধাক্কানো শুরু করেছে। টম প্রথম কামানটায় আগুনটা ছুয়িয়েই লাফ দিয়ে সরে গেলো ওখান থেকে। সাথে সাথে গর্জে উঠলো সেটা। বিস্ফোরণে দরজাটা ওটার কজা থেকে খুলে গেলো, সাথে উড়িয়ে দিলো যারা দরজা ধাক্কাচ্ছিলো তাদেরকে। দ্বিতীয় দলটা এগিয়ে এলো খোলা দরজা দিয়ে, কিন্তু টম ততোক্ষণে দ্বিতীয় কামানটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। আগের লাশগুলোর উপর জমা হলো এদের লাশ।

কিন্তু পিছনে আরো অনেক সৈন্য-আর কামানে আবার গোলা ভরার সময় আর নেই। যে তক্তাগুলো দিয়ে দরজাটাকে ভারী করা হয়েছিলো, টমের লোকজন সেগুলো তুলে নিয়ে দরজার সামনে তূপ করে দিলো। দরজার সামনে পড়ে থাকা লাশ, কামান আর দরজার ভাঙা অংশ, সব মিলিয়ে মোটামুটি একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো। ওরা ওটার পিছনে হামাগুড়ি দিয়ে বসে লুকালো।

সবাই আচমকা ঘুম থেকে উঠলেও, গত কয়েক মাসে টম যেভাবে কড়াকড়িভাবে নিয়ম শৃঙ্খলা অনুশীলন করিয়েছে তা কাজে দিলো আজ। লোকেরা ঠিকঠাক জানে কাকে কি করতে হবে। আর টমের কামানের বিস্ফোরণ ওদেরকে সেসব করার জন্যে পর্যাপ্ত সময় এনে দিলো। অর্ধেক লোক প্রতিবন্ধকতার পিছনে লুকিয়ে গুলি করতে থাকলো। বাকিরা মাস্কেটে গুলি ভরে দিতে লাগলো। ওদের পিছনে দুটো কম বয়সী ছেলে বালির ভিতর একটা গর্ত খুড়ছে। টম দেখিয়ে দিয়েছে জায়গাটা।

কিন্তু ওদের অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণের পরেও শত্রুরা আসতেই থাকলো। দরজার সামনে জমে থাকা তাদের সঙ্গীদের লাশের উপর দিয়েই এগিয়ে আসছে ওরা। একটু পর এতো কাছে চলে এলো যে প্রতিবন্ধকতার এপারের লোকজন গুলি ভরার সময় পেলো না। ওরা দ্রুত বেয়নেট লাগিয়ে নিলো। একেবারে হাতাহাতি লড়াই শুরু হলো কিছুক্ষণ পর। দুই দলই রক্তে ভিজে আছে।

ছেলে দুটো টমের কথামতো গর্ত খুঁড়ে ওটার ভিতর একটা জিনিস ভরে আবার উপরে বালি ছড়িয়ে দিলো। তারপর দুটো মুগুর তুলে নিয়ে ওরাও লড়াই করতে এগিয়ে গেলো। টম ওদেরকে ইশারায় সরে যেতে বললো। ও খুব ভালোমতোই বুঝছে যে লড়াই কোন দিকে যাচ্ছে। এখন যেহেতু দুই দলই মুখোমুখি, তাই শত্রু সেনাপতির কাছে বেশি সৈন্য থাকায়, সে সুবিধা আদায় করতে পারবে সহজেই। টম ওর লোকদের পেছাতে দিচ্ছিলো না, ঠিক একটা ফুটোয় গজাল ঢোকানোর মতোই ওদেরকে সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো। ওরা যতোই ভালো লড়াই করুক না কেনো, শত্ৰুদলের অব্যাহত চাপ খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কিছুক্ষণের মাঝেই হাফসে যাবে ওরা।

“সুরক্ষা কেল্লায় চলে যাও সবাই,” আদেশ দিলো টম।

অবরোধের শুরু থেকেই টমের আশংকা ছিলো যে এরকম কিছু একটা হবে। সেজন্যেই ও একটা সুরক্ষা কেল্লা বানিয়ে রেখেছে আগেই। ওদের সর্বশেষ আশ্রয় বলা যায় এটাকে। ফটক থেকে সবচে দূরে, দুর্গের উত্তর পশ্চিম দিকটায় প্রচুর অস্ত্র আর গোলাবারুদ জমা করে রেখেছে টম। ও কোনো দিবাস্বপ্ন দেখেনি। জানতো যে খুব বেশিদিন টিকবে না ওরা। আর দেয়ালের কাছে থাকলে ওরা শত্রুর মাস্কেটের গুলির সহজ শিকারে পরিণত হবে। শত্রুরা দেয়াল দখল করতে পারলেই ওরা শেষ। ও শুধু চাচ্ছে ওরা ওদের আক্রমণকারীদের এমন একটা শিক্ষা দেবে যাতে ওরা লড়াই করার নাম ভুলে যায়।

“যাও সবাই,” চিৎকার করে উঠলো ও। “তাড়াতাড়ি।”

এই যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেও ওর কণ্ঠ শোনা যেতে লাগলো বেশ জোরেই। প্রতিবন্ধকের পিছনের লোকজন লাফ দিয়ে পিছু হটে এতো জোরে ছুট দিলো যে ওদের সাথে যারা হাতাহাতি করছিলো তারা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলো। সামনের সারিতে যারা এতোক্ষণ প্রাণপণ লড়াই করছিলো তারা পিছনের সৈন্যদের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মারা পড়লো।

টম গেলো সবার শেষে। তবে যাওয়ার আগে একটু থেমে ছেলে দুটো যে গর্তটা খুঁড়েছিলো সেটা থেকে বেরিয়ে থাকা সলতেয় গুলি করলো। তারপর দিলো দৌড়।

টমের পিছনে উঠোনে হুড়মুড় করে ঢুকতে লাগলো সৈন্যরা। ওরা হয়তো টমকে ধরতে পারতো, কিন্তু অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হলো। গাদাগাদি করে দৌড়ানোর সময় বা নিজেদের মাস্কেট সোজা করতে গিয়ে ওরা একজন আর একজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে লাগলো। ফলে জ্বলতে থাকা সলতেটা নজরে এলো না কারো।

টম সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আগুনটাও বালির নিচে পোরা পাউডারের কৌটায় পৌঁছে গেলো। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে ছড়িয়ে পড়লো আগুন। সেই সাথে বালি আর রক্ত ছিটকে পড়লো চারপাশে। যেনো কোনো দৈত্যাকার হাত মাটি ফুড়ে উঠে এসেছে। এতো শক্তিশালী বিস্ফোরণ হলো যে মৃত সৈন্যগুলোর হাড়-গোড় পর্যন্ত গুলির মতো ছুটে গিয়ে আশেপাশের সৈন্যদের গায়ে বিধলো। আক্রমণকারীদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো।

বিস্ফোরণের শব্দ পুরো উঠোনকে প্রকম্পিত করে তুললো। আর্তনাদের ভিতরেও টম নতুন একটা শব্দ শুনতে পেলো, প্রতিধ্বনিগুলো ঘনীভূত হয়ে মূল বিস্ফোরণটার চাইতেও জোরে পুরো দুৰ্গটাকে কাঁপিয়ে দিলো। বাড়তে বাড়তে একেবারে বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হতে লাগলো, তারপর ধীরে ধীরে দুর্গের দেওয়ালের প্রকল্পমান পাথরে প্রশমিত হয়ে গেলো।

টম সিঁড়ির মাথায় উঠে নিচের উঠোনে তাকালো। ধোয়া আর ধুলোয় ভরে আছে বাতাস। তবে এর মাঝেও কি হয়েছে স্পষ্ট দেখতে পেলো। ফটকের চিহ্নও নেই আর। গত তিনমাস ধরেই শত্ৰুদলের গোলাগুলির সব ধকল গিয়েছে এটার উপর দিয়ে। আর আজ ওটার ঠিক পাশেই বিস্ফোরণ হওয়ার আর সহ্য করতে পারেনি। ভেঙে পড়ে জীবিত বা মৃত সবাইকে চাপা দিয়ে দিয়েছে।

তারপরেই ও ফ্রান্সিস আর অ্যানার খোঁজে চারপাশে তাকালো। দুজনেই ওখানে আছে। অ্যানা একজন লোকের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তার ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে দিচ্ছে। ফ্রান্সিস ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ও চিৎকার করে কিছু একটা বলছিলো, কিন্তু টমের কান তখনও বিস্ফোরণের শব্দের কারণে তালা লেগে থাকায় কিছুই বুঝতে পারছিলো না।

বাতাসের ধুলোবালি ঝরে পড়তে লাগলো উঠোনে। হতাশ হয়ে টম দেখলো ওর ফাটকাটা পুরোপুরি কাজে লাগেনি। বিস্ফোরণের পরেও শত্রু সৈন্যরা নিবৃত হয়নি। ফটকের সামনে জমা লাশ পেরিয়ে ওরা ছুটে এসে ওদের সুরক্ষা কেল্লায় আক্রমণ করতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যাবে যে ওরা দুর্গের দখল নিয়ে ফেলেছে।

টম পিস্তল তুলতে গিয়ে দেখে যে ওটা নেই। গণ্ডগোলের মাঝে কখন যে পড়ে গিয়েছে টের পায়নি। ও তরবারি তুলে নিলো। সব শেষ, মানসিক ভাবে প্রস্তুতি এই নিয়ে নিলো। কিন্তু তবুও ও হাল ছাড়বে না। ও আত্মসমর্পণ করবে না, এততদিন ও খুব আশা করে ছিলো যে আবার সারাহকে দেখতে পাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে আর সময় পাওয়া গেলো না।

ফ্রান্সিস তখনও ওকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু টম তবুও কিছু শুনছে না দেখে ও টমের কাধ ধরে সমুদ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে দিলো। বিচিত্র কোনো কারণে ফ্রান্সিস পাগলের মতো হাসছে।

টমও দেখতে পেলো এবার। আর এই যুদ্ধের আতংকের মাঝেও ওর চেহারায় এক অপার্থিব আনন্দ ফুটে উঠলো। ঘাটে একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। পালগুলো মাস্তুলের গায়ে মেঘের মতো উড়ছে। এক গাদা কামানের মুখও দেখা যাচ্ছে পাশ থেকে। আর জাহাজের পিছনের দিকে উড়ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাল আর সাদা ডোরাকাটা পতাকা। ওটা থেকে একটা নৌকা ঢেউ পেরিয়ে বালিতে এসে ঠেকলো। তাতে লাল উর্দি পরা নৌবাহিনির সৈন্য।

জাহাজের একটা কামান গর্জে উঠলো। টম দেখলো গোলাটা পানি পেরিয়ে সোজা উড়ে এসে রানির সৈন্যদলের মাঝখানে একটা বিশাল রক্তে ভরা গর্তের সৃষ্টি করলো। এক বালির ঝর্নায় রূপান্তরিত হলো যেনো সৈকতটা। আর একটা কামান গর্জে উঠলো, আরও একটা। একের পর এক গোলাবর্ষণে রানির সৈন্যরা বিন্দুমাত্র অবকাশ পেলো না। মুহূর্তেই ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। সোজা নিজেদের শিবিরের দিকে দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে পালালো। নিজেদের অস্ত্র, কামান বা রসদপত্র নেওয়ার কোনো চেষ্টাই করলো না। এমনকি অফিসারেরাও পালাতে শুরু করলো, সৈন্যদেরকে ফেরানোর কোনো চেষ্টাই করলো না তারা।

একমাত্র যে লোকটা পালালো না সে হচ্ছে টুঙ্গার, ঘোড়ার পিঠে বসে চিৎকার করে ওর সৈন্যদের না পালিয়ে যুদ্ধ করতে আদেশ দিতে লাগলো। কথায় কাজ না হওয়ায় নেপচুন তরবারিটা ব্যবহার করতে লাগলো। নিজেই নিজের লোকদের কোপানো শুরু করলো। কিন্তু পলায়নরত সৈন্যরা ওকে কোনো পাত্তা দিলো না এবার। সব আদেশ নির্দেশ অবমাননা করে জঙ্গলে গিয়ে লুকালো। একজন ওকে টেনে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু টুঙ্গার এক কোপে লোকটার চেহারা দুই ভাগ করে দিলো।

আবার জাহাজের কামান গর্জে উঠলো। গোলাটা টুঙ্গারের ঘোড়ার এতো কাছে পড়লো যে আর একটু হলেই ঘোড়ার মুণ্ডু উড়ে যেতো। জানোয়ারটা সামনে পা তুলে উঁচু হয়ে গেলো, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে আতংকে, শুধুমাত্র টুঙ্গারে ঘোড়া সামলানোর অতিমানবীয় দক্ষতার কারণেই ও পিঠ থেকে ছিটকে বালিতে পড়লো না।

শেষে ক্রুদ্ধ একটা গর্জন ছেড়ে টুঙ্গারও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে উল্টোদিকে ছুটে চলে গেলো। টম দেখতে পেলো যাওয়ার পথে সামনে যে পড়লো তাকেই ও নেপচুন তরবারিটা দিয়ে কোপাতে কোপাতে এগিয়ে গেলো।

টম বুঝলো যে এটাই ওর শেষ সুযোগ। টুঙ্গার যদি একবার জঙ্গলে ঢুকে যায় তাহলে আর কখনো ও এই তরবারির দেখা পাবে না। আর আলফ উইলসন আর বাকি যাদের টুঙ্গার খুন করেছে তার বদলাও নিতে পারবে না। টম সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে, উঠোন পেরিয়ে ফটকের সামনে জমা পাথরের পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলো। বিস্ফোরণের তাপে তখনও পাথরগুলো গরম হয়ে আছে।

চোখের উপর হাত দিয়ে টম যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজতে লাগলো। কোথায় টুঙ্গার?

*

ক্রিস্টোফার টলতে টলতে দুর্গ থেকে সরে যেতে লাগলো। ধুলোবালিতে মুখের ভিতরটা ভরা; বিস্ফোরণের শব্দের কারণে এখনো ওর কানে তালা লেগে আছে। মাথায় হাত দিলো ও, খালি চামড়া আর রুক্তের স্পর্শ পেলো সেখানে। বিস্ফোরণে মাথার চুল পুড়ে গিয়েছে।

ফটকের একেবারে সামনেই ছিলো ও। টুঙ্গার এক প্রকার জোর করেই ওকে আক্রমণের নেতৃত্বে পাঠিয়েছিলো আজ। সন্দেহ নেই ও ইল্কলীর কথাটা বিশ্বাস করেনি। তাই ভেবেছিলো এতে করে যদি কোনো ঝামেলা হয় তাহলে মাঝখান থেকে ক্রিস্টোফার অক্কা পেয়ে ওকে বাঁচিয়ে দেবে। এবং নিখুঁতভাবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও হতে চলেছিলো। দরজা খুলতেই ক্রিস্টোফার টম উইল্ডকে অন্যপাশে দেখতে পায়। ও ভেবেছিলো আগে আগে আক্রমণ করে রানির লোকের হাতে পড়ে জবাই হওয়ার আগেই টম উইল্ডকে ও বন্দী করবে। ঠিক সেই সময়েই ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে সতর্ক করে দেয় আর ও পিছনেই থেকে যায়। ওর মা বলতো যে শয়তান তার সাঙ্গপাঙ্গদের রক্ষা করে সবসময়। ক্রিস্টোফার জানতো যে এটা হচ্ছে ভাগ্য। তরবারিটায় ওর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে একটা সুযোগ। ও আগালো না, একটু পরেই ওর লোকদের বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছাতু হয়ে যেতে দেখলো, যারা বেঁচে ছিলো তারা দরজার নিচে চাপা পড়ে মরল, আর টম উইল্ডও ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলো। বিস্ফোরণের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো ক্রিস্টোফার, কিন্তু পড়া অবস্থাতেই টের পেলো যুদ্ধের ভাগ্য উল্টে গিয়েছে। ওর লোকেরা প্রাণপণ পালাচ্ছে, তারপরই যখন কামানের গোলা একজন লোকের মুণ্ড উড়িয়ে দিলো, তখনই জাহাজটা নজরে এলো ওর। আর ওর লোকদের এরকম করার কারণটাও ধরতে পারলো।

এতে মোটেও হতাশ হলো না ও। এই সৈন্যদলের সাথে ওর কোনো সুসম্পর্ক নেই। আর এই মুহূর্তটার জন্যে ও বহুদিন যাবত অপেক্ষা করে আছে। সাথে সাথে ও টুঙ্গারের খোঁজ করতে লাগলো। একটু দূরেই টুঙ্গারকে দেখা গেলো ঘোড়ার উপর বসে আছে। চিৎকার করে লোকজনকে পালাতে নিষেধ করছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।

এই যুদ্ধের গন্ডগোলের মাঝেও ক্রিস্টোফার মেরুদণ্ডে একটা শিহরণ অনুভব করতে পারলো। টুঙ্গার আজ শেষ। যদি ইংরেজদের হাতে না-ও মরে, রানির হাতে মরবে নিশ্চিত। এখন শুধু তরবারিটা দখল করতে হবে।

টুঙ্গারের দিকে দৌড় দিলো ও। আশেপাশে আহত লোকজন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলো। ওদেরকে ধাক্কা মেরে আগাতে লাগলো ক্রিস্টোফার। সামনেই দেখা গেলো একজন সৈন্য টুঙ্গারের ঘোড়াটা ধরে টানছে, কিন্তু নেপচুনের এক কোপে শিক্ষা হয়ে গেলো তার। সেদিকে দেখতে থাকায় মাটিতে পড়ে থাকা বন্দুকটার দিকে খেয়াল হলো না ক্রিস্টোফারের। ওটায় পা বেধে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ও। পিছন থেকে দুজন সৈন্য ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো সামনে। কিন্তু মাথা তুলতেই ও দেখতে পেলো একটা কামানের গোলা ঠিক ওর সামনেই দুজনকে পিষে দিলো বালিতে। ও যদি আছাড় না খেতো… আবারও ও শয়তানকে ধন্যবাদ দিলো ওকে রক্ষা করার জন্যে।

কিন্তু এতোক্ষণে টুঙ্গারও বুঝে গেলো যে আর লাভ নেই। ও পালানোর জন্যে ঘুরে সোনালি তরবারিটা দিয়ে কাস্তে চালানোর মতো করে কোপাতে কোপাতে লোকজনের মাঝ দিয়ে পথ করে আগাতে লাগলো। কিন্তু ওদের শিবির আর দুর্গের মাঝের সরু বালির চড়াটায় এতো মানুষ জমে আছে যে এতো কিছুর পরেও রাস্তা করতে পারলো না। ওর ঘোড়াটাও এতো মানুষ আর সমুদ্রে জাহাজের ভেপুর আওয়াজে ভয় পেয়ে জায়গায় জমে গেলো।

ক্রিস্টোফার ভীড় ডিঙিয়ে আগাতে লাগলো ওর লক্ষ্যের দিকে। কোমর থেকে উরুমিটা খুলে নিলো, এরকম পরিস্থিতি আসতে পারে ভেবে সারাক্ষণ ওটা পরে থাকে ও। কিন্তু লোকজনের অব্যাহত চাপের কারণে ওটার প্যাঁচ খোলার জন্যে যথেষ্ট জায়গা পেলো না। একটু ফাঁকা হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। ভীড় কিছুটা পাতলা হলে লোকজনের মাথার উপর দিয়েই ছুঁড়ে দিলো ওটা।

ইস্পাতের ফলাটা প্যাঁচ খুলে সোজা টুঙ্গারের কবজি পেঁচিয়ে ধরলো। ক্রিস্টোফার শক্ত করে ধরে সর্বশক্তিতে টান দিলো ফলাটা। টুঙ্গারের হাতটা কেটে পড়ে গেলো মাটিতে। কাটা হাতেই নেপচুন তরবারিটা ধরা, আর ওটা থেকে তীর বেগে বের হতে লাগলো রক্ত। টুঙ্গার আর্তমাদ করে উঠলো। রক্তপ্রবাহ থামাতে ও ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলো। কিন্তু ওর ঘোড়াটা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলো। যেইমাত্র টের পেলো যে লাগাম আলগা হয়ে গিয়েছে, সাথে সাথে নিজের পিছনের পা দুটো তুলে ঝাড়া দিলো। টুঙ্গার উড়ে গিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়লো বালিতে। ঘোড়াটা দিলো ছুট, যাওয়ার পথে যে পড়লো সামনে তাকে মাড়িয়ে ছুটে গেলো জঙ্গলের দিকে।

ওদের পাশের ভীড় পাতলা হয়ে আসছে। বেশিরভাগ সৈন্যই বনের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, নয়তো পৌঁছাতে গিয়ে মারা পড়েছে। ক্রিস্টোফার দেখতে পেলো যে ইন্ডিয়াম্যানটা থেকে একটা নৌকা ডাঙ্গার দিকে আসছে। লাল উর্দি পরা মেরিন সৈন্য দিয়ে ভরা। ওরা ওকে এখানে ধরতে পারলে,..

নেপচুন তরবারিটা বালির উপর শুয়ে গুপ্তধনের মতো চকচক করছে। ক্রিস্টোফার ওটার দিকে হাত বাড়ালো। এতো ধ্বংসস্তূপের মাঝেও ওর মনে হতে লাগলো ও জয়লাভ করেছে। এতোদিন যতো অবর্ণনীয় কষ্ট সয়েছে, যেসব ভয়ানক জিনিস ও করেছে বা দেখেছে, সেগুলো সবই এই তরবারিটা পাওয়ার জন্যে সওয়া যায়। তরবারিটা ওর, মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরেই পড়ে আছে ওটা।

কিন্তু আগাতেই একটা হাত ওর গোড়ালি, আঁকড়ে ধরলো। আচমকা টানে ক্রিস্টোফার ভারসাম্য হারিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লো। ও তরবারিটার দিকে ঝাঁপ দিলো কিন্তু হাতটা প্রচণ্ড শক্তিতে ওকে আটকে দিয়ে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলো।

ক্রিস্টোফার শরীরটা বাকিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে হাতটা টুঙ্গারের। কাটা হাতটা বালিতে চেপে রেখেছে যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়, আর বাম হাত দিয়ে ক্রিস্টোফারকে ধরে রেখেছে। একটা মাথার খুলি খচিত ছুরি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে ও, এতো জোরে যে ফলায় লেগে ঠোঁটের দুই কশ কেটে গিয়েছে।

“বেঈমান,” ফলাটা চেপেই হিসিয়ে উঠলো টুঙ্গার। “তুই আমাকে হারিয়েছিস ঠিক আছে, কিন্তু আমার আগেই আমি তোকে শিবের (ধ্বংসের দেবতা) কাছে পৌঁছে দেবো।”

প্রচণ্ড ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে ও ওর কাটা ডান হাতের উপরেই ভর করে নিজেকে টেনে তুললো। একই মুহূর্তে ও ক্রিস্টোফারের পা-টা ছেড়ে দিয়ে মুখ থেকে ছুরিটা নিয়ে এক টানে ক্রিস্টোফারের পায়ে ঢুকিয়ে দিলো।

আরও একবার কালারিতে শেখা কৌশল বাঁচিয়ে দিলো ক্রিস্টোফারকে। টুঙ্গার ছেড়ে দেওয়া মাত্র ক্রিস্টোফার সমস্ত শক্তি জড়ো করে লাফ দিয়ে পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে গেলো। টুঙ্গার ছুরি চালাতে চালাতে ও ততোক্ষণে নিজের পায়ে খাড়া হয়ে গিয়েছে। ফলে চামড়ায় আচড় কেটে বেরিয়ে গেলো ছুরির ফলা, রক্ত বের হতে লাগলেও নিচের মাংসপেশির ক্ষতি হলো না।

এবার আর কোনো উপায় রইলো না টুঙ্গারের। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো এশবার, কিন্তু ক্রিস্টোফার ওকে ঘুষি মেরে শুইয়ে দিলো। তারপর ওর হাত থেক ছুরিটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললো। ক্রিস্টোফার টুঙ্গারের পিঠের উপর বসে পিছন থেকে গলা চেপে ধরলো হাত দিয়ে। টুঙ্গার হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্রিস্টফারে চোখে খোঁচা মারার চেষ্টা করলো কিন্তু ওর হাত সে পর্যন্ত পৌঁছালো না। ক্রিস্টোফার ওর হাত কামড়ে ধরলো। হাড় ভাঙার মট আওয়াজ পাওয়ার পর হাতটা ছাড়লো। টুঙ্গার চিৎকার করার জন্যে মুখ খুললো কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হলো না। কারণ ক্রিস্টোফার টুঙ্গারের গলার প্যাঁচ একটুও ঢিল করেনি। টুঙ্গারের শ্বাসনালীর উপর আরও জোর বাড়ালো ক্রিস্টোফার।

টুঙ্গারের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। চেহারা রক্ত জমে লাল হয়ে গিয়েছে, এতোটা লাল যে ক্রিস্টোফারের মনে হলো যে বোধহয় ওর চেহারার ক্ষতটা বরাবর ফেটে মগজ বেরিয়ে আসবে। কালো কুচকুচে দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভ বের হয়ে গেলো ওর। বাতাসের জন্যে হাসফাস করছে।

মট করে ভেঙে গেলো টুঙ্গারের শ্বাসনালী। চোখ বেরিয়ে এলো কোটর ছেড়ে। জিভ বের করা অবস্থাতেই মাথা হেলে পড়লো এক পাশে। ক্রিস্টোফার তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আরো একটা মোচড় দিলো দেহটায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তরবারিটা নিয়ে জঙ্গলের নিরাপদ আশ্রয়ে দৌড় দিলো। পায়ের ক্ষতে মন দেওয়ার সময় এখন আর নেই।

মেরিনের লোকজন ডাঙায় উঠে এসেছে। ওরা ক্রিস্টোফারের দিকে চেঁচালো কিন্তু ও কান দিলো না বা ফিরেও তাকালো না; তবে আশেপাশের সৈকতে ছিটকে ওঠা বালি দেখে বুঝতে পারলো যে ওরা ওর দিকে গুলি করছে। এবার ও ফিরে তাকালো। ব্যাপারটা বুঝলো না ও, মেরিনগুলো কেন যেনো ওকে ধাওয়া করছে না। ওদের পিছনেই দুর্গের ফটকের ধ্বংসস্তূপের উপরে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বলে না দিলেও ও জানে নোকটা হচ্ছে টম উইল্ড।

সে ক্রিস্টোফারকে পরাজিত করেছে। কিন্তু তরবারিটা এখন ক্রিস্টোফারের হাতে। আর তাতে ও এক নতুন উদ্যম ফিরে পেলো। এক ছুটে বনের ধারে পৌঁছে জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে গেলো।

*

বনের সামান্য ভিতরেই ক্রিস্টোফার টুঙ্গারের ঘোড়াটা খুঁজে পেলো। পলায়নরত সৈন্যরা ওর দিকে নজর দেয়নি। বনের ভিতর একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাস চাবাচ্ছে। সারা গা রক্ত আর ধুলোবালিতে ভরা।

ক্রিস্টোফার ওর লাগামটা ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলো। আশ্বস্ত হয়ে ওকে নিজের পিঠে উঠতে দিলো ঘোড়াটা। ও.জানে যে শীঘ্রই ধাওয়া করা হবে ওকে। সর্বশক্তি দিয়ে ঘোড়া ছোটালো তাই। সমুদ্র থেকে আসা পানির নালাগুলো পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথে পেরিয়ে এসে যখন নিশ্চিত হলো যে ও সম্পূর্ণ একা, তখনই থামলো।

ঘোড়াটা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। পেটের দুপাশ ঘামে ভিজে গিয়েছে। তবে এতো গরম যে অল্প সময়েই ঘাম বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। ও ঘোড়াটাকে একটু বিশ্রাম দিতে জিন থেকে নেমে, লাগাম ধরে হাঁটতে লাগলো। মাথার ভিতর চিন্তার ঝড় চলছে ওর।

রানির কাছে আর ফিরে যেতে পারবে না ক্রিস্টোফার। ওর সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় আর দুর্গটা আবার ইংরেজরা দখল নিয়ে নেওয়ায় তার কূটকৌশল পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন তাকে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে। আর কোম্পানিও নিশ্চয়ই এখন খুব বেশি নরম মেজাজে থাকবে না। ওরা হয়তো বলবে ক্রিস্টোফারকে ওদের হাতে তুলে দিতে যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে পারে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বোষেতে ফিরে গিয়ে, ওর বাবার সামনে মাথা নুইয়ে প্রাণভিক্ষা চাওার ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ওর সারা শরীর রাগে রি রি করে উঠলো।

হাঁটতে হাঁটতে একটা চৌরাস্তায় এসে পৌঁছালো ও। গাছপালার ফাঁকে কয়েকটা ছোট ছোট কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। গ্রামবাসী ওর ঘোড়ার আওয়াজ পেয়েই লুকিয়ে পড়েছে। ওরা জানে যে যখন কোনো ক্ষমতাধর তোক গ্রামে আসে তখন ভালো কিছু ঘটে না। ক্রিস্টোফার কুঁড়েগুলোয় ঢুকে খাবার দাবার যা পেলো নিয়ে নিলো। কয়েক থালা ভাত, আর সামান্য শুঁটকি মাছে। টাকা পয়সা খুঁজতে গেলো না। এদের জীবন বনের জানোয়ারদের চাইতে খুব বেশি সুবিধার না। নিজের উপর অন্য কারো দৃষ্টি টের পেলোলা ও, ঝোঁপ ঝাড়ের ভিতর থেকে নজর রেখে চলেছে ওরা। কিন্তু ও পাত্তা দিলো না। কারণ নেপচুন তরবারিটাই ওদেরকে নিরাপদ দুরত্বে রাখতে যথেষ্ট।

ক্রিস্টোফার খাপ থেকে তরবারিটা বের করলো। ওটা ধরলেই অন্যরকম একটা শিহরণ খেলে যাচ্ছে শরীরে। ও ওটা হাতে ধরে নাড়তে চাড়তে লাগলো যাতে ওটার স্বর্নালি ফলাটা গাছের ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় চকচক করে ওঠে। হাতলের নীলাটা দেখে মনে হচ্ছে একটা চোখ যেনো ওর আত্মার দিকে তাকিয়ে আছে। ও সব হারিয়েছে-কিন্তু এই তরবারিটা পাওয়ার পর থেকে  নিজেকে অজেয় মনে হচ্ছে ওর।

কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো ও, কি করবে ভাবছে সেটা। ত সাথে হওয়া শেষ কথোপকথনের একটা অংশ মনে এলো ওর।

মুক্ত হলে আমরা কোথায় যাবো? আমরা যদি একসাথে থাকতে তাহলে এমন কোথাও যেতে হবে যেখানে আমাদের অতীত কেউ জানে না

টিরাকোলা, তামান্না জবাব দিয়েছিলো। ওখানে আইন কানুনের নেই। ওখানে গেলে আমি আর তুমি সত্যিই মুক্ত বিহঙ্গের মতো পারবো।

একদিন না একদিন নিশ্চয়ই যাবো, ক্রিস্টোফার জবাব দিয়েছিলো

ক্রিস্টোফার আবার ঘোড়ার পিঠে চড়ে, সোজা উত্তরে রওনা দিলো

*

টম রক্তে ভেজা বালির ভিতর টুঙ্গারের দেহটা খুঁজে পেলো। ওর ডান হাত কাটা, কিন্তু মারাত্মক কোনো ক্ষত দেখা গেলো না শরীরে। খুব সাবধানে আগাতে লাগলো টম। বলা যায় না, এখনো বেঁচে থাকতে পারে।

টুঙ্গারের মুখের ভিতর থেকে একটা মাছি বেরিয়ে এলো, বেরিয়ে থাকা জিভটাও চোখে পড়লো তখন। টম বুঝলো ওর আর ভয় পাবার কিছু নেই। কয়েক কদম আগেই ও কাটা হাতটা খুঁজে পেলো। জায়গাটা ঘোড়ার খুরের ছাপ-এ ভরা। কিন্তু তরবারিটার কোনো চিহ্ন ও দেখতে পেলো না।

রানির সৈন্যদলের সবাইই ততক্ষণে সৈকত পেরিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছে। একজনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হলো; একজন লম্বা টাকমাথা লোক। দেখে চেনে চেনা লাগলো ওর। কিন্তু এতো দূর থেকে পাম গাছগুলোর আলো ছায়ার কারণে তার হাতে কোনো তরবারি আছে কিনা বুঝতে পারলো না টম।

হতাশায় ছেয়ে গেলো ওর মন-তবে কিছুক্ষণের জন্যে। নিশ্চয়ই কোনো সৈন্যই পালানোর সময় নিয়ে গিয়েছে তরবারিটা। টম তাই আশা ছাড়লো না। এরকম একটা জিনিস লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কথা ছড়াবেই, আর টম অবশ্যই কান খোলা রাখবে সেটা শোনার জন্যে। যদি রানি তরবারিটা ফেরত দিতে না চায়, তাহলে তার মহল মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।

“অস্ত্র নামিয়ে নাও!”

টম ঘুরে দেখলো দুই ডজন মাস্কেট সোজা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ডাঙায় উঠে এসেছে মেরিনেরা। সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে এক সারি করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, পা-এর মোজা ঢেউয়ে লেগে ভিজে গিয়েছে।

টম সাবধানে হাত তুললো। “আরে, আমিতো আপনাদের লোক।”

টমের গলা শুকিয়ে ফ্যাসফেসে হয়ে গিয়েছে-তবে লোকগুলো ধরতে পারলো ওর কথা। ওদের সার্জেন্ট অস্ত্র নামাতে আদেশ দিলো।

“মাফ করবেন, এবার আর একজন বলে উঠলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেনের নীল পোশাক পরা একজন লোক সৈন্যদের সারি থেকে সামনে এগিয়ে এলো। আপনাদের দুর্দশার খবর যখন মাদ্রাজে পৌঁছালো তখন আমরা ভেবেছিলাম যে জীবিত অবস্থায় কোনো ইংরেজকে বোধহয় আর পাবো না।” বলেই থেমে গেলো লোকটা। “ও ঈশ্বর! আপনি কি…?”

টম সূর্য থেকে বাঁচতে চোখের উপর হাত চাপা দিলো। এতো ঝড় ঝাঁপটা গিয়েছে ওর উপর দিয়ে যে ক্যাপ্টেনের মুখটা চিনতে সময় লাগলো কিছুটা। পোড় খাওয়া চেহারা, ঝকঝকে নীল চোখ, সোনালি আর ধূসরে মেশালো চুল।

“ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ড?”

“আবার দেখা হলো। আর এতোদিনে আমি আমার ঋণ শোধ করতে পারলাম বলে মনে হচ্ছে।” ইঞ্চবার্ড আগ্রহের সাথে তাকিয়ে রইলো টমের দিকে। “কোন পোড়া কপালে এখানে এসে জুটেছেন?”

“লম্বা কাহিনি।”

“আপনি কতোটা কষ্ট করেছেন সেটা কল্পনাও করতে পারছি না।” ইঞ্চবার্ড দুর্গের দিকে ইংগিত করলো। “এতো এতো প্রতিকূলতার পরেও এতো দিন ধরে অবরোধ প্রতিহত করে থাকা। লেডেনহল স্ট্রিটে আপনার নামে জয়ধ্বনি করা হবে নিশ্চিত।”

“ওদের কৃতজ্ঞতার কোনো দরকার নেই আমার। আমি শুধু আমাকে আর আমার পরিবারকে রক্ষা করতে সব করেছি। যদি কোম্পানির এতো অর্থলিপ্স না থাকতো তাহলে রানির সাথে এই যুদ্ধ কোনোদিনও বাধতো না।”

“যাই হোক,” খোঁচা মেরে বললো ইঞ্চবার্ড, “লন্ডনের সওদাগরেরা নায়কদের খুবই পছন্দ করে। বিশেষ করে যারা তাদের সম্মান আর ব্যবসার মুনাফার সুরক্ষা করে।”

“আমার কাছে শেষ কথা হচ্ছে আমার স্ত্রী আর অ্যাগনেস-মিসেস হিকস। ওরা ভালো আছে তো? আসার সময় কেমন দেখে এসেছেন?”

ইঞ্চবার্ডের চেহারা কালো হয়ে গেলো। “আপনার কথা বুঝলাম না।”

“আপনারা মাদ্রাজ থেকে এসেছেন না?”

ইঞ্চবার্ড মাথা ঝাঁকালো।

“তাহলে ওদেরকে দেখেননি? নাহলে আমাদের এখানের অবস্থা সম্পর্কে জানলেন কার কাছ থেকে?”

“মাদ্রাজে এখান থেকে কেউ যায়নি। তামিল কিছু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খবর পেয়েছি আমরা। ওরা সড়কপথে মাদ্রাজ গিয়েছে।”

“কিন্তু সারাহ আর অ্যাগনেসতো কয়েক মাস আগে রওনা দিয়েছে, আর্তনাদ করে উঠলো টম। “বহু আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা ওদের।”

“হতে পারে আমরা রওনা দেওয়ার পরে ওরা পৌঁছেছে।” ইঞ্চবার্ড টমের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থা দেখে নিজের স্বর নরম করলো। “এই বর্ষায় সমুদ্রের অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিলো না। সম্ভবত ওরা কাছাকাছি কোনো বন্দরে নোঙ্গর করে আবহাওয়া ভালো হওয়ার অপেক্ষা করছিলো।”

কিন্তু টম যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। এসবই ফাঁকা বুলি, কোনো সত্যিকার আশা নেই। চরম হতাশ হয়ে গেলো ও, একটু হলেই কেঁদে দিতো। সারাহকেই যদি আর না পাবে তো এতো কষ্ট করে অবরোধ সহ্য করে কি লাভ হলো? সারাহের নানান ভয়াল পরিণতি মাথায় আসতে লাগলো ওর। প্রত্যেকটা আগেরটার চাইতে ভয়ংকর।

এই অমানিশার মাঝের একটু হলেও আশার প্রদীপ আছে। সারাহের যদি আসলেই কিছু হতো তাহলে ও সেটা টের পেতো। সারাহ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।

“আমাকে ওদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে,” টম ইঞ্চবার্ডের দিকে তাকাতেই তার চেহারায় সহমর্মিতা দেখতে পেলো। “আপনি কোম্পানির কৃতজ্ঞতার কথা বললেন। যদি কথাটা আসলেই সত্যি হয় তো আমাদেরকে মাদ্রাজ পৌঁছে দিন।”

*

টম, ফ্রান্সিস আর অ্যানা ব্রিঞ্জোয়ান ছাড়ার তিন সপ্তাহ পর গিয়ে মাদ্রাজ বন্দরে পৌঁছালো। জায়গাটা দেখে, বইতে দেখা মধ্যযুগের শহরগুলোর ছবির কথা মনে পড়লো টমের। মরিচা রঙের পাথরের বাড়িতে ছেয়ে আছে শহরটা। সুরক্ষার জন্যে অসংখ্য অর্ধচন্দ্রাকার কেল্লা আর সারি সারি কামান বসানো সমুদ্রের ধার জুড়ে। তার পিছনে অনেকগুলো সুদৃশ্য ভবন, তবে উত্তর দক্ষিণে ধীরে ধীর ভবনের উচ্চতা ক্রমান্বয়ে কমে গিয়েছে। ওদিকে সব ভাঙাচোরা বাড়ির বস্তি। কোম্পানির সাথে ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করা সওদাগরেরা থাকে সেদিকে।

জাহাজের নোঙর নামানো হলো না, তার আগেই এক ঝাঁক ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা ছুটে এলো ডাঙা থেকে। ওগুলোতে আছে নারিকেল, রাম, ফল আর মাছ। কয়েকজন মহিলা প্রায় নগ্ন অবস্থায় নাবিকদের সাথে এসে ঢলাঢলি করতে লাগলো। টম জানে ওদের কাছেও বেচার মতো জিনিস আছে।

“ওরা আপনার নাম দিয়েছে অরম্বারস,” ইঞ্চবার্ড বললো। “মানে হচ্ছে শহরে নতুন আগন্তুক। আপনার কাছ থেকে ভালো পয়সা খসানোর চেষ্টা করবে ওরা।”

“তাহলে খুবই হতাশ হবে ওরা, কারণ আমার কাছে একটা পয়সাও নেই,” টম বললো। “আপনি মালপত্র ডাঙায় পাঠাবেন কখন?”

“কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবো আমরা,” ইঞ্চবার্ড বললো। “আগে জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে লোকজনের জন্যে কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু গভর্নর চায় যে আমি অবিলম্বে টাকার প্যাকেটটা পাঠিয়ে দেই। আপনি যদি কষ্ট করে কাজটা করতেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকতাম।”

টম ওর কথা বুঝতে পেরে কৃতজ্ঞ বোধ করলো। ফ্রান্সিস আর অ্যানার সাথে একটা ছোট নৌকায় চড়ে বসলো ও। নৌকার তক্তাগুলো পেরেক দিয়ে না লাগিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফলে ওদের ওজনে বারবার জায়গা থেকে নড়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে পানি ঢুকতে লাগলো।

“ডাঙা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে তো?” ফ্রান্সিস বললো। “নৌকাটা তো সাগরে ডুবিয়ে মারার জন্যে বানানো হয়েছে দেখি।”

“মাঝিরা জানে যে ওরা কি করছে,” টম বললো। আমাদের নৌকার মতো না এগুলো। এগুলো স্রোতের সাথে সাথে বেকে যেতে পারে। তুমি হয়তো ভিজে যাবে, কিন্তু কোনোদিনও নৌকা উল্টে মরবে না।”

আসলেই তাই। নৌকাটা ওদেরকে ভিজিয়ে দিলো, কিন্তু নিরাপদেই জেটির কাছে বন্দরের দরজায় পৌঁছে দিলো। জাহাজের কাগজপত্র দেখাতেই ওদেরকে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হলো। দরজার পার হতেই সরাসরি বাজারে গিয়ে পড়লো ওরা। বালুতে ভরা রাস্তাগুলোর দুই পাশ ছোট ছোট দোকানে ভরে আছে। দোকানদার পাশেই দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জিনিসপত্রের দাম বলে বলে খরিদ্দার ডাকছে। একপাশের দেয়ালে পরবর্তী জাহাজ কখন আসবে সেই কাগজ সাটানো। অ্যানাকে দেখতে পেয়ে কয়েকজন দোকানদার এগিয়ে এসে অভিবাদন জানালো। অ্যানার প্রতি ওদের মমতা দেখে খুশি হলো টম। ফ্রান্সিস ভ্রু কুঁচকে পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো।

অ্যানা দোকানদারদের মাতৃভাষায় গড় গড় করে কথা বলতে লাগলো। বলতে বলতে ওর চেহারা কালো হয়ে গেলো। “এদের কাছে সারাহ বা অ্যাগনেসের কোনো খবর নেই। তবে ওরা নাকি দেখেছে যে একটা জাহাজ ব্রিঞ্জোয়ানের একজন লোককে গত সপ্তাহে উদ্ধার করে এনেছে। একজন ইংরেজ নাকি। এখন দুর্গে আছে।”

“ওখানেই যাবো তাহলে,” টম বললো। “তুমি আর ফ্রান্সিস ঘাটে আরো একটু খোঁজ খবর করে দেখো কিছু জানা যায় কি না।”

চারপাশে দেয়াল ঘেরা শহরটার মাঝখানে যে দুৰ্গটা সেটা দেখে মনে হলো ব্রিঞ্জোয়ানের দুর্গটারই একটা বড়সড় প্রতিরূপ। যদিও আকারে দ্বিগুণ, আর ওটার মাঝে একটা তিনতলা সুরম্য অট্টালিকা দেখা যাচ্ছে। ওটার বাঁকানো খিলানটার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় টমের মনে পুরনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন ও ভেবেছিলো যে সব শেষ, সেই ভয়ানক সময়টার সব কিছু আবার প্রতিধ্বনিত হলো ওর মনে।

ইঞ্চবার্ডের বদৌলতে ও একটা ওয়েটিং রুমে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো। তাকার প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলো একজন চাকরকে। সেটা নিয়ে লোকটা চলে যেতেই ও বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।

সময় বয়ে যেতে লাগলো। ঘরের গ্রান্ডফাদার ঘড়িটা ঢং ঢং করে ঘণ্টার ধ্বনি দিয়ে জানিয়ে দিলো এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। টম প্রচণ্ড রেগে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবছে সেটা খুলে ফেলবে কিনা। চেয়ারের হাতল চেপে ধরে উঠে যাওয়া থেকে বিরত রাখলো নিজেকে।

ঠিক যখন ওর মনে হলো যে আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা সম্ভব না, তখনই দরজাটা খুলে গেলো। ওকে ইশারায় ডাক দিলো দারোয়ান। প্রচুর বাতাসওয়ালা একটা ঘরে এসে ঢুকলো ও। ঘরে অনেকগুলো জানালা। দেয়াল জুড়ে আগের আমলের অস্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো। সব দেয়ালে গেঁথে রাখা হয়েছে। মাস্কেটের একটা ছড়া, একগাদা তরবারি, আড়াআড়ি করে রাখা বল্লম। দেখে টমের হাই উইল্ডের লাইব্রেরির কথা মনে পড়ে গেলো। বহু বছর ওখানে যাওয়া হয় না ওর।

একজন লোক হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। “উইলিয়াম ফ্রেজার,” নিজের পরিচয় দিলো লোকটা। “ফোর্ট সেন্ট জর্জের গভর্নর আমি। আপনি নিশ্চয়ই টমাস উইল্ড?”

মাথা ঝাঁকালো, টম। ফ্রেজার জোরে ওর হাতে চাপ দিলো। “তাহলে আমি আর আমার কোম্পানি দুটোই আপনার কাছে ঋণী। ক্যাপ্টেন ইঞ্চবার্ডের রিপোর্ট পড়েই বুঝেছি যে আপনার অকুতোভয় পদক্ষেপের কারণেই দুৰ্গটা হাতছাড়া হয়নি আমাদের। নইলে ওটার সাথে দুর্গের লোকজনেরও করুণ পরিণতি হতো। তারচে বড় কথা কোম্পানির সম্মান ধুলোয় মিশে যেতো। ব্যবসার কথা বাদই দিলাম, একবার যদি ঐ কালাগুলোর মাথায় ঢোকে যে ওরাও চাইলে আমাদেরকে মারতে পারে তাহলেতো এদেশে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।”

টম কোনো কথা বললো না। ব্যাপারটা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। ও কখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রক্ষক হতে চায়নি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সেটাই হয়েছে। আর বিপদও এখনো কাটেনি। কয়েক মাসের অবর্ণনীয় কষ্টের পর এরকম আরামদায়ক পরিবেশ এরকম উষ্ণ অভিবাদন পেলে বেখেয়াল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেউ যদি ওকে চিনে ফেলে আর গাই একবার খবর পেয়ে যায়…

“আমি দুঃখিত, আপনাদের বেশি লোককে বাঁচাতে পারিনি,” নিচু কণ্ঠে বললো টম। “মিস্টার ফয় আসলে বাঁচানোর মতো কাউকে রেখে যাননি।”

“ওনার অপরিণামদর্শি আচরণের মূল্য উনি দিয়েছেন।”

‘শুধু উনি একাই দেননি। আরও অনেকেই। আর তাদের এক্ষেত্রে কিছুই করার ছিলো না।” টম টের পেলো গত কয়েক মাসের সব রাগ ভিতরে ফেনিয়ে উঠছে। ওর ইচ্ছে করেছে এই ভারী পর্দা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে, দেয়ালের সব ছবি টেনে আছড়ে ফেলে ফ্রেজারের টেবিলের সব কাগজ পত্রও ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে।

জোর করে নিজের রাগ সামলালো ও।

“অবরোধ শুরু হওয়ার আগে আপনাদের এক মুনশি কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে একটা নৌকায় করে পালিয়ে আসে। ফয়-এর স্ত্রী, ক্যাপ্টেন হিকসের স্ত্রী আর আমার স্ত্রী ছিলো ওর সাথে। ওরা মাদ্রাজ আসবে বলে রওনা দিয়েছিলো।”

ফ্রেজারের চেহারা গম্ভীর হয়ে গেলো। “গত সপ্তাহেও যদি আসতেন তাহলে আপনাকে কোনো ভরসা দিতে পারতাম না। কারণ সেরকম কিছুই শুনিনি আমি। তবে এখন কিছু জানি আমি। তবে সেটা যে সুসংবাদ তা বলতে পারবো না।”

টমের বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো। সামলাতে ফ্রেজারের ডেস্কের একটা কোনা চেপে ধরলো ও। হাতের মুঠি সাদা হয়ে গিয়েছে। “খবরটা কি?”

“বসুন,” ফ্রেজার একটা চেয়ারের দিকে ইংগিত করলো। “খবরটা যে এনেছে তার মুখ থেকেই শুনুন নাহয়। সে এখানেই আছে।”

ফ্রেজার একটা বেল চাপলো। টম একটা পিছন দিক উঁচু চেয়ারে বসলো। পিছনে দরজা খোলার আওয়াজ পেলো ও। মাপা পদক্ষেপে এগিয়ে এলো কেউ।

“মিস্টার কাইফেন,” দারোয়ান ঘোষণা দিলো। বলে সে দরজা বন্ধ করে দিলো আবার।

ঘরের অর্ধেকটা ঢুকে টমকে চোখে পড়লো কাইফেনের। জায়গায় জমে গেলো সে। ভীত চোখে ও একবার সামনে আর একবার বের হওয়ার দরজার দিকে তাকাতে লাগলো।

‘মিস্টার উইল্ড,” শুকনো গলায় বললো ও। অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পালানো সম্ভব না বুঝতে পেরে সামনে এগিয়ে এলো। “ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, আপনি বেঁচে আছেন। আমি আসলেই ভাবতে পারিনি যে আবার দেখা হবে আমাদের।”

শেষবার যখন ওদের দেখা হয়েছিলো তখন ওরা রানির মহল থেকে জান হাতে নিয়ে পালাচ্ছিলো। মাঝের মাসগুলো ওদের কারো-ই ভালো যায়নি। কিন্তু কাইফেনের দিন যে ভয়ানক গিয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। নাকের উপর ফোস্কা পড়ে আছে। সূর্যের তাপের ঝলসে চামড়ার রঙই বদলে গিয়েছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে কোটর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে যে কোনো সময়। হাতের আঙুল ক্রমাগত কাঁপছে।

টমের মনে অনেক প্রশ্ন ভীড় করে আছে। কিন্তু ও করলো মাত্র একটা প্রশ্ন। “আমার স্ত্রী কোথায়?”

কাইফেন শিউরে উঠলো। একটা চেয়ারের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়ে এমনভাবে মুখ করে বসলো যেনো টম ওর চোখের দিকে তাকাতে না পারে।

“আমি যা বলবো তা আপনার পছন্দ হবে না স্যার।”

*

নৌকাটা শান্ত সমুদ্রে আগাচ্ছেই না বলা চলে। আটজন পুরুষ আর তিনজন মহিলা ওটার মাল বোঝাই খোলর ভিতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। পুরুষদের কাবো-ই কোমরের উপরে কাপড় নেই; মহিলাদের কাপড়ের অবস্থাও তথৈবচ। চারটা দাঁড় স্বচ্ছ পানিতে কোনো আলোড়ন তুলতে পারছে না, শুধু পানিতে একবার নামছে আর উঠছে। একটু পরেই ক্ষান্ত দেবে ওরা, কারণ বহু আগেই বুঝে গিয়েছে যে এই ভ্যাপসা গরমের মাঝে নৌকা বাওয়ার চেষ্টা করে কোনো। লাভ নেই।

মেঘহীন আকাশ থেকে খরতাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। এবারের বর্ষাটা বেশ দুর্বল ছিলো। ঝড় ঝাপ্টা যা হয়েছে সব একেবারে সবসময় যখন হয়, ঠিক সেই সময়ে। কিন্তু এরপরে যে ভারী বর্ষণ হয় সেটা এবার হয়নি। ফলে কৃষকদের মাথায় হাত। ওরা মাটি খুঁড়েও পানির সন্ধান পাচ্ছে না। খরায় এবারের ফসল ভালো হবে না। আগামী মৌসুম ওদের কিভাবে চলবে জানে না কেউ। আর নৌকার ওরা জানে না যে আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত টিকতে পারবে কিনা।

দশ বছর বয়স থেকে অ্যাগনেস ভারতে থাকে। ইয়র্কশায়ারের ছোট ছোট পাহাড় আর মৃদু বৃষ্টিপাতের স্মৃতি ঝাপসা আকারে মনে আছে কিছুটা, অনেক সময় মনে হয় ওগুলো বুঝি স্বপ্ন। ও প্রায় বিশ বছর এখানে টিকে আছে। বিশটা ভয়ংকর বর্ষা; বিশটা গা ঝলসানো গ্রীষ্ম। মাঝে মাঝে মনে হতো যে হাড় পর্যন্ত পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। পাঁচটা বাচ্চা হয়েছিলো অ্যাগনেসের, কোনোটাই তিন বছরের বেশি বাঁচেনি। দুঃখ কষ্ট কাকে বলে ভালোই জানা আছে ওর।

কিন্তু এখন যে যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে সেটা আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। একটা তিরিশ ফুট লম্বা নৌকায়, আরো দশজন লোকের সাথে ঠাসাঠাসি করে তিন সপ্তাহ ধরে বসে আছে। নৌকাটা এতো বেশি জিনিসপত্রে ঠাসা যে কিনার পানি ছুঁই ছুঁই করছে। উপরে কোনো আচ্ছাদন নেই, কোনো গোপনীয়তা নেই। প্রথম ঝড়টা পার হওয়ার পর, লেই নামের কেস্ট্রেল-এর সারেং-টা পালের ক্যানভাস ছিঁড়ে নৌকার পিছন দিকে, উপরে আর সামনা সামনি পর্দার মতো লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে শুধু দাঁড় বেয়েই চলতে হচ্ছে ওদের। সারাহের যত্ন করতে না হলে অ্যাগনেসও দাঁড় বায়। সেই পরিশ্রমে ওর হাত কড়া পড়ে কুঁচকুচে কালো হয়ে গিয়েছে।

“আমারও বাইতে সাহায্য করা উচিত,” এক সকালে বললো সারাহ। ওর জ্বর গিয়ে উঠে বসতে পারছে একটু। তবে তখনও খুবই দুর্বল।

“মাথা খারাপ?” অ্যাগনেস বললো। “তোমার যে অবস্থা তাতে দাঁড় তুলতেই পারবে না।”

“কিন্তু তাতে লোকগুলো আমাকে অকর্মা মনে করবে না। সবাই-ইতো একটু পরে পর করছে।”

“সবাই না,” অ্যাগনেস বললো। তারপর অগ্নি দৃষ্টিতে লিডিয়া ফয়-এর দিকে তাকালো। লিডিয়া নৌকার সামনের দিকে সিন্দুকগুলোর সাথে বসে আছে। কাইফেন বসে আছে ওর পাশে। খবরদারি করার চেষ্টা করছে। নৌকায় সবাই-ই ঠাসাঠাসি করে আছে, কিন্তু এর মাঝেও ওদের ঢলাঢলি সবার কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে। মাথার উপর একটা ছাতি ধরা ওর। লিডিয়া ওটা আর কাউকে দেয় না।

“লোকজন সবাই জানে যে তুমি ওদেরকে কতোটা স্নেহ করো,” অ্যাগনেস সারাহকে বললো। “শুধু তোমাকে নিরাপদ কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্যে এতো কষ্ট করছে ওরা।”

সারাহ দুর্বলভাবে হাসলো। “তাহলেতো আমার

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই কাশতে শুরু করলো সারাহ। কাশির দমকে বমি পেয়ে গেলো ওর। নৌকার কিনারের মাথা নিতে নিতেই সকালে খাওয়া সামান্য ভাত আর শুঁটকি মাছের পুরোটাই বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে।

অ্যাগনেস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারাহের বমি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে ধরে রাখলো। প্রতি সকালেই এরকম হচ্ছে।

“উনি যদি খেয়ে পেটে রাখতেই না পারে, তাহলে ওনার পিছনে খাবার নষ্ট না করলেই ভালো হবে,” কর্কশ কণ্ঠে বললো লিডিয়া ফয়। “এমনিতেই আমাদের না খেয়েই থাকতে হচ্ছে।”

“বাকি সবার মতো সারাহও ওর ভাগ পাবে,” জোর দিয়ে বললো অ্যাগনেস। নৌকার সব লোকের মাঝে একমাত্র লিডিয়াই কোনো কষ্ট করছে না বলা চলে। কম খাবারের ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ওর গায়ের রঙ এখনো আগের মতোই, স্তনও পোশাকের উপর দিয়ে আগের মতো ফুলে বেরিয়ে আছে। অ্যাগনেসের ধারণা কাইফেন সম্ভবত সবার অলক্ষ্যে ওকে অতিরিক্ত খাবার দিচ্ছে-বা আরো বেশি। কয়েকদিন রাতের বেলা ও নৌকার সামনের দিকে থেকে অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পেয়েছে।

“আমি বোঝা বাড়াতে চাই না,” বলতে বলতে সারাহ শুয়ে পড়লো। ওর পেটটা এখনো মোচড়াচ্ছে। অ্যাগনেস এমনভাবে সরে বসলো যাতে ওর ছায়া সারাহের উপর পড়ে। তারপর এক কাপ পানি বোনের ঠোঁটে ধরলো। কাপটা চীনামটির তৈরি, গায়ে উইলো পাতার নকশা আঁকা। এই পরিস্থিতিতে এই সুন্দর জিনিসটা একেবারেই বেমানান। অ্যাগনেস যখন দেখলো যে মিসেস ফয় তার পুরো ডিনার সেটা নৌকার তুলেছে তখন আক্ষরিক অর্থেই ওর মুখ হা হয়ে গিয়েছিলো।

“সাবধানে,” লিডিয়া বললো। “আবার বৃষ্টি না হলে কিন্তু পানির টানাটানি পড়ে যাবে।”

এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতির আর একটা নির্মম দিক হলো এটা। যখন বৃষ্টি আসে তখন এতো বেশি আসে যে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। সবাই তখন দাঁড় বাওয়া ছেড়ে পানি সেঁচতে শুরু করে। কিন্তু ওদের কাছে পানি ধরে রাখার মতো কিছু না থাকায়, বৃষ্টি থেমে সূর্য উঠলেই দেখা যায় তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে মরে।

অ্যাগনেস সামনের উপকূলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে সৈকত দেখা যাচ্ছে। ঝড়ের পর থেকে ওরা ডুবে যাওয়ার ভয়ে সবসময় ডাঙ্গার কাছে কাছে থাকে।

“আমাদের ডাঙায় যাওয়া উচিত একবার,” অ্যাগনেস বললো। “খাবার পানি পাওয়া যেতে পারে-বা গ্রামও থাকতে পারে। ওখান থেকে কিছু খাবারও আনা যাবে।”

“খাবার?” লিডিয়া কটাক্ষ নিক্ষেপ করলো ওর উপর। “ওরা আমদেরকে কেন সাহায্য করবে? আমারতো মনে হয় আমাদের গলা কেটে মালপত্র সব লুট করে নিয়ে যাবে।”

“আমাদের কাছে যথেষ্ট স্বর্ণ আছে। কিনে নিলেই হবে।”

“গরমে মাথা গুলিয়ে গিয়েছে আপনার। আমি এই গেয়োগুলোকে আমার একটা ফানামও (তৎকালীন মাদ্রাজের মুদ্রা) দেবো না।”

“এগুলো কোম্পানির স্বর্ণ,” অ্যাগনেস মনে করিয়ে দিলো।

“এগুলো আমার স্বামীর,” লিডিয়া জোর দিয়ে বললো।

“আর যদি মরেই যান তাহলে এগুলো কোনো কাজেই আসবে না।” অ্যাগনেস ভারতে যততদিন ছিলো ততোদিন কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী হতে শিখেছে। গাই-এর তিরস্কার আর ওর বোন ক্যারোলিনের খোঁচা দুটোই সহ্য করে গিয়েছে বিনা প্রতিবাদে। বয়স বাড়া সাথে সাথে ক্যারোলিন আরো বেশি মোটা, আর অসুখী যেমন হয়েছে, তেমনি ওর খোঁচার ধারও বেড়েছে বহুগুণ। শুধু নিজের স্বামীর কথা ভেবে অ্যাগনেস একটা শব্দও উচ্চারণ করনি কোনোদিন।

কিন্তু এখন টের পেলো ওর সহ্যশক্তি আর আগের মতো নেই। কারণটা হতে পারে ওর স্বামী বিয়োগ বা সূর্যের উত্তাপ অথবা এই চরম পরিস্থিতি। ও আর কিছুর পরোয়া করে না। ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে গেলো ও, আর সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলো না।

“আমার বোনের একটু ভালোমতো বিশ্রাম দরকার,” গরম কণ্ঠে বললো ও। “বাকিদেরও একটু বিশ্রাম আর ভালো খাওয়া প্রয়োজন। ওই সিন্দুকের উপর বসে বসে তা দেবেন আর আমাদের যা দরকার সেটা করতে দেবেন না, সেটা আমি হতে দেবো না।”

যারা দাঁড় বাইছিলো তারা দাঁড় তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। লিডিয়া নৌকার কিনার ছাড়িয়ে আর এক দিকে তাকিয়ে রইলো। “আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন মিসেস হিকস।”

অ্যাগনেস লেই-এর দিকে ফিরলো। ও হাল ধরে নৌকার একদম পিছনে বসে আছে। “কষ্ট করে নৌকা বাম দিকে ঘোরান। আমরা ডাঙায় নামবো।”

“ঐ গেয়োগুলোর হাতে লুট হয়ে দাসিগিরি করতে?” লিডিয়া কাইফেনকে ধরে ঝাঁকি দিলো। কাইফেন এততক্ষণ তর্কে না জড়াতে আর এক দিকে তাকিয়ে ছিলো। “মিস্টার কাইফেন! আপনি এখানকার দায়িত্বে আছেন।”

কাইফেন একবার অ্যাগনেস আর একবার লিডিয়ার দিকে তাকাতে লাগলো। “মিসে ফয় ঠিক বলেছেন,” শেষে কোনোমতে বললো ও। “যেদিকে যাচ্ছেন সেদিকেই যান। ডাঙায় যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।”

“মাফ করবেন ম্যাডাম, কিন্তু কোম্পানির নীল কোট পরলেই আপনি ক্যাপ্টেন হয়ে যাবেন না,” লেই বললো। তারপর ও হাল ঘুরিয়ে ফেলতেই বাকিরা আবার দাঁড় বাইতে শুরু করলো।

লিডিয়া রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো। আমার কথা না শুনলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। মাদ্রাজ পৌঁছেই আমি গভর্নরের কাছে নালিশ করবো। আর উনি তোদের সব কটাকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন।”

লেই-ও গরম চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। “আগে মাদ্রাজ পৌঁছাই, তারপর দেখা যাবে।”

“মিস্টার কাইফেন,” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আবার চেঁচিয়ে উঠলো লিডিয়া। “আপনি এই বেয়াদবি চুপচাপ সহ্য করবেন?”

‘কখনোই না,” ঠাণ্ডা গলায় বললো অ্যাগনেস। “আপনি যেভাবে ওনার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন, তাতে আপনার পোষা কুত্তা বাদে আর কিছু মনে হয় না আমার ওনাকে।”

অ্যাগনেসের নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। ওর মুখ থেকে এই কথাগুলো বেরিয়েছে। লিডিয়ার চেহারা রাগে সাদা হয়ে গেলো। অ্যাগনেস কাইফেনের দিকে চাইলো। কাইফেন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

গালাগাল করতে করতে লিডিয়া ওর জামার নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট পিস্তল বের করে আনলো। পিস্তলটার বাট হাতীর দাঁতের বানানো। অ্যাগনেসের দিকে তাক করলো সেটা।

“মিস্টার লেই, আবার আগের দিকে চালান,” আদেশ দিলো লিডিয়া। পিস্তল ধরা হাতটা এক চুল কাঁপছে না ওর।

কেউ নড়লো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অ্যাগনেসের দিকে তাকালো লেই। মাল্লাগুলোও ওদের দিকে চেয়ে রইলো। ঢেউ এসে নৌকার খোলে বাড়ি খাওয়ার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই আশেপাশে।

“জাহাজ!”

সারাহের কণ্ঠ নীরবতা ছিন্ন করলো। সবার অলক্ষ্যে ও উঠে বসেছে কখন যেনো। আর এখন সমুদ্রের দিকে দেখাচ্ছে। মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে আছে। ওর গলা এতোটাই ফ্যাসফেসে হয়ে আছে যে শব্দ বের হলো না বললেই চলে, কিন্তু নৌকার আশেপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে থাকায় শুনতে পেলো সবাই।

মুহূর্তে ঝগড়া ভুলে, সারাহ যেদিকে দেখিয়েছে সেদিকে তাকালো সবাই। দিগন্তে সাদা পালওয়ালা একটা জাহাজ ওদের চোখের সামনে এগিয়ে আসছে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বেঁচে গেলাম আমরা,” কাইফেন প্রায় কেঁদে দিলো। ওর পাশেই লিডিয়া সরু চোখে জাহাজটাকে দেখতে লাগলো।

“জাহাজটা কি ইংল্যান্ডের?”

“দেখে মনে হচ্ছে গ্রাব,” লেই বললো।

গ্রাব হচ্ছে ভারতীয় রীতিতে বানানো এক ধরনের জাহাজ। শব্দটা আরবি। অর্থ কাক। পাখির মতোই এগুলো সামান্য বাতাসেই উড়ে চলতে পারে। আর মাত্র দুটো পাল থাকায় ওগুলো সমুদ্রপথের এক দুর্দান্ত বাহনে পরিণত হয়েছে। তবে সবচে আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলোর লেজের দিকটা কেটে ফেলে সেখানে একটা কামান বসানো হয়। ফলে কেউ যদি ধাওয়া করে তাহলে সেদিকে দিয়ে খুব সহজেই গোলা ছুঁড়ে বাধা দেওয়া যায়।

“এরা কি কান্ট্রি ট্রেডার নাকি?” অ্যাগনেস জিজ্ঞেস করলো। ভারতীয় মহসাগরের উপকূলের মধ্যে যারা ব্যবসা করে তাদেরকে কোম্পানি নাম দিয়েছে কান্ট্রি ট্রেডার।

“বছরের এই সময়ে সমুদ্রে বেরিয়ে নিজেদের মালামাল খোয়ানোর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস খুব বেশি কারো নেই,” সন্দিহান সুরে বললো লেই।

ওদের উল্লাস থিতিয়ে পড়লো। এখন বরং জাহাজটা যতোই এগিয়ে আসতে লাগলো ততোই বাড়তে লাগলো ওদের দুশ্চিন্তা। সন্দেহের দোলাচালে দুলছে সবার মন। একবার মনে হচ্ছে উদ্ধার হবে ওরা, আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতির চাইতেও বাজে অবস্থায় পতিত হতে যাচ্ছে।

“পতাকা তুলছে ওরা।”

একটা লাল পতাকা ওটার মাস্তুল বেয়ে উঠে গেলো। সাথে সাথে বাতাস এসে ছড়িয়ে দিলো সেটাকে। সবাই স্পষ্ট দেখতে পেলো টকটকে লাল জমিনে একটা সাপের প্রতিকৃতি।

অ্যাগনেস এর আগে পতাকাটা কখনো দেখেনি। তবে পতাকাটার ভয়ংকর কুখ্যাতি জানা আছে ওর। ব্রিঞ্জোয়ানের কোম্পানির খাবার ঘরে প্রায় রাতেই এদের কথা বলবলি হতে শুনেছে ও। এটা হচ্ছে মালাবার উপকূলের ত্রাস-জলদস্যু আংরিয়া-র পতাকা। এই এলাকার এমন কোনো সওদাগর নেই, যার জাহাজের কোনো না কোনো লোক আংরিয়ার হাতে খুন বা বন্দী হয়ে অবর্ণনীয় অত্যাচারের স্বীকার হয়নি।

“ডাঙার দিকে যাও,” আর্তনাদের মতো শোনালো কাইফেনের গলা। “পালাতে না পারলে খবর আছে।”

মাল্লারা সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড় বাইতে শুরু করলো। ওরা সংখ্যায় মাত্র কয়েকজন, আর খুবই দুর্বল হয়ে আছে। গ্রাবটা তাই ওদের পিছু ছাড়লো না, শান্ত সাগরে মসৃণভাবে ধেয়ে এলো।

“খোদ শয়তান ওদের জাহাজ চালতে সাহায্য করে,” হাফাতে হাফাতে বললো একজন।

“চুপ,” লেই আদেশ দিলো। “কথা বলে দম নষ্ট কোরো না।”

“তীরের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলে ওরা আর আমাদেরকে ধরতে পারবে না আশা করি, কারণ তাহলে ওদের খোল চড়ায় আটকে যাবে,” আশান্বিত কণ্ঠে বললো কাইফেন।

অ্যাগনেস মাথা ঝাঁকালো। “আমি ব্রিঞ্জোয়ানের ঘাটে এরকম জাহাজ ভীড়তে দেখেছি। এগুলো কম পানিতে চলাচলের উপযোগী করে বানানো হয়।”

গ্রাবটার সামনের দিক থেকে আলোর ঝলকানি দেখা গেলো। এক সেকেন্ড পরেই কামানের বুমমম শব্দ কাঁপিয়ে দিলো চারদিক। গোলাটা উড়ে এসে ওদের নৌকা থেকে তিরিশ গজ মতো দূরে পানিতে আলোড়ন তুলে ডুবে গেলো।

“অসভ্যের দল ঠিকমতো কামানও দাগতে পারে না,” লিডিয়া ফয় বললো। এখনো ও আইভরির হাতলের পিস্তলটা ধরে আছে।

“এটা ছিলো সতর্কীকরণ,” লেই বললো। “পরেরটা কাছেই পড়বে।”

যেনো ওর কথা শুনেই গ্রাব থেকে আবার ছোঁড়া হলো গোলা। এবার গোলাটা এতো কাছে পড়লো যে ওদের গায়ে পানির ছিটে এসে লাগলো।

“আমাদের ভার বেশি,” লেই উদ্বিগ্ন সুরে বললো। “একটা লাগলেই ডুবে যাবে নৌকা। আপনি কি সাঁতরাতে পারেন মিসেস হিকস?”

“অল্পসল্প। কিন্তু সারাহকে ডাঙায় নেবো কিভাবে?”

ওরা ধেয়ে আসা জাহাজটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতো কাছে চলে এসেছে যে অ্যাগনেস ওটার কামানের নলের উপরে সূর্যের ঝলকানি দেখতে পেলো। সেই সাথে সামনের দিকে জড়ো হওয়া লোকজনও নজরে এলো ওর। ওরা ওদের অস্ত্রপাতি বাতাসে নাড়তে নাড়তে মুখ দিয়ে রক্ত হিম করা রণ-হুঁঙ্কার ছাড়ছে।

“কি করবো আমরা?”

*

গভর্নরের ঘরের চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে কাইফেন নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে আছে। জানালা দিয়ে সূর্যাস্তের আলো এসে পড়ছে ওর চেহারায়। একবারে লাল টকটকে লাগছে ওকে।

“স্বাভাবিকভাবেই আমি দস্যুদের ঠেকানোর জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমরা অনাহরে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম, আর তাছাড়া সমুদ্রে অনেকদিন ধরে আছি। দস্যুরা তাই সহজেই হারিয়ে দিলো আমাদের। ওর মহিলাদেরকে বন্দী করে আমাকে একটা ছোট নৌকায় করে ভাসিয়ে দেয়। আমাকে ছেড়ে দেয়ার কারণ হলো আমাকে দিয়ে একটা খবর মাদ্রাজে পাঠাতে চায়। তা হচ্ছে বন্দিদের জন্যে মুক্তিপণ দিতে হবে। আর তারপরেই ভাসতে ভাসতে, কোনোমতে যমের দুয়ার থেকে ফিরে এখানে এসে পৌঁছেছি আমি।”

ওর গল্প শুনতে শুনতে টম নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে সারা ঘরে পায়চারি শুরু করেছিলো। কথা শেষ হতে থামলো ও। তারপর জানালার গোবরাটে ভর দিয়ে বাইরের সূর্যাস্ত দেখতে লাগলো। শহরের পশ্চিমের একটা ছোট উপহ্রদের পানিতে ডুব দিচ্ছে সূর্যটা।

“কতো?” জিজ্ঞেস করলো টম।

কাইফেন অস্বস্তিভরে নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো। “মাফ করবেন?”

“ওরা কতো টাকা মুক্তিপণ চাইছে?”

“এইতো…” কাইফেনের মুখ ডাঙায় ভোলা মাছের মতো খাবি খেতে লাগলো। “পাঁচ হাজার রুপি।”

“কিভাবে দিতে হবে টাকা? মহিলাদের কোথায় আটকে রেখেছে ওরা?”

কাইফেন এতো জোরে নিজের আঙুল মোচড়াতে লাগলো যে টমের মনে হলো ওগুলো ভেঙে যাবে যে কোনো সময়। “আমার মনে নেই। আসলে পরিস্থিতি… সবকিছুই এতোটা ভয়ংকর ছিলো যে, আপনি তো বুঝতেই পারছেন। আমি কোনো মতে জান নিয়ে পালিয়েছি।”

“আংরিয়ার ঘটি হচ্ছে বোম্বের দক্ষিণের টিরাকোলার দুর্গ,” গভর্নর বললো। “নিশ্চিত ওদেরকে ওখানেই নিয়ে যাওয়া হয়ছে।”

টম ওর কথায় পাত্তা দিলো না। ও জানালা থেকে ঘুরে কাইফেনের দিকে আগালো। চেয়ারের ভিতর কুঁকড়ে গেলো কাইফেন। ওর সামনে টমকে এখন দানবের মতো লাগছে।

“মিথ্যে কথা।”

বলে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই টম কাইফেনের কোটের কলার চেপে ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এক লাথিতে ফেলে দিলো মেঝেতে। তারপর আরো এক লাথিতে দেয়ালের গায়ে আছড়ে ফেললো। ফ্রেজার ওকে থামাতে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু টমের আক্রোশ দেখে থমকে গেলো।

“সত্যি কথা বল,” ওকে টেনে তুলে জানতে চাইলো টম।

কাইফেন নিজের জামার ভিতর এতো বেশি সেধিয়ে গিয়েছে যে ওর চেহারা আর দেখাই যাচ্ছে না। ও বিড়বিড় করে কি কি বলতে বলতে হাত পা ছুঁড়তে লাগলো। “ছেড়ে দিন আমাকে।” চি চি করে বললো ও।

টম ছেড়ে দিলো ওকে। ধপ করে মেঝেতে আছাড় খেয়ে ব্যথায় কাতরে উঠলো কাইফেন।

“তুই একটা কাপুরুষ, একটা নরাধম তুই,” টম বললো ওকে। “তুই যদি শুধু নিজের চামড়া বাঁচানোর ধান্দা না করে আমার কথা শুনতি, তাহলে ঐ নৌকায় করে আমরা সবাই আজ পালিয়ে বাঁচতে পারতাম। এতোগুলো ভালো মানুষ আজ না মরে বেঁচে থাকতো। আর আমার বৌও থাকতো আমার সাথে।”

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেলো টম; কথা বলতে বলতে আবার লাথি শুরু করলো ও। ডাক ছেড়ে কাঁদতে আরম্ভ করলো কাইফেন।

“মিস্টার উইল্ড,” ফ্রেজার ডাকলো। হতভম্ব হয়ে গিয়েছে ও। “আমি কিন্তু প্রহরীদের ডাকবো।”

টম পিছিয়ে এলো। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে ওর। চোখে ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। কারণ, কাইফেনের দিকে চোখ গেলে আবারো ওর ওকে পিটাতে ইচ্ছে করবে।

“দস্যুরা তোকে ছেড়ে দিয়েছে, না? তোকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, তাই না?” বলতে বলতে টম ঘুষি তুললো। কাইফেন কো কো করতে করতে ঘরের এক কোনায় সরে গেলো।

“মিস্টার উইল্ড,” ফ্রেজার ডাকলো ওকে।

“তুই যখন ঘরে বসে খেলনা দিয়ে খেলতি, তখন থেকে আমি সমুদ্রে দস্যুদের সাথে লড়াই করে আসছি। ওদের কাছে প্রতিটা বন্দীই হচ্ছে ব্যবসার পণ্য। একটা স্বর্ণের বস্তা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওরা কাউকেই ছাড়বে না। তাই আবারও বলছি, ভালোয় ভালোয় বল কি হয়েছিলো?”

কাইফেন উঠে বসলো। নাক বেয়ে রক্ত পড়ছে। ফ্রেজারের দিকে কাতর নয়নে তাকালো ও।

“আপনি ওনাকে আমার সাথে এরকম করতে দেবেন? আপনার সৈন্যদের ডাকুন-একে আটক করুন। পাগল হয়ে গিয়েছেন ইনি।”

“ওনার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

কাইফেন টম আর গভর্নরের দিকে তাকাতে লাগলো। ওর পক্ষে কেউ নেই দেখতে পেয়ে চেহারা অন্ধকার হয়ে গেলো ওর।

“আমি দস্যুদের সাথে লড়াই করিনি,” ফিসফিস করে বললো ও।

“আর ওরা তোকে ধরেওনি, তাই না?” জেরা করলো টম।

“আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়েছিলাম, কাইফেন কাতর কণ্ঠে বললো। “আমরা ডাঙার খুব কাছেই ছিলাম তখন। আমি সাতরাতে পারতাম। দস্যুরা তখন লুট করতে এতোই ব্যস্ত ছিলো যে আমার দিকে খেয়াল করেনি।”

“আপনি মহিলাদেরকে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন?” গভর্নর জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ,” মাথা নিচু করে বললো কাইফেন। “একশো দস্যুর বিপক্ষা আমি কি-ইবা করতে পারতাম? আমি ভেবেছিলাম কারো কাছে সাহায্য পাবো হয়তো। সবাইকে সতর্ক করে দেবো।”

“তুই এরকম কিছুই ভাবিসনি,” টম বললো। রাগ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে ওর। “তুই শুধু নিজেকে বাঁচানোর চিন্তা করছিলি।”

কাইফেন প্রতিবাদ করলো না। আমি একটা গ্রাম খুঁজে পাই। ওরা আমাকে আশ্রয় দেয়। দস্যুরা চলে যাওয়ার পরে জেলেরা আমাকে উপকূলে নিয়ে আসে। তারপর একের পর এক গ্রাম হেঁটে পাড়ি দিয়ে অবশেষে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি।” তারপর ভালো মানুষের মতো বললো, “বিশ্বাস করুন, এরপর থেকে এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন আমি বেচারা মহিলাদের মুক্তির জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিনি। আমি যদি আমার অবস্থানের সাথে ওদেরটা বদল করতে পারতাম, তাহলে খুশি মনেই তা করতাম।”

টমের অগ্নিদৃষ্টি দেখে থেমে গেলো কাইফেন। টম মেঝেতে শুয়ে থাকা নাকি কান্না করতে থাকা লোকটার দিকে তাকালো। ওর মনে পড়লো অনেক আগে কোম্পানির এক চাকর ওদের পরিবারের সাথে বেইমানি করে দস্যুদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো। ওর বাবা হাল লোকটার সাথে কি করেছিলেন সেটাও মনে পড়লো ওর। উনি চাকরটার কাছ থেকে আগে স্বীকারোক্তি আদায় করেছিলেন, তারপর উলঙ্গ করে জানালা দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ফ্রেজার অনুমতি দিলেও টমের আর কাইফেনকে কষ্ট দেওয়ার মতো মানসিকতা নেই। কাইফেন আগাগোড়া একজন পুরুষ। যে দায়ে ওকে দোষী করা হচ্ছে, সেই দায়িত্ব ও নিজে থেকে নেয়নি। ওর উপরের ঠোঁটে রক্ত আর শ্লেষ্ম জমে আছে। যেনো বড় ছেলেদের হাতে ধোলাই হওয়া ছোট একটা বাচ্চা।

“আমার সামনে থেকে ভাগ,” হিসিয়ে উঠলো টম।

কাইফেন হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে গেলো। আবারও টমের আঘাতের ভয়ে সারা শরীর শক্ত হয়ে আছে। ও দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই টম ফ্রেজারের দিকে ফিরলো।

“সারাহ আর অ্যাগনেসকে ফিরিয়ে আনবো কিভাবে?”

ফ্রেজার অস্বস্তি নিয়ে তাকালো ওর দিকে। “যদি আংরিয়া ওদেরকে ধরে থাকে তাহলে নিশ্চিত যে ওদের মুক্তিপণের দাবি বোম্বেতে পাঠিয়েছে।”

“এখন কি হবে তাহলে?”

“গভর্নর কোর্টনী দস্যুদের সাথে কোনো প্রকার সমঝোতায় বিশ্বাসী না। ওনার মতে এতে ওদেরকে আরো উসকে দেওয়া হয়।”

“তো? উনি কি দুর্গ আক্রমণ করবেন?”

ফ্রেজার কি বলবে ভেবে পেলো না। “আংরিয়া হলো পুরো মালাবার উপকূলের সেরা দস্যু। আর গাই কোর্টনীর হাতে অতো সামরিক শক্তি নেই।”

“তার মানে উনি ওদেরকে ওখানেই পচে মরতে দেবেন? এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন অ্যাগনেস হিকস, গাই কোর্টনীর শ্যালিকা।”

“আমিতো আসলে ওনার ব্যাপার জানি না,” ফ্রেজার টমের চেহারার যন্ত্রণা খেয়লা করলো। “তবে আমি আপনাকে একটা জাহাজে করে বোম্বেতে পৌঁছার ব্যবস্থা করতে পারি। আপনি নিজে গভর্নর কোর্টনীর সাথে আলাপ করবেন নাহয়। যদি উনি আপনাকে মুক্তিপণের টাকাটা না-ও দেন, তাহলে ওখানে বা সুরাটে অনেক সওদাগর পাবেন যারা আপনাকে টাকাটা ধার দেবে।”

“কিসের বিনিময়ে?” হতাশ কণ্ঠে বললো টম। “আমার কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই। আর আপাতত যে হবে সেই সম্ভাবনাও নেই। আমি নিজের জীবন বাজি রেখে কোম্পানির মূল্যবান সম্পত্তি রক্ষা করেছি। আমার পুরষ্কার কি এটাই? আমার স্ত্রী এখন একটা দস্যুর কয়েদখানায় পচে মরবে?”।

ফ্রেজার দুই দিকে হাত ছড়িয়ে বললো, “আমি কিছু করতে পারলে খুশিই হতাম। আপনিতো জানেন-ই যে এই দস্যুগুলোর বিবেক বলে কিছু নেই। এদের কাছে ব্যবসাই মুখ্য, আর বন্দীরা হচ্ছে ওদের ব্যবসার পণ্য। আংরিয়া যে মুক্তিপন চাচ্ছে সেটা জোগাড় করুন, তাহলে ও আপনার সাথে কোনো ঝামেলা করবে না।”

“আর যদি না পারি?”

“তাহলে ও ক্ষতি মেনে নেবে, আর যারা ওর টাকা শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাদের জন্যে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করবে।”

*

মাদ্রাজে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হলো ওদেরকে। প্রতিদিন অ্যানা, টম আর ফ্রান্সিসকে নিয়ে বাজারে গিয়ে অ্যানার পরিচিত ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলতো। সবাই ওদের কথা শুনে দুঃখপ্রকাশ করলো, কিন্তু কারো কাছেই ধার দেওয়ার মতো টাকা ছিলো না।

“আসলে কিছুই করার নেই,” অ্যানা বললো। “ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কারোই বেচা বিক্রি হবে না।”

অবশেষে ওরা রওনা দিলো। কেপ করমোরিন থেকে শুরু করে মালাবার উপকূল পর্যন্ত বাতাসের অনুকূলে এগিয়ে চললো জাহাজ। সকাল বেলা ডাঙা থেকে ধেয়ে আসতো বাতাস, ফলে সমুদ্রের গভীরে ঢুকে যেতো ওরা। বিকেলের দিকে সমুদ্রের বাতাস জোরালো হয়ে এলে ওরা আবার কূলের কাছাকাছি চলে আসতো।

ওরা ব্রিঞ্জোয়ান পার হয়ে আসলো। দিগন্তে একটা ফোঁটার মতো দেখা যাচ্ছিলো ওটাকে। সমুদ্রের মাঝ থেকে ওটার ধ্বংসলীলার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। টম ওটাকে দেখতে পেয়ে খুশিই হলো। আরো উত্তরে আগাতেই আনা আঙুল দিয়ে কিডস আইল্যান্ড দেখালো। ওখানে নাকি দস্যু সম্রাট বিলি দ্য কিড একবার জাহাজ ভিড়িয়েছিলো।

“ওখানে কোনো গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে যাননিতো আবার?” ফ্রান্সিস বললো। “আমাদের খুব কাজে লাগতো এখন।”

পাম গাছের সারি ভরা সৈকত শেষ হয়ে, একটা রুক্ষ, পাথুরে সৈকত শুরু হলো। দিগন্তে ঘন জঙ্গলে ভরা শৈল অন্তরীপ দেখা যেতে লাগলো একের পর এক। ওগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ঘোট ঘোট উপসাগর আর নদীর মোহনা। অনেকগুলোতে দেখা গেলো পাথরের দুর্গ দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোর পাদদেশে মাঝে মাঝে নির্জন ঘাটে একটা দুটো নৌকাও চোখে পড়লো।

“দেশটায় সবসময় যুদ্ধ লেগেই থাকে,” অ্যানা ব্যাখ্যা করলো। “তিরিশ বছর আগে মারাঠারা মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেদের আলাদা সাম্রাজ্য দাবি করে বসে। কিন্তু এখন ওরা নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ করছে। বুড়ো রানি তার নিজের সৎ ছেলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এই ফাঁকে আংরিয়া নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। দুই পক্ষকেই সমান তাল দিয়ে যাচ্ছে।”

জাহাজটা মূল ভূখণ্ড পেরিয়ে আসতেই নতুন আর একটা শৈল অন্তরীপ চোখে পড়লো। ওটার গোড়ায় সাদা ফেনায় ভরা ঢেউ এসে বাড়ি খাচ্ছে। উপরে কালো পাথরের তৈরি একটা দুর্গ ছোট পাহাড়টার পুরো চূড়াটা দখল করে আছে।

“ঐতো,” অ্যানা দেখালো। “ওটাই টিরাকোলা। আংরিয়ার আস্তানা।”

টম একটা টেলিস্কোপ দিয়ে দুর্গটার জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো, যদি কোনো একটায় সারাহের মুখ দেখা যায় সেই আশায়। ওর বুকটা হু হু করে উঠলো। এতো কাছে এসেও এতো দূরে থাকার যন্ত্রণা সহ্য হতে চাইলো না। এই ভয়াল দর্শন দেয়ালের ওপারেই সারাহ আর অ্যাগনেস আছে। কি অবস্থায় আছে। তা ঈশ্বরই জানেন শুধু। নিশ্চয়ই ওরা অপেক্ষা করে আছে যে টম কবে এসে ওদেরকে উদ্ধার করবে। একবার মনে হলো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সাঁতরে পাড়ে গিয়ে পাহাড়ের ধারটা বেয়ে দুর্গে গিয়ে ওঠে।

“এটাতো একেবারে দুর্ভেদ্য মনে হচ্ছে,” নিচু কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস।

জাহাজের মাস্টার ওদের পাশে এসে দাঁড়ালো। “দেয়ালগুলো আঠারো ফুট পুরু। এখন পর্যন্ত একমাত্র এবং সর্বশেষ গভর্নর স্যার নিকোলাস ওয়েইট আংরিয়ার বিরুদ্ধে কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। উনি একঝাক বোমারু জাহাজ নিয়ে একটা বহর গঠন করে এখানে নিয়ে আসেন। দেয়ালগুলো অনেক উঁচুতে হওয়ায় জাহাজ থেকে গোলা ছোঁড়া সম্ভব ছিলো না। উনি কামানের নলের ভিতর মর্টার ভরে দেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। পাথরে লেগে ওগুলো ডিমের মতো ফেটে যায়, তাতে পাউডার ঝরে পড়ে ফিউজও নষ্ট হয়ে যায়।”

টম দুর্গ আর ওটার চারিপাশটা ভালো করে দেখে নিলো। প্রতি কোনায় উঁচু মিনার। দেয়ালের নিচের দিকটা শুধু পাথর কেটে বানানো। উপরের গাথুনিও এতো মজবুত যে ইউরোপের কোথাও এরকম দেখেছে কিনা মনে করতে পারলো না। খুব বেশি কামান অবশ্য দেখা গেলো না, তবে তাতে খুব বেশি কিছু আসে যায় না। দুৰ্গটার অবস্থানই ওটাকে অনাক্রম্য করে তুলেছে।

শৈল অন্তরীপটা পেরিয়ে উপকূলটা একটা গভীর উপসাগরে গিয়ে পড়লো। একটা নদী এসে মিশেছে ওখানে। টম গুণে দেখলো ওখানে প্রায় বারোটা জাহাজ নোঙ্গর করা। এর ভিতর কয়েকটা বড় আকারের গ্রাব দেখা গেলো, একেকটা প্রায় যুদ্ধ জাহাজের সমান লম্বা। তিনটা মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি একত্র করে বেঁধে উপসাগরের প্রবেশপথটা আটকে রাখা হয়েছে।

“আরো কয়েকটা পাল তোল,” মাস্টার আদেশ দিলো। দস্যুদের জাহাজের এতোটা কাছে চলে আসায় উদ্বিগ্ন বোধ করছে সে। কিন্তু গাছের গুঁড়িগুলো জায়গাতেই থাকলো আর ওদেরকে কোনো জাহাজ ধাওয়া করলো না। তার মানে আজ আংরিয়ার হাতে অন্য জরুরি কাজ আছে।

দূরে সরে যেতে যেতে টম দুর্গটার দিকে তাকিয়ে রইলো। “আমি আবার ফিরে আসবো,” প্রতিজ্ঞা করলো ও। বাতাস ওর কথাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো সুদূরে।

৭. দুর্গের গভীরের কারাগার

দুর্গের গভীরের কারাগারে নড়েচড়ে উঠলো সারাহ কোর্টনী। উঠে বসতেই লোহার কড়াগুলোয় টান পড়ে ব্যথা করে উঠলো হাতে। সামনের অন্ধকারে তাকিয়ে রইলো ও। ঘড়ির কাটার শব্দের মতো টুপটাপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে; অন্য বন্দিরা কেউ ফোঁপাচ্ছে, কেউ বিলাপ করছে। ও কোনো কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে পাথরের ভিতর দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগলো। আশা করছে ব্যাপারটা যেনো একটা দুঃস্বপ্ন হয়।

ওর শরীর জুড়ে একটা কাঁপুনি বয়ে গেলো, ঠিক কোনো মোমবাতির পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে ওটার শিখার ভিতরে যেরকম কাপন হয়, সেরকম।

“কি হলো?” জিজ্ঞেস করলো অ্যাগনেস। বোনের দিকে সবসময় নজর ওর। বমি আপাতত আর হচ্ছে না; আর ওদেরকে যে সামান্য খেতে দেওয়া হচ্ছে তাতেও সারাহের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বরঞ্চ ওর ওজন আরো বেড়েছে। কিন্তু এখন নতুন আর এক দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে, “জ্বর এসেছে আবার?”

সারাহ মাথা নাড়লো। “মনে হলো টমের গলা শুনতে পেলাম যেনো। স্বপ্নে দেখলাম যে ও আমাদেরকে উদ্ধার করতে এসেছে। নেপচুন তরবারিটা হাতে দরজা দিয়ে দৌড়ে এসে আমাদের বাঁধন কেটে দিলো।” বল দীর্ঘশ্বাস ফেললো সারাহ। তারপর হাতটা পেটের উপর রেখে বললো। “এই স্বপ্ন আর সত্যি হবে না। তরবারিটাই তো হারিয়ে গিয়েছে।”

এই কয়েদখানায় ওরা ঠিক কতোদিন ধরে আছে সেই সম্পর্কে ওর কোনো ধারণাই নেই। কয়েক সপ্তাহ তো হয়েছেই। এতো নিচে দিনের আলো পৌঁছায় না, দেয়ালে কোনো ফাটল ও নেই যা দিয়ে দিনের হিসাব রাখতে পারবে। ওরা আছে। একটা গুহার ভেতর, শৈল অন্তরীপটার একদম পেটের ভিটর গুহাটা। সারাহ মাঝে মাঝে বাইরে পাথরের গায়ে ঢেউয়ের বাড়ির শব্দ শুনতে পায়। কারাগারের দেয়ালগুলো পাথর কেটে বানানো হয়েছে। বৃষ্টি পড়লেই ওটার ধার বেয়ে পানি পড়ে, পুরো ঘরটা স্যাঁতসেতে হয়ে আছে তাতে। আর আলো বলতে আছে একমাত্র পাশের গুহার একটা কুপির সামান্য আলো সেটাতে তেল ফুরিয়ে গেলে মাঝমাঝে কয়েক দিন পার করে, তারপর প্রহরীরা তেল ভরে দিয়ে যায়।

“ও আসবেই,” অ্যাগনেস বললো। “যদি ও বাতাসে ভেসে পৃথিবীর উল্টো পাশেও চলে যায়, এমনকি যদি তোমার আর ওর মাঝে শ্রেষ্ঠ মুঘল সেনারাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবুও ও তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে।”

“যদি ও বেঁচে-ই না থাকে? আমি জানিও না যে ও চিত্তিত্তিঙ্কারা থেকে। পালিয়ে আসতে পেরেছিলো কিনা।”

অ্যাগনেস সারাহের হৃৎপিণ্ডের উপর হাত দিলো। “ওর যদি কিছু হতো, তাহলে এখানে টের পেতে।” টম আর সারাহের সাথে ব্রিঞ্জোয়ানে মাত্র কয়েকদিন ছিলো অ্যাগনেস, কিন্তু তাতেই খেয়াল করেছে যে ওরা দুজন দুজনকে কতোটা ভালোবাসে। ও জানে যে টম ওদেরকে উদ্ধার করবেই।

গুহার অন্য প্রান্ত থেকে খনখনে গলায় উপহাস করে উঠলো কেউ।

“স্বামীর উপর ভরসা করে লাভ নেই। যদি বেঁচে-ও থাকে, তবে এতে দিনে ভুলেই গিয়েছে যে সে বিবাহিত ছিলো।”

“আমি ওকে পুরো ভরসা করি।”

“আমিও মিস্টার কাইফেনের উপর ভরসা করেছিলাম,” খেঁকিয়ে উঠলো লিডিয়া। “কিন্তু কাপুরুষটা সঁতরে ডাঙায় চলে গেলো। কে জানতো একজন ভদ্রলোক, তিনজন মহিলা আর সব সম্পত্তি ওই দস্যুদের হাতে ফেলে পালিয়ে যাবে?”

“টম ওরকম না,” নরম গলায় বললো সারাহ। ও সারাক্ষণই টমের কথা ভাবে, কিন্তু খুব বেশি আলোচনা করে না। কারণ অ্যাগনেস সদ্য বিধাব হয়েছে, সেখানে সারাহের নিজের স্বামীকে নিয়ে জাবর কাটাটা নিষ্ঠুর হয়ে যায়।

“আমাদেরকে বাঁচাতে পারেন একমাত্র গাই কোর্টনী, লিডিয়া বললো। “আমার আর দেরি সহ্য হচ্ছে না।” বলে ও অ্যাগনেসের দিকে তাকালো। “আপনি তো ওনার শ্যালিকা। উনি এখনো আমাদের মুক্তিপণের টাকা দিচ্ছেন না কেনো?”

“আপনি যদি ভেবে থাকেন আমার টানে গাই আমাদেরকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবে, তাহলে ভুল করছেন,” অ্যাগনেস বললো। “তার চোখে পৃথিবীর সবচে বড় দুষ্কর্মটা করেছি আমি। তার ব্যক্তিগত লাভ হতে পারতো এমন একটা কাজে আমি সায় দেইনি। উনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক উচ্চ পদস্থ লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলেন আমার। কিন্তু আমি বিয়ে করি ক্যাপ্টেন হিকসকে। হিকস ছিলেন দীনহীন এক সৈনিক। গাই আমাকে এই অপরাধে কখনোই ক্ষমা করেনি। আর সেজন্যেই আমাদেরকে ব্রিঞ্জোয়ানে নির্বাসন দিয়েছিলো।”

অ্যাগনেস ঠাণ্ডা দেয়ালে হেলান দিলো আবার। এসব কথা আজ প্রথম না। দস্যুরা ধরে অ্যানার পর থেকেই বেশ কয়েকবার এসব নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু আজ লিডিয়া এখানেই কথা শেষ করতে দিলো না। ও সোজা উঠে বসে হাতটা টেনে কড়াগুলো ঠিকঠাক করলো। তারপর সারাহ আর অ্যাগনেসের দিকে কুটিল একটা চাহনি দিয়ে বললো, “আপনার যে আপন বোন না, এই ভাব ধরে থাকেন কেন?”

ওদের হতভম্ব চেহারা দেখে লিডিয়া শব্দ করে হেসে দিলো। “আপনারা ভেবেছিলেন আমার কাছে থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবেন? আমি তো আর অন্ধ না। আমি সবই দেখেই, সবই শুনি। ব্রিঞ্জোয়ান থেকে আসার আগেই আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তো এটা লুকিয়ে রাখা সম্ভবই না। আপনার দুজনের এতো যত্ন নেন; আমি ঘুমিয়ে আছে মনে করে ফিসফিস করে কতো কথা বলেন। আমি আপনাদের গোপন খবরটা জানি-আর যে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে চান না, সেটাও আমার জানা আছে।”

লিডিয়া মাথা তুললো। ফলে ওর চোখা থুতনিটা ওদের দিকে তাক হয়ে থাকলো। “অস্বীকার করতে পারেন?”

যদিও এটা কোনো ব্যাপার না, তবুও অ্যাগনেসের কেনো যেনো মনে হলো ওর খুব দামি কোনো সম্পদ হাতছাড়া হয়ে গেলো। এই কয়েদখানায় নিজেদের বলতে ছিলো শুধু এই গোপন কথাগুলো। এখন সেটাও আর থাকলো না। আর ও লিডিয়াকে এক বিন্দু বিশ্বাস করে না।

“হ্যাঁ, এটা সত্য,” নির্বিকারভাবে বললো সারাহ। “অ্যাগনেস আর আমি বোন। ঘটনাক্রমে ব্রিঞ্জোয়ানে নামার আগে প্রায় বিশ বছর ওকে দেখিনি আমি।”

“তার মানে আপনিও গভর্নরের স্ত্রী ক্যারোলিন কোর্টনীর বোন?”

সারাহ মাথা ঝাঁকালো।

লিডিয়া হাতকড়াসমেত ওর হাত দুটো উপরে তুললো। “তাহলে আমাদের বন্দিকারীকে বলে দিন যে আপনারা আসলে কারা। যদি গাই কোর্টনী জানতে পারেন যে এরা তার স্ত্রীর দুই বোনকেই আটকে রেখেছে-সেই সাথে তার পরম বিশ্বস্ত বন্ধু মিস্টার ফয়-এর বিধাব স্ত্রীও আছেন-তাহলে যতো টাকাই চাক না কেন উনি দিয়ে দেবেন।”

“আপনার ধারণা ভুল,” সারাহ বললো। “গাই যদি আমার আসল পরিচয় জানতে পারে, তাহলে. ও আংরিয়াকে টাকা দিয়ে বলবে আমাদেরকে মরার আগ পর্যন্ত এখানে রেখে দিতে। আর যদি ও আমাকে মুক্ত করে নেয়, তাহলে তা করবে আংরিয়ার চাইতেও ভয়ংকর কোনো শাস্তি দেওয়ার জন্যে।”

লিডিয়া সামনে ঝুঁকে এলো? যেনো কোনো ব্লাডহাউন্ড কুকুর রক্তের ঘ্রাণ পেয়েছে। “কেন?”

দেরিতে হলেও সারাহ টের পেলো যে ও অনেক বেশি বলে ফেলেছে। দুর্বলতা আর হতাশা ওর সতর্কতা কমিয়ে দিয়েছে। সেটা তেমন কিছু না।”

“যদি এই কারণেই আমাকে এই কয়েদখানায় পচে মরতে হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই তেমন কিছু,” লিডিয়া চার হাত পায়ে ভর দিয়ে আরো সামনে এগিয়ে এলো। “কেনো গাই আপনাকে এতো অপছন্দ করে?”

“কোনো কারণ নেই।”

“আপনাকে ভালোবাসতো নাকি?”

সারাহ শিউরে উঠলো। “কোনোদিনও না।”

লিডিয়া ভাবতে লাগলো। “উনি অ্যাগনেসকে তার পছন্দ ছাড়া বিয়ে করায় ক্ষমা করতে পারেননি। সম্ভবত আপনিও একই কাজ করেছিলেন, তাই না?”

সারাহ আর কিছু বলার সাহস করলো না।

“কিন্তু তাতে তো তার আপনাকে এভোটা ঘৃণা করার কথা না,” লিডিয়া জোরে জোরে ভাবতে লাগলো। তার মানে কাহিনি আরো আছে। আপনার স্বামীকে নিয়ে সম্ভবত। আপনার স্বামী আর গভর্নর কোর্টনীর মাঝে শক্রতা আছে নাকি?”

লিডিয়ার নাক কুঁচকে গেলো। “কিন্তু কেন উনি এতোটা রাগ করবেন? আপনার স্বামী কি করেছিলেন? ইন্টারলোপার নাকি? নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী?”।

“ইন্টারলোপার,” অ্যাগনেস বললো। “আপনিতো জানেনই যারা কোম্পানির ব্যবসা মেরে খায় গাই তাদেরকে কতোটা ঘেন্না করে। এটাই কারণ।”

কিন্তু অ্যাগনেসের হড়বড় করে বলা কথার কারণে লিডিয়া মিথ্যেটা ধরে ফেললো। “না! সেটা আসল কারণ বলে মনে হচ্ছে না। একটা বিজয়ীর হাসিতে ওর দুই ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেলো। আমরা যখন ব্রিঞ্জোয়ানে নৌকায় মালামাল ভরছিলাম, তখন একটা লোক আপনাকে মিসেস কোর্টনী” বলে ডাক দিয়েছিলো। এরকম কেনো করবে? আর যে ছেলেটা আপনাদের সাথে ছিলো, সে হচ্ছে গাইয়ের ভাতিজা-ফ্রান্সিস কোর্টনী। সবকিছু খুব বেশি কাকতালীয়, তাই না?”

“ভুল শুনেছেন,” সারাহ বললো।

“আমার মনে হয় না। আর আপনি যদি মিসেস কোর্টনী হন, তাহলে আপনার স্বামী নিশ্চয়ই…” এক মুহূর্ত ভাবলো লিডিয়া! “টম কোর্টনী।”

সারাহ আর অ্যাগনেসের বজ্রাহত চেহারা খেয়াল হলো লিডিয়ার। ও হেসে দিলো আবার। “আপনি হচ্ছেন মিসেস টম কোর্টনী। শুধুমাত্র গাই-এর শ্যালিকা না, তার ভাইয়ের স্ত্রী-ও। এখন বুঝতে পারছি সব। বোম্বে থাকার সময় আমি টম কোর্টনীর কথা শুনেছিলাম। সবাই বলতো যে ওরা এমন শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে যে একজন আর একজনকে খুন করতে গিয়েছিলো। একবার নাকি শুধু টমের নামটা বলার অপরাধে, গাই তার বাড়ির ছাদ থেকে কাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো।”

“আমি এসব গুজবে কান দেই না,” অ্যাগনেস বললো।

কিন্তু লিডিয়ার কথা তখনও শেষ হয়নি। “আরো একটা কাহিনি মনে পড়ছে। এখন। এক বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম। ক্যারোলিন কোর্টনীর চাকরানি তাকে বলেছিলো ঘটনাটা। এই চাকরানি ইংল্যান্ড থেকেই ক্যারোলিনের সাথে এসেছিলো। সে বলেছিলো যে গাই-এর সাথে বিয়ে হওয়ার আগেই নাকি ক্যারোলিন নিজের কুমারীত্ব হারিয়েছিলো-এমনকি ওর পেটে তখন নাকি বাচ্চাও ছিলো।”

এই অন্ধকারেও মনে হলো লিডিয়ার চেহারা জ্বলজ্বল করে উঠলো। গত কয়েক সপ্তাহের কায়ক্লেশে ওর চৌকো চেহারাটা আরো বেশি ধারালো হয়েছে, এখন ওকে দেখতে ভয়ংকর লাগে।

“সবাই বলাবলি করে যে বাচ্চাটা-মানে ক্রিস্টোফার কোর্টনী নাকি গাই এর সন্তান না। ক্যারোলিন নাকি ইংল্যান্ড থেকে আসার পথে জাহাজে ইচ্ছে মতো যার তার সাথে শুয়েছে। আর যদিও বিয়ের দিনের ওয়াইন গাই-ই খেয়েছেন, কিন্তু বোতলের মুখ প্রথম খোলার সুযোগ নাকি ওনার হয়নি। সেই সৌভাগ্য হয়েছিলো ওনার ভাই টমের।”

এই অন্ধকারেও লিডিয়ার চোখ বিজয়ানন্দে চকচক করতে লাগলো। “এ কারণেই গাই আপনাকে ঘৃণা করে।” তারপর সারাহের দিকে চেয়ে উপহাসের সুরে বললো, “তবে আমি ভেবে পাই না, নিজের বোনের সাথে এরকম করার পরেও আপনি ওর প্রতি এতো বিশ্বস্ত। আমি হলে কোনোদিন কারো শেষ পাতের খাবার হয়ে খুশি থাকতাম না।”

“এখনতো আপনি বুঝলেন যে কেনো গাইকে সারাহের আসল পরিচয় জানানো যাবে না,” অনুনয়ের সুরে বললো অ্যাগনেস। “কথাটা আর কাউকে বলবেন না।”

লিডিয়া আবার নিজের কোনায় ফিরে গেলো। সদ্য বিজয়ের শিহরণে ওর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে আছে।

“আমার উপর ভরসা করতে পারেন,” বললো লিডিয়া। “আমি কাউকে বলবো না। আর একটা ব্যাপার, যেটার কথা আপনি কাউকে বলছেন না।”

“মানে?” নিস্তেজ কণ্ঠে বললো সারাহ।

“আপনার পেটে বাচ্চা। আপনি কখনো বলছেন না, কিন্তু আপনার পেটের ফোলাটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে সেটার। নৌকায় আপনি খাবার পেটে রাখতে পারতেন না। আর এখন এতো কম খাবার খেয়েও আপনি মোটা হচ্ছেন। আরো অনেকগুলো লক্ষণ আছে। যে কোনো মহিলাই সেগুলো ধরতে পারবে।”

সারাহ ওর হাত মুঠো করে ফেললো।

“আপনি দস্যুদেরকে বললেন না কেনো?” লিডিয়া জিজ্ঞেস করলো।

“গত পনেরো বছর ধরে আমি আর টম বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করছি,” ব্যথিত কণ্ঠে বললো সারাহ। “এর মাঝে একবার মাত্র পেটে বাচ্চা এসেছিলো আমার। কিন্তু সেটাও নষ্ট হয়ে যায়। আর এখন এই অবস্থায়…” সারাহের কথা মিলিয়ে গেলো।

“দস্যুরা জানতে পারলে নিশ্চিত ওর এই দুরবস্থার ফায়দা ওঠানোর চেষ্টা করবে,” অ্যাগনেস বললো। “সেজন্যেই আমরা এটা নিয়ে কথা বলি না, আর মিসেস ফয়, আপনাকেও অনুরোধ করছি দস্যুদেরকে কিছু না জানানোর জন্যে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে,” লিডিয়া বললো। তারপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। যদিও আলোর ঘাটতি থাকার কারণে কেউ তা দেখতে পেলো না। আর আমি বলবোই বা কাকে?”

*

কয়েদখানার অনেক উপরে-দুর্গের যে অংশটা পাথরের তৈরি সেখানে-নিজের দরবারে বসে আছে দস্যু আংরিয়া। গায়ে গতরে ও বেশি তাগড়া না, কিন্তু ওর চোখের তীক্ষ্ণতা একবার যে দেখেছে সে কখনো ভুলতে পারবে না। গিট পাকানো একটা পাগড়ি মাথায় ওর, নাকের নিচে একটা জাদরেলি গোফ, সেটা প্রায় জুলফিতে গিয়ে ঠেকেছে।

ওর জন্ম আসলে নাবিক-এর ঘরে না। ওর বাবা ছিলেন একজন দেশমুখ, মানে ছোট জমিদার। ওনার দায়িত্বে ছিলো প্রায় একশোটার মতো গ্রাম। কাজের মধ্যে ছিলো কৃষকদের মধ্যকার বিবাদ মেটানো, আর চোর ডাকাতের হাত থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করা। কিন্তু আংরিয়ার এই গ্রামীণ জীবনের গবাধা জীবন ভালো লাগতো না। কৃষকেরা ওর বাবার পা চাটতো, ওর বাবা আবার তার উপরওয়ালার পা চাটতো। আর তাদের জীবনের একমাত্র ধ্যান ধারণা ছিলো পরের বছরের ফসল ঘরে তোলা। এসবে কোনো গৌরব ছিলো না। জীবনে প্রথম যেবার আংরিয়া একটা জাহাজ দেখতে পায়, তখনি ও নিজের ভবিতব্য বুঝে ফেলে। জাহাজটা ছিলো একটা পর্তুগিজ বাণিজ্য জাহাজ। সবগুলো পাল তুলে উপসাগর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো সেটা। ওটার মতো করে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো ওর। আগে থেকেই এই সমাজ সংসারের নানান রীতিনীতির বেড়াজাল ভালো লাগতো না; কারো নিষেধ নামহীন একটা জীবন ছিলো ওর স্বপ্ন। পঁচিশ বছর পর ও ঠিকই স্বপ্নটা পূরণ করেছে, তবে সেই সাথে কুখ্যাতিও কুড়িয়েছে প্রচুর।

এই দরবার ঘরটা ওর সাফল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা স্মারক ঝোলানো-ডাচ, ইংরেজ, পর্তুগীজ পতাকা, জাহাজের ঘণ্টা, বাতি, এমনকি নগ্নবক্ষা মৎস্যকুমারীর কাঠের মূর্তিও আছে। মেঝেতে পুরু কম্বল পাতা, কোথাও কোথাও তিনটা পর্যন্ত ফেলে রাখা হয়েছে। ওর লোকেরা ওটার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকে বা অবসর সময়ে পাশা খেলে, আরক পান করে আর আরব থেকে আনা হুক্কা থেকে ধূমপান করে। এখন অবশ্য সবাই চুপচাপ বসে আছে। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ আংরিয়ার সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে।

আজ বিকেলে এসে পৌঁছেছে লোকটা। যে ঘোড়াটায় চড়ে দুর্গে উঠে এসেছে সেটা একসময় দুর্দান্ত একটা বাহন ছিলো বোঝা যায়, কিন্তু টানা কয়েক সপ্তাহ দুর্গম পাহাড়ি পথ চলায় এখন খোঁড়াচ্ছে। লোকটার লম্বা কালো দাড়ি, তবে মাথার চুল পুড়ে টাক হয়ে গিয়েছে। ঘোড়া থেকে নেমে লাগামটা আস্তাবলের চাকরটার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পরে যখন ও সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তখন দেখা গেলো সে দুর্গের বাকি সবার চাইতে লম্বা। আংরিয়ার সাথে কথা বলতে চাইলে ও। প্রহরীরা বিনা বাক্যব্যয়েই ঢুকতে দিলো ওকে। কোমরে এরকম জবরদস্ত একটা তরবারি ঝোলানো থাকলে, তাকে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে পারা যায় না।

আংরিয়া একদৃষ্টিতে ক্রিস্টোফারকে জরিপ করলো কিছুক্ষণ। মুখভর্তি দাড়ি, আর গোলাপি হয়ে ফুটে থাকা চামড়ার তাজা কাটা দাগগুলোর পরেও আগন্তুককে একটা বালক বলে মনে হচ্ছে। এখনো বিশ হয়নি বয়স, কিন্তু যুদ্ধ করে পাকা হয়ে গিয়েছে। সন্দেহাতীত ভাবে একজন যোদ্ধা এ। তবে বয়স খেয়াল করার আগে আংরিয়া প্রশংসার দৃষ্টিতে ওর দৈহিক গড়ন আর শক্তিমত্তা খেয়াল করলো।

“কি নাম?” জিজ্ঞেস করলো আংরিয়া।

“রুদ্র,” জবাব দিলো আগন্তুক। রুদ্র হচ্ছে ভগবান শিব-এর একজন অবতার। শিব হচ্ছেন ধ্বংসের দেবতা। ছেলেটার তারুণ্য আর চোখের খুনে দৃষ্টি দেখে। আংরিয়া যেনো শিবঠাকুরেরই এক টুকরো প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।

“এখানে কি চাই?”

“আপনার হয়ে কাজ করতে চাই?”

“কি কাজ পারিস তুই?”

“আমি টুপিওয়ালাদের কায়দা কানুন সব শিখেছি,” ক্রিস্টোফার বললো। “আমি ওদের সাথে জাহাজ চালিয়েছি। আমি আপনার লোককে ওদের মতো করে যুদ্ধ করা শেখাতে পারবো-আরো বেশি সুশৃঙ্খল আর দক্ষতার সাথে?”

আংরিয়া মাথা নাড়লো। “তোর বয়স যতোদিন, তার চাইতে বেশিদিন ধরে আমি টুপিওয়ালাদের সাথে লড়ছি। আমার লোকদের ওদের মতো করে যুদ্ধ করতে না জানলেও চলবে। আমার এমন লোক দরকার যে নিজের মতো করে, সাহসের সাথে যুদ্ধ করবে। একটা বাঘকে কখনো কোবরার মতো ছোবল মারা শেখানো সম্ভব না।

“কালারি-তে যুদ্ধ শিখেছি আমি। আমি বাঘ বা কোবরা, দু’ভাবেই লড়াই করতে জানি।” ক্রিস্টোফার নিজের তরবারি বের করলো। “সেটা প্রমাণ করার জন্যে আমি এখানকার যে কারো সাথে লড়তে প্রস্তুত।”

কথাটা শোনামাত্র অর্ধেক লোক দাঁড়িয়ে গেলো। হতচ্ছাড়াটাকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্যে সবাই প্রস্তুত। কয়েকজন অবশ্য জায়গাতেই বসে রইলো। এরা সবাই বয়স্ক আর অভিজ্ঞ। এরা ঠিকই আগন্তুকের সামর্থ্যের আন্দাজ করতে পেরেছে, তাই আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় যাওয়ার চিন্তা করেনি।

আংরিয়া উঠে দাঁড়িয়ে চুপ করালো সবাইকে। তারপর বেদি থেকে নেমে এসে ক্রিস্টোফারের চারপাশে এমনভাবে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো যেনো গ্রামের মেলায় সদাই করতে এসেছে।

“দারুণ তরবারি তো,” বললল ও। দরবারের আলোয় নীলাটা ঝিকিয়ে উঠছে। “তোর সাহস আসলেই অনেক বেশি, নইলে এরকম একটা তরবারি হাতে এরকম সম্পূর্ণ অচেনা একদল মানুষের মাঝে আসার সাহস করতি না।”

“আপনার উপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে,” ক্রিস্টোফার বললো।

আংরিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশংসাটা গ্রহণ করলো।

“তবে যদি কেউ এটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সে সাথে সাথে তার হাতটা হারাবে।”

আবার চাপা গর্জন শোনা গেলো ঘরের ভেতর। যদিও কেউ এগিয়ে এসে চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলো না। আংরিয়া আবার ওদের চুপ করতে বললো।

“তোর পরিচয় যে সত্যি সেটা কিভাবে বুঝবো আমি? আমার শত্রুর অভাব নেই। তুইতো রাজা শাহুজি-র চর হতে পারিস। বা যে টুপিওয়ালাদের জাহাজটা লুট করেছিলাম তাদেরও পাঠানো কেউ হতে পারিস।”

ক্রিস্টোফার ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “আপনার কোন লোকটা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন?”

আবার কয়েকজন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলো, হাতে ছুরি বেরিয়ে এসেছে।

আংরিয়া হাসলো। “আসল কথা হচ্ছে, একজন চর হলে তুই এসে আমার লোকদের না ক্ষেপিয়ে তেল মারার চেষ্টা করতি। তবে এটাও হতে পারে যে, তুই ইচ্ছে করে এরকম করছিস যাতে আমি উল্টোটা ভাবি।”

আংরিয়া হাত দিয়ে ইশারা করতেই পাশের একটা দরজা খুলে গেলো। চারজন প্রহরী একজন অস্থিচর্মসার লোককে টানতে টানতে নিয়ে এলো। লোকটার মাথায় চুল নেই বললেই চলে, কিন্তু মুখ ভরা দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। গায়ে কাপড় নেই, শুধু কোমরের নিচে একটা ফালি ঝোলানো। গায়ের অসংখ্য কাটাকুটির দাগ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে কি পরিমাণ অত্যাচার সহ্য করা লাগে লোকটার। প্রহরীরা ওকে আংরিয়া আর ক্রিস্টোফারের মাঝে ছুঁড়ে দিলো।

“এই লোকটা আমার টাকা চুরি করার চেষ্টা করেছিলো,” আংরিয়া বললো। “এর শাস্তি কি হওয়া উচিত?”

বন্দী কোঁ কোঁ করে উঠলো। ক্রিস্টোফারের বিরক্ত লাগলো খুব। “যদি আপনার ভাড়ার থেকে চুরি করে তো ওর অবশ্যই মরা উচিত।” বলে ও নিজের তরবারি বের করলো। তরবারির ফলাটার নিখুঁত চেহারা আর স্বর্ণালী ধারটা দেখে ঘর জুড়ে সবাই এবার বিস্ময় ধ্বনি করে উঠলো। “আমি কি আপনার হয়ে কাজটা করে দেবো?”

“তরবারি নামা,” আংরিয়া বললো। “এতো খুবই সহজ সাজা। আমি এরকম লোকের জন্যে একটা বিশেষ জায়গা বানিয়েছি। পানির ধারে, দুর্গের পাদদেশে। আমি ওখানে একটা লোহার গলবন্ধ ওখানকার পাথরে লাগিয়ে রেখেছি। ঠিক জোয়ারের পানি যতোটা ওঠে সেই জায়গায়। তুই না বললি তুই নাবিক ছিলি?”

প্রশ্নটায় ঘাবড়ে গেলো ক্রিস্টোফার, “একবার মাত্র।”

“বসন্তকালের জোয়ার কেমন হয় জানিস তো?”

“এক মাসে দুইবার, অমাবস্যা আর পূর্ণিমার সময়। জোয়ারের সময় স্বাভাবিকের চাইতে বেশি পানি উঠে যায়, ভাটার সময় নামেও বেশি দূর।”

আংরিয়া মাথা ঝাঁকালো। “গলবন্ধটা কারো মাথা এমন জায়গায় আটকে রাখে যেখানে বসন্তকালের জোয়ার ছাড়া পানি পৌঁছায় না। যে বাধা থাকবে সে প্রতিদিন একটু একটু করে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকবে। আর ওখানকার পাথর ঝিনুক আর শামুকে ভরা। ঢেউয়ের ধাক্কায় ওগুলোর উপর ঘষা খাবে সে। ওগুলোর ধারালো কিনারে লেগে চামড়া ফালাফালা হয়ে যাবে। যখন পানি নেমে যাবে, তখন সূর্যের তাপে ওর গায়ের চামড়া কুঁচকে গিয়ে, পানি শুকিয়ে কাটা জায়গায় শুধু লবণ লেগে থাকবে। লবণ পানি ঢুকবে তার মুখে প্রচণ্ড পিপাসায় কাতর হয়ে থাকবে সে, কিন্তু একটা ফোঁটা খেতে পারবে না। খেলে পেট মোড় দিয়ে উঠবে। যদি পূর্ণিমার মাঝামাঝি একে ওখানে ঝুলিয়ে দেই, তাহলে দুই সপ্তাহের মতো লাগবে পানি এসে একে ডোবাতে। আর যখন ডুবে মরবে, তখন ওকে মরার সুযোগ দেওয়ার জন্যে উল্টো ধন্যবাদ দেবে আমাকে।”

বন্দী লোকটা করুণ সুরে ক্ষমা চাইতে শুরু করলো। একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ওর গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে থামিয়ে দিলো। আংরিয়া আর ক্রিস্টোফার একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। দস্যুর চোখের দিকে তাকিয়ে ক্রিস্টোফার শুধু একটা জিনিসই দেখতে পেলো, সেটা হচ্ছে ক্ষমতার অসীম ক্ষুধা। ও জানে না যে আংরিয়াও ওর চোখের আড়ালে একই জিনিস দেখতে পেয়েছে।

“আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই,” আংরিয়া বললো। “তুই এখানে নিজে থেকেই এসেছিস, আমি আবার তোকে এভাবেই চলে যেতে দেবো। কোনো বাধা ছাড়াই আমার দুর্গ থেকে চলে যেতে পারবি। আর যদি এখানে থেকে আমাকে খুশি করতে পারিস, তাহলে অচিরেই প্রচুর টাকা কামাতে পারবি। কিন্তু যদি আমার সাথে বেঈমানি করিস, তাহলে এমন মূল্য দিতে হবে যে হাঙ্গরেরাও তোর গা থেকে খাওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাবে না।”

ক্রিস্টোফার ইতস্তত করতে লাগলো। আংরিয়া ভাবলো ও বোধহয় ভয় পেয়েছে।

“যদি তোর মনে ভয়ের লেশমাত্র থেকে থাকে তাহলে এখানে কোনো জায়গা হবে না।”

ক্রিস্টোফারের ওসবের বালাই নেই। ঘরের ভিতরের ধন সম্পদ আর দেয়াল ঝোলানো জিনিসগুলো দেখেই ও বুঝে গিয়েছে যে এটাই ওর জায়গা। ও আংরিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। একজন চাকর এসে ওর সামনে এক বাটি দুধ আর এক থালা ভাত রাখলো। ও ভাতের সাথে দুধ মেখে চেটে পুটে খেয়ে নিয়ে আংরিয়ার শিখিয়ে দেওয়া শপথ বাক্যটা পাঠ করলো।

“আজ থেকে আমি আপনার অন্ন খাবো, আর সবসময় আপনার পায়ের কাছেই থাকবো।”

*

কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বোষেতে পৌঁছালো টমরা। বন্দরের ঢোকার সময় থেকেই টম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। জাহাজের মাস্টার মালাবার পয়েন্টের সাতটা গাছের সোজাসুজি জাহাজ চালাতে লাগলেন। এখানকার প্রবাল প্রাচীর আর চড়াগুলোড় ফাঁক দিয়ে আগানোর জন্যে এটাই সবচে নিরাপদ গতিপথ। টম এর আগে এসব শুধু মানচিত্রেই দেখেছে সাঙ্কেন রক, দ্য ওয়েস্টার, মিডল গ্রাউন্ড। ওগুলো পেরিয়ে ওরা বোম্বের পানিতে চলে এলো। ডুঙ্গারি পাহাড়ের উপরের বিশাল দুৰ্গটার নিচে গিয়ে থেমেছে উপসাগরটা।

টম ওর জামা, পায়জামা এমনকি মোজাও খুলে ছোট পায়জামা পরে নিলো, যাতে ওকে একজন নাবিকের মতো লাগে। ডাঙায় যাওয়ার সময়, বাকিদের মতো ও-ও দাঁড় বাইলো। অ্যানা আর ফ্রান্সিস পিছনের দিকে মাস্টারের সাথে বসে রইলো। টমের এখানে কেমন যেনো নিজেকে বেপর্দা মনে হতে লাগলো, এমনকি ব্রিঞ্জোয়ানের চাইতেও এখানে ওর নিজেকে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। এটা গাই-এর এলাকা। কে জানে গভর্নরের বাড়ি থেকে কেউ হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে সবদিকে।

আশপাশের ডোবা আর পচা মাছের গন্ধে টমের নাক সুড়সুড় করতে লাগলো। নৌকা পাড়ে ঠেকতেই ও দ্রুত নিজের চেহারা ঢেকে ফেললো। বিকেল বেলা, তাই পানির ধারে তেমন কেউ নেই। কুলি আর খালাসীরা ঘাটের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। জাহাজ ভেড়ার পরেও ওদের মালপত্র নামানোয় খুব বেশি আগ্রহ লক্ষ্য করা গেলো না।

ফ্রান্সিস, অ্যানা আর মাস্টার কয়েকজন কোম্পানির কর্মচারীর সাথে কথা বলতে লাগলো। গাই কোর্টনীর ভাতিজা আচমকা এখানে এসে উপস্থিত হওয়ায় ওরা যারপরনাই অবাক। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নিজেদের মধ্যে চিন্তিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি বিনিময় করতে লাগলো ওরা। সবাই ভাবছে যে এই নতুন আগমনে দুর্গের ক্ষমতার ভাগ কিভাবে কোনোদিকে হেলে পড়বে এখন। মুঘল সম্রাটেরা দিল্লিতে যেভাবে রাজ্য চালাতেন, গাই-ও এখানে ঠিক সেভাবেই নিজের সাম্রাজ্য বানিয়ে বসেছে। ওর অধস্তনেরাও তাই সবসময় ওর মেজাজ মর্জি বুঝে চলার চেষ্টা করে।

কোম্পানির লোকেরা ফ্রান্সিসকে গভর্নরের বাড়িতে নিয়ে গেলো। যখন টম নিশ্চিত হলো যে কেউ খেয়াল করছে না, তখন ও দুর্গের দেয়ালের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সরাইখানাগুলোর দিকে আগালো। ভিতরে লোকজন গিজগিজ করছে। এক কোনায় একটা টেবিল খুঁজে নিয়ে বসে পড়লো টম। কয়েক মুহূর্ত পরেই মেরিডিউ নামের এক নাবিক এসে উপস্থিত হলো ওখানে। মেরিডিউ হলো কেস্ট্রেল-এর ডুবে যাওয়া আর ব্রিঞ্জোয়ানের অবরোধ দুটোই পার করে বেঁচে যাওয়া মুষ্টিমেয়দের একজন।

“কেউ আপনার পিছু নেয়নি, হুজুর। আমি দুর্গের বাইরে মাস্টার ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করছি গিয়ে।”

টম মাথা ঝাঁকালো। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো কাজ নেই।

*

ফ্রান্সিস দুর্গের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। পিছনে সশব্দে ফটকটা বন্ধ হয়ে যেতেই নিজেকে ফাঁদে আটকা পড়া পশুর মতো মনে হতে লাগলো ওর। সামনের চত্বর, প্রহরীদের থাকার জায়গা, ভাড়ার ঘরে পেরিয়ে গভর্নরের বাড়িতে যাওয়ার সিঁড়ি বেয়ে যতোই উঠতে লাগলো, ততোই দুশ্চিন্তা আরো ঘনীভূত হতে লাগলো। গভর্নরের বাড়িটা দুর্গের দক্ষিণ পাশে। সোজা বন্দরের দিকে মুখ করা।

আগেই ওর আগমনের খবর পৌঁছে গিয়েছে। ওকে সরাসরি তাই উপরের তলার গভর্নরের অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো।

ফ্রান্সিসের সাথে ওর চাচা গাই-এর আগে কখনোই দেখা হয়নি। হাই উইন্ডের দেয়ালে অবশ্য তার একটা ছবি ঝোলানো ছিলো। কিন্তু সেটা তার বাচ্চাকালের। একটা গোলগাল বাচ্চা একটা কুকুরের বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছেলেটার সাথে এখন বিশাল জানালাগুলোর সামনে বসে থাকা লোকটার কোনো মিলই নেই। লোকটা লম্বা আর একহারা, পরনে সবুজ কোট। এতো নিখুঁতভাবে সেলাই করা যে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। বসা অবস্থাতেও তার চেহারায় গৌরব আর ধূর্ততা দুটোই ফুটে উঠছে। যেনো কোনো বিড়াল ঘুমের ভান করছে। গাই কোর্টনী দেখতে সুপুরুষ, সুঠাম দেহ, মাথা ভর্তি চুল। কিন্তু তবুও চোখের দিকে তাকালে কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছে হবে না। ফ্রান্সিস, গাই-এর চেহারায় তার যমজ ভাই টমের প্রতিচ্ছায়া খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না।

“আলোয় এসে দাঁড়াও, যাতে ভালোমতো দেখতে পারি,” গমগমে গলায় বলে উঠলো গাই। তারপর ও ফ্রান্সিসকে এমন দৃষ্টিতে জরিপ করতে লাগলো যে ফ্রান্সিসের মনে হতে লাগলো ও যেনো বিক্রির জন্যে হাটে ভোলা কোনো পশু। “হুম, তুমি আসলেই বিলির ছেলে। সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আমি তোমার বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করবো না।”

ফ্রান্সিসের কিছু বলার সাহস হলো না। বলতে চাইলেও গলা দিয়ে বের হতো কিনা সন্দেহ। ঘরের চারপাশে তাকাতে তাকাতে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে নজর গেলো ওর। ছবিটা স্যার হাল কোর্টনীর, রাজা চার্লসের আমলের পোশাক গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় পরচুলা, তার উপর পালক লাগানো টুপি। এক হাত অলসভাবে একটা দুর্দান্ত সুন্দর তরবারির হাতলের উপর রাখা। চিত্রকর অসম্ভব দক্ষ হাতে ছবিটা এঁকেছেন। হাতলের নীলাটার প্রতিটা খাঁজ পর্যন্ত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

গাই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করলো। “ছবিটা পছন্দ হয়েছে?”

“হাই উইন্ডে যখন ছিলো তখন আরো বেশি পছন্দ ছিলো,” ফ্রান্সিস বললো। কোথায় আছে ভুলে গিয়েছে যেন।

গাই একটা বাঁকা হাসি হাসলো। “চিনতে পেরেছো তাহলে। তোমার সৎ বাবার কাছে থেকে কিনেছিলাম এটা। সে তো আমাকে এটা দিতে পেরেই খুব খুশি। কারণ নগদ টাকার খুবই দরকার ছিলো তার।”

গাই হাতের পালকের কলমটা নামিয়ে রাখলো। এতোক্ষণ কিছু একটা লিখছিলো সে। “স্বীকার করছি যে আমি বিগত কয়েকমাস ধরে তোমার আসার অপেক্ষা করছি। বর্ষার আগেই আমি তোমাকে কোম্পানির কাজে নিয়োেগ দেওয়া সংক্রান্ত একটা চিঠি পেয়েছি।”

“কেপ টাউনে আটকে পড়েছিলাম আমি।”

গাই ফ্রান্সিসকে জরিপ করলো আবার। ছেলেটা লন্ডন ছাড়ার আগেই চিল্ডস গোপনে ওকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন সব। এটাও জানিয়েছেন যে টম এখনো বহাল তবিয়তে কেপ টাউনে অবস্থান করছে। আর উনি ফ্রান্সিসকে পাঠিয়েছেন টমকে মারতে। খবরটা শোনার পর থেকেই গাই-এর মেজাজ চড়ে আছে। আশা নিরাশার দোলাচালে দুলতে দুলতে বিগত কয়েক মাস পরবর্তী খবরের অপেক্ষায় বসে আছে সে।

“লর্ড চিল্ডস কেপ টাউনে তোমাকে একটা কাজ করতে দিয়েছিলেন বলে শুনেছি,” গাই বললো।

নিজের যমজ ভাইয়ের খুনের কথা কেউ এভাবে সহজভাবে করতে পারে বলে ফ্রান্সিসের ধারণা ছিলো না। দুই ভাইয়ে কি এমন হয়েছিলো সেই চিন্তাটা আবার ফিরে এলো ওর মাথায়।

“জী।”

“তা সেটা কি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে?”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকালো।

“আমি সেরকম কোনো খবর পাইনি।”

“আমরা লাশটা পাহাড়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম। শিয়াল আর হায়েনা থাকে ওখানে। ওদেরকে যে আর কেউ চিনতে পারবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পরে আমি এক কান্ট্রি ট্রেডারের জাহাজে উঠি, কিন্তু সেটা ব্রিঞ্জোয়ানের কাছে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। আমি ওখানকার কুঠিতে আশ্রয় নেই। এরপর কি কি হয়েছে তা তো আপনার জানা।”

“তা তো অবশ্যই।”

“আপনি নিশ্চয়ই জানতেন যে অ্যাগনেস আন্টি, আর তার স্বামী ক্যাপ্টেন হিকস ব্রিঞ্জোয়ানে ছিলেন।”

“ক্যাপ্টেনের হিকসের মৃত্যু আসলেই বড় একটা আঘাত,” নির্বিকার কণ্ঠে বললো গাই।

“আর-আমি জানিনা আপনি খবরটা পেয়েছেন কিনা-অ্যাগনেস আন্টিকে দস্যু আংরিয়া ধরে নিয়ে গিয়েছে।”

গাই ওর কলমের প্রান্ত দিয়ে নিজের থুতনিতে আঘাত করতে লাগলো। “হ্যাঁ, অনেক আগেই শুনেছি। কয়েক সপ্তাহ আগে আংরিয়ার কাছ থেকে মুক্তিপণের দাবিতে চিঠি পেয়েছি। অ্যাগনেসের সাথে সে ফয়ের বৌ এবং আর একজন মহিলাকেও আটকে রেখেছে। ইনি নাকি ক্যাপ্টেন হিকসের বোন।” গাই-এর ভ্রু কুঁচকে গেলো। “ক্যাপ্টেন হিকসের যে বোন আছে সেটাই জানতাম না আমি।”

“কেপ টাউন থেকে আমি যে জাহাজে আসছিলাম, উনিও সেই জাহাজেই ছিলেন,” ফ্রান্সিস বলে উঠলো তাড়াতাড়ি। গাই-এর সন্দেহ দূর করতে চাইছে। “ডরসেটে থাকতেন উনি। কিন্তু কিছুদিন আগে বিধাব হয়েছেন। তাই ভাইয়ের কাছে সাহায্য নিতে আসছিলেন।”

মিথ্যেয় কাজ হলো। গাই আগ্রহ হারিয়ে ফেললো।

“কিছু মনে না করলে, আংরিয়া মহিলা তিনজনের জন্যে কতো টাকা চেয়েছে, সেটা কি একটু বলা যাবে?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো।

“তিরিশ হাজার রুপি।”

ফ্রান্সিস হাঁ হয়ে গেলো। “তার মানে পাঁচ হাজার পাউন্ডেরও বেশি।

“প্রায় ছয় হাজার পাউন্ড,” গাই শুধরে দিলো।

গাই-এর সুস্থির দশা দেখে ফ্রান্সিস আর এক দফা অবাক হলো। “কিভাবে টাকা দেবেন? ওদের সাথে কোনো বন্দোবস্ত হয়েছে?”

“বন্দোবস্ত?” গাই এতো জোরে হেসে উঠলো যেনো বিগত কয়েক মাসে এতো মজার কিছু শোনেনি। “আমি আংরিয়াকে বলে পাঠিয়েছি যে ও আমার কাছে থেকে শুধু মাত্র সীসা পাবে, স্বর্ণ না। কামানের মুখ থেকে ছোঁড়া হবে সেটা।”

“তার মানে আপনি ওর দুর্গ আক্রমণ করতে চাচ্ছেন?”

“আরে নাহ। টিরাকোলা দুর্ভেদ্য একটা দুর্গ। আমরা যদি আক্রমণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, তাহলে সারা দুনিয়ার সামনে মাথা হেট হয়ে যাবে। বানটাম থেকে জাঞ্জিবার পর্যন্ত সবকয়টা জলদস্যু তখন আর আমাদের এক ফোঁটা ভয় পাবে না। তাতে ব্যবসার যা ক্ষতি হবে তা কোনোদিন আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।”

“তাহলে কি করবেন?”

গাই কিছু না বলে কলমটা এলোমেলো নাড়তে লাগলো। একসময় ফ্রান্সিস এর অর্থ বুঝতে পারলো। “কিন্তু এভাবে ওনাদেরকে ছেড়ে দেবেন? অ্যাগনেস হিকস আমার আন্টি-আপনার শ্যালিকা।”

গাই ওর দিকে শীতল চোখে তাকালো। “আমাকে আবেগতাড়িত করার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমার বৌ গত একমাস ধরে প্রতি রাতে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে কিছু একটা করার জন্যে। হাত পায়ে ধরতে পর্যন্ত বাদ রাখেনি। শেষে পিটিয়ে ভূত ছাড়িয়েছি। একজন মহিলার পক্ষে ব্যবসার এতো মারপ্যাঁচ বোঝা সম্ভব না, কিন্তু তুমি…” সরু চোখে ফ্রান্সিসকে দেখতে লাগলো গাই। “তুমি এখানে এসেছে আমার আশ্রয়ে থাকতে, কোম্পানির হয়ে কাজ করতে। আমি আশা করবো তুমি অন্তত পরিস্থিতির নাজুকতা বুঝতে পারবে। লর্ড চিল্ডসকে যদি লিখে পাঠাতে হয় যে, তোমার জন্যে আমার এখানে কোনো পদ খালি নেই, তাহলে সেটা আমার জন্যেও সম্মানহানীকর।”

ফ্রান্সিস উথলে ওঠা রাগটাকে সামলালো। এতে করে ওর কোনো লাভ হবে না। “দুঃখিত, চাচা। আমি আর আপনার উপরে কখনো কিছু বলবো না। আমি এদেশে আসলাম-ই তো কয়েক মাস। তাই এখনো আসলে এখানকার পরিস্থিতির কিছুই ভালোমতো জানি না।”

“আর এ কয়মাসেই যথেষ্ট ঝড় ঝাঁপটা গেলো তোমার উপর দিয়ে।” গাই নিজের চেয়ারে হেলান দিলো। চোখ অর্ধেক মুদে রেখেছে। “ব্রিঞ্জোয়ানে যে লোকটা একাই দুৰ্গটাকে বাঁচিয়ে দিলো তার সম্পর্কে বলো দেখি। আমি অনেকের কাছ থেকেই খবর পেয়েছি। কিন্তু লোকটা যে আসলে কে সেটা কেউ বলতে পারলো না।”

ফ্রান্সিস জমে গেলো। ঝড় বইতে লাগলো মাথার ভিতর। টমের পরিচয় ফাস না করে গাইকে কি কি বলা যায় সেটা ভাবছে।

“ওনার নাম হচ্ছে টম উইল্ড। কেপ টাউন থেকে যে জাহাজটায় আসছিলাম ওটার মাস্টার ছিলেন উনি। সত্যি কথা হচ্ছে, আমিও খুব বেশি কিছু জানি না ওনার সম্পর্কে। উনি কথাবার্তা খুব কম বলতেন।”

“দুর্গে এতোগুলো মাস আটকে থাকার পরেও? আমিতো ভেবেছিলাম যারা এতোদিন একসাথে একটা অবরোধ কাটিয়ে দিয়েছে, তারা তাদের একান্ত গোপনীয় সব খবরও জেনে ফেলবে।” গাই দুই হাতের আঙুল একসাথে ভাজ করে থুতনি রাখলো তার উপর। “আমি যাদের কাছ থেকে খবর নিয়েছি তারা তো বললো তোমরা নাকি খুব ঘনিষ্ট ছিলে? তুমি বাদে আর কারো উপর নাকি সে অতোটা ভরসা করতো না।”

“সবাই-ই সবার কাজ করেছে।”

“তুমি নাকি তাকে চাচা ডাকতে?”

“ভুল করেছে ওরা। আমি ক্যাপ্টেন হিকসকে চাচা ডাকতাম। যে বলেছে সে গুলিয়ে ফেলেছে।”

ফ্রান্সিস জোর করে গাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আশা করছে চেহারায় ওর মিথ্যাগুলো ধরা পড়বে না।

“তা এই মিস্টার উইল্ড কি তোমার সাথে বোম্বেতে এসেছেন?”

মিথ্যে বলে লাভ নেই। গাই নিশ্চয়ই এততক্ষণে জাহাজের লোকজনের তালিকাটা দেখেছে। “জ্বী, এসেছেন।”

“উনি কোথায় থাকবেন সেটা কি বলেছেন তোমাকে?”

“না।”

“সমস্যা নেই,” সন্তুষ্ট দেখালো গাই-কে। “বোষে ছোট একটা জায়গা। তাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। এনার সাথে দেখা করতে পারলে খুব খুশি হবো আমি। একেবারে সমুদ্র থেকে উঠে এসে কোম্পানির ব্যবসা আর সম্মান দুটোই রক্ষ করেছেন। অনেক গল্প করা যাবে ওনার সাথে।”

“ওনার সাথে দেখা হলে, আপনার কথা বলবো তাহলে,” ফ্রান্সিস চলে যাওয়ার ছুতো খুঁজতে লাগলো। “মাফ করবেন চাচা, অনেক লম্বা ভ্রমণ সেরে এসেছি। আমি শহরে থাকার জন্যে জায়গা খুঁজে নেবো।”

গাই এমন ভাব করলো যেনো কষ্ট পেয়েছে খুব। “এসব কি বলো। আমার ভাতিজা তুমি-তাছাড়া যুদ্ধজয়ী বীর। আমার সম্মানিত মেহমান হিসেবে এই বাড়িতেই থাকবে তুমি। আমি নিজে তোমার জন্যে পরে বাসা খুঁজে দেবে। আমার পরিবারের কোনো সদস্যুতো আর যেন তেন জায়গায় থাকতে পারে না

ফ্রান্সিস ওর আতংক লুকানোর চেষ্টা করলো। “অনেক ধন্যবাদ চাচা,” সংকোচের সাথে বললো ও। “কিন্তু আমি এখানে আসার আগেই একটা সরাইখানায় ঘর নিয়ে নিয়েছি। আমি ওখান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে এখুনি চলে আসছি তাহলে।”

“আমি একজনকে পাঠিয়ে তোমার জিনিসপত্র আনানোর ব্যবস্থা করছি,” গাই বললো। তারপর আবার কি ভেবে বললো, “তবে তোমার বয়স কম। আর দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় খুব বিরক্ত নিশ্চয়ই। বোম্বের পথঘাটে একটু ঘোরা ফেরা করে খোলা হাওয়া খেলে খারাপ লাগবে না তোমার।” বলে গাই ফ্রান্সিসের দিকে চোখ টিপলো। ওর ইংগিত ধরতে পেরে শিউরে উঠলো ফ্রান্সিস। “ঠিক আছে, যাও তাহলে। ছয়টায় রাতের খাবার খাই আমরা।”

“তখন আবার দেখা হবে। আসি, চাচা।”

ফ্রান্সিস বিদায় হতেই গাই বেল বাজিয়ে তার একজন কেরানিকে ডাকলো। নীল পোশাক পরা কমবয়সী এক ছেলে উপস্থিত হলো একটু পর। ছেলেটা একেবার তালপাতার সেপাই। মাথায় তেল চপচপ করছে। চেহারায় বসন্তের দাগ। নাম পিটার পিটার্স। গাই জানে যে নিজের পদোন্নতির জন্যে ছেলেটা যে কোনো কিছু করতে রাজি।

“ফ্রান্সিসের পিছু পিছু যাও, আর দেখো ও কোথায় কোথায় যায়,” গাই আদেশ দিলো ওকে। “কার কার সাথে কথা বলে সেটা দেখে এসে জানাবে আমাকে।”

পিটার্স জামার হাতার পিছন দিয়ে মুখ মুছে কুর্নিশ করলো। “অবশ্যই, স্যার।”

“বিশেষ করে ও টম উইল্ড নামের কারো সাথে কথা বলে কিনা সেটা খেয়াল করবে। যদি এই উইল্ড ব্যাটাকে খুঁজে পাও, তাহলে আর ওকে অনুসরণ করার দরকার নেই। সাথ সাথে ও কোথায় আছে সেটা আমাকে এসে জানাবে।”

পিটার যাওয়ার পর, গাই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বন্দরের জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা মাছি এসে বসলো জানালার আড়কাঠে। ব্রিঞ্জোয়ানের রহস্যময় রক্ষাকর্তার কথা শোনার পর থেকেই গাই-এর মনের ভিতর ভয়ানক একটা চিন্তা ডালপালা ছড়াচ্ছে। আর এখন লোকটা ফ্রান্সিসকে সাথে করে বোম্বেতে চলে আসায় ওর সন্দেহের গোড়ায় জল ঢালা হয়েছে। আরো।

এতো বছর পর, ওর এতো সাহস হবে এখানে আসার? গাই বেঁচে থাকতে ও কি বোম্বেতে এসে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেবে?

হ্যাঁ, বেজার মুখে ভাবলো ও। টম একাধিকবার প্রমাণ করেছে যে গাই এর জিনিস কেড়ে নিতে ওর কোনো লজ্জাবোধ নেই। আর সেজন্যে ওকে যদি দুনিয়া ফুড়ে অন্যপাশেও চলে যেতে হয়, তো ও সেটাই করবে।

আচমকা গাই প্রচন্ত ক্ষিপ্রতায় হাত চালালো। জানালার কাঁচের গায়ে মাছিটা ভর্তা হতে গেলো আঘাতে। হাত ঘুরিয়ে দেখে, সেখানে রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা।

এবার আর তুই পালাতে পারবি না।

*

ফ্রান্সিস বেরিয়ে এসে দেখে মেরিডিউ দুর্গের বাইরে ঘুরঘুর করছে। দুজন মিলে টম যে সরাইটায় বসে ছিলো সেখানে গেলো। ফ্রান্সিসের কাছে থেকে গাই এর সাথে দেখা হওয়ার সব ঘটনা শুনে টমের চেহারায় আধার ঘনিয়ে এলো।

“সারাহের জন্য ও কিছু করবে, সেটা অবশ্য আমি আশাও করিনি,” টম বললো। “কিন্তু অ্যাগনেসের জন্যেও কিছু করবে না? ওর স্বামী কোম্পানির কুঠি বাঁচাতে লড়াই করে মারা গিয়েছে!” অতীতে বহুবারের মতো আরো একবার ওর মনে হলো ও আর গাই কি আসলেই একই সাথে একই মায়ের গর্ভে ছিলো? তাহলে এতো আলাদা হলো কিভাবে ওরা?

“কিন্তু আমাদের এখানে দেরি করা সম্ভব না,” ফ্রান্সিস বললো। “গাই আপনার সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করেছে আমাকে আমার মনে হয় উনি সন্দেহ করছেন যে এই টম উইল্ড লোকটা আসলে নিজের আসল পরিচয় দিচ্ছে না।”

টম হতাশার শব্দ করলো মুখ দিয়ে। “আমার ভালো দেখে একটা ছদ্মনাম নেওয়া উচিত ছিলো। একটা বাচ্চা ছেলেও ধরে ফেলবে ফাঁকটা।”

“আপনি তো আর জানতেন না যে ভাগ্যের ফেরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়াবেন।”

“কিন্তু এটা তো জানতাম যে গাইয়ের এলাকায় প্রবেশ করছি। ও আমার খবর পাবে না এটা ভেবে নেওয়াটা গাধামি হয়েছে।”

“আমার মনে হয় উনি এখনো এ ব্যাপারে নিশ্চিত না। আমি ওনাকে বলেছি যে আমি আপনাকে কেপ টাউনে খুন করেছি, তবে আমার কথা বিশ্বাস করছেন কিনা জানিনা। উনি কিন্তু ব্রিঞ্জোয়ানের লোকজন আর যে জাহাজে করে এখানে এসেছি সেটার লোকজনের সাথে কথা বলবেন। আর তখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে দেরি হবে না।” ফ্রান্সিস ওর পানীয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। “কি করবো এখন আমরা?”

টম উত্তর দেওয়ার আগেই অ্যানা ঢুকলো ঘরে। পিছনে ঢ্যাঙা এক লোক। কুজো হয়ে হাটছে লোকটা, নাকটা টকটকে লাল হয়ে আছে। অ্যানা টেবিলের পাশে আরো দুটো টুল টেনে আনলো।

“আমি বাজারে গিয়ে কয়েকজন পরিচিত ব্যবসায়ীর সাথে কথা বললাম,” কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলো অ্যানা। “ওরাই আমাকে মিস্টার ব্যারির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।”

ঢ্যাঙা লোকটা সামান্য মাথা ঝোঁকালো। টমের ইশারা পেয়ে ফ্রান্সিস উঠে গিয়ে আরো দুটো পানীয় নিয়ে এলো।

“অনেক ধন্যবাদ, ব্যারি বললো। তারপর ঢকঢক করে গ্লাসের অর্ধেকটা গলায় ঢেলে দিলো। “এতোক্ষণে শান্তি পেলাম।”

“মিস্টার ব্যারি গভর্নর কোর্টনীর হয়ে কাজ করেন,” ব্যাখ্যা করলো– অ্যানা।

বাকিরা শক্ত হয়ে গেলো। “এনাকে বিশ্বাস করা যায়?” টম জিজ্ঞেস করলো।

ব্যারি কথাটা গায়ে মাখলো না। “গভর্নর কোর্টনীর জন্য আমার কোনো দরদ নেই। তবে তার টাকা সম্পর্কে দুয়েকটা কথা আমার জানা আছে।”

“সেটা দিয়ে আমাদের কি?” তিক্ত কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস। “আমি আমার চাচাকে দেখেছি। অ্যাগনেস আন্টি বা বাকিদের উদ্ধারের জন্যে আংরিয়াকে একটা শিলিং-ও দেবেন না উনি। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে দস্যুদের সাথে কোনো মীমাংসায় যাবেন না।”

ব্যারি ওর পানীয় থেকে মুখ তুলে চাইলো। “হাহ, থুতু ফেললো ও একদলা। “গভর্নর কোর্টনী মুখে বলেন যে দস্যুদের সাথে ওনার কোনো লেনদেন নেই। কিন্তু ওনার মুক্তিপণ না দিতে চাওয়ার আসল কারণ এটা।”

“মানে?” জানতে চাইলো ফ্রান্সিস।

ব্যারি ওর গ্লাসের ভিতরে তাকিয়ে রইলো। ওটা ততোক্ষণে খালি হয়ে গিয়েছে। টম ব্যাপারটা ধরতে পেরে নিজের পানীয়টা ওর দিকে ঠেলে দিলো। ব্যারি চোখ টিপলো।

“আমি জেটির পাশে কোম্পানির গুদামের হিসাবরক্ষক ছিলাম। ভালোই কাজ করতাম। ফলে পদোন্নতি হতে দেরি হয়নি। একবার হিসাবের খাতায় আমি কিছু গড়মিল খুঁজে পাই। কিছু জিনিসের দাম মেটানো হয়েছে কিন্তু সেগুলো এসে পৌঁছায়নি। কিছু জিনিসের পাশে ‘হারানো মাল হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমি নিজের চোখে সেগুলোকে দেখেছি। আর একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে আমি তখনি গভর্নর কোর্টনীকে বিষয়টা দেখাই।”

“নিশ্চয়ই সেজন্যে আপনাকে কোনো ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি,” ফ্রান্সিস বললো।

“আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়,” ব্যারি টেবিলের সবার দিকে তাকালো। ওদের সহানুভূতি আশা করছে। আমাকে হুমকি দেন যে তিনমাসের মাঝে আমাকে শেষ করে ছাড়বে।”

“হুম, একেবারে গাই-এর মতই,” টম বললো। “কিন্তু আংরিয়ার সাথে এর সম্পর্ক কি?”

ব্যারি আবার ওর গ্লাসটা তুলে ধরে দেখালো যে ওটা খালি হয়ে গিয়েছে। টম ওখানকার মেয়েটাকে ইশারা করলো। সে এগিয়ে এসে আর এক গ্লাস দিয়ে গেলো। ব্যারি ওটা নিতে গেলো, কিন্তু তার আগেই টম সেটা কেড়ে নিয়ে ব্যারির নাগালের বাইরে সরিয়ে নিয়ে গেলো।

“আগে গাই আর আংরিয়ার ব্যাপারটা বলুন। তারপর চাইলে এতো মদ। কিনে দেবো যে তাতে ডুবে মরতে পারবেন।”

ব্যারি ওর টুলে নড়েচড়ে বসলো। পড়ে যাচ্ছে মনে করে টম একটা হাত বাড়িয়ে দিলো, কিন্তু ব্যারি তার আগেই আবার সোজা হয়ে গেলো। চেহারায় ধূর্ত একটা ভাব ফুটে উঠেছে।

“আংরিয়া কত চাচ্ছে?” জিজ্ঞেস করলো ব্যারি।

“তিরিশ হাজার রুপি,” বললো ফ্রান্সিস।

“হাহ!” ব্যারির থুতুর সাথে সাথে টেবিল জুড়ে অ্যালকোহলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়লো। “তিরিশ হাজার রুপি গাই কোর্টনীর হাতের ময়লা। গভর্নরের বাড়ির নিচে, মানে দুর্গের মাটির নিচের প্রকোষ্ঠে ওনার একটা আলাদা ঘর আছে। ওখানে অনেকগুলো কাঠের সিন্দুক রাখা। প্রতিটাতে কমপক্ষে এক লাখ রুপি করে আছে। এক লাখ বোঝেন তো?” ও সামনে ঝুঁকে এলো। তারপর প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চারণ করে বললো, “একশো হাজার রুপি।”

“তাহলে গাই মুক্তিপণ দিচ্ছে না কেন,” হতাশ কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস। “এই কয়টা টাকা ওনার গায়েও লাগবে না।”

“ওনার হাত থেকে যদি একটা পয়সাও কোথাও পড়ে যায়, সেটার জন্যেও গাই কোর্টনী সাতদিন আফসোস করেন। তবে এখানে ব্যাপার সেটা না। ব্যাপারটা হচ্ছে উনি দস্যুদের বিরুদ্ধে কিছু করেন না, কারণ ওনার যে পরিকল্পনা তাতে আংরিয়া থাকলেই লাভ। এতে করে সাগর পথে ত্রাসের সৃষ্টি

“এটা কোনো কথা হলো। দস্যুরা তো ওদের ব্যবসার জন্যেও হুমকি,” ফ্রান্সিস প্রতিবাদ করলো।

“ইন্ডিয়াম্যানগুলো হচ্ছে সাগরের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বেশি অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত জাহাজ। আংরিয়া ওগুলোকে ঘাটায় না। তার বদলে ও ইন্টারলোপার বা কান্ট্রি ট্রেডারদের লুট করে।”

“এভাবে গাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী কমে যায়, আর মালপত্রের দামও যায় বেড়ে?” টম শিষ দিয়ে উঠলো। যদিও ও জানে যে ওর অবাক হওয়া উচিত না। জাহাজ নিয়ে প্রথম যেদিন সমুদ্রে নেমেছিলো, সেদিন থেকেই ও জানে যে ভারত মহাসাগর হচ্ছে পৃথিবীর সবচে দুর্ধর্ষ দস্যুদের বিচরণক্ষেত্র। কয়েক বছর আগেই, হেনরি এভারি নামের এক ইংরেজ, মুঘলদের একটা জাহাজ উদ্ধার করে। জাহাজটা মক্কায় যাচ্ছিলো হজ্ব করতে। প্রচুর সম্পদ ছিলো ওটায়। দস্যুরা তিনদিন ধরে লুট করে জাহাজটা। লুটের মাল আর কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, গাই নিজেও ঐ দস্যুগুলোর চাইতে কোনো অংশেই কম নির্মম না।

ব্যারি টেবিলে আঙুল দিয়ে তবলা বাজাতে বাজাতে বললো, “এ-তো ঘটনার অর্ধেক। শাহুজি-র কথা শুনেছেন?”

টমার ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো।

“শাহুজি হচ্ছে সাতারা-র রাজা। মারাঠাদের রাজা আরকি,” অ্যানা বললো। “বিগত তিরিশ বছর ধরে ওরা মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীন হবার জন্যে যুদ্ধ করছে। নিজেদের আলাদা সাম্রাজ্য গড়তে চায় ওরা।”

“কিন্তু তাতে গাই চাচার কি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“মালাবার উপকূলের বেশিরভাগ বন্দর শাহুজির নিয়ন্ত্রণে,” ব্যারি বলল। “আর বন্দর থেকে যে রাস্তাগুলো বেরিয়েছে সেগুলোও ওনার দখলে বলে কোর্টনী ওনার সাথে একটা মধ্যস্ততায় আসতে চান। মানে ওনার মালামালের জন্যে নিরাপত্তা আর বন্দরে যে রাজস্ব দেওয়া লাগে সেটা একটু যাতে রাখেন সে ব্যাপারে একটা চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। আর শাহুজির জন্য হচ্ছে আংরিয়া। গাই ভেবেছিলেন যে শাহুজির সাথে করা চুক্তির খাতিরে আংরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, কিন্তু যেহেতু কোনো চুক্তি হয়নি, আংরিয়ার দস্যুতার কারণে শাহুজি আরো দুর্বল হচ্ছেন আর গাইয়ের শক্তি বাড়ছে।”

টম এই এলাকার গোলকধাঁধাতুল্য রাজনীতির কিছুটা অবস্থা টের গেলেন সন্দেহ নেই গাই একজন সুদক্ষ খেলোয়াড়। সারা উপমহাদেশ জুড়ে ওরা বিস্তৃত করে রেখেছে। এখন সুতোর টানে একজনের বিরুদ্ধে আর একজন খেলিয়ে খেলিয়ে নিজের আখের গোছাচ্ছে। কিন্তু টমের কাছে এসব ব্যাখ্যা কোনো গুরুত্ব নেই।

“এসব ফরমান, রাজা, মুঘলদের ব্যাপার স্যাপারে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই,” ও বললো। “আমাদের মাথা ব্যথা শুধু সারাহ আর অ্যাগনেসকে কিভাবে উদ্ধার করা যায় সেটা নিয়ে।”

“কিন্তু কিভাবে?” ব্যারি বললো। “আপনারা তো মাদ্রাজ থেকে এসেছেন। দুৰ্গটা দেখেছেন না? ওটা একেবারে দুর্ভেদ্য।”

“আমি ওটাকে দখল করতে চাই না। আংরিয়া ব্যবসায়ী লোক। তিরিশ হাজার রুপি মুক্তিপণ দিয়েই ওদেরকে ছাড়িয়ে আনবো।”

ফ্রান্সিস হতাশায় টেবিলের উপর ঘুষি বসালো একটা। ওটার উপরের থালাবাটিও সব ঝনঝনিয়ে উঠলো। “কিন্তু আমাদেরতো অতো টাকা নেই। এতো কথা বলেও আমরা ঘুরে ফিরে সেই বটের তলাতেই ফিরে এলাম।

টম দাঁত বের করে হাসলো। রক্তের মধ্যে পরিচিত এক শয়তান হাতছানি শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু আমরা এখন জানি গাই কোথায় টাকা রাখে।

বাকিরা ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “মানে আপনি ওনার সিন্দুক ড করতে চাচ্ছেন?” ধীরে ধীরে বললো অ্যানা।

“আংরিয়ার দুর্গে ঢোকার চাইতে গাই-এর সিন্দুক ঘরে ঢোকা কিন্তু হবে না,” ব্যারি সতর্ক করলো। “ওখানের চাবি মাত্র একটা। আর সেটাকে নিজের অফিসে লুকিয়ে রাখে।”

“কিন্তু আমরা আংরিয়ার দুর্গটা না চিনলেও গাই-এর দুর্গে ঢুকতে পারবে একজন আমাদের সাথে আছে,” টম ফ্রান্সিসের দিকে ফিরলো। “বাকি লোকজন যারা আছে তাদের সবাইকে ঘাটের কাছে জড়ো করো। গাইকে এবার নিজের পরিবারকে সহায়তা করার শিক্ষা দিতে হবে।”

ওর আত্মবিশ্বাস সবার মাঝেই সঞ্চারিত হলো। খুশি মনে সরাই থেকে বেরিয়ে গেলো সবাই। করার মতো একটা কাজ পেয়েছে অনেকদিন পর। ফ্রান্সিস আর মেরিডীউ বাকিদের খুঁজতে চলে গেলো। কেস্ট্রেল-এর বেঁচে যাওয়া আরও চারজন লোক ওদের সাথে বোম্বে এসেছে। ব্যারি, অ্যানা আর টমকে অস্ত্রপাতি আর অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র জোগাড় করে দিতে পারবে এমন একজনের কাছে নিয়ে গেলো। ভালোয় ভালোয় হয়তো ওরা সিন্দুক ঘরে ঢুকতে পারবে কিন্তু কোনো ঝামেলা ছাড়াই বেরিয়ে আসতে পেরবে তেমনটা মনে করে না টম।

এতো খুশির মাঝে কেউ খেয়ালই করলো না যে মুখে বসন্তের দাগওয়ালা একটা ছেলে সরাইখানার এক কোনায় অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে। সে ওদেরকে বেরিয়ে যেতে দেখলো। তারপর নিজেও ত্রস্ত গতিতে বেরিয়ে গেলো।

*

ছয়টা বাজার কিছু আগে ফ্রান্সিস ধীর পায়ে দুর্গে এসে ঢুকলো। রাত নামতে শুরু করেছে। ফটকের প্রহরীরা খটাশ করে স্যলুট ঠুকলো ওকে। ওদের চোখে ভয় দেখতে পেলো ফ্রান্সিস। এর মাঝেই সবাই জেনে গিয়েছে যে ও গাই-এর ভাতিজা।

ও আগাতেই পিছনে ফটক বন্ধ হয়ে গেলো। চত্বরের অর্ধেকটা পেরিয়ে, ফ্রান্সিস আচমকা দিক বদলে পাশের একটা ছোট ভাড়ার ঘরে ঢুকে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পরে সেখান থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে আবার ফটকের দিকে এগিয়ে গেলো।

“ভুলে পানশালায় আমার টাকার ব্যাগটা ফেলে এসেছি,” হড়বড় করে বললো ও। বিব্রত হওয়ার ভান করছে। “গাই চাচা জানতে পারলে খুব রাগ করবেন।”

সিপাহীরা আবার দরজা খুলে দিলো। ওটা পুরোপুরি খুলতেই ফ্রান্সিস অর্ধেক ঘুরে কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিলো।

“আরে আরে একি,” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

চমকে উঠে ফিরে তাকালো সিপাহীরা। ভাড়ার ঘরটা থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করেছে। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে আগুনের লকলকে জিভ।

“আগুন!” চেঁচিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস। বাকিরাও এবার খেয়াল করলো সেটা। এর মধ্যেই চতুরের ওদিক থেকে আতংকিত চিৎকার ভেসে আসতে শুরু করেছে। পানির বালতি আনতে ছোটাছুটি শুরু করেছে লোকজন।

এই হৈ হট্টগোলের মাঝে খোলা ফটক দিয়ে চুপিসারে ঢুকে পড়া লোক তিনজনের দিকে খেয়াল করলো না কেউ। টম, ব্যারি আর মেরিডিউ ফ্রান্সিসের পিছু পিছু গভর্নরের বাড়ির ভিতরে চলে এলো। কেউ আটকালো না ওদের। বারান্দা থেকেই ফ্রান্সিস খেয়াল করলো চাকরেরা আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় খাবার ঘরের রূপার বাসনপত্রসহ দামী সব জিনিসপত্র সরানোর কাজে ব্যস্ত।

ফ্রান্সিস পথ দেখিয়ে বিশাল সিঁড়িটা ধরে তিনতলায় নিয়ে এলো সবাইকে। তারপর স্বল্প আলোকিত বারান্দা ধরে গাই-এর অফিসে এসে উপস্থিত হলো। ফ্রান্সিস ভেবেছিলো যে ভবনের সবাই আগুন দেখতে চলে যাবে। কিন্তু ওকে হতাশ হতে হলো। একজন সিপাহী মাস্কেট কাঁধে অফিসের দরজায় পাহারা দিচ্ছে।

“হচ্ছেটা কি?” প্রহরী জানতে চাইলোর ও বাইরে থেকে চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছে কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ে কি হয়েছে দেখতে যাওয়ার সাহস হয়নি।

‘আগুন,” সংক্ষেপে বললো ফ্রান্সিস। “গভর্নর কোর্টনী আমাকে পাঠিয়েছেন তার অফিসের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা দেখতে।” বলে নিজের চেহারা দেখাতে আলোয় এসে দাঁড়ালো ও। “আমি ওনার ভাতিজা ফ্রান্সিস কোর্টনী।”

ওদের পারিবারিক নামটা আবারও জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করলো। প্রহরী একদিকে সরে যেতে গিয়েও থেমে গেলো আবার।

“এনারা কারা?” টম আর মেরিডিউ-এর দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলো লোকটা। “আমিতো এদেরকে চিনলাম না।”

“টম উইল্ড। ব্রিঞ্জোয়ান বিজয়ের নায়ক।”

প্রহরী নড়লো না। “গভর্নর কোর্টনীতে আমাকে ওনার কথা কিছু বলেননি।” ও ব্যারির দিকে এক ঝলক তাকালো। নিজেকে অন্যদের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করছে সে। তারপর মাস্কেটের নল ফ্রান্সিসের দিকে সোজা করে বললো। “আমি আপনাকে ঢুকতে দিতে পারবো না।”

ফ্রান্সিস নড়লো না। আমার কাছে চাচার পাঠানো চিরকুট আছে। এটা দেখলেই সব বুঝবেন।” বলে ও নিজের কোট খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো। প্রহরী দেখার জন্যে ঝুঁকে এলো সামনে।

কোটের আড়ালে ফ্রান্সিসের হাত ঢাকা ছিলো, তাই ঘুষিটা দেখতে পেলো না প্রহরী। চোয়ালে ঘুষিটা লাগতেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলো সে। আবার উঠে দাঁড়ানোর আগেই টম এগিয়ে এসে আর একটা প্রচণ্ড আঘাতে ওকে মেঝেতে শুইয়ে দিলো।

“ভালো বুদ্ধি দেখিয়েছো,” টম অজ্ঞান প্রহরীটাকে পেরিয়ে এসে দরজার উপর হাত রাখলো। নিচে চাকরদের ইতস্তত ছোটাছুটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গাই-এর দামি জিনিসপত্র সরানোতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মাঝে সত্যি সত্যি কারো অফিসটা দেখে যাওয়ার কথা খেয়াল হবে।

কিন্তু তবুও টম ইতস্তত করতে লাগলো। যদি গাই এখনো অফিসে থেকে থাকে? হয়তো মরিয়া হয়ে ওর দরকারি কাগজপত্র গোছাচ্ছে। ওরা মুখোমুখি হয়ে গেলে ও কি করবে?

একটা পুরনো স্মৃতি ওর মনে দোলা দিয়ে গেলো। গত যে দুই বার তোমাদের দেখা হয়েছে, ও তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। তৃতীয়বার দেখা হলে নিশ্চিত থাকতে পারো যে তোমাদের কেউ একজন মারা পড়বে।

ও হাতলটা চেপে ধরে দরজায় ঠেলা দিলো।

ঘরটা খালি। টম এতো খুশি হলো যে বলার না, কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় নেই।

“গাই ওর সিন্দুকের ঘরের চাবি এখানেই কোথাও রাখে। তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করতে হবে সেটা।”

ওরা বিশাল ঘরটার একেক দিকে ছড়িয়ে পড়লো। টম গাই-এর ডেস্কের দিকে আগাতে গিয়ে থেমে গেলো। দেয়ালে স্যার হাল কোর্টনীর ছবি দেখে যেনো সম্মোহিত হয়ে গিয়েছে।

“বাবা,” বিড়বিড় করলো ও। হাল প্রায় বিশ বছর আগে মারা গিয়েছেন। কিন্তু এখানে এভাবে আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে দেখে টমের মাঝে আবারও হারানোর বেদনাটা ফিরে এলো। “এটা তো ছিলো…”

“হাই উইন্ডে, ফ্রান্সিস বললো।

টম ছবিটার নেপচুন তরবারিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আঁকা ছবি থেকেও নীলাটার দ্যুতি বের হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। হতাশা দলা পাকিয়ে উঠলো ওর ভিতর। ওর উত্তরাধিকার ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সারাহকে উদ্ধার করেই ও আবার ব্রিঞ্জোয়ানে ফিরে যাবে। তারপর যে তরবারিটা চুরি করেছে তাকে খুঁজে বের করবে।

কিন্তু সেসব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে। চিন্তাটাকে সরিয়ে রাখলো ও ফ্রান্সিস ততোক্ষণে গাই-এর ডেস্ক খুঁজে দেখা শুরু করেছে। নিজের ছুরিটা দিয়ে চাড় দিয়ে ডেস্কের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখছে। ভিতরের কাগজপত্র ছিটিয়ে পড়ছে মেঝেতে। “চাবিটা এখানেই কোথাও আছে।”

ব্যারি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। “আর বেশি সময় নাই। আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে ওরা।”

টম শুনতে পেলো কথাটা। ও জানে দ্রুত করতে হবে সব। কিন্তু ছবিটা যেনো সম্মোহিত করে রেখেছে ওকে। গাই-এর অফিসে তরবারি সমেত ওর বাবার ছবিটা এতো এতো স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে ওর মাথা ঘুরতে শুরু করলো।

কিন্তু দেরি করার সুযোগ নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ও ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। তাতেই একটা জিনিস চোখে পড়লো। ও ছবিটার দিকে এগিয়ে সোনার পাত বসানো ফ্রেমটার চারপাশে হাত বুলাতে লাগলো। একটু পরেই কাঠের উপরে দুটো শক্ত স্ফীতি হাতে বাধলো ওর।

“কবজা,” অবাক হলো টম। ও ছবির পিছনে নিজের ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলো। দেয়াল বরাবর খানিকটা উঠতেই, কিছু একটায় আটকে গেলো ছুরির ফলাটা।

“এখানে নিশ্চিত কোনো ধরনের তালা আছে।” টম ছুরিটা ঝাঁকি দিয়ে, মুচড়িয়ে ফলাটা ছোটানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

কট করে শব্দ করে খুলে গেলে কিছু একটা। ছুরির ফলাটা ঝনাৎ করে মেঝেতে গিয়ে পড়লো সাথে সাথে। ওর পা থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে।

ফ্রান্সিস ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো। “খোলে না?” জিজ্ঞেস করলো ও।

টম ওকে ওর ছুরির ভাঙ্গা ফলাটা দেখালো। “তালাটা খুবই শক্ত।”

ফাঁকটায় নিজের আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করলো ফ্রান্সিস। কিন্তু ঢুকলো না। একটু পিছিয়ে আবার ফ্রেমটা পরীক্ষা করে দেখলো ও।

“পেন-নাইফ বা লেটার ওপেনারের মতো কিছু পেয়েছো?” মেরিডিউকে জিজ্ঞেস করলো টম।

কিন্তু জবাব পাওয়ার আগেই ফ্রান্সিস সামনে এগিয়ে, ফ্রেমের স্বর্ণের বাধাইয়ের একটা অংশ জোরে চেপে ধরে অর্ধ বৃত্তাকারে মোচড় দিলো। শোনা যায় না এমন একটা শব্দ করে ফ্রেমটা নিচের দিকে খুলে গেলো।

টম প্রশংসার চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। “সাবাস।”

ওরা সবাই জড়ো হলো ওখানে। ছবিটার পেছনে দেওয়ালে একটা খুপরি দেখা যাচ্ছে। হিসাবের খাতাপত্র আর কাগজে ঠাসা। টম ওগুলো বের করে ‘ ব্যারি আর ফ্রান্সিসের হাতে দিলো।

ব্যারি একটা খাতার পাতা উল্টালো। “এগুল সব গাই-এর গোপন আয়ের হিসাবপত্র,” অবাক হয়ে বললো ও। “লেডেনহল স্ট্রিটের চোখ এড়িয়ে শুধু নিজের লাভের জন্যে যেসব লেনদেন করেছেন তার সবই আছে এখানে।”

“আরে রাখো ওগুলো,” উত্তেজিত স্বরে বললো টম। “যা খুঁজছি সেটা সম্ভবত পেয়ে গিয়েছি।” একটা পিতলের চাবি তুলে ধরলো ও। অনেকগুলো দাঁত ওটায়, নিশ্চিত কোনো জটিল তালার চাৰি। “এখন গোপন ঘরটা খুঁজে বের করতে হবে।”

“আমি পারবো সেটা,” ব্যারি বললো। “শুধু একবার প্রহরীগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে পার হতে পারলেই হবে।”

বাইরের লোকজনের আওয়াজ শুনেই টম বুঝলো আগুন নিভে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রহরীরা যার যার জায়গায় ফিরে যাবে। টম কোমরে হাত দিয়ে পিস্তলটা স্পর্শ করলো। আশা করছে এটা ব্যবহার করতে হবে না।

“আমাদেরকে হয়তো-”।

কথা শেষ করার আগেই অফিসের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেলো। বোম্বে আর্মির লাল কোট আর সবুজ বেল্ট পরা প্রায় এক ডজন সৈন্য প্রবেশ করলো ঘরের ভেতর। কেউ কিছু করার আগেই সৈন্যরা দরজার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে হাতের মাস্কেট টম আর ওর সঙ্গীদের দিকে তাক করে ধরলো।

“এক চুল নড়বে না কেউ,” দলের সার্জেন্ট আদেশ করলো। “গভর্নর কোর্টনী আসার আগ পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।”

চারজনের কেউই জায়গা থেকে নড়লো না। সিপাহীদের দিকে তাকিয়ে টম বুঝলো যে এরা আগুন নেভাতে যায়নি। পোশাক বা ঝকঝকে সাদা বুকের বেল্ট-এ কোমো কালি ঝুলি লেগে নেই বা চেহারায় তাড়াহুড়া করে আসার চিহ্ন নেই, এমনকি ওদেরকে দেখে অবাকও হয়নি। যেনো ওরা ওদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলো।

টমের মেরুদণ্ড বেয়ে হতাশা ছড়িয়ে পড়লো। ব্যারির দিকে তাকালো ও।

“আপনি কি আমাদের সাথে বেঈমানি করেছেন?”

কিন্তু ব্যারির ভীতসন্ত্রস্ত চেহারাটা দেখেই বুঝলো যে কথাটা সত্যি না। ব্যারিও বাকিদের মতোই প্রচণ্ড অবাক হয়েছে। বরং ওকে দেখেই মনে হচ্ছে। সবচে বেশি ভয় পাচ্ছে।

এখন অবশ্য এসব কোনো ব্যাপার না। গাই যেভাবেই খবর পাক না। কেনো, ওরা ওর ফাঁদে আটকে গিয়েছে। আর গাই আসছে।

টম পিছিয়ে যেতে শুরু করলো। কোমরের পিছনে হাতটা নিতেই পায়জামার ফাঁকে গুঁজে রাখা পিস্তলটার স্পর্শ পেলো।

“নড়বে না,” ধমকে উঠলো সার্জেন্ট। তার প্রর উপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। গাই আসার আগে একান্ত বাধ্য না হলে ও গুলি করার সাহস করবে না। টম আরো এক পা পিছিয়ে গেলো।

বাকিরাও ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পিছিয়ে গেলো এক পা। সার্জেন্ট অগ্নি দৃষ্টিতে ওদের সবার দিকে তাকাতে লাগলো। “আর এক ইঞ্চিও যদি পিছন তাহলে কিন্তু আমি গুলি করার আদেশ দেবো। গভর্নর কোর্টনীর কথা মানার দরকার মনে করবো না।”

টম সার্জেন্টের চোখে চোখে চেয়ে রইলো। তারপর আরও এক পা পিছিয়ে গেলো। গাই-এর ডেস্কের পেছনে চলে এসেছে ও। একদম পিছনের জানালার সামনে। সার্জেন্ট ব্যাপারটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো, কারণ পিছনে আর যাওয়ার জায়গা নেই।

“গভর্নর কোর্টনী আপনাদের মতো লোকের জন্যে কয়েদখানায় আলাদা একটা ঘর বানিয়েছেন,” টমকে বললো সার্জেন্ট। “আর ওখানে একবার গেলে এমন অবস্থা হবে যে গভর্নর গাই আদেশ দিলে নিজের গু-ও চেটে পরিষ্কার করবেন।”

দরজার বাইরে সিঁড়িতে একটা ভারী পদশব্দ পাওয়া গেলো। সিপাহীরা সোজা হয়ে হাতের মাস্কেট আরো সোজা করে তাক করে ধরলো।

“ওরা আর এক মুহূর্ত পরেই গুলি করবে,” টম ওর সঙ্গীদের বললো। “প্রস্তুত হও।”

“শয়তানের চেহারা আজ দেখবেন,” খেঁকিয়ে উঠলো সার্জেন্ট। “এতো আরামের মৃত্যু আপনাদের কপালে নেই।”

পদশব্দ সিঁড়ির উপরে এসে পৌঁছালো।

টম বাকিদের দিকে তাকালো। ও যা করতে যাচ্ছে তা পাগলামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু এটাই ওদের একমাত্র আশা। যদি গাই-এর হাতে ধরা পড়ে, তাহলে গাই সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়ানো ঘৃণার শোধ তুলবে। বিশেষ করে টমের উপরে। আর সবচে খারাপ হলো, সারাহ আর অ্যাগনেসকে উদ্ধারের আর কোনো আশা-ই থাকবে না। তবে যদি গাই টের পায় ওরা আসলে কারা, তাহলে হয়তো মুক্তিপণ দিয়ে ওদেরকে ছাড়িয়ে আনবে, তবে সেটা সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র টমের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়ানোর জন্যে।

গাইকে খুন করবো না আমি, টম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো। বিলির সাথে যে ভুল করেছি সেটা এবার করবো না।

দরজার কাছে চলে এলো পদশব্দ। একজন ওজনদার লোকের টানা পদক্ষেপ। বোঝাই যাচ্ছে যে কোনো তাড়াহুড়া নেই। নিজের বিজয় তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে ও, মনে মনে ভাবলো টম। ও কোমর থেকে পিস্তলটা ছুটিয়ে আনলো, চেষ্টা করছে সেটা যাতে কারো চোখে না পড়ে। একটা মাত্র গুলি করার সুযোগ পাবে সে।

“ওরা সবাই-ই আছে এখানে?” বারান্দা ধরে গাই-এর গমগমে গলাটা শোনা গেলো। “অনেকদিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষে করছি আমি।”

গাই-এর গলা শুনে টমের সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। শেষবার যখন গলাটা শুনেছিলো, তখন ও সারাহকে নিয়ে একটা ছোট ফেলুক্কা নৌকার করে জাঞ্জিবার থেকে পালাচ্ছিলো। গাই-এর প্রায় একশো লোক ওদের দিকে গুলিবর্ষণ করছিলো তখন। গাই-এর শেষ কথাগুলো এখনো ওর মাথায় গেঁথে আছে।

একদিন না একদিন সুদে আসলে সব মেটাতে হবে দেখিস। সব আদায় করে ছাড়বো আমি। কসম।

“আমি দুঃখিত,” টম বললো। বলেই কেউ কিছু বোঝার আগে ও পিস্তল তুলে সার্জেন্টের হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি করলো।

এর প্রতিক্রিয়াও হলো সাথে সাথেই। সিপাহীরা এমনিতেই টানটান অবস্থায় ছিলো। গুলির শব্দ কানে যাওয়া মাত্র চিন্তা ভাবনা ছাড়াই সবগুলো মাস্কেট গর্জে উঠলো একসাথে।

টম এরকমটাই আশা করেছিলো। গুলি করতে করতেই তাই ডেস্কের পেছনে বসে পড়লো ও। সাথে সাথেই মাথার উপর দিয়ে মাস্কেটের গুলিগুলো উড়ে গেলো। কান ফাটানো গুলির শব্দের সাথে যোগ হলো কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ। উপসাগরের দিকে মুখ করে থাকা সবগুলো জানালার কাঁচ ভেঙে চুরচুর হয়ে গিয়েছে।

ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেলো। টম চিৎকার করে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে ডাকলো। কিন্তু গুলির শব্দে কানে তালা লেগে থাকায় নিজের আওয়াজ নিজের কানেই পৌঁছালো না ওর। ধোয়া ভেদ করে একটা অবয়ব এগিয়ে এলো–ফ্রান্সিস–চেহারায় একটা কাঁচ ছিটকে লেগে কেটে রক্ত বের হচ্ছে, এর বেশি কিছু হয়নি। মেরিডিউকেও দেখা গেলো পেছনে।

টম জানালার দিকে দেখালো। তারপর ওটার দিকে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিলো নিচে। জানালা দিয়ে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে শরীরকে ঘুরিয়ে নিলো যাতে পিঠ থাকে বাইরের দিকে। ভেঙে থাকা কাঁচের টুকরোয় টান লেগে ওর জামা ছিঁড়ে গেলো। তবে সেটা মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যেই। জড়তার কারণে সহজেই জানালা পেরিয়ে বাইরের বাতাসে গিয়ে পড়লো টম।

সেদিন সকালে যখন ওদের জাহাজটা বন্দরে ভিড়ছিলো, তখনই টম দুর্গের চারপাশটা খুব ভালো করে খুটিয়ে দেখে নিয়েছিলো। সেই পর্যবেক্ষণ কাজে দিয়েছে। ও তখনই বন্দরের দিকে মুখ করে থাকা জানালাগুলো খেয়াল করেছিলো। আর ধরেই নিয়েছিলো যে গাইয়ের অফিসটাও নিশ্চয়ই এমন কোথাও হবে যেখান থেকে ও বন্দরের জাহাজের দিকে চোখ রাখতে পারবে। জানালা আর বন্দরের মাঝে আছে দুর্গের দেয়াল। গাইয়ের দৃষ্টি যাতে বাধা না পড়ে তাই দেয়ালটা উচ্চতায় তিনতলার চাইতে ছোট। আর সেটা এই জানালাগুলোর কড়িকাঠের ঠিক নিচেই এসে শেষ হয়েছে।

দেয়ালের উপর গিয়ে পড়তেই একরাশ ভাঙা কাঁচের টুকরো ঝরে পড়লো টমের উপর। ও উঠে দাঁড়াতে গেলো, কিন্তু সাথে সাথেই ফ্রান্সিস উপর থেকে ওর গায়ে এসে পড়ায় আবার পড়ে গেলো। মেরিডিউ পড়লো ওদের পাশে।

“ব্যারি?” টম ঠোঁট নেড়ে জিজ্ঞেস করলো। ফ্রান্সিস গলা বরাবর বুড়ো আঙুল দিয়ে টান দিলো। ব্যারি মাথা নামাতে এক মুহূর্ত দেরি করে ফেলেছিলো। ফলে চড়া মূল্যই দিতে হয়েছে।

টম উপরে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে ধোয়া কেটে গিয়েছে; সেখান থেকে প্রথমে চিৎকার শুনতে পেলো। তারপর গুলির আওয়াজ। আদেশ দেওয়ার জন্যে সার্জেন্ট না থাকায় সিপাহীরা সম্ভবত এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছে, আধারে নিজেদেরকেই মারছে কিনা কে জানে। তবে বেশিক্ষণ এই দশা থাকবে না। টম দেয়ালের গায়ে একটা সিঁড়ি বা মইয়ের আশায় এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো।

ওরা ফাঁদে আটকে পড়েছে। নিজের গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে, জানালার নিচ থেকে কোনো প্রহরী ওর কথা শুনে ফেলার ভয়ে গাই দুই দিকের দেয়ালেই কোনো ফাঁক রাখেনি। এখান থেকে নামার কোনো রাস্তা নেই।

উপর থেকে গাই-এর গলা ভেসে এলো। আদেশ করছে কিছু একটা। সিপাহীরা জানালার ধারে এসে নিচে তাকালেই দেখতে পাবে টম আর ওর সঙ্গীরা একটা ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতোই অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“পানিতে ঝাঁপ দাও,” আদেশ দিলো টম। “আর কোনো উপায় নেই।”

টম দেয়ালের কামান বসানোর ছিদ্র পথে নেমে পড়লো। নিচেই দুর্গ আর সাগরের মিলনস্থলে সাদা ফেনায়িত ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথরে। ও জানে না পানির নিচে কি আছে। কতো দ্রুত-ইবা ওরা নিচে পড়বে?

“থামো বলছি,” জানালা থেকে চিৎকার করে বললো কেউ। টম তাকিয়েও দেখলো না। জানে লোকটা কে। ও গুঁড়ি মেরে গর্তটায় বসে দু পাশের দেয়াল আঁকড়ে ধরলো, তারপর পুরো শরীর টানটান করে দিলো লাফ। দেয়াল থেকে যতো দূরে সম্ভব সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

যেনো অনন্তকাল পর নিচে পড়লো ও। পানিতে পড়া মাত্র লাথি মেরে আর হাত ছুঁড়ে উপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনো ডুবো পাথরে লেগে হাত পা ভেঙে যায় কিনা সেই ভয় করছে। অক্ষত অবস্থাতেই পানির উপরে ভেসে উঠলো ও। মাথা তুলতেই ফ্রান্সিস এসে পড়লো পাশে।

মেরিডিউ এলে এরপর। ভাগ্যক্রমে ও খুব দক্ষ সাঁতারু। তারপর তিনজনই দ্রুত পা ছুঁড়ে সাগরের গভীরের দিকে এগিয়ে গেলো। খুব দ্রুত নেমে এসেছে রাত, এখনই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ফলে উপরের প্রহরীরা ওদেরকে আর দেখতে পেলো না। থেকে থেকে মাস্কেটের গুলির শব্দ শোনা যেতে লাগলো, কিন্তুওদের ধারে কাছেও এলো না কোনোটাই।

টম সামনে কোথাও নৌকায় বাধা দাড়ের ক্যাচকোচ শব্দ শুনতে পেলো। যতোটা সম্ভব পানি থেকে মাথা তুলে স্প্যানিশ লেডিস’ গানটার সুরে শিষ বাজালো ও।

অন্ধকার ফুড়ে আনার গলা শোনা গেলো। “কি হয়েছে? আহত হয়েছেন নাকি?”

ওর কণ্ঠ টমের কানে মধু বর্ষণ করলো। পরিকল্পনা মোতাবেক, অ্যানা আর কেস্ট্রেল-এর বেঁচে যাওয়া বাকিদের একটা নৌকা নিয়ে বন্দরে অপেক্ষা করার কথা ছিলো। টমরা সিন্দুকের ঘর থেকে স্বর্ণ চুরি করে সংকেত দিলেই নৌকা নিয়ে ওরা দুর্গের দেয়ালের সমুদ্রমুখী দরজাটায় চলে আসতো। তারপর পালিয়ে যেতো। কিন্তু গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে অ্যানা নৌকা এগিয়ে নিয়ে। এসেছে।

অ্যানা নৌকাটা ওদের দিকে আরো খানিকটা এগিয়ে নিয়ে এলো। আগে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে উঠে যেতে দিলো টম, তারপর নিজেকে টেনে তুললো। “গাই জানতো যে আমরা আসবো।”

“ব্যারি কি বেঈমানি করেছে নাকি?” অ্যানা জিজ্ঞেস করলো।

“যদি করেও থাকে তাহলে জীবন দিয়ে তার দাম চুকিয়েছে।” টম মাথা ঝাঁকিয়ে কানে ঢোকা পানি বের করে দিলো। “তবে আমার সেরকম মনে হয় না। আসলে আমাদের এটা ভাবাই গাধামি হয়েছে যে আমরা বোম্বেতে এসে গাই-এর নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াবো আর ও কিছুই টের পাবে না।”

টম ফিরে তাকালো। দুর্গের কারণে জেটি দেখা যাচ্ছে না। তবে ও নিশ্চিত ওখানে ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছে। “গাই জানে যে আমরা পানিতে ঝাঁপ দিয়েছি। ও আমাদেরকে খুঁজতে নৌকা পাঠাবে। আমাদের লাশটাও খুঁজে পেলে খুব খুশি হবে ও। সময় থাকতেই পালিয়ে যেতে হবে।”

“স্বর্ণের কি হবে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“অন্য কোনো দিন…” টম বললো। তবে ও ভালোমতোই জানে যে সেটা আর সম্ভব হবে না। গাই এই আশাতেই থাকবে, আর বোম্বের প্রতিটা লোক টম আর ফ্রান্সিসের খোঁজে ঘুরবে। আর যদি ওরা দুর্গে আবার ঢুকতেও পারে, তাহলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে গিয়ে দেখবে কয়েকশো প্রহরী সিন্দুকগুলো পাহারা দিছে।

নৌকাটার একটা ছোট পাল আছে। মেরিডিউ আর বাকিরা মিলে সেটা খাঁটিয়ে দিলো। সন্ধ্যার হালকা বাতাসে ওটা ফুলে উঠে সমুদ্রের দিকে টেনে নিয়ে চললো নৌকাকে।

“ডোরিয়ান আর আবোলির সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে কেমন হয়?” অ্যানা বললো। “ওরা যদি মোটামুটি লাভ করে ফিরতে পারে, তাহলে হয়তো সেই টাকা দিয়েই আংরিয়ার মুক্তিপণ মেটানো যাবে।”

“কয়েক মাস লেগে যাবে তাতে,” টম বললো। তাছাড়া লাকুইডিভায় পৌঁছানোর মতো কোনো জাহাজ নেই আমাদের। আর যদি সেটাও জোগাড় করা যায়, তাহলেও যেতে যেতে নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবে। ডোরিয়ান আমাদের আশা ছেড়ে কেপ টাউনে রওনা দিয়ে দেবে ততোদিনে।”

“তাহলে করবো কি আমরা?” ঝট করে বললো ফ্রান্সিস।

টম সামনের দিকে তাকালো। এখনো দুর্গের আগুনটা পুরোপুরি নেভেনি। ধিকিধিকি জ্বলছে চত্বর জুড়ে। উপরের আকাশও লাল হয়ে আছে ওটার আভায়। আর তাতে নিচের গভর্নরের বাসাটাকে একটা আবছায়ার মতো লাগছে। সামনের খালটা পার হলেই জলাভূমি, তার পরেই ভারতের মূল ভূখণ্ডের খোলা সৈকত। এই উপকূল জুড়েই কোথাও সারাহ আর অ্যাগনেস ওদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। ও ওদের আশাকে মিথ্যে হতে দিতে পারবে না।

“আমরা ওদের মুক্তিপণ দিতে পারবো না, আনমনে বললো টম। “তার মানে বিকল্প উপায় একটাই।”

“জোর করে মুক্ত করে আনা?” কথাটা যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না ফ্রান্সিস। “কিন্তু আংরিয়ার দুর্গ তো নাকি দুর্ভেদ্য।”

টম নৌকার সাথে আড়াআড়ি বসে আছে। তাই সবাই সেটা বলে, কিন্তু নিশ্চিত হচ্ছো কি করে? গুজব শোনা যায় যে এটা দুর্ভেদ্য, তাই আর কেউ কখনো ওটা জয় করার চেষ্টাও করে না। আর যেহেতু কেউ কখনো জয় করতে পারেনি, তাই ওটার দুর্ভেদ্য হিসেবে সুনাম আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি কখনো এমন কোনো দুর্গের কথা শুনিনি যেটা জয় করা সম্ভব না।”

“কিন্তু সে জন্যে আমাদের একটা সৈন্যদল লাগবে,” দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললো ফ্রান্সিস।

টম ওর কাঁধে চাপড় দিলো। “সেটাই।”

টম অ্যানার কাছ থেকে হালটা নিজের হাতে নিয়ে নৌকাটা সোজা অন্ধকার উপকূলের দিকে চালাতে লাগলো। ফ্রান্সিস চেয়ে রইলো ওর দিকে।

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“আমাদের জন্যে একটা সৈন্যবাহিনি খুঁজতে।”

*

টিরাকোলা দুর্গের নিচের গুহাগুলোয় সবসময়েই রাতের অন্ধকার। এর মাঝেও লিডিয়া ফয় তার তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তির সাহায্যে কানে আসা নানা শব্দ মিলিয়ে, সময় আর দিন রাতের আগমন অনুমান করতে শিখে ফেলেছে। এই বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইগুলোর ভিতর দিয়েও ও ভাটার টান আর জোয়ারের স্রোত আলাদা করতে পারে, রাতের বেলার অব্যাহত নিস্তব্ধতা আর দিনের কর্মব্যস্ততার আভাস পায়।

এখন দুর্গ ঘুমিয়ে আছে। দূরের বাতিটা থেকে যে সামান্য আলো আসছে তার আলোয় লিডিয়া দেখতে পেলো দুই বোন একসাথে শুয়ে আছে। সারাহের মাথা অ্যাগনেসের বুকের উপর রাখা। সারাহের পেট এখন খুব ভালোমতোই ফুলে উঠেছে। এই আলো আধারিতেও বোঝা যায়। ব্যাপারটাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও আর পারবে না। দুজনেই ঘুমাচ্ছে, খুব আস্তে আস্তে পড়ছে শ্বাস।

যা করার এখনি করতে হবে লিডিয়াকে। ও নিজের স্কার্টটা তুলে হাতের বেড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিলো যাতে নাড়াচাড়ায় শেকলে কোনো শব্দ না হয়। তারপর পা টিপে টিপে কয়েদখানার দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। সারাহ বা অ্যাগনেস কেউই টের পেলো না কিছু। গরাদ আটা দরজার উল্টো পাশে একটা বাতি জ্বলছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা গেলো প্রহরী সিঁড়ির উপর বসে বসে নাক ডাকছে।

লিডিয়া মেঝে থেকে একটা ছোট নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে সৈন্যটার দিকে ছুঁড়ে দিলো। নুড়িটা সোজা কপালে গিয়ে লাগলো তার, ঘুম ভেঙে ঘোত ঘোত করে উঠলো লোকটা। হাত চলে গেলো দেয়ালে ঝোলানো মাস্কেটের দিকে। মাস্কেটটা নামিয়ে লিডিয়ার দিকে তাক করে, ভয় দেখিয়ে ওকে ফিরে যেতে বললো সে। অন্য হাত দিয়ে কপাল ডলছে তখনও। লিডিয়া এক পা-ও নড়লো না।

“ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চাই আমি,” ভাঙা ভাঙা পর্তুগিজে বললো লিডিয়া।

প্রহরী ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের আঙুলের মাথায় রক্ত লেগেছে কিনা সেটা পরীক্ষা করতে লাগলো। লিডিয়া তাই বুঝলো না যে লোকটা ওর কথা বুঝেছে কিনা। যে কয়টা ভারতীয় শব্দ ও জানে সেগুলো দিয়ে চেষ্টা করলো আর একবার। “সুবাদার? জাগিরদার? হাবালদার?”

প্রহরী মাথা ঝাঁকিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।

লিডিয়া ওর স্কার্টের নিচের দিকে হাত বাড়ালো। গার্ডের চেহারায় আগ্রহ দেখা গেলো এবার। লিডিয়া ওর দুই পায়ের ফাঁকে হাত ঘষতে লাগলো। প্রহরী ঠোঁট চেটে উঠে দাঁড়ালো। তারপর এসে দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো যাতে ভালো করে দেখতে পায়।

লিডিয়া কাপড়ের নিচ থেকে হাত বের করে আনতেই দেখা গেলো আঙুলের ফাঁকে একটা স্বর্ণালি প্যাগোডা খচিত মুদ্রা। যখন দস্যুদের হাতে ধরা পড়া নিশ্চিত হয়ে গেলো, তখন ও এটা নিজের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলো। নিজের স্কার্টে মুদ্রাটা মুছে প্রহরীর দিকে বাড়িয়ে ধরলো ও। প্রহরী ওটা নিতে হাত বাড়ালো কিন্তু লিডিয়া গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত টেনে নিলো। প্রহরী হতাশ চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে।

“হাবালদার, “ আবার বললো লিডিয়া। তারপর পর্তুগিজে বললো, “আমার ওনাকে জরুরি একটা খবর দেওয়ার আছে।”

প্রহরী ইতস্তত করতে লাগলো, কিন্তু লিডিয়ার হাতের মুদ্রাটার অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারছে না। ও দেয়াল থেকে একটা চাবির গোছে নিয়ে দরজা খুলে, মুদ্রাটার জন্যে হাত পেতে দিলো।

“হাবালদার,” আবার বললো লিডিয়া। মুদ্রাটা মুঠো করে শরীরের পিছনে নিয়ে রেখেছে।

প্রহরী আর কথা বাড়ালো না। লিডিয়াকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে যেতে লাগলো। উপর দিকে, ভবনের কাঠামো একদম অন্যরকম। নিচের অংশটা নিরেট পাথর কেটে বানানো। আর উপরে অংশটা মাপ মতো কাটা পাথরের ইট দিয়ে গড়া। একটু পর পরই বাতি ঝোলানো দেয়ালে। আরো উপর উঠতেই দেয়ালে পর্দা আর নানান অলঙ্করণ দেখা যেতে লাগলো। এতো সুন্দর যে, বোঝাই যাচ্ছে ওগুলো লুটের মাল। এই পরিস্থিতিতেও লিডিয়া ওগুলোর দামদর করতে লাগলো মনে মনে।

অবশেষে ওরা প্রহরীদের কক্ষে পৌঁছালো। আধা ডজনের মতো প্রহরী পাশা খেলছিলো ওখানে। লিডিয়াকে দেখা মাত্র ওদের ক্যাপ্টেন সাথের প্রহরীটাকে ধমকাতে শুরু করলো। কিন্তু লিডিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সোজা ক্যাপ্টেনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

“আমার কথা কি বুঝতে পারছেন?” পর্তুগিজে বললো ও। “আমি আপনাদের ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চাই।”

ক্যাপ্টেন কাঁধ ঝাঁকালো। একটা বর্ণও বোঝনি সে। আর তাতে ওর কিছু যায় আসে-ও না। ও লোকদেরকে কিছু একটা বলতেই সবাই অশ্লীল ভঙ্গিতে হেসে উঠলো। ক্যাপ্টেন নিজের উরুসন্ধিতে হাত বুলালো। লিডিয়া নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে এক পা আগে বাড়লো।

“এখানে কেউ ইংরেজি পারে?” রাগের অভিনয় করে বললো ও। “আমার কাছে একটা গোপন খবর আছে।” লিডিয়া জানে যে ওরা ওর কথা বুঝবে না, কিন্তু আশা করছে যে অন্তত ওর কথার গুরুত্বটা ধরতে পারবে।

ক্যাপ্টেন ওর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো। তারপর ওর অধস্তন কাউকে কিছু একটা আদেশ দিলো।

দুজন লোক ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে লিডিয়ার দুই হাত চেপে ধরলো। লিডিয়া চিৎকার দিতে গেলো কিন্তু তৃতীয় আর একজন পিছন থেকে এগিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরলো। ক্যাপ্টেন কোমর থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করে ওর গলায় ঠেকালো।

ছুরির ডগা লিডিয়ার কাপড়ের গলা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো লোকটা। ছুরির শীতল স্পর্শ চামড়ায় লাগতেই লিডিয়া স্থির হয়ে গেলো। তারপর আচমকা ঘ্যাচ করে একটানে ছুরিটা নামিয়ে আনলো ক্যাপ্টেন। কোমর পর্যন্ত দুই ভাগ হয়ে গেলো লিডিয়ার পোশাক। ওর বিশাল স্তন বেরিয়ে এসে দুলতে লাগলো। ওর বাহু দুটো পিছনে টেনে আটকে রাখা হয়েছে। ফলে ওগুলো ঢাকার সুযোগ নেই। লিডিয়া ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে রইলো, যেনো দৃষ্টি দিয়ে লজ্জা দিতে চাচ্ছে।

ক্যাপ্টেন হেসে ছুরিটা আবার খুঁজে রাখলো বেল্টে। তারপর হাত বাড়িয়ে দুই হাতে দুটো স্তন চেপে ধরে, এমনভাবে ওজন করতে লাগলো যেনো ওগুলো পাকা পেঁপে। ক্যাপ্টেন আবার নিজের উরুসন্ধিতে হাত দিয়ে মালিশ করতে শুরু করলো। লিডিয়াও চোখ নামিয়ে তাকালো সেদিকে। ধুতির নিচে তার পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে।

লিডিয়া পিঠ দিয়ে পিছনের লোকগুলোকে ধাক্কা দিলো। ওরাও সহজাতভাবেই আবার ওকে ঠেলে সোজা করতে সামনের দিকে দিলো টান। লিডিয়া সেই জড়তাকে কাজে লাগিয়ে ওর ডান হাঁটুটা ক্যাপ্টেনের উরুসন্ধি বরারবর ঠেলে দিলো। এতোক্ষণের জমা রাগ আর আক্রোশের পুরোটা ঝাড়লো লাথিটা দিয়ে।

ক্যাপ্টেন একজন মহিলার মতো চিৎকার করতে করতে পিছিয়ে দেয়ালের গায়ে গিয়ে পিঠ ঠেকালো। দুই হাত দিয়ে উরুসন্ধি চেপে ধরে আছে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই ব্যথাটা সামলে নিয়ে আবার লিডিয়ার দিকে আগালো সে। চেহারা জুড়ে তখনো যন্ত্রণা। ডান হাতে ছুরিটা তুলে নিয়েছে আবার। লিডিয়াকে গেঁথে ফেলবে বোঝাই যাচ্ছে।

“থামো।” রাশভারি একটা কণ্ঠ হুকুম করলো। “ওকে ছেড়ে দাও এখুনি।”

প্রহরীরা সাথে সাথে আজ্ঞা পালন করলো। ওরা লিডিয়াকে ছেড়ে দিয়ে পিছনে সরে হাত পিঠের পিছনে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সবার চেহারায় ভীতি। এমনকি ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হাতের ছুরিটা ফেলে দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা নিচু করে রইলো।

ওদের সবার নজর প্রহরী কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে।

একজন প্রহরী বিনয়ের সাথে কপাল সামান্য ঝুঁকিয়ে বিড়বিড় করে একটা নাম বললো, “রুদ্র”। রুদ্র দুর্গে আসার পর থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে খুব দ্রুত আংরিয়ার খুব কাছের লোক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে ওকে একটা গ্রামে পাঠানো হয়। ওখানকার লোকজন আংরিয়াকে চাদা দিতে চাইছিলো না। ও দুই বছরের চাদা একসাথে নিয়ে ফিরে আসে। পরের বার ওকে আংরিয়ার এক ক্যাপ্টেনের সাথে সমুদ্র অভিযানে পাঠানো হয়। এবার ও প্রায় পাঁচটা জাহাজ আর একশো হাজার রুপি লুট করে নিয়ে আসে। আংরিয়ার ক্যাপ্টেন অবশ্য মারা গিয়েছিলো। যুদ্ধের ডামাডোলে কেউ বলতে পারবে না যে কিভাবে সে মারা গিয়েছে, তবে লোকজন ভিতরে ভিতরে রুদ্রকেই সন্দেহ করে। যদিও ওর সামনে কিছু বলার সাহস করে না। আংরিয়া গুজবটা শুনে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। “সাপের গর্তে নামলে সবাইকেই নিজেকে নিজে রক্ষা করতে জানতে হয়।” ও রুদ্রকে মৃত ক্যাপ্টেনের জায়গায় পদোন্নতি দিয়ে দেয়। এরপর থেকে আর এসব গুজব ডালপালা মেলতে পারেনি। বিশেষ করে এক মুখ পাতলা লোককে যখন থেকে দুর্গের নিচের পানিতে ভাসতে দেখা গেলো, তখন থেকেই এই সংক্রান্ত ব্যাপারে সবার মুখে তালা পড়ে যায়।

রুদ্র লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। “কে তুই?” এতো নিখুঁত উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলো যে লিডিয়া চমকে গেলো। লোকটা লম্বা, কাঁধ চওড়া। মাথায় একটা তাজা পোড়া ক্ষত, ফলে তালুতে টাক হয়ে আছে খানিকটা। তবে দাড়ি আর ভ্রু ঘন আর কুঁচকুচে কালো। শুধু একটা চামড়ার আড়াআড়ি বেল্ট ছাড়া কোমর পর্যন্ত গায়ে কাপড় নেই তার। লিডিয়া বুঝতে পারলো বয়সের দিক দিয়ে যতোটা মনে হয়, লোকটা তার চাইতে কম বয়সী হলেও, ভয়ঙ্করত্বের দিকে দিয়ে অনেক অনেক বেশি।

“আমার নাম লিডিয়া ফয়,” হাত দিয়ে পেঁচিয়ে বুক ঢাকতে ঢাকতে বললো ও। তারপর রুদ্রের আগ্রহ কমে যাওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি বললো, “আমার কাছে আপনাদের মালিককে দেওয়ার মতো একটা জরুরি খবর আছে।”

“কি খবর?” জানতে চাইলো রুদ্র।

“আমি শুধু আপনাকেই বলতে চাই সেটা,” ও অর্থপূর্ণভাবে বাকি লোকগুলোর দিকে তাকালো। “একাকী কোথাও কথা বলা যাবে না?”

*

ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকিয়ে লিডিয়াকে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণে ওর ঘরটা। ওর আগে এখানে কেউ থাকতো না। দস্যুদের স্বভাব নেকড়েদের মতোই-লুট করুক, খাক বা ঘুমাক সব একসাথে করে। স্বভাবতই তাই এরকম নির্জন জায়গা এড়িয়ে গিয়েছে বাকিরা। কিন্তু ক্রিস্টোফারের জন্যে এই নীরব জায়গাটাই ছিলো সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত।

তাছাড়া এটা ওকে ওর গোপনীয়তা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ও নিজেকে বুঝিয়েছে যে লিডিয়াকে এখানে নিয়ে এসেছে শুধু নিরিবিলি ওর কাহিনি শোনার জন্যে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সত্যি না। গার্ডরুমে পা দিয়েই যা দেখতে পেয়েছিলো সেটা ভুলতে পারছে না কোনোমতেই কোমর পর্যন্ত চেরা জামার ভিতর থেকে বেরিয়ে থাকা লিডিয়ার ভরাট স্তন। এখন অবশ্য লিডিয়া ওর ছেঁড়া জামার দুটো অংশ কোনো মতে গিট দিয়ে নিজের আব্রম্ন রক্ষা করছে। কিন্তু তবুও গিটের ফাঁক দিয়ে নগ্ন চামড়া দেখা যাচ্ছে।

পুলার হাতে ও আর তামান্না ধরা পড়ার পর থেকে আর কোনো মেয়ের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়নি ক্রিস্টোফারের। এমন না যে সুযোগ হয়নি-এই দুর্গে প্রচুর বেশ্যা বা এমনি আগ্রহী মেয়েমানুষ আসে-কিন্তু ও কখনো তাদের প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করেনি। কিন্তু এই মেয়েটার প্রতি করছে এখন।

“কি বলবেন বলুন,” ক্রিস্টোফার জানতে চাইলো।

লিডিয়া আবারও নিজের পরিস্থিতি ভুলে অন্য বিষয়ে নাক গলানো শুরু করলো। “একজন ভারতীয় জলদস্যু হয়ে কিভাবে এতো নিখুঁত ইংরেজি শিখলেন?” জিজ্ঞেস করলো ও।

“ওদের সাথে কাজ করেছি অনেকদিন,” ব্যাখ্যা করলো ক্রিস্টোফার।

“বোম্বেতে গিয়েছিলেন কখনো?”

ক্রিস্টোফার কি বলবে ভেবে পেলো না। এ কি ওকে চিনতে পারবে? কিন্তু সেটা অসম্ভব। আজ সকালেও এক বালতি পানিতে ও নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছে। ওর মা পর্যন্ত ওকে চিনতে পারবে না।

“গিয়েছি দুয়েকবার,” ক্রিস্টোফার বললো।

“তাহলে নিশ্চয়ই গভর্নর গাই কোর্টনীর নাম শুনেছেন?”

“হ্যাঁ,” সংক্ষেপে বললো। “তা শুনেছি।”

“আপনি কি এটা জানেন, যে তার স্ত্রীর দুই বোন এই দুর্গে বন্দী?”

ক্রিস্টোফার হতবাক হয়ে লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। লিডিয়া ওর শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে ক্রিস্টোফারের এই বিহ্বল অবস্থাটা খেয়াল করলো কিন্তু কারণটা ধরতে পারলো না।

“ওনাদের নাম হচ্ছে সারাহ আর অ্যাগনেস। কিন্তু সারাই ওনার আসল পরিচয় লুকিয়ে রেখেছেন। কারণ…” সারাহ যে গাই-এর জন্যে নিজের পরিচয় গোপন রাখছে সেটা ও বলে দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু কি মনে করে শেষ মুহূর্তে চেপে গেলো। “কারণ ওনার ধারণ আংরিয়া এই সম্পর্কের ফায়দা ওঠাতে চাইবে। আর মুক্তিপণের টাকা বাড়িয়ে দেবে।” শেষে মিথ্যে বললো ও।

“আপনি তার গোপন খবর ফাঁস করে দিচ্ছেন,” ক্রিস্টোফার মন্তব্য করলো। তবে গলা শুনে বোঝা গেলো ও লিডিয়াকে দোষ দিচ্ছে না।

লিডিয়া ওর কাছে ঘেঁষে এলো, এতো কাছে যে ওর উন্নত স্তন প্রায় ক্রিস্টোফারের খোলা বুকে স্পর্শ লেগে গেলো। লিডিয়া ক্রিস্টোফারের শরীরের উত্তাপ টের পেলো।

“আসলে,” মিনতি করলো লিডিয়া। “চিত্তিত্তিঙ্কারাতে এক গণহত্যায় আমার স্বামী মারা যায়। এর পর থেকেই আমি একা। আমি কারো করুণা চাই না; শুধু নিজের মুক্তি আদায় করে নিতে চাই।”

লিডিয়া নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তারপর ছোট একটা মেয়ের মতো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো ক্রিস্টোফারের দিকে। কি মনে করে ক্রিস্টোফারের বাহু স্পর্শ করলো লিডিয়া। ওর শক্ত মাংসপেশি অনুভব করলো। “আমি জানি না আপনি কিভাবে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ভাগ্যই আমাদেরকে এক করেছে। আমাকে রক্ষা করতে পারবে এরকম একজন লোকের আমার খুব দরকার।”

ক্রিস্টোফার লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কথাটা শুনে মনের ভিতর ঝড় বইছে ওর। সমগ্র সত্তা চাচ্ছে লিডিয়াকে ভোগ করতে। কিন্তু এটাও পরিষ্কার যে মেয়েটা ওর এই আকর্ষণকে নিজের সুবিধার জন্যে কাজে লাগাতে চাইছে।

ক্রিস্টোফার হাত বাড়িয়ে লিডিয়ার ছেঁড়া জামাটার গিটু খুলে আবার টেনে খুলে দিলো। লিডিয়া বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করলো না। লিডিয়ার কব্জিতে তখনও হাতকড়া পরানো। ও দুই হাত একসাথে উপরে তুলে হাতকড়া সমেত হাতটা ক্রিস্টোফারের ঘাড়ের পিছনে নিয়ে এলো। তারপর পিছিয়ে যেতে শুরু করলো। ওর টানে ক্রিস্টোফারও আগাতে লাগলো সামনে বিছানায় নিজের হাটুর পিছন দিকটার স্পর্শ পেতে তারপর থামলো লিডিয়া।

“ব্যথা দেবেন না যেন,” বিড়বিড় করে বললো ও, কিন্তু ক্রিস্টোফারের কানে কথাটা গেলো বলে মনে হলো না। ও হামলে পড়লো লিডিয়ার উপর। ধাক্কায় লিডিয়া ধপ করে পিছন দিকে বিছানার উপর পড়ে গেলো। হাতকড়ার টানে ক্রিস্টোফারও ঝুঁকে এলো ওর উপর।

লিডিয়া একই সাথে ব্যথা আর আবেশ দুটোতেই শীকার করে উঠলো। জীবনে প্রথমবারের মতো ওর মনে হলো স্বর্গসুখ লাভ করলো যেনো। উন্মত্ত কামনার সামনে এতোদিনের কষ্ট করে গড়ে তোলা শঠতা আর ধুর্ততার বাঁধ ভেসে গেলো খড়কুটোর মতো।

লিডিয়ার আবেশী ক্রন্দনের সাথে ক্রিস্টোফারের জান্তব গর্জন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো। উত্তেজনা থিতিয়ে আসার পর, ওভাবে ক্রিস্টোফারের গলায় হাতকড়া বাধিয়ে রেখেই মরার মতো ঘুমিয়ে পড়লো লিডিয়া।

ক্রিস্টোফারের ঘুম এলো না। পাশে শুয়ে লিডিয়ার লম্বা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে, ওর বলা কথাগুলোর মর্মার্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করতে লাগলো।

যদিও ওর অ্যাগনেস খালার কথা খুব বেশি মনে নেই। ও ছোট থাকতেই বোম্বে ছেড়ে চলে এসেছিলেন উনি। উনি কিভাবে টিরাকোলা দুর্গে এসে আটকা পড়েছেন সেটা অনুমান করতে পারছে ক্রিস্টোফার। কিন্তু সারাহ কোটনী?

ওর মা ক্যারোলিন তার মেঝো বোন সম্পর্কে কোনো কথাই বলতেন না; ক্রিস্টোফার বারো বছর বয়সে প্রথম তার কথা জানতে পারে। ওর জিজ্ঞাসার জবাবে ওর মা জানিয়েছিলেন যে সারাহ বহু বছর আগেই ওনার স্বামী, মানে ক্রিস্টোফারের চাচা টমের সাথে আফ্রিকায় মারা গিয়েছেন।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উনি আসলে মারা যাননি। আর উনি যদি জীবিত থাকেন, তার মানে কি টমও জীবিত না?

কেল্লার জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে উল্টোপাশের দেয়ালে ঝোলানো নেপচুন তরবারিটায় লেগে প্রতিফলিত হতে লাগলো। স্বর্নালি ধারটা চাঁদের আলোয় রূপালি লাগছে। টম-ই কি তরবারিটা ভারতে নিয়ে এসেছেন? আর তাই যদি হয়, তাহলে সেটা ক্রিস্টোফারের জন্যে ভালো না খারাপ?

গাই, টম চাচাকে দুই চোখে দেখতে পারতো না। ক্রিস্টোফার গাইকে দেখতে পারে না। তার মানে কি ও আর ওর চাচা জোট বেঁধে ওর বাবার বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে পারবে? ও কি সারাহকে ব্যবহার করে টম চাচাকে নিজের পক্ষে কোনোভাবে আনতে পারবে? নাকি লিডিয়ার কথাটা আংরিয়ার কানে পৌঁছে দেব? এতে মুক্তিপণের পরিমাণ বাড়বে। আর তাতে ও আংরিয়ার আরো বেশি আস্থাভাজন হতে পারবে।

চাঁদ হেলে পড়লো, তারা ডুবে গেলো আর ক্রিস্টোফারের জানালার পাশের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করলো। ক্রিস্টোফার লিডিয়ার হাতকড়ার বন্ধন থেকে সন্তর্পণে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। লিডিয়ার দিকে তাকালো ও। ওর চামড়া নিখুঁত ফর্সা আর মসৃণ। আবার ওর নাভীর নিচে শিরশির করে উঠলো। পরে হবে, দুনিয়ার সমস্ত সময় পড়ে আছে; নিজেকে বললো ও।

ক্রিস্টোফার আবার লিডিয়ার পাশে শুয়ে, হাত বাড়িয়ে ওর নরম স্তনে চাপ দিলো। অস্ফুটে গুঙিয়ে উঠলো লিডিয়া।

ঠিক তখনি, বজ্রপাতের মতো স্পষ্ট কিন্তু চাপা একটা আওয়াজ ভেসে এলো জানালা দিয়ে। মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গেলো ক্রিস্টোফার। অনেক দূর থেকে এসেছে, কিন্তু শব্দটা নিজের নিঃশ্বাসের শব্দের মতোই চেনা ওর কাছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কামানের গোলা ছোঁড়ার আওয়াজ ওটা।

জানালার কাছে এগিয়ে মাথা বের করলো ক্রিস্টোফার। দুর্গের দেয়ালের পেছনে, যে সরু শৈল অন্তরীপটা দুর্গের সাথে মূল ভূ-খণ্ডের সংযোগ দিয়েছে সেটার পিছন দিয়ে একটা ছোট পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্য উদিত হচ্ছে। আর সেই পাহাড়ের গা বেয়ে দেখা যাচ্ছে কয়েক হাজার বল্লমের মাথায় বাধা পতাকা। সকালের মৃদু বাতাসে উড়ছে সেগুলো। আর ওগুলো বহন করছে যে ঘোড়সওয়ারেরা, তারা ঘোড়া থামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টিরাকোলা দুর্গের দিকে।

দুর্গ আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে এক বিশাল সেনাবাহিনি।

*

পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। রাস্তা এতো সরু যে এক পাশপাশি দুজনেরও হাঁটার উপায় নেই। সামনের আলো আধারিতে মস্ত একটা অবয়ব আবছা দেখা যাচ্ছে, ওটাই পাহাড়ের উপরের বিশাল দুৰ্গটা।

দলটার সবার সামনে আছে টম কোর্টনী। অ্যানা আর ফ্রান্সিস আছে ওর পেছনেই। মেরিডিউ আর কেস্ট্রেল থেকে বেঁচে যাওয়া আরও চারজন আছে ওদের পেছনে। অনেকদিন হয় বোম্বে ছেড়েছে ওরা। নৌকা নিয়ে সোজা উপকূল বরাবর আগাতে আগাতে শেষে একটা পাহাড়ের গোড়ায় এই রাস্তাটা খুঁজে পেয়েছে। এটা দিয়ে পশ্চিমদিকের পর্বতশ্রেণীর চূড়ায় পৌঁছানো যায়।

“এটা পুরো একটা রূপকথার দেশ। সব জায়গা যেনো কোনো অভিশাপে মুড়ে আছে,” ফ্রান্সিস বললো। ছোট বেলায় হাই উইন্ডের লাইব্রেরিতে যেসব আর্থারিয়ান নাইটদের গল্প কথা ছিলো সেসব ও গোগ্রাসে গিলতে। এখানে আসার পথে ওরা যেসব জায়গা পেরিয়ে এসেছে, সেসব ওকে রাজা ফিশারের থাকার জায়গা-সেই অভিশপ্ত গ্রেইল দুর্গের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সদ্য বর্ষা গত হয়েছে, রাস্তার দু-ধারের সবকিছু সবুজ আর সতেজ হয়ে থাকার কথা; কিন্তু মাঠঘাট সব বিরান হয়ে পড়ে আছে। বেশিরভাগ গ্রামই জনশূন্য। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে যে তিন চার দিনেও ওরা কোনো জনমানবের দেখা পায়নি। রাতের বেলাতেও আশেপাশে তেমন কোনো আগুন বা বাতি দেখা যায় না। যাদের দেখা পেলো তারাও সবাই-ই প্রায় উলঙ্গ আর ক্ষুধার্ত। ওদের পদশব্দ পেয়ে এমনভাবে নিজেদের মাটির তৈরি ছোট ছোট বাসা থেকে বের হয়ে আসছিলো যেনো কোনো পশু নিজের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। সভ্যতার একমাত্র চিহ্ন ছিলো প্রতিটা প্রান্তরের শেষ মাথায় থাকা দুর্গগুলো। পাহাড়ের মাথায় ওগুলো দেখতে ঈগল পাখির বাসার মতো লাগে।

“এখানে এই অবস্থা কেন?” ওদের যাত্রার দ্বিতীয় দিন সকালে জিজ্ঞেস করেছিলো ফ্রান্সিস।

“যুদ্ধ,” জানিয়েছিলো অ্যানা। “এটা হচ্ছে মারাঠাদের এলাকা। গত তিরিশ বছর ধরে স্বাধীনতার দাবিতে ওরা মুঘলদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্যে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে ওদেরকে। আর এখন নিজেদের রাজ্য উদ্ধার হলেও কে সেটা শাসন করবে সেটা নিয়ে শুরু হয়েছে গণ্ডগোল। গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেশটা।”

এতোদিন পরে এসে ওরা সাতারা-র দুর্গের কাছে পৌঁছেছে। রাস্তাটা প্রায় খাড়াভাবে উঠে গিয়েছে পাহাড়ের চূড়ায়। প্রধান ফটকে প্রহরী আটকালো ওদেরকে। টম এগিয়ে গেলো কথা বলতে। আর ওর পরিচয় লুকানোর কিছু নেই। ধীরে সুস্থে স্পষ্টভাবে সব বললো ও। অ্যানা পাশ থেকে অনুবাদ করে দিলো।

“আমি টমাস কোর্টনী। বোম্বের গভর্নর গাই কোর্টনীর ভাই। আমি রাজা শাহুজির সাথে কথা বলতে চাই।”

ওর পরিচয় শুনে প্রহরীদের চোখ কপালে উঠে গেলো, টম বুঝলো না সেটা কি ভালো নাকি খারাপ। তবে ঢুকতে দেওয়া হলো ওদেরকে। একজন চাকর পথ দেখিয়ে ওদেরকে একটা বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে এলো। তারপর ওদেরকে বসতে বলে সে দুর্গের মূল ভবনের ভিতরে ঢুকে গেলো।

“এই রাজা সম্পর্কে কিছু জানো তুমি?” অ্যানাকে জিজ্ঞেস করলো টম। “তার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ওনার কি এখন আর নতুন যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ আছে?”

“রাজাকে হালকা ভাবে নেবেন না,” সতর্ক করলো অ্যানা। “একবার মুঘল সৈন্যরা এই দুর্গ দখল করে নিয়েছিলো। ওরা যে থাকতেই এসেছে সেটা প্রমাণ করতে মুঘল সেনাপতি নিজের স্ত্রী আর বাচ্চাদেরকে এখানে নিয়ে আসেন। শাহুজি দুৰ্গটা অবরোধ করে, মুঘল সেনাপতির স্ত্রী আর মেয়েদের ধরে নিয়ে আসেন। তারপর তাদেরকে দেয়ালের নিচে কামানের নলের উপর বেঁধে, কামানে পাউডার ভরে, পাশে আগুন হাতে ওনার লোকদের দাঁড় করিয়ে রাখেন।”

“তারপর কি হলো,” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“মুঘল সেনাপতি আত্মসমর্পণ করেন। শাহুজি ওনার রাজধানী পুনরুদ্ধার করেন আর সেই থেকে এখানেই আছেন।” বলে অ্যানা হাতের উপর বসা একটা মাছি ঝাঁকি মেরে তাড়ালো। “শুনেছি যে উনি নাকি একেকজনের কাছে একেকরকম রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেন। মানে যাকে ওনার চরিত্রের যেটুকু দেখাতে ইচ্ছে হয় সেটুকুই দেখান। তাই আপনার সামনে যে ভান-ই করুক না কেন, প্রতারিত হবেন না।”

চাকরটা ফিরে আসতেই অ্যানা থেমে গেলো। গাই কোর্টনীর নামটা সাথে সাথেই কাজে দিয়েছে দেখা যাচ্ছে। মেরিডিউ আর বাকিদেরকে রেখে টম, অ্যানা আর ফ্রান্সিস আরও বেশ কয়েকটা করিডোর আর ঘর পেরিয়ে দুর্গের একেবারে মাঝখানে এসে উপস্থিত হলো।

“এর মানে কি?” ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো ফ্রান্সিস।

“এটা হচ্ছে শাহুজির আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ, টম জবাব দিলো। “একজন ফালতু লোক হলে সে আমাদেরকে খামাখা বসিয়ে রেখে নিজের ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করতো।”

বিশাল সিঁড়িটার একদম মাথায় উঠে চমৎকার কারুকার্যময় এক জোড়া দরজা পেরিয়ে দরবার কক্ষে এসে হাজির হলো ওরা। ভারতীয় হিসেবে দরবারটা নিতান্তই অনাড়ম্বর বলা চলে। কিন্তু এর পরেও যে কোনো ইউরোপিয়ান রাজদরবার এটার জৌলুসতার কাছে একদম একটা মঠের মতো মনে হবে। ঘরের একদম মাঝে একটা বেদীর উপর একটা সিংহাসন। তার চারপাশ ঘিরে আছে সভাসদ আর প্রহরীরা। সিংহাসনটা দেখে মনে হচ্ছে খাঁটি স্বর্ণের তৈরি। তার উপর বাঘ আর সিংহের ছাল বিছানো। ওটায় যে লোকটা বসে আছে তার পরনেও দামী পোশাক। তাতে রূপার সুতো দিয়ে হাতীর দাঁতের নকশা সেলাই করা। আর সেই সাথে মণি-মুক্তা এসব তো আছেই।

টম যতোটা ভেবেছিলো তার চাইতে কম বয়স রাজার। এখনো তিরিশ হয়নি। নিখুঁতভাবে কামানো গাল তার যৌবনকে আরো উদ্ভাসিত করছে। সোজা হয়ে বসে আছেন রাজা, নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন, নিজের যা আছে তা নিয়ে গর্বিত। তিন আগন্তুককে ভালো ভাবে দেখলেন তিনি। তার চোখের দৃষ্টি রহস্যময়। সারা দরবার জুড়ে কোনো শব্দ নেই। শুধুমাত্র শাহুজি যখন নিজের গলায় ঝুলানো মুক্তার মালাগুলো নাড়ছেন তখন টক টক শব্দ হচ্ছে।

“আপনি গভর্নর কোর্টনীর ভাই,” অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন উনি। কথাটা একটা মন্তব্য ছিলো, প্রশ্ন না। উনি কথা বলছেন পর্তুগিজে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে মোজাম্বিক আর সোফালাতে ব্যবসা করার সময় টম ওখানকার পর্তুগিজ বসতকারীদের কাছে থেকে কিছুটা পর্তুগিজ শিখেছিলো। কিন্তু তবুও অ্যানাকেই কাজে লাগালো। কারণ ভুল বোঝাবুঝি হলে সমস্যা।

“আমি গাই কোর্টনীর যমজ ভাই।”

“উনি কি আমার কাছে যে ফরমানটা দাবী করেছিলেন সেটা নিতে আপনাকে পাঠিয়েছেন?” শাহুজি জানতে চাইলেন।

“আমি এখানে আমার ভাইয়ের পক্ষ থেকে আসিনি,” টম স্বীকার করলো। “আমি এখানে এসেছি আপনি কিভাবে তার কাছে থেকে একটা সুবিধা আদায় করতে পারেন, সে ব্যাপারে একটা পরামর্শ দিতে।”

রাজা চোখ পিটপিট করে তাকালেন ওর দিকে। আপনি যদি গাই কোর্টনীর ভাই হয়ে থাকেন, তাহলে তার সাথে বেঈমানি করতে চাচ্ছেন কেন?” টমের মনে পড়লো আনা ওদেরকে মারাঠাদের গৃহযুদ্ধের কারণটা বলেছিলো। শাহুজির ফুফু ওনার কাছে থেকে রাজ্যটা ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছেন।

“আমার ধারণা আপনি ব্যাপারটা অন্য যে কারো চাইতে ভালো বুঝবেন, মহামান্য। সবসময় একই পরিবারের সদস্যুদের একই উদ্দেশ্যে কাজ করা সম্ভব হয় না।

অ্যানা অনুবাদ করে দেওয়ার পর টম ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো। একবার ভাবলো যে বাড়িয়ে বলে ফেললো কিনা। রাজা যদি অপমানবোধ করেন তাহলে ঝামেলা। রাজার চোখ সরু হয়ে থাকায় তার মনোভাব কিছুই বোঝ গেলো না। শহুজি চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর সামান্য একটু ঝুঁকে এলেন সামনে। “তা ঠিক কিসের জন্য আমার কাছে এসেছেন?”

“আমি একটু আপনার সাথে একাকী কথা বলতে চাই,” সোজাসুজি বলে দিলো ইম। ও খুব ভালোমতোই জানে যে দরবার হচ্ছে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ, এখানে বসে রাজাকে পটানো যাবে না।

শাহুজি ঠোঁট গোল করে তাকালেন টমের দিকে। তারপর কোনো কথা না বলে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিচে নেমে এলেন। সভাসদরা সরে দাঁড়ালো; দূরের দেয়ালে একটা দরজা খুলে দিলো কেউ। টম আর বাকিরা রাজার পিছু নিয়ে আগালো সেদিকে। দরজাটা দিয়ে ওরা বাইরের প্রান্তরের দিকে মুখ করে থাকা একটা পাথরের ব্যালকনিতে এসে উপস্থিত হলো। অ্যানার বলা মুঘল সেনাপতির পরিবারের কথা মনে পড়লো টমের। এখানে দাঁড়িয়েই কি সেনাপতি দেখতে পেয়েছিলেন যে তার স্ত্রী আর মেয়ে নিচে কামানের মুখে বাধা? ওদের কান্না কি ওখান থেকে ওনার কানে এসে পৌঁছাচ্ছিলো?

প্রহরীরা ওদেরকে ওখানে রেখে দরবারে ফিরে গেলো আবার। যাওয়ার পথে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো। এখানেও সব কিছু নীরব, শুধু রাজার গলার মালার টুকটাক আর পাহাড়ে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

“কেন আপনি আপনার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যেতে চান?” শাহুজি একরকম নির্বিকার ভাবে প্রশ্নটা করলেন। যেনো টমের শরীর স্বাস্থ্যের খবর নিচ্ছেন।

“আমার ধারণা আমাদের দুজনেরই একজনের বিরুদ্ধে শত্রুতা আছে।”

“গভর্নর কোর্টনী আমার শক্র না।”

“আমি দস্যু আংরিয়ার কথা বলছিলাম। সে আপনার জাহাজ লুট করে উপকূলে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। আর সে আপনার বিরুদ্ধে আপনার ফুফুর পক্ষ হয়ে কাজ করছে।”

শাহুজি এতো সামান্য মাথা ঝোঁকালেন যে বোঝাই গেলো না।

“আংরিয়া আমার স্ত্রী আর তার বোনকে ধরে নিয়ে গিয়েছে,” টম বলে চললো। “তারপর টিরাকোলার দুর্গে ওদেরকে আটকে রেখেছে।”

শাহুজির চেহারায় সামান্য বিরক্তি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো আবার, এই প্রথম তার চেহারায় কোনো অনুভূতি দেখা গেলো। “টিরাকোলা আমার দুর্গ,” শাহুজী বললেন।

“আর সেজন্যেই আমরা আপনার কাছে এসেছি,” তাড়াতাড়ি বললো টম। “আপনি আপনার দুর্গ ফেরত চান, আমি আমার পরিবার ফেরত চাই।”

শাহুজি কি ওর কথায় উৎসাহিত হলেন নাকি অপমানিত হলেন সেটা টম বুঝতে পারলো না।

“আমার ভাই গাই আপনার সাথে একটা চুক্তি করতে চায়,” টম বললো। “ও আংরিয়াকে ওর শয়তানি চালিয়ে যেতে দিচ্ছে, যাতে করে আপনি ওর সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। কিন্তু আমরা যদি আংরিয়াকে ওর দুর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ওর আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে আপনি কিন্তু। গাইয়ের চাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। আর তাছাড়া উপরি হিসেবে নিজের দুৰ্গটা তো ফেরত পাচ্ছেন-ই।”

“তা আমাকে এসব কেন বলছেন?” শাহুজি জিজ্ঞেস করলেন।

“কারণ আংরিয়া বন্দীদের জন্যে মুক্তিপণ দাবী করেছে, আর গাই সেই টাকাটা দিতে সম্মত হচ্ছে না,” ফ্রান্সিস মাঝখান থেকে বলে উঠলো। “একমাত্র আপনার পক্ষেই টিরাকোলা দুর্গ আংরিয়ার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের পরিবারকে মুক্ত করা সম্ভব।”

টম ফ্রান্সিসের দিকে নিষেধের দৃষ্টিতে তাকালো, তবে শাহুজিকে দেখে মনে হলো না যে উনি কিছু মনে করেছেন। শুধু ওনার টা কিছুটা উঁচু হলো।

“আপনাদের কেন মনে হচ্ছে যে আমার টিরাকোলা দখলের সামর্থ্য থাকার পরেও, আমি সেটা দখল না করেই বসে আছি?” বলে উনি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এখনো পুরো প্রান্তর জুড়ে হালকা কুয়াশার আস্তরণ। “আমার রাজ্যের অবস্থা আপনাকে বলছি শুনুন, শাহুজি বলে চললেন। “আপনারা আসার পথে জমিগুলোতে কোনো ফসল দেখেছেন?”

টম আর ফ্রান্সিস মাঠ নাড়লো।

আবার বলা শুরু করলেন শাহুজি, “আপনার রাজা যদি আপনার গ্রামকে রক্ষাই করতে না পারে, তাহলে ফসল ফলিয়ে লাভটা কি? একসময় দেশটা প্রাচুর্যে ভরপূর ছিলো। এখন কৃষকেরা শুধুমাত্র সেসব ফসল বোনে যেগুলো তারা জঙ্গলে পালানোর সময় সাথে নিয়ে যেতে পারবে। তিরিশ বছর ধরে আমার ঠাকুরদা ছত্রপতি শিবাজি মুঘলদের সাথে এই সাম্রাজ্যের জন্য লড়েছেন। উনি মারা যাওয়ার পরে আমার ফুফু দাবি করলেন তার ছেলে নাকি এখানকার সম্রাট হবেন, কিন্তু আদতে সিংহাসনের দাবি আসলে আমার। মুঘলেরা মারা গিয়েছে। তাদের সাম্রাজ্যও খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না, কারণ আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করছি। আমরা এটাকে বলি ভালেরাই-মানে বল্লমের শাসন। প্রতিটা গ্রামের মাতবর মনে করে যে সে একজন সেনাপতি। তারা তাদের নিজেদের লোকজন জড়ো করে সামান্য কারণেই মারামারি করতে লেগে যায়। কোথাও কোথাও তো আমাকে গ্রামের চৌকিদারের চাইতেও কম দাম দেওয়া হয়।

রাজা দেয়াল থেকে খুলে আসা একটা ছোট পাথর তুলে নিয়ে নিচে ফেলে দিলেন।

“ঠাকুরদা যুদ্ধ শুরু করার পর থেকেই মুঘলেরা আমাদেরকে ডাকাত হিসেবে ঘোষণা করে। গোয়ালঘরের দুর’ বলে ডাকতো ওরা আমাদেরকে। আমি দেখেছি ইঁদুরের যখন খাওয়ার কিছু পায় না, তখন ওরা কিভাবে একে অপরকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়। মুঘলদের কথাই আসলে ঠিক ছিলো, আমরা আসলেই তাই।” রাজা এতোগুলো কথা বললেন কিন্তু একবারের জন্যেও তার কষ্ঠ উঁচু হলো না বা কোনো অনুভূতি খেলা করলো না।

“আপনারা পৃথিবীর সবচে শক্তিধর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন,” টম মনে করিয়ে দিলো।

“আপনি কখনো কোনো মুঘল ঘোড়সওয়ারকে দেখেছেন?” প্রশ্নটা করে শাহুজি উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন, “ওদের ঘোড়াগুলো দুনিয়ার সবচে বড় আর সবার চাইতে শক্তিশালী। ঘোড়াগুলোকে ওভাবেই বড় করা হয়। কারণ অস্ত্র আর বর্মসহ একজন ঘোড়সওয়ারের ওজন হয় অনেক। আমাদের ঘোড়াগুলো ছোট। ছোট ছোট পায়ের জানোয়ার। পাহাড়ে চড়তে বা দ্রুত পালাতে কাজে লাগে। আমরা কখনোই মুঘলদের সাথে সামনা সামনি লড়াই করার সাহস করিনি। ওরা যখন আমাদের বিরুদ্ধে লড়তে আসতো, তখন আমরা ওদেরকে পার হয়ে যেতে দিতাম। তারপর ওদের রসদপত্র আনা নেওয়ার রাস্তা দিতাম বন্ধ করে। ওরা যখন আমাদের দুর্গ অবরোধ করতো, আমরা ওদেরকে দখল ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিজেদের ফসলের ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিতাম আর সব গবাদি পশু জবাই করে ফেলতাম, যাতে দখলকারীরা না খেয়ে থাকে। এভাবেই আমরা যুদ্ধ চালিয়েছি। টিরাকোলার মতো একটা দুর্গের সামনে আমরা খড়কুটোর মতোই উড়ে যাবে।”

“আপনাদের মনে কোনো দয়ামায়া নেই?” রেগেমেগে বললো ফ্রান্সিস। “কতোদিন হচ্ছে আমার খালা দস্যুগুলোর হাতে বন্দী। আপনি ওনাদেরকে ঐ কয়েদখানায় ওভাবে পচে মরতে দেবেন?”

নির্বিকার চোখে ওর দিকে তাকালেন শাহুজি। “ছোট থাকতে আমাকে বন্দী করে মুঘল দরবারে পাঠানো হয়েছিলো। আমি আমার পুরো শৈশব ওখানে কাটিয়েছি। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবতাম আজ কি প্রহরীরা আমার গর্দান উড়িয়ে দেবে কিনা; আর প্রতি সন্ধ্যায় শুতে যাওয়ার আগে আমি জানতাম না যে পরের সকালটা দেখতে পাবো কিনা।”

“আমি জানতাম না সেটা,” ফ্রান্সিস চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জা পেয়েছে।

“আমার বয়স যখন এগারো, মুঘলেরা আমার বাবাকে আটক করে। আমার বাবা আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। মুঘলরা তাই তাকে শিকারি কুকুরের মুখে ছেড়ে দেয়। ওরা বাবার একটা একটা করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ফেলে। আমাকে জোর করে পুরো দৃশ্যটা দেখানো হয়। তারপর এই বিজয়ের উৎসবে আমাকে বসানো হয় ঠিক মুঘল সম্রাটের পাশে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, বন্দী হিসেবে কেমন লাগে সেটা জানা আছে আমার।”

ফ্রান্সিস নিচু গলায় ক্ষমা চাইলো। টমও মাথা নিচু করে সহমর্মিতা জানালো। এখন ও বুঝতে পারছে যে কিভাবে শাহুজি এতো নিরুত্তাপ কণ্ঠে নিজের সাম্রাজ্যের ধংসের কথা আলাপ করতে পারছেন। একজন বন্দী হিসেবে, সবসময় গলার সামনে একটা তরবারি নিয়ে বড় হয়েছেন উনি। ফলে ওনার আবেগ অনুভূতিকে এতো গভীরে কবর দিতে শিখেছেন যে ওগুলো হয়তো আর কোনোদিনও আলোর মুখ দেখবে না।

“আমি আসলে করুণা ভিক্ষার জন্যে আসিনি,” টম বলতে শুরু করলো।

শাহুজি কিছুই বললেন না, কিন্তু তার চোখে অধৈর্য ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

“কিন্তু আমার বিশ্বাস আমাদের দুজনেরই লক্ষ্য উদ্দেশ্য একই।”

অ্যানা যোগ দিলো আলোচনায়। “দস্যু আংরিয়া এই গৃহযুদ্ধে আপনার ফুফু আর তার ছেলেকে সমর্থন দিচ্ছে। আপনি যদি আপনার রাজ্যকে আবার জোড়া দিতে চান, তাহলে সবার আগে আংরিয়াকে সরাতে হবে।”

“আমার বাবা মুঘলদেরকে তিলে তিলে পরাজিত করেছিলেন। আমিও আংরিয়াকে সেভাবেই পরাজিত করবো-সময় নিয়ে। আর তাছাড়া টিরাকোলা দুর্গ অজেয়।”

টম বিরক্তিসূচক শব্দ করে উঠলো। “যার সাথেই দেখা হয়, সে-ই একথা বলে। কেউ কখনো ওটাকে আক্রমণ করে দেখেছে?”

“যারা করেছে তারা সেই কাহিনি বলার জন্যে আর বেঁচে নেই,” শাহুজির মুখে একটা হাসি ফুটে উঠতে উঠতেও উঠলো না।

“আমাকে একদল সৈন্য দিন। আমি ওই দুর্গের ফটক খুলে আপনার হাতে তুলে দেবো,” নিষ্কল্প কণ্ঠে বললো টম।

“আমি শুনেছি যে আপনি নাকি অবরোধ ঠেকানোর ব্যাপারে ভালোই পারদর্শী। তা সেভাবে কি অবরোধ করতেও পারবেন?”

টম শাহুজির তাকানোর ভঙ্গিটা খেয়াল করলো। লোকটার জ্ঞান সম্পর্কে একটা আন্দাজ করতে পারলো ও। ব্রিঞ্জোয়ানের দুর্গ অবরোধ এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে সংগঠিত হয়েছে। অন্য আর একটা সাম্রাজ্য, অন্য আর একটা নামে, কিন্তু তবুও শাহজি সেটা জানেন। এটাও ধরে ফেলেছেন যে টম ওখানে ছিলো। অথচ ও আজ সকালেই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। টম ভিতরে ভিতরে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না।

“আপনি কি দস্যু আল-আউফ এর নাম শুনেছেন?” টম জিজ্ঞেস করলো।

“অশুভ?” শাহুজি সহজেই আরবি নামটার বাঙলা করে ফেললেন। মুঘল দরবারে বড় হওয়ায় আরবি ভাষাটা সম্ভবত ভালোই জানেন উনি। “দুঃখি শুনিনি।”

“কারণ সে বহু আগেই মারা গিয়ছে। মরার আগ পর্যন্ত সে ছিলো ভারত মহাসাগরের সবচে ভয়ংকর জলদস্যু। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এতো সুরক্ষিত জাহাজগুলো পর্যন্ত ওর হাত থেকে রক্ষা পেতো না। ফ্লোর-ডি-লা মার নামের একটা দ্বীপে বিশাল একটা দুর্গ ছিলো তার। ওখান থেকেই সবকিছু পরিচালনা করতো সে। দুর্গের প্রতিরক্ষায় ছিলো অস্ত্র-গোলাবারুদ আর কামানসহ প্রায় এক হাজার জলদস্যুর বিশাল বাহিনি। লোকজন ঐ দুৰ্গটাকেও দুর্ভেদ্য বলতো। আমি আর আমার বাবা মিলে ওদের জাহাজের বহর জ্বালিয়ে দিয়ে, দুর্গের দরজা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি নিজে আল-আউফের মাথা ওর ধড় থেকে আলাদা করেছিলাম।”

ওটাই ছিলো হাল কোর্টনীর জীবনের শেষ যুদ্ধ। যে বিস্ফোরণে দুর্গের দেয়াল উড়িয়ে দেওয়া হয়, সেটার আঘাতেই উনি পা হারান। কয়দিন পরেই গ্যাংগ্রিনে তার জীবনাবসান হয়। কিন্তু টম সেটার কথা উল্লেখ করলো না।

শাহুজির পিছনে, সূর্যের আলো মেঘ ভেদ করে নেমে এসে কুয়াশাকে রাঙ্গিয়ে দিলো। ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রে ধোঁয়ার মাঝে কামানের গোলার আগুনের মতো। টম রাজার দিকে তাকালো, কিন্তু তার ভাবলেশহীন চেহারা দেখে কিছুই বোঝা গেলো না।

তবে বোঝা গেলো যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। উনি সোজা হয়ে টমের কাঁধের উপর দিয়ে কিছু একটা বললেন। ঘুরতেই টম দেখলো কমপক্ষে আধা ডজন চাকর দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। যদিও ও নিশ্চিত যে এরা এখানে একটু আগেও ছিলো না। চাকরেরা কুর্নিশ করে টম আর তার সাথীদেরকে ওদের পিছু নিতে ইশারা করলো। তার মানে ওদের আলাপ শেষ।

“উনি কি বললেন?” আবার প্রাসাদের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে ফ্রান্সিস অ্যানাকে জিজ্ঞেস করলো।

“ঘোষণা দিলেন যে উনি শিকারে যাবেন।”

ফ্রান্সিস করিডোরের মুখে ঝপ করে দাঁড়িয়ে গেলো। “আমরা এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি, শিকার না, প্রতিবাদ করলো ও।

“তুমি বোঝোনি,” অ্যানা বললো। “একটা হচ্ছে অন্যটার প্রস্তুতি। রাজা আমাদের প্রস্তাব বিবেচনা করছেন, কিন্তু উনি আরো কয়েকটা বিকল্পও ভেবে দেখছেন। যখন উনি ওনার সামন্তদেরকে শিকারের জন্য আহ্বান করবেন, তখন তারা তাদের সাথে তাদের চাকর বাকর, সৈন্যদল আর অস্ত্রপাতিও নিয়ে আসবে। উনি ওনার সৈন্যদেরকে জড়ো করছেন কিন্তু যুদ্ধে যাবেন কি যাবেন সেই সিদ্ধান্ত ভোলা রয়েছে। আর তাছাড়া শিকার সফল হলে সেটা যুদ্ধে সাফল্যের জন্যেও বড় একটা লক্ষণ বলে বিবেচিত হবে।”

“যদি শিকার ভালো না হয়?”

অ্যানা কাঁধ ঝাঁকালো, “প্রার্থনা করো যেনো তেমনটা না হয়।”

৮. শাহুজির প্রাসাদ

শাহুজির প্রাসাদেই থাকার ব্যবস্থা হলো ওদের। পরের কয়েকদিন যাবত একের পর এক অস্ত্রধারী সৈন্যদল পাহাড়ের ওই বিপদসংকুল রাস্তাটা ধরে উঠে আসতে লাগলো। সেই থেকে পুরো মহল এক মুহূর্তের জন্যেও আর নীরব নেই। আস্তাবলে, হাতীর দল থেকে থেকে শুড় তুলে ডেকে উঠছে। ঘোড়াগুলো মাটিতে খুর ঠুকে শব্দ করছে।

টম পুরোটা সময় জাবর কেটে পার করে দিলো। ওদের খাতির যত্ন কম করছেন না শাহুজি। সুন্দরি পরিচারিকাদেরকে দিয়ে প্রচুর খাবার আর পানীয় পাঠিয়েছেন। কিন্তু মহলের মূল ভবন ছেড়ে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। টম জানালার ধারে বসে বসে সৈন্য সামন্তের আসা যাওয়া দেখলো, তারপর বিরক্তি ধরে গেলে দাবা খেললো বসে বসে। ফ্রান্সিস মোটামুটি খেলতে পারে। টম সেই ছোট থেকেই দাবা খেলে বড় হয়েছে। তাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো আনার সাথে।

“ইশ যদি বাস্তব জীবনেও একটা দুর্গ দখল করা এতোটা সহজ হতো,” টমের একটা নৌকা খেয়ে দিয়ে বললো অ্যানা। খুঁটিগুলো সব হাতীর দাঁতের বানানো। টম আগে কখনো এরকম খুঁটি দিয়ে দাবা খেলেনি। সবগুলো খুঁটিই হয় হাতী, নাহয় কোনো দেবতা, নাহয় সাধারণ কোনো সৈনিকের মতো করে বানানো। মানে খুঁটিগুলোর পদমর্যাদাও একদম নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

টম মন্ত্রী দিয়ে আক্রমণ করে জবাব দিলো। পরের কয়েক চালেই ও অ্যানার দুটো বড়ে, একটা হাতী আর একটা নৌকা খেয়ে রাজাকে কোণঠাসা করে ফেললো।

“আপনি ঠিক একজন ইংরেজের মতো খেলেন,” অ্যানা বললো। কণ্ঠে মুগ্ধতা। বাকি সব টুপিওয়ালার মতোই আপনি আক্রমণ করতে ভালোবাসেন, ফলাফল নিয়ে অতো ভাবেন না। আর ভারতীয়রা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে ভালোবাসে।”

অ্যানা ওর ঘোড়াটা তুলে একটা চুমু খেলো, তারপর সেটা দিয়ে টমের মন্ত্রীকে খেয়ে দিলো।

“অপেক্ষা খুবই বিরক্তিকর,” টম বললো অ্যানাকে। ওর হাতী বোর্ডের অন্য প্রান্ত থেকে এসে রাজার কোণাকুণি একটা ঘরে স্থির হলো। রাজা চাইলে ওটাকে খেতে পারবে না, কারণ ঘরটাকে পাহারা দিচ্ছে ওর ঘোড়া। ফলে রাজার আর নড়ার জায়গা রইলো না।

“চেকমেট,” হেসে অ্যানাকে বললো টম।

*

শিকারের দিন সকাল বেলা শাহুজির একজন চাকর এসে ওদেরকে ডেকে নিয়ে গেলো। তারপর পালকিতে করে পাহাড় থেকে নিচে নামিয়ে আরো কয়েক মাইল দূরে শাহুজির শিকার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসলো রাজার ডুলিরা। বাড়িটা হচ্ছে একটা নির্মল দিঘির পাশে বানানো কয়েক তলার একটা প্যাগোডা। ওটার সামনে দেয়ালে ঘেরা একটা বাগানও আছে।

টম আর ফ্রান্সিস দুজনেরই শিকারে হাতেখড়ি হাই উইল্ড এস্টেটের বাগানবাড়িতে। সেই পুরনো স্মৃতি ফিরে এলো ওদেরঃ ঢাকের আওয়াজ, শিঙার শব্দ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো উত্তেজনা। তবে এতো বড় পরিসরে কখনো শিকারের সুযোগ হয়নি আগে। কয়েকশো ঢাক দেখা গেলো। বাদ্যকরেরা বাঁশি সহ আরো নানা প্রকার তারের বাদ্য বাজাচ্ছে। পরিচারিকারা সবাইকে লবঙ্গ মেশানো আরক পরিবেশন করছে, এছাড়াও আছে থালা ভর্তি খেজুর আর কাঠবাদাম। হাতীগুলো শান্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে, মাহুতের দেওয়া বিশাল পাতার আটি থেকে একমনে চিবিয়ে যাচ্ছে। ওগুলোর পিঠে সুন্দর নকশাকাটা অনেকগুলো বক্স দেখা গেলো। অ্যানা বললো ওগুলোর নাম নাকি হাওড়াহ।

“ওগুলোতে করে বাঘ মারতে যাবো আমরা, অ্যানা জানালো।

ফ্রান্সিস বিশাল জানোয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। “পড়ে যাবো নাতো?”

“সরাসরি বাঘের মুখে পড়ার চাইতে অন্তত নিরাপদ,” আশ্বস্ত করলো অ্যানা।

প্রথমে ঢাকীর দলে ঢুকে গেলো জঙ্গলের ভিতরে। হাতে লাঠি আর কুড়াল। বাকিরা অপেক্ষা করতে করতে সকালটা ওখানেই কাটিয়ে দিলো। বাদ্যকরেরা বাজানো বন্ধ করে দিলো একসময়; হাসি ঠাট্টা স্তিমিত হয়ে নীরব কথপকথনে রূপ নিলো। সবচে জোরে শব্দ হতে লাগলো শুধু হাতীগুলোর পাতা চাবানোর। সকল শিকারিরা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

“আমাদের কি হাতীর পিঠে চড়ে বাঘের পিছনে ধাওয়া করা উচিত না?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো।

অ্যানা ওর প্রশ্নটা রাজাকে অনুবাদ করে শোনালো।

“জঙ্গলে ঢুকে খুঁজলেই বাঘ পাওয়া যায় না,” রাজা ব্যাখ্যা করলেন। “ওদেরকে আগে ওদের আস্তানা থেকে বের করে আনতে হবে। আমার লোকেরা বনের কয়েকটা জায়গায় মহিষ বেধে রেখেছে। বাঘ ওগুলোকে খেতে আসলেই, ওরা আমাদেরকে খবর দেবে। তখন আমরা সেখানে যাবো।”

শাহুজিকে সেদিন সকালে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেলো। মহলে থাকতে যেকরকম সবসময় চিন্তিত থাকেন এখানে সেরকম নেই মোটেও। অবশ্য একটা ভাবগাম্ভীর্যের মুখোশ পরে আছেন, কিন্তু তবুও শিকারের আনন্দ আর উত্তেজনা লুকাতে পারছেন না। যে লোকটা জীবনের অর্ধেক সময় বন্দী হিসেবে কাটিয়েছে, তার কাছে এই বিশাল জঙ্গলের মাঝে একটা জন্তুকে ধাওয়া করা যে কেমন আনন্দের হতে পারে, তা টম অনুধাবন করতে পারলো।

একজন সংবাদ বাহক প্যাগোডার সামনের খোলা জায়গাটায় দৌড়ে এলো। তার সারা গা ঘামে ভেজা, জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। খবরটা কোনোমতে দিয়েই হাটু মুড়ে বসে পড়লো সে।

শাহুজি তার অতিথিদের দিকে ফিরলেন। উত্তেজনায় চেহারা জ্বলজ্বল করছে তার। এরমধ্যেই চাকরেরা হাতীগুলোতে অস্ত্রপাতি তুলতে শুরু করে দিয়েছে।

“একটা বাঘ মহিষ খেতে এসেছে,” একজন আর একজনকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো সবাই।

টম জীবনে অগণিত হাতী মেরেছে, কিন্তু এই প্রথম একটার পিঠে চড়তে যাচ্ছে। আফ্রিকার যেসব হাতি দেখে অভ্যস্ত ও, এটা সেগুলোর চাইতে ছোট, কিন্তু তবুও দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। হাতীগুলোর দুই চোখের মাঝে লাল রঙের বিশাল একটা বৃত্ত আঁকা হয়েছে। তাতে চেহারায় একটা জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব চলে এসেছে। অভ্যাসবশত টম ওটার দাঁত দুটো মাপতে শুরু করলো আর ভাবতে লাগলো কেপ টাউনে কতোটা নিয়ে ফিরতে পারবে।

মাহুত হাতীটার পেটে চাপড় দিতেই ওটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। টম জানোয়ারটার বাড়িয়ে দেওয়া পিছনের পায়ে ভর দিয়ে ওটার নিতম্বের উপর উঠে এলো, তারপর হাওড়ায় গিয়ে বসলো। একটা ছোট ছেলে এক জোড়া জবরদস্ত বন্দুক নিয়ে উঠে এলো। বন্দুকের গায়ে রুপার খোল পরানো। চোখ কুচকে নলের ভিতর দিয়ে তাকালো টম। বন্দুকটার গতি আর দক্ষতা যে অনেক বেশি, তা দেখেই বোঝা গেলো।

মাহুত দড়াবাজিকরের মতো লাফ দিয়ে হাতীর মাথার দিক দিয়ে উঠে এলো। তারপর ওটার ঘাড়ের ওপর বসে পা দুটো গুঁজে দিলো জানোয়ারটার কানের পেছনে। লোকটা স্পষ্ট কিন্তু নিচু গলায় কিছু একটা বলতেই উঠে দাঁড়ালো হাতীটা। টম পিছনে তাকিয়ে দেখলো অ্যানা আর ফ্রান্সিসও যার যার হাতীতে চড়ে বসেছে। সবার আগে আছেন রাজা। ওনার হাওড়াটার কাঠে দুর্দান্ত সুন্দর নকশা কাটা আর সোনার সুতা দিয়ে বোনা একটা কাপড় দিয়ে মোড়া।

টম কিছুক্ষণের মাঝেই হাতীটার হেলেদুলে চলার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে জঙ্গলের গভীরে এগিয়ে চললো ওটা। জন্তুটার সামর্থের কথা ভাবতেই মনে মনে অবাক হলো টম। যদি হাওড়াটা গাছের কোনো ডালে বাধার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে হাতীটা শুড় বাড়িয়ে সেই ডালটা টেনে ভেঙে দিতে লাগলো। মাঝে মাঝে সরু রাস্তায় পুরো গাছটাকেই ঠেলে ফেলে দিলো। রাস্তায় পানি বা কাদা থাকলে মাথা নামিয়ে শুড় দিয়ে দেখে নিতে লাগলো কোথায় পাড়া দিলে পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

কয়েক মাইল পর একটা শৈলশিরার কাছে এসে উপস্থিত হলো ওরা। ওখানে রাস্তা থেকে নেমে একটা নালা দিয়ে আগাতে লাগলো এরপর। নালাটা আসলে একটা শুকিয়ে যাওয়া নদীগর্ভ। ওখান দিয়ে প্রায় কয়েক মাইল গেলো ওরা। নদী গর্ভের কাদা আর বালিতে নানা প্রজাতির জন্তু জানোয়ারের পদচিহ্ন চিহ্নিত করতে পারলো টম। গাছের ডালে বানর কিচিকিচ করতে লাগলো। নদীর ধার দিয়ে গলা বড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো বন মোরগ। এক ঝাঁক ময়ুর উড়ে গেলো ওদের মাথার ঠিক উপর দিয়ে। সূর্যের আলোয় ওগুলোর নীল রঙের গলা ঝিলিক দিতে লাগলো। দৃশ্যটা দেখে টম হঠাৎ একটা বেদনা অনুভব করলো। নেপচুন তরবারিটার কথা মনে পড়ে গিয়েছে ওর।

নদীর এক জায়গায় একটা ক্ষীণ ধারা এসে মিশেছে, রাজা সেখানে সবাইকে থামতে আদেশ করলেন। হাতীগুলো হাঁটু মুড়ে বসতেই শিকারিরা সব নেমে পড়লো। টম ওর পা সোজা করতে করতে আশপাশটা দেখতে লাগলো। নিচের মাটিতে ওদের শিকারের কোনো চিহ্ন দেখা যায় কিনা সেটা খুঁজছে।

শাহুজির চোখ এড়ালো না ব্যাপারটা। এর আগে কখনো বাঘ শিকার করেছেন?” অ্যানার মাধ্যমে জিজ্ঞেস করলেন উনি।

“সিংহ শিকার করেছি।”

শাহুজি মাথা ঝাঁকালেন। “আমি সিংহ দেখেছি। মুঘল সম্রাট তার মনোরঞ্জনের জন্যে দিল্লির দরবারে কয়েকটা এনে রেখেছিলেন। কিন্তু বাঘ বেশি ভয়ংকর। আকারেও বড়, শক্তিশালী, হিংস্র। সিংহ দলবেধে শিকার করে, কিন্তু বাঘ করে একা একা। তাই ওকে বেশি শক্তিশালী আর ধূর্ত হতে হয়। আমি একটা বাঘকে একটা মহিষ মেরে মুখে করে টেনে নিয়ে যেতে দেখেছি। যেনো একটা বিড়াল ইঁদুর মেরে নিয়ে যাচ্ছে।”

শাহুজি টমের চেহারার অবিশ্বাসী দৃষ্টিটা খেয়াল করলেন। “একবার দিল্লিতে, সম্রাট বাঘ আর সিংহের লড়াইয়ের আয়োজন করেছিলেন। মহল জুড়ে তখন শুধু এই লড়াই নিয়ে আলাপ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামন্তরা জড়ো হতে থাকেন এই অভূতপূর্ব লড়াই দেখার জন্যে। জানোয়ার দুটোকে যখন খাঁচার ভিতর ছেড়ে দেওয়া হয়, দর্শকেরা সবাই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।”

“কে জিতেছিলো?” জানতে চাইলো ফ্রান্সিস।

“এক থাবায় সিংহটাকে মেরে ফেলেছিলো বাঘটা। সিংহের ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গিয়েছিলো। সেখান থেকে রক্তক্ষরণেই পরে মারা পড়ে সিংহটা।” আবারও টম শাহুজির ভূতুড়ে হাসিটা দেখতে পেলো। সর্বোচ্চ এইটুক আবেগই উনি প্রকাশ করেন। “সম্রাট প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। এতোগুলো আমির আর জাগিরদার-তারা সবাই খুব হতাশ হন।”

কথা বলার ফাঁকেই রাজার চাকরেরা ওনার হাওড়াটা হাতীর পিঠ থেকে খুলে, ধরাধরি করে একটা লম্বা গাছে দিকে নিয়ে গেলো। তারপর ওটায় রশি বেঁধে প্রায় দশ ফুট উপরে একটা বেরিয়ে থাকা গাছের ডালে বেঁধে দিলো। পাশে একটা বাঁধলো একটা মই।

“এটা হচ্ছে মাচা,” শাহুজি বললেন। “এখানেই অপেক্ষা করবো আমরা।”

মই বেয়ে উঠে গেলো ওরা। চাকরেরা দুটো হাওড়া পাশাপাশি বেঁধে দিয়েছে। একটা টম আর শাহুজির জন্যে, আর একটা অ্যানা আর ফ্রান্সিসের জন্যে। বন্দুকবাহীসহ বাকি চাকরেরা পিছনের ডালগুলোতে আশ্রয় নিলো। সবাই চোখ বড়বড় করে আশে পাশের জঙ্গলে নজর বুলাচ্ছে।

“বাঘেরা পানি ধরে চলতে পছন্দ করে,” বলতে বলতে শাহুজি অপর পাড়ে যেখানে ধারাটা নদীতে এসে মিশেছে সেটা দেখালেন। “ঢাকীর দল যদি ঠিকমতো তাড়িয়ে আনতে পারে তাহলে এখান দিয়েই আসবে বাঘটা।”

টম বুঝতে পারলো শিকার কেন যুদ্ধযাত্রার জন্যে এতো ভালো প্রস্তুতির কজ করে। জঙ্গলের ভিতর এখন প্রায় আটশো নোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সবাই এক অদেখা শিকারকে খুঁজছে, তাই ওদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষাটা সবচে জরুরি। কারণ একটা সারিও যদি একটু এগিয়ে বা পিছিয়ে যায়, তাহলে মাঝে যে ফাঁকটা সৃষ্টি হবে, সেটা দিয়েই বাঘ বেরিয়ে যেতে পারবে। যদি বাঘ দিক পরিবর্তন করে, তাহলে পুরো সারিটাকেই ঘুরে যেতে হবে। এর ফলে সবার মাঝে যে বোঝাঁপড়ার সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন দলপতির মাঝে একইভাবে আদেশ গ্রহণ ও হস্তান্তরের মাধ্যমে পুরো দলটাকে দিয়ে সেটা পালন করানোর যে অনুশীলন হচ্ছে-সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে অমূল্য কাজে দেবে।

মাহুতেরা হাতীগুলোকে বনের দিকে নিয়ে গেলো। “ওরাও ঢাকীদের সাথে যোগ দেবে,” শাহুজি বললেন। “হাতীগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়া আছে। ওরা গাছের ডাল ভেঙে, শুড় দিয়ে খুঁড়িতে বাড়ি দেবে। শব্দে বাঘ ভয় পেয়ে যাবে।”

বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ওরা। জঙ্গল জুড়ে নানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কানের পাশে নানান পোকা ডাকতে ডাকতে ওদের গা বেয়ে উঠতে লাগলো। যতোটা সম্ভব স্থির থাকার চেষ্টা করলো টম একটা নীলগাই নদীর ধারে ঘুরে বেড়ালো কিছুক্ষণ। টম ওটার দিকে বন্দুক তাক করলো কিন্তু গুলি অপচয় করলো না।

“আংরিয়ার সাথে আমার শত্রুতা অনেক পুরনো,” হঠাৎ বলে উঠলেন শাহুজি। “আপনি সেটা জানেন নাকি?”

টম মাথা নাড়লো।

“আংরিয়া জলদস্যু হওয়ার আগে আমার নৌবাহিনির ক্যাপ্টেন ছিলো। মুঘলরা আমাদেরকে ডাঙায় শায়েস্তা করছিলো বারাবার, সমুদ্রই তাই তখন ছিলো আমাদের আশ্রয়স্থল। যোগাযোগ আর রসদপত্রের জন্যে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলাম এই পথের উপর। কিন্তু যখন আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো, আংরিয়া তখনই আমাদের সাথে বেঈমানি করে বসলো। ও বিদ্রোহ করে ওর নিয়ন্ত্রণে থাকা জাহাজ আর নলাকজন নিয়ে ভেগে যায়। তারপর টিরাকোলায় আমাদের সৈন্যদের পরাস্ত করে ওটর দখল করে নেয়। এরপর থেকেই ও উপকূল জুড়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে চলেছে। আমাদের দুর্গগুলো অবরোধ করতে থাকে, জাহজগুলো লুট করতে থাকে। এদিকে মুঘলেরাও আমাদের হাত থেকে সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নিতে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করছিলো তখন। আমি ওকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। সমুদ্রে ওর নিজস্ব অরাজক সাম্রাজ্য সৃষ্টির লোভের কারণে আমাদের পুরো সাম্রাজ্য হারানোর উপক্রম হয়েছিলো।”

শাহুজি আঙুল দিয়ে তার বন্দুকের বাটের উপর টোকা দিতে লাগলেন।

“তারপরেও ওকে ক্ষমা করে দিতাম। সাম্রাজ্যের খাতিরে আমাদের ঝামেলাটা ছেড়ে দিতে রাজি ছিলাম আমি। শান্তি প্রস্তাব দিয়ে প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিলাম। ও কি করেছিলো জানেন?”

এমনকি স্মৃতিটা মনে পড়তেও তার চেহারা রাগে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

“ও আমার লোকদের ফেরত পাঠায়। তবে তার আগে তাদের চোখ উপড়ে নেয় আর লোহা পুড়িয়ে কপালে ওর প্রতীক এঁকে দেয়। কপালের চামড়া পুড়ে খুলির হাড় বেরিয়ে পড়েছিলো লোকগুলোর। এমনকি মস্তিষ্কে পর্যন্ত সমস্যা হয়ে যায়। ওরা এখন আবার ছোট বাচ্চার মতো হয়ে গিয়েছে। কথা বলতে পারে না, কাপড়েই পেশাব পায়খানা করে দেয়।”

সারাহ আর অ্যাগনেস যে এই রকম মানসিকতার একজনের কাছে বন্দী এই চিন্তাটা টম জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিলো।

“আংরিয়াকে হাতীর পায়ের নিচে পিষে মারতে পারলে সবচে খুশি হতাম আমি,” শাহুজি বলতে লাগলেন। “দিল্লিতে মুঘল সম্রাট এভাবে মাঝে মাঝে ওনার শত্রুদের মৃত্যুদণ্ড দিতেন। আমি আপনাকে সত্যিটা বলছি। আমাকে রাজমুকুট পরিহিত অবস্থায় শ’খানেক পরিষদ নিয়ে বসে থাকতে দেখে যদি ভাবেন যে আমি মহান মানুষ, তাহলে ভুল করছেন।”

বলে শাহুজি নিজের বুকে থাবা দিলেন। “হ্যাঁ, আমি মহান। আমি পবিত্র পৈতা ধারণ করেছি, আমি হচ্ছি ছত্রপতি, মারাঠাদের সম্রাট। তবুও…” ওনার চেহারায় শোকের ছায়া নামলো। “আমার মহলের বাইরে আমার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। গৃহযুদ্ধে প্রতিটা লোকের আসল চেহারা খুলে যাচ্ছে। আমি যদি টিরাকোলা আক্রমণ করে ব্যর্থ হই, তাহলে সেটা আমার সামর্থ্যের প্রমাণের উপর কুঠারাঘাত করবে।”

“গাই কোর্টনীও একই কথা বলে,” ফ্রান্সিস বললো। “উনি মনে মনেই নিজেকে শক্তিশালী ভেবে মজা পান। সেটা প্রমাণ করার ঝুঁকি নিতে চান না।”

ফ্রান্সিস ঝোঁকের বশে বলে ফেলেছে কথাটা। কিন্তু শাহুজি কিছু মনে করলেন না। “যখন বড় হবে, তখন বুঝবে যে অনেক সময় ক্ষমতা জাহির করাটা, আসলে ক্ষমতা থাকার চাইতে জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।”

“কিন্তু ক্ষমতা থাকার পরেও যদি ব্যবহার না করেন, তাহলে সেটা আসলে কোনো ক্ষমতাই না,” টম বললো।

শাহুজি উত্তর দিলেন না। একটা নতুন শব্দ জঙ্গলের এতোক্ষণের হট্টগোলকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। একটানা ছন্দময় দ্রিম দ্রিম শব্দ। যেনো এক হাজার কামার একসাথে তাদের হাতুড়ি দিয়ে লোহার ওপর পেটাচ্ছে। টম একবার ভাবলো এটা আবার কোনো অচেনা প্রজাতির পাখি কিনা। তারপর শাহুজির প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারলো এ হচ্ছে ঢাকের আওয়াজ। বাঘকে ভয় দেখিয়ে মাচার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। টমের কাছে ওটা শুধুই সাধারণ একটা আওয়াজ। কিন্তু খেয়াল করলো শাহুজি কান পেতে শব্দটা শুনছেন। শব্দটা কতোটা আগালো তার নিখুঁত হিসাব রাখছেন।

ওদের বাম পাশে হাত তালি আর হৈচৈয়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। গাছের মাথায় বসা লোকগুলো করছে কাজটা। বাঘটা যাতে রাস্তা ছেড়ে দিক না বদলায় সেজন্যে এই ব্যবস্থা। শাহুজি একটা বন্দুক তুলে নিলেন। টম, ফ্রান্সিস আর অ্যানাও একই কাজ করলো। টম টের পেলো ওর রক্তে শিকারের উত্তেজনা পাক দিয়ে উঠছে।

জঙ্গল জুড়ে ভয়ংকর একটা গর্জন ছড়িয়ে পড়লো। গাছে মাথার লোকগুলোর আওয়াজ বাড়লো আরো। তাতে করে বাঘ চাইলেও নদীপথ ছেড়ে অন্য কোনোদিকে যেতে পারলো না। স্বর্ণালি সূর্য কিরণের মতো বাঘটা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। টম জানোয়ারটা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হলো যে হাতের বন্দুকটার কথাও খেয়াল থাকলো না। জন্তুটা বিশাল, কিন্তু সেই বিশাল শরীরের তুলনায় এতো দ্রুত চলছে যে ওটার সঠিক মাপ সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব না। তবে আফ্রিকায় দেখা যে কোনো সিংহের চাইতে যে বড় তা ও নিশ্চিত।

বাঘটা লাফ দিয়ে নদীবক্ষে নেমে এলো। হাতীর উপর থেকে নেমে ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেটা থেকে মাত্র বিশ কদম মতো দূরে। সামনে মানুষের গন্ধ পেয়ে দাঁত খিঁচিয়ে গরগর করে উঠলো জানোয়ারটা। তারপর ঘুরে গেলো। ওটার ঘাড়ের সাদা চুলগুলো খাড়া হয়ে আছে। গর্জন করতেই ঝিকিয়ে উঠলো ওটার তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো।

এতো কাছ থেকেও গুলি লাগানোটা খুব কষ্টকর ছিলো, কিন্তু রাজা গুলি করে বসলেন। টম গুলিটা লাগতে দেখলো, জন্তুটার শোল্ডার ব্লেডের অনেক পিছনে। ভারী গুলিটার আঘাতে জানোয়ারটা গড়িয়ে পড়লো মাটিতে, কিন্তু একই মুহূর্তে ডিগবাজি দিয়ে আবার ওটা চারপায়ে খাড়া হয়ে গেলো। তারপর যেনো কিছুই হয়নি এমনভাবে চলে যেতে লাগলো। টম আর ফ্রান্সিস একযোগে গুলি করলো। কিন্তু বাঘ খুব দ্রুত ছোটা শুরু করেছে, তাই ওদের বুলেট কয়েক ফুট পেছনে মাটিতে লেগে ধুলো আর শুকনো পাতা ছেটানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। বাঘটা বনের ধারে পৌঁছে উধাও হয়ে গেলো।

শাহুজি গাছ থেকে লাফিয়ে নামলেন। পড়ে ব্যথা পাবেন কিনা সে খেয়াল নেই। তারপর বাঘটা যেখানে গুলি খেয়ে ডিগবাজি দিয়েছিলো সেখানে ছুটে গিয়ে মাটিতে রক্তের দাগ খোঁজা শুরু করলেন।

“বাঘটা আহত হয়েছে,” ঘোষণা দিলেন রাজা। “কিন্তু মরেনি। আর আহত বাঘ সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর।”

“এখন কি করবো আমরা?” জানতে চাইলো টম।

“একে তো আহত, তার উপর ধাওয়া খেয়ে বাঘটা খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকার কথা। কাছেই একটা জলা আছে। আমার মনে হয় ওটা ওখানেই যাবে।”

অ্যানা অনুবাদ শেষ করার আগেই মাহুতগুলো হাতী নিয়ে হাজির হয়ে গেলো। এখন আবার হাওড়া বাধার সময় নেই। পিঠের উপর শুধু কম্বল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা হাতীর পিঠে চড়ে, ওটার পেট পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা একটা রশি ধরে নিজেদেরকে পতনের হাত থেকে বাঁচালো। জানোয়ারটা লম্বা পা ফেলে আবার ঢুকে গেলো জঙ্গলের ভিতরে।

কিছুক্ষণ পরেই ওরা বনের ভিতরের সরু রাস্তাটা পেরিয়ে চওড়া একটা ঘাসবনের ভিতরে এসে ঢুকলো। ওখানে ঘাস এতো বড় যে হাতীর পেটে ঘষা লাগতে লাগলো। টমের মনে হতে লাগলো ও যেনো একটা জাহজের উপর আছে। বরফে ভরা সাগরের ভিতর দিয়ে চলছে ওরা। নিজের বন্দুকটা চেপে ধরে সামনে মাটিতে কোনো রক্তের দাগ বা বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায় কিনা সেই চেষ্টা করতে লাগলো ও। জানে যে বাঘটাকে দেখা যাবে না, লুকিয়ে থাকবে সে। এই লম্বা ঘাসের আড়ালে ওটার গায়ের ভোরাগুলো নিখুঁতভাবে মিশে যাবে।

একজন শিকারি হাতীগুলোর আগে আগে দৌড়ে যাচ্ছিলো। আচমকা সে চিৎকার দিয়ে সামনের মাটিতে কিছু একটা দেখাতে লাগলো। কিন্তু গতি কমালো না একটুও।

“বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে,” অ্যানা জানালো।

মাহুতেরা লাঠি মেরে হাতীগুলোর গতি বাড়িয়ে দিলো। একটু পরেই ঘাস শেষ হয়ে গিয়ে খালি মাটির এলাকা শুরু হলো। অসংখ্য খুর আর থাবার ছাপ দেখা গেলো ওখানে। হাতীর পিঠের উপর বসে থেকেও টম এর মাঝে বাঘের ছাপগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলো। ওটার সদ্য রেখে যাওয়া ছাপগুলোয় নিচ থেকে পানি উঠে জমা হচ্ছে। আর জানোয়ারটার রক্তক্ষরণও হচ্ছে। উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় চুনির মতো জ্বলজ্বল করছে রক্তের ফোঁটাগুলো।

“বাঘটা পুরুষ। যুবক। চোদ্দ বছর মতো বয়স। সামনের বাম পায়ের বুড়ো আঙুলটা নেই,” গড়গড় করে বলে গেলেন শাহুজি। অ্যানা অনুবাদ করে শোনালো।

টম রাজার দিকে চেয়ে মাথা ঝোকালো। হাতীর পিঠে চড়ে থেকেও মাত্র কয়েক ঝলক দেখায় এতো কিছু বলে ফেলতে পারাটা রাজার শিকারের অনবদ্য দক্ষতার কথাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

একটা কাদাময় গর্তের কিনারে গিয়ে ছাপগুলো শেষ হলো। ওটার অর্ধেক পানিতে ভরা। এক জোড়া বাজ, পাতা ঝরা একটা গাছের মগডাল থেকে লক্ষ্য করছে ওদের দিকে। কিন্তু বাঘটা কোথাও নেই।

যেকোনো সময় আক্রমণের আশংকায় টমের দেহের প্রতিটা স্নায়ু টানাটান হয়ে থাকলো। এটাই হচ্ছে শিকারের অভিভুতকারি শিহরণ। যেদিন ওর বাবা প্রথম ওর হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছিলেন, সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত এক ফোঁটা নেশা কমেনি।

বাঘটা কাছে পিঠেই আছে। হাতীগুলো ওটার ঘ্রাণ পাচ্ছে।

দুশ্চিন্তাগ্রস্তের মতো গা ঝাড়ি দিতে লাগলো হাতীগুলো। গুড় দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। এভাবে নড়লে চড়লে শিকারিদের পক্ষে ঠিকমতো নিশানা করে লাগানো সম্ভব হবে না। শাহুজি পিছলে নেমে এলেন হাতীর পিঠ থেকে। টম আর ফ্রান্সিস ওনাকে অনুসরণ করলো।

শাহুজি ওনার শিকারের লোকদের সাথে পরামর্শ করলেন। “সামনে আরো একটা জলা আছে। আর একটু উত্তরে,” অ্যানা অনুবাদ করে শোনালো। “ওটা দিয়ে গেলে একটা গিরিখাত হয়ে অন্যপাশের উপত্যকায় পৌঁছা যাবে। বাঘটা আমাদের হাত থেকে বাঁচতে সেদিক দিয়ে যেতে পারে।”

ওরা কথা বলতে বলতেই ওদের কাছাকাছি পৌঁছে গেলো ঢাকীর দল। কয়েক মিনিট পরেই দেখা গেলো কয়েকশো অর্ধনগ্ন লোক ঢাক আর লাঠি হাতে ফাঁকা জায়গাটায় উপস্থিত।

রাজার হাতীটা পিপাসার্ত হয়ে ছিলো। কোনো সংকেত না দিয়েই ওটা দিঘিটার কিনারে গিয়ে পানিতে শুড় ডুবিয়ে খেতে শুরু করলো। মাহুত চিৎকার করে ওটার রশি ধরে টান দিলো; আরো একজন চাকর এগিয়ে এলো ওকে সাহায্য করতে। কিন্তু তবুও ওটাকে নড়ানো গেলো না। শব্দ পেয়ে, কি হয়েছে দেখার জন্যে হাতীটার দিকে ফিরলো সবাই।

শিকারিদেরকে শিকারে পরিণত করতে ঠিক সেই মুহূর্তটাকেই বেছে নিলো বাঘটা। কয়েকটা ছোট গাছের চারার পেছনে লুকিয়ে ছিলো ওটা এতোক্ষণ। চারাগুলো মানুষের হাঁটুর চাইতে বড় হবে না, খুবই পাতলা। এর পিছনে এতো বড় একটা জানোয়ার লুকিয়ে ছিলো-বিশ্বাসই হতে চাইলো না টমের। এমনকি আফ্রিকার সিংহের মাঝেও ও এরকম গতি দেখেনি। সাদা লম্বা গোফগুলো খাড়া খাড়া হয়ে আছে, প্রচণ্ড আক্রোশে মুখব্যাদান করে আক্রমণ করে বসলো বাঘটা। লেজটা একটা বাঁকা তরবারির মতো পিঠের উপর সোজা হয়ে আছে। থাবাগুলো একেকটা স্যুপের বাটির সমান। সেগুলো পুরোটা সামনে ছড়িয়ে মাটি দাবিয়ে ছুটে এলো সামনে। একটা মাহুতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘটা। এক থাবায় লোকটার মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে গেলো। হতভাগ্য লোকটা পিছন দিকে দুই ভাজ হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে।

কিন্তু বাঘটা লাশের দিকে কোনো নজরই দিলো না। পরের লাফে ওটা একজন পলায়নরত লোকের উপর গিয়ে পড়লো। এক কামড়ে তার মাথাটা ছিঁড়ে ফেললো বাঘটা; আরো একজন শিকার হলো ওর, আরো একজন। মুহূর্তে নরক গুলজার হয়ে গেলো জায়গাটায়। মানুষজন সব চিৎকার করে ছুটে পালাতে লাগলো, হাতীগুলোও ভয় পেয়ে আর্ত রব ছাড়তে ছাড়তে এদিকে সেদিকে দৌড় দিয়ে পায়ের নিচে পিষে মারলো কয়েকজনকে।

টম একপাশে দৌড়ে গেলো। বাঘের দিকে নিশানা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু লোকজন আতংকিত হয়ে উল্টোপাল্টা ছোটাছুটি করতে থাকায় তাক করতে পারলো না, বরং কয়েকজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে মরার জোগাড় হলো। টম দেখলো ফ্রান্সিস ওর বন্দুক তুলে উন্মত্ত জানোয়ারটার দিকে গুলি করলো। কিন্তু গুলি করার আগ মুহূর্তে একজন ঢাকী ওর সামনে চলে আসায় গুলিটা গিয়ে লাগলো লোকটার বুকে। মাটিতে পড়ার আগেই মারা গেলো সে। হাত থেকে ছুটে পড়ে গেলো তার ঢাকটা।

শাহুজি এতো কিছুর মাঝেও নিজের জায়গা ছেড়ে নড়েননি। নিজের বন্দুকটা উপরে তুলে ধরে বাঘটাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্যে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন; “এদিকে আয় শয়তান! তোকে আমি তোর শয়তান প্রভুগুলোর কাছে ফেরত পাঠাবো। আয় এদিকে।”

বাঘটা মনে হলো তার ডাক শুনতে পেয়েছে। কারণ এরপরেই ওটা সোজা তার দিকে দৌড় দিলো। প্রচণ্ড একটা হুঙ্কার ছাড়লো বাঘটা, যেনো শাহুজির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। দাঁতগুলো ওটার থাবায় মরা মানুষগুলোর রক্তে লাল হয়ে আছে। সেগুলো বের করে রেখেই ছুটে এলো জানোয়ারটা। শাহুজি সামনে ঝুঁকে বন্দুকের বাটটা নিজের কাঁধে ঠেকালেন। ট্রিগারে আঙুল স্থির। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন।

ঠিক তখনি টম দেখতে পেলো যে শাহুজি হাতীটা খেয়াল করেননি। এটা হচ্ছে সেই হাতীটা যেটা দিঘিতে পানি খেতে গিয়েছিলো। এখন বাঘের গন্ধ আর গর্জনে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে। অন্ধের মতো সোজা রাজার দিকে ছুটছে।

টম চিৎকার করে ডাকলো রাজাকে। কিন্তু রাজার সমস্ত মনোযোগ তখন তার সামনে আগুয়ান হিংস্র শার্দুলটার দিকে। হাতীটাও শুড় দিয়ে ক্রমাগত বাঘটার গন্ধ পাচ্ছে, আর কানে ওটার গর্জন বাজতে থাকায়, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে পাত্তা দিলো না। ওটার সামনের উদ্যত পা-টা সোজা শাহুজির পিঠে গিয়ে লাগলো। শাহুজি বাতাসে উড়ে প্রায় পনেরো ফুট দূরে গিয়ে পড়লেন। গুলিভরা বন্দুকটাও ছিটকে গেলো হাত থেকে। ওটা উড়ে গিয়ে পড়লো অ্যানার পায়ের কাছে। ও দ্রুত সেটা তুলে নিলো হাতে।

হাতীটা লম্বা ঘাসের জায়গাটার দিকে ছুটে চলে গেলো। বাঘটা যখন দেখলো যে সামনে আর রাজা নেই, তখন ওটা দৌড় থামিয়ে নতুন কোনো শিকারের সন্ধানে মাথাটা ডানে বামে ঘুরাতে লাগলো।

ফ্রান্সিসের দিকে নজর গেলো বাঘটার। গর্জন ছেড়ে ওর দিকে ধাওয়া দিলো এবার। ফ্রান্সিস ওর অস্ত্রটা তাক করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। ওর চোখের উদ্ৰান্ত দৃষ্টি আর ফ্যাকাশে চেহারা দেখেই টম বুঝলো যে ফ্রান্সিসের মাথা কাজ করছে না। সম্ভবত এর আগে কখনো এতো ভারী বন্দুক চালায়নি ফ্রান্সিস। আর জীবনে কখনো এরকম আক্রমণোদ্যত কোনো শিকারি প্রাণীর সামনে তো পড়েই নি।

টম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে গুলি করে বাঘটাকে লাগানো সম্ভব না; তার উপর অ্যানা ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ফ্রান্সিসের জীবন বিপদাপন্ন, তাই শেষ সম্ভাবনাটুকুও কাজে লাগাতে হবে। ও নিজের বন্দুকটা তুলেই গুলি করলো। কিন্তু সাথে সাথে টের পেলো কিছু একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। বন্দুকের নল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, কিন্তু ওটার বাট ওর গায়ে কোনো ধাক্কা দিলো না। হয় ওর সাথের শিকারি গুলি ভরতে ভুলে গিয়েছে, অথবা হাতীর পিঠ থেকে নামার সময় ঝুঁকিতে গুলিটা পড়ে গিয়েছে।

ঘটনা যেটাই হোক, বাঘটা এখনো আগের গতিতেই ফ্রান্সিসের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। একদম শেষ মুহূর্তে মনে হলো ফ্রান্সিস ওর সাহস ফিরে পেয়েছে। ও নিজের বন্দুকটা উপরে তুলেই গুলি করলো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ও তাকিয়ে ছিলো বাঘটার দিকে, বন্দুকের নিশানা যে ঠিক কোনদিকে পড়েছে সে খেয়াল ছিলো না। গুলিটা বাঘের তিন-চার ফুট বাম দিয়ে ছুটে আরো ছয়ফুট পিছনে মাটিতে গিয়ে গাঁথলো।

ফ্রান্সিস আর উপায়ন্তর না দেখে বন্দুকটা ফেলে ঘুরে দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু বাঘটা ততোক্ষণে ওর দিকে ঝাঁপ দিয়েছে। মুখটা হাঁ করে খোলা, সামনের দুই থাবা ওর দিকে প্রসারিত। ফ্রান্সিস অসহায়ের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে চিৎকার করে বললো, “না! না!”

আর একটা গুলির শব্দ কাঁপিয়ে দিলো চারপাশ। বাঘটাকে দেখে মনে হলো বাতাসে থাকতেই একটা ঝাঁকি খেলো যেন। কিন্তু ওটার ভরবেগ ওটাকে ঠিকই ফ্রান্সিসের উপর নিয়ে ফেললো। ধাক্কায় মাটিতে আছড়ে পড়লো ফ্রান্সিস। আর জটাও পড়লো ওর উপর।

টম প্রায় সাথে সাথেই ওদের কাছে পৌঁছে গেলো। বাঘের মাথাটা টেনে ধরলো ওতারপর কিভাবে ঐ তাগড়া দেহটা ফ্রান্সিসের উপর থেকে টেনে সরালো ও নিজেও জানে না।

“তুমি ঠিক আছো?” চিৎকার করে জানতে চাইলো টম।

“মনে তো হচ্ছে,” ফ্রান্সিস হামাগুড়ি দিয়ে বাঘের তলা থেকে বেরিয়ে এলো। “আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। ধন্যবাদ চাচা।”

“আমি না! আমার বন্দুকেতো গুলি-ই ছিলো না…” বলে টম আশেপাশে তাকালো। আর তখনি প্রথমবারের মতো অ্যানাকে চোখে পড়লো। ওদের ওখান থেকে দশ ফুট মতো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ও। তখনও রাজার লম্বা বন্দুকটার বাট ওর কাঁধে ঠেকানো। নীলচে একরাশ ধোয়া বন্দুকের নল থেকে উড়ে যাচ্ছে।

“অ্যানা দুয়ার্তে!” টম ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁপতে থাকা হাত থেকে বন্দুকটা নামিয়ে নিলো। “তুমি গুলি করেছিলে?” অ্যানা মাথা ঝাঁকালো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। “একজন পুরুষ মানুষও এটার জন্যে সারা জীবন গর্ব করবে।” টম বললো।

টম আবার ফিরে এসে বাঘের মাথাটা দুই হাত দিয়ে মুচড়ে উল্টো করে ধরলো। অ্যানার গুলিটা সোজা জন্তুটার কপালে লেগেছে। ঘিলু ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছে ওটা।

“আর একজন মহিলার এরকম গুলির জন্যে দ্বিগুণ গর্ব করা উচিত।”

“আমার এটা ছাড়া আর উপায় ছিলো না; ফ্রান্সিস ছাড়া আমার আর কেউ নেই,” কান্না সামলাতে সামলাতে বললো অ্যানা।

*

চিত্তিত্তিঙ্কারায় রানির মহলে প্রবেশ করতেই টমের গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। এখানে যারা যারা মারা পড়েছে তাদের কথা মনে পড়লো ওর। ক্যাপ্টেন হিকস, লরেন্স ফয় সহ আরো অনেকে। তারপরেই ওর মনে হলো ঘটনাগুলো আসলে স্বপ্ন ছিলো কিনা। দেয়ালের বুলেটের ছিদ্রগুলো বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। পাথরের গায়ে লেগে থাকা রক্তের দাগও আর নেই। ভেঙে পড়া ব্যালকনিটা ঠিকঠাক করা হয়েছে। এখানে যে যুদ্ধ হয়েছিলো তার একমাত্র প্রমাণ হলো দেয়ালে করা নতুন প্রাস্টার। সেদিনের হত্যাকাণ্ডের কথা মনে আসতেই প্রচণ্ড রাগ হলো ওর।

দরবার ঘরটাও অনেকগুলো তিক্ত স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো। গতবার যখন এসেছিলো, তখন এখানে নেপচুন তরবারিটা নিয়ে টুঙ্গারের সাথে লড়াই করতে গিয়ে প্রায় মরতে বসেছিলো। আর এবার রানি নিজে ওকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেলেন। যেনো ওদের মাঝে কিছুই হয়নি। শাহুজির মতো ইনিও যা কিছু রাজ্যশাসনের জন্যে ঝামেলাপূর্ণ তা ভুলে যেতে সিদ্ধহস্ত। আসলে সব শাসকেরই এই গুণটা থাকে। টম ভেবে পেলো না ও কি এজন্যে রানিকে করুণা করবে নাকি ঈর্ষা করবে।

তবে এসব বাজে চিন্তায় বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করলো না ও।

“সাতারার রাজা, ছত্রপতি শাহুজির পক্ষ থেকে এসেছি আমি। আমার জাহাজ থেকে যে কামানগুলো উদ্ধার করেছিলেন সেগুলো ফেরত নেওয়ার জন্যে পাঠিয়েছেন উনি। ব্রিঞ্জোয়ানের কাছেই ওনার পাঠানো জাহাজ অপেক্ষা করছে। আপনি ওগুলো দিয়ে দিলেই ওটায় করে নিয়ে যাওয়া হবে।” এই জাহাজে করেই টম সাতারার কাছের সৈকত থেকে এখানে এসেছে। ফ্রান্সিস আর অ্যানা থেকে গিয়েছে শাহুজির মহলে। শাহুজি টিরাকোলা দুর্গ অবরোধের জন্যে নিজের সৈন্যদল প্রস্তুত করছেন।

টমের রাগ দেখে রানি হাসলেন। হাসলে তাকে এতো সুন্দর দেখায় যে এক মুহূর্তের জন্যে টম সব ভুলে থমকে গিয়েছিলো।

“কামানগুলো আমি উদ্ধার করেছি, তাই ওগুলো আমার,” রানি ব্যাখ্যা করলেন। “এই উপকূলে যত জাহাজডুবি হয়, সেগুলোর মালামালসহ সব আমার।” বলে উনি এক হাত তুলে টমকে কিছু বলা থেকে নিবৃত করলেন। “ক্যাপ্টেন কোর্টনী, আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। বরং আমি কেন যেনো আপনার প্রতি একটা অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ করি। তাই যদি আমার সামর্থ্য থাকতো তাহলে আমি কোনো ধরনের বাহানা ছাড়াই সবগুলো কামান আপনাকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে ওগুলো আর আমার কাছে নেই। আমার সৈন্যরা যখন ব্রিঞ্জোয়ানের অবরোধ ছেড়ে পালিয়ে আসে, তখন তারা কামানগুলোও ওখানে ফেলে আসে। পর টুপিওয়ালারা ওগুলো নিয়ে নেয়। আমি শুনেছি ওগুলোকে ওরা ওদের দুর্গের দেয়ালে লাগিয়েছে।”

টম মনে মনে অভিশাপ দিলো ভাগ্যকে। এমনটা হবে সেটা ধরেই রেখেছিলো, কিন্তু তবুও রানির কাছে আগে এসেছে যদি ওর ধারণা ভুল হয়, সেই আশায়। আর গাই যদি বোম্বে থেকে ওর পালানোর খবর এখানে পাঠিয়ে থাকে, তাহলে কামানগুলো আনতে ব্রিঞ্জোয়ানে গেলে যে সমাদর পাবে না তা বলাই বাহুল্য।

“এতো কষ্ট করে আমার কাছে আসার পরেও আপনার সময় নষ্ট হলো দেখে খারাপ লাগছে,” রানি বললেন। “কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি আসলে আপনার সাথে আবার দেখা হওয়ায় মন থেকে খুশি হয়েছি। আর কোনোভাবে কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?” বলে রানি নিজের সিংহাসনে ঝুঁকে এলেন। এতে তার স্তনযুগলও আরো বেশি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো।

“আর একটা ব্যাপার।” ওর প্রতি রানির এই পরিবর্তিত মানসিকতা টমকে একটু অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। তাই ও ঠিক করলো এটার পুরো সুবিধা আদায় করবে। আপনার সেনাপতি টুঙ্গার আমার একটা তরবারি কেড়ে নিয়েছিলো। ওটা আমার পরিবারের ঐতিহ্য। তরবারিটার সাথে আমার অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে। স্বর্ণের গিলটি করা ছিলো তরবারিটায়। হাতলে ছিলো একটা বিশাল নীলকান্তমণি।”

“আমি চিনি ওটাকে।” মাথা ঝাঁকালেন রানি। সত্যিই দুর্দান্ত ছিলো তরবারিটা। টুঙ্গার ওটা সবাইকে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াতো। অবরোধের সময়েও ওর সাথেই ছিলো ওটা।”

“হ্যাঁ,” টম বললো। “টুঙ্গার মারা যাওয়ার পরে তার লাশটা আমি ব্রিঞ্জোয়ানের কাছেই খুঁজে পাই। কিন্তু অস্ত্রটা ওর কাছে ছিলো না।”

“আপনাদের কেউ হয়তো নিয়ে নিয়েছে।”

“আমিই সবার আগে ওর লাশটার কাছে পৌঁছেছিলাম। যদি কেউ নিয়ে থাকে তো আপনার সৈন্যদের কেউই নিয়েছে।”

রানি হাত নেড়ে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলেন। টম তার হাতটা খেয়াল করলো; ওগুলো দারুণ সুন্দর, ঠিক তার চেহারার মতোই। “আমার কোনো প্রজা আমার কাছে থেকে এরকম কিছু লুকিয়ে রাখার সাহস করবে না। একজন কৃষক এরকম একটা অস্ত্র দিয়ে করবেই বা কি? আর আমার চোখ এড়িয়ে এতো দামি একটা জিনিস বিক্রি-ইবা করবে কার কাছে? আর যদি ওটা পাওয়া না যায়, তার মানে ওটা হয় সাগরের ভেসে গিয়েছে, নয়তো কেউ লুট করেছে।”

টমের উত্তরটা মনঃপুত হলো না। যদিও ও জানে যে রানি ঠিকই বলছেন। আর একটা প্রশ্ন আছে ওর।

“আপনার দলে একজন লোক ছিলো-লোকটা শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলতে পারতো, আর একটা অদ্ভুত তরবারি ছিলো তার। অনেকটা চাবুকের মতো। তার কি হয়েছে?”

“ওর নাম ছিলো আৰসালম। শেষদিন যুদ্ধের পর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ওর। আমরা ওর লাশও খুঁজে পাইনি। হয়তো দুর্গের ফটকের কাছে যে বিস্ফোরণ হয়েছিলো সেটায় চাপা পড়েছে।”

রানির কথাগুলো টমকে কেনো যেনো খুব কষ্ট দিলো। অবশ্যই একজন ডাকাতের মৃত্যুতে ওর কিছুই আসে যায় না। কিন্তু তবুও কেন যেনো মন মানতে চাইলো না। আবসালম নামের লোকটার সাথে ওর কিছু দেনা পাওনা ছিলো-ক্যাপ্টেন হিকসের মৃত্যুর বদলা নেওয়া তো আছেই। কিন্তু সেই সাথেও কিছু আছে।

টম যাওয়ার জন্যে ঘুরলো।

“দাঁড়ান,” আদেশ না অনুরোধের সুর রানির গলায়। টম থেমে দাঁড়ালো। “অনেক টুপিওয়ালাই ভারতে এসে সৈনিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন।”

“আমি সাতারার রাজার হয়ে কাজ করি,” টম জবাব দিলো।

“উনি যতো টাকাই দিক আমি তার তিনগুণ দেবো। আমার রাজ্যের একজন উচ্চ ক্ষমতাসীন হতে পারবেন আপনি। আপনার আর জীবনে কিছুই লাগবে না।”

রানির গাল হালকা লাল হয়ে গিয়েছে। তার অলংকারে ভরা হাতটা ওনার গলা আর স্তনযুগলের মাঝের উপত্যকায় স্থির হয়ে আছে।

“আমার সাথে থাকুন, টমাস কোর্টনী।” রানির গলা খাদে নেমে এসেছে। “আমার আপনাকে দরকার।”

কামনা আর অপরাধবোধ দুদিক থেকে টেনে ধরলো টমকে। মনে হলো ওর চেতনার ভিত্তিমূল ধরে ঝাঁকি দিয়েছে কেউ। রানি খুব বেশি সুন্দর, কিন্তু একই সাথে খুব বেশি শয়তানি তার মনের ভিতর।

টম নিজের টুপির প্রান্ত ধরে মার্জিতভাবে কুর্নিশ করলো। “দুঃখিত, মহামান্য। আমাকে যে এখন আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে যেতে হবে।”

*

ব্রিঞ্জোয়ানের কুঠিতে আবার এসে রানির মহলের চাইতেও বেশি অবাক হলো টম। ফটকের প্রহরী ওর দিকে এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো যেনো ও কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা।

“মিস্টার উইল্ড?” কথা জড়িয়ে গেলো প্রহরীর।

টম ওকে চিনতে পারলো। অবরোধের পরেও বেঁচে যাওয়া সিপাহীদের একজন। ও লোকটার নাম মনে করার চেষ্টা করলো। “আকাল?”

টম ওকে চিনতে পারায় প্রহরীর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “স্বাগতম সাহেব।”

“নতুন গভর্নর এসে গিয়েছেন?”

“তিন সপ্তাহ আগে এসেছেন।” দাঁত বের করে বললো আকাল। যেনো এটা খুব হাসির কিছু। “তবে আমার মনে হয় না উনি আপনাকে দেখে খুশি। হবেন।”

“তাহলে এখনি আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও।”

দুৰ্গটা পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। এখনো পুরো শেষ হয়নি। বেশ কয়েকজন অর্ধনগ্ন শ্রমিককে দেখা গেলো পাথর, ইট-সুরকি আনা নেওয়া করছে। এখনো ফটকটা পুরো নির্মাণ শেষ হয়নি। তবে টম যে গভর্নরের বাড়িটা ভেঙে ফেলেছিলো, সেটা আবার নির্মাণ শেষ। এবার খড় পাতার বদলে ইট আর টাইলস দিয়ে ছাদ বানানো হয়েছে দেখে খুশি হলো ও। শেষমেশ শিক্ষা হয়েছে তাহলে।

গভর্নরের অফিসের দরজায় কোনো প্রহরী দেখা গেলো না। “বাইরেই থাকো,” টম আকালকে বললো। “তুমি যে আমাকে ঢুকতে দিয়েছো এটা ওর না জানাই ভালো।”

দরজায় নক না করেই ভিতরে ঢুকে পড়লো টম। গভর্নরের ডেস্কে কাগজপত্র জমে পাহাড় হয়ে আছে। তবে সেগুলো নিশ্চয়ই জরুরি কিছু না। কারণ গভর্নরকে দেখা গেলো পাশেই একটা ছোট বিছানায় শুয়ে আছেন। আধো ঘুমে রত উনি, বুকের কাছে একটা ওয়াইন ভরা গ্লাস ধরা। কিছু চলকে পড়ে ওনার সাদা জামার উপর লম্বা একটা দাগ সৃষ্টি করেছে, দেখে মনে হচ্ছে কেটে গিয়েছে।

টম দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। গভর্নর চমকে উঠে ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন। আরো ওয়াইন চলকে পড়লো ঝাঁকিতে। টমের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন উনি।

“মিস্টার উইল্ড, চি চি করে বললেন গভর্নর।

টম চেহারা কালো করে মাথা ঝাঁকালো। ও যে অবাক হয়েছে সেটা প্রকাশ। করলো না। “মিস্টার কাইফেন।”

“কি-আহ-কেন…?” কাইফেন টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো।

“আমার কামানগুলো নিতে এসেছি,” সরাসরি বলে দিলো টম। “যে নাইন পাউন্ডারগুলো রানি জাহাজ থেকে উদ্ধার করেছিলো। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যেগুলো কোম্পানি তুলে এনেছে।”

কাইফেন হতবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো।

“আপনি কি এখন বলবেন নাকি যে ওগুলো আপনার সম্পত্তি?” জিজ্ঞেস করলো টম। “কোম্পানির জন্যে এতো কিছু করলাম। এখন আপনি অন্তত আমাকে আমার জিনিস ভালয় ভালয় নিয়ে যেতে দিন।”

কাইফেন অবশেষে বাকশক্তি ফিরে পেলো। “হাবলাদার, “ চিৎকার করলো

দরজা খুলে গেলো। টম ঘুরে তাকিয়ে আর একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেলো। সেই গোফওয়ালা সার্জেন্ট। অবরোধের সময় একসাথে লড়াই করেছিলো ওরা। হাবিলদারের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে কোমর থেকে পিস্তল বের করে টমের দিকে তাক করে ধরলো।

“এই লোকটা একজন খুনী, একটা চোর, জালিয়াত! লন্ডন আর বোম্বে দুই জায়গাতেই তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে, কো কো করে বললো কাইফেন। “এখনি বন্দী করো একে।”

হাবিলদার টমের দিকে চেয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে গোঁফে তা দিতে লাগলো। তারপর পিছনে ফিরে ওর লোকেদের কিছু একটা আদেশ দিলো। ঘরের বাইরের ত্রস্ত পদশব্দ শুনতে পেলো টম।

টমের মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছে। ওর নিজের পিস্তল আছে, জুতোর ভাজে একটা ছুরিও আছে। কিন্তু হাবিলদারের উদ্যত পিস্তলের চাইতে দ্রুত ও পিস্তল বের করতে পারবে না।

“মিসেস হিকস আর আমার স্ত্রীকে আংরিয়ার হাত থেকে উদ্ধার করতে আমার ঐ কামানগুলো লাগবে,” টম কাইফেনকে বললো। “আর ওরা ঐ শয়তানের হাতে ধরা পড়েছিলো আপনার জন্যেই। আপনি যখন পালাচ্ছিলেন, তখন আমি এখানে বসে আপনার এই দামী কুঠি জীবন দিয়ে আগলে রেখেছিলাম।”

দুজন সিপাহী করিডোর দিয়ে ভিতর প্রবেশ করলো। দুজনের হাতেই হাতকড়া। টমের কিছুই করার নেই। ও নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। “এভাবেই কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে?”

কাইফেন জবাব দিলো না। টমের কথা শেষ না হতেই হাবিলদার ওর পিস্তলের নিশানা টমের দিক থেকে কাইফেনের দিকে সরিয়ে নিলো। একই সময়ে সিপাহী দুজন টমকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে কাইফেনের হাত জোর করে টেনে ধরে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। হাতকড়ার অন্য প্রান্তটা আটকালো চেয়ারের হাতলের সাথে।

“এটা কিন্তু বিদ্রোহের শামিল,” চেঁচিয়ে উঠলো কাইফেন। “গভর্নর কোর্টনী যখন সব শুনবেন

“তাতে আমার প্রতি গাই-এর ধারণা এক কণাও পরিবর্তন হবে না, উল্লসিত কণ্ঠে বললো টম। ও কাইফেনের কোটের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে কাইফেনের মুখে গুঁজে দিলো, যাতে আর ঘ্যানঘ্যান না করতে পারে। তারপর হাবিলদারকে জড়িয়ে ধরলো।

“ধন্যবাদ, বন্ধু,” টম বললো। “যদিও এটা করা ঠিক হলো না। ওরা আপনাকে বিদ্রোহের দায়ে ফাঁসি দিতে পারে।”

হাবিলদার দাঁত বের করে হাসলো। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। “আংরিয়া আসলেই মিসেস হিকসকে আটক করে রেখেছে?”

“হ্যাঁ, আর আমার স্ত্রী সারাহকেও। টিরাকোলার দুর্গে বন্দী ওরা।”

“কামানগুলো ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে জাহাজ এনেছেন?”

“সৈকতে অপেক্ষা করছে।”

“জাহাজে আর একজন লোকের জায়গা হবে তো? আমি যেতে ইচ্ছুক।”

টম হাবিলদারের হাত চেপে ধরলো। “ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।” তারপর টম কাইফেনের দিকে তাকালো। চেয়ারে বসে গোঁ গোঁ করছে আর বাঁধন খোলার জন্যে. অযথা টানাটানি করছে। আমি আমার কামানগুলো নিয়ে যাচ্ছি। আর সেই সাথে ভাবছি কোম্পানীকে কিছু পাউডার আর গোলাবারুদের ভার থেকেও মুক্ত করে দেবো।”

কাইফেন আক্রোশে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে মুখের রুমাল ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু টম আবার ওটাকে ভিতরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে কাইফেনের কোমর থেকে বেল্ট খুলে ওর মুখে লাগিয়ে দিলো।

“কাজ শেষে ছেড়ে দেবো আপনাকে। হাবিলদার সাহেব আমাকে সাহায্য করছেন, তবে আপনার যদি মনে হয় যে আমি কামানগুলো একা সরাতে পারতাম না, তাহলে সাবধান করে দিচ্ছি। যদি আমাকে সাহায্য করেছে সন্দেহে কোনো সিপাহীর গায়ে একটা আঙুলও তোলা হয়, আমি কিন্তু সে খবর পাবো। আর আমি তার শোধ তুলবোই। রানি মিস্টার ফয়কে কি করেছিলো মনে আছে তো? আমি আপনার যে অবস্থা করবো, তার তুলনায় সবাই বলবে ওটা কিছুই না। বোঝা গিয়েছে?”

কাইফেন মোচড়ামুচড়ি বন্ধ করে অসহায় চোখে মাথা ঝাঁকালো।

“মিসেস ফয়কে আপনার শুভেচ্ছা পৌঁছে দেবো,” টম আশ্বস্ত করলো ওকে।

*

কামানের মুখ থেকে আগুন বেরিয়ে এলো। টেলিস্কোপ দিয়ে টম দেখতে পেলো গোলাটা দুর্গের ফটকের বামে গিয়ে আঘাত করলো। জায়গাটা আগের গোলার আঘাতে খানিকটা ভেঙেই ছিলো, এখন আরো খানিকটা পাথর টুকরো হয়ে গড়িয়ে পড়লো। গোলন্দাজের নির্ভুল নিশানার প্রশংসা করতেই হয়। পিছনেই টম শুনতে পেলো মেরিডিউ মারাঠা গোলন্দাজদের চিৎকার করে। উৎসাহ দিচ্ছে। “ওয়ার্ম এন্ড স্পঞ্জ। পাউডার।” ওর প্রশিক্ষণে এর মধ্যেই ওদের গোলা ভরার সময় দশ থেকে পাঁচ মিনিটে নেমে এসেছে। দস্যুদের দুর্গের ভিতর ঢুকতে পারলে কি কি গুপ্তধন পাওয়া যাবে সেসব গল্প সৈন্যদেরকে শুনিয়েছে মেরিডিউ। তাতেই ওদের উৎসাহ বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ।

ব্রিঞ্জোয়ান থেকে উদ্ধার করে আনা কামানগুলো নিয়ে শাহুজির সৈন্যদল এখানে এসে হাজির হয়েছে আজ পাঁচ সপ্তাহ। পাঁচ সপ্তাহ ধরেই ওই পুরু দেয়ালগুলো ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছে ওরা। এতো বেশি লোকজন এই দুৰ্গটাকে অজেয় বলেছে যে আর একটু হলে টমও কথাটা বিশ্বাস করে বসতো। কিন্তু এখন ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে ওটার দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করার পর মনে হচ্ছে আশা ছাড়া ঠিক হবে না।

এটা সত্যি যে সমুদ্রপথে যে কোনো আক্রমণই বৃথা যাবে। খাড়া গিরিখাতটার গোড়ায় কোথাও এক চিলতে জায়গা নেই যেখানে একটা ঘাট বানিয়ে জাহাজ ভেড়ানো যাবে। আর আংরিয়া যেখানে ওর জাহাজের বহর ভিড়িয়ে রাখে তার চারপাশে কাটা গাছে ফেলে রেখেছে। ওখানে যাওয়া সম্ভব না। এছাড়া প্রবাল প্রাচীরে এখানকার পানি ভরা। জোয়ারের সময় দেখা যায় না। ফলে পানি নেমে গেলেই, দুর্গে বোমা বর্ষণ করতে আসা জাহাজগুলো ভয়ানক বিপদে পড়ে যায়।

ডাঙার দিক দিয়েও এটা আক্রমণ করা দুরূহ। দুর্গের ফটকের সামনের শৈল অন্তরীপটা খুব বেশি সরু। ফলে ওদিক দিয়ে আসতে গেলে ফটকে বসানো হালকা কামানগুলোর মুখোমুখি না হয়ে আসার উপায় নেই। দুর্গের দেয়াল ঘেঁষে ঘন কাটা ঝোঁপ জন্মে আছে। ওগুলো শুধু যে আক্রমণকারীদের আহত করে তা-ই না, ওগুলোর কণ্টকময় ডালগুলো কামানের গোলার আঘাত অনেকটা চুষে নেয়। ফটক থেকে চার ফুট লম্বা লোহার কাটা বেরিয়ে আছে বাইরে। ফলে হাত দিয়ে গুতো মেরেও ফটক খোলা সম্ভব হবে না।

কিন্তু এর বাইরে প্রতিরক্ষাকে সুসংহত করার আর কোনো চেষ্টা করা হয়নি। দুর্গ থেকে আধা মাইলটাক দূরে একটা ছোট পাহাড় আছে। ওখান থেকে চাইলেই দুর্গে গোলা ছোঁড়া যায়। পাহারার জন্যে আংরিয়া ওখানে একটা ছোট মিনার বসিয়েছিলো। তবে সেটা বসানোর উদ্দেশ্য ছিলো সমুদ্রে জাহাজ আছে কিনা তা দেখা। শাহুজির গোলন্দাজেরা এক বোমায় খুঁড়িয়ে দিয়েছে সেটাকে। তারপর পাহাড়ের চূড়ার দখল নিয়ে, মাটিতে গর্ত খুঁড়ে, তাতে মাচা বানিয়ে কেস্ট্রেল-এর নাইন পাউন্ডারগুলো বসিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে দিন রাত সর্বক্ষণ বোমা মেরেই চলেছে। আর ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওদের প্রতিবন্ধকতা গুঁড়িয়ে পড়ছে।

টম প্রার্থনা করলো এটুকুই যেনো যথেষ্ট হয়।

*

শৈল অন্তরীপের গোড়ার জেটিটায় জেলেরা তাদের সারা দিনের শিকার নৌকা থেকে নামাচ্ছে। অবরোধের কারণে ওরা মাছের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ভালোই। কারণ দেয়ালের দুই পাশেই আগ্রহী ক্রেতা কম নেই। একটা নতুন ফসলের মাঠে পাখিরা যেভাবে ভীড় করে নৌকাগুলোও প্রতি সকালে সেভাবে এসে জড়ো হয়। কামানের গোলার আওয়াজ এখান থেকে শুনলে দূরে কোথাও বজ্রপাতের আওয়াজের মতো মনে হয়।

শব্দটা এখন কানে এতোটা সয়ে গিয়েছে যে নৌকা থেকে মাছগুলো নামানো তদারকি করার সময় ক্রিস্টোফারের ওগুলো আর খেয়ালই হলো না। একটা ঢেউ এসে পাথরে আছড়ে পড়তেই ওর মুখে এসে পানির ছিটা লাগলো। সমুদ্রে দেখা গেলো একটা সওদাগরি জাহাজের পাল ধীরে সুস্থে উপকূল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ওটার নির্ভীক চলে যাওয়া দেখে এক অক্ষম আক্রোশে ছেয়ে গেলো ক্রিস্টোফারের মন। মারাঠাদের সমুদ্রের দিক থেকে দুৰ্গটা আক্রমণ করার সামর্থ নেই। কিন্তু তবুও আংরিয়া জাহাজগুলোকে বের করতে দেবে না। ওর নাকি দুৰ্গটা রক্ষা করতে সকল লোক আর কামানের দরকার হবে। তাই জাহাজের বহর এখনো গাছের গুঁড়ির বেষ্টনীর এপাশেই নোঙর করে আছে। আর স্থানীয় সওদাগরেরা কোনো ভয় ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছে।

ক্রিস্টোফার টিরাকোলাতে এসেছে শুধুমাত্র ধনী হওয়ার আশায়। আর এখন যেহেতু জাহাজ নিয়ে বের হওয়া যাচ্ছে না, আর কোনো লুটপাট বা ডাকাতির সুযোগও নেই, তাই বর্তমান জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া অকর্মণ্যতা আর টাকা পয়সার কমতি ওর মাথা গরম করে দিচ্ছে।

ওখানে যে শুধু ওর একারই এরকম লাগছে, তা কিন্তু না। বেশ কয়েকজন দস্যুই অসন্তোষ প্রকাশ করা শুরু করেছে, প্রথমে ফিসফিস করে হলেও ইদানীং আংরিয়ার সামনেই বলে উঠছে কেউ কেউ। ওরা জানে যে মারাঠাদের পক্ষে দুৰ্গটা দখল করা সম্ভব না। এটা অজেয়, দুর্ভেদ্য। এর একটা কারণ হচ্ছে, সমুদ্রপথে ওরা অফুরন্ত রসদপত্র জোগাড় করতে পারবে। ফলে অনাহার বা অন্য কোনো ভয় ওদের নেই। কিন্তু তাহলে কেন ওরা খামাখা বসে না থেকে নিজেদের রুজির সন্ধানে বের হবে না?

ক্রিস্টোফার এ ব্যাপারে কিছু একটা করবে বলে ঠিক করলো।

বেশিরভাগ জেলেরই মাছ দেওয়া শেষ। আবার নিজেদের জালের কাছে। ফিরে যাচ্ছে। এখন যে মাছগুলো ধরা পড়বে সেগুলো ওরা সন্ধ্যায় মারাঠাদের কাছে বিক্রি করবে। ওদের কাছে যুদ্ধ বেঁধে বরং ভালোই হয়েছে। আয় ইনকাম বেড়েছে। মাছ ভরা পিপাগুলো একটা কপিকলে করে দুর্গের দেয়ালের পাশ দিয়ে উপরে তুলে নেওয়া হচ্ছে।

অন্যান্য দস্যুরা আবার দুর্গের ভিতরে নিজেদের জায়গায় ফিরে গেলেও, ক্রিস্টোফার দাঁড়িয়ে থেকে মাঝির সাথে কথা বলতে লাগলো।

সবাই চলে গেলে ক্রিস্টোফার এক জেলেকে একপাশে টেনে নিলো। ও জানে এই জেলেটাকে ভরসা করা যায়। কারণ গত এক সপ্তাহ ধরে লোকটা মাছের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার পরেও, ক্রিস্টোফার তেমন কিছুই বলছে না। কারণ লাভের ভাগ ও নিজেও পাচ্ছে। এখন ক্রিস্টোফার ওকে পাহাড়ের গোড়ায় এমন এক জায়গায় নিয়ে গেলো যেখানে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দে ওদের কথোপকথন শোনা যাবে না।

“আজ মারাঠাদের ওখানে যাবেন?”

জেলে মাথা ঝাঁকালো।

“তাহলে আমার পক্ষ থেকে ওদেরকে একটা খবর পৌঁছে দিতে হবে।”

ক্রিস্টোফার ওর কথাটা বললো, তারপর জেলের কাছ থেকে দুইবার শুনলো। কাগজে লিখে দেওয়ার দুর্বুদ্ধি করলো না।

“যদি ধরা খান, আমি কিছুই স্বীকার করবো না। আর যদি আমার সাথে বেঈমানি করেন, তাহলে আপনার পুরো পরিবারকে খুঁজে বের করে আপনি মাছের পেট যেভাবে ফাড়েন সেভাবেই ফেঁড়ে ফেলবো। বোঝা গিয়েছে?”

জেলে কাঁপতে শুরু করলো। ক্রিস্টোফার হেসে ওর কাধ চাপড়ে দিলো।

“যদি সব ঠিকঠাকমতো হয়, তাহলে দুজনেই লাভ ভাগ করে নেবো। আপনাকে আর জীবনেও মাছ ধরে খেতে হবে না।”

*

সেই রাতে শাহুজি টমকে নিজের তাঁবুতে ডেকে নিলেন। তাঁবুটা দুর্দান্তভাবে বানানো হয়েছে। একজন রাজার জন্যে উপযুক্ত। তাঁবুর ভিতরে আবার ভারী রেশমের পর্দা ফেলে কয়েকটা ঘরে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলোর ভিতরে মেহগনি কাঠের দামি সব আসবাব। কোনায় কোনায় সুগন্ধী ধূপ জ্বলছে, ফলে বাইরের দুর্গন্ধ ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না। ভিতরে ঢোকার পর এটা যে যুদ্ধক্ষেত্র সেটাই বোঝার কোনো উপায় থাকলো না। শুধু কামানের গোলার শব্দই মনে করিয়ে দিচ্ছে সেটা। প্রতিবার গোলা ছোঁড়া হতেই তাবুটা কেঁপে ওঠে। তাবুর ভিতরের স্বর্ণের থালা আর গ্লাসগুলোও কাঁপতে থাকে সেই সাথে।

“অগ্রগতি কেমন আমাদের?” রাজা জিজ্ঞেস করলেন।

“দেয়ালের ফাটল বাড়ছে,” টম জবাব দিলো! “কাজটা অনেক আস্তে আস্তে হচ্ছে-দেয়ালগুলো একেকটা পনেরো ফুট পুরু। তবে একটু একটু করে হলেও ভেঙে পড়বে যে কোনো সময়।”

“বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে,” শাহুজি বললেন। “ব্রিঞ্জোয়ান থেকে যে গোলা বারুদ এনেছিলেন তাতে আর বেশিদিন চলবে না। আমার সৈন্যবাহিনি ওদের বাড়ি ছেড়েছে অনেকদিন। গত সপ্তাহেও যারা লড়াই করতে মুখিয়ে ছিলো আজ তারা বাড়ির জন্যে বেজার হয়ে আছে।”

“দস্যুদের গুপ্তধনের চেহারা দেখলেই ওদের সব অভিযোগ চলে যাবে।”

“যদি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাহলে।”

টমের চোখ সরু হয়ে গেলো। অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ও এই ভয়টাই করে আসছিলো : শাহুজি একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন বা টমের উপর আর ভরসা করতে পারবেন না।

“আপনি কি অবরোধ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন, মহামান্য?”

শাহুজি এক বাটি খেজুর টেনে নিলেন। তারপর একটা খেজুর মুখে পুরে রূপার একটা বাটিতে আঙুলের মাথাটা ধুয়ে নিলেন!!

“আমি শুনেছি আপনার দেশে নাকি লড়াই শুরু হলে মরার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে,” শাহুজি বললেন।

টমের ব্লেনহেইম-এর যুদ্ধের কথা মনে পড়লো। কয়েক বছর আগেই যুদ্ধটা হয়েছিলো ফ্রান্স, ব্রিটেন আর রোমান সাম্রাজ্যের মাঝে। কেপ টাউনে বসে ও যা শুনেছে তা হচ্ছে ফ্রেঞ্চদের নাকি প্রায় তিরিশ হাজার সৈন্য মারা গিয়েছে, যা কিনা ওদের পুরো সৈন্যবাহিনির অর্ধেকেরও বেশি। টম মাথা ঝাঁকালো।

“ভারতে আমাদেরকে সেই তুলনায় সভ্য বলতে পারেন,” শাহুজি বললেন। “বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন আরকি। আমাদের মহামুণি কৌটিল্য বলেছিল যে বল প্রদর্শনের চাইতে ষড়যন্ত্র করে যুদ্ধে জেতা সহজ। সামনে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করার কি দরকার যদি কেউ তোমার জন্যে পিছনের দরজা দেয়?”

টম বুঝতে পারলো শাহুজি কি বোঝাতে চাচ্ছেন। “আপনার কি মমে পড়ে যে টিরাকোলায় সেরকম কেউ আছে?”

শাহুজি মাথা ঝাঁকালেন। আমাকে একজন একটা খবর পাঠিয়েছে।

কোর্টনীরা কখনোই এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে কিছু লাভ করতে আসে না। তবে টম ওনার কথাটার মর্মার্থ ধরতে পারলো। যদি দুর্গটা মুখোমুখি ছাড়াই দখল করে নেওয়া যায়, তাহলে খুব বেশি হতাহত হবে না আর। অ্যাগনেস আর সারাহকে অক্ষত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা-ও বাড়বে।

“কে খবর পাঠিয়েছে।”

“এক জেলে নিয়ে এসেছে খবরটা। সে বলেছে যে খবর দিয়েছে আংরিয়ার খুব কাছের লোক। সে নাকি টাকার সন্ধানে আংরিয়ার কাছে ভিড়েছিল, কিন্তু এখন নাকি বুঝতে পেরেছে যে আংরিয়ার সাথে বেই করেও টাকা কামাতে পারবে ও।”

“এরকম একটা লোককে কি বিশ্বাস করা ঠিক?”

“আমরা ওর বিশ্বাস কিনে নেবো,” শাহুজি একটা ছোট রেশমের ডাল টেনে নিয়ে হাতের তালুর উপর ঢাললেন। এক মুঠো কাটা হীরা তার হাতের চামড়ার উপর ঝিলিক মেরে উঠলো।

“কিভাবে কথা হবে লোকটার সাথে?”

“লোকটার পক্ষে কারো চোখে না পড়ে ডাঙা দিয়ে আমাদের কাছে আসা সম্ভব না। কিন্তু পাহাড়ের গোড়ায় নাকি পানিতে নামার জন্যে একটা পথ আছে। ওদিক দিয়ে আংরিয়া রসদপত্র আনা নেওয়া করে। কাল রাতে সেই লোকটাকে উপকূল ধরে একটা সৈকতে নিয়ে আসবে। আপনি গিয়ে তার সাথে কথা বলবেন।”

“যদি পুরোটাই একটা ফাঁদ হয়?”

শাহুজি হাতের মুঠো গোল করে আবার হীরা গুলো থলেটার ভিতর রেখে দিলেন। “সেরকম কিছু হলে, কি করতে হবে সেটা আপনি নিশ্চয়ই করতে পারবেন।”

*

পরের রাতটা ছিলো বেশ শান্ত আর পরিষ্কার। ক্ষয়ে যাওয়া একটা চাঁদ ঝুলে আছে আকাশে। বালি আর ঢেউয়ের ফেনার উপর তারার আলো পড়ে চিকচিক করছে। সৈকত ছেয়ে থাকা পাম গাছগুলোর একাটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টম। সাগর থেকে কেউ তাই ওর দিকে নিশানা করতে পারবে না। ছোট উপসাগরটার দুই পাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতশ্রেণির দিকে তাকালো ও একবার। ফ্রান্সিস আর মেরিডিউ আছে ওখানে। হাতে ফ্লিন্টলক বন্দুক। ম্যাচলকের আলো অন্ধকারে দেখা যেতে পারে।

“আপনার কি মনে হয় যে ও আসবে?” মোহিত নামের সেই হাবিলদার বললো। টমের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সে। ও নিজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উর্দি ফেলে দিয়ে এখন ধুতি পরে আছে। হাতে একটা জৈত্রি (লাঠির মাথায় কাটা যুক্ত বল বেঁধে তৈরি করা অস্ত্র)। শাহুজির অস্ত্রভাণ্ডারের ভিতর থেকে খুঁজে বের করেছে।

সাগরের ভিতর থেকে কিছু একটা চি চি করে ডেকে উঠলো। এতো আস্তে যে ঢেউয়ের শব্দের আড়ালে প্রায় শোনাই যায় না। কিন্তু টমের সমস্ত ইন্দ্রিয় টানটান হয়ে আছে। ও অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। একটু পরেই সাগরের বুকে একটা আবছা কাঠামো চোখে পড়লো। ওটা একটা ছোট নৌকা। ভারতীয়রা এগুলোকে মাসসুলা বলে। এতো হালকা আর ছোট যে একটা ঢেউ-ই ওটাকে ঠেলে সৈকতে নিয়ে আসার জন্যে যথেষ্ট।

দুজন লোক লাফ দিয়ে নেমে ওটাকে টেনে বালিতে এনে রাখলো। একজন নৌকার পাশেই বসে থাকলো; আর একজন বুক ফুলিয়ে সোজা গাছের সারির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। একজন ভারতীয় হিসেবে অনেক লম্বা লোকটা। প্রায় টমের সমান বলা যায়। তারার আলোয় টম বুঝলো লোকটার মুখ ভরা দাড়ি গোফ। মাথায় পাগড়ি আর কোমরে একটা তরবারি ঝুলছে।

টমের একে আগে কখনো দেখার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু তবুও, এই অন্ধকারেও ওর লোকটার কিছু একটা চেনা চেনা মনে হতে লাগলো। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেলো ওর। জঙ্গলের ভিতর সেই জলার ধারে বাঘ খোঁজার সময়েও এমন লেগেছিলো। ও লোকটার চেহারা দেখার চেষ্টা করলো, কিন্তু তা অন্ধকারে ঢেকে আছে।

“কি নাম আপনার?” কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইলো মোহিত।

“রুদ্র।”

“ওকে জিজ্ঞেস করেন কিভাবে ও ফটকটা খুলবে,” টম মোহিতকে বললো।

ক্রিস্টোফার টমের গলা শুনে এতোটাই বিস্মিত হয়েছে যে ও আর একটু হলেই ইংরেজিতে জবাব দিয়ে বসেছিলো। ও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে হাবিলদারের অনুবাদ শোনার ভান করলো। ওর মনের ভিতর ঝড় চলছে। গাছের আড়ালে থাকার কারণে লোকটার চেহারা ছবি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু তবুও ওর মনে হচ্ছে যে ও লোকটাকে চেনে। ইনি কি বোম্বের কেউ নাকি?

ওরা ক্রিস্টোফারের উত্তরের অপেক্ষা করছিলো। “আমি সদর দরজা খুলতে পারবো না। ওগুলোয় পাহারা খুব কড়া। আর আপনারা আগানো শুরু করলে সবাই দেখতে পাবে।”

“তাহলে?” টম অধৈর্য গলায় বললো। “আমাদেরকে এখানে টেনে আনার মানে কি?”

আবারও ক্রিস্টোফার জোর করে হাবিলদারের অনুবাদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। অবশ্য এতে করে সামনের ইংরেজ লোকটাকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেলো ও। লোকটা লম্বা, চওড়া কাঁধ, দাড়ি আর চুল দুটোই কালো। আত্মবিশ্বাসী হুকুম করে অভ্যস্ত। ঠিক ওর নিজের মতোই সব বৈশিষ্ট্য।

তারপর আচমকাই ও ধরে ফেললো লোকটা কে। টম উইল্ড, যে তাকে ব্রিথ্রোয়ানে পরাজিত করেছে; এনাকে সর্বশেষ দেখেছিলো দুর্গের ভেঙে পড়া

ফটকের উপরে। যার তরবারি এখন ওর কোমরে ঝুলছে। ইনি এখানে কিভাবে এলেন?

উইল্ড-ও একইভাবে ক্রিস্টোফারকে মন দিয়ে দেখছে। উনি কি ওকে চিনে ফেলেছেন? নাকি এটা সেই পুরনো চেনে চেনা ভাব?

“আংরিয়া তার জাহাজগুলো দুর্গের উত্তরে একটা উপসাগরে নোঙ্গর করে রাখে, ওগুলোর চারপাশে গাছের গুঁড়ির বেড়া দিয়ে ঘেরা,” ক্রিস্টোফার বললো। জোর করে কণ্ঠ শান্ত রাখছে, সেই সাথে মাথা-ও নিচু করে থাকলো যাতে ওর চেহারা ছায়ার ভিতর থাকে।

“আমরা সেটা জানি।”

“তিন রাত পরেই অমাবস্যা। আমি গাছের গুঁড়ির বরগাগুলো কেটে দেবো। ভাটার টানে জাহাজগুলো ভেসে যাবে। আপনারা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে গিয়ে জাহাজগুলো পুড়িয়ে দিতে বা যেটা ইচ্ছে করতে পারবেন। জাহাজ ছাড়া সে রসদপত্র জোগাড় করতে পারবে না। ভালো হয় যদি আপনার আপনাদের নিজস্ব গ্রাব আর গালিভাতগুলো নিয়ে আসতে পারেন। তাহলে ওগুলোর কামান দিয়ে ডাঙার দিক থেকে যারা আসবে তাদের সামলাতে পারবেন। আংরিয়ার শহীদ হওয়ার বিন্দুমাত্র খায়েশ নেই। যদি ও বুঝতে পারে যে জেতার সম্ভাবনা নেই তাহলে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করবে। ভারতীয়রা এটাই পছন্দ করে।”

অনেকগুলো কথা বলেছে ক্রিস্টোফার। হাবিলদার সেগুলো অনুবাদ শেষ করতেই টম নিজের বেল্ট থেকে একটা ছোট থলে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলো।

“রাজা শাহুজি এটা দিয়েছেন।” বলে ও থলেটা হাতের উপর ঢেলে দিলো। তারার আলোতেও কাটা হীরাগুলো ঝিকমিক করে উঠলো। ক্রিস্টোফার জুলজুল করে তাকিয়ে রইলো ওগুলোর দিকে।

“যা যা বললে সেটা যদি করেন, তাহলে শাহুজি আপনার দিকটা খেয়াল রাখবেন,” টম বললো। “আপনি

কথা শেষ না করেই থমকে গেলো টম, কারণ ক্রিস্টোফার হীরাগুলো ভালোমতো দেখতে যেই সামনে ঝুঁকেছে তখনই চাঁদের আলো গিয়ে পড়েছে ওর তরবারির হাতলের উপর। হাতলে বসানো মসৃণ পাথরটা থেকে আলো ঠিকরে পড়লো বালিতে, তার নিচেই খাপের ভিতর থেকে দেখা গেলো তরবারিটার সোনার বাঁধানো অংশটা-টম সারাজীবন ধরে এই নকশাটা চেনে। এটা হচ্ছে নেপচুন তরবারি। রাতের কারণে ওটার নীলা পাথরটা এখন নীলচে দেখাচ্ছে, কিন্তু ওটার আকৃতি ও ঠিকই ধরতে পারছে। আর সারাহের দেহের বাকের মতোই ও তরবারিটার ফলার বাকও চেনে; হাতলের ফোলা অংশ, খাপে ভরে রাখার পরেও ওটার বেরিয়ে থাকা তীক্ষ্ণ ডগা-এটা ওরই নীল তরবারি।

ও পারলে তখনি ওটা কেড়ে নিতো। “এই তরবারি আপনি কোথায় পেয়েছেন?” প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো টম।

ক্রিস্টোফার সোজা হয়ে ওর ডান হাতটা হাতলে রাখলো। “লড়াই করে জিতেছি।”

কথাটা বলার আগেই টম বুঝে গেলো কেন একে চেনা চেনা লাগছিলো। সব জট খুলে গেলো ওর। এই লোকটাকেই ও রানির মহলে দেখেছিলো। এ ই ওর কামানগুলোকে উদ্ধার করেছিলো, ক্যাপ্টেন হিকসকে মেরেছিলো। আর কিভাবে কিভাবে আবার এই টিরাকোলার দুর্গে এসে হাজির… আর ওর কাছে এখন নেপচুন তরবারি।

টম তরবারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ব্রিঞ্জোয়ান থেকে ফিরে আসার পর, ও প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলো। জানতে যে তরবারিটা হারানোর দুঃখ ভুলতে ওর অনেকদিন লাগবে। কিন্তু ওটা আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এটা মনকে বুঝিয়ে ফেলেছিলো। তবে আবার ওটাকে দেখা যাচ্ছে। হাতের নাগালেই।

টম জানে যে ওর চুপ থাকা উচিত, কিন্তু পারলো না।

“ওটা আমার তরবারি,” হিস হিস করে বলে উঠলো ও। “ওটার মালিক ছিলো আমার বাবা, তার আগে আমার দাদা, তার আগে তার বাবা।”

ক্রিস্টোফার টমের দিকে তাকিয়ে রইলো। “আপনার বাবার?” ইংরেজিতেই বলে ফেললো ও। কিন্তু দুজনেই এমন হতবাক যে কেউই খেয়াল করলো না ব্যাপারটা। এতো বড় ধাক্কা খেয়েছে ক্রিস্টোফার যে কথাটা হজম করতে পারছে না।

ক্রিস্টোফার নিজেকে সামলে নিলো। “তরবারিটা আমার,” যতোটা সম্ভব বিনয়ের সাথে বললো ও। “গোলকোন্দা খনির সমস্ত হীরার বিনিময়েও এটা হাতছাড়া করবো না আমি।”

টমের মনে ঝড় বইতে লাগলো। ওর সাথে হাবিলদার আছে। দুজন মিলে একে কাবু করতে পারবে। আর তাছাড়া ফ্রান্সিস আর মেরিডিউ-ও উপর থেকে রাইফেল তাক করে রেখেছে এদিকে। একবার ডাক দিলেই ডাকাতটা মারা পড়বে। তরবারিটা আবার দখলে চলে আসবে ওর।

ও আদেশটা দেওয়ার জন্যে মুখ খুললো। কিন্তু ভিতরে থেকে কেউ যেনো ওকে সাবধান করলো যে কাজটা ঠিক হবে না। ও হয়তো তরবারিটা পাবে, কিন্তু যা হারাবে তা সারাজীবন কেঁদেও আর ফিরে পাবে না। কিন্তু তরবারিটা ওর চোখের সামনে, ওটার নীলাটার ধারগুলোয় তারার আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, যেনো ওকে চোখ টিপছে। ও এটাকে হারিয়ে ফেলেছিলো, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আবার এটাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে। ও কি ধরনের মানুষ যে এরকম একটা সুযোগ হেলায় ছেড়ে দেবে? এটা ওর উত্তরাধিকার-আর তাছাড়া সমস্ত কোর্টনী পরিবারের ইজ্জত আর সম্মান জড়িয়ে আছে এর সাথে।

ক্রিস্টোফার বুঝলো যে কিছু একটা সমস্যা আছে। ও এক পা পিছিয়ে গেলো; হাত তরবারির হাতলের উপর। অবশ্য দক্ষ বন্দুকবাজের হাত থেকে এতে ও রক্ষা পাবে না। টম লম্বা একটা দম নিলো যাতে চিৎকার করে পাহাড়ের উপরে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে আদেশটা দিতে পারে।

কিন্তু ও আদেশটা দিতে পারলো না। টমের বাস্তব বুদ্ধি ওকে সেটা করতে দিলো না। ও যদি একে মেরে ফেলে, তাহলে জাহাজের বেড়া কেউ খুলবে না-দুর্গটাও জয় করা সম্ভব হবে না। আর তাহলে সম্ভবত টম জীবনেও আর সারাহ বা অ্যাগনেসকে দেখতে পাবে না।

ওর সবচে ভালোবাসার রমণীকেই যদি ও নিরাপদে উদ্ধার করতে না পারে, তাহলে কোর্টনীদের ইজ্জত সম্মান তখন কোথায় যাবে?

টম মুখটা বন্ধ করে ফেললো। হঠাৎ মনে হলো ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। ওর। লজ্জা লাগছে খুব, একই সাথে স্বস্তিও পাচ্ছে এই ভেবে যে গুলি করার আদেশ দেয়নি।

“আংরিয়ার দুজন বন্দী আছে,” টম বললো। “ইংরেজ মহিলা। ওদের কথা জানেন কিছু? ওরা কেমন আছে?”

তরবারির হাতলে ক্রিস্টোফারের মুঠো ঢিল হলো। ও জানে না টম কেনো থেমে গেলো, তবে বিপদ যে আসছে সেটা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলো।

“হ্যাঁ,” নিচু স্বরে বললো ও। “হ্যাঁ, মহিলা দুজন এখনো ভালো আছেন। তবে একজনের…”

ও প্রায় বলেই দিয়েছিলো যে পেটে বাচ্চা। কিন্তু বললো না। গত পাঁচ মিনিটে বেশ কয়েকবার ওর ভাগ্য বদল হয়েছে। সবকিছু বুঝে উঠতে ওর কিছু সময় দরকার। আগেই সব বলে দেওয়া ঠিক হবে না। পরে কাজে লাগতে পারে।

“স্বাস্থ্য একটু খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনো সমস্যা নেই, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো ক্রিস্টোফার।

“খেয়াল রাখবেন ওদের যেনো কোনো কিছু না হয়,” টম বললো। ভিতরে ভিতরে ও ভাবছে, কে তুমি? এই লোকটা এমন নিখুঁত ইংরেজি বলে, কিন্তু ডাকাত আর দস্যুদের সাথে সবসময় চলাফেরা। আর এখন ওর তরবারি দখল করে বসে আছে। কোন ভাগ্যে ঘুরে ফিরে বারবার ওদের দেখা হয়ে যাচ্ছে?

অপরদিকে ক্রিস্টোফারের আর অজানা নেই যে ও কার সাথে কথা বলছে। তরবারিটা ছিলো আমার বাবার… লোকটাই বলেছে কথাটা। যদি সত্যি বলে থাকে, তাহলে ইনি অবশ্যই গাই-এর ভাই। অবশ্য লোকটার গলার জোর দেখে মনে হয়নি যে সে মিথ্যে বলছে। উইলিয়াম চাচা মারা গিয়েছেন। আর ক্রিস্টোফার ওদের পরিবারের ঠিকুজি থেকে জানে যে ডোরিয়ান চাচার চুল লাল। তার মানে এতোক্ষণ ও ওর চাচা টম কোর্টনীর সাথে কথা বলেছে।

ক্রিস্টোফার সাথে সাথে আতংকিত হয়ে পড়লো এই ভেবে যে টম ওকে চিনে ফেলবে। ব্যাপারটা অসম্ভব যদিও-টমের সাথে ওর জীবনেও দেখা হয়নি। এমনকি ওর কথাও সম্ভবত উনি জানেন না। কিন্তু আবার মনে হলো ও-ও জীবনেও ভাবেনি যে ও এরকম একটা পরিবেশে কখনো ওর মৃত চাচার সাথে দেখা হয়ে যাবে।

ওকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে ভাগতে হবে। কোনো কথা না বলেই ও ঘুরে ক্রস্ত পায়ে নৌকার দিকে যাওয়া শুরু করলো। এতোটাই আচমকা যে টম ওটাকে ফাঁদ মনে করে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েই ফেলেছিলো প্রায়।

কিছু একটা উড়ে এলো বাতাসে। সহজাত প্রবৃত্তিবশে ক্রিস্টোফার এক হাত দিয়েই লুফে নিলো জিনিসটা-সেই হীরা ভরা থলে। হাতটা মুঠো করতেই ও থলের পাতলা কাপড়ের ভিতর দিয়ে হীরাগুলোর আকৃতি অনুভব করতে পারলো।

“আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম,” বিস্মিত গলায় বলে উঠলো ক্রিস্টোফার।

“কিন্তু বেড়ার গাছগুলো কাটতে ভুলো না যেন,” টম সতর্ক করে দিলো।

নৌকাটা পানিতে ঠেলে নামাতেই ক্রিস্টোফারের গোড়ালিতে ঢেউ আছড়ে পড়লো। ঠাণ্ডা বাতাস ওর ভাবনা চিন্তাকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করলো অনেকটাই। যেনো একটা স্বপ্নের ঘোর থেকে টেনে তুললো ওকে।

“সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। বেড়া খোলা-ই পাবেন।”

*

ক্রিস্টোফার টলতে টলতে নেমে এলো নৌকা থেকে। আসার আগে মাঝিকে একটা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে এলো মুখ বন্ধ রাখার জন্যে। তারপর পাথর কেটে বানানো সিঁড়িটা বেয়ে উঠে গেলো। ঢেউ থেকে ছিটকে আসা পানিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে সিঁড়িটা; ভাবনায় ডুবে থাকায় প্রায় আছাড় খেয়েই বসেছিলো।

ও জোর করে ভাবনাগুলোকে সরিয়ে দিলো। এখনো বিপদমুক্ত না ও। সিঁড়ির মাথার ঘোট দরজাটায় টোকা দিয়ে নিজের নাম বললো ও।

দরজার ছোট জানালাটায় একটা চেহারা দেখা গেলো। “মালটা কেমন?”

ক্রিস্টোফার ভুলেই গিয়েছিলো যে কোন মিথ্যেটা বলে দুর্গ ছেড়ে বেরিয়েছিলো। জোর করে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বললো, “একেবারে খাসা। তুমিও গিয়ে দেখতে পারো।”

ভারী হুড়কো টেনে খোলার শব্দ পাওয়া গেলো। দরজা খুলতেই ও প্রহরীকেও একটা স্বর্ণমুদ্রা দিলো। দেওয়ার সময় নিজের কোমরে বাঁধা হীরার থলেটার কথা মনে পড়লো। “আংরিয়া যেনো কিছুই না জানে,” সাবধান করে দিলো ও। “ও যদি জানতে পারে যে আমি দুর্গের বাইরে গিয়েছিলাম, তাহলে মেরেই ফেলবে।”

“মেয়েটা নিশ্চয়ই সেই জিনিস। নইলে নিজের গর্দানের ঝুঁকি নিতেন না,” প্রহরী বললো। আরো বিস্তারিত শুনতে চাচ্ছে।

“মধুর চেয়েও মিষ্টি, গোলাপের চাইতেও কোমল!” ক্রিস্টোফার সায় দিলো।

ও দুর্গের একদম চূড়ার মাথায় নিজের ঘরে চলে এলো। লিডিয়া বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছিলো ওর।

ক্রিস্টোফার ওর হাতকড়া খুলে দিলো। এটা এখন একটা নিয়মিত কার্যে পরিণত হয়েছে : দিনের বেলায় লিডিয়া কয়েদখানায় থাকে, কিন্তু প্রতি রাতে কারারক্ষী ওকে ক্রিস্টোফারের ঘরে দিয়ে যায়। ক্রিস্টোফার কারণটা জানে না, কিন্তু কেন যেন ও যতোটা স্বীকার করে, তার চাইতে বেশি লিডিয়ার সঙ্গ পছন্দ করে। এতোগুলো মাস আর বছর ছদ্মবেশে জালিয়াতি করে চলার পর এততদিনে ও একটু ইংরেজি বলার আর শোনার ফুরসত পেয়েছে। কিন্তু এটা তার চাইতেও বেশি কিছু। লিডিয়ার ভিতরে কিছু একটা আছে যা ক্রিস্টোফারকে টানে। লিডিয়া যেনো একটা আগুনের ফুলকি, যা ওর ভিতরের শুকনো কাগজগুলোতে অগ্নি সংযোগ করেছে।

আর লিডিয়ার মতো করে আর কেউ আদর করতে পারে না। কোনো কিছুতেই বাধা নেই ওর। এমনকি তামান্নাও এতোটা উদ্দাম ছিলো না।

লিডিয়া ক্রিস্টোফারের পিঠ জড়িয়ে ধরলো। তারপর সামন ঝুঁকে ওর হাত ক্রিস্টোফারের দুই পায়ের ফাঁকে উরুতে ঘষতে লাগলো।

ক্রিস্টোফার সাড়া দিলো না।

লিডিয়া কোনো সতী সাধ্বী কেউ না। এর মাঝেই ওর দুটো স্বামী ছিলো, আর গোটা দশেক প্রেমিক ছিলো, কিন্তু ক্রিস্টোফারের মতো করে আর কাউকে ও এতোটা বিলিয়ে দেয়নি। যদিও শুরুতে ওর পুরো ছলাকলাটাই ছিলো নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে ক্রিস্টোফার ওকে সত্যিকার ভাবেই আকর্ষণ করে। ও সারাদিন বসে বসে অপেক্ষা করে কখন কারারক্ষী এসে ওকে ক্রিস্টোফারের ঘরে নিয়ে যাবে।

“কিছু হয়েছে নাকি?”

দুশ্চিন্তার মাঝে ক্রিস্টোফার খেয়ালও করলো না যে লিডিয়া কিছু বলেছে। ও নিজেকে লিডিয়ার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নেপচুন তরবারিটা তুলে নিলো। তারপর ওটার ফলায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো।

“আমার উপর রাগ করেছেন?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো লিডিয়া। যতোই ক্রিস্টোফারের প্রতি আকৃষ্ট হোক না কেন, ও জানে যে ক্রিস্টোফার অসন্তুষ্ট হলে ওর কপালে শনি আছে। ওর জীবন নির্ভর করছে এর উপর।

ক্রিস্টোফার ওর দিকে তাকালো। “আজ সন্ধ্যায় এমন একটা কথা জেনেছি, যেটা আসলে হজম করতে পারছি না।”

লিডিয়া ওর লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে ক্রিস্টোফারের হাতে মালিশ করতে লাগলো। “কি কথা, সোনা?”

“তুমি বুঝবে না।”

লিডিয়া ক্রিস্টোফারের ঘাড়ের মাংসপেশিতে হাত বুলালো, ওগুলো ঠিক নোঙরের কাছির মতো পাকানো। আরো জোরে চাপ দিলো ও, যতোটা পারে ভিতরে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করছে আঙুল। ক্রিস্টোফার আরামে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো।

“একবার বলেই দেখুন না,” লিডিয়া আবদারের সুরে বললো। “আপনি নিজের ভিতর এতো কিছু চেপে রাখেন! আমাকে বলে কেন কিছুটা হালকা হন না?”

ক্রিস্টোফারের আসলে বলার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু লিডিয়ার আঙুলের চাপে মনে হলো যেনো কিছু একটা খুলে গেলো, অনেকটা বোতলের মুখ খুলে যাওয়ার মতো। “টম কোর্টনী এখানে হাজির হয়েছেন,” ফস করে বলে ফেললো ও।

লিডিয়ার আঙুল থেমে গেলো। “টম কোর্টনী?”

“গাইয়ের ভাই। আজ সন্ধ্যাতেই তার সাথে দেখা হলো। উনি এখানেই আছেন। ঐ অবরোধকারীদের দলে।”

“নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?”

“উনি তরবারিটা চিনে ফেলেছেন। এটা নাকি তার বাবার ছিলো। আর এখন ওনার।” একবার শুরু হতেই বাঁধ ভাঙা নদীর মতো করে কথা বের হতেই থাকলো ক্রিস্টোফারের মুখ দিয়ে। “তুমি না বলেছিলে তোমার সাথে যারা আছে তাদের একজন হচ্ছেন সারাহ কোর্টনী। উনি হচ্ছেন টমের স্ত্রী-উনি এসেছেন ওনাকে উদ্ধার করতে।”

লিডিয়ার মস্তিষ্কে ঝড় চলছে। তথ্যগুলো হজম করার চেষ্টা করছে, সেই সাথে ওগুলোর গুরুত্ব নিরূপণের চেষ্টা করছে।

“গভর্নর ওনাকে পাঠিয়েছেন নাকি?” সাবধানতার সাথে জিজ্ঞেস করলো লিডিয়া। “গাই কি অ্যাগনেস আর সারাহকে মুক্ত করতে এই সৈন্যদল পাঠিয়েছেন?”

ক্রিস্টোফার হাসলো। “সেটা কোনোদিন সম্ভব না। গাই আমার চাইতেও টমকে বেশি ঘৃণা করে। যদি জানতে পারে যে টম এখানে, তাহলে উনি নিজে এসে টমের গলা কেটে আংরিয়াকে উপহার দেবে।”

“কোর্টনীদের সম্পর্কে দেখি আপনি অনেক কিছু জানেন,” খোঁচা মেরে বললো লিডিয়া। “আপনি কি আমাকে না জানিয়েই সারাহের সাথে শুয়েছেন নাকি?”

ক্রিস্টোফারের চেহারা আবার কালো হয়ে গেলো। লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ও। এমনভাবে ওর আপাদমস্তক দেখতে লাগলো যে লিডিয়া ওর জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেলো। এই মেজাজে ক্রিস্টোফার যে কোনো কিছু করে বসতে পারে।

“আমাকে বলুন, সোনা,” অনুনয় করলো ও। “আমি তো আপনারই দলে।”

ক্রিস্টোফার আর নিজের ভিতর কথাগুলো ধরে রাখতে পারলো না। “সারাহ কোর্টনী আমার চাচী। আমি হচ্ছি ক্রিস্টোফার কোর্টনী, গাই-এর ছেলে। দুই বছর আগে আমি গাই-এর সাথে ঝামেলা করে বোম্বে থেকে পালিয়ে চলে আসি।”

আচমকা সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো লিডিয়ার কাছে। “আপনি নিশ্চয়ই গাইকে খুব ঘৃণা করেন?”

“আমার সমগ্র সত্তা দিয়ে।”

কথোপকথন দ্রুত আগাচ্ছিলো। আর এতোগুলো সম্ভাবনার মাঝ দিয়ে লিডিয়া ঠিক করতে পারছিলো না কোনটা ধরে নাড়লে ওর সবচে সুবিধা। ওর আপাতত সব গোপন রাখলেই ভালো হবে মনে হয়। কিন্তু ও যদি এখন না বলে, আর ক্রিস্টোফার পরে সব জানতে পারে, তাহলে সম্ভবত কোনোদিনও ওকে ক্ষমা করবে না।

লিডিয়া ওর দিকে ঝুঁকে এলো। এরপর ও যা বলতে চাচ্ছে সেটা ও চাইলেও আর আটকে রাখতে পারলো না।

“গাই আপনাকে ঘৃণা করার একটা কারণ আছে, যা আপনি জানেন না। গাই আপনার বাবা নন।”

ক্রিস্টোফার এতটাই অবাক হলো যে হেসে ফেললো। পর মুহূর্তেই ওর চেহারা শক্ত হয়ে গেলো। যেনো লিডিয়াকে ধরে মার দেবে। “এসব কি আবোল তাবোল বলছো?” ওর গলা চড়ে গেলো। “তুমি কি ভেবেছো যে। তোমাকে আমার বিছানায় শুতে দেই মানে এসব উল্টাপাল্টা বলে আমাকে অপমান করতে পারবে? আমি চাইলে এখুনি তোমাকে আবার কয়েদখানায় ফেরত পাঠাতে পারি-বা আংরিয়ার কাছে মজা করতে পাঠাতে পারি।”

“সারাহ কোর্টনী বলেছে আমাকে, কোনোমতে বললো লিডিয়া। “তার বোন, মানে আপনার মা ক্যারোলিন নাকি টমের সাথে শুয়েছিলেন। যখন ওনারা সবাই একসাথে জাহাজে করে ইংল্যান্ডে যাচ্ছিলেন তখন। গাই তাকে স্পর্শ করার আগেই উনি গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন।” লিডিয়া খেয়াল করলো টম ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তার পেটে ছিলেন আপনি।”

“অসম্ভব।” কিন্তু ও যতোই কথাটাকে অস্বীকার করতে চাক না কেন, ওটা ওর মাথায় ঘুরতে লাগলো। কথাটার সত্যতা ওর ভেতরে অনুরণিত হতে লাগলো। কিছুতেই সরাতে পারলো না। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। ঠিক যেমন একজন নাবিক তার চার্টে দেখনো পথ ধরে নিরাপদে জাহাজ বন্দরে ভেড়াতে পারে, ক্রিস্টোফারও তেমনি ওর সারা জীবনের নতুন একটা গতিপথ দেখতে পেলো। গাইয়ের মেজাজ, নিজের স্ত্রীর প্রতি তার তীব্র অসন্তোষ, নিজের সন্তানের প্রতি তার অসম্ভব আক্রোশ। যেভাবে ছোট থেকে কোম্পানির লোকজন এটা সেটা বলাবলি করতো, আর গাই ঘরে ঢুকলেই চুপ হয়ে যেতো। সত্য কথা হচ্ছে, ওর বাবার চুল লাল আর চামড়াও ফর্সা, আর ক্রিস্টোফারের চুল আর গায়ের রঙ দুটোই গাঢ়। তুমি ভেবছিলে এসব তোমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। নিজেকে তিরস্কার করলো ও। সৈকতে দেখা লোকটার দর্পন প্রতিবিম্ব ও। টম কোর্টনীর ছেলে ও।

ওর সারা জীবনটা বদলে গেলো মুহূর্তেই। জানালার চৌকাঠে হাত রেখে বাইরের রাতের আকাশের দিকে চেয়ে রইলো ও। লিডিয়া পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

“টম আপনার বাবা,” আবার বললো লিডিয়া। “আর উনি এখানেই আছেন, অপেক্ষা করছেন।” বলে ও জানালা দিয়ে দূরে অবরোধকারীদের জ্বালা আগুনগুলোর দিকে ইশারা করলো। “এখন আর আপনার উচিত হবে না। ওনাকে তার স্ত্রী আর তার আপন ছেলের সহবত থেকে বঞ্চিত করা। চলেন আমরা ওনার কাছে যাই। আজ রাতেই। আমি জানি আপনি প্রহরীদের একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। দেখবেন, উনি আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবেন। আপনাকে নিজের সন্তান হিসেবেই মেনে নেবেন।”

লিডিয়া চুপ করে গেলো। ক্রিস্টোফার জানালার উপরে নেপচুন তরবারিটা তুললো। ফলাটা দিগন্তের দিকে তাক করা।

“এটা জন্মগত ভাবেই আমার সম্পত্তি,” বিড়বিড় করে বললো ক্রিস্টোফার। “টম কোর্টনী এটা তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে, আর আমিও এটা তার কাছ থেকেই পেতাম। যদি না সে আমাকে ফেলে পালাতে।”

“এখনতো আবার উনি. আপনাকে খুঁজে পেয়েছেন, লিডিয়া বললো।

ক্রিস্টোফার ঘোর লাগা চোখে তাকালো লিডিয়ার দিকে।

“না, নরম স্বরে বললো ক্রিস্টোফার। তারপর একটু ভেবে যেনো ব্যাপারটার নিশ্চয়তা খুঁজে পেয়ে আবার বললো, “না।”

লিডিয়া এর আগে কখনো ক্রিস্টোফারের চোখে এমন উন্মাদ দৃষ্টি দেখেনি। ও পিছনে দিকে সরে গেলো। বুঝলাম না।”

ক্রিস্টোফার তরবারিটা খাপে ভরে রাখলো। “টম কোর্টনী কেমন মানুষ?” শীতল গলায় বললো ও। “আমার মা-কে ভোগ করলো, তারপর মায়ের পেটে যখন আমি আসলাম, তখন তাকে একটা ময়লা কাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আমার বাবা-গাই-যে আমাকে ঘৃণা করে, সেটা কোনো অবাক করার বিষয় না। আমি তাকে সন্তুষ্ট করার কত চেষ্টা করেছি, তার আদর পাওয়ার জন্যে কতো কষ্টই করেছি, কিন্তু তবুও উনি আমাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারেননি, কারণ আমি তার সন্তান নই।”

“আপনার পক্ষে তো জানা সম্ভব ছিলো না।”

“আমি ওনাকে কতোটা যে অপছন্দ করি!” প্রতিটা শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করতে লাগলো ক্রিস্টোফার। “আমি বুঝি না। উনি আমার মায়ের সম্মান রক্ষা করেছেন। চাইলে ওনাকে ছেড়ে দিতে পারতেন। এরপরে আবার আমাকেও ভালবাসাটা আসলে তার জন্যে বেশি বেশি হয়ে যেতো। আমি ছিলাম তার ভাইয়ের অপরাধের প্রমাণ, কিন্তু তবুও উনি আমাকে তার ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। উনি ওনার সর্বোচ্চটা করেছেন, উনি আমাকে তার সন্তান হিসেবে পালন করেছেন, কিন্তু বিনিময়ে আমি তাকে ঘৃণা বাদে আর কিছুই দেইনি। আর তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে, তাহলে হয়তো জীবনেও আমার সত্যিটা জানা হতো না।”

ক্রিস্টোফার শক্ত হাতে লিডিয়ার মুখটা ধরে রইলো। লিডিয়া নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেললো না। ক্রিস্টোফারের চোখের দিকে চাইলো, কিন্তু ক্রিস্টোফার কি ওকে চুমু খেতে চায় নাকি ঘাড়টা মটকে দেওয়ার জন্যে এভাবে ধরেছে সেটা ও জানে না।

“আমি দুঃখিত, কোনোমতে বললো লিডিয়া।

ক্রিস্টোফার ওর কপালে চুমু খেলো। “তুমি ভুল কিছু করোনি। তোমাকে ধন্যবাদ। এখন আমার সামনে বিশাল একটা সুযোগ এসে হাজির হয়েছে।”

লিডিয়া আশান্বিত হয়ে উঠলো, “কিসের? বাবার সাথে পুনর্মিলনের?”

“প্রতিশোধ নেওয়ার।”

*

কোনো শব্দ না করেই নৌকাগুলো ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলো। ফ্রান্সিস দাঁড় আটকানোর জায়গাটাতে সবাইকে ভালোমতো তেল দিয়ে রাখতে বলেছিলো। আর দাঁড়েও বলেছিলো ন্যাকড়া বেঁধে নিতে, যাতে শব্দ সর্বনিম্ন হয়। মারাঠারা পাহাড়ী মানুষ, নৌকা চালিয়ে অভ্যস্ত না। দুর্গ থেকে দেখা যায় না এমন জায়গায় নিয়ে, টম আর ফ্রান্সিস ওদেরকে সারাদিন অনুশীলন করিয়েছে। কেস্ট্রেল-এর নাবিকেরা ছিলো ওদের প্রশিক্ষক। কিন্তু যতোই হোক, এই রাতের বেলা, খোলা পানিতে ওরা ঠিকই গণ্ডগোল করে ফেললো।

একজন মাল্লা ঠিকমতো দাঁড় ফেলতে পারলো না। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে হাত থেকে পিছলে গেলো দাঁড়টা। ঠাস করে সোজা গিয়ে পড়লো নৌকার ভিতর জড়ো করে রাখে অস্ত্রগুলোর উপর। দাঁড়ের বাড়ি খেয়ে তরবারিগুলো ঝনঝন করে উঠতেই মাল্লাটা গালি দিয় উঠলো।

“আস্তে,” হিসিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস।

লোকটা দাঁড়টা আবার তুলে নিতে নৌকার খোলের দিকে ঝুঁকে গেলো। বাকিরা সবাই দাঁড় তুলে বসে রইলো, নিঃশ্বাস নেওয়ারও সাহস করছে না। সবাই কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে যে ওরা ধরা পড়ে গিয়েছে কিনা।

কিন্তু পাখির কিচিরমিচির, পোকামাকড়ের কিচকিচ, তীরে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ আর ওদের দাঁড় থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার শব্দ বাদে আর কিছুই শোনা গেলো না। মেরিডিউ ফ্রান্সিসের পাশে বসে নিচু স্বরে আদেশ দিতেই আবার সবাই বাওয়া শুরু করলো।

“যখন গোলাগুলি শুরু হবে, তখন এরা ঠাণ্ডা থাকতে পারলেই হয়, ফিসফিসিয়ে বললো মেরিডিউ। “যদি বেড়াটা কাটা না থাকে তো আমাদেরকে খুব দ্রুত পালাতে হবে।”

“ওটা কাটা থাকবে,” ফ্রান্সিস জোর দিয়ে বললো। যেনো নিজেকেই আশ্বস্ত করলো ও। নৌকার ডানপাশে দুৰ্গটার অবয়ব দেখা গেলো। তারাভরা আকাশের বিপরীতে কালো দেখাচ্ছে। একটা মিনারে আলো জ্বলছে। নিশ্চয়ই একজন প্রহরী ওদিক দিয়ে নজর রাখছে। সে কি চুপিচুপি ওদের জাহজাগুলোর দিকে যেতে থাকা এই ছোট্ট নৌকাটা খেয়াল করতে পারবে? গালিভাত নামের চারটা ডিঙি নৌকা। প্রতিটায় পঞ্চাশজন করে অস্ত্রধারী লোক।

টম চাচা এখন থাকলে ভালো হতো, মনে মনে ভাবলো ফ্রান্সিস। দুজনের এতো কষ্টের পর, ওর চাচার সান্নিধ্যেই নিজেকে নিরাপদ মনে হয়। ও ভেবেছিলো টম-ই বোধহয় এই আক্রমণে নেতৃত্ব দেবে-টম চেয়েছিলোও-কিন্তু শাহুজি বাধ সাধেন। “আপনিই আমাদেরকে এই বিশাল কামানগুলোকে এনে দিয়েছেন আর সেগুলো থেকে টুপিওয়ালাদের মতো গোলা ছোঁড়াও শিখিয়েছেন। যদি আপনি অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেন বা যদি পাহারাদারদের হাতে ধরা পড়েন বা অন্য কিছু হয় আপনার, তাহলে আমার সৈন্যদলের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে যাবে।”

“আমার স্ত্রী আছে ওখানে,” টম প্রতিবাদ করেছিলো। কিন্তু ও আর কোনো যুক্তি দেওয়ার আগেই ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। ও জানে ওর কি করতে হবে।

“আমি যাবো সৈন্য নিয়ে।”

এখন নৌকায় বসে সেজন্যে ওর আফসোস হচ্ছে না-তবে ভয় পাচ্ছে ঠিকই। সামনেই কাঠ আর রশির ঘষা খাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো। ওরা ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। ও অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলো। বেড়াটা খুঁজছে, আশা করছে যে ওটা ওখানে থাকবে না।

“অন্তত ওরা আমদের জন্যে ওঁত পেতে নেই,” বিড়বিড় করে বললো ফ্রান্সিস। কোনো নৌকাতেই কোনো আলো নেই। আর তীরেও কেউ আগুন জ্বেলে পাহারা দিচ্ছে না। সম্ভবত আংরিয়া ওর সব লোককে দুর্গের ভিতরে থাকার আদেশ দিয়েছে।

ও পায়ের কাছে বস্তাটায় হাত দিলো। এটার ভিতর মাটির বানানো ছোট ছোট ঘটে তেল ভরে নিয়ে আসা হয়েছে। ঢাকনার ভিতর দিয়ে একটা সলতে ভরা। ওরা, দেখে ফেলার ভয়ে নৌকায় আগুন বহন করতে পারেনি, কিন্তু প্রতিটা নৌকাতেই আগুন জ্বালানোর মতো যথেষ্ট সরঞ্জাম আছে। ওরা আংরিয়ার জাহাজগুলোর কাছে পৌঁছালেই সলতেয় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে দেবে।

শৈল অন্তরীপটা পেরিয়ে উপসাগরে প্রবেশ করলো ওরা। দুপাশেই এখন ডাঙা। কালো দেখাচ্ছে সবদিকে। বেড়াটার কাছাকাছি চলে এসেছে। বা টের না পেয়েই ওটাকে ছাড়িয়ে এসেছে কিনা কে জানে। সম্ভবত লোকটা তার কথা রেখেছে।

ফ্রান্সিস ওর বসার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো, নৌকার দুলুনির তালে তালে দুলছে। দৃষ্টি সামনের দিকে নিবদ্ধ। সামনে কি কিছু দেখা যাচ্ছে? নাকি ওটা পানির ভিতর চর জাতীয় কিছু?

ধ্যাপ করে নৌকার সামনের অংশ শক্ত কিছু একটায় বাড়ি খেলো। ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে গিয়ে আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো ফ্রান্সিস। লোকজন সতর্ক হয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো; কয়েকজন দাঁড় ফেলে অস্ত্র তুলে নিয়েছে।

“বেড়াতে লাগলো নাকি?” সতর্ক কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস।

মেরিডিউ অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে জিনিসটা কি সেটা বোঝার চেষ্টা করলো। “এটা একটা নৌকা,” ও জবাব দিলো। “আমরা বন্দরের ভিতরে।”

ফ্রান্সিস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বেঈমান লোকটার লোভের উপর সন্দেহ না থাকলেও, লোকটার উপর ভরসা করতে পারেনি। আর এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ও নিশ্চিত ছিলো না যে বেড়াটা কাটা কিনা।

“আমরা কি বোমাগুলোয় আগুন লাগানো শুরু করবো?” মেরিডিউ জিজ্ঞেস করলো।

“আর একটু ভিতরে যাওয়ার পরে,” ফ্রান্সিস বললো। “প্রথম জাহাজটায় আগুন দেওয়ার পরেই কিন্তু আমাদেরকে পালানোর তোড়জোড় শুরু করতে হবে।”

ও পিছনে ফিরে দেখে বাকি নৌকাগুলোও চলে এসেছে। ভেজা দাড়ের পানি স্নানভাবে চিকচিক করছে। “সবার শেষের নৌকাকে বলো এখানেই অপেক্ষা করতে যাতে পালানোর সময় সমস্যা না হয়। বাকিরা আমাদের পিছু পিছু আসো।”

নৌকাগুলো ঘাট বরাবর এগিয়ে গেলো। মেরিডিউ নৌকার সামনে লগি হাতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। সামনে কিছু পড়লে সরিয়ে দেবে ওটা দিয়ে। আংরিয়ার বহরের কাছে পৌঁছে যাওয়ায়, ফ্রান্সিস জাহাজগুলোকে আরও স্পষ্ট দেখতে পেলো। অনেকগুলোই ছোট, ওদের গালিভাতের চাইতে বড় না, কিন্তু কয়েকটা আছে বিশাল গ্রাব, নাক ভোতা জাহাজ ওগুলো। মাস্তুল নৌকার লোকগুলোকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গিয়েছে। ফ্রান্সিস অনুমান করলো যে ওগুলোতে নিশ্চয়ই যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ আছে, নইলে এগুলোও দুর্গের রসদপাতি আনার কাজে ব্যবহার করতো আংরিয়া। এগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই ও অনেক দূরে চলে যেতে চায়।

ওরা বেয়ে চললো। সামনে আর কোনো গ্রাব নেই, তার মানে ওরা নিশ্চয়ই জেটির পিছনে কম পানিতে চলে এসেছে। এখানেই নদীর মুখটা। ফ্রান্সিস সবাইকে থামতে আদেশ দিলো।

“অনেকদূর চলে এসেছি,” ঘোষণা দিলো ফ্রান্সিস। “বোমাগুলোতে আগুন লাগাও।”

ওর কেমন যেনো লাগতে লাগলো। এটাই হচ্ছে সবচে বিপজ্জনক সময়, উপসাগরের অনেক ভিতরে চলে এসেছে ওরা। কিছু হলে, মাঝখানে আরো দুটো নৌকা পেরিয়ে তারপর নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে পারবে। এখন আবার ওদেরকে আগুন জ্বালাতে হবে, কেউ নজর রেখে থাকলে নিজেদের উপস্থিতি ফাস হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণের মাঝেই।

কিন্তু এই কাজটা করতেই এসেছে ওরা। ফ্রান্সিস আগুন জ্বালার বক্সটা থেকে ছোট একটু আগুনের মশলা বের করলো। মেরিডিউ বস্তাটা নৌকার খোলে উপুড় করে সবগুলো বোমা বের করে এক সারি করে রাখলো। ফ্রান্সিস চকমকি পাথরটা ঘষা দিলো ইস্পাতের উপর।

প্রথম ফুলকিটা আগুনের মশলায় স্পর্শ করার আগেই একটা গুলির আওয়াজ রাতের নীরবতাকে খান খান করে দিলো। ঝট করে মাথা তুললো ফ্রান্সিস। সাথে সাথে দেখতে পেলো উপসাগরে ঢোকার মুখে কোথাও কামানের মুখ থেকে আগুন বেরিয়ে এলো।

“আমাদের লোকজন নাকি?” প্রশ্ন করলো ফ্রান্সিস। কিন্তু আর একটা শব্দ শুনেই বুঝলো এটা ওদের কাজ না। যে নৌকাটাকে পাহারায় রেখে এসেছে সেটা ছিলো উপসাগরের মাঝখানে। গোলার আওয়াজ আসছে কাছের ডাঙা থেকে।

“নৌকা ঘোরাও,” চিৎকার করে আদেশ দিলো ও। “আমরা ধরা পড়ে গিয়েছি।”

অস্ত্র ফেলে দিয়ে দাঁড় তুলে নিলো সবাই। অন্ধকারে একজন আর একজনের সাথে ঠোকাঠুকি লেগে গেলো। কয়েকজন আবার বসলো উল্টো হয়ে, ফলে দাঁড়ে দাঁড়ে বাড়ি খেতে লাগলো; কোনো দিকে না এগিয়ে এক জায়গায় পাক খাওয়া শুরু করলো নৌকাটা।

“সবাই একসাথে,” ফ্রান্সিস চেঁচালো। সামনে ও শুধু একগাদা কালো অবয়বকে দাঁড় হাতে ঠেলাঠেলি করতে দেখতে পাচ্ছে। কোনদিকে যে যাচ্ছে। সেটা যেমন বুঝতে পারছে না, কোনদিকে যাওয়ার আদেশ দেবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না।

তারপর আচমকা সবকিছু আলোকিত হয়ে গেলো। উপসাগরের সবকিছু। দুইপাড় জুড়ে বিশাল বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠলো। ওগুলোর আগুন এতো উজ্জ্বল ভাবে আর এত উপরে উঠতে লাগলো যে ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চোখে ঠিকমতো দেখতে পেলো না। নোঙর করে রাখা জাহাজগুলোতেও আরো অনেকগুলো আলো জ্বলে উঠলো। অনেকগুলো পায়ের দৌড়ে আসার শব্দ শোনা গেলো ডেক-এর উপর। এততক্ষণ লুকিয়ে ছিলো এরা।

রাত যেনো দিনে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। নিজের দৃষ্টি ঠিক হতেই ফ্রান্সিস চেয়ে দেখলো নৌকার সবাই আতংকে জায়গায় জমে গিয়েছে। যেনো বজ্রাহত হয়ে আছে সবাই। আলোর পরিমাণ বাড়তেই লাগলো। আরো অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হচ্ছে। পাহাড়ের চূড়ায় সংকেত দেওয়া হতে লাগলো। দুর্গের ভিতর থেকেও আলো আসতে লাগলো। নৌকা থেকে জাহাজের খোপ দিয়ে কামান বের করার অশুভ ধ্বনি ভেসে এলো ফ্রান্সিসের কানে।

“ফাঁদে পড়েছি আমরা!” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

*

ঘুম আসছে না টমের। ফ্রান্সিস এখন এই অন্ধকারে সাগরে। নিজের জীবন বিপন্ন করে সারাহ আর অ্যাগনেসকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। টম সহজে দুশ্চিন্তা করে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটুও স্থির হতে পারছে না। নিজের তাবুতে শুয়ে আছে ও, ভেবেছিলো একটু ঘুমাতে পারলে সময়টা তাড়াতাড়ি যাবে। কিন্তু দেখা গেলো শোয়া মাত্র দুনিয়ার যতো খারাপ চিন্তাগুলো ভীড় করতে লাগলো মাথায়। যদি বেড়াটা ভোলা না থাকে? যদি দস্যুরা ওদেরকে ধোকা দেয়? বা যদি আংরিয়া ধরে ফেলে ঐ ডাকাতটার কাছে থেকে চাপ দিয়ে সব কথা বের করে ফেলে? যদি-?

থাকতে না পেরে শেষমেশ ও তাবু থেকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের উপরের মিনারটার উপর উঠে গেলো। এতো উঁচু থেকে পাহাড়ের শেষ প্রান্ত, আর তার নিচের উপসাগর দুটোই দেখা যায়। ওখানেই আংরিয়ার জাহাজগুলো নোঙর করে রাখা, ফ্রান্সিসেরও এতোক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা সেখানে। টম নিশ্চিত যে ও সবার আগে আগে যাচ্ছে।

নিজের ভাতিজাকে নিয়ে গর্ব করে টম। গত কয়েক মাসে ওরা দুজন দুজনের চোখের আড়াল হয়নি বললেই চলে। এখন ছেলেটা কাছে না থাকায় টম বুঝতে পারছে ওর অনুপস্থিতি কতোটা মর্মপীড়াদায়ী। টম ফ্রান্সিসের উপর ভরসা করেই চলে এখন। ফ্রান্সিসের তারুণ্য, ওর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, ওর শান্তশিষ্ট মার্জিত চলাফেরা। এরকম কাউকে নিয়ে যে কেউই গর্ব বোধ করবে।

হঠাৎ একটা অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো ওর মন। আবারও ওর মনে সেই বহু বছর আগের টেমস নদীর ভয়ংকর স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেলো। মুখ ঢাকা মানুষটার হাতে পিস্তলটা দেখা; একটা জ্যাভেলিনের মতো করে নেপচুন তরবারিটা ছুঁড়ে দেওয়া, সেটা লোকটার হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিতে দেখা। আবোলি মৃত লোকটার মুখের আবরণ সরাতেই সেখানে বিলির মুখ আবিষ্কৃত হওয়া।

আমি ফ্রান্সিসের বাবাকে খুন করেছি। এটাই ওর আদি পাপ। প্রতিবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেই এই অমার্জনীয় অপরাধটা ওকে তাড়া করে।

কিন্তু ও ফ্রান্সিসকে যতোটা ভালোবাসে, বিলি কখনোই ততোটা বাসতো না, ভাবলো টম। ফ্রান্সিসের ভালো দিকগুলো দেখলে বিলি সহ্য করতে পারতো না। দরকার হলে পিটিয়ে ওর ভিতর থেকে ভালোটা বের করে ওকে একজন শয়তানে পরিণত করতো। ফ্রান্সিস তখন পরিণত হতো এক ভাঙাচোরা, বিকৃত মানসিকতার মানুষে। বা আরো খারাপ, হয়তো হুবহু বিলির মতো হতো। এক শয়তান, যে কিনা শুধু ক্ষমতার লোভে মত্ত, যে কিনা অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজের আখের গোছাতে ছাড়ে না।

আমি বিলিকে খুন করেছি। কিন্তু আমি ফ্রান্সিসকেও বাঁচিয়েছি। এই অনুভূতিটা একটা চাবির মতো টমের মনটা পাল্টে দিলো। প্রায় বিশ বছর ধরে বন্ধ থাকা একটা তালা খুলে গেলো যেনো। ও এতোদিন বুঝতেও পারেনি যে এতো শক্ত করে এই বাঁধনটা ওর বুকে চেপে বসে ছিলো, আজ এখন সেটা খুলে যাওয়ায় বুঝতে পারছে। একটা নতুন চেতনা যেনো জাগ্রত হচ্ছে ওর ভিতরে। ওর আত্মাকে পরিপূর্ণ করে দিচ্ছে। রাতের তাজা আর পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাস বুক ভরে টেনে নিলো ও। এতো সব সুগন্ধে ভিতরটা ভরে গেলো যেগুলো ও এতোদিনে এই প্রথম খেয়াল করলো।

বিলিকে খুব করার অপরাধবোধ কখনোই যাবে না ওর। কিন্তু অবশেষে ও সেটা থেকে মুক্তিরও একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে।

নিচের অন্ধকারে একটা আগুন ঝলসে উঠলো। টম মিনারের ধারটা চেপে ধরলো। ৰিলিসহ যাবতীয় চিন্তা মুহূর্তে উবে গিয়েছে। ফ্রান্সিস নিশ্চিত বেড়াটা পার হয়ে উপসাগরের ভিতরে ঢুকে ওর বোমাগুলো ছোঁড়া শুরু করেছে। টম ফ্রান্সিসের ছোট নৌকাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। এটাই হচ্ছে পরিকল্পনার সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ। ফ্রান্সিসরা যদি এখন দ্রুত পালিয়ে আসতে না পারে, তাহলে সোজা আংরিয়ার কামানের মুখে পড়ে যাবে।

কিন্তু আগুনের শিখা কোনো জ্বলন্ত জাহাজ থেকে আসছে না। ওগুলো আসছে ডাঙা থেকে। একটা বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে যাচ্ছে সোজা আকাশের দিকে। ওটার পাশেই আরো একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠলো। তারপর আর একটা, আরো একটা, কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো উপসাগরটা যেনো একটা চুলায় পরিণত হলো। জাহাজের ডেক এ লোকজন জড়ো হতে লাগলো। এদেরকে দেখে মনে হলো না যে ওরা অবাক হয়েছে, কেউই ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে এসে হাজির হয়নি। সবাই-ই আগে থেকেই সচেতন ছিলো কি ঘটতে যাচ্ছে, উঠে এসেই কামানের দিকে ছুট দিলো সবাই।

টমের কেমন অসুস্থ লেগে উঠলো। ওখানে আর দেরি করলো না ও। মই বেয়ে একরকম পিছলে নেমে এলো নিচে। ঘষায় হাত ছিলে গেলো, কিন্তু পরোয়া করলো না। দৌড়ে গেলো শাহুজির তাবুর দিকে।

“ওরা আমাদের জন্যে ফাঁদ পেতে বসে ছিলো,” হড়বড় করে বললো টম। আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না ওর। কারণ সাথে সাথে কামানের বিস্ফোরণের শব্দ তাঁবুর দেয়াল কাঁপিয়ে দিলো। এরপর একের পর একে চলতেই থাকলো। এক মুহূর্তের জন্যেও থামছে না গোলাবর্ষণ। ফ্রান্সিস এই গোলাগুলির ভিতর ছোট্ট একটা নৌকায় করে ভাসছে সেই চিন্তাটা মাথায়ও আনতে চাচ্ছে না টম।

শাহুজি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। উনি উঠে দ্রুত একটা চাদর গায়ে দিলেন। নিচের উপসাগর থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ চলতেই থাকলো।

“আমার সাথে পাঁচশো লোক দিন,” অস্থির কণ্ঠে বললো টম। “আমি উপসাগরে গিয়ে ওদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবো-বা অন্তত ওদের গোলার জবাব দিতে পারবো।”

শাহুজি মাথা নাড়লেন। “আমি জানি আপনার ভাতিজা ওখানে আছে। কিন্তু উপসাগরের দুই পাশেই খাড়া পাহাড়। এই অন্ধকারে ওদিক দিয়ে নামতেই পারবেন না। আর ওরা সবাই কামানের আড়ালে থাকবে। ওরা যেহেতু জানতো যে নৌকাগুলো যাবে, তার মানে ওরা এটাও ধরে রেখেছে যে আমরা ওদেরকে উদ্ধার করতে যাবো। ওদের গোলন্দাজেরা সাথে সাথে দেয়ালের পিছনে কামানে বসে যাবে, আর আপনাদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।”

টম জানে যে শাহুজি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ফ্রান্সিসের কিছু হয়ে যাওয়ার ভয় ওকে এসব যুক্তি মানতে সায় দিচ্ছে না। “আমি একাই যাবো তাহলে।”

“আপনাকে আমি আটকাবো না। কিন্তু খামাখা শহীদ হয়ে গেলে আপনার ভাতিজা বাঁচবে না-বা দুর্গের ভিতরে আপনার স্ত্রীও উদ্ধার হবে না।”

টম থমকে গেলো। রাজার এই নিষ্ঠুর ধীর স্থির কথাবার্তা ওর সহ্য হচ্ছে না। শাহুজির মতো এক অর্বাচীনের কাছ থেকে ওর এরকম জটিল পরিস্থিতিতে কি করা উচিত সেই শিক্ষা নিতে হবে না।

“আপনি বলেছিলেন এই আক্রমণটা ব্যর্থ হলে আপনাকে অবরোধ ছেড়ে দিতে হতে পারে,” টম বললো।

“আমি আপনাকে আগেও বলেছি, আমরা হচ্ছি গোয়ালঘরের ইঁদুর। আমরা আমাদের শত্রুকে তিলে তিলে মারি। আর যখন বিড়াল আসে, তখন আমরা দৌড়ে আমাদের গর্তে গিয়ে লুকাই। এভাবেই টিকে আছি আমরা।”

কামানের গোলার আওয়াজ বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। টম টের পাচ্ছে তাঁবুর খুঁটিগুলোর কম্পন থামছেই না। ওর হাতে সময় নেই।

“আংরিয়া কিন্তু জানতো যে আমরা ঘাটের দিক দিয়ে আক্রমণ করবো,” আচমকা বলে উঠলো টম।

“সেরকমই মনে হচ্ছে।”

“তার মানে ও দুর্গ থেকে ওদিকে লোকজন পাঠিয়ে দিয়েছে কামান চালানোর জন্যে।” টমের মাথার ভিতর একটা পরিকল্পনা বাসা বাঁধছে। একটা জুয়া, কিন্তু ওর মাথায় আর কিছু আসছে না। ফ্রান্সিস, সারাহ আর অ্যাগনেস-ওদের সবার জীবন এখন হুমকির মুখে।

শাহুজি টমের অভিব্যক্তিটা খেয়াল করলেন। “কি করতে চাচ্ছেন আপনি?”

“আংরিয়া যেটার কথা স্বপ্নেও ভাববে না।”

*

উপসাগরটার পাশের আগুন এতো উঁচুতে উঠে গেলো যেনো মেঘ ছুঁয়ে ফেলবে। পানির উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়তে লাগলো; কামানের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলো চারপাশে।

ফ্রান্সিসদের নৌকার অবস্থাটা হচ্ছে বস্তায় ভরা বিড়ালের বাচ্চার মতো। পালাতে হলে ওদেরকে আংরিয়ার বিশাল জাহাজ বহরের কামানের সামনে দিয়ে যেতে হবে। একেকটা গ্রাব বিশাল লম্বা। গালিভাতের লোকজন নিজেদের নৌকার মুখ ঘোরানোর জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা হতে লাগলো খুবই ধীরে ধীরে। ওদের চারপাশে কামানের গোলা শব্দ তুলে উড়ে যাচ্ছে। একটা এসে ওদের একজনের মাথা উড়িয়ে নিয়ে গেলো। দেখে মনে হলো যেনো গাছ থেকে নারিকেল পড়লো। আর একটা সোজা এসে পড়লো পিছনের নৌকাটায়। সাথে সাথে দুইভাগ হয়ে গেলো নৌকাটা, আরোহীরা সবাই পানিতে ছিটকে পড়লো। কামানের গর্জনের সাথে এবার যুক্ত হলো আর্তচিৎকার। মারাঠারা সাঁতার পারে না।

ফ্রান্সিস হালটা ধরে মোচড় দিলো। গালিভাতের নাক ঘুরে গেলো দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজগুলোর দিকে।

“আরে করছেনটা কি?” চেঁচিয়ে উঠলো মেরিডিউ। “মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?”

“জাহাজের দিকে গেলেই ভালো হবে,” ফ্রান্সিস বললো। “আমাদের দিকে আর গোলা ছুঁড়তে পারবে না তাহলে।”

লোকজন সজোরে দাঁড় বাইতে লাগলো। সবার মুখ নৌকার পিছনের দিকে থাকায় ওরা দেখছে না যে ফ্রান্সিস ওদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে কামানের গর্জন আরো জোরালো হওয়ায় ওর উদ্দেশ্য ঠিকই ধরতে পারলো। কামানের মুখ থেকে বের হওয়া আগুনের হলকা এসে লাগতে লাগলো ওদের পিঠে। লোহার বল চারপাশের বাতাসকে চিরে দিচ্ছে থেকে থেকে। গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে মাথার উপর। ভয়ংকর লাগছে শুনতে, তবে এখন ওরা ওগুলোর নাগাল থেকে নিরাপদ। ওর জাহজাগুলোর এতো কাছে চলে এসেছে যে কামানের মুখ এতো বেশি বাঁকানো সম্ভব না।

কামানের গুরুগম্ভীর গর্জন থেমে এখন শুরু হলো মাস্কেটের খট খট। গ্রাবের লোকজন রশি বেয়ে মাস্তুল বেয়ে উঠতে শুরু করলো, যাতে ওখান থেকে নিচে গুলি ছুঁড়তে পারে। নৌকার চারপাশে মুহূর্তের মাঝে সীসার ভারী বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। আশে পাশের পানি টসবগ করে ফুটতে আরম্ভ হলো গুলির চোটে।

অনেকগুলো গুলিই লাগলো জায়গা মতো। একটা ভোলা নৌকার ভিতর ঠাসাঠাসি করে এতোগুলো লোক বসে আছে, ফলে লুকানোর কোনো জায়গা পেলো না ওরা। কিছুক্ষণ পরেই নৌকার খোল রক্তের পুকুরে পরিণত হলো। নৌকার দুই ধার ছিদ্র হয়ে চালুনির মতো দেখতে হয়ে গেলো, দাঁড়গুলো ভেঙে অর্ধেক নৌকার কিনারে ঝুলতে লাগলো, বাকি অংশ পানিতে ভেসে গেলো দূরে।

“কাছের গ্রাবটার দিকে গুলি করতে থাকো,” চেঁচিয়ে বললো ফ্রান্সিস। তবে আহতদের চিৎকার ছাপিয়ে অল্প কয়েকজনই ওর ডাক শুনতে পেলো। ওরা যদি জাহাজের বন্দুকবাজগুলোকে থামাতে না পারে, তাহলে এই ছোট নৌকাটায় কিছুক্ষণের মাঝে দস্যুরা ইচ্ছে মতো নিশানা করে মারতে পারবে ওদেরকে।

ফ্রান্সিস সামনে তাকালো। মাল্লারা সবাই দাঁড়ের উপর উবু হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে রক্ত ভরে আছে সবার। কিন্তু তখনও ওরা চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেনি। এই প্রচণ্ড আক্রমণের মাঝেও ওদের সাহসের প্রমাণ পেলো ফ্রান্সিস। তবে আর বেশিক্ষণ এই মনোবল ধরে রাখতে পারবে না। দস্যুদের সাথে লড়াই করতে হলে ওদের অন্য কিছু লাগবে।

জীবনে প্রথমবারের মতো ফ্রান্সিস নেতৃত্বের আসল বোঝা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারলো। ওকেই সবাইকে পথ দেখেতে হবে, আর সেটা করতে গিয়ে যদি মরেও যেতে হয় তবুও কিছু করার নেই।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়ালো, মাথা নিচু করে রেখেছে যাতে কামানের গোলা না লাগে। তারপরেও মাত্র এক ইঞ্চি উপর দিয়ে চুল পুড়িয়ে উড়ে গেলো একটা গোলা। দাঁড়ানোর সাথে সাথে ওর পায়ের ধাক্কা লেগে শক্ত কিছু একটা গড়িয়ে পড়ে গেলো-ওদের বানানো বোমাগুলোর একটা। দস্যুদের আচমকা আত্মপ্রকাশের কারণে ভুলেই গিয়েছিলো ওগুলোর কথা।

ফ্রান্সিস দুই হাতে দুটো তুলে নিলো। “আগুন জ্বালাও দেখি।”

মেরিডিউ সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলো। সাবধানে নিশানা করে ফ্রান্সিস দুটকেই ছুঁড়ে দিলো জাহজের ভিতর। এরকম গোলাগুলির মুখে যেখানে ওর নৌকা ভরে আছে মরা লাশ আর আহত লোকে, সেখানে ওর পক্ষে মাথা তোলাই ছিলো দায়-কিন্তু ওদের সবার জীবন মরণ নির্ভর করছিলো এটার উপর।

ওর নিশানা ভুল হলো না। বোমা দুটো জাহাজের কিনারে গিয়ে লাগলো, ঠিক কামানের খোপের নিচে। তারপর বিশাল দুটো অগ্নিশিখা তৈরি করে বিস্ফোরিত হলো। ওদিকে যে দস্যুরা ছিলো সাথে সাথে তাদের গায় আগুন ধরে গেলো। কয়েকজন ডেক-এ শুয়ে পড়ে গায়ের আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

গালিভাতটা গিয়ে গ্রাবটার গায়ে বাড়ি খেলো।

“আমার সাথে সাথে,” চিৎকার করে বললো ফ্রান্সিস। একপাশে একটা রশি ঝুলছিলো। ও সেটা আঁকড়ে ধরে একটা দোল দিয়ে জাহাজের পাশের কাঠের পাটাতনে উঠে এলো। কি হবে সেটা ভাবার সময় এখন হাতে নেই। বোমার তেলে খুব দ্রুত আগুন ধরে কিন্তু তাতে জাহাজে আগুন ধরেনি। দস্যুরা এর মধ্যেই আবার জড়ো হতে শুরু করেছে।

জাহাজের পাশের জালটা বেয়ে উঠে লাফ দিয়ে জাহাজের ডেকে নেমে এলো ফ্রান্সিস, তরবারি বের করে ফেলেছে। একজন দস্যু দৌড়ে এলো ওর দিকে। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে ছিলো ওর। আন্দাজেই ফ্রান্সিস দস্যুটার গলা বরাবর তরবারি চালালো, একবারের বেশি আর তরবারি তুলতে হলো না ওকে।

নির্মমভাবে লড়ে গেলো ফ্রান্সিস। ওর নিজের জন্যে, ওর লোকজনের জন্যে, সারাহ আর অ্যাগনেসের জন্যে-আর আবারও অ্যানাকে একনজর দেখার আশায়। একটা কামানের উপর লাফিয়ে উঠলো ও। জুতোর ভিতর দিয়ে ওটার গায়ের উত্তাপ টের পাচ্ছে। প্রথমে গোলন্দাজের চেহারা বরাবর লাথি হাকালো ফ্রান্সিস, তারপর লোকটা পিছিয়ে যেতেই সোজা পেটে চালিয়ে দিলো তরবারি।

একটা চিৎকার দিয়ে দস্যুটা ডেক-এ পড়ে গেলো। ফ্রান্সিস সামনে তাকালো। ওর দলের অনেকেই উঠে এসেছে জাহাজে। কয়েকজন মাস্তুল বেয়ে উঠে গিয়ে বন্দুকবাজগুলোকে পেড়ে ফেলার কাজ শুরু করে দিয়েছে। ওরা ওদেরকে টেনে নিচে ফেলে দিলো। ডেক-এর উপর পড়ে, ভর্তা হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হলো ওদের।

গ্রাবে যত লোক ধরে ততো লোক নেই। নিজের জাহাজের সংখ্যার উপর নির্ভর করে আংরিয়া ওর লোকদের অল্প অল্প করে সবগুলো জাহাজে ছড়িয়ে দিয়েছে। শুধু কামান দাগতে পারবে এরকম কয়জনই আছে একেকটা জাহাজে। ওরা ভাবেওনি যে ফ্রান্সিসের লোকেরা জাহাজে চড়তে পারবে। ফ্রান্সিসের লোকেরা লাগামহীন আক্রোশ নিয়ে লড়াই করতে লাগলো। ছোট নৌকাটায় যে যন্ত্রণা ওরা পেয়েছে তা সুদে আসলে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেলো সবগুলো দস্যু মৃত, নয়তো পানিতে ঝাঁপিয়ে পালিয়েছে।

“রশি কেটে দাও,” আদেশ দিলো ফ্রান্সিস। আজ অমাবস্যা, ভাটার টান খুব বেশি। যদি দস্যুদের কামানের গোলার হাত থেকে বাঁচা যায়, তাহলে স্রোতের টানেই ওরা এলাকাটা পেরিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করা যায়।

হঠাৎ ফ্রান্সিসের খেয়াল হলো এদের মাঝে ও-ই সবচে অভিজ্ঞ নাবিক। তার মানে ওদের সম্ভাবনা আরো কমে এলো। তবে মেরিডিউ ওর সাথে আছে, ও জানে কখন কি করতে হবে। মেরিডিউ-ই মারাঠাদেরকে নোঙ্গরের কাছিটা। দেখিয়ে কোথায় কাটতে হবে বলে দিলো। কয়েকজন ওই কাজে লেগে পড়তেই ফ্রান্সিসের চোখে পড়লো ক্যানভাসগুলো। ও কয়েকজনকে ওটার রশি ধরে টানার কাজে লাগিয়ে দিলো। প্রধান পালটা খুলে যেতেই মেরিডিউ দ্রুত দৌড়ে গিয়ে ওটার সাথে বাধা রশিগুলো টানটান করে দিলো। একেবেকে, থেমে থেমে জাহাজটা সামনের দিকে আগাতে লাগলো।

মেরিডিউ রশিগুলো ছেড়ে দিয়ে প্রায় বিড়ালের, দক্ষতায় লাফিয়ে নামলো। “নিচে নেমে গেলে ভালো হবে মনে হয়। সামনের গ্রাবের সারির দিকে দেখিয়ে বললো ও। “খোলা সমুদ্রে যেতে হলে আমাদেরকে আগে ওগুলো পার হতে হবে।”

অগ্নিকুণ্ডগুলোর তেজ কমে এসেছে। ফলে ডাঙায় থাকা দস্যুরা ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে জাহাজে আসলে কি হচ্ছে। নিজেদের লোকের গায়ে লাগিয়ে ফেলার ভয়ে গুলি করা বন্ধ রেখেছিলো ওরা। কিন্তু জাহাজ নড়ে উঠতেই বুঝলো যে ওটা মারাঠাদের দখলে চলে গিয়েছে, তাই আবার গুলি করতে শুরু করলো।

ফ্রান্সিস নিচে নামার হ্যাচের দিকে তাকালো। “আমি লুকাবো না,” দৃঢ় গলায় বললো ও। ও গ্রাবটার সামনের দিকে তাকালো। ওখানে চারকোণা একটা দুর্গ মতন বানানো। পিছন দিকে খোলা। ভিতরে দুটো নাইন পাউন্ডারের লম্বা নল উঁকি দিচ্ছে।

“চেষ্টা করে দেখি অবস্থার উন্নতি করা যায় কিনা।”

কামান চালাতে জানে এরকম ডজন খানেক লোক বাছাই করলো ফ্রান্সিস। তারপর ওদেরকে কামানগুলোর কাছে পাঠিয়ে দিলো। দস্যুগুলো পর্যাপ্ত পাউডার আর গোলা ফেলে রেখে গিয়েছে। টম যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবে করে দ্রুত ওরা কামানে গোলা ভরে সামনের জাহাজটার দিকে তাক করে ফেললো।

“যতোটা সম্ভব নিচু করে তাক করো,” নির্দেশ দিলো ফ্রান্সিস। “আমরা ওটার সামনে আর পিছন দুই দিকে ফুটো করে দেবো।”

কামান গর্জে উঠতেই জাহাজটা দুলে উঠলো। সন্তুষ্ট চিত্তে ফ্রান্সিস দেখলো গোলা দুটো সোজা গিয়ে জাহাজের পিছন দিকের খোল গুঁড়িয়ে দিয়ে ডেক-এর দিকে চলে গেলো। টম আর আবোলির কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার কারণে ও জানে যে গোলাটা সামনে যাকেই পাবে তাকেই ভর্তা বানিয়ে দিয়ে উড়ে যাবে।

“রি-লোড,” আদেশ দিলো ও। মারাঠারা কেউ ইংরেজি জানে না। কিন্তু আদেশটা ঠিকই ধরতে পারলো। ওরা দ্রুত হাতে নলটা পরিষ্কার করে ফেললো, তারপর ঠিকঠাক নিয়ম মেনে গোলা ভরে, আবার জায়গামতো গোলা ছুঁড়ে আবার পরবর্তী গোলা ভরার কাজ শুরু করে দিলো। দস্যুরা এর আগে কখনোই তাদের প্রতিপক্ষের কাছে থেকে এভোটা প্রতি আক্রমণের শিকার হয়নি। আর এতো দ্রুত পরে আরও একটা একটা আক্রমণ আসবে সেটা তো ছিলো ওদের কল্পনারও বাইরে। ওরা এখন এতো কাছে চলে এসছে যে ফ্রান্সিস জাহাজটার নিচের ডেক থেকে আর্তনাদও শুনতে পেলো।

মেরিডিউ হাল ধরেছে জাহাজটার। ও দিক পরিবর্তন করলো যাতে ওরা সামনের জাহাজটার পাশ কেটে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু জাহজটার পাশ ঘেঁষে খোলা পানিতে বেরিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, ও জাহাজটার পিছনে যাওয়া শুরু করলো। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানালো। এতে করে কামানের মুখ থেকে আংরিয়ার জাহাজটাই ওদেরকে আড়াল করে রাখবে।

কিন্তু তবুও এদিক দিয়ে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন, পরের বার কাছে আসতেই দেখা গেলো ওরা এতো কাছ দিয়ে যাচ্ছে যে দুটোর একটা আর একটার সাথে বাড়ি খেলো। যদি দস্যুগুলো এদিকের কামান প্রস্তুত করে রাখতো, তাহলে একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ফ্রান্সিস জাহাজটা গুড়ো গুছো করে দিতে পারতো। কিন্তু ফ্রান্সিসের একটু আগের আক্রমণের কারণে ওদের সবার কামানের মুখ এখন খোলা সাগরের তাক করা। ও দেখতে পেলো দস্যুরা দ্রুত কামানের মুখ এদিকে ঘোরানোর জন্যে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে।

“দেখা যাক এই শক্ত দাওয়াই ওরা কেমন হজম করতে পারে,” বললো ফ্রান্সিস। আর একটা বোমা তুলে নিলো ও দ্রুত হাতে জ্বেলে দুটো জাহাজের মধ্যবর্তী ছোট ফাঁকটা পার করে ছুঁড়ে দিলো জাহাজে। একগাদা দড়িদড়ার উপর পড়ে বিস্ফোরিত হলো বোমাটা। মাঝে দস্যুরা কামানে দাগার কথা ভুলে আগুন নেভাতে ছোটাছুটি শুরু দিলো। কারণ, ওরা সারা ডেক জুড়ে পাউডার আর গোলা ছড়িয়ে রেখেছে, একবার আগুন ওগুলোর একটা পিপার কাছে পৌঁছালেই কম্ম সাবার হয়ে যাবে। একজন এক বালতি পানি এনে আগুনের উপর ঢেলে দিলো সাথে সাথে বিশাল একটা অগ্নিশিখা ওকে গ্রাস করলো।

ডাঙা থেকে ভেসে এলো বাতাস। শুরুতে দুর্বল থাকলেও এই সরু পথ দিয়ে পার হওয়ার সময় চাপে পড়ে বেশ শক্তিশালী হয়ে গেলো সেটা। বানানোই হয়েছে অল্প বাতাসেও প্রচুর বেগ লাভের জন্যে। আর এই বাতাসে একেবারে উড়াল দিলো। ওরা সর্বশেষ বড় জাহাজটার পাশে চলে এলো। এটা পার হয়ে যেতে পারলেই খোলা সাগরে গিয়ে হাজির হওয়ার মাঝে আর ডাঙায় কয়েকটা কামান দেখা গেলো, কিন্তু সেগুলো নিয়ে আর দুশ্চিত ফ্রান্সিসের। দুর্গের কামানগুলো এতো বাঁকানো সম্ভব হবে না, আর গোলন্দাজেরা ওদের দিকে নিশানাই করতে পারলো না। একটা গোলাও ওদের কাছে এলো না।

ফ্রান্সিস পিছনে তাকিয়ে ঘাটটা ঠিকমতো দেখতে লাগলো। ওরটা কেটে বেরিয়ে এসেছে, আর দস্যুদেরকেও বেঈমানির উপযুক্ত শিক্ষা দিতে এসেছে। একটা জাহাজ গুঁড়িয়ে দিয়েছে, আর একটা দিয়েছে পুড়িয়ে। এখন আংরিয়ার গালিভাতগুলোর মাঝে ভাসছে, ফলে আরো ডজন কয়েক নৌকায় আগুন ধরে গিয়েছে।

কিন্তু এখনো দস্যুদের প্রায় অর্ধেক জাহাজ অক্ষত। আর প্রায় সব লোক নিয়ে ওরা এখানে এসেছিলো, এখন ফিরে যাচ্ছে গোটা তিরিশ। চড়া মূল্য দিতে হয়েছে ওদের। ফ্রান্সিসের মনে হতে লাগলো যে পুরো দায়টাই ওর।

যে নৌকাটাকে পাহারা দিতে রেখে গিয়েছিলো সেটাকে কোথাও দেখা গেলো না। ও আবার ভালো করে সামনে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো। মনে পড়লো, আক্রমণ যখন শুরু হয় তখন এখানেই প্রথম গোলা ছোঁড়া হয়েছিলো।

নৌকাটাকে দেখতে পেলো না ও। কিন্তু সেটা খুঁজতে গিয়েই সামনে কালো সমুদ্রের মাঝে আরো কালো একটা রেখা ধরা পড়লো ওর চোখে। এক মুহূর্তের জন্যে ও জোর করে মনকে বোঝাতে চাইলো যে ওটা আসলে সামান্য একটা ছায়া, বা ঢেউয়ের কোনো খেলা। কিন্তু সেটা মিথ্যা। নিজের চোখে দেখা জিনিসটাকে অস্বীকার করতে পারলো না ও শেকলে বাঁধা মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি পুরো উপসাগরের মুখটাকে আটকে রেখেছে।

“ওরা বেড়াটা বন্ধ করে দিয়েছে,” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

মেরিডিউ হাল টেন ধরতেই পুরো জাহাজ কেঁপে উঠলো।

“সোজা যেতে থাকো,” উন্মাদের মতো বলে উঠলো ফ্রান্সিস।

“তাহলে সোজা বেড়ায় গিয়ে বাড়ি খাবো,” মেরিডিউ মনে করিয়ে দিলো।

“ওটাকে ভেঙে বেরিয়ে যাবো।”

“জাহাজের মাথা ভেঙে যাবে। ডুবে যাবে জাহাজ।” উপসাগর যেখানে খোলা সাগরে মিশেছে, আসার সময় ওখানের পানির ঘূর্ণি দেখেই বুঝেছিলো যে নিচে কিরকম মারাত্মক চোরা স্রোত বইছে। “সোজা চলে যাবো সমুদ্রের তলায়।”

মেরিডিউ-এর কথার সত্যতা ধরতে পেরে ফ্রান্সিসের শেষ আশাটাও উবে গেলো। ভেবেছিলো এ যাত্রায় ওরা বোধহয় বেচেই গেলো; কিন্তু ফাঁদটা আসলে ওদের চারপাশ থেকেই আটকে রেখেছে। এখন ওদের একমাত্র উপায় হচ্ছে জাহাজটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা বা ওখানে বসে বসে অপেক্ষা করা কখন দস্যুরা এসে ওদেরকে গোলা ছুঁড়ে পানিতে নিয়ে ফেলবে।

ডাঙার কামানগুলো থেকে একটা গোলা জাহাজের নাকে এসে লাগলো। অবশেষে আংরিয়ার গোলন্দাজেরা নিশানা খুঁজে পেয়েছে। পিছনেই বেশ কয়েকটা গালিভাত ঝাঁক বেঁধে এগিয়ে আসতে লাগলো জাহাজের দিকে। ঠিক যেভাবে হাঙরের দল আহত তিমির দিকে এগিয়ে যায়।

ফ্রান্সিসের অ্যানার কথা মনে এলো। অ্যাগনেস আর সারাহের কথা ভাবলো। তবে সবচে বেশি মনে এলো টমের কথা। ও কিভাবে কোর্টনীদের ব্যর্থ করে দিলো সেটার কথা।

“কি করবো আমরা?”

৯. সৈন্যদল

টম জীবনে কখনো কোনো সৈন্যদলকে এতো দ্রুত জমায়েত হতে দেখল। সৈন্যরা নিজেদের শিবির থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের কাছে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ওর অবশ্য অবাক হওয়া উচিত হয়নি, মনে হচ্ছে পাহাড়ি যোদ্ধা। ওরা রাতের বেলা এক হাতে তরবারি, আর বাম পাশে বল্লম রেখে ঘুমায়।

হাবিলদার মোহিত আর ব্রিঞ্জোয়ান থেকে বাকি যারা এসেছিলো তারা প্রস্তুত হয়ে গেলো। ওদেরকে দেখে খুশি হলো টম। মোহিত মারাঠাদের থেকে ধার নিয়ে একটা তুলোর তৈরি বর্ম পরেছে গায়ে। পিঠে বন্দুক। কোমরে ছুরি আর তার সাথে গুলির বেল্ট। আর সবচে ভয়ংকর অস্ত্রটা ও নিয়েছে সেটা হচ্ছে একটা বল্লম। ওটার ধরার জায়গাটা হাতলের মতো, আর মাথা হাতের মুঠোর মতো।

মারাঠা সৈন্যদের দেখা গেলো একটা ছোট জগের মতো পাত্র একজনের হাত থেকে নিয়ে আর একজনকে দিচ্ছে। প্রথমে পাত্রটায় আঙুল ডুবিয়ে নিজেদের চেহারায় সেটা দিয়ে দাগ দিচ্ছে।

“কি করছে ওরা?” জানতে চাইলো টম।

“হলুদ মাখাচ্ছে, মোহিত ব্যাখ্যা করলো। ও নিজেও হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিজের গালে তিনটা সমান্তরাল হলুর রেখা এঁকে নিলো। দেবতাদের কাছে পবিত্র। এটা মাখার মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দিলাম। এখন আর আমাদের মরার ভয় পাওয়ার কারণ নেই, কারণ দেবতারাই এখন আমাদের রক্ষাকর্তা।”

ও টমকে পাত্রটা ধরিয়ে দিলো। টম হলুদ তরলটা আঙুলে মোহিতের মতো করে নিজের গালেও এঁকে নিয়ে, মনে মনে এই উপমহাদেশের অধিকর্তা যে দেবতাই হোক না কেনো, তার উদ্দেশ্য প্রার্থনা করে নিয়ে মৃত্যুকে ভয় পায় না-ব্যর্থতাকে পায়। সারাহ, অ্যাগনেস বা ফ্রান্সিস কাউকে হারাতে পারবে না ও।

যুদ্ধের বিশাল বিশাল হাতীগুলো সৈন্যদের মাঝে এসে দাঁড়ালে ফেলার শব্দ ছাড়া ওদের মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের হলো না। জানোয়ারগুলোর প্রশিক্ষণের নমুনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো।

শাহুজি সামনের হাতীটার পিঠ থেকে অনায়াসে পিছলে নেমে এসে পাশে দাঁড়ালেন।

“আক্রমণ শুরু করতে প্রস্তুত?”

টম অবাক হলো। “আমিতো ভেবেছিলাম আপনি-”।

শাহুজি হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলেন ওকে। “এটা আপনার লড়াই। আপনি আমার সৈন্য চেয়েছিলেন। আমি সেটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যদি না আপনি এই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করতে চান।”

“এটাই একমাত্র উপায়।”

“গোলার আঘাতে দেয়ালে যে ফাটল ধরেছে সেগুলো এখনো বেশি নিচু না,” শাহুজি সাবধান করে দিলেন। “আরো এক সপ্তাহ গেলে তারপর ওটা সহজেই পার হওয়া যেতো।”

“আমরা ওটা বেয়ে উঠে যাবো,” টম জোর দিয়ে বললো।

শাহুজি মাথা ঝাঁকিয়ে ওনার পেছনের হাতীগুলোর দিকে ইশারা করলেন।

“সেটাই যদি আপনার করণীয় হয়, তাহলে এটায় করেই যান।”

টম জানোয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কোনো সন্দেহ নেই ওটা দুর্দান্ত, ভীতি জাগানিয়া, এই জন্তু দেখলে শত্রুর মনে এমনিতেই ভয় ধরে যাবে। কিন্তু একই সাথে এটা খুবই বড়, আর সহজ একটা নিশানা। ওটায় উঠলে দুর্গের যে কোনো বন্দুকবাজ ওকে অনায়াসে পেড়ে ফেলতে পারবে।

শাহুজি ওর চিন্তা ধরতে পারলেন। “সবাইকে জানতে হবে যে ওদের সেনাপতি ওদের সাথেই আছেন,” নরম গলায় বললেন উনি। “যদি ওরা আপনাকে দেখতে না পায়, তাহলে ভাবতে পারে যে আপনি যুদ্ধ থেকে পালিয়েছেন। আর আপনি যদি যুদ্ধ না করেন, তাহলে ওরা কেনো করবে?”

নিচের উপসাগর থেকে আরো কয়েকটা কামানের গর্জন শোনা গেলো। টম নিজের শরীরে সৈন্যদলের প্রত্যেকের দৃষ্টি অনুভব করতে পারলো। এখন আর তর্কের সময় নেই।

“আপনি যতোটা ভাবছেন তার চাইতে নিরাপদ এটা,” শাহুজি বললেন। “শিকারের হাতী আর যুদ্ধের হাতী আলাদা।”

মাহুত হাতীটাকে বসিয়ে দিতেই টম উঠে গেলো পিঠে। শাহুজির কথাটার মর্মার্থ ধরতে পারলে সাথে সাথেই। বাঘ শিকারে যেরকম নকশা কাটা হাওড়া ব্যবহার করা হয়েছিলো, সেগুলো আর নেই। এখানে আছে একটা বর্মাচ্ছাদিত বক্স। চারপাশে লোহার পাত। তার সামনে একটা হালকা কামান বসানো।

মোহিত চড়লো ওর পিছনে, মাহুত বসলো বক্সের সামনে। নিচে তাকিয়ে টম দেখলো সৈন্যদলও ওদের পাশে হাঁটা শুরু করেছে। একদম সামনের সারির সৈন্যগুলো পুরো নগ্ন। ওদের সারা গায়ে ছাই মাখা, চুল ছিঁড়ে এলোমেলো করে রেখেছে। হাঁটার সময় মোচড় খেয়ে প্রায় লুটিয় পড়তে লাগলো মাটিতে। ছাই মাখা দেহটা দেখে মনে হতে লাগলো যেনো ধোয়া উড়ে যাচ্ছে রাতের আকাশে।

“এরা কারা?” মোহিতকে জিজ্ঞেস করলো টম।

“ঘোসিয়া,” জবাব দিলো হাবিলদার। “এরা হচ্ছে অস্পৃশ্য। ধ্বংসের দেবতা শিবের আরাধক। উন্মাদ কতগুলো, কিছুই ভয় করে না।”

ওদের গলায় একটা নিনাদ শোনা গেলো; এক পৈশাচিক কান্নার সুর, যা শুনে কপালে ঘাম জমে গেলো টমের। একটু পর ঘোশিয়ারা ওদের তরবারির ফলা দিয়ে বুক চাপড়াতে লাগলো।

“আংরিয়া আমাদের আসার শব্দ পেয়ে যাবে,” টম বিরক্ত হলো।

“আপনি ওদেরকে থামাতে পারবেন না, মোহিত বললো। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।”

ওদের সামনের দল ততোক্ষণে গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসে শৈল অন্তরীপটা সংযোগকারী চিকন ভূমিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিচে উপসাগরের আগুনের আলো কমে এসেছে। ভৌতিক একটা আভা ছড়াচ্ছে ওগুলো থেকে। হাতীর পিঠ থেকে নিচে দেখতে পেলো টম। লড়াই জমে উঠেছে। একটা বড় গ্রাবকে দেখা গেলো অন্য জাহাজগুলো থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর একটায় আগুন ধরে গিয়েছে। ফ্রান্সিসের নৌকাগুলো চোখে পড়লো না ওর-তবে পুরো পানি ভরে আছে ভাঙা কাঠের টুকরো আর মরা লাশে।

একটা মাস্কেটের গুলি এসে সামনের লোহার পাতে লাগতেই টুং করে ঘণ্টার মতো আওয়াজ হলো। টম শাপ শাপান্ত করতে করতে মাথা নিচু করে ফেললো। ওরা এর মধ্যেই ওদের নাগালের ভিতরে চলে এসেছে। আংরিয়ার লোকজন ঘুমাচ্ছিলো না। ওরা মারাঠাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত আত্মরক্ষা শুরু করেছে। ঐ সরু এক চিলতে জায়গা বরাবর সমানে গুলি করে যাচ্ছে, ওরা। মারাঠা সৈন্যদের মাঝে কামানের গোলা এসে পড়লো। টম, একজন ঘোশিয়াকে খেয়াল করলো, তখনও উন্মাদের মতো নেচেই যাচ্ছে। কামানের গোলা খেয়ে সে সোজা উড়ে গিয়ে পড়লো পিছনের লোকগুলোর ভিতরে। ওর সাথীরা তাতে না দমে, উল্টো গর্জন ছেড়ে সামনের দিকে দৌড় দিলো।

একটা কসাইখানা হয়ে গেলো সরু জায়গাটা। টমের চারপাশে মুড়ির মতো মরতে লাগলো মানুষ। একটা কামানের গোলা ওর হাতীর মাথার মাত্র কয়েক ফুট সামনে পড়লো। জানোয়ারটা কান ঝাড়া দিলো একবার, তারপর মাথা নিচু করে সামনে ধেয়ে গেলো। মাস্কেটের গুলি এসে লাগলো ওটার গায়ে, কিন্তু তেমন কোনো ক্ষতি হলো না। আফ্রিকার অভিজ্ঞতা থেকে টম জানে খুব কাছ থেকে গুলি করার পরেও, একটা গুলি শুধু হাতীর গায়ের ধুলো ঝাড়া বাদে আর কোনো ক্ষতিই করতে পারে না।

কিন্তু গুলি খাওয়ায় রেগে গেলো হাতীগুলো। সজোরে সামনে ধেয়ে গেলো ওগুলো। আর ওটার পিঠে হাওড়াটা বিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান একটা নৌকার মতো দুলতে লাগলো। হাতীর বিশাল একেকটা পদক্ষেপে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো হাওড়াটা। গতির চোটে টমের কানের পাশ দিয়ে শো শো করে বাতাস বইছে। সেই সাথে গুলির তোড়ে লোহার পাতে টুংটাং আওয়াজ চলছেই। টম যা ভেবেছিলো সেটাই হয়েছে, সবাই সহজেই ওকে নিশানা করতে পারছে। দস্যুরা জানে যে টম কোথায় আছে, কিন্তু জানোয়ারটার বিশাল আকৃতি ওর জন্যে একটা সুরক্ষার কাজ করছে। মারাঠারাও জানোয়ারটার পিছনে লুকিয়েছে। দেয়ালের উপরের দস্যুগুলোর, হাত থেকে হাতীটার দেহ সবার জন্যে একটা সুরক্ষা প্রাচীরের কাজ করছে। হাতীটা দেয়ালের কাছের কাঁটা ঝোঁপ মাড়িয়ে ছুটে গেলো, ফলে মাঝখান দিয়ে পথ হয়ে গেলো একটা।

হাতীটার গতি কমে এলো। টম বক্সের কিনারা দিয়ে ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে দেখলো ওরা ঠিক দেয়ালের সামনে চলে এসেছে। তবে তার জন্যে চড়া দামও দিতে হয়েছে। পুরো শৈল অন্তরীপটা জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ।

কামানগুলোর গর্জন থেমে গিয়েছে, কিন্তু মাস্কেটের গর্জন এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেয়ালের দস্যুগুলো এখন প্রায় সরাসরি হাতীটার উপরে। টম বক্স থেকে লাফিয়ে হাতীর গা বেয়ে পিছলে নেমে এলো। ডানে তাকিয়ে দেখে ফটক থেকে গজাল বেরিয়ে আছে। এতো লম্বা যে এই হাতীটার চাইতেও বড় জানোয়ারকে থামিয়ে দিতে পারবে। আর সামনে দেয়ালের যে অংশটা ভেঙেছে সেখানে পাথরের টুকরো স্তূপ হয়ে জমে আছে।

টমের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। পাহাড়ের মিনার থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো, যে ফাঁকটা হয়েছে সেটা দিয়ে বেয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু এখন এই গোলাগুলির মাঝে দাঁড়িয়ে পুরো পাহাড়ের মতো লাগছে দেয়ালটা। শাহুজির সতর্কবার্তা মনে পড়লো, আমার গোলন্দাজদের আরো এক সপ্তাহ লাগবে।

কিন্তু এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। দেয়ালের একটা অংশ টুকরো টুকরো না হয়ে, পুরোটা একসাথে ধ্বসে পড়েছে। নিচে পড়ে সুন্দর একটা আড়াল তৈরি করেছে সেটা। টম দৌড়ে গিয়ে ওটার পিছনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো।

পাশ দিয়ে সৈন্যরা দৌড়ে গেলো। ঘোশিয়ারা দেয়ালের কাছে যেতে গিয়ে ভয়ানকরকম আহত হতে লাগলো। কিন্তু তবুও দেখা গেলো লড়াইয়ের মানসিকতা একটুও কমছে না। বিড়ালের মতো করে লাফ দিয়ে পাথরের টুকরোগুলোর উপর উঠে দেয়ালের ভাঙা অংশটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

টমের লজ্জিত বোধ হলো। বাকিরা যেখানে ওর পরিবারের জন্যে প্রাণ দিচ্ছে সেখানে ও এভাবে চোরের মতো লুকিয়ে থাকতে পারে না। পাগলামি ভর করলো যেনো ওর উপর। ঘোশিয়াদের মতো ওর রক্তেও বান ডাকলো পাগলামি। দেয়ালের টুকরোটার পিছন থেকে লাফ দিয়ে উঠে সামনে ছুটে গেলো ও। পায়ের ধাক্কায় টুকরো পাথর ছিটকে যেতে লাগলো; মাস্কেটের গুলি ছুটতে লাগলো চারপাশে। কিন্তু ওর মাথার ভিতর যে গর্জন চলছে তার আড়ালে চাপা পড়ে গেলো গুলির আওয়াজ।

দেয়ালের মাথায় উঠতে হবে, ওর মাথার ভিতর শুধু এটাই ঘুরছে। প্রায় পৌঁছেই গেলো সেখানে। এই দুর্গম পাথরের স্তূপের ভেতর দিয়ে আর মাত্র কয়েকটা ধাপ

কিন্তু ও যে পাথরটার উপর পা ফেললো সেটা সরে গেলো জায়গা থেকে। তারপর একগাদা টুকরো পাথর সমেত ঢাল বেয়ে পিছলে গেলো নিচে। দড়াম করে আছড়ে পড়ে গেলো টম। ফুসফুস থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেলো যেনো। ধুলো আর পাথরের চূর্ণে ভরে গেলো মুখ।

তবে ঘোশিয়ারা ওদের কাজ ঠিকই করে গেলো। ভগবান শিবের সহায়তায় দেয়ালের মাথায় পৌঁছে গেলো ওরা। আর ওদের দেখে দস্যুরাও ভয় পেয়ে গেলো। ফলে দুর্গের দিকে থেকে আসা গুলির পরিমাণ কমলো কিছুটা। ঘোশিয়ারা দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিজয় নৃত্য করতে লাগলো, সেই সাথে সেই পৈশাচিক কান্না তো আছেই।

কিন্তু সাথে সাথেই আর একটা গুরুগম্ভীর শব্দ পাওয়া গেলো। কামানের গর্জন। আংরিয়া জানতো যে মারাঠারা দেয়ালের ভাঙা জায়গাটার মাথায় উঠতে পারবেই, ও তাই ঠিক তার পিছনেই একটা কামান বসিয়ে রেখেছিলো। গোলার ভিতর ছিলো মাস্কেটের গুলি ভরা। দেয়ালের মাথায় যে-ই উঠুক তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে ছিলো কামানগুলো।

টম এখনো নিচে কুঁকড়ে পড়ে আছে। আচমকা বজ্রপাতের মতো করে দেওয়ালের মাথায় ঝলসে উঠলো কামানের গোলাটা। দেয়ালের মাথার লোকগুলো মুহূর্তেই ভস্ম হয়ে গেলো ওর চোখের সামনে। টমের সারা শরীর শিউরে উঠলো তা দেখে। ওর আশে পাশে পোড়া মাংস আর টুকরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এসে পড়তে লাগলো।

পা পিছলে না গেলে আমার অবস্থাও ওদের মতোই হতো। কিন্তু টমের এখন শুয়ে শুয়ে কৃতজ্ঞতা বোধ করার মতো সময় নেই। কামানে নতুন গোলা ভরার আগেই ওকে ওখানে পৌঁছাতে হবে।

নিজের তরবারিটা তুলে নিয়ে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঢালটা বেয়ে সোজা উপর উঠতে লাগলো টম। পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে লাগলো ও। খুব দ্রুত, যাতে আগের বারের মতো পা পিছলে না যায়।

পাথরের স্তূপের ঢালের ঠিক নিচে একটা শোরগোল শোনা গেলো। প্রথমে একজন একটা শ্লোগান দিচ্ছে, তারপর বাকি সবাইও তাল দিচ্ছে। “হর! হর! মহাদেব!” ওর পিছনের লোকজন প্রথমে কামানের গোলার আওয়াজে ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তবে এখন আবার নতুন করে জড়ো হচ্ছে। টমের পিছু পিছু মারাঠাদের রণহুংকার ছাড়তে ছাড়তে ধেয়ে এলো ওরা। যাদের হাতের অস্ত্র পড়ে গিয়েছিলো, তারা হাতে পাথর তুলে নিয়ে ছুটে এলো। সামনে কোনো দস্যু পড়লে ওটা দিয়েই থেতলে দিতে লাগলো। সামনের কামানের। আশেপাশে যেসব দস্যু জড়ো হয়েছিলো, তাদেরকে হাতের বল্লম ছুঁড়ে মারা হলো। টম এক দৌড়ে ঢাল বেয়ে সোজা উপরে উঠে দেয়ালের ভাঙা অংশটায় গিয়ে থামলো। মোহিত ছিলো ওর এক পা পিছনেই। একজন দস্যু বেয়নেট হাতে দৌড়ে এলো, কিন্তু ও হাতের জৈত্রিটা দিয়ে এক বাড়িতে তার মাথাটা তরমুজের মতো ফাটিয়ে দিলো।

এক মুহূর্তের জন্যে ভাঙা দেয়ালটার উপরে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। ওদের দুই পাশে দুর্গের দুটো মিনার। সামনের চত্বরে অনেকগুলো মশাল আর বাতি জ্বলছে। টম ঠোঁট চাটলো, চেহারায় লেগে থাকা হলুদের তিক্ত স্বাদ এসে লাগলো জিহ্বায়।

তারপর ও আকাশের দিকে অস্ত্র তুলে জয়ধ্বনি করে উঠলো। সাথের লোকদের মতোই হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “হর! হর! মহাদেব! ঈশ্বর আমাদের সহায়।”

ওরা দুর্গের ভিতরে ঢুকে পড়েছে, এখন ওকে সারাহ আর অ্যাগনেসকে খুঁজে বের করতে হবে।

*

যুদ্ধের হট্টগোল পাথর বেয়ে নিচের কয়েদখানাতেও শোনা যাচ্ছে। কামানের গোলার প্রচণ্ড শব্দ বা গোলা আছড়ে পড়ার সময়কার গর্জন, দুটোই কয়েকগুণ বর্ধিত হয়ে ওদের কানে এসে লাগছে। সেগুলোর কাপনে ধুলো আর টুকরো পাথর খসে পড়ছে দেয়াল থেকে। ওদের মনে হতে লাগলো কোনো অতিকায় দানবের পেটের ভিতর আটকা পড়েছে যেনো।

অ্যাগনেস আর সারাহ একা বসে আছে। প্রহরীরা খানিক আগে এদের লিডিয়াকে নিয়ে গিয়েছে। প্রতি সন্ধ্যাতেই কাজটা করে ওরা। প্রথমবার যখন এরকম হলো, অ্যাগনেস সে রাত পুরোটা জেগে ছিলো। আর বসে বসে ভাবছিলো দস্যুরা না জানি ওর উপর কি অত্যাচারটাই না করছে। কিন্তু লিডিয়া ফিরে আসার পর দেখা গেলো ও অ্যাগনেসের দুশ্চিন্তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না এমনকি দেখে মনে হলো যে ও বরং খুশি-ই হয়েছে। এটা থেকে, লিডিয়ার নির্লজ্জ কিছু কথা বার্তা থেকে অ্যাগনেস ধারণা করে নিয়েছে যে দস্যুদের মাঝ থেকে একজন প্রেমিক জুটিয়ে নিয়েছে।

এজন্যে ও লিডিয়াকে দোষ দেয় না। বেঁচে থাকার তাগিদে সবাই-ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অ্যাগনেস কখনোই এরকম কিছু করতো না কিন্তু তাই বলে ও নিজেকে পুরোপুরি ভাগ্যের হাতেও সপে দেয়নি। অন্ধকারে বসে বসে ও ছোট একটা লোহার কাঠি দিয়ে নিজের হাতকড়ার তালা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাথরের মধ্যে গাঁথা অবস্থায় পেয়েছে ওটা। হয়তো কোনো এককালে ওখানে কোনো আঙটা ছিলো, সেটারই ধ্বংসাবশেষ। প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছে. ওর ওটাকে দেয়াল থেকে খুলতে। চোখা মাথায় ঘষা খেয়ে বেশ কয়েকবার আঙুল কেটে রক্ত বেরিয়েছে কাজটা করতে হতো রাতে, যখন লিডিয়া চলে যেতো। কারণ ওর সামনে পড়লে ওর গোপন প্রেমিকের কাছে ফাস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।

আজ ও কাজটা শেষ করতে পেরেছে। লিডিয়াও নেই, আর লোহার দরজাটার সামনে বসে থাকা প্রহরীরাও আজ চলে গিয়েছে। প্রথমে ও কারণ ভেবে পায়নি, তারপরেই কামানের গর্জন ভেসে এলো। আংরিয়া সম্ভবত ওদেরকে যুদ্ধ করতে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। তাতে ও ভিতরে নতুন এক উদ্যম অনুভব করছে। অ্যাগনেস জানে না যে, টম আর ফ্রান্সিস দেয়ালের বাইরেই আছে, এমনকি ঐ মুহূর্তেই টম বিশাল একটা হাতীতে করে দরজার দিকে ধেয়ে আসছে। ও শুধু জানে যে দুর্গে আক্রমণ হয়েছে।

প্রায় বিশ বছর একজন সৈনিকের ঘর করেছে অ্যাগনেস। ও খুব ভালোমতোই জানে যদি দুর্গের পতন হয়, আর আক্রমণকারীরা এসে দুজন অসহায় নারীকে এভাবে বন্দী অবস্থায় পায়, তাহলে কি হবে।

ওর পাশেই সারাহ অস্ফুট গুঙিয়ে উঠে কাত হয়ে শুলো। ও এখন আর পাশ ফিরতে পারে না। ওর শুকিয়ে কাঠ হওয়া শরীর থেকে বেটপভাবে পেটটা ফুলে আছে। পেটের চামড়া এতো বেশি টানটান হয়ে আছে যে অ্যাগনেসের ভয় লাগে যে ফেটে যাবে যেকোনো সময়। বাচ্চা হওয়ার আর বেশি দেরি নেই। তাতে করে অ্যাগনেসের তাড়া আরো বেড়েছে। এই কয়েদখানায় যদি একটা বাচ্চা জন্ম নেয়, তাহলে এই দস্যুগুলো তাকে নিয়ে কি খেলা খেলবে সেটা অ্যাগনেস চিন্তা করতেও ভয় পাচ্ছে। নিজের আহত, প্রায় অবশ আঙুল দিয়ে ও লোহার ফালিটা হাতকড়ার ভিতরে খোঁচাতে লাগলো। প্রায় এক ঘণ্টা যাবত চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিক সেদিক সবদিকেই মুচড়িয়ে চেষ্টা করে দেখেছে। মাঝে মাঝে লোহার টুকরোটায় কিছু একটা আটকাচ্ছে, আর ওর মনে আশায় দুলে উঠছে। কিন্তু প্রতিবারই চাপ দিলে দেখা যাচ্ছে ওটা পিছলে সরে যাচ্ছে।

পাথরের ভিতর বেয়ে আসা শব্দের পরিমাণ আরও বাড়ছে। দেয়াল থেকে ঝুলি খসে পড়লো আরো খানিকটা। যুদ্ধ চরম অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে। মরিয়া হয়ে আবার ও লোহার টুকরোটা সজোরে চেপে ধরল তালার ফুটোয়। হাতের কাটা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়লো তালার গায়ে। এতোক্ষণ ও আঙুল ভাঙার ভয়ে বেশি চাপ দেওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু এখন আর কিছুর পরোয়া করলো না। দুর্বল বাহুর সব শক্তি আর এই কয়েক মাসের বন্দী জীবনের সমস্ত আক্রোশ জড়ো করে লোহার টুকরোটার উপর ঝুঁকে পড়লো বলা যায়।

খুলে গেলো তালা। কড়াটা ঝট করে খুলে পড়ে গেলো নিচে। হাঁটুতে লেগে ছিলে গেলো চামড়া ও কড়াটার দিকে তাকিয়ে রইলো, এখনো ওর অন্য হাতটা থেকে ঝুলছে। এখনো ওর পুরো বিষয়টা বিশ্বাস হচ্ছে না। বিগত কয়েক মাসের মধ্যে প্রথম ও নিজের কবজিটা দেখতে পেলো। ঘষায় ঘষায় ওখানকার চামড়া ছুলে গিয়ে কালো হয়ে আছে। ধরলেই ব্যথা করে।

কোনোমতে নিজের পায়ের উপর উঠে দাঁড়ালো ও! সারাহ তখনও ঘুমিয়ে আছে, এখুনি ওকে জাগানোর প্রয়োজন নেই। অ্যাগনেস পা টিপে টিপে গুহা থেকে বেরিয়ে লোহার দরজাটার কাছে চলে এলো। ওটার পরেই সিঁড়ি। ওখানেও তালা মারা-তবে সিঁড়ির গোড়ায়, দেয়ালে এক গোছা চাবি ঝোলানো আছে। বাইরে গোলগুলি শুরু হওয়ায় তাড়াহুড়ায় প্রহরীরা ওটাকে খেয়াল করেনি।

অ্যাগনেস হাত বাড়িয়ে নাগাল পেলো না। তবে তখনও ওর ডান কবজিতে হাতকড়াটা বাধা। ও গরাদের ফাঁক দিয়ে হাতটা বের করে দিলো। তারপর কড়ার খোলা প্রান্তটা মাছ ধরার জাল ফেলার মতো করে চাবির গোছার দিকে ছুঁড়ে দিলো।

কড়াটা চাবির গোছার সামান্য নিচে ঠকাস করে দেয়ালে বাড়ি খেলো। সিঁড়ি জুড়ে প্রতিধ্বনি উঠলো শব্দটার। ও আবারও চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না।

এতোক্ষণে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ শুনে ফেলেছে–কিন্তু তাতে ওর যেনো জেদ আরো চেপে বসলো। ও এবার সময় নিয়ে তাক করে ছুঁড়ে দিলো কড়াটা।

এবার জায়গামতো লাগলো সেটা, আর গোছাটা দেয়াল থেকে খুলে শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলো। আবারও কড়াটা ব্যবহার করে ওটাকে টেনে কাছে। নিয়ে এলো অ্যাগনেস। তারপর সেটা তুলে নিয়ে চাবিটা তালায় লাগাতেই খুলে গেলো দরজা।

এখন সারাহকে বের করতে হবে। কিন্তু সারাহের কাছে ফিরে যাওয়ার আগেই একটা গা শিউরানো কান্নার আওয়াজে ভরে গেলো পুরো গুহা। কান্নার আওয়াজটা সারাহের। অ্যাগনেস দৌড়ে গেলো সেদিকে।

সারাহ মেঝেতে শুয়ে আছে, ওর মস্ত পেটের গায়ে হাঁটু চেপে ধরা, দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর, যেনো একটা প্রচণ্ড বেদনা চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না সারাহ। আবারও প্রচণ্ড ব্যথায় ডুকরে উঠলো। মাথাটা মেঝেতে বাড়ি খেলো, ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। একটু পরে কেটে রক্ত বেরিয়ে আসলো।

অ্যাগনেস জানে ব্যথাটা কিসের। বোম্বেতে, আর পরে বিশ্লোয়ানেও ও মহিলাদের প্রসব বেদনার সময় সাথে থেকেছে। ওর কাজ ছিলো ডাক্তারকে সহায়তা করা। ও মহিলাদের হাত ধরে থাকতো, মুখ মুছিয়ে দিতো, আর কানে কানে উৎসাহ মূলক কথা বলে সান্ত্বনা দিতো। প্রায়ই ও নবজাতককে খুশিতে ঝলমল করতে থাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে পেরেছে, আবার বেশ কয়েকবার পুরো কষ্টটাই বৃথা গিয়েছে।

পালানোর সব চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো ওর। এখন আর সারাহকে নাড়ানো সম্ভব না। ও টান দিয়ে সারাহের পোশাক খুলে ফেললো। একদম সব। তারপর সেটাকে নোংরা মেঝের উপর বিছিয়ে দিলো। সারাহ কাপড়টার উপর মোচড়াতে লাগলো। ওর নগ্ন দেহের পুরোটা জুড়ে ঘাম জমে আছে। এই হালকা আলোতেও চিকচিক করছে তা।

চিৎকারের হার দ্রুত হতে লাগলো। অ্যাগনেস প্রতিবার ব্যথার মাঝের সময়টা গুণতে লাগলো। প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু সারাহ এখনো ধাক্কা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত না-কিন্তু আর দেরিও করা সম্ভব না।

আরো কয়েকটা কামানের গর্জন ভেসে এলো পাথরের ভিতর দিয়ে। আর তারপরেই সিঁড়ি বেয়ে ছুটন্ত পদশব্দ নেমে আসতে শুনতে পেলো অ্যাগনেস।

*

“কি করবো আমরা?”

ফ্রান্সিস একবার সামনের বেড়া আর একবার পিছনে ধেয়ে আসা নৌকাগুলোর দিকে তাকালো। কি করবে সেটা ভাবারও সময় নেই হাতে। দ্রুত কাছিয়ে আসছে বেড়াটা।

“জাহাজের মুখ ঘোরাতে হবে,” মেরিডিউ বললো। “নইলে আমরাই ওদের কাজটা সহজ করে দিয়ে, নিজেরাই নিজেদেরকে ডুবিয়ে মারবো।”

“তাহলেতো আবার ঐ গ্রাবগুলোর মাঝে গিয়ে পড়তে হবে। ওরা আমাদেরকে বোমা মেরেই উড়িয়ে দেবে।”

“ওদিকে গেলে ঝুঁকি আছে মানছি, কিন্তু সোজা গেলে মৃত্যু একেবারে নিশ্চিত।”

ফ্রান্সিস উন্মাদের মতো চারপাশে তাকাতে লাগলো। তাতেই। আটকে গেলো বেড়ার শেষ মাথায়। এক প্রান্তে ওটা একটা ছোট্ট কেল্লায় গিয়ে মিশেছে। ওখান থেকে উপসাগরের শেষ প্রান্তটা পাহারা দেওয়া হয়। অপর প্রান্তে বেড়াটা সোজা দুর্গের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়েছে। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় ওখানে একটা ছোট জেটি দেখতে পেলো ফ্রান্সিস। ওটার পরেই পাহাড়ের গায়ে একটা দরজাও দেখা গেলো।

“জাহাজের মুখ বাম দিকে ঘোরান,” আদেশ দিলো ও।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মেরিডিউ জাহাজ ঘোরাতে আরম্ভ করে দিলো। কিন্তু মাথাটা ঘুরে যেতেই ফ্রান্সিস হুইলটা ধরে আবার আগের দিকে ঠেলে দিলো।

“জাহাজ পুরো ঘোরাতে হবে না,” ফ্রান্সিস বললো। “গাছের গুঁড়িগুলো যেখানে বাঁধা সেদিকের পাথর বরাবর চালান।”

“তাহলেতো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে জাহাজ।”

ফ্রান্সিসের চেহারায় ছিটগ্রস্ত মানুষের মতো একটা হাসি ফুটে উঠলো। ওর ভিতরের অনিশ্চয়তাটা আর নেই; ও জানে যে এটাই ওর একমাত্র সুযোগ।

“আমরা ডাঙায় নামবো।”

ওদের জাহাজটা আগুয়ান নৌকাগুলোর সামনে আড়াআড়ি হয়ে, উপসাগরের মোহনা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। একদম সহজ নিশানা। বন্দুকের গুলি এসে জাহাজের পাশে লাগতে লাগলো। পাশের খোল ভেঙে ছিটকে পড়লো পানিতে। গালিভাতের দস্যুরা যখন টের পেলো যে জাহাজটা বেড়ার ফাঁদে আটকে গিয়েছে, তখন ওদের দাঁড়ের গতি আরো বেড়ে গেলো। যারা আগে জাহাজে উঠতে পারবে তাদেরকে আংরিয়া অতিরিক্ত পুরষ্কার দেবে।

“জেটির কাছে যাওয়ার আগেই যদি ওরা আমদেরকে ধরে ফেলে?” মেরিডিউ জিজ্ঞেস করলো। “ভাটার টান কমে গিয়েছে। আমাদেরকে এখন ধরে ফেলা পানির মতোই সহজ।”

“তাহলে আমরা সাঁতার দেবো।”

মেরিডিউ নিজের কপালে একটা চাপড় মেরে দড়াদড়িগুলোর দিকে দৌড়ে গিয়ে ওখানের লোকজনকে নির্দেশনা দিতে লাগলো। ও ওদেরকে নতুন লক্ষ্যের দিকে পাল ধরে রাখার কাজ দিয়েছে। যদিও পালটাতে অনেকগুলো ফুটো হয়ে গিয়েছে, তারপরেও কাজ হচ্ছে যথেষ্ট। ফ্রান্সিস বাকিদেরকে জাহাজের ভাঙা অংশগুলো কেটে পানিতে ভাসিয়ে দিতে বলেছে। ও চাচ্ছে জাহাজ যতোটা সম্ভব। জোরে ছোটাতে, সামনের পাহাড়ের দিকে যতোটা সম্ভব এগিয়ে যেতে চায় ও।

তবে এখন, আর এক দিক থেকে আক্রমণের শিকার হলো ওরা। জেটিতে থাকা দস্যুরা ওদেরকে আসতে দেখতে পেয়েছে, ফ্রান্সিসের উদ্দেশ্যও ধরতে পেরেছে। আগুনের আলোয় ফ্রান্সিস দেখতে পেলো আংরিয়ার লোকেরা সবাই হন্তদন্ত হয়ে, হাতের বল্লমগুলো দিয়ে কামানের মুখটা সোজা করার চেষ্টা করছে, যাতে জাহাজের দিকে গোলা ছুঁড়তে পারে। বাকিরা হাঁটু গেড়ে বসে বন্ধুক তাক করে ধরে আছে।

ফ্রান্সিস জাহাজের সামনের দুর্গ মতন জায়গাটার দিকে দৌড়ে গেলো। সামনের উঁচু আড়ালটার কারণে ওটায় মাস্কেটের গুলি ঢুকতে পারে না। দস্যুরা আবার পিস্তলে গুলি ভরার আগেই ও সবাইকেই ওটার পিছনে লুকিয়ে পড়তে বললো।

বিশাল কামানটার পিছনে লুকিয়ে ও সামনের ফাঁকা দিয়ে উঁকি দিলো। জেটির লোকজন কামানটা সুবিধামতো বসিয়ে ফেলেছে। এখন দ্রুত গোলা ভরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ যেনো একটা রাউন্ড ধরে খেলা ডুয়েল। দুই পক্ষই চেষ্টা করছে অন্যদলের আগেই গুলি করতে।

গ্রাবটা থেকেই গোলা ছোঁড়া হলো প্রথমে। কামানগুলো গোলা ছুঁড়ে আঁকি দিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু সেই গর্জন ছাড়িয়ে আরো প্রচণ্ড একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। জাহাজটা সজোরে গিয়ে জেটিতে আছড়ে পড়েছে। পানির বেশি গভীরে ডুবে ছিলো না জাহাজটা, ফলে একদম ডাঙার কাছে চলে যেতে পেরেছে। ওটার সামনের দিকটা একদম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পাথরুের উপরে উঠে গেলো। ডেক-এর লোকজন সব আছড়ে পড়লো এদিক সেদিক। জাহাজের কামানগুলোও ছিটকে গিয়ে কাত হওয়া ডেক ধরে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। একটুর জন্যে ফ্রান্সিসের পা থেতলে গেলো না।

“ওঠো সবাই!” চিৎকার করে উঠলো ও। “আক্রমণ করো ওদেরকে!”

গ্রাবের সামনের দিকটা ভোতা করে নকশা করা হয়েছে যাতে অন্য নৌকা এতে ওঠানো যায়। এখন জায়গাটা সুন্দর একটা পাটাতনের মতো কাজ করলো। পাথরের উপর দিয়ে সোজা জেটি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে সেটা। ফ্রান্সিসের নেতৃত্বে মারাঠারা ওটা ধরে দৌড়ে গেলো। তারপর রণহুংকার ছাড়তে ছাড়তে ওটার শেষ মাথা থেকে লাফিয়ে নেমে, ঝাঁপিয়ে পড়লো দস্যুদের উপর।

কামানের সর্বশেষ গোলাটায় ভালোই কাজ হয়েছে। দস্যুদের কামানটা উল্টে পড়ে গিয়েছে। পাশে যারা ছিলো, তারা নিজেদের রক্তে গোসল হয়ে পড়ে আছে পাশে। বাকিদেরকে পেড়ে ফেলতে কোনো কষ্টই হলো না ফ্রান্সিসদের। ফ্রান্সিস একজনের বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দিলো। তারপর চারপাশে তাকিয়ে দেখে আর কোনো শত্রু জীবিত নেই।

জেটি এখন ওদের দখলে।

“এখন?” মেরিডিউ জানতে চাইলো। হাতের কুড়াল থেকে রক্ত মুছছে। ও পাথরে গাথা আঙটাগুলো দেখালো। ওখানেই গাছের গুঁড়িগুলো বাধা। “বেড়াটা কেটে দেবো?”

“খুব বেশি লাভ হবে না আর। পালানোর জন্যে আর কোনো জাহাজ তো নেই।”

একটা মাস্কেটের গুলি এসে লাগলো দেয়ালে। ওদেরকে ধাওয়া করে আসতে থাকা নৌকার বহরটা কাছিয়ে এসেছে। সামনের গালিভাতটাতো একেবারে ওদের ভাঙা জাহাজটার পাশেই চলে এসেছে। ওটার লোকজন লাফিয়ে জাহাজের ডেক-এ নেমে যেতে লাগলো, জেটিতে পৌঁছানোর জন্য ওটাকে একটা সেতুর মতো ব্যবহার করছে।

জেটিতে লুকানোর আর কোনো জায়গা নেই। শুধু পাহাড়ের গায়ের ছোট দরজাটা ছাড়া।

“দুর্গে চলো সবাই,” চেঁচিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস। আগে ও ওর সবগুলো লোককে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, সবার শেষে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। সাথে সাথে তিনটা গুলি এসে লাগলো কাঠের দরজাটায়।

দেয়ালের একটা খোপে একটা বাতি জ্বলছে। ওরা কয়জন আছে গুণে নিলো ফ্রান্সিস। কাটায় কাটায় বারোজন মারাঠা, সাথে ও নিজে আর মেরিডিউ। এর মাঝে অর্ধেক আহত। এক হাজার লোকের বাহিনির বিরুদ্ধে এই ক্ষুদ্র একটা দল!

বাইরে থেকে প্রচণ্ড ধাক্কায় দরজাটা কেঁপে উঠতে লাগলো।

“দরজাটা কিন্তু বেশিক্ষণ টিকবে না,” সাবধান করলো মেরিডিউ।

ফ্রান্সিস ওর পিস্তলে গুলি ভরে নিলো। “খোলা মাত্র ওদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হবে।”

“সম্ভবত অন্য কোনো রাস্তা আছে,” মেরিডিউ একটা কানে হাত দিয়ে শোন্তর চেষ্টা করতে করতে বললো। “উপরে বোমার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?আমার মনে হয় মিস্টার টম আমাদের দিক থেকে দস্যুদের দৃষ্টি সরাতে ফটকের দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছেন। কিন্তু ঐ দরজা খুলতে ওনাদের খবর হয়ে যাবে। আমরা যদি উপরে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতে পারি, তাহলে পুরো পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যাবে।”

ফ্রান্সিস কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালো। একটা খাঁড়া সিঁড়িপথ পাথরের ফাঁক দিয়ে দুর্গের উপরে উঠে গিয়েছে। ওখানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত সবাই-ই এখন উপরে যুদ্ধে ব্যস্ত।

আবারও কেঁপে উঠলো দরজাটা। কাঠ ভেদ করে একটা কুড়ালের মাথা দেখা গেলো। সেটা খুলে নিয়ে আবার চালানো হলো। ফুটোটাও বড় হতে লাগলো তাতে।

“তাহলে আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই।”

ফ্রান্সিস আর ওর লোকেরা দৌড়ে গেলো সেদিকে, হাতে পিস্তল। সামান্য দূর যাওয়ার পরেই দড়াম করে দরজাটা ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলো। অনেকগুলো মানুষ চিৎকার করতে করতে একসাথে ঢুকে পড়লো ভেতরে। ফ্রান্সিস গতি বাড়িয়ে দিলো, এক যোগে তিনটা করে সিঁড়ি ভাঙছে। সিঁড়ির প্রতিটা কোনায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেলো, ওদিকে কেউ আছে কিনা সেই পরোয়া করছে না।

ওরা একটা জায়গায় এসে পড়লো যেখানে সিঁড়িটা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। ডান দিকে একটা নেমে গিয়েছে নিচে, আর একটা উঠে গিয়েছে উপরে।

ফ্রান্সিস উপরে দেখালো। “এদিকে। এটা দিয়েই-”।

একটা গা শিউরানো চিৎকার ভেসে এলো নিচের সিঁড়িটা দিয়ে। ফ্রান্সিস থেমে গেলো।

“অন্যদিকে মন দেওয়ার সময় নেই,” মেরিডিউ চেঁচিয়ে উঠলো। পিছনে ওদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের আওয়াজ চলে এসেছে খুব কাছে।

আবারও ভেসে এলো চিৎকার-একজন মহিলা প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাচ্ছে বোঝা গেলো।

“আপনারা ফটকের দিকে যান,” মেরিডিউকে বললো ফ্রান্সিস। “আমি আসছি।”

সাথে সাথেই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ও ডানের সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে নেমে গেলো। সবাইকে ছেড়ে আসার মতো কোনো ব্যাখ্যা ওর কাছে নেই। কিন্তু সারাহ আর অ্যাগনেস এখানেই কোথাও আছে, আর ও ওদেরকে এভাবে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পারবে না।

সিঁড়ির একদম গোড়ায় একটা লোহার দরজা দেখতে পেয়ে থেমে গেলো ফ্রান্সিস। দরজায় কোনো প্রহরী নেই। আর চাবিও তালার ভিতর ঢোকানো-তবে ভিতর থেকে। ও ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো দরজাটা।

নিয়মিত বিরতিতে চিৎকার চলছেই। যেনো কেউ একটা গরম ছুরি কারো পেটে ঢুকিয়ে একটু পরপর মোচড় দিচ্ছে।

এক হাতে তরবারি আর এক হাতে পিস্তল নিয়ে ফ্রান্সিস যথাসম্ভব শব্দ না করে এগিয়ে গেলো সামনে। শব্দ অনুসরণ করে কয়েকটা পাথরের ঘর পার হয়ে এলো ও। একটু পরেই একটা বাঁকে এসে উপস্থিত হলো। শব্দের তীব্রতায় বোঝা গেলো এর পরের গুহাটা থেকেই আসছে চিৎকার। ও দেয়ালের গায়ে নিজেকে চেপে ধরলো, তারপর সোজা হয়ে আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো, হাতে উদ্যত পিস্তল।

কিন্তু যা দেখলো তাতে হতভম্ব হয়ে গেলো পুরোপুরি।

সারাহ চিত হয়ে শুয়ে আছে, পা দুদিকে ছড়ানো, পুরো শরীরটা ফ্রান্সিসের দিকে ফেরানো। গায়ে একটা সুতা পর্যন্ত নেই। অ্যাগনেস ওর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সারাহের মাথাটা নিজের মাথায় নিয়ে আদর করছে আর ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সারাহের চোখ খোলা কিন্তু ফ্রান্সিসের আগমন টের পেলো না ও। অ্যাগনেস সারাহের উপর পড়া ছায়াটা দেখতে পেয়ে চোখ তুলে তাকালো।

“ফ্রান্সিস?” চমৎকৃত হলো অ্যাগনেস।

ফ্রান্সিস ওদের দিকে দৌড়ে গিয়ে অ্যাগনেসের পাশে বসে পড়লো। আবারও তীব্র যন্ত্রণার একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো সারাহের শরীর জুড়ে। আগেরটার চাইতে বেশি থাকলো এবার। অ্যাগনেস সারাহের কপালের ঘাম মুছিয়ে দিলো।

“ওনার কি-?” ফ্রান্সিস আর এক দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো। সারাহের নগ্ন শরীরের দিকে তাকাতে পারছে না। “কি হয়েছে? ওরা কি খুব অত্যাচার করেছে?”

এই দরম দুর্দশার মাঝেও অ্যাগনেস হেসে দিলো। “আরে বোকা, ওর বাচ্চা হচ্ছে। আর বেশি দেরি নেই।”

“বাচ্চা?” ফ্রান্সিস হাঁ হয়ে গেলো। “কিন্তু কিভাবে?”

“ভয় পেয়ো না। দস্যুরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি। এটা টমেরই বাচ্চা, তোমার চাচাতো ভাই। মানে, যদি শেষ পর্যন্ত আজকের রাতটা পার করতে পারে।”

সারাহের চিৎকারের মাত্রা কমে ফোপানিতে পরিবর্তিত হলো। অ্যাগনেস ওর কাধ ধরে আস্তে আস্তে তুলে বসালো।

“ওকে ঘোরাতে সাহায্য করো দেখি,” অ্যাগনেস বললো। “বাচ্চা বের হতে সহজ হবে তাহলে।”

ফ্রান্সিস হাই উইল্ডে ঘোড়া আর ভেড়ার বাচ্চা প্রসব দেখেছে। তাই বাচ্চা জন্মদান সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ না ও। কিন্তু এরকম একটা লড়াইয়ের মাঝে যে ওকে দাই-এর ভূমিকা পালন করতে হতে পারে তা ওর সুদূরতম কল্পনাতেও ছিলো না। ও হাতের অস্ত্রগুলো নামিয়ে রাখলো। তারপর অ্যাগনেস আর ও ধরাধরি করে সারাহকে চার হাত পায়ে বসিয়ে দিলো। প্রচণ্ড জোরে হাফাচ্ছে সারাহ।

উপরে আবার কামানের শব্দ পাওয়া গেলো। এতোক্ষণে ফ্রান্সিসের এই হুট করে আগমনের ব্যাপারটা খেয়াল হলো অ্যাগনেসের। “গোলা কি তোমরা মারছো নাকি? এখানে এলে কিভাবে? দুর্গ দখল করে ফেলেছো? টম কোথায়?”

“সত্যিটা হচ্ছে আমি জানি না যে কি হচ্ছে,” ফ্রান্সিস স্বীকার করলো। “আমি আংরিয়ার বন্দরের জাহাজগুলো ধ্বংস করতে এসেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে যাই। তারপর পালাতে গিয়ে পানির ধারের যে দরজাটা আছে ওটা দিয়ে উঠে এসেছি। আমার মনে হয় টম চাচা উপরে ফটকের দিক থেকে আক্রমণ করেছেন যাতে আমাদের দিক থেকে নজর সরে যায়। কিন্তু এখন ওখানে কি অবস্থা সেটা জানিনা।”

সারাহ গুঙিয়ে উঠলো। এবার অন্যরকম একটা শব্দ। নিচু কিন্তু আগের গুলোর চাইতে বেশি স্পষ্ট, যেনো ও বিশাল একটা ওজন তোলার চেষ্টা করছে। অ্যাগনেস ওকে জড়িয়ে ধরলো।

“বাচ্চা হয়ে যাবে এখনি।”

*

রাতটা প্রচণ্ড অস্থিরতায় কাটলো ক্রিস্টোফারের। ফাঁদ পাতা শেষ, শুধু শিকার আটকা পড়ার অপেক্ষা। কিন্তু সব ঠিকমতো হবে কিনা সেই দুশ্চিন্তা ওকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। ও আংরিয়াকে বন্দরে আক্রমণের খবরটা দিয়েছে। দস্যুদেরকে এটা বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে শত্রুদেরকে ধোকা দেওয়াই ওর উদ্দেশ্য ছিলো। অবশ্য ও যে হীরা ভর্তি থলেটা পেয়েছে সেটার কথা চেপে গেলো বেমালুম। সেটা এখন ওর ঘরে একটা বেল্টের ভিতরে নিরাপদে সেলাই করে রেখে দেওয়া হয়েছে। টম কোর্টনী সম্পর্কেও কিছু বললো না। প্রতিশোধটা ও ব্যক্তিগত ভাবেই নেবে।

ক্রিস্টোফার নিজে বন্দরের আক্রমণটায় নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আংরিয়া নিষেধ করলো। কারণ ধূর্ত দস্যুর মাথায় তখন এটা ঘুরছে যে ক্রিস্টোফার মারাঠাদের সাথে যে বেঈমানি করার কথা বলছে সেটা কি আসলে ওদের সাথে করবে কিনা শেষ পর্যন্ত। ও ক্রিস্টোফারকে দুর্গ ছেড়ে নড়তে নিষেধ করে দিলো। ক্রিস্টোফার উপসাগরটার দিকের দেয়ালে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে আর দুশ্চিন্তা করছে। যদি টম ওকে চিনে ফেলে? যদি ও ক্রিস্টোফারের বেঈমানির কথা বুঝে ফেলে? যদি ওরা না আসে? ও দেয়ালের উঁচু অংশটায় হেলান দিয়ে রাতের আধারে তাকিয়ে রইলো। হাতে নেপচুন তরবারিটা নাড়ছে। উরুমিটা ওর কোমরে শক্ত করে আটা। লিডিয়ার কথা ভাবলো ও, ওর ঘরে অপেক্ষা করছে। ওর কাছে গেলে অবশ্য এসব কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকা যাবে। কিন্তু সেসব পরে করলেও হবে। বিজয়ীর বেশে যখন ফিরবে তখন ওর সঙ্গ আরো মধুর মনে হবে।

প্রথম অগ্নিকুটা জ্বলে ওঠা মাত্র ও টের পেলো ওর পরিকল্পনা একদম ঠিকঠাক খেটে যাচ্ছে। দেয়ালের এখান থেকে ও দেখতে পেলো যে শত্রুদের নৌকাগুলো একেবার বন্দরের মাঝে আটকা পড়ে গিয়েছে। আংরিয়ার বাহিনি ঘিরে ফেলছে ওদেরকে। এখান থেকে আর পালানোর উপায় নেই।

কিন্তু ওরা এখনো জানে না যে কেন এভাবে ধরা খেলো। ও আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলো নৌকা একটা গ্রাবের গায়ে এসে ঠেকলো, তারপর আরোহীরা জাহাজটায় চড়ে বসে কোনোভাবে জাহাজটা দখল করে নিয়ে ছড়িয়ে থাকা অন্য জাহাজগুলোর ফাঁক দিয়ে চালানো শুরু করে দিলো। দস্যু গোলন্দাজদের এতো চেষ্টা সত্ত্বেও ওটা ডুবলো না বা একটা মাস্তুলও ভাঙলো না। বরং ওটাই যাওয়ার পথে অন্য কয়েকটা জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, সোজা পালানো শুরু করলো।

তবে পালাতে পারবে না। সবগুলো নৌকা উপসাগরে ঢোকার পরেই ক্রিস্টোফারের লোকেরা বেড়াটা আবার লাগিয়ে দিয়েছে। জাহাজটা যদি কোনোমতে এখান থেকে পালিয়ে যেতেও পারে, বেড়ার কাছে গিয়ে প্রজাপতি যেভাব জালে আটকায় সেভাবেই আটকে পড়বে।

জাহাজটার ধ্বংস দেখার আশায় তাকিয়ে থাকতেই আর একটা নতুন শব্দ কানে এলো ওর : চেঁচামেচি, আর্তচিৎকার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। সৈন্যদল ধেয়ে আসছে।

“হচ্ছেটা কি?”

অন্ধকার কুঁড়ে আংরিয়ার গলা হিসিয়ে উঠলো। ক্রিস্টোফার ওর উঠে আসার আওয়াজ পায়নি। ও ঘুরে গেলো, কিন্তু আংরিয়া একদম ওর পিছনেই চলে এসেছিলো। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ও ক্রিস্টোফারকে দুই হাতে ধরে আগের দিকে ফিরিয়ে দেয়ালের কিনার দিয়ে ঠেসে ধরলো। ওখানেই ঝুলে রইলো ক্রিস্টোফার। আংরিয়া ওর হাতটা ছেড়ে দিলেই সোজা নিচে গিয়ে পড়বে।

“এসব কি তোর কাজ?” আংরিয়া জানতে চাইলো। “আমার লোকদের দুই ভাগে ভাগ করে ফেলার জন্যে কোনো চালাকি? যাতে আমার শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে?”

“না, প্রভু,” মিনতি করলো ক্রিস্টোফার। দেয়ালের উপর ভারসাম্য রাখতে গিয়ে বারবার পিছলে যাচ্ছে পা। নিচে পড়লে কতোদূর যাবে সেদিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না ওর। “আমি জানিও না-”

“মারাঠারা আক্রমণ করছে। যখন আমাদের সমস্ত মনোযোগ বন্দরের দিকে, ওরা তখন দেয়ালের দিক থেকে আক্রমণ করছে।”

“আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে ওরা আক্রমণ করবে। আমাদের চরেরা ডাঙার দিকে দিয়ে আক্রমণের কোনো লক্ষণই দেখতে পায়নি ওদের মধ্যে।”

আংরিয়া ক্রিস্টোফারের চোখের দিকে তাকালো। যা-ই দেখে থাকুক তাতে ও ক্রিস্টোফারের কথাকেই সত্যি বলে ধরে নিলো। ওকে টেনে তুলে একটা কামানের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললো, “পূর্ব দেয়ালের দিকে যা। ফটক রক্ষার দায়িত্ব তোর। আর আমি বলে দিচ্ছি যে, কেউ যদি তোকে কাজে সামান্যতমও কোনো ত্রুটি করতে দেখে, তাহলে যেনো সাথে সাথে তোর কল্লা নামিয়ে দেয়।”

ক্রিস্টোফার দেয়াল ধরে দৌড়ে গিয়ে উত্তর-পূর্ব মিনারে যাওয়ার সিঁড়ি ধরে উঠে গেলো। নিচে যা দেখলো তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না ওর। পুরো শৈল অন্তরীপ একটা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। ওদের মাঝখানে আবার তিনটা বিশাল হাতীও আছে। দুর্গের কামানের গোলায় এর মধ্যেই আক্রমণকারীদের অনেকেই আহত নিহত হয়েছে। কিন্তু তাতেও ওরা এক বিন্ধু দমেনি। কয়েকজনকে দেখে মনে হলো উলঙ্গ। ক্রিস্টোফার ভাবলো মারাঠারা বোধহয় বন্দীদের সামনে দিয়েছে যাতে কামানের গোলার আঘাত ওদের উপর দিয়ে যায়।

ওরা দেয়ালের ভাঙা অংশটা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে। বুঝতে পারলো। ক্রিস্টোফার।

দুর্গে যারা যারা ছিলো তারা সবাই দুর্গের পূর্বে ছুটছে। ক্রিস্টোফার একজন গোলন্দাজ ক্যাপ্টেনকে দেখতে পেলো। “দেয়ালের ভাঙা জায়গা বরাবর দুটো কামান বসিয়ে দাও। আর ওগুলোর ভেতর মাস্কেটের গুলি আর টুকরো টাকরা যা যা পাও ভরে রাখো। যদি ওরা দেয়ালের উপর উঠেই পড়ে, তাহলে একেবারে গাছের ডালের পাখি মারার মতো ওদেরকে উড়িয়ে দিতে পারবে।”

ক্রিস্টোফার জানে যে টম কোর্টনী-ই আছে এর পেছনে। ও অন্ধকারে ওকে খুঁজতে থাকলো। মাস্কেট আর কামানের গোলা ছোঁড়ার সময় যে আগুন বের হচ্ছে তার আলোয় চেহারাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। উনি কি আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন? নাকি চালাকি করে অন্য লোকদের দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবেন?

আক্রমণকারীরা এখন এতো কাছে চলে এসেছে যে দুর্গের কামানগুলো দিয়ে আর ওদের গায়ে লাগানো সম্ভব না। ক্রিস্টোফার গোলন্দাজদেরকে কামান ফেলে দেয়ালের বন্দুকবাজদের সাথে যোগ দিতে আদেশ দিলো। প্রকাণ্ড একটা গর্জন ভেসে এলো দেয়ালের ওদিক থেকে। কোনো মানুষ এই আঘাত সহ্য করতে পারবে বলে ও বিশ্বাস করে না। কিন্তু তবুও দেখা গেলো ওরা আসছেই। ধোয়ার ভিতর দিয়ে ক্রিস্টোফার দেখলো ওদের ধুলোয় ভরা দেহগুলো হামাগুড়ি দিয়ে ধ্বংসস্তূপের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে। ভাঙা পাথরের টুকরোগুলোর নিচে লুকাচ্ছে, আবার উঠে আসছে। বেশ কয়েকজন দস্যু মারা পড়লো তাতে, অন্যেরা গিয়ে জায়গা নিলো তাদের।

ওদেরকে থামাতে হবে। “গুলি থামিয়ে দাও,” ক্রিস্টোফার বললো। “ওদেরকে ভাবতে দাও যে ওরা বিজয়ী হয়েছে।”

আদেশটা দেয়াল জুড়ে পৌঁছে গেলো। মাস্কেটের গুলি বর্ষণ থেমে গেলো। ক্রিস্টোফার হাতের নেপচুন তরবারিটা তুলে ধরলো যাতে নিচে চত্বরের দস্যুরা ওটা দেখতে পায়। মারাঠারা এটাকে সুযোগ মনে করে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে শেষ কয়েক গজ পেরিয়ে দেয়ালের উপর উঠে এলো।

“এখন!” চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। সাথে সাথে তরবারিটাও নামিয়ে আনলো। চত্বরের কামানগুলো একসাথে গর্জে উঠলো। একগাদা মাস্কেটের গুলি আর অসংখ্য ভাঙা ধাতুর টুকরো ছুটে গেলো সামনে। যারা এগিয়ে এসেছিলো তারা সাথে সাথে মাংসের দলায় পরিণত হলো।

দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা খালি হয়ে গেলো মুহূর্তেই। দস্যুরা উল্লাস করে উঠলো। বিজয় বুঝতে পেরে ওরা সবাই ভাঙা জায়গাটায় দৌড়ে গেলো ওদের সদ্য বিজিত প্রতিদ্বন্দীদের উপহাস করতে।

“থামো,” চেঁচিয়ে উঠলো ক্রিস্টোফার। কিন্তু কেউ ওর কথা শুনতে পেলো না বা শুনলেও পাত্তা দিলো না। কয়েকজন মাস্কেট ফেলে দিয়ে তরবারি তুলে নিলো যাতে কাছ থেকে মারতে পারে।

ক্রিস্টোফারের মতো ওরাও ভেবেছিলো যে কামানের গোলাটা মারাঠাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা মিটিয়ে দেবে। তাছাড়া ধোয়া কেটে যাওয়ার পরে দেখা গেলো ঢালের নিচের লোকগুলোর বিহ্বল দশা তখনও কাটেনি। ওদের মাঝে একজন উঠে দাঁড়ালো, তারপর নিজে ভাঙা জায়গাটার দিকে দৌড় দিলো আর চিৎকার করে বাকিদেরকেও আক্রমণ করতে আদেশ দিতে লাগলো। বাকিরা সাথে সাথে উঠে এলো ওর পাশে। কারো হাতে কুড়াল, কারো হাতে বল্লম, একজনের হাতে একটা বিশাল জৈত্রি, মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো সেটাকে নাড়ছে।

দস্যুরা কোনো প্রতিরোধ আশা করেনি। অতিরিক্ত উৎসাহে ওরা একেবারে সোজা শত্রুদের মুখে পড়ে গেলো। এখন সেই সুযোগ গ্রহণ করলো মারাঠারা। ওরা দস্যুদের পা কেটে দিলো, ফলে ওরা ভাঙা পাথর বেয়ে নিচে পিছলে পড়তে লাগলো। যাদের হাতে অস্ত্র নেই তারা পাথর তুলে নিয়ে শত্রুদের মাথার ঘিলু বের করে দিতে লাগলো। দস্যুরা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো যে কি করবে।

দ্বিতীয়বারের মতো মারাঠারা দেয়ালের ভাঙা জায়গাটায় উঠে এলো। আবারও ক্রিস্টোফার অপেক্ষা করতে লাগলো কামানের গোলার আঘাতে ওদের উড়ে যাওয়ার, কিন্তু এবার দেখা গেলো কামানের কাছে কেউ নেই। গোলন্দাজেরাও মারামারি করতে ছুটে যাওয়ায় কেউ কামানে গোলা ভরেনি।

ক্রিস্টোফার গালাগালির তুবড়ি ছোটালো। ভাঙা দেয়ালের উপর একজনকে দেখা গেলো বিজয়োল্লাসে নিজের ততবারি তুলে ধরেছে। অবয়বটা টম কোর্টনী বাদে আর কারো না। ক্রিস্টোফার একটা বন্দুক তুলে নিয়ে টম কোর্টনীর বুক বরাবর তাক করলো। কিন্তু ধোয়ার কারণে টম ওর আড়ালে চলে গেলো। ধোয়া কাটতেই দেখলো টম আর ওখানে নেই।

প্রচণ্ড রাগে অস্ত্রটা আছড়ে ফেললো ক্রিস্টোফার। ওর সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। ও জানে দস্যুরা কিভাবে লড়াই করে। যখন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, তখন ওরা অজেয়-কিন্তু একবার যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলেই ওদের নিয়ম শৃঙ্খলার আর কোন বালাই থাকে না। শেষ মুহূর্তের প্রতিরোধ বলে এদের মাঝে কিছু নেই। এরমধ্যেই ও দেখতে পেলো দস্যুরা চত্বর জুড়ে পালানো আরম্ভ করেছে। পিছনে ধাওয়া করছে মারাঠারা। দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে এখন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো এসে ঢুকছে ওরা। দুর্গের পতন ঘটে গিয়েছে।

পরাজয় আর রাগ দুটো অনুভুতিই একসাথে গ্রাস করলো ক্রিস্টোফারকে। টম কোর্টনী-ই এর জন্যে দায়ী। এখানে, বা ব্রিঞ্জোয়ানে সবখানেই। ওর জীবনের প্রতিটা বাকে-সেই মায়ের পেটে আসার পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেখানে যা কিছু ক্রিস্টোফার চেয়েছে তার সবকিছুই এই লোকটা ছিনিয়ে নিয়েছে। ওর জন্মদাতা পিতা টম কোর্টনী-ই হচ্ছে ওর জন্ম শত্রু।

কিন্তু পরাজিত হলেও এখনো ও চাইলে টমের বিজয়কে ভস্ম করে দিতে পারে। ও দেয়াল ধরে দৌড়ে গিয়ে দুর্গে ঢোকার দরজাটা দড়াম করে খুলে ভিতরে ঢুকে গেলো।

শত্রুরা ঢোকার আগেই লুটপাট শুরু হয়ে গিয়েছে। হেরে যাওয়ায় দস্যুরা এখন একজন আর একজনের সাথে লেগেছে। নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করছে সবাই। পালাতে পারবে এই আশায়, ভাড়ার ঘরে ঢুকে বহন করতে পারবে এমন যা যা পাচ্ছে নিয়ে নিচ্ছে ওরা।

ক্রিস্টোফার ওসবের ধার ধারলো না। ও এই হৈ হট্টগোল পেরিয়ে একটা চরম নিষ্ঠুর উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চললো। দুই একজন দস্যু ওর হাতের তরবারিটা খেয়াল করে এগিয়ে এসে ওটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে চাইলো, কিন্তু ওর চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে গেলো সে চেষ্টা না করলেই ভালো করবে। বাকিরা লুটপাটে এতো ব্যস্ত ছিলো যে ওকে খেয়াল করলো না।

দস্যুরা দুর্গের ভিতরে ঢুকে যেতেই শোরগোল কমে এলো অনেকটা। ক্রিস্টোফার ওর গতি বাড়িয়ে দিলো, তারপর থেমে গেলো আচমকা। ছুটন্ত পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে। উপর থেকে না, নিচ থেকে আসছে। ও দেয়ালের পাশের একটা কুলুঙ্গিতে ঢুকে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়লো।

প্রায় ডজনখানেক লোক দৌড়ে উঠে গেলো। ওদের পোশাক দেখে বুঝলো যে এরা মারাঠা, তবে সবার সামনের লোকটা একজন ইংরেজ নাবিক। এক মুহূর্ত ক্রিস্টোফার ভাবলো ওটা টম নাকি। হয়তো ও আসলে দেয়ালের দিকে আসেইনি। ক্রিস্টোফারের হাত তরবারির হাতলে চেপে বসলো। ও শুধু হাতটা বাড়ালেই ইংরেজটার কল্লা পড়ে যেতো।

“তাড়াতাড়ি,” লোকটা ডাকলো। কণ্ঠ শুনে ক্রিস্টোফার স্বস্তি পেলো। টম না ওটা। ও ওদেরকে যেতে দিলো। একটু পরেই ওদের পদশব্দ মিলিয়ে গেলো উপরে।

ক্রিস্টোফার আবার নামতে শুরু করলো। একটু পরে ছোট একটা কক্ষে চলে এলো যেখানে রাস্তা দুই দিকে গিয়েছে। কিন্তু এবার সাথে সাথে আরো অনেকগুলো পদশব্দ পাওয়া গেলো। আর এখানে লুকানোরও কোনো জায়গা নেই। ও অস্ত্র তুলে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।

তবে ও এই লোকগুলোকে চেনে। আলোয় এসে দাঁড়াতেই ও দেখতে পেলো এরা সবাই আংরিয়ার লোক। বন্দরের আক্রমণের দায়িত্বে ছিলো সবাই।

এখানে ক্রিস্টোফারকে দেখতে পাবে বলে আশা করেনি ওরা। “টুপিওয়ালারা কই?” জানতে চাইলো ওরা। “আমরা ওদেরকে পানির দিকের দরজাটা দিয়ে ধাওয়া করে এসেছি। এদিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। ওরা।”

“দুর্গ পতন হয়েছে,” কর্কশ কণ্ঠে বললো ক্রিস্টোফার। “শত্রুরা ভিতরে ঢুকে পড়েছে।” ও দুজনের দিকে নির্দেশ করলো। “তুমি আর তুমি আমার জন্যে এখানে অপেক্ষা করো। আর বাকিরা পানির দরজার কাছে গিয়ে পালানোর জন্যে একটা নৌকার ব্যবস্থা করো। আমি একটু পরেই আসছি।”

বলেই ক্রিস্টোফার কয়েদখানায় নামার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো। নিচে নেমে খোলা দরজা দেখতে পেয়ে থমকে গেলো। চিৎকারের আওয়াজ পেলো ও, একজন মহিলা যেনো মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে। কোনো দস্যু কি এর মধ্যেই এখানে এসে নিজের কুমতলব হাসিল করা শুরু করে দিয়েছে? কিন্তু না, চিৎকার যেনো খুব নিয়মিত হচ্ছে। আর এর মাঝে খুব নরম সুরে কেউ কথা বলছে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা।

ও কোমর থেকে উরুমিটা খুলে নিলো। তারপর হাতের তালুতে পেঁচিয়ে সোজা সামনে এগিয়ে গুহার যেখান থেকে শব্দটা আসছে, সেখানে উপস্থিত হলো। কোনা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলো ও।

একজন পুরুষ আর মহিলা আর একজন মহিলার পাশে বসে আছে। সেই মহিলা উলঙ্গ অবস্থায় চার হাত পায়ে ভর দিয়ে আছে। মহিলা হাফাচ্ছে আর গোঙাচ্ছে। ওদের কেউই ক্রিস্টোফারের আগমন টের পেলো না। ক্রিস্টোফার হাসলো। এটাই হবে ওর চূড়ান্ত আঘাত-টম কোর্টনীর প্রতি ওর উপহার।

“কুত্তীটা বিয়াচ্ছে নাকি?” বলে উঠলো ক্রিস্টোফার।

ছেলেটা ঘুরে ক্রিস্টোফারকে দেখেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক যেমনটা ক্রিস্টোফার ভেবেছিলো। উরুমিটার ফলা ছুটে গেলো বাতাসে, আর ছেলেটার পায়ের মাংস কেটে দুই ভাগ করে দিলো। ছেলেটা আর্তনাদ করে পড়ে গেলো মাটিতে। জায়গাটা চেপে ধরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পায়ে শক্তি পেলো না।

“ফ্রান্সিস,” কেঁদে উঠলো অ্যাগনেস।

“ফ্রান্সিস?” ক্রিস্টোফার বললো এবার। ও নেপচুন তরবারিটা ছেলেটার বুখে গেঁথে দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু থেমে গেলো, নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না। “ফ্রান্সিস কোর্টনী?”

ফ্রান্সিস এক দলা থুতু ফেললো মেঝেতে তারপর মাথা ঝাঁকালো।

“তোর পরিবারের কি হাল করি তা চেয়ে চেয়ে দেখবি এখন।”

*

টম ভাঙা দেয়ালটা থেকে লাফিয়ে নামলো। এপাশেও দেয়ালের ভাঙা টুকরো ঢাল তৈরি করেছে। ওগুলো বেয়ে নেমে এলো ও তরবারি তুলে ধরা, কিন্তু সেটা ব্যবহার করা লাগলোই না বলা চলে। দস্যুরা ওর সামনে থেকে যে যেভাবে পারলো ভেগে গেলো। পিছনেই মারাঠা বাহিনি হুড়মুড় করে ঢুকতে লাগলো ভিতরে। ঘোশিয়া সৈন্যগুলো খুনের উৎসবে লেগে গেলো যেনো। উলঙ্গ আর উন্মত্ত অবস্থায় খোদ শয়তানের রূপ ধরে মানুষ মারতে লাগলো ওরা। যাদের হাতে অস্ত্র আছে তারা সামনে যাকে পেলো তারই কল্লা নামিয়ে দিতে লাগলো; বাকিরা খালি হাতেই দেখা গেলো গলা টেনে ছিঁড়ে ফেলছে।

এই কসাইখানার ভিতরেই কোথাও সারাহ আর অ্যাগনেস আছে। টম চত্বর থেকে যতো দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। মোহিত ও আগালো পাশেই। কয়েকজন দস্যু তখনও যুদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, জায়গায় জায়গায় তাই ছোট ছোট লড়াই চলছে। টম ওদেরকে পাত্তা না দিয়ে দুর্গের ভিতরে ঢুকে গেলো।

“ওরা বন্দীদেরকে কোথায় রাখতে পারে বলেন দেখি,” টম জিজ্ঞেস করলো মোহিতকে।

মোহিত কাঁধ ঝাঁকালো। তারপর আচমকা সামনে দৌড়ে গিয়ে পলায়নরত এক দস্যুর কাধ চেপে ধরে, পা দিয়ে ল্যাং মেরে শুইয়ে দিলো মাটিতে। একই সাথে ছুরি বের করে চেপে ধরলো গলায়। ভারতীয় ভাষায় কিছু একটা চেঁচিয়ে বললো মোহিত।

দস্যুটা ওর দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে। তারপর হড়বড় করে কিছু একটা বললো। মোহিত ওকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

“কয়েদখানা হচ্ছে দুর্গের নিচের গুহাগুলোতে। দুর্গের ভিতরে উত্তর-পূর্ব দিকে নাকি নিচে নামার একটা সিঁড়ি আছে।”

ভিতরে ঢুকতে ওরা কোনো বাধার সম্মুখীন হলো না। পলায়নরত দস্যুরা ওদের দেখে এমনিতেই সামনে থেকে সরে যেতে লাগলো। ওরাও ওদেরকে পাত্তা দিলো না। দস্যুরা যুদ্ধ করার সমস্ত ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে; এখন শুধু লুণ্ঠন কার্যে ব্যস্ত। আর টমের ওদের কাছে কিছুর প্রয়োজনও নাই। একদম নিচে নেমে আসতেই দেখা গেলো একটা সিঁড়ি দুর্গের ভিত্তির মাঝে নেমে গিয়েছে। টম দ্রুত নেমে এলো নিচে।

নিচে নামতে নামতে ওর আশা বাড়তে লাগলো। সিঁড়ি যেনো শেষই হয় না। কিন্তু দস্যু বা আর কেউ দুর্গের এদিকটাতে এসেছে বলে মনে হচ্ছে না।

“আমরা মনে হয় সময়মতোই এসে পড়েছি,” মোহিতকে বললো টম।

কিন্তু টম জানে না যে বাস্তবতা ভিন্ন। ওরা সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে এলো। গোড়ায় একটা ছোট কক্ষ দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে আবার দুটো রাস্তা নেমে গিয়েছে দুদিকে। টম ভাবছিলো যে কোন সিঁড়িটা দিয়ে নামবে, সে কারণেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুজনকে খেয়লা করলো না। সিঁড়িতে পদশব্দ পেয়েই ওরা দুজন দরজার দুই পাশে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টম আর মোহিত দরজা দিয়ে ঢুকতেই, ভারী তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের উপর।

হতে পারে সৈন্য দুজন কোনো শব্দ করে ফেলেছিলো, বা একেবারে প্রবৃত্তির বশে ঠিক এক মুহূর্ত আগে টম টের পেয়ে গেলো যে আক্রমণ আসছে। আঘাতটা আটকানোর সময় পেলো না ও। শুধু মাথা নিচু করে মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সাথে টেনে নামিয়ে নিলো মোহিতকেও। তরবারির ফলা দুটো ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। এদিকে কোনো কিছুতে বাধা না পাওয়ায় দস্যু দুজন ভারসাম্য হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে ওদের গায়ের উপরেই এসে পড়লো। টম আর মোহিত ওদেরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে, তরবারির দুই খোঁচাতেই ঐ দুজনের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো।

টম দুটো সিঁড়ির দিকেই তাকিয়ে থাকলো। কোনটায় যাবো? “আপনি ডানটায় যান, আমি বায়েরটা খুঁজে দেখছি,” টম বললো।

দুজন দুই দিকে চলে গেলো ওরা। টম ঝড়ের বেগে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। প্রতিটা সেকেন্ড যেনো ওর উপর চেপে বসছে। উপরের ঐ দুজন লোক কোত্থেকে আসলো? আরো অনেকেই ছিলো নাকি? ওরা সারাহ আর অ্যাগনেসের কিছু করেনি তো? টমের বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো।

সিঁড়ির গোড়ায় একটা লোহার দরজা। এটাই নিশ্চিত কয়েদখানা। টম একবার ভাবলো মোহিতকে ডেকে আনবে কিনা, কিন্তু তাতে মূল্যবান সময়ের অপচয় হবে ভেবে বাদ দিলো চিন্তাটা। আর তাছাড়া দরজাটা খোলাই আছে। গুহার ভিতরের দিক থেকে একটা মহিলার আর্তচিৎকার শুনতে পেলো ও। একটু পরেই একজন পুরুষ মানুষও আর্তনাদ করে উঠলো। সমস্ত কুচিন্তা আবার ফিরে এলো মাথার ভিতর। কোনো সতর্কতার ধার না ধরে ও সোজা দৌড় দিলো গুহার ভিতরের দিকে। একটু পরেই একটা বড়সড় কক্ষে এসে হাজির হলো টম।

একবার তাকিয়েই সব বুঝে গেলো ও। ওর সুদূরতম আশা, আর ওর গভীরতম ভয়, দুটোই একই সাথে বাস্তব হয়ে ধরা দিলো সামনে। সারাহ নগ্ন অবস্থায় চার হাত পায়ে ভর দিয়ে চিৎকার করছে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে; অ্যাগনেস জবুথবু হয়ে বসে আছে পাশে; ফ্রান্সিস পায়ে একটা গভীর ক্ষত চেপে ধরে দেয়ালের গায়ে সেটে আছে। আর সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওদের সাথে বেঈমানি করা লোকটা। এক হাতে উদ্যত নেপচুন তরবারি, অন্য হাতে সেই চাবুকের মতো ফলাটা।

লোকটার পিঠে টমের দিকে–কিন্তু অ্যাগনেসের চেহারা ছিলো এদিকে। ফলে টমকে দেখে ওর চোখে মুখে যে স্বস্তির ছাপ পড়লো সেটা ও লুকাতে পারলো না। টম কিছু করার আগেই ক্রিস্টোফার অ্যাগনেসের চেহারার পরিবর্তন ধরতে পেরে ঘুরে গেলো পিছনে। বিকট এক হাসি ফুটে উঠলো ওর চেহারায়।

“টম কোর্টনী,” ইংরেজিতে বলে উঠলো ও। “আমি আশা করে ছিলাম যে আপনি শেষ দৃশ্যটা দেখতে সময়মতো হাজির হবেন।”

প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলো টম। হাতের তরবারিটা তুলে নিয়ে জ্যাভেলিনের মতো ছুঁড়ে দিলো। ঠিক যেভাবে টেমসের তীরে নেপচুন তরবারিটা ছুঁড়ে বিলির হৃৎপিণ্ড ফুড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মারাঠা তরবারি অনেক ভারী, ফলে ঠিকমতো ছুঁড়তে পারলো না। লক্ষ্যে পৌঁছার আগেই মাথাটা নিচু হয়ে গেলো, আর ক্রিস্টোফার উরুমি ছুঁড়ে ওটাকে নিজের দিক থেক সরিয়ে দিলো। ঝন করে মেঝেতে পড়ে পিছলে গেলো ওটা।

এখন অসহায় হয়ে গেলো টম। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এলো। উরুমির ফলাটা সাপের মতো একেবেকে আগালো ওর সাথে সাথে, পাথরের উপর সরসর শব্দ করছে। ঘরের অন্য শব্দটা করছে সারাহ, গোঙাচ্ছে।

“আমি এই অস্ত্রটা ঠিক একজন চিত্রকরের আকার তুলির মতো ব্যবহার করতে পারি,” ক্রিস্টোফার বলে উঠলো। “আমি একটা একটা করে আপনার হাত পা কেটে নেবো। তারপর যখন আর আপনার কিছু করার থাকবে না তখন আপনি চেয়ে চেয়ে দেখবেন কিভাবে আমি আপনার বৌকে জবাই করি আর আপনার ছেলেকে আছড়ে ঘিলু বের করি।”

টম বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। “কেনো? আমি তোমাকে কি করেছি?”

“জানেন না আপনি? অনুমান করেন দেখি?” ক্রিস্টোফার আরো এক পা এগিয়ে এলো। তারপর সারাহের দিকে ইশারা করলো, এখন ও দেয়াল চেপে ধরে শুধু হাঁটুতে ভর দিয়ে আছে। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে বাচ্চার মাথা দেখা যাচ্ছে। ক্রিস্টোফার টমের চেহারার অভিভূত অবস্থাটা দেখে হেসে দিলো।

“আপনি তো ঐ বাচ্চাটাকে বাঁচাতে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত, তাই না? আপনি এই অজেয় দুর্গে এতো কষ্ট করে এসে এটাকে ছিন্ন ভিন্ন করেছেন শুধু ওটাকে রক্ষা করার জন্যে। ইশ! কতো মহান আপনি! কতো বড় বীর!”

তবুও টম বুঝতে পারলো না।

“কিন্তু সব সময়তো আপনি এতোটা কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন না। নাকি ছিলেন?” চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললো ক্রিস্টোফার। “আমার মা-কে ভোগ করে তার পেটে বাচ্চা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু জানার পর ভাগতে দুইবার ভাবতে হয়নি আপনার। আপনি আমাকে ত্যাগ করেছেন, আর আপনার ভাইকে রেখে গিয়েছেন আমার মায়ের লজ্জাকে ঢাকতে।”

টম এতোক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ওর চেহারা দেখে ক্রিস্টোফারও টের পেলো সেটা। নিজের কৃতকর্মের জন্য একই সাথে টমের চেহারায় আতংক, ভয় আর লজ্জা খেলা করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ক্রিস্টোফার টের পেলো লিডিয়ার বলা প্রতিটা কথা-ই সত্যি। উরুমিটা ছোঁড়ার জন্যে ও হাত সোজা করলো, কোথায় মারবে সেটা চিন্তা করছে। প্রথমে ভাবলো টমের উরুতে ছুঁইয়ে ওর হ্যামস্ট্রিংটা দুই ভাগ করে দেবে। তারপর ধীরে সুস্থে একে, একে বাকি সব করতে পারবে।

“কে তুমি?” জিজ্ঞেস করলো টম। ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছে; কথাটা ফিসফিসানির মতো শোনালো।

ক্রিস্টোফার ওর চোখের দিকে তাকালো। দুজনের চোখই হুবহু এক। যেনো আয়নার দিকে তাকিয়েছে ও।

“আমি আপনার ছেলে।”

বলে উরুমি চালালো ক্রিস্টোফার।

কিন্তু কিছু একটা টেনে ধরলো ওকে পিছন থেকে। উরুমি নড়লো না। ফ্রান্সিস হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগিয়ে এসে ওটার মাথা চেপে ধরেছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে ফলাটা। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে ফ্রান্সিসের। যেখানে ধরেছে। সেখানে আঙুল কেটে রক্ত পড়ছে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়লো না ফলাটা।

প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে উঠে ক্রিস্টোফার উরুমিটা ছেড়ে দিয়ে নেপচুন তরবারিটা তুলে নিলো। এটাই ঠিক আছে। কোর্টনীদের তরবারি দিয়েই ও টমকে শেষ করবে। আর তরবারিটার উপর ওর উত্তরাধিকারটাও সুনিশ্চিত হবে।

কিন্তু ফ্রান্সিস যখন ক্রিস্টোফারকে আটকে রেখেছিলো তখন অ্যাগনেস নড়ে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠে যেখানে টমের তরবারিটা পড়েছিলো সেখানে গিয়ে তরবারিটা তুলে নিয়ে টমের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ক্রিস্টোফার ওকে নড়তে খেয়াল করলো। সাথে সাথে ও নেপচুন তরবারিটা চালালো কিন্তু অ্যাগনেস গড়িয়ে গুহার অন্যদিকে সরে গেলো। ক্রিস্টোফার আবার আক্রমণ করতে পারার আগেই টম ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর দিকে। রেগে মেগে সমস্ত শক্তি দিয়ে তরবারি চালালো টম, একদম শেষ মুহূর্তে কোনোমতে সরে গেলো ক্রিস্টোফার।

ক্রিস্টোফার ভাবলো ও যদি সারাহের কাছে পৌঁছে ওর গলায় তরবারি ধরতে পারে তাহলে টম আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু ফ্রান্সিস বিপদটা আঁচ করতে পারলো। ও মেঝে থেকে যতোটা পারলো সোজা হয়ে ক্রিস্টোফার আর সারাহের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

ক্রিস্টোফার চাইলে এক কোপে ফ্রান্সিসের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু সেটা করতে গেলে ওর পিঠ টমের দিকে ফিরে যেতো, টম আবার ওর দিকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। টমের আক্রমণ নিজের তরবারি দিয়ে ঠেকালো ক্রিস্টোফার, ঝন ঝন শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো সাড়া গুহা জুড়ে।

ওদের সবার বিরুদ্ধে ক্রিস্টোফার একা। ও খুব দ্রুত প্রতি আক্রমণ শুরু করলো। বহুল চর্চিত কয়েকটা আঘাত দিয়ে কোণঠাসা করে ফেললো টমকে। ক্রিস্টোফার এখনো প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে আছে, কিন্তু এখন অনেকগুলো বিপদ সামনে। দুর্গের পতন হয়েছে-কিছুক্ষণ পরেই লোকজন চলে আসবে এদিকে। ওকে পালাতে হবে দ্রুত।

টমকে ঠেলতে ঠেলতে সারাহের কাছে নিয়ে আসলো ও। এখন ক্রিস্টোফার আর দরজার মাঝে আর কিছুই নেই। ও আবার টমকে আক্রমণ করলো। একদম বই থেকে রপ্ত করা নিখুঁত সব আক্রমণ। আর ওর ধারণা মতোই টমও সহজেই ওগুলো আটকে দিলো। কিন্তু যেই টম উল্টো জবাব দিতে যাবে, তখনই ক্রিস্টোফার আচমকা পিছনে দিকে সরে গিয়ে, টম কিছু করার আগেই উল্টোদিকে ঘুরে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। একটু পরেই সিঁড়িতে হারিয়ে গেলো ওর পদশব্দ।

সারাহ কেঁদে উঠলো, ওর গোঙ্গানিটা এখন একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে রূপ নিয়েছে। টম দৌড়ে গেলো ওর কাছে।

রক্ত আর তরল উগরে দিয়ে বাচ্চাটা অ্যাগনেসের পেতে রাখা হাতে এসে পড়লো।

“ছেলে হয়েছে আপনার।”

বাচ্চাটার চেহারাটা একজন বৃদ্ধের মতো কুঁচকে আছে, চোখ বন্ধ, নাড়ি তখনও মায়ের সাথে সংযুক্ত। গায়ের ত্বক অস্বাভাবিক নীল।

“ও কি…বেঁচে আছে?” টমের ভিতর এতো জোরে আবেগের ঝড় বইতে লাগলো যে অসুস্থ্য লেগে উঠলো ওর। এক মিনিট আগে, ও এমন এক শয়তানের বিরুদ্ধে লড়ছিলো, যে দানব কিনা ওর নিজেরই সৃষ্টি; এখন আবার সারাহের সাথে দেখা হলো, সেই সাথে বাবাও হলো। ওর মাথার ভিতর এতো বেশি চিন্তা ঘুরতে লাগলো মনে হলো যেনো মাথাটা ছিঁড়ে বের হয়ে যাবে সব।

অ্যাগনেস বাচ্চাটার পিঠে একটা চাপড় দিতেই ওটা কাশি দিয় উঠলো। শ্লেম্মা বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। বাচ্চাটা অর্ধেক চোখ খুলে টমের দিকে কেমন ঢুলুঢুলু বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

“ওকে নিন, অ্যাগনেস আগ্রহ ভরে বললো। “আপনার ছেলে।”

অ্যাগনেস বাচ্চাটাকে টমের বাহুতে বসিয়ে দিলো। যদিও টমের সাহস হচ্ছিলো না ওকে ধরার। বাচ্চাটা এতো ছোট, ওজনটাও অনুভব করতে পারলো না ও। কিন্তু তবুও যেই মুহূর্তে ও নিজের ছেলেকে স্পর্শ করলো তখনি এমন একটা ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতা ওর ভিতরে উথলে উঠলো, যা এর আগে কখনোই অনুভব করেনি। ওর চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। এততক্ষণ ভরে যে আবেগের ঝড় বইছিলো, স্তিমিত হয়ে গেলো সেটা। ছেলের নিষ্পাপ চোখ দুটোয় যে নির্মল শান্তি তা শান্ত করে দিলো সব অস্থিরতাকে।

কিন্তু ওর কাজ এখনো শেষ হয়নি। ও দ্রুত বাচ্চাটাকে সারাহের বাড়িয়ে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলো।

“যাও,” সামান্য পরেই সারাহ বললো। সব ব্যথা এক নিমিষে চলে গিয়েছে ওর। এখন উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। ওর মাথার চুল পড়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে, চেহারা ভর্তি ঘাম, পা ভরা রক্ত। গায়ে একদম কিছুই নেই। বাচ্চার নাড়িটা তখনও ওর দুই পায়ের। ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে। কিন্তু তবুও ও এমন একটা আভায় জ্বলজ্বল করছে : যা টম আগে কখনোই দেখেনি। যেনো ভিতর থেকেই একটা নিশ্চয়তা ওকে জানিয়ে দিচ্ছে যে ওর একটা অংশ নতুন করে জন্ম গ্রহণ করেছে। টমের মনে হলো সারাহকে এর আগে কখনো এতোটা সুন্দর লাগেনি।

“তোমার আর আমাদের বাচ্চার পাশে থাকা উচিত আমার,” টম প্রতিবাদ করলো।

“আমরা এখানে নিরাপদ আছি,” সারাহ বললো। “কিন্তু তরবারিটা এখনো ঐ শয়তানটার দখলে-আর ও ওটা দিয়ে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। তোমাকে, আমাকে–আর ওকেও।” ও বাচ্চাটাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বাচ্চাটা সারাহের স্তনে নাক ঘষছে আর ছোট্ট ছোট্ট আঙুল দিয়ে ওর স্তনের বোটা খুঁজছে।

কারো দৌড়ে আসার শব্দ পাওয়া গেলো। টম ঘুরে গেলো। ও ভাবেনি যে ক্রিস্টোফার ফিরে আসবে আবার, কিন্তু দুর্গে এখনো অনেকেই আছে। এই লুটতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে যে কেউই ওদের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মোহিতকে আসতে দেখে শান্ত হলো ও। পিছনে আরো চারজন লোক।

“আমরা দস্যুদেরকে পানি পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছি,” হাবিলদার। জানালো। “ফেরার পথে আরেকটাকে পেয়েছিলাম কিন্তু সে পালিয়ে গিয়েছে।” বলে ও ভ্রু কুঁচকানো। “ঐ লোকটাই আমাদের সাথে বেঈমানি করেছে সম্ভবত। ওর হাতে একটা দারুণ সোনালি তরবারি দেখলাম।”

“অনেক ধন্যবাদ,” টম লোকটার কাঁধ স্পর্শ করলো। “এখানে থাকুন। আর একটু খেয়াল রাখবেন আমার… “ আবারও বাচ্চাটার দিকে নজর যেতেই ওর কথা জড়িয়ে এলো। পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে এখন সে। “পরিবারের যেনো কিছু না হয়।”

“সাথে কাউকে দেবো?”

টম মাথা নাড়লো। “আমি একাই করবো কাজটা।”

*

টম আবার দুর্গের উপর দিকে দৌড়ে গেলো। এবার আর অসতর্ক না, কান খাড়া করে রেখেছে কারো পদশব্দ শুনতে পায় কিনা সেই আশায়। তরবারি প্রস্তুত-কিন্তু ওর চিন্তার প্রায় পুরোটা জুড়েই আছে অন্য একটা জিনিস : বাচ্চাটা, এতো ছোট আর অসহায়, ঠিক একটা পালকের মতো পলকা।

আমি একজনের পিতা।

তুমি আগেও বাবা হয়েছিলে, একটা নিষ্ঠুর কণ্ঠ ভিতরে ডেকে উঠলো। একটু আগে দেখা দানবটা যে ওর ছেলে সেটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ক্রিস্টোফার, অ্যাগনেস, সারাহ আর বাচ্চাটাকে কি করতে চেয়েছিলো সেটা মনে আসতেই আবার ওর ভিতরটা শক্ত হয়ে গেলো।

আমার বাবা আমাকে বাধ্য করেছিলেন। হাল কোর্টনী যখন টমের সাথে ক্যারোলিনের মাখামাখির ব্যাপারটা টের পান, আর তার ফলে গাই আর টমের মাঝে গড়ে ওঠা তিক্ততার কথা জানতে পারেন, উনি সাথে সাথে গাই আর কোর্টনীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেন। ওদেরকে বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে, ক্যারোলিনের বাবার সহকারী হিসেবে গাই-এর জন্যে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তখন কেউই টের পায়নি যে ক্যারোলিনের পেটে বাচ্চা আছে। টম এমনকি বিদায়-ও জানাতে পারেনি ক্যারোলিনকে।

টম ব্যাপারটা জানতো না, কিন্তু ওর বাবা ইচ্ছাকৃতভাবে ওর কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছিলেন। যখন ক্যারোলিনের বাবা বাচ্চাটার কথা জানিয়ে হালকে চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠি উনি পড়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেন। বহু পরে উনি টমকে ব্যাপারটা জানান, ডোরিয়ান হারিয়ে যাওয়ার পরে যখন ওরা ইংল্যান্ডে ফিরছিলো তখন।

আমারই উচিত ছিলো ক্যারোলিনকে বিয়ে করা। কিন্তু যতোই ভাবতে লাগলো, ততোই মনে হলো কাজটা ঠিক হতো না। তাহলে সারাহের সাথে বিয়ে হতো না। আর তাহলে সম্ভবতি কখনোই ডোরিয়ানকে উদ্ধার করতে পারতো না। এখন সারাহের গর্ভে ওর ছেলেটাও হতো না।

ফ্রান্সিসকে দেখো, নিজেকে বললো টম। ব্ল্যাক বিলির ঔরসে জন্ম, জুয়াড়ি সৎ বাবার কাছে মানুষ হয়েছে, জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত সত্যিকার একজন কোর্টনী-ই হয়েছে, নিজের পরিবারের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। জন্ম পরিচয়েই একজন মানুষ মানুষ হয় না, মানুষ হয় সে নিজেকে যা তৈরি করে তাতে।

“মিস্টার কোর্টনী?”

টম উপরের তলায় পৌঁছে গিয়েছে। পরিচিত কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকালো ও, মেরিডিউ দাঁড়িয়ে আছে দরজা ধরে।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তুমি বেঁচে আছো,” টম বললো। “কিন্তু কিভাবে?” .

“মাস্টার ফ্রান্সিস আমদেরকে উপরে ফটক খুলতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি, আপনিই আমাদের হয়ে কাজটা করে দিয়েছেন। আপনাকে খুঁজলাম এতোক্ষণ, না পেয়ে তাই আবার মাস্টার ফ্রান্সিসের কাছে যাচ্ছিলাম।”

“যাও।” মোহিত, সারাহ আর বাকিদের সাথে আছে। কিন্তু আরও কিছু লোক ওদের সুরক্ষায় থাকলে আরো ভালো হয়। তারপরই আর একটা চিন্তা মাথায় এলো। “এদিক দিয়ে সোনার পাত বসানো তরবারি হাতে কাউকে আসতে দেখেছো নাকি?”

মেরিডিউ মাথা নাড়লো। টম দুর্গের উত্তর-পূর্ব মিনারের উঠে যাওয়া আঁকাবাঁকা সিঁড়িটার দিকে তাকালো। “ও নিশ্চয়ই তাহলে উপরে গিয়েছে।”

সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো টম। খুব প্যাচানো সিঁড়ি। দেয়াল জুড়ে ছোট ছোট জানালা। ওগুলো দিয়ে নিচের চত্বরের দুই এক ঝলক চোখে পড়ছে। সূর্য উঠছে। লড়াই শেষ। শাহুজির লোকেরা ফটক খুলে সব দখলে নিয়ে নিয়েছে। রাজাকে দেখা গেলো বিশাল একটা হাতীর পিঠে চড়ে চিৎকার করে লোকজনকে আদেশ দিচ্ছেন। বন্দীদেরকে জড়ো করা হচ্ছে এক জায়গায়। যুদ্ধের কান ফাটানো তর্জন গর্জনের পর এখন এই সূর্য ওঠার আগ মুহূর্তের নীলচে আলোয় সবকিছু অপার্থিব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে।

সিঁড়ির গায়ের একটা দরজায় পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো টম। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো ভিতরে কেউ আছে কিনা। একজন পুরুষ আর একজন মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেলো অন্য প্রান্তে। খুব তাড়াহুড়া করে দুজনে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে।

টম লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললো। ভিতরে ঢুকতেই একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে উঠে নিজের জামাটা বুকের সাথে চেপে ধরলো। মহিলা নগ্ন, তবে মাত্রই কাপড় পরা শুরু করেছিলো। এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও মহিলাকে চেনা চেনা লাগলো টমের। সামান্য পরেই নামটা মনে পড়লো ওর, লিডিয়া ফয়। তবে মুহূর্তেই ওর অস্তিত্ব মুছে গেলো টমের মাথা থেকে, কারণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কোমরে একটা ভারী বেল্ট বাঁধছে ক্রিস্টোফার।

টম ওর দিকে ধেয়ে গেলো। লিডিয়া চিৎকার দিয়ে উঠলো আবার। কিন্তু কালারিতে নিবিড় পরিচর্যা পাওয়ার কারণে মুহূর্তের ভগ্নাংশের মাঝে ক্রিস্টোফার নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলতে পারে। ও নেপচুন তরবারিটা তুলে নিয়ে একপাশে সরে গেলো। একই সাথে সেটা দিয়ে টমের তরবারিতে এতো জোরে বাড়ি দিলো যে, টমের হাত থেকে তরবারি প্রায় ছুটেই গেলো। টম ঘুরে সোজা হয়ে আবার তরবারি সোজা করে দাঁড়ালো।

ক্রিস্টোফার সামনে বাড়ার ভান করলো, তারপরেই ঘুরে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলো। ওর জন্যে নিচে নামা নিরাপদ না-কারণ টম যদি ওকে ধরে। ফেলে, তাহলে একটা লাথি মেরেই ওকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দিতে পারবে। তাতে ঘাড় ভেঙে মারা যেতে পারে ও। তাই ও উপরে উঠতে লাগলো। একদম সিঁড়ির মাথা পৌঁছে, ওখানকার ছোট দরজাটা কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলে দুর্গের ছাদে উঠে এলো। কিন্তু দরজাটা বন্ধ করার আগেই উঠে এলো টম।

এবার মিনারের ছাদে মুখোমুখি হলো দুজন। ক্রিস্টোফার দাঁতে দাঁত চাপলো। টম সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আর নিচে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই। এসপার নাহয় ওসপার কিছু একটা হবেই এখন।

“আমাকে যদি মেরেই ফেলবেন, তাহলে আমাকে জন্ম না দেয়াটাই ভালো হতো না,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ক্রিস্টোফার। ভিতরে আক্রোশ দানা বাঁধছে। গাই-এর নিষ্ঠুরতা, ওর মায়ের নীরবতা, যাদেরকে যাদেরকে খুন করেছে-আর সবার আগে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা-সব চিন্তা মাথায় ঘুরছে ওর। বুঝতে পারছে না ওর কি ওনাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরা উচিত হবে, নাকি তরবারিটা বুকে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত হবে।

তৃতীয় নিয়মটা কি? অতীতের একটা কণ্ঠ ওর মাথায় ডেকে গেলো।

আত্ম নিয়ন্ত্রণ।

ক্রিস্টোফার জোর করে আবেগকে সরিয়ে রাখলো। শুধু হাতের তরবারিটা বাদে আর কিছুকেই ও অনুভব করতে চায় না।

“আমি তোমাকে মারতে চাই না,” টম বললো। ও মন থেকেই বলেছে কথাটা। দিগন্তে সূর্য উঠছে, ভোরের ঝিরিঝিরি বাতাস ওর কানে গুনগুন করে উড়ে যাচ্ছে। টম টের পাচ্ছে যে নতুন একটা দিন নতুন আশার বার্তা নিয়ে শুরু হচ্ছে। “তুমি যদি আসলেই আমার ছেলে হও। তাহলে তুমি যা-ই করে থাকো না কেন, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবো।”

‘আমাকে ক্ষমা করে দেবেন?” অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার। “আপনার তো হাঁটু মুড়ে বসে আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এই সব কিছুর জন্যে আপনি দায়ী। আপনি যদি আমার মাকে ছেড়ে না যেতেন…”

আবারও আবেগ ক্রিস্টোফারকে কাবু করে ফেলতে চাইলো। ও সেটাকে সরিয়ে দিলো আবার।

“আমি জানতামই না যে ক্যারোলিনের পেটে বাচ্চা ছিলো,” টম প্রতিবাদ করলো।

“কারণ আপনি কোনো পরোয়া করতেন না।” বলতে বলতে ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড আক্রোশে তরবারি চালাতে লাগলো। টম সেটা আটকাতে গিয়ে ছাদের কিনারে চলে এলো। “মজা যা করার করে নিয়ে আপনি নিজের রাস্তায় ভেগে গিয়েছিলেন। যেনো সে একটা বন্দরের মাগী। আমার মা!”

“আমার কিছুই করার ছিলো না।” ক্রিস্টোফারের আঘাতগুলো ঠেকাতে ঠেকাতে বললো টম। কিন্তু হাতে এই অনভ্যস্ত অস্ত্রটা থাকায় ঠিকভাবে ঠেকাতে বা আক্রমণ করতে কোনোটাই পারছিলো না। আর এর বিপরীতে নেপচুন তরবারিটা যেনো বাতাসে নেচে বেড়াতে লাগলো।

“আমি দুঃখিত,” টম বললো। এটাও ও একেবারে হৃদয়ের অকুস্থল থেকে বললো। ওর অবস্থান থেকে তাকালে ও স্পষ্ট দেখতে পায় ওদের জীবনটা কতো ঘটনা-দুর্ঘটনা, সেই সাথে অসংখ্য সুযোগ, সম্ভাবনা, সত্যি-মিথ্যে পেরিয়ে আজ এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। যদি ভাগ্যই ওদেরকে এখানে টেনে এনে থাকে তাহলে নিশ্চিত তা কোনো না কোনো প্রয়োজনেই এনেছে।

“এখানে কেন এসেছেন?” ক্রিস্টোফার জানতে চাইলো। “আমাকে পালাতে দিচ্ছেন না কেনো?”

“তরবারিটার জন্যে,” সত্যিটাই বললো টম।

ক্রিস্টোফার শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ওটা। চেহারা দেখেই বোঝা গেলো জীবনেও মানবে না ও। “এটা আমার।”

টম ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তরবারিটার সোনালি ফলাটার দিকে তাকালো। ওটার বিশাল নীলাটায় সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। একটা নিখুঁত অস্ত্র। ওর বাবার কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার, কোর্টনী পরিবারের সম্মান।

কিন্তু নিজের ছেলের প্রতি ভালোবাসার কাছে একটা তরবারির আর কি দাম থাকতে পারে?

“রেখে দাও,” টম বললো। “যদি এটা দিয়ে আমরা আবার এক হতে পারি, তাহলে ওটা তোমারই থাক।”

ক্রিস্টোফার হাসলো। টম টের পেলো ওর ভিতর একই সাথে পরম একটা স্বস্তি আর স্নেহের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ক্রিস্টোফার যা-ই করে থাকুক, যে অশুভ কার্যকলাপই ওকে এখানে টেনে আনুক না কেনোটম ওকে ক্ষমা করার একষ্টা রাস্তা বের করেই ফেলবে।

টম দুই হাত সামনে বাড়িয়ে ডাকলো, “বাবা আমার।”

“বাবা।”

ক্রিস্টোফার টমকে ওর দিকে দুই কদম এগিয়ে আসতে দিলো। তারপর তরবারিটা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবার।

ছাদের একদম কিনারে দাঁড়িয়ে থাকায় টমের পিছিয়ে যাওয়ার উপায় ছিলো না। কিন্তু ও পুরোপুরি অপ্রস্তুত-ও ছিলো না। ক্রিস্টোফারকে ক্ষমা করেছে ঠিক আছে, কিন্তু এখনো ওকে বিশ্বাস করা শুরু করেনি। ক্রিস্টোফারের চোখের হিংস্র দৃষ্টি ওর চোখ এড়ায়নি। ক্রিস্টোফার তরবারি নামিয়ে আনার এক সেকেন্ড আগেই ও খেয়াল করলো ব্যাপারটা। একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়িয়ে নিজের তরবারিটা উপরে তুলে ক্রিস্টোফারের তরবারি ডানপাশে সরিয়ে দিলো। দুটো তরবারি বাড়ি খেয়ে ঝনঝনিয়ে উঠলো। মিনারের উপরে এই নীরব জায়গায় আরো জোরালো শোনালো সেটা। ক্রিস্টোফার তরবারি তুলে আবার আক্রমণ করলো। আবার দুই ফলা একসাথে আটকে থাকলো কিছুক্ষণ। টম আর ক্রিস্টোফার দুজনই দুজনকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। পুরোপুরি শক্তির খেলা চলছে। কেউই তরবারি ছোটাতে সাহস করছে না, কারণ তাতে অন্যজন তরবারি চালানোর সুযোগ পেয়ে যাবে।

আচমকা ক্রিস্টোফার পিছন দিকে লাফিয়ে সরে গেলো, যাতে টম ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। টম সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, নিচে নামার সিঁড়ির মুখের চৌকো দরজাটায় পা প্রায় ঢুকেই গিয়েছিলো। ও পা সরিয়ে নিতে গিয়ে কাত হয়ে গেলো একপাশে। তারপর সেদিক দিয়ে নিচে পড়তে পড়তেও সামলে নিলো আবার। ক্রিস্টোফার লাথি চালালো সেদিকে। কিন্তু টম সাথে সাথে পিছিয়ে যাওয়ায় লাগলো না লাথিটা। টম মাটিতে শুয়ে পড়ে, সাথে সাথে পাশে গড়িয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো-একটুর জন্যে ক্রিস্টোফারের আঘাতটা ঠেকিয়ে দিতে পারলো ও। নিচু করে উরু বরাবর মেরেছিলো কোপটা।

এরপর দুজন দুজনকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো। ক্রিস্টোফার আক্রমণ করলো, টম ঠেকালো, কিন্তু কারো ভঙ্গিতেই কোনো তেজ নেই। মুখে মুখে তর্ক চলতে লাগলো, দুজনেই অপেক্ষা করছে একটা মোক্ষম সুযোগের।

ক্রিস্টোফারের মাথায় অবশ্য অন্য একটা চিন্তা চলছিলো। ওর বয়স মাত্র বিশ, আর সারা রাত কিছুই করেনি বলা চলে; আর টম চল্লিশ ছাড়িয়েছে–বিগত কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করছে ও। যতোই ক্রিস্টোফার ওকে কম আক্রমণ করে বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছে, ততোই ওর ভিতরের যুদ্ধের স্পৃহাটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। টম নিজেও টের পেলো যে ওর মনোবল কমে আসছে।

ব্যাপারটা আরো ক্ষেপিয়ে দিলো ওকে। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে ও আক্রমণ চালালো, দুই হাতে ধরে আছে তরবারিটা। জোর করে সমস্ত শক্তি দুই হাতে জড় করে সমানে ক্রিস্টোফারের দিকে তরবারি চালাতে লাগলো।

কিন্তু ওর ইচ্ছাশক্তি ব্যাপক হলেও শরীরে কুলালো না। যতো জোরে ও চেষ্টা করলো, ওর হাত ততো ধীরে সাড়া দিতে লাগলো। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ও। ঘন ঘন এলোমেলো শ্বাস নিচ্ছে। ক্রিস্টোফার পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে পিছনে হেলে পড়ে টমের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিলো, ওর মুখে বিজয়ীর হাসি। ধীরে ধীরে টমকে তার শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেলতে দিচ্ছে। সব শেষে একটা কোবরার মতো করে ও আঘাত করবে।

কিন্তু সময়টা ক্রিস্টোফারের পক্ষে নেই। চৌকো দরজাটা দিয়ে দুর্গের সিঁড়িতে লোকজনের চিৎকার শোনা গেলো। ইংরেজ কণ্ঠ-ফ্রান্সিস বা মেরিডিউ ওকে খুঁজতে আসছে।

“এসব পাগলামি বাদ দাও,” টম বললো। “তুমি জিততে পারবে না।”

ক্রিস্টোফার ওর দিকে নিখাদ শয়তানের মতো একটা চাহনী দিলো। “হয়তো, কিন্তু আমি নিজের প্রতিশোধ তো নিতে পারবো।”

“তাতে কি লাভ হবে তোমার?”

ক্রিস্টোফার শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। উত্তর জানা নেই ওর। তারপর ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবার। তরবারি সোজা টমের বুক বরাবর ধরে রেখেছে। টম নিজের তরবারি দিয়ে ওটা সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে।

নেপচুন তরবারিটা টমের বাম কাঁধ ভেদ করে চলে গেলো। একই মুহূর্তে, টমের আঘাতটাও লাগলো। তবে সেটা টমের নিশানা মতো ক্রিস্টোফারের তরবারির ফলায় লাগলো না, লাগলো তরবারি ধরা হাতের কবজিতে। তরবারিটা ভারী, তার উপর টম সমস্ত শক্তি দিয়ে চালিয়েছিলো কোপটা। মাংস, পেশিতন্ত্র আর হাড় ভেদ করে ওপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো তরবারিটা।

ক্রিস্টোফার আর্তনাদ করে উঠলো। নেপচুন তরবারিটা পড়ে গেলো ছাদের মেঝেতে। হাতলে ক্রিস্টোফারের কাটা হাতটা আটকে আছে। ক্রিস্টোফার পিছিয়ে গেলো, কবজি পেটের সাথে চেপে রেখেছে। রক্তপাত বন্ধ করতে চাচ্ছে। কিন্তু তবুও ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে।

টমেরও কাঁধ থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু ওর আঘাতটা মারাত্মক না। ও নেপচুন তরবারিটা পা দিয়ে চেপে ধরলো। কিন্তু তবুও ক্রিস্টোফার ভালো হাতটা দিয়ে ওটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।

“সব শেষ,” টম বললো।

ক্রিস্টোফার ছাদের কিনারে উঠে দাঁড়ালো। নিচে তাকাতেই মাথা ঘুরে উঠলো ওর; রক্তপাতের কারণে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। নিচে সবুজ দরিয়া পাথরের চারপাশ ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ছে।

“বিদায়, বাবা।”

একদম শেষ মুহূর্তে টম বুঝতে পারলো ক্রিস্টোফার কি করতে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টোফারকে ধরতে গেলো ও, নিজের কি হবে সে খেয়লা ছিলো না। কিন্তু দেরি করে ফেললো। ক্রিস্টোফার বাতাসে ঝাঁপ দিয়ে নিচে পড়ে গেলো। টমের মনে হল যেনো অনন্তকাল ধরে ওকে পড়তেই দেখছে। তারপর একসময় নিচের ফেনিল সাগরে সামান্য আলোড়ন তুলে হারিয়ে গেলো পানির নিচে।

টম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ, ক্রিস্টোফার আবার ভেসে ওঠে কিনা সেটা দেখার আশায়। এতে উপর থেকে পড়ার পরেও কি বেঁচে থাকা সম্ভব? নাকি নিচে পাথরে লেগে ওর শরীরটা কি ভর্তা হয়ে গিয়েছে?

চিন্তাটা মাথায় আসতেই শিউরে উঠলো ও। রক্তে লড়াইয়ের উত্তাপ জমে গেলো মুহূর্তেই। কেনো যেনো বিজয় অনুভব করতে পারছে না ও, এক শোচনীয় পরাজয়ের অনুভূতি সারা দেহ জুড়ে।

আমার ছেলে, ভাবলো ও। আর আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। ঠিক যেভাবে বিলিকেও বাঁচাতে পারিনি।

চোখের কোনা দিয়ে নেপচুন তরবারিটাকে ঝিকিয়ে উঠতে দেখলো টম। হাতলে তখনও ক্রিস্টোফারের কাটা আঙুল মুঠো করে ধরে আছে। টম একটা একটা করে খুলে আনলো সেগুলো। এমনকি মরে গিয়েও ওগুলো তরবারিটা ছাড়তে রাজি না। দগদগে মাংস দেখে বমি পেলো ওর। কি করেছে সেটা দেখে আর সহ্য করতে পারছিলো না। তারপর কি মনে হতে তরবারিটাকে ছদের কিনারের দিকে ছুঁড়ে দিলো।

ও তরবারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সকালের রোদে ঝকমক করছে। একটুর জন্যে ক্রিস্টোফারের মতো ছাদ থেকে সমুদের গিয়ে পড়েনি। নীলাটা মিটিমিট করে জ্বলতে জ্বলতে যেনো ওকে ভেংচি কাটছে। তরবারিটা কি একজন মানুষের জীবনের চাইতেও মূল্যবান? ওর সন্তানের জীবনের চাইতেও?

কিন্তু আজ এক নতুন সূর্য উদিত হয়েছে, নতুন করে জীবনের সূচনা হয়েছে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে টমের সারাহকে বলা কয়েকটা কথা মনে পড়লো। “একজন মানুষের মানুষ হওয়ার পিছনে কি থাকে?” জানতে চেয়েছিলো টম। আর সারাহ জবাব দিয়েছিলো, “মানুষ যে গুণাবলিই পাক বা কারো কাছ থেকে যা কিছুই শিখুক-সে সবার চাইতে আলাদা একটা মানুষ হবে। তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো। সঠিক পথে না হাঁটলে সেটা তোমার দায় না।”

ক্রিস্টোফার ওর নিজের রাস্তা বেছে নিয়েছিলো, ঠিক যেমন বহু বছর আগে নিয়েছিলো বিলি। একটা পরিবার হচ্ছে একটা জ্যান্ত আর অশান্ত জিনিসের মতো। আর অন্যসব জ্যান্ত জিনিসের মতোই, এটা কখনো নিজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। টম যা করেছে তা শুধু নিজেকে বাঁচাতে।

ও তরবারিটা তুলে নিয়ে নিচে নিজের পরিবারের কাছে ছুটে গেলো।

*

সারাহ আর অ্যাগনেস তখনও কয়েদখানাতেই আছে। এতোদিনের বন্দীদশা ছেড়ে আজ ওরা মুক্ত। কিন্তু আরো বেশি রক্তপাতের ভয়ে সারাহকে এখনই এখান থেকে সরাতে চায়নি অ্যাগনেস। টম ওদেরকে তাজা বাতাস আর পরিষ্কার কামরায় নিয়ে যেত চাচ্ছিলো, কিন্তু অ্যাগনেসের কথাটা যুক্তিযুক্ত হওয়ায় চুপ করে গেলো। আর এখন যেহেতু প্রতিটা দস্যুকেই ধরে আনা হয়েছে, তাই কয়েদখানাও অন্য যে কোনো জায়গার মতো নিরাপদ।

অ্যানাও চলে এসেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে শাহুজির শিবিরে আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। সাথে করে খাবারও নিয়ে এসেছে। এসে ফ্রান্সিসের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। সারাহকেও কি একটা মলম লাগিয়ে দিয়েছে, জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য। এখন ও আর ফ্রান্সিস দুজন দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে একসাথে বসে আছে, অবাক চোখে বাচ্চাটাকে দেখছে। ওদের চেহারার ভাব দেখে, ওদের আলিঙ্গনের শক্তি দেখে টম বুঝলো যে ওর দাদা হতে খুব বেশি দিন লাগবে না।

আশেপাশের জীবন মৃত্যুর খেলার সবকিছু ভুলে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে, এখনো ওর নাড়ীটা কাটা হয়নি। অ্যাগনেসের পাশে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তপিণ্ডের সাথে তখনও আটকে আছে।

“এটা কেটে দিলে ভালো হতো না?” অনিশ্চিত সুরে জিজ্ঞেস করলো টম।

“আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম,” অ্যাগনেস বললো।

টম নিজের বেল্টের নেপচুন তরবারিটায় হাত দিলো। কিন্তু এরকম পবিত্র একটা তরবারি বাচ্চা প্রসবের মতো অশুচি কাজে ব্যবহার বা এরকম একটা প্রাণঘাতী অস্ত্র একটা নিষ্পাপ বাচ্চার কাছে আনার কোনোটাতেই টমের ইচ্ছে করছিলো না।

কিন্তু বাচ্চাটা টমের উত্তরাধিকারি। তরবারিটা কোর্টনীদের ঐতিহ্য, আর একদিন এই ছোট্ট বাচ্চাটাই বড় হয়ে তরবারিটা চালাবে। টম প্রথমে ফলাটা মুছে একেবারে চকচকে বানিয়ে ফেললো। অ্যাগনেস দুই হাত দিয়ে চটচটে নাড়ীটা ধরে কোথায় কাটতে হবে দেখিয়ে দিলো। ধারালো প্রান্তটা এক টানে কেটে ফেললো সেটাকে। টম শেষ প্রান্তটা বেধে দিয়ে বাচ্চাটার কপালে চুমু খেলো। ও ভবিষ্যতে কি হবে? কেমন মানুষ হিসেবে বড় হবে ও?

তুমি শুধু ওকে সঠিক পথটা চিনিয়ে দিতে পারো।

“কি নামে ডাকবো ওকে আমরা?” টম জিজ্ঞেস করলো।

সারাহ অ্যাগনেসের দিকে তাকালো। ওর বোন এই ভয়াবহ দীর্ঘ গর্ভধারণের সময়টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওর যত্ন নিয়েছে। নিজেও কতোটা যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গিয়েছে কিন্তু একটা বারের জন্যে অভিযোগ করেনি।

“ওর নাম হচ্ছে জেমস,” সারাহ বললো। “ক্যাপ্টেন হিকসের নামানুসারে রাখলাম নামটা।”

অ্যাগনেসে চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। সারাহ সামনে ঝুঁকে এলো যাতে অ্যাগনেস নিজেকে সামলে নিতে পারে। ও বাচ্চাটার দিকে তাকালো। ছোট্ট পেটটা থেকে তখনও নাড়ির সামান্য অংশটা বেরিয়ে আছে।

“টম কোর্টনী,” ঢুলুঢুলু কণ্ঠে বললো সারাহ। “তুমি দেখি ছেলের নাড়িতে পাল খাটানোর গিট্টু মেরেছে।”

*

বোম্বের দুর্গটার ফটকের দারোয়ান সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে চিনলো না। টাক মাথা, গাড় বাদামি রঙের চামড়া দেখে মনে হতে পারে যে লোকটা একটা উচ্চ বর্ণের পার্সি। এরা কোম্পানির ব্যবসার উপর খেয়ে পরে বেঁচে থাকে। কিন্তু এর গায়ের পোশাক ইউরোপিয়ান। গায়ে চমৎকার কাপড়ের লাল রঙা কোট, পরনে সাদা ধবধবে পায়জামা। একটা হাত জামার হাতার ভিতরে ঢোকানো, তবে অন্যটা মুঠো পাকিয়ে আছে।

“মহামান্য গভর্নর কারো সাথে দেখা করেন না,” দারোয়ান জানালো।

“আমি গভর্নরের সাথে কথা বলতে আসিনি, আমার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

দারোয়ান হাঁ হয়ে গেলো। মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলো চেহারা। “মাস্টার ক্রিস্টোফার?”

“মিস্টার কোর্টনী।”

দারোয়ান তালা খুলতে হিমশিম খেয়ে গেলো। “অবশ্যই স্যার, আমরা আসলে ভেবেছিলাম…

“ভুল ভেবেছিলেন।”

দুই বছর আগে যে নধর কিশোর দুর্গ ছেড়েছিলো তার সাথে ক্রিস্টোফারকে এখন মেলানো অসম্ভব। এখন তার উপর ওর চেহারা রোদে পুড়ে কয়লা, চেহারা ভেঙে চুরে একাকার, একটা হাত নেই। ভিতরের চত্বরটা পেরিয়ে লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে গভর্নরের অফিসে উঠে এলো ও। এতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে যে দরজার প্রহরী ওকে আটকাতে ভুলে গেলো। দরজা পার হয়ে আসার পরে সম্বিত ফিরলো প্রহরীর। ক্রিস্টোফার প্রহরী বা পিছনে আগুয়ান চিৎকার কোনোটাকেই পাত্তা দিলো না। সোজা উপরের তলায় চলে এলো।

“ক্রিস্টোফার কোর্টনী,” গাই-এর অফিসের বাইরের প্রহরীটাকে চিৎকার করে জানালো ও। “আমার বাবার সাথে দেখা করবো আমি। আটকালে তোকে আমি চাবুক মারার ব্যবস্থা করবো।”

দরজা খুলে যেতেই ক্রিস্টোফার ঢুকে গেলো বিশাল অফিসটায়। নতুন করে লাগানো জানালা থেকে রঙের গন্ধ আসছে; স্যার হাল কোর্টনীর ছবিটা কিছুটা বাঁকা হয়ে ঝুলছে। দেয়ালের কাঠের গায়ে পাউডারের দাগ দেখা গেলো, ওটার খুব কাছ থেকে পিস্তল ছুঁড়েছিলো কেউ।

করিডোরে হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে গাই নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিলো। ওই অবস্থাতেই ক্রিস্টোফারের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। ওর কলমের মাথা চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় কালি জমতে লাগলো নিচের খাতার উপর।

“তুমি কি…?” নিজে নিজে বিড়বিড় করলো গাই।

তারপরই সামলে নিলো নিজেকে। চোয়াল বন্ধ হয়ে চেহারা আবার শক্ত হয়ে গেলো। শীতল একটা হাসি হাসলো ও।

“উড়নচণ্ডী ছেলেটা বাড়ি ফিরেছে দেখি। হাহ! তোমার মা অন্তত এখন খুশি হবে।”

ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালো।

“তো?” ধমকের সুরে বললো গাই। “কি মনে করে এসেছো আবার? এখন কি তোমার নামে মেজবান দেবো নাকি?”

“ওসব লাগবে না। আমার নিজেরই অনেক টাকা আছে।”

ক্রিস্টোফার নিজের মুঠি খুলে একগাদা উজ্জ্বল ঝকমকে হীরে দেখালো। গাই ওটার দিকে এক নজর দেখে নাক সিটকালো।

“এসব পাথরের টুকরো দেখেই পটে যাবো ভেবেছো? তুমি হয়েছে। বড়লোক? ধন সম্পদ কি সেটাই তো বোঝো না।”

“রুথকে বিয়ে করার মতো টাকা পয়সা হয়েছে আমার।”

“কে?”

“রুথ। কর্পোরাল রেড্ডির মেয়ে।”

এরপরেও গাই-এর এক মুহূর্ত লাগলো বুঝতে। তারপর মাথাটা পিছনে হেলিয়ে এতো জোরে হো হো করে হেসে উঠলো যে জানালার পর্দাগুলো পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। “রুথ রেডিড? এতোদিন পরেও তুমি ঐ মাগীটাকে মনে রেখেছো?”

“আমি ওকে বিয়ে করবো।”

“আমার তা মনে হয় না।”

ক্রিস্টোফার হাতের ভিতর লুডুর ঘুটির মতো করে হীরাগুলো নাড়তে লাগলো। আমি এখন একজন ধনী লোক। আমাকে তুমি আটকাতে পারবে না।”

“আমি তোমাকে আটকাতেও চাই না,” খুশি উপচে পড়ছে গাই-এর চেহারায়। “তোমার বিয়েতে আমার দোয়া রইলো। কিন্তু সমস্যা একটাই-” বলতে বলতে আবার হাসিতে ভেঙে পড়লো ও। “তোমার পেয়ারি বিয়ে করে ফেলেছে।”

ক্রিস্টোফারের মনে হলো ওর পায়ের নিচে যেনো মাটি নেই। “কি?”

“তুমি যাওয়ার পরপরই ও বিয়ে করে ফেলে। জাহাজঘাটের এক কুলিকে। একটা বাচ্চাও আছে এখন। আমার বিশ্বাস সুখে শান্তিতেই আছে ওরা। যদিও…” বলে ও ক্রিস্টোফারের হাতের হীরা গুলির দিকে ইংগিত করলো। “এখন যদি এগুলো দেখে তাহলে এতো তাড়াহুড়ার জন্যে আফসোস করবে নিশ্চিত।”

ক্রিস্টোফার অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা মিথ্যা নিশ্চিত। গাই নিশ্চয়ই ওকে কষ্ট দিতে বানিয়ে বানিয়ে মজা করছে। রুথ কখনোই ওর সাথে ধোকাবাজি করবে না।

কিন্তু গাই-এর আনন্দ একদম খাঁটি। ক্রিস্টোফার ওর বাবার চোখের দিকে তাকালো। তাকিয়েই বুঝলো সে সত্যিটাই বলছে। আবারও জিতে গেলো গাই।

রাগে চোটে ও হীরাগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। মেঝেতে লাফিয়ে ঘরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো ওগুলো। লাফানো থামার আগেই ক্রিস্টোফার দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু ভাবতে পারছে না আর। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন, ও গাইকে এক হাত নেবে, কিন্তু আবারও নিজের বাবার কাছে পরাজিত হলো।

“দাঁড়াও।”

ক্রিস্টোফার যতো বড়ই হোক, ঠিক সেই ছোট বেলার মতো করেই গাই এর আদেশ ওর মগজের অভ্যন্তরে ভীতির সৃষ্টি করলো। দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথেই। ক্রিস্টোফার ঘুরলো। গাই ওর চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলো ওর দিকে। এক হাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দুজন এখন। দুজনেরই নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। যেনো মুখোমুখি দুই মুষ্টিযোদ্ধা।

“আমি জানি মেয়েটাকে খুব পছন্দ করতে তুমি,” গাই বললো। এক মুহূর্তের জন্যে গাইকে খুব অমায়িক একজন লোক মনে হলো। “কিন্তু ওকে আর আমাদের মাঝে আসতে দিও না। তুমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিজে বুনো ওল লাগিয়ে খেতে চেয়েছ, তা করতে গিয়ে আঘাত প্রত্যাঘাতও পেয়েছে ভালোই। এখন নিজের পরিবারের, নিজের জায়গায় ফিরে এসো।”

“আমি এখানে তোমার নীল কোট পরা চাকর হতে ফিরে আসিনি। আমি ওর চেয়ে অনেক ভালো কিছু পারি।”

গাই ওর আপাদমস্তক দেখল একবার। ওর ভিতর নতুন কিছু একটা আছে, যা আগে ছিলো না। কঠোর আর ভয়ঙ্করে মেশানো জিনিসটা।

“সেটাই মনে হচ্ছে,” ধূর্ত কণ্ঠে বললো গাই। “আমি তোমাকে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ দেবো। খবর পেয়েছি যে মাদ্রাজের গভর্নর নাকি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য না-সে নাকি আমাদের চিরশত্রু একজনকে সাহায্য করেছে। তুমিই ওর জায়গা নিতে পারো।”

ক্রিস্টোফার ঢোক গিললো। কোম্পানির তিনটা বিশাল প্রদেশের একটার গভর্নর হওয়াটা ওর বয়সী একজনের জন্যে অভূতপূর্ব এক সম্মানের বিষয়। আর গাই-এর দিক থেকে ওর উপর ভরসা করার পক্ষে বিশাল একটা প্রমাণ। যদিও জানে যে এর ফলে ও সারা জীবনের জন্যে গাই-এর কাছে বাধা থাকবে। আর সারাজীবন ও এটাই এড়াতে চেয়েছে।

“তোমার উপর কি আমি ভরসা করতে পারি?” গাই জানতে চাইলো।

প্রশ্নটা ঝুলে রইলো ওদের মাঝে। ক্রিস্টোফার গাই-এর চোখের দিকে তাকালো। কি বলা যায় ভাবছে : আমি জানি কেনো তুমি আমার সাথে এমন করতে। আমি জানি কেনো তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারোনি। তোমার ভাই তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছে সেটার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই, ওর জামার ডান হাতার নিচে ওর কাটা হাতটা কেঁপে উঠলো।

গাই তখনও উত্তরের অপেক্ষায় আছে। ওর আঙুলগুলো কোটের বোতামে খেলে বেড়াচ্ছে; গাই গাল ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে বাতাস বের করে দিলো। ক্রিস্টোফার বুঝলো গাই দুশ্চিন্তার মাঝে আছে। ক্রিস্টোফার কি করে না করে তা নিয়ে আসলেই সে দুশ্চিন্তা করে।

ক্রিস্টোফারের চোখে পানি চলে এলো। ও মুখ ঘুরিয়ে নিলো যাতে গাই দেখতে না পায়। গাই ভাবলো ও বুঝি চলে যেতে চাচ্ছে। ও হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টোফারের জামার হাতা টেনে ধরলো। আচমকা টানে ক্রিস্টোফার থমকে দাঁড়ালো। আর গাই এসে পড়লো ওর উপরে।

ক্রিস্টোফার সোজা হয়ে দাঁড়ালো আবার। বাবা আর ছেলে মুখোমুখি দাঁড়ানো। নীল আর বাদামি চোখ জোড়ার মাঝে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব।

“তোমার উপর ভরসা করতে পারি তো?” গাই আবার বললো।

ক্রিস্টোফার অনেক কিছু বলতে পারতো, অনেকগুলো জবাব ওর জানা ছিলো, কিন্তু সেগুলোর কি আসলে কোনো দাম আছে?

“জ্বী, বাবা,” বললো ও।

*

ক্রিস্টোফার গাই-এর অফিস থেকে এমন হতবুদ্ধি অবস্থায় বেরিয়ে এলো যে বসার ঘরে বসে থাকা মেয়েটাকে-বা মেয়েটা ওর দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কোনোটাই খেয়াল হলো না। মেয়েটা নিজের পোশাকের বুকের দিকটা একটু নামিয়ে নিয়ে, গদি আটা চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর দিকে এগিয়ে এলো।

“মিস্টার কোর্টনী?” ডাক দিলো মেয়েটা।

ক্রিস্টোফার অবাক হয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। একটা যুবতী মেয়ে। ধারালো চেহারা, পূর্ণ স্তন ওর জামা ফুড়ে যেনো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। প্রথমে ওর চেহারার দিকে ঠিকমতো নজর যায়নি ক্রিস্টোফারের। মাথার টুপির নিচে পরিপাটি করে চুলগুলো আচড়ানো তার, লম্বা হাতার জামা পরার কারণে শেকলের দাগ-ও আর দেখা যাচ্ছে না। টিরাকোলার সেই বেহায়া প্রেমিকার সাথে এখন ওকে মেলানো প্রায় অসম্ভব।

তারপরেই প্রবল আতংকে ক্রিস্টোফার মেয়েটাকে চিনতে পারলো। আজ বিকেলেই দ্বিতীয়বারের মতো ওরা পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। মেয়েটা ওর সব গোপন খবর জানে। ও যদি ওর বাবাকে বলে দেয়, তাহলে গাই-এর অফিসে এতোক্ষণ যতো অগ্রগতি হয়েছে সবগুলো দরজা আবার বন্ধ হয়ে যাবে। আর সবচে বড় কথা আংরিয়াকে সহায়তার দায়ে কোম্পানি ওকে ফাঁসিতেও ঝুলাতে পারে।

“আমরা কি পরিচিত?” নরম সুরে বললো ও।

মেয়েটা ওর কাছে ঘেষে এলো। “আমার মনে হয় না আমাদের দেখা হয়েছে, বা হলেও এতে আগে যা আপনার মনে থাকার কথা না। আমার নাম লিডিয়া ফয়।”

ক্রিস্টোফার কিছু বললো না সাথে সাথে! সম্ভবত মেয়েটা ওর নীরবতা বিক্রি করতে ইচ্ছুক।

“খবর পেলাম আপনি নাকি আপনার বাবার কাছে ফিরে এসেছেন,” বললো লিডিয়া। “আমি জানি আপনাদের পুনর্মিলনে এখানকার সবাই খুব খুশি হবে।”

ক্রিস্টোফার সতর্ক চোখে ওকে দেখতে লাগলো। চায় কি মেয়েটা? ও নিজের কোট এ হাত দিলো, ভিতরের ছুরিটার স্পর্শ পেলো হাতে।

“আমার মনে হয়, আর একটু নিরিবিলি কোথাও আলাপ করলে ভালো হবে,” ক্রিস্টোফার বললো।

“না না, তার দরকার হবে না,” লিডিয়া বললো। “আমাদের গোপন কিছুই বলার নেই। আমরা হচ্ছি দায়িত্ববান দুজন ইংরেজ, তাই না?”

এতো নিষ্পাপ ভঙ্গিতে কথা বলছে লিডিয়া যে ক্রিস্টোফার মুগ্ধ হয়ে . গেলো। যেনো ওরা আসলেই কেউ কাউকে চেনে না, দেখেও নি আগে। কি খেলা খেলছে এ?

“শুনেছিলাম আপনাকে নাকি দস্যুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো?” সাবধানে জিজ্ঞেস করলো ক্রিস্টোফার।

“এখন মুক্ত আমি।”

“নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে!”

লিডিয়ার চেহারা কালো হয়ে গেলো। “ভয়ংকর। যদিও…” বলে ও ইঙ্গিতময় একটা হাসি হাসলো। “একদম যে একঘেয়ে ছিলো তা বলবো না। তবে আমি নিশ্চিত যে আপনিও স্বীকার করবেন যে আমাদের আসলে অতীত আঁকড়ে ধরে থাকা উচিত না। বিশেষ করে ভবিষ্যতে যখন অপার সম্ভাবনার দুয়ার খোলা আছে।”

ওদের চোখাচোখি হলো-আর চোখে চোখেই বোঝাঁপড়াটা হয়ে গেলো দুজনের। লিডিয়া সামনে এগিয়ে ক্রিস্টোফারের গাল স্পর্শ করলো।

“আশা করি শিগগিরিই আমরা আরো বেশি পরিচিত হতে পারবো।”

*

ওখান থেকে প্রায় একশো মাইল দক্ষিণে টম ওর নতুন জাহজের সামনের ডেক-এ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে জাহাজের দড়াদড়ি। জাহাজটা আংরিয়ার বহরে ছিলো। ফ্রান্সিসের হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছে সে রাতে। শাহুজি ওটা টমকে দিয়ে দিয়েছেন, সাথে কয়েকজন জেলে আর মারাঠা স্বেচ্ছাসেবীও দিয়েছেন। আর কেস্ট্রেল-এর সর্বশেষ বেঁচে থাকা কু-রা তো আছেই। মেরিডিউকে পাল এর মাস্টার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদটা পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট ও।

“ওগুলো আমাদেরকে একটানে কেপ টাউনে নিয়ে যাবে,” মেরিডিউ বললো। “বা এরপরে যেখানেই যেতে চান, সেখানেই।”

উপসাগরের উপরে দুর্গে এখন শাহুজির পতাকা উড়ছে। পাশ দিয়ে যেসব জাহাজ যাচ্ছে তারা সবাই তার বিজয়ের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে। দুর্গে লুকানো সমস্ত গুপ্তধন খুঁজে বের করতে শাহুজির লোকদের প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে গেলো। এখনো ওগুলোর অনেকগুলো সাতারার মহলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বক্সে ভরা হচ্ছে। টমের জাহাজের খোলের ভিতরেও বেশ ভালো একটা পরিমাণ আছে। শাহুজি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দিয়েছেন সেসব।

“শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এবারের অভিযানে লাভ-ই হলো, চাচা,” ফ্রান্সিস বললো। অ্যানার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও।

“লাভের চাইতেও বেশি,” টম জবাব দিলো। সারাহের কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললো ও। জীবনে এর আগে এতোটা গর্ব আর ভালোবাসা অনুভব করেনি টম। “আমরা যা পেয়েছি, তা… অমূল্য।”

“আপনি কি থাকবেন-ই না?” ফ্রান্সিস বললো।

অ্যানা আর ফ্রান্সিস ভারতে থেকে যাবে ঠিক করেছে। অ্যানার বাবার ব্যবসা আর কুঠিগুলো আবার নতুন করে শুরু করবে। ঠিক করেছে কোচিনে বাড়ি বানাবে ওরা, ওটা হচ্ছে ওলন্দাজ উপনিবেশ। ওখানে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নাক গলাতে পারবে না। মোহিত যাবে ওদের সাথে।

“আমাদের জন্যে ভালো ভালো মাল জোগাড় করে রেখো,” টম বললো। “ধাগামী বর্ষার পরেই আসবো আমরা।”

“দস্যুদের কাছ থেকে বেঁচে বর্তে থাকতে পারলে হয়।”

ওটা আসলেই মারাত্মক ঝুঁকির। কিভাবে যেনো আংরিয়া টিরাকোলা থেকে পালিয়ে গিয়েছে। ওর আরো কয়েকটা দুর্গ আর আরো অনেকগুলো জাহাজ আছে; কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থেকে ও যে আবার মালাবার উপকূলে দস্যুগিরি করতে নামবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে আপাতত টম আশা করলো ও ডাঙাতেই লুকিয়ে থাকবে।

“লাকুইডিভা দ্বীপে যাবেন নাকি?” অ্যানা জিজ্ঞেস করলো। নাদুস নুদুস গাল আর উজ্জ্বল চোখে ওকে দেখতে বেশ লাগছে। “ও ওর জামার কোমর বড় করছে,” দুই রাত আগে সারাহ টমকে চুপিচুপি বলেছে। “আমার মনে হয় আমরা যখন ফিরে আসবো তখন জেমস একজন খেলার সাথী পেয়ে যাবে।” টমের মনে হলো ও এখনি অ্যানার পেটের ফোলা অবস্থাটা টের পাচ্ছে।

“দেরি হয়ে যাবে,” টম বললো। “আমাদের আরো প্রায় এক বছর আগে ফেরার কথা ছিলো। ডোরিয়ান আমাদের জন্যে অপেক্ষা করেনি নিশ্চিত। কেপ টাউনে গিয়েই ওকে খুঁজে পাবো আশা করি।”

“ঈশ্বর সহায় হোক চাচা,” ফ্রান্সিস বললো। “আর আমার জন্যে যা যা করেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।”

টম ওর চুল এলোমেলো করে দিলো। “একজন কোর্টনী নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে নেয়।”

ওরা সবাই কোলাকুলি করে বিদায় নিলো। তারপর আবার কোলাকুলি করলো। একটা নৌকায় করে ডাঙ্গায় ফিরে গেলো ফ্রান্সিস আর অ্যানা। আর গ্রাবটা নোঙর তুলে সাগরের দিকে আগাতে লাগলো। টম সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই নতুন আসা লোকগুলো পাল তুলতে দৌড়ে গেলো। কয়েকদিনের মাঝেই ওরা দক্ষ নাবিকে পরিণত হবে।

সারাহ ওরা পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাতের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিলো।

“আমি জানি তুমি কি ভাবছো, টম কোর্টিনী।”

“কি?”

“ভাবছো এই জাহাজ আর এদের লোকজনকে কোথায় নিয়ে যাবে, আর একবার বাড়ি ফেরার পর কি কি মুনাফা-ই বা তুমি করতে পারবে।”

টম মাথা নাড়লো। “মালপত্র সব বিক্রি করে-সব দেনা শোধ করার পরেও হাতে ভালোই টাকা পয়সা থেকে যাবে। আমি ভাবছি কেপ টাউনে একটা জায়গা কিনে সেখানে আমাদের জন্যে একটা বাড়ি বানাবো।”

“ডাঙায় থাকা তোমার কাজ না,” সারাহ বললো। “কয়েক মাস পরেই আবার সাগরের ডাক শুনতে পাবে।”

টব বাচ্চাটার কথা ভাবলো, এখন ওদের কেবিনে একটা খাটে ঘুমিয়ে আছে, তার পাশেই নেপচুন তরবারিটা ঝোলানো। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এবার ব্যাপার স্যাপার একটু অন্যরকম হবে।”

সারাহ হেসে টমের বুকে মাথা ঠেকালো। হাতে হাত রেখে রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। পরিপূর্ণ তৃপ্ত দুজনেই। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়লো। জাহাজ সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, আর ওদের পিছনে মালাবার উপকূল আর ভারত উপমহাদেশ ধীরে ধীরে অন্ধকারের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস আগে জাহাজডুবি হয়ে ডাঙায় ওঠার পর থেকে ওদের জীবনে কি কি হয়েছে সেসব ভাবতে লাগলো টম।

“ভাবছি আমাদের মতো ডোরিয়ানের অভিযানও কি এতো রোমাঞ্চকর হয়েছে কিনা,” টমের কণ্ঠে মজাং।

সারাহ ওর গালে চুমু খেলো। “ওদেরটাও কম মজার হয়নি, দেখো।”

Exit mobile version